অ সামাজিক পর্ব-০১

0
655

গল্প- “অ সামাজিক”
পর্ব- ১

সকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। জুলাই মাস চলছে এখন। এ বছর তুলনামূলক বৃষ্টিপাত কম হলেও আজ বৃষ্টি নামাতে কোনো কৃ প ণ তা নেই। যেদিন জরুরি কাজ থাকবে, সেদিন একটা ব্যা গড়া বাঁ ধা চাই ই চাই। হয় বৃষ্টি নামবে, নয়তো ভ্যাঁ প সা গরম থাকবে, রাস্তায় বের হলে গাড়ি পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। দুপুরে একটা বিয়ের নেমন্তন্ন আছে, না গেলেই নয়, এদিকে বৃষ্টি ঝরার নামগন্ধ নেই।

পাশের রুমে প্রেমা গান শুনছে, ‘আজি ঝরোঝরো মুখর বাদল দিনে।’ এসব গানের আবেদন কখনোই ফুরোয় না। বিশেষ করে বর্ষা ঋতুতে বা বৃষ্টির দিনে গানগুলো যেন আরো আরো বেশি প্রাণ ফিরে পায়। প্রেমার রুমের দরজা বন্ধ। সায়লা, প্রেমার মা, তিনি ক ড়া নাড়লেন দরজায়। বৃষ্টির শব্দে আর গানের অনুরণনে কিছুটা অন্যমনস্ক থাকার কারণে প্রথমে প্রেমা শুনতে পেলো না। দরজায় আবার ক ড়া পড়লো। প্রেমা বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। সায়লা প্রেমাকে বললো- এখনো দরজা লাগিয়ে গান শুনছিস, দুপুরবেলা যে বিয়ের দাওয়াত আছে ভুলে গেলি?

প্রেমা বললো, না ভুলবো কেন, মনে আছে, আর আমি ভুলে গেলেই’বা কী, আমি তো আর যাচ্ছি না বিয়েতে, তোমরা গেলে যাও।

সায়লা বললো, অনেকদিন ধরেই তুই কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করিস না, এভাবে সব আনন্দ থেকে নিজেকে গু টিয়ে রাখিস কেন শুনি?

প্রেমা বললো, আরে তেমন কিছু না, এমনিতেই যেতে ভালোলাগে না, আর তোমরা যার বিয়েতে যাচ্ছো, তাদের পরিবারের সাথে তোমার আর বাবার ভালো সম্পর্ক থাকলেও আমি তো তেমনভাবে চিনি না তাদের, গিয়ে কি মজা পাবো নাকি, আর তাছাড়া এত বৃষ্টির ভেতর যেতেও ইচ্ছে করছে না, তোমরাই’বা কীভাবে যাবে?

আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি বৃষ্টি কমে কিনা, তোর খলিল কাকা কে ফোনে জানিয়ে রেখেছি, সে অটো নিয়ে আসবে একটু পর, সেই অটোতেই যাবো।

প্রেমা বললো, ঠিক আছে তোমরা যাও তাহলে, এবারের মতো আমাকে ছে ড়ে দাও, পরে কখনো যাবো।

সায়লা ছোট্ট একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, এরপরেও কখনো তুই যাবি না আমি জানি, এটাও জানি কেন যাবি না, তবু তোকে বারবার বলি এভাবে ঘরকুনো হয়ে থাকিস, দেখতে ভালোলাগে না তাই। যাই হোক থাক তাহলে।

সায়লা চলে যায়, প্রেমা আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। মায়ের কাছে মুখ ফুটে না বললেও মায়েরা অনেককিছুই টের পায়, এটা তাদের এক আশ্চর্য ক্ষমতা!

বৃষ্টি কিছুটা কমার পর তারা বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বিয়ে বাড়ির দূরত্ব তাদের বাড়ি থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার। পৌঁছে দেখে এখনো বৈঠক শুরু হয়নি। কেননা, এত বৃষ্টির ভেতর বেশিরভাগ অতিথিই এসে পৌঁছাতে পারেনি, আর তাছাড়া বৃষ্টি কাদার ভেতর খেতে বসাটাও এক ঝ ক্কি র ব্যপার। বৃষ্টি ঝরে এলে আস্তে আস্তে পরিচিত অনেকেই আসতে লাগলো। প্রেমার বাবা-মা তাদের সাথে কুশল বিনিময় করছে, গল্প করছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, আপনাদের ছেলে-মেয়েরা আসেনি কেন? প্রেমার কি বিয়ে হয়েছে, সে কি করে এখন, এত বয়স হয়ে গেছে তবু কেন বিয়ে হয়নি ইত্যাদি নানান প্রশ্ন।

প্রেমার বয়স এখন বত্রিশ, একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। বিয়ে কেন হয়নি, তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। প্রেমা তো রূপে, গুণে ফেলে দেবার মতো মেয়ে নয়। আসলে, সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যে যেদিন বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করে রেখেছেন, সেদিনই বিয়ে হবে। কথায় বলে না, ‘জন্ম-মৃ ত্যু-বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।’ কিন্তু তারপরও ধর্মবিশ্বাসী বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী মানুষগুলো এসব প্রশ্ন করে বারবার বি র ক্ত করে, বি ব্র ত করে। আর এজন্যই প্রেমা এখন আর কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান বা আত্মীয় স্বজনদের কোনো ধরণের সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। এসব প্রশ্নগুলো তাকে অ স্বস্তিতে ফেলে খুব।

নিহাল, প্রেমার একমাত্র ছোট ভাই, ঢাকাতে বিসিএস দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। একসময় সে গ্রামে চলে আসে। নিহালের বাবা-মা জিজ্ঞেস করে, ঢাকা ছেড়ে এভাবে হুট করে চলে এলে কেন সমস্ত মালপত্র সমেত? নিহাল তাদের বুঝিয়ে বলে, বিসিএস এর জন্য তার কোচিং করা শেষ। পর্যাপ্ত বই, গাইড আর শিটও সে সংগ্রহ করে ফেলেছে। এখন বাসায় বসে পড়লেই হবে, ঢাকায় থেকে অযথা প্রতি মাসে অনেক খরচ, আর তাছাড়া বিসিএস এর প্রিপারেশন নেবার জন্য ঢাকায় থাকাটা বাধ্যতামূলক নয়, গ্রামে থেকেও প্রস্তুতি নেয়া যায় ভালোভাবে। এসব শুনে নিহালের বাবা-মাও আর কিছু বলে না। নিহালের পড়াশুনা শেষ হয়েছে আরো বছর দুয়েক আগে। তারপর সে পার্ট টাইম চাকুরি করেছে বটে, তবে তাতে বিসিএস এর প্রস্তুতি ঠিকমতো নেয়া যাচ্ছিলো না, অন্তত নিহালের মনে হতো সে পারছে না। একসময় সে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বিসিএস এর প্রতিই পূর্ণ মনোযোগ দেয়। গ্রামে চলে আসার পরেও সে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে। আশপাশের মানুষের সাথেও তেমন একটা মেশে না, আড্ডা দেয় না, শুধু চৌরাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটায় বিকেলে চা খেতে যায়। নিহালের বাবা-মা খেয়াল করে দেখে, আজকাল সে চা খেতেও বের হচ্ছে না। যখন দরকার হয়, পড়তে পড়তে মাথাটা ধ রে যায়, নিজেই গ্যাসের চুলায় চা বানিয়ে খায়।

নিহালের বাবা আসাদ প্রামাণিক, অবসরে আছেন এখন, আগে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শুক্রবার, ঐ এলাকায় হাটবার। হাটে যাবার পর নিহালের বাবাকে দেখে একজন জিজ্ঞেস করে, নিহাল এতদিন ধরে গ্রামে এসে পড়ে আছে কেন, সে এখনো কেন কোনো চাকুরি করছে না, কিছুদিন ধরে তাকে চৌরাস্তার মোড়েও আসতে দেখা যায় না, ছেলে মানুষ এত ঘরকুনো হলে কি চলে ইত্যাদি। বাসায় ফিরে সে নিহালকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে ঘর থেকে বের হয় না আজকাল, কেন চা খেতে যায় না বাইরে। নিহাল হঠাৎ এসব প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে বাবা? তখন আসাদ সাহেব সবকিছু খুলে বলে। নিহাল সব শুনে বলে, ঠিক এ কারণেই আর চা খেতে যাই না বাবা। আসাদ সাহেব ভ্রু কুঁ চ কে বলে, মানে? নিহাল বলে, সারাদিন ঘরে থেকে পড়াশুনা করে একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য চা খেতে বাইরে যাই। কিন্তু রোজ ওখানে গ্রামের মুরুব্বি গোছের লোকেরা কেউ না কেউ আমাকে এসব প্রশ্ন করে, তারপর কয়েকজন মিলে এসব নিয়ে যার যার মনমতো মন্তব্য করতে থাকে, এতে আমি খুবই বি র ক্ত আর বি ব্র ত হই, রিফ্রেশমেন্ট করতে গিয়ে উল্টো মেজাজ আরো বি গড়ে যায়, তাই আর যাই না ওখানে। নিহালের বাবা বুঝতে পেরে ছেলের কাঁধে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে তার সামনে থেকে চলে যায়।

নিহাল ওর ঘরে বসে পড়ছিলো মন দিয়ে। হঠাৎ প্রেমা আসে। বলে, একটু বি র ক্ত করতে এলাম। নিহাল হেসে বলে, ফর্মালিটি করিস নাতো, স্কুল থেকে কখন এলি?

এইতো ফিরলাম, ফ্রেশ হয়ে, খাওয়াদাওয়া করেই তোর ঘরে এলাম। তুই নাকি খাসনি এখনো, বিকেল হয়ে গেছে তো, দুপুরের খাবার কি রাতে খাবি নাকি?

নিহাল প্রেমার কথা শুনে ম্লান হাসে।
প্রেমা বলে, আমার চোখের দিকে তাকা তো।
নিহাল মজার ছলে তাকায়।

প্রেমা জিজ্ঞেস করে, তুই ঠিক আছিস তো ভাই? আচ্ছা একটা সত্যি কথা বল তো, ঢাকা থেকে তুই কেন চলে এলি?

নিহাল বলে, কেন আবার, জানিসই তো, এত টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না, আর ঢাকায় থাকলে খাবারদাবারেও স ম স্যা হয়, এখন বাড়ি থেকে মায়ের হাতের রান্না খাই, আবার বাসা ভাড়াটাও দিতে হয় না।

তোর প্রেমিকার খবর কিরে, কি যেন নাম, নুসরাত বোধয়, ওর কথা যে অনেকদিন ধরে বলিস না, আমারও জিজ্ঞেস করা হয় না। ও এখন কেমন আছে, কই আছে?

কোথায় আছে জানি না, ভালোই আছে হয়তো।

হয়তো মানে কি, তুই জানিস না? তোদের কি যোগাযোগ হয় না এখন? মান-অভি মানের পালা চলছে নাকি সম্পর্কটাই চু কে বুকে গেছে?

নিহাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সে এখন অন্য কারো বাসার ছাদে কাপড় শুকোয়, ওর শোবার ঘর, রান্নাঘর সব বদলে গেছে, বদলে গেছে ওর ঠিকানা, হয়ত জীবনও বদলেছে অনেকখানি!

প্রেমা এসব শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, তারমানে নুসরাতের বিয়ে হয়ে গেছে?

নিহাল সংক্ষেপে বলে, হু।

নিহালের কথা ভেবে প্রেমার একটু মন খা রা প হয়। বলে, এজন্যই তুই ঢাকা ছেড়ে চলে এলি, এজন্যই তুই বিসিএস এর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস?

নিহাল বলে, কিছুটা হয়ত তাই, তবে অনেকখানিই জীবনের তাগিদে। নুসরাতের কোনো দো ষ নেই, ভাগ্যে যার সাথে লেখা ছিলো, তার সাথেই বিয়ে হয়েছে, ওর স্বামী সরকারি বড় কর্মকর্তা, আমি তো এখনো বে কার।

প্রেমা বললো, ও এত সহজে তোকে ছে ড়ে চলে গেলো? তুই নাহয় এখনো ভালো কোনো চাকুরিতে জয়েন করতে পারিসনি, কিন্তু তোর তো পার্ট টাইম চাকুরি ছিলো, নুসরাত নিজেও ছোটখাটো কোনো চাকুরি যোগাড় করতে পারতো, তারপর দুজন মিলে একসাথে সংসার করতি, একদিন তো দিন বদলাতো, সারাজীবন তো আর কষ্ট করে কাটাতে হতো না।

নিহাল বলে, নুসরাতকে ভু ল বুঝিস না। ঐ যে বললাম ভাগ্য, ওর ভাগ্যে যে লেখা ছিলো, তার সাথেই সংসার বেঁ ধে ছে, আমাদের কীইবা করার ছিলো।

প্রেমা বললো, তোর খুব কষ্ট হয় ওর জন্য তাই না?

নিহাল বললো, অ স্বীকার করলে সেটা নাটকীয় শোনাবে।

প্রেমা আর কথা বাড়ালো না। আচ্ছা আসি বলে উঠে চলে গেলো।

চলবে।