আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৪.
বিশাল বারিধারায় মত্তো পুরো চিটাগাং শহর।বয়ে চলেছে শৈত্যপ্রবাহ।কুচকুচে ঘন কালো আকাশ আর থেকে থেকে মৃদু বাতাস পরিবেশকে শিহরিত করে তুলেছে।মাঝে মধ্যে দু’একটা নেড়ি কুকুরের কান্নার শব্দ ও পাওয়া যায়।অনুভূতি শীতলময়।ঘরে আছে শুধু কুহেলী,নয়না আর সেযুঁতি।ওরা দু’জন পড়ছে।কুহেলীর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে আনরুবার অবস্থা দেখে।উপশিরায় পর্যন্ত ছুটে চলে আতংকের ছটাক।শীতের মাঝে ঘামছে শরীর।হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য পড়ে মুহূর্তেই।তবে এখন ঘাবড়ে গেলে চলবে না।জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে শুধু নিজের অনুভূতিকে পাত্তা দিতে হয়না।কুহেলী দৌড়ে নয়নার ঘরের দিকে আসতে গিয়ে আছড়ে পড়লো সিড়িতে।শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠছে।ওঠে দাঁড়িয়ে আবার দৌড়ে শুরু করে।ঠোঁট হালকা কেটে বের হয়ে এলো টাটকা রক্ত।নয়না আর সেযুঁতির পড়া শেষ হয়েছে মাত্র।তাদের স্যার জীতু দরজার দিকেই আসছিল।হঠাৎই কুহেলীকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে ঘাবড়ে ওঠে সে।অপ্রস্তুত ভঙ্গীমায় কুহেলীর দিকে তাকিয়ে বেশ চমকে যায় জীতু।পরমা সুন্দরীর নারীর মুখখানিতে ঘন বিষন্নতা।কপাল আর কাধের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।ধবধবে সাদা কপাল ঘেমে একাকার হয়ে মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে।কুহেলী ভেবেছিল স্যার হয়ত চলে গিয়েছেন।জীতুর সামনে এভাবে পড়ে দ্রুত উড়না ঠিক করে নিল কুহেলী।কিছু বলার আগেই নয়না দৌড়ে এসে কুহেলীকে ধরে বললো,
‘কুহু,বোন কি হয়েছে? এইভাবে ছুটে আসলা কেন?’
কুহেলী দম ছেড়ে কোন রকমে বলে,
‘আপু,আপু আন্টি কেমন যেন করছে।মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে।’ এক শ্বাসে বলে কুহেলী।
নয়নার হাত জোড়া ঠান্ডা হয়ে গেল কথাটা শোনা মাত্র।চিন্তিত হয়ে বললো,
‘কি বলছো তুমি!’
কুহেলী শুধু জোরে জোরে শ্বাস নেয়।কথা বলতে পারেনা।সেযুঁতি ভ্রুকুটি করে হাতের বই নিচে ফেলে ‘আম্মা’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে নিচে নেমে আসে।জীতু এম্বুল্যান্সে ফোন করে নিচে আসে তাদের পেছন পেছন।চল্লিশ মিনিটের মাথায় আনরুবাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় সবাই।সান্দ্রকে জীতু ফোন করে বলে দ্রুত হাসপাতালে চলে আসতে।জহির গিয়েছিলেন তাদের ক্ষেতে কাজ সারাবছর কাজ করা মানুষদের শীতের জামা কাপড় দিতে।তিনিও দ্রুত চলে আসেন হসপিটালে।সমারোহ পূর্বেই ছিল।ডাক্তার সীমা আনরুবারকে পূর্ব থেকেই দেখতেন।বলতে গেলে জহিরের বাড়ির ডাক্তার ছিলেন তিনি।তবে এখন বেশি একটা তার প্রয়োজন পড়ে না।সমারোহ আর সান্দ্র থাকতে আর ডাক্তারেরই বা কি প্রয়োজন।সমারোহ গতবছর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ইন্টার্নশীপ কমপ্লিট করে এই হসপিটালে হার্ট সার্জন হিসাবে জয়েন করেছে।আনরুবাকে যখন আনা হয়েছে সমারোহ তখন ওটিতে ছিল।ডা.সীমা হসপিটালে ডিউটিরত অবস্থায় থাকায় আনরুবার খবরটা বাতাসের বেগে পৌঁছে’ছে তার কাছে।সীমা নিজ দায়িত্বে আনরুবাকে দ্রুত ওটিতে নিয়ে গিয়ে সব ক্লিন করেন।প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশন দিয়ে মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে দেন।ওটি থেকে বের হয়ে সমারোহ আর নয়নার সাথে কথা বলেন আনরুবার খাওয়া দাওয়া নিয়ে।জানান খুব বেশি প্রবলেম হয়নি তবে হতে পারতো।
‘দুপুরে হয়ত ঠিক মতো খায়নি আনা তাই না?’
‘জি,না।আম্মা রোজা রেখে ছিলেন আজ।’
দ্রুত গতিতে বলে নয়না।সীমা মাথা হালকা ঝুঁকিয়ে জরুরি ভঙ্গীতে বলেন,
‘ইফতারে কি খেয়েছে?’
‘ফল।আপেল,আনারস আর আঙ্গুর সাথে পায়েস।’
‘তার বাদে বোধ হয় কোন কোমল পানীয় খেয়েছে!’
নয়না অভিজ্ঞ গলায় বলে,
‘ওটা তো আম্মার অভ্যাস।রোজ রোজ ভাইয়াকে দিয়ে আনাবে।আম্মার পছন্দ বলেই বাড়িতে থাকে যখন খুশি খায়।’
সীমা ফোঁশ করে শ্বাস ছাড়ে।চোখের চশমা খুলে বলেন,
‘বয়স হয়েছে তাও অভ্যাস বদলায় না।আর তোমরাই বা করতে দাও কেন এমন? পানীয়তে অ্যালকোহলের পরিমাণ বেশি ছিল বলে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।এরপর বাড়িতে নিয়ে গেলে একমাস শুধু সেদ্ধ খাবার খাওয়াবে কোন প্রকার মশলা ছাড়া।’
নয়না মাথা ঝুঁকে সম্মতি জানায়। সান্দ্র ডাব আর শুকনো খাবার কিনে এনেছে কুহেলীর জন্য।বেশ দূর্বল হয়ে গেছে ওর শরীরটা।নেতিয়ে পড়েছে একদম।কুহেলীর চোখের সামনে ভেসে ওঠছে শুধু সেই কালো রাতটা।ভয়াবহ আর্তনাদ।কতটা কেঁদেছিল সেই মেয়েটা!আনরুবার মতোই গোঙ্গাচ্ছিল।ভয়াবহ,তার চেয়েও বড় করুণ।কুহেলীর চোখ বেয়ে দু’এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।একবার ঝাঁকুণি দিয়ে ওঠে শরীর।সেঁযুতি কুহেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আরেক দফা কেঁপে ওঠে কুহেলী।তারপর আবার স্থির।সেঁযুতির স্পর্শ অনুভব করে।কোমল নরম হাত যেন ঘুম নিয়ে আসতে চাইছে তার দেহে।সেঁযুতি পরিপক্ক গলা মেলে বলে,
‘ভয় পেয়েছো না খুব আম্মার অবস্থায়?’
কুহেলী নিশ্চুপ থাকে।সেঁযুতি আবার বলে,
‘আমিও পেয়েছিলাম।তবে তোমার মতো অত না,এর আগেও তিনবার হয়েছিল এমন।আম্মা বড়ই অবুঝ হয়ে যায় মাঝে মধ্যে।নিজের খেয়াল রাখেনা।চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে।’
সেঁযুতি একটু থেমে আবার বলে,
‘কুহূ!’
‘হু।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর কুহেলীর।
‘তোমার কি জ্বর আসে?শরীর কপাল দেখি গরম হয়ে যাচ্ছে।’
‘আমার বমি পাচ্ছে।’
‘খুব বেশি খারাপ লাগছে?’
বেশ বেখেয়ালি ভাবে কুহেলী বলে,
‘হয়ত।আপু আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো আপু।ভয় লাগছে।’
সেযুঁতি ভ্রুকুটি করে অবাক হয়ে দেখে কুহেলীকে।মেয়েটা তখনো ঘামছে আর অনবরত কাঁপছে।সেযুঁতি হাতের বন্ধন আরো শক্ত করে।বলে,
‘ডাবের পানি খাবে একটু?খেলে ভালোলাগবে।’
‘উহুম।’
‘কিছুই তো খাওয়া হয়নি রাতে।অসুস্থ হয়ে পরেছো তুমি।একটু কিছু খেতেই হবে।’
নয়না আর সেযুঁতি মিলে ডাব আর পাস্তা খাইয়ে দেয়।
–
১৯৯৬ সালের মাঘের মাঝামাঝি সময়। ভোরের সূর্য তখনো মেঘের ভেলায় ভাসছে।কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে রেখেছে শিমুলপাড়ার আকাশটাকে। নয়াহূরী নদীর (কাল্পনিক নাম) ধার ধরে কৃষকেরা শীত উপেক্ষা করে মাঠে ছুটেছে কাজের তাড়ায়।শিমুলপাড়া জুড়ে শীতের বিশাল চাদর রুক্ষ করে রেখেছে বাতাস-প্রকৃতি।খোর্শেদ রজবকে খেঁজুর গাছে তুলেছেন টাটকা রস নামাতে।রজব খোর্শেদ বাড়ির খাস কাজের লোক।অনাথ রজবকে এক শীতের সকালেই ইস্কুলের মাটির বারান্দ থেকে তুলে এনেছিলেন খোর্শেদ।নিজের ছেলের মতোই ভাবে।রজব তাকে চাচা বলেই ডাকে।পড়া লেখা করাতে চাইলেও রজব করলো না।তার এক কথা,
‘চাচা আমরার গিলুতে এগুলা ঢুকতো না।আমরার পড়তে ইচ্ছা করে না।’
সেই নিয়ে কি কান্ড!খোর্শেদ কতোই না মেরেছিল রজবকে স্কুলে যেতে চায় না বলে।মাঝে মধ্যে ভয়ে একটু আধটু যেতো।কুহেলীর চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড় রজব। তারপরও একই ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলেন খোরশেদ।ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা হাসতো রজবকে নিয়ে।এতো বড় হয়েও ছোট ক্লাসে পড়ে।তা নিয়ে অবশ্য রজবের কোন ধারধারি না থাকলেও কুহেলী ভীষণ বিরক্ত হতো।পড়ার আবার বয়স আছে নাকি!তেই রজবকে কিছু বলতো, ঘটা করে কথা শুনিয়ে দিত কুহেলী।আবার কুহেলীকে কেউ বিরক্ত করলে রজব গিয়ে মেরে তক্তা বানিয়ে দিয়ে আসতো। রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরও দুই ভাই বোনের ভালোবাসা মুগ্ধ করে খোরশেদ আর হাসনাকে।সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু যখন রাতে লুডু তার তাস খেলা বাদ দিয়ে অংকের বইটা নিয়ে কুহেলীর কাছে যেতে হতো খোর্শেদের ভয়ে তখনই আর ভালোলাগতো না রজবের।তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো যে আর পড়বে না।যেমন ভাবনা তেমন কাজ। খোরশেদ আর হাজার মেরেও স্কুলে নিতে পারেনি রজবকে।সেই থেকেই রজবের শান্তি।
খোর্শেদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন রজবকে।রজব খেঁজুর রসের কলসি কোমরে ঝুলিয়ে নিচে নেমে বলে,
‘চাচা,পোত্তেক বার কুহ আপায় আমারে গাছে ওঠতে কইতো।আমি নামলেই ঝাপাইয়া পড়তো কলসির উপর।এইবারে আপা নাই।আমার ভাললাগতাছে না এক্কেরে।’
খোর্শেদ প্রসন্ন হাসেন।বুকটা যে তারও ছিঁড়ছে,জ্বলছে।যে মেয়ের ঘুমন্ত মুখ ভোরে না দেখলে তার দিন চলতো সেই মেয়ে কাছে নাই আজ কতোগুলো দিন!সত্যিই সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়।সময় বহমান।
বেলা সাড়ে দশটা।পুরো শিমুলপাড়া কাজে মুখরিত।খোর্শেদ আজ কুঞ্জাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে প্রথম ক্লাস করে চলে এসেছেন বাড়িতে।শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে।মাথাটা ঘুরাচ্ছে,হাটুর ব্যথাটাও বেড়েছে।
গ্রামের কয়েকটা ছেলেপুলে নিয়ে উঠানে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে আলু পোড়াচ্ছে রজব।কুঞ্জার পোড়া আলু পছন্দ।তার জন্যও রেখে দিচ্ছে।খোর্শেদ ঠান্ডা জলে গোসল করে এসে চেয়ার পেতে বসেছে আগুনের কাছে।হাসনাহেনা দৌড়ে এসে তেল মালিশ করে দেন খোর্শেদের শরীরে।তার সাথে বায়নাও করেন কুহেলীকে দেখবেন বলে।খোর্শেদ কিছু বলেন না।ঠায় বসে আগুন দেখেন।বাড়ির সদর দরজা দিয়ে তখন হায়দার বাড়ির জসীম হায়দার আর তার বড় ছেলে পলাশ হায়দার ঢুকে বাড়িতে।হায়দার বংশ এক সময় গ্রামে জমিদারি করতো।ছয় গ্রাম মিলে ছিল তাদের জমিদারি।কিন্তু জমীসের বাবা রতবরের আমলেই ওঠে যায় জমিদারি।সেই হিসাবে গ্রামে বেশ দাপট দেখিয়েই চলেন তারা।বিত্তশালী বলে কেউ তাদের বিরুদ্ধেও যেতে পারে না।সবাই মোটামুটি ভালোই জানে তাই বিরুদ্ধে যায় ও না তেমন।হাসনাহেনা মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে রান্নাঘরের আঁড়ালে গিয়ে তাদের কথা শুনার চেষ্টা করেন।খোর্শেদ তাদের দেখে ওঠে দাঁড়াতে নিলে জসীম হায়দার বলে ওঠেন,
‘আরে ভাই ওঠতে হইবো না। কেমন আছো কও?হুনলাম শরীরডা তোমার ভালা যায় না?’
খোরশেদ প্রসন্ন হেসে বলে,
‘এই আছি কোন রকম।তা কি দরকারে ভাই?’
জসীম উঠানের এক প্রান্তে একটা চেয়ার দেখতে পেয়ে রজবকে ইশারা করে আনতে।রজব না দেখার ভান ধরে আলু পোড়ানো শুরু করে। খোরশেদ তুষ্ট হন না। রজবকে বলেন,
‘ বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ দেখলে চেয়ার আগায় দিতে হয় জানোস না? যাহ দুইটা চেয়ার নিয়া আয়।’
‘না, না একটাতেই হইবো। ওইখান আনো দেহি বাপ।’ জসীম বলেন।
রজব বিরক্তিকর চেহারা করে গিয়ে চেয়ার আনে। জসীম বসতে বসতে বলেন,
‘ক্যান!কাজ ছাড়া কি আইতে পারি না তোমার বাড়ি?দুই দন্ড কথা কইতে।’
‘তা পাড়েন। আপনি ব্যস্ত মানুষ গল্প করার সময় কই?’
‘তা ঠিক।তবে দরকারেই আইছি। মানুষের মন দেহি ভালোই বুঝো?’
খোরশেদ মৃদু হাঁসি ভান করে।বলে,’কি দরকার বলেন।ভনিতা করার কি দরকার।’
খোরশেদের কথা শুনে পিত্তি শুদ্ধ জ্বলে ওঠে জসীমের।পলাশের কপাল কুঁচকে আসে।কিছু বলতে গিয়েও জসীমের ইশারায় কিছু বলে না। জসীম দাঁত কেলিয়ে হেসে বলেন,
‘আসল কথাই কি।আমি তো তোমারে আগেই কইছিলাম তোমার মাইয়া কুহেলীর মতোন আরেকটা সুন্দরী এই গেরামে ক্যান,পাশে দশ গেরামেও নাই।তোমার মাইয়্যাল লগে আমার ছুডু পোলা প্রিতুসের বিয়ে দিমু।এরপরো হে আমাগোর চোখের আড়াল হইয়া শহরে গেল কেমনে?’
‘আমার মেয়েরে বিয়া দিব না তোমার ছেলের কাছে এটা আমি আগেও বলছি।আর… ‘
খোর্শেদ আরো কিছু বলতে চাইলেও জসীম হায়দার তাকে থামিয়ে দিয়ে তার কাধে দুই হাত রেখে বলেন,
‘আইচ্চা,গেছে ভালা কথা।মেলা দিন হইছে আমি কিছু কইনাই।পড়ার শখ মিট্টা গিয়া থাকলে তাড়া দিয়া আনো মাইয়ারে গেরামে।আমার পোলার মন ভাইঙ্গা গেলে পড়ে জসীম হায়দার কতডা খারাপ হইতে পারে তা তো জানোই তো?তার আগেই লইয়া আনো।এতে আমারো ভালা আর।আর, তোমারো ভালা।’
বলেই রক্ত চক্ষু দেখিয়ে খোর্শেদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন জসীম আর পলাশ।
–
ঘন কালো মেঘকুঞ্জে মোড়ানো আকাশ। শীতের মাঝে বৃষ্টির ছড়াছড়ি।কম্বলে জড়িয়ে আছে কুহেলী।নয়না প্রায় আধঘন্টা ধরে কুহেলীর চুলে বিলি কেটে যাচ্ছে।কুহেলীর ঘুম পাতলা।তবে নয়না এতো সময় যাবৎ ডাকেনি বলে ওঠেনি।সারা রাত ঘুম হয়নি।একটা থেকে ঘুমোচ্ছে।এখন বিকাল চারটা।নয়না প্রসন্ন হেসে বলে,
‘বোন ওঠো।খেতে হবে না?’
কুহেলী এবার চোখ মেলে তাকায়।নয়নাকে দেখে কুহেলীর চোখ জোড়া শীতল হয়।বলে,
‘আন্টি কেমন আছে?’
‘এখন ভালো।আব্বা আর বোন আছে হাসপাতালে সান্দ্র আর সমারোহ ভাইয়া মাত্র ফিরেছে।তোমাকে খাইয়ে আমি হাসপাতালে যাব।আম্মাকে আজই নিয়ে আসব।’
‘আচ্ছা।যাও আমি আসছি।’
‘কোথাও যেতে হবে না আমি খাবার নিয়েই আসছি।আচ্ছা তুমি হাঁসের মাংস খাও?’
কুহেলী মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল।নয়না ঠোঁট বিস্তৃত করে হেঁসে বলে,
‘রাঁধতে ঝামেলা বলে একসাথে দুই বেলার জন্য রেঁধে ফেলছি খিঁচুড়ি আর হাঁসের মাংস ভুনা।খেতে পারবা নাকি খাইয়ে দিব?’
‘আমি পারব।তুমি বরং রওনা হও।’
‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি।ভাইয়াদের খাওয়া বাকি।একটু জোর করে খেতে বলো ঠিক আছে?’
‘আচ্ছা।’
নয়না চলে যাওয়ার পর চট জলদি খাবারটা নিয়ে নিচে চলে আসে কুহেলী।সমারোহ আর সান্দ্রর খাবার প্লেটে নিয়ে ট্রেতে করে সাজিয়ে নিয়ে সান্দ্রর ঘরে আসে।
‘ভাইয়া আসবো?’
‘কুহেলী নাকি?’
‘জি ভাইয়া।’
‘আসো আসো।’
কুহেলী ভিতরে ডুকে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘খাবার নিয়ে এলাম।’
সান্দ্র দ্রুত পায়ে হেটে গিয়ে ট্রে থেকে প্লেট নিতে নিতে বললো,
‘এমা,আমি নিয়ে নিতাম।তুমি অসুস্থ শরীরে কষ্ট করে আনতে গেলে!’
‘ঠিক হয়ে যাচ্ছি ভাইয়া।আপনারা সারারাত পরিশ্রম করলেন।তাই নিয়ে এলাম।’
‘তুমিও তো ঘুমাওনি।ওটা সমারোহর জন্য!’
মাথা মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলে।সান্দ্র মিটিমিটি হেসে বলে,
‘আচ্ছা যাও,তুমিও খেয়ে নিও।’
প্রতিত্তোরে কুহেলী ভোরের মোলায়েম সূর্যের মতো খুব মিষ্টি করে হাসে।তারপর ঘর থেকে বের হশে আসে।সমারোহর ঘরের সামনে এসে সূক্ষ চিনচিনে সূরে কূহেলী বলে,’আসবো?’
অপর পাশ থেকে ভেসে আসে একটা পুরুষালি কন্ঠ, ‘হুম।’
সমারোহ তখন মাত্র গোসল সেড়ে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে খালি শরীরেই বের হয়ে এসেছে বাথরুম থেকে।গলায় লম্বা ফকফকা সাদা তাওয়াল ঝুলানো।সুঠাম,প্রসস্ত বিশাল উজ্জ্বল দেহ।প্রসন্নতা ভরা লোমশ বক্ষ অন্তর কাঁপিয়ে তোলে।সমারোহ ও এমতাবস্থায় কুহেলীকে আসতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কুহেলী দ্রুত আবার ঘর থেকে বের হয়ে যায়।কপাল কুঁচকে আসে সমারোহর।সে ভেবেছিল নয়না।দ্রুত শার্ট গায়ে জড়িয়ে সে বলে,
‘এসো এখন।’
কুহেলী লজ্জায় ঝুবুথুবু হয়ে যায়।ইশঃ! একটু আগে কি বাজে একটা মুহূর্তেই মুখেই না তাকে পড়তে হয়েছে।ভাবতেই যেন বিশাল গতিবেগ সম্পন্ন অযাচিত অনুভূতি আহত করে তাকে।বাতাসে বাতাসে ছুটে অচেনা অনুভবের মিলন মেলা।
সমারোহ আরো একবার বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘কুহেলী ভেতরে এসো।’
কুহেলী হালকা কাঁপুনী নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ঘরের ভেতর ঢোকে।সমারোহকে আড়চোখে একবার দেখে নেয়।বিছানার মাথায় বসে আছে সে।হাতে ছোট্ট সাইজের বিশাল মোটা একটা বই।কমছে কম আটশ পৃষ্ঠা তো এর হবেই।কুহেলী দু’কদম আগিয়ে গিয়ে টি টেবিলে ট্রে রাখলো।এই দু’কদম আগাতেই যেন পায়ে ব্যথা ধরেছে।দেহ জড়তায় পরিপূর্ণ।কারণটা বের করতে পারছে না কুহেলী।সমারোহ কিছু সময় অতিবাহিত হতেই বললো,
‘আসলে আমি ভেবেছিলাম নয়না এসেছে তাই আসতে বলেছিলাম।’
কুহেলী কিছু বলে না।শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।সমারোহ বইটা বিছানায় সশব্দে ফেলে আবার বলে,’তুমি খেয়েছো?’
কুহেলী মাথা ডানে বামে নাড়ায়।
‘না।’
‘কেন?খাবার আমার ঘরেই নিয়ে আসো।একসাথে খাই।’
‘আচ্ছা।আনছি।’
কুহেলী ঘর থেকে চুপচাপই বের হয়।বের হয়ে এক বিশ্ব জয়ী হাসি ফুঁটিয়ে তোলে তার গোলাপী পাতলা ঠোঁটে।এ হাঁসির ক্ষীণ শব্দমালা যেন স্রোতময় নদীতে বেয়ে চলা নৌকার বৈঠায় অতি আপন করে গড়ে তোলা কলকলে ছপাৎ ছপাৎ ছন্দের ন্যায়।
কুহেলী খাবার নিয়ে সমারোহর ঘরে চলে আসে।খাবার নিয়ে নাচতে নাচতে এই ঘরে তো চলে এসেছে ঠিকই কিন্তু এখন যেন আড়ষ্টতা আরো জেঁকে বসেছে।মনটাকে কিছুতেই যেন স্থির করা সম্ভব হচ্ছে না।এতো জড়তা কুহেলীর আগে কোনদিনও ছিল বলে মনে পড়ে না তার।মনে থেকে থেকে অশান্ত ঝড়ের বেগ বেড়ে চলেছে। বৃষ্টির বেগ একটু আগে কমেছে। আকাশও কিছুটা ফর্সা হয়েছে।কালো মেঘ কাটেনি এখনো।এক ঘন্টা সময়ও বাকি নেই সন্ধ্যা নামতে। কুনোব্যাঙ এর ঘ্যাংর ঘ্যাং শব্দ সময়টাকে ছন্দময়ী করে তুলছে। সাথে আছে ঝিঁঝিঁপোকার জোড়ালো ডাক।মাথা ঝিম ধরে কুহেলী বসে থাকে।সে বুঝে উঠতে পারে না এতো ভালোলাগা কিসের।সামনে বসে থাকা সুদর্শন পুরুষের মায়ার ,নাকি প্রকৃতির আমেজ! শুধু এটা ঠাওর করে এ সময় সুন্দর।এ হৃদস্পন্দনের নৃত্য অমায়িক!
খাবার খাওয়া শেষ করে সমারোহ বলে,
‘ তোমার তো আজ যাওয়া হলো না। ভর্তির কাজও অবশ্য এতো ঝামেলার মধ্যে করা যেত না।আমি বরং তোমাকে কাল নিয়ে যাব।সময়ও থাকবে হাতে।চাইলে শহরটা একটু ঘুরিয়েও আনতে পারবো।ঘুরতে ভালোবাসো?’
কুহেলী মুখে কিছু বলে না।তবে মন বাক বাকুম করে নেচে চলেছে।খুশি মনেই মাথা ডানে হেলিয়ে উত্তর দেয়, ‘খুব।’
‘তুমি বড্ড চুপচাপ থাকতে ভালবাসো দেখি।’
সমারোহর কথায় বেশ কিছু সময় ধরে ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতোন করে তাকায় কুহেলী।এই প্রথম কেউ তাকে শান্ত বললো।গ্রামে তো তার বাধা ধরা নাম ছিল ‘উড়নচন্ডী’।আর সমারোহ শান্ত বলবে নাই বা কেনো লোকটার সামনে দম আটকে রাখার মতো অবস্থা হয় তার! পা,মুখ,দেহ সব স্থবির হয়ে যায়।তবে সমারোহর কাছ থেকে এমন প্রশংসা পেয়ে আরেক দফা নেচে উঠলো কুহেলীর মন। তবু ও কুহেলী সামান্য ব্যঙ্গ করে বললো,
‘মোটেই না।আমি শান্ত নই। এখানে নতুন বলে। আচ্ছা আপনি মেডিক্যাল হলে রুম পেয়েছেন?আব্বা বলেছিল যে একটা রুম মেনেজ করে দিতে।’
সমারোহ কয়েক গুণ অবাক হয়ে বললো,
‘কেন হলে রুম লাগবে কেন?’
‘তাহলে আমি থাকবো কোথায়!’
‘আম্মা তোমাকে যেতে দিবে না। তোমার আব্বাকে সেদিন যাওয়ার সময়ই বলে দিয়েছে।’
কুহেলীর কান জোড়া যেন এই কথা শোনার জন্য বহুকাল ধরে শূন্য শূন্য হয়ে ছিল।এখন প্রাণে জল ফিরেছে।কুহেলী কখনোই অন্যদের বাড়িতে থাকতে পছন্দ বোন করে না। তবে এই বাড়ির মায়ায় জড়িয়েছে সে কয়েকদিনের ব্যবধানে। বিশেষ করে এই লোকটার।এই মানুষটির জালে সে আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে গেছে।
সমারোহ’র কথা শুনে কুহেলীর মুখের প্রসন্নতা চোখ এড়ায়নি সমারোহর। বেলকনি থেকে বিকেলের শেষ আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে কুহেলীর চেহারায়।প্রকৃতির লালচে কালো আভা যেন কুহেলীকে স্বর্গীয় হুরের রূপ দান করেছে।আর সেই অমায়িক রূপের সৌরভ গোগ্রাসে আস্বাদন করছে সমারোহর চোখ।কাজল চোখের লজ্জা মাখা চাহনি সমারোহ’র বৈদ্যুতিক কাঁপুনি সৃষ্টি করছে।ছোট ছোট খয়েরী বর্ণের চুলগুলো কপাল ছেয়ে ফেলতে চাইছে।পাতলা ফিনফিনে গোলাপী ঠোঁট সবচেয়ে বড় আক্রমণ করে বসে সমারোহর উপর। হৃৎপিণ্ডের সবচেয়ে গহীনের গোপন কুঠুরিতে উথালপাথাল করে দেয় সর্বস্ব।এক পুরুষ মনে সৃষ্টি করে অন্য এক অতীব সুন্দরী নারীর জন্য ক্ষুদ্র আকর্ষণ।কুহেলী মুচকি হেসে ধনুকের মতো শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে ওঠে দাড়ায়। মাথা হালকা দুলিয়ে বলে,
‘ ঘরে যাচ্ছি আমি।’
কুহেলী চলে গেল।সমারোহ নিজের ঘোরের মাঝেই আটকে রইলো সময়টাকে খামচে ধরে।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৫.
সকালের আলো আজ সময়ের আগেই ফুটেছে।সূর্য মামার যেন আজ বড্ড বেশি তাড়া।কুয়াশার ঘনঘটার মাঝে ডিমের নরম কুসুমের মতো হলুদ সূর্যটা মেঘ খুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে।সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়েছে শহর জুড়ে।গতকালের বৃষ্টি যেন তাকে বশীভূত করতে পারেনি কিছুতেই।কুহেলী কম্বলের ওমের মাঝেই হাটু মুড়ে ওঠে বসে।দুই হাত দিয়ে কম্বল টেনে তোলে বাহু ছুঁইয়ে কাঁধ অব্দি।শীত যেন প্রাণ নিবে।তবে শহুরে শীতকালটা বড়ই কৃত্তিম বলে মনে হয় কুহেলীর।এই যেমন তার সুন্দর গ্রামটা শীতকালের ছোঁয়ায় শুভ্র হয়ে যেতো।তিন হাত দূরেই দেখা যেত না কিছু।রোদ উঠতে উঠতে তো সেই বেলা দশটা কি এগারোটা।কখন তো দুপুর একটায় টুক করে উঁকি দিত সূর্য।আর এখানে শীতের প্রখরতা কম।আবার হুট করেই শীত অনেক বেশি।চিটাগাং সমুদ্র নিকটবর্তী বলে শীত কম থাকে।কুহেলী শীতে হাতপা গুটিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে চোখ মেলে জানালাতে।কাঁচের জানালার উপারে দু’জোড়া পাখি বসে আছে।শরীর হলুদ বর্ণের।পাখিগুলো দেখে হতভম্ব হয়ে গেল কুহেলী।শীতের সকালে পাখিরা এখানে এলো কি করে!কুহেলী বিষ্ময় নিয়ে গায়ে পশমী সোয়েটার জড়িয়ে গিয়ে জানালাল গ্লাস টেনে খুলে।পাখিজোড়াকে হাতে নিয়ে দেখে শরীর তাদের প্রচন্ড ঠান্ডা।নির্ঘাত পথ ভুলে এখানে এসে পড়েছে!কুহেলী তার সোয়েটারে একাংশে পাখিগুলোকে চেপে ধরে।অপর পাখিটা হয়তো তার জোড়া।বেঁচে আছে দুটোই তবে চিকিৎসা লাগবে!
শীতের কারণে পাখি দুটার অবস্থা বেহাল।একজনের পায়ে সামান্য ক্ষতও আছে।কুহেলী ঠিক কি করবে মাথায় আসে না।পাখি দুটোকে বিছানায় কম্বলের নিচে রেখে দৌড়ে রান্নাঘরে যায় পানি গরম করতে।রান্নাঘরে গিয়ে দেখে সমারোহ আগে থেকেই সেখানে আছে।এক চুলায় চা বানাচ্ছে আর চুলায় পানি গরম হচ্ছে।কুহেলীকে দেখে মুচকি হাসে।বলে,
‘রাতে ঘুম হয়েছে?অত সকালে নিচে যে!সবে মাত্র সাড়ে পাঁচ’টা।’
কুহেলীও হালকা হাসে।লোকটার চোখেমুখে ঘুম জড়ানো।চোখগুলো ফোলা ফোলা।কন্ঠে নেশা।কি অদ্ভুত মায়াময় পুরুষ সমারোহ।
কুহেলী নিষ্পলক দেখে চলে তাকে।সমারোহ তখন আদা কুঁচি করছে চা’য়ের জন্য।সমারোহর ধারনা হয় কুহেলী কিছু না বলে শুধু দেখেই চলেছে তাকে।অস্থিরতা হয় সমারোহর।ভীষণ রকম অস্থিরতা।কেটলীর পাশে রাখা চিকন সাদা ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে সে।উদ্দেশ্য কুহেলীর ধ্যান ভাঙানো।তবে বিশেষ লাভ হয়েছে বলে বোধ হয় না।কুহেলীর উত্তর না পেয়ে সে আবার বলে,
‘কি হলো,কি দেখো এভাবে?’
দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেলে কুহেলী।নিজের কর্মকান্ডের জন্য এখন তারই লজ্জা হচ্ছে।মাথা নিচু করে বলে,
‘নামাজ পড়ে শুয়েছিলাম।ঘুম আসে নাই।আমি একটু গরম পানি নিব?’
‘হুম,অবশ্যই!নাও।’
মুচকি হেঁসে খুব সহজভাবে বলে সমারোহ।কুহেলী একটা ছড়ানো পেয়ালাতে গরম পানি নেয়।সমারোহ ভ্রুঁক্রুটি করে বলে,
‘কি করবে?খাবে তো মগে নাও।’
কুহেলী একবার কিছু একটা ভেবে পাখিগুলোর কথা বলে সমারোহকে।সমারোহ চকিতে বলে,
‘আর তুমি পানি নিচ্ছ তাদের গোসল করাতে!’
কুহেলী কিছুটা অপরাধী সুরে বলে,’হুম।’
‘এজন্যই মেয়েদের বোকা বলে।নিয়ে আসো ওদের আমার ঘরে।’
সমারোহ আবার নিজের কাজে মন দিল।কুহেলী সমারোহর এহেন কথায় কিছুনা অপমান বোধ করলেও চুপ রইলো।মুখখানি পেঁচার মতো করে পা বাড়ালো সিড়ির দিকে।কুহেলী রান্নাঘর ছাড়তেই মুচকি হাঁসলো সমারোহ।কেন যেন কুহেলীর বোঁচা মুখটা দেখতে খুব আকর্ষণীয় মনে হয় তার।
কুহেলী পাখি দুটোকে হাতে করে সমারোহর ঘরে নিয়ে আসতে সমারোহ তাদের নিয়ে বিছানার উপর একটা বড় তাওয়ালে রাখলো।টেবিলের উপর রাখা হেয়ারড্রায়ার দিয়ে গরম হাওয়া ছাড়তে লাগলো তাদের।কুহেলী বিছানা বরাবর পাতা সোফায় বসে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো কান্ডখানা।তারপর বললো,
‘আপনি হেয়ারড্রাইয়ার ইউজ করেন?’
কুহেলীর কথা শুনে সমারোহর এই মুহূর্তে মনে হলো যেন হেয়ার ড্রাইয়ার ব্যবহার করা পাপ!পাখিগুলোর শরীর ততক্ষণে শুকিয়ে এসেছে।যন্ত্রটা প্যাকেট বন্ধী করে রাখতে রাখতে সমারোহ বলে,
‘কেনো বলো তো?’
‘না মানে এটা তো মেয়েরা ব্যবহার করে।আর আপনার চুল বড় হলেও অত বড় তো নয়!’
সমারোহ এবার হেসে ফেললো।বাড়ি কাঁপানো হাসি।কুহেলী বোকা বনে গেল সমারোহর হাসি শুনে।যেন ও কিছু ভুল বলেছে।
‘হাসছেন কেনো এভাবে?’
‘আমার বিড়াল ছিল ক্রুশা।তার জন্যই কিনেছিলাম।’
কুহেলী এবার দু-তিন গুন বেশি আগ্রহী হয়ে বলে,
‘কোথায় এখন সে?আমি তো এই বাড়িতে আসার পর থেকে বিড়াল দেখিনি।’
সমারোহর মুখ চুপসে যায়।কাল বৈশাখীর আকাশের মতো আধারে ঢাকা মুখে বলে,
‘কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে ও।’
কুহেলী চুপচাপ শুনে।মন খারাপ হয়।সমারোহ খুব যত্ন করে সারিয়ে তোলে পাখিগুলোকে ।তারপর কুহেলীকে বলে তৈরী হয়ে নিতে।একঘন্টা পর বের হবে তাকে নিয়ে।এরপর ডিউটি আছে।কুহেলীও বাধ্য মেয়ের মতো নিজের ঘরে আসে তৈরি হতে।ঘরে এসে আপন মনে অনেক কিছুই ভাবে কুহেলী।গ্রামে তাদের বাসাতেও তো বিড়াল থাকতো।একটা নয় দুটো নয় পুরো পাঁচটা বিড়াল।নামও দিয়েছিল সে।কাঁকন,মাখন,কবরী,মিঠাই আর মিষ্টি।প্রত্যেকেও ওর প্রিয় ছিল।এখন ওদেরও দেখতে পায়না।গ্রামের কথা ভাবতেই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরে কুহেলীর।সবার কথা মনে পরে।হাতে মোবাইল নিয়ে বাড়িতে ফোন করতে নিয়েও রেখে দেয়।শীতের সকাল নেটওয়ার্ক পাওয়া অসাধ্য ব্যাপার।মন খারাপ করে গিয়ে সকালেই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে নেয় কুহেলী।শীতে কাঁপতে কাঁপতে এসে আবার কম্বলের নিচে ঢুকে নিজেকে গরম করে নেয়।গ্রামে থাকতেও শীতপর প্রতিটা দিন সকালে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে লেপ জড়িয়ে উনুনের পাশে বসে শীত পোহাতো।তারপর খেতো রজবের নামিয়ে দেয়া টাটকা খেজুরের রস।সে কি আনন্দ!
–
নিজের জন্য নদীর ফকফকা পরিষ্কার টাটকা পাঙ্গাশ মাছ কিনেছে রজব।বাড়িতে একমাত্র সে ছাড়া আর কেউ খায়না পাঙ্গাশ মাছ।তবে তার কাছে চাচির পাঙ্গাশ ভুনার চেয়ে সুস্বাদু দুনিয়ার আর কিছু নেই বলে মনে হয়।ছোট ছোট পুটি আর চিংড়ি মাছ কিনে বাড়ি ফিরার পথে প্রিতুসের সাথে দেখা হয়ে যায় রজবের।সুদর্শন চেহারা আর বিশাল দেহের অধিকারী প্রিতুসকে দেখলেই রজবের মেজাজ বিগরে যায়।রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে কয়েকজনকে নিয়ে খড়ের গাদার মধ্যে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।তাকে এড়িয়ে রাস্তা দিয়ে আসার সময় প্রিতুস গলা উঁচিয়ে বলে,
‘ও রজইব্বা, যাস কই!এদিকে আয়।’
রজব ভ্রুক্ষেপহীনভাবে প্রিতুসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘কি কইবা তাড়াতাড়ি কও।আমরার বাড়িতে মেলা কাম পইরা আছে।’
‘কি মাছ লইয়া যাস?দেহা দেখি!’
‘তোমারে কেন দেখামু?তোমাগো আর কাম নাই মাইনসের জিনিসে নজর দেওন ছাড়া?’
প্রিতুস ঠাট্টা করে বলে,’মানসের কেমনে?শ্বশুরের কো।’
রজব কপাল কুঁচকে ফেলে মুহুর্তেই।অসহ্য রকম গায়ে পড়া লোক তো ওই বংশের সবাই!রজব ভেঙচিয়ে বলে,
‘বাবারে বাবা,শখ কি?নিজের লগে কুহেলীর যোগ্যতা দেখছো নি?নিজে অশিক্ষিত কালা ভূত!আর আমাগো কুহেলী ডাক্তার,সারা গেরাম এহন তারে চিনে।আল্লাহর রহমতে নূরানী চেহারা তার।আর তুমি এক ওয়াকত(ওয়াক্ত) নামাজ পড়েননি?’
মেজাজ চটে যায় প্রিতুসের।রাগে গিজ গিজ করতে করতে বলে,
‘বাড়ির চাকরের কতো বড়বড় কথা!সুন্দরী গেরামে থাকতে তো তার আঁচল ধইরা ঘুরতি বইল্লা কিছু কইতে পারি নাই।তার চোখে রাখাম হইয়া যামু বইল্লা।এহন কি করবি?এমন কেলামু না,বাপ দাদার নাম ভুইল্লা যাবি।তা আমার সোনা বউডা গেরামে আইবো কবে?’
‘না আছে পড়ালেখা আর না আছে বুদ্ধি।হেয় আবার আইছে কুহেলীরে বিয়া করতে।ও এহন ডাক্তার।তুমি তার পায়ের যোগ্য নি?’
প্রিতুসের পাশে থাকা ছেলেটি এসে সজোরে থাপ্পড় বসায় রজবের গালে।টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে যায় রজব।তা দেখে হাসিতে ফেটে পরে প্রিতুস।বাজারের ব্যাগে থাকা সবকটা মাছ মাটিতে ফেলে দেয় সে।রজবকে আবার তুলে মারা শুরু করে।হাত মচকে দেয়,ঘনঘন কয়েকটা বিশালাকৃতির থাপ্পড়ে মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে টাটকা রক্ত।শরীরের প্রতিটা অঙ্গ অবস হয়ে আসে,একফোঁটা জোর আর নেই।এমনি এখন উঠে দাড়িয়ে বাড়ি ফিরবার শক্তিও তার নেই।শ্বাস গারো হয়।তাও কুহেলীর সম্পর্কে বলা কথাগুলো যেন বিষ ঢালছে শরীর জুড়ে।রজব মাটিতেই পড়ে থাকে।চারপাশে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তার সখ করে কেনা মাছগুলো।মুখের টাটকা রক্তও মাটিতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
প্রিতুস রজবের দিকে এগিয়ে এসে ঝুকে বলে,
‘চাকর চাকরের মতোই থাকবি।একবার তোদের সেই পড়াকু আপা গেরাম থেইক্কা আমার চোখ ফাঁকি দিয়া পালাইছে মানে কি বারবার পালাইতে পারবো?এতো বোকা আমি?একবার খালি আইতে দে গেরামে।তুইল্লা নিয়া সোজা আমার খাটে ফালামু।যত তেজ আছে দেখমু সেইদিন।’
রাগে ক্ষোভে রজবের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষন হয়।ফোসফাস শব্দ করে শ্বাস নেয়।কুহেলীকে খুব ভালোবাসে সে।তার নামে এতো খারাপ কথা বলার সাহস কি করে দেখায় প্রিতুস!রজবের চেহারা দেখে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে চলে যাচ্ছিল প্রিতুস আর তার সঙ্গীরা।রজব সাহস,শক্তি জুগিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।আসেপাশে তাকিয়ে দেখে একটা বড় বাঁশের টুকরা পরে আছে কিছুটা দূরে।দ্রুত পদক্ষেপে মাটিতে পড়া মাছগুলো বাজারের ব্যাগে ভরে নেয় রজব।তারপর গিয়ে বাঁশের খণ্ডাংশ হাতে নিয়ে ডিল ছুঁড়ে প্রিতুসের দিকে।মাথায় আঘাত আকস্মিক আঘাতে অপ্রস্তুত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রজব।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের সর্বস্ব দিয়ে দৌড় শুরু করে বাড়ির দিকে।প্রিতুস আহত হওয়ায় কেউ রজবপর পিছু নেয়ার সময় পায়না।প্রিতুসকে দ্রুত হায়দার বাড়ি নিয়ে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
–
সবুজ ঘেরা জঙ্গল তার মাঝে মাটির পথ। মাটির রাস্তাটা যেন প্রকৃতি নিজেই খুব যত্নে গড়ে তুলেছে।হালকা সোঁ সোঁ বাতাস আর ঝিরিঝিরি কুঁয়াশার আভা দুপুরের শেষ সময়ে বিদ্যমান।সূর্য নেই আকাশ জুড়ে তবু যেন আকাশ মোড়ানো চিরকুটে খুব গোপনে রেখে গেছে শেষ রেখাখানি।কুহেলী উম্মুক্ত পা ছন্দের তালে একের পর এক ফেলে হেটে চলেছে।পেছন পেছন আসছে সমারোহ।সমারোহর দারুণ লাগছে ব্যপারটা।শহুরে মেয়েদের আর গ্রামে বেড়ে ওঠা মেয়েদের মাঝে এই একটা গভীর পার্থক্য।গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেয়েরা প্রকৃতির মাঝে মিলিয়ে যেতে পারে ভালো।যেটা গ্রাম ভালোবাসা শহুরে মেয়েরাও মোটেই পেরে ওঠে না।তবে কুহেলীর হাটার ধরন বেশি ভালোলেগেছে সমারোহর।জঙ্গলের মাঝপথ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা গিয়ে মিশেছে বিলের পাশে।সেই দিকটাতে বিলের দুই পাশ ধরে রাস্তা। মানুষ বেশিরভাগ সময় ব।সমারোহ আর কুহেলী হাঁটতে হাঁটতে বিলের কাছে এসে পড়েছে।কুহেলী বেশ প্রফুল্ল হয়ে ঘুরে বেড়ায়।ভর্তির কাজ শেষে কুহেলীকে ঘুরাতে নিয়ে এসেছে সমারোহ।বাড়িতে থেকে থেকে নিশ্চয়ই এতো দিনে বেশ ক্লান্ত কুহেলী।সমারোহর ভাবনা খুব একটা ভুল নয় এটা কুহেলীর ছটফটানি দেখলেই বুঝা যায়।লাল আর সাদা মিশেল ফরিং ধরতে তার পিছুপিছু ছুটে চলেছে কুহেলী।সমারোহ গায়ের কালো জ্যাকেটে হাত গুঁজে মুগ্ধ নয়নে দেখছে সেই দৃশ্য।কালো রঙের জামা আর হুডি যেন কুহেলীর গায়ের ধবধবে ফর্সা রং আরো মোহময় করে তুলেছে।আসলেই তুলেছে কিনা জানা নেই।
কিন্তু সমারোহ চক্ষুজোড়া শীতল হচ্ছে এক সুন্দরী রমণীর এমন অবুঝ কন্ঠে।কুহেলী খোঁপা বাঁধা চুল ছোটার ফলে খুলে গিয়ে দমকা হাওয়ায় উড়ছে সোঁ সোঁ করে।পড়ন্ত লাল আলোর ছটা কেশযুগলে মিশে হালকা মেরুণ ঝিলিক তুলছে।সমারোহর চোখ জোড়া অবাধ্য নদীর স্রোতের মতো আটকে যায় সেখানেই।
সকালে ভর্তির জন্য সকল কাগজপত্র জমা দিয়ে বড় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে টাকা জমার দেয়ার জন্য।সমারোহর তখন ডিউটি ছিল।সকল কাজ নিজে নিজেই করে নিয়ে সমারোহর কেবিনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১২টা বেজে যায়।এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় ডিউটি শেষ হওয়া অবদি।এক রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করার পর হঠাৎ সমারোহ নিজেই বলে শহরের কিছু অংশ ঘুরে দেখাবে।
কাল ক্ষাণিক চেষ্টা চালানোর পরও যখন ফরিং ধরা হলো না কুহেলীর।ছোট ছোট পা ফেলে এসে দাঁড়ালো সমারোহর খানিকটা পাশে।সমারোহর চোখ জোড়া তখনো দেখছে কুহেলীর ঘন পাঁপড়িযুক্ত কাজল কালো চোখগুলোকে।ঘামে সিক্ত কেশ লেপ্টে আছে কপাল জুড়ে।শীতল পরশে পাতলা ওষ্ঠদ্বয় ঘনঘন কাঁপছে মেয়েটার।এ চিত্র কতটা মোহময়!
সমারোহর বুক জুড়ে গাঢ় দাগ কেটে যেতে লাগলো কুহেলীর মোলায়েম হাঁসি।কেন যেন মনের মাঝে সূক্ষ্ম বাসনা জেগে উঠলো এই নারীর প্রতি।হঠাৎ বোধ ফিরতে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল সমারোহ।এ কি করছিল সে!কুহেলীকে এভাবে দেখার অনুমতি কি আদো তার আছে? তাছাড়া কোন মেয়ে মানুষের প্রতিই যে তার শুধু সম্মান ছাড়া আর কোন অনুভূতি কাজ করে না।কুহেলীর প্রতিও হয়তো এটা সামান্য কোন ভালোলাগা ছাড়া আর কিছুই নয়।আর যদি হঠাৎ কিছু জেগেও ওঠে তা ভালোবাসা তো নয়ই কিছুক্ষণের ভালোলাগা মাত্র ।সমারোহ নিজের উপর জোর দিয়ে আওড়াতে থাকে কোন মেয়ের প্রতি কোন প্রকার কোন অনুভূতি তার নেই আর থাকবেও না।সমারোহ বিলের জলে চোখ মিলিয়ে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।কুহেলী একঝলক দেখে সমারোহকে।লোকটাকে খুব বিমর্ষ লাগছে এই মুহূর্তে।কপালের উপর পড়ে থাকা অগোছালো চুলগুলো যেন তার ক্লান্তির প্রমাণ।কুহেলী থমকায় লোকটার এতো রূপ দেখে।কখনো সমারোহকে দেখে মনে হয় খুবই গোছানো মানুষটা।আবার কখনো মনে হয় নিজের জীবন গুছিয়ে ওঠতে না পাড়ার যন্ত্রনায় শেষ হয়ে যাচ্ছে!একাকিত্ব ক্রমশঃ গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে।সমারোহর চোখমুখে গাঢ় ক্লান্তির ছাপ দেখতে পায় কুহেলী।অথচ আসবার সময় কতো প্রফুল্ল ছিল।বুকটা কেঁপে উঠে।কিসের এতো অবসাদ মানুষটার!অবশ্য কুহেলীর তা জানার অধিকার নেই।শুধু চাইতে পারে পছন্দের মানুষটার সব কষ্টগুলো যেন তার হয়।এতটুকু অবশ্য কুহেলী নিজের মানুষগুলোর জন্য রোজই চায়।মাথা থেকে সে সকল চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কুহেলী বলে,
‘জায়গাটা খুব সুন্দর।’
‘হুম।’
‘আপনি এখানে প্রায়ই আসেন?’
সমারোহ ফোঁস করে এক বুক নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
‘আগে মেডিক্যালে পড়া কালীন চিটাগং আসলে প্রায়ই আসা হতো।এখন তিন বছর পর এলাম।’
‘কোন মেডিক্যালে পড়তেন?’
‘ঢাকা মেডিক্যাল।’
‘সান্দ্র ভাইয়া?’
‘ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়তো তাই সুবিধা হয়েছিলো।একসাথে থাকতাম।’
আবার নিশ্চুপ হয়ে যায় পরিবেশ।কুহেলী একটু থেমে কিছু একটা ভাবে তারপর আবার বলে,
‘আপনি খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেন আমি শুনেছি সেযুঁতি আপুর থেকে।একটা শোনাবেন এখন?’
সমারোহ চকিতে তাকায় কুহেলীর দিকে। কবিতা তার খুব প্রিয়।তবে সময়ের সাথে এর বোল সে হারিয়ে ফেলেছে। সমারোহ খুব গম্ভীর্যর্পূণ চেহারা সৃষ্টি করে থমথমে গলায় বলে,
‘আগে করতাম আবৃত্তি।এখন করি না।’
‘কেনো? এখন করেন না কেন?’
কুহেলী ফট করে বলে ফেলে কথাটা।কুহেলীর কথা শুনে বেশ বিব্রত আর বিরক্তি বোধ করে সমারোহ।এতো কেনো জানতে হবে এই মেয়ের! একবার বলেছে না, মানে না। বিরক্তি বোধ করলেও নিমিষে তা লুকিয়ে নিল সমারোহ।কুহেলীও বুঝতে পারলো কথাটা তার মোটেই বলা উচিত হয়নি।হয়তো কোন বিশেষ কারন রয়েছে তাই বলছে না।সেদিন ঘুরাঘুরিতে আর বেশি একটা মন ছিল না সমারোহর।তাই বাড়ি ফিরে আসা হলো।
চলবে.
®সাইমা ইসলাম প্রীতি
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৬.
সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে।তেজ বিহীন প্রসন্ন শীতল রোদ এখন।মোটা এনাটমি বই বন্ধ করে বেলকনিতে এসে হাত ছড়িয়ে কিছুটা রিল্যাক্স হলো কুহেলী।ক্লাস শুরু হয়েছে দু’সপ্তাহ হলো।প্রথম ছ-সাতটা ক্লাস কেবল বই কিনা-কাটা করতে করতেই শেষ।তবে পড়ার চাপে এখন সর্বদা টটস্ত থাকতে হয়।চট্টগ্রাম এসেছে প্রায় একমাস হতে চললো।আসার পর শরীরও শুকিয়ে গেছে অনেকটা।চোখে একটা চিকন ফ্রেমের পাতলা গ্লাসের চশমাও জুটেছে এর মাঝে।এই যা পরিবর্তন।আরো একটা বড় পরিবর্তন আছে বটে।সেটা হলো খুব স্বল্প পরিসরে সমারোহকে মিস করা।কুহেলী বেলকনিতে রাখা টুলে বসে ভাবে অদ্ভুত হলেও কতটা সত্যি যে এইলোকটাকে ও খুব পছন্দ করে কিন্তু তার সামনে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়।তিন সপ্তাহে গুনে গুনে তিনবার লোকটার সামনে নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে কিনা তার জানা নেই।কুহেলীর ধারনা সমারোহ ও কেমন যেন এরিয়ে চলে কুহেলীকে।নাহলে কখনো কোন বাহানায় যেতে পারে না সমারোহ ঘরে।প্রথমে তো প্রায়ই যেত। দরকার না থাকলেও মিথ্যে দরকার তৈরি করে নিত।এখন পারে না।নাকি সেই সুযোগটা সমারোহ দেয় না।কুহেলী লাইব্রেরীতে গেলে সমারোহ ঘরে চলে যায়।কুহেলীর ছাদে যাওয়ার সময় সমারোহ যায় না।সবার সাথে খাবার খেতে নিচে গেলেও দেখা যায় সমারোহ খেয়ে নিয়েছে।দেখা হয় না।কথা হয়না।চোখ জুড়ানোর উপায়ও হয় না!বিষয়গুলো খুব ব্যাথিত করে কুহেলীকে।
শীতকাল শেষ।বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সব উজাড় করে বসে আছে।এখনের দিনে রোদ থাকে কড়া বিকেল নামতে নামতেই ঠান্ডারা সব ঝোড়ো হয়।পাখিরা সকালে আকাশে উড়ে খাবারপর খোঁজে আব দুপুর হতেই ক্লান্ত হয়।
সারিকার পুরনো ঘরটা এখন পাকাপোক্ত ভাবে কুহেলীকে দিয়ে দেয়া হয়েছে।ছোট্টঘরটা বইয়ে কোনঠাসা হয়ে গেছে।পড়ার টেবিলে অগোছালো চার-পাঁচটা বই ঠিকঠাক করতে করতে চট করে কুহেলীর মাথায় এলো এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে কিছু সময় কাটালে ব্যাপারটা মন্দ না। ইদানীং কেউ ছাদে যায় ও না তেমন একটা।কুহেলীও নিজেকে ঘর বন্দি করে নিয়েছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞায়।যে যার কাজে ব্যস্ত।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ!চটজলদি রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা হলো কুহেলী। মৃদু শীতে কফিতে এক চুমুক দিতেই মনে হয় কলিজা অবদি উষ্ণতা পায়।মন ফুরফুরে হয়ে। মেজাজ ভালো হয়ে যায়।ছাদের ফ্লোরে পা রাখতেই কুহেলীর চোখ পড়ে সমারোহর দিকে।শুধু এক পলক সমারোহকে দেখেই চমকে ওঠে কুহেলী।সমারোহর মোবাইলে খুব জোরে জোরে কারো সাথে চিৎকার করে কথা বলছে।ঠিক কথা বলছে না কাওকে একটা শ্বাসাচ্ছে।সমারোহর কথা স্পষ্ট শুনতে পায় সে।
‘ভালোবাসতাম তোমাকে খুব। কিন্তু তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি আর কোন দিন ফোন দিবে না আমাকে।এর পরেও যদি আর কোন…’
কুহেলীর আর কিছু শোনার ইচ্ছা করছে না। অজানা কোন কারনে চোখ দুটো জ্বলছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।হাত কাঁপছে ফলে কফির কিছু অংশ হাতে পড়ে যায়।এতোটা গরম সহ্য করতে না পেরে ‘আহ!’ বলে চিৎকার করে উঠে কুহেলী।হাত থেকে কফি মগ নিচে পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সমারোহ খুব রাগান্বিত অবস্থায় ছিল। আওয়াজ শুনে কুহেলীর দিকে ফিরে তাকায়।চোখ দুটো তার রাগের বশে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।সমারোহ ফোন কেটে মোবাইল আছড়ে ফেলে ছাদের খাজকাটা মেঝেতে। কুহেলী ভয় নিয়ে তাকায় সমারোহর দিকে। পছন্দ হলেও অজানা কারনে সমারোহকে বড্ড বেশি ভয় পায় কুহেলী।
প্রিয় মানুষের প্রতি যেমন ভালোবাসা,মায়া,আবেগ বেশি কাজ করে তেমন খারাপ লাগা আর ভয় পাওয়া তার প্রতিই বেশি হয়।কুহেলীর মতে সমারোহ খুব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ।তাকে এর আগে কখনোই কারো সাথে রেগে কিংবা চেঁচিয়ে কথা বলতে কুহেলী দেখেনি,এই প্রথম।তবে এখন ভয়ের চেয়ে কষ্টটা বেশি হচ্ছে।বুকটা জ্বালা করছে।কান দুটো গরম হয়ে আসছে।বুকের ব্যাথাটা যেন ধীরে ধীরে দলা পাকিয়ে গলাতে এসে আটকে পড়ছে।ঘনঘন শ্বাস ফেলছে কুহেলী।মনে মনে সে ভেবে নিয়েছিল সমারোহকে সে ভালোবাসে।সে সত্যিই সমারোহকে নিজের সবটা বিলিয়ে ভালোবাসতো না যদি না জানতো সমারোহ জীবনে অন্য কেউ রয়েছে।
____________________
রাগে গিজগিজ করছে জুলেখার সম্পূর্ণ দেহ।মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে প্রিতুস।কালো পালঙ্কে শুয়ে গোঙাচ্ছে সে।একটু আগে ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ করে ঔষধ পত্র লিখে দিয়ে গেলো।প্রিতুসের জন্মদাত্রী জুলেখা।একটু দূরে চেয়ারে বসে আছেন জসীম।পলাশ তার পাশেই দাঁড়ানো।প্রিতুস তার সৎ ভাই হলেও যথেষ্ট সমীহ করে পলাশ তাকে।ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে মন চটে গেছে তার।জুলেখা মরাকান্না জুড়ে বসেছেন।কপাল চাপড়ে বারবার একই বিলাপ করে যাচ্ছে।পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে।হঠাৎ কান্না থামিয়ে জুলেখা জসীমের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে বলে,
‘আপনে এইটার প্রতিশোধ নিবেন না?আমার খোকারে আমি ছুট(ছোট) বেলার থেইক্কা একটা টোক্কাও লাগতে দেইনাই।হেই খোকা একটা একদিনের ছেমরার কাছে মাথা ফাটাইয়া বাড়ি ফিরলো।আহ!আহ!আমার কলিজাটা পুড়তাছে।খোকার আপনে কিছু করেন,জলদি কিছু করেন।আমার পরাণ পুড়ে।’
জসীম নড়েচড়ে না।মাথা যথেষ্ট গরম হয় তার।একে তো খোরশেদের উপর রাগ তার উপর ছোট বউ।ইচ্ছে করতেছে আগে জুলেখার গলা টিপে কথা বন্ধ করে তার খোরশেদকে গ্রাম ছাড়া করতে।অসহ্য সব কান্ড।বেজায় বিরক্তি নিয়ে বলেন,
‘তুমি চুপ করবা?খালি কানের ভিতর প্যানের প্যানের।আমারে জানতে দেও কি হইছিল!’
‘আর কি জানবেন আপনি?আর কি জানবেন?আমার খোকার হাল দেখছেন?আপনি যদি এখনি ওই পোলারে না মারছেন দেইখ্যেন আমি কি করি!’
জুলেখার কথা শুনে জসীম রক্তচক্ষু দিয়ে দেখে তাকে।ভয়ে চুপ হয়ে যান জুলেখা।জসীমের পিত্তি জ্বলে উঠে মেয়ে মানুষের উঁচু গলায় কথা শুনলে।রাগ থামানোর জন্য টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস মাটিতে সজোরে ফেলেন।কাঁচের মনোরম নকশা করা গ্লাসটা মুহূর্তেই খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়।তারপরও রাগ কমে না।চেয়ার থেকে ওঠেই পাংশুটে চেহারায় খপ করে এক হাতে জুলেখার চুলের মুঠি ধরে আরেক হাতে গাল জোরে চেপে ধরে বলে,
‘আগে আমার পোলা তারপর তোর।চিৎকার চেঁচামেচি কইরা মাথা ধরাবি না।আমার সামন থেকে যা কইতাছি।তোর গলা যাতে আর না শুনি।’
জুলেখা ব্যাথায় কথা বলতে পারেনা।জসীমের হাত ছোটানোর জন্য ছটফট করতে থাকে।পলাশ কপাল কুঁচকে বলে,
‘আব্বা এরে ছাইরা দাও।আগে বদমাইশ রজইব্বার একটা ব্যবস্থা করতে হয়।যদি কও তো পোলাপান লইয়া যাইয়া হাত পা ভাইঙ্গা দিয়া আসি।’
পলাশের কথায় জুলেখাকে ছেড়ে দিয়ে প্রিতুসের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে জসীম।কালো সুন্দর চেহারায় কালসিটে দাগ।ঠিকঠাক শুতেও পারছেনা ছেলেটা।জসীমের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই এক লাফে প্রিতুসের কাছে এসে বসে জুলেখা।শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে আবার সেই বিলাপ জুড়ে দেয়।পলাশ কপাল কুচকুচে ভাবে দুনিয়ার সবচেয়ে বেহায়া এই মহিলা।
পাশের ঘরে বসে বসে জসীমের বড় বউ রুনা তসবি পড়েন।এই সব বিষয়ে বিরক্তির শেষ নেই তার।রুনা আল্লাহর কাছে তওবা কেটে মাফ চান।নিজের স্বামী সন্তানদের জন্যও মাফ চেয়ে মোনাজাত করেন।তাদের বিপথ থেকে সৎপথে আসার দোয়া করেন।তারপর জায়নামাজ তুলে ঘুমাতে যান।
জসীমকে চুপ দেখে পলাশ আবার বলে,’আব্বা কিছু কও না কেরে?নাকি রাত্তিরে মাইরা গাঙ্গে ভাসায় দিমু?’
জসীম এবার মুখ খুলেন।চারদিকে নিজের ভেতর থাকা বিষ ছড়িয়ে বলেন,
‘কিছুই করবি না তুই।ওই শুয়োরের বাচ্চারে আমি কাইট্টা আটচল্লিশ টুকরা বানাইয়া কুত্তারে খাওয়ামু।সবুর কর সবকিছুর সঠিক সময় লাগে।’
–
দলা পাকানো থুঁথু মাটিতে ফেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় মুছে ফেললো পলাশ।শরীরের বিশাল ভারী চাদরে হাত মুছতে মুছতে গলা ছেড়ে ডাকে,
‘খোর্শেদ মিয়া গো।বাইত্তে আছো নি?থাকলে বাইরাইয়া আও।ও খোর্শেদ মিয়া।আছো!’
দুদিন আগের ঘটনা যেন তার মনেই নেই। লাহাড়ি ঘরে ব্যাটারি চালিত লাইট জ্বালিয়ে পড়ছিল কুঞ্জা।পলাশের পুরো ব্যাপারটা তার আয়ত্তে এসেছে।তার ধারণা এই মানুষগুলো যতো এই বাড়িতে আসে উঠান নোংরা করে।কুঞ্জার কথা সত্য করে দিয়ে আরেক দলা থুঁথু নিক্ষেপ করে পলাশ।ঘৃণায় কুঞ্জার মুখ থেকে ছুটে বের হয়ে আসে , ‘ছিঃ!’
পলাশ কথাটা শুনা মাত্রই মাথা বায়ে কাত করে তাকায় কুঞ্জার দিকে।কুঞ্জা দ্রুত না দেখার ভান ধরে আবার মন বসায় পড়াতে।পলাশ পানের কালসেটে দাঁতে বিশ্রি হাঁসি হাঁসে।কুঞ্জার ভেতরটা রি রি করে ওঠে পলাশের এই বিশ্রি হাঁসি দেখে।পলাশ সরু কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে এগিয়ে যায় কুঞ্জার দিকে।বলে,
‘কি লো ছেড়ি!অত পইড়া কি হইবো?বইনের মতো কলেজ পাশ দিবিনি?’
কুঞ্জা কথা বলতে পারেনা।তার ছোট্ট মস্তিষ্কের ভীতির সৃষ্টি হয়।পলাশ নামক লোকটা যে বিশ্রি মনমানসিকতার তা সে আরো অনেক আগেই বুঝেছে।লোকটার চাহনীও খারাপ।এর আগে তার আপা থাকতে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে আসতো ছোট ভাইয়ের সাথে তার আপার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।অথচ সুযোগে বাজে চোখে মেয়েদের গোপনীয় জায়গায় চোখ বুলাতো।ছোট্ট কুঞ্জার বয়স কম হলেও সে বুঝতো।পলাশের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবার কালচে দাঁতে হাসে সে।বিদ্রুপের কন্ঠে ঠাট্টা করে বলে,
‘মাইয়্যা মাইনসের এতো ত্যাজ ভালা না।তেঁজ দিয়ে কিছ্ছু করতে পারবি না যেই দিন তুইল্লা লইয়া যামু হ্যা!তোর আ…’
কথা শেষ করার আগেই পলাশের চোখ পড়ে হাসনাহেনার উপর।পুকুরপাড়ে গোসল সেড়ে ভেজা চুলে গামছা বেঁধে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই হেনার চোখে পড়ে পশাল।হাতের বালতি ভেজা জামা-কাপর সেখানে ফেলে দ্রুত এসে কুঞ্জার সামনে দাঁড়ান।কুঞ্জার চোখের কার্ণিশ সিক্ত হয় হাসনাহেনাকে দেখে।চোখের ইশারায় যেন স্বস্তি প্রকাশ করে।হাসনাহেনা কটমটে চোখে রেগে তাকান পলাশের দিকে।ফোঁস-ফাঁস শব্দ হয় তার দ্রুত নিঃশ্বাসে।হাসনাহেনার অবস্থা দেখে পলাশ হায়দার কিছুটা বিচলিত হয়ে পরে।মহিলা চুপচাপ থাকলে কি,তেজ আছে বটে।হাসনাহেনা ক্রমশ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে কড়া বলে,
‘তোমাগোরে কইছিনা আমি,আমার মাইয়্যাগো থেইক্কা দুরে থাকবা?কত্তো বার কইলে কানে ঢুকবো?’
পলাশ ফিক করে হাঁসে কথাটা শুনে।যেন এখানে বড় কোন সার্কাসের জোকার এসে প্রকান্ড কোন মজা করে বসেছে।হাসনাহেনার চোখ থেকে অগ্নি বর্ষিত হয়।খোর্শেদ বিদ্যালয়ের হেড মাস্টরের সাথে দেখা করতে গিয়েছে।লোকটার বারণ আছে হায়দার বংশের মানুষের সাথে হেনার কথা বলার।খোর্শেদ সবসময় বলেন,
‘ইতর আর ছোট লোকরে হেনা যতোই যতোই বুঝাও তাদের মনে খালি কিটই বাসা বাইন্দা থাকবো।তাই কথা কইতে নাই এইসব লোকের লগে।’
হাসনাহেনা খুব মান্য করেন খোর্শেদকে।তাই আবারো মাথা ঠান্ডা করে বলেন,
‘বাবা পলাশ ছোট থেইকা তোমারে বড় হইতে দেখছি আমি।তোমার বড় বয়সে।সম্মান দেখাইয়া কথা কওন উচিত তোমার।আর এসব পাপ ছইড়া আল্লাহ্’র কাছে মাফ চাও।আর এই বাড়িতে আইবা না।খারাপ হইবো কইলাম আইলে।’
শেষ কথাগুলো গম্ভীর আর শক্ত কন্ঠে বলেন হাসনাহেনা।পলাশের তাতে কোন হেলদুল দেখা যায় না।দাঁত কেলিয়ে হেঁসে বলে,
‘তা চাচি আমি কিন্তু তোমার ছুডু মাইয়্যারে আগে ভালা কইরা দেখি না।বড় মাইয়্যাডা তো রূপে আগুন।ছুডুডাও কিন্তু কম না।গায়ের রং ময়লা হইলে কি চেহারা,শরীর মাশাল্লাহ(মাশা’আল্লাহ)।আর কিছুদিন বাদে যগমগে যুবতি হইয়া গেরামের পোলাগো পাগল বানাইবো।এর চেয়ে এডার লাইগাও একটা…’
কথা শেষ হওয়ার আগেই আরেক দফা হাসে পলাশ।হাসনাহেনার ক্রোধ এবার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।গলার রগ দপদপ করে।হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে হাসনাহেনা আলগ ঘরের দিকে ছুটে যান।রজব বাজারে যাওয়ার আগে আলগ ঘরের সামনে বসে রামদা দিয়ে ডাব ছিল ছিল।দা এখনো সেখানেই পড়ে রয়েছে।হাসনাহেনা ত্রস্ত হাতে রাম’দা নিয়ে ক্ষিপবেগে পা ফেলে ছুটে আসেন।পলাশ কিছু বুঝে ওঠে নিজেকে বাঁচানোর পূর্বেই এক কোঁপ বসান পলাশের বুকের দিকটায়।পলাশ ছিটকে দূরে সরে যাওয়ার দরুণ বুকের সামনের অংশের পাঞ্জাবী ছিঁড়ে যায়।ডান হাতের বাহুতে মাংসপেশীর অতিগভীরে কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে।পলাশের হাত পা কেঁপে ওঠে।ব্যাথার চোটে বাম হাত দিয়ে ডান হাত চেপে মাটিতে পড়ে যায়।চিৎকার করে ওঠে।গলা ফেটে বের হয়ে আসে ‘ও আম্মা গো!’ ভয়ে সংকীর্ণ হয়ে কুঞ্জার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।এই বুঝিয়ে লুটিয়ে পড়বে সে সহস্র কণা রক্তের মাঝে।তবুও হাসনাহেনার চিত্ত শান্ত হয়না।আবার তেড়ে আসতে আসতে বলেন,
‘আয় তুই,আয় জানোয়ার।হাত দিয়া দেখা আমার মাইয়্যার গায়ে।তোর হাত দুইডা কাইট্টা কুত্তারে খাওয়ামু আজকে আমি।চোখ উপড়াইয়া ফেলামু।’
পলাশ ভয়ে ওঠে দৌড়ানো শুরু করে।জোরে দৌড়ানোর ফলে হোঁচট খায়।জুতা ছিড়ে যায়।পেছনে তাকিয়ে দেখে হাসনাহেনা দৌড়ে আসছে।জুতা খুলে ফেলে আবার কোন রকমে ওঠে প্রাণপণ দৌড়াতে থাকে।হেনা রাগে রাম’দা ছুড়ে মারে।দা উড়ে গিয়ে মাটিতে বিশাল আঘাত করে পড়ে।দা’য়ের শরীর অর্ধেক ঢুকে যায় মাটির ভেতর।পলাশ পালিয়েছে।হাসনাহেনার হাতে মুখে রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে থাকে।বাড়ির উঠান জুড়ে স্পষ্ট রক্তের ছাপ।হাসনাহেনা পেছন ফিরে দেখেন কুঞ্জা অজ্ঞান অবস্থায় লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
–
ঘরে এসে লম্বা সময় নিয়ে গোসল করে সমারোহ।মনের ভিতরটা কেমন ভারী হয়ে আছে।বুকে অযাচিত ব্যাথা স্পষ্ট।গোসলে যাওয়ার আগে ওয়াটার হিটার জগে পানি গরম হয়ে দিয়ে গিয়েছিল।এখন নামিয়ে টি-ব্যাগ ডুবিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।বাগানে লাগানো আম গাছটার সবচেয়ে বড় ডালটা এসে পড়েছে সমারোহর উন্মুক্ত বারান্দায়।অবাক করার মতো হলেও এই ডালেই সবচেয়ে বেশি হয় প্রতিবার।এক পলক গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।পানসে চায়ে এক বিষাক্ত চুমুক দিয়ে কি যেন ভাবে সে!
তখন কুহেলীর এভাবে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ায় সমারোহ বেশ খানিক চমকে ওঠলেও নিস্তেজ দাঁড়িয়ে ছিল।মানুষের মন বড়ই বিষ্ময়কর বস্তু।এ যে একই সময়ে কতো কিছু চায় আর অন্যায় আবদার করে তা কারো জানা নেই।এই যেমন এই মুহূর্তেই সমারোহর মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেল একটা।এ কথা মনে উঁকি দেয়ার কারণ জানে না সে।কুহেলী এভাবে চলে গেল বলে নাকি মৌসিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে তাই?আবার পরক্ষণেই মনে হলো কুহেলী কেন কষ্ট পাবে?সমারোহ তো তাকে কষ্ট দেয়ার মতো কিছু করেনি!আর কষ্টই বা পেতে যাবে কেনো।তবে মৌসির বিষয়টা ভিন্ন।কুহেলীর তাতে কষ্ট পাওয়ার নয়!হয়তো বা অন্য কোনো কারণে চলে গিয়েছিল।
ঘর জুড়ে অন্ধকার।সেযুঁতি চকিত হয় কুহেলীর ঘরে ঢুকে।অন্যান্য দিন এবেলা কুহেলী পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে।আজ সন্ধ্যা থেকে এই ঘরে লাইট জ্বলে নাই।রাতের খাবার টেবিলে প্রত্যেকে অপেক্ষা করছে কুহেলীর জন্য।ডাকাডাকিও হয়েছে একদফা।আনরুবার কোমর ব্যাথা বেড়েছে আবার।তাই নিজে না ওঠে সেযুঁতিকে পাঠিয়েছেন কুহেলীকে নিয়ে যেতে।
সেযুঁতি একবার ডাকে কুহেলীর নাম ধরে।সাড়া না পেয়ে লাইট অন করে দেখে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানার একাংশে জুবুথুবু হয়ে শুয়ে আছে কুহেলী।
লাইট অফ করে সেঁযুতি নরম পায়ে হেঁটে গিয়ে বসে কুহেলীর শিরদাঁড়ে।ধীরে মাথায় হাত রেখে বলে,
‘কাঁদছো তুমি?’
কুহেলী একপ্রকার চমকে ওঠে।মৃদু-মন্দা শীতল আমেজে চোখদুটো লেগে এসেছিল তার।সেযুঁতির স্পর্শ পেয়ে ঘুম ছুটে গিয়েছে।কাঁদছিল তো সে বটেই।তবে আঁধারে সুযোগ নিয়ে চোখ মুছে বললো,
‘না তো।বাড়ির কথা মনে পড়েছে যে!’
সেযুঁতির ওষ্ঠ স্ফীত প্রসারিত হয়।টিপ্পনী কেটে বলে,
‘কেন আমরা বুঝি পর!মন খারাপ করতে হবে কেনো শুনি?’
কুহেলী চুপ থাকে।ওঠে বসে আঙ্গুলের খোঁচায় এলোমেলো কেশযুগল খোঁপা করে।গায়ে ওরনা জড়িয়ে বলে,
‘চলো আপু।’
সেযুঁতি হেসে বলে,
‘আজ রাতে পড়বে বলে তো মনে হচ্ছে না!আমার এমনিতেও পড়াতে মন থাকে না।খাবার খেয়ে আড্ডা দিব আজ।’
কুহেলী মিষ্টি হেঁসে মাথা হালকা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানায়।খাওয়া শেষে বাড়ির সামনের বাগানের একাংশে কাঠে আগুন জ্বালানো ছোটখাটো ব্যবস্থা করা হয়।নয়না আর সেঁযুতির ইয়ার ফাইনাল শেষ হলো আগের সপ্তাহে।গল্প জুড়বার এই সুন্দর পরিবেশ।সান্দ্র,সমারোহও আছে।আর আছে বৈশাখী এবং শর্মিলা।তাদের মামাতো দুই বোন।একজন নয়নার সমবয়সী আরেকজন ক্লাস টেন এ পড়ে।
কুয়াশা চাদরে ঢাকা রাত যেন তাদের হাসি ঠাট্টায় নিজের নিঃস্তেজ বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে।ঝিঁঝিঁ পোকার ঘনঘন ডাক ভেসে আসছে কান অব্দি।কি সুশ্রাব্য সে শব্দের বুনন।থোকা থোকা জোনাকি পোকারা বাগানের গাছের চারিদিকে জটলা বেঁধে উড়ছে।পরিবেশটা উজ্জ্বল করতে আঁধারে জ্বলছে।আগুন জ্বালানো,গায়ে পশমী মোটা চাদর।তাতেও কুহেলীর শরীর শীত মানছে না।ঠোঁট অনবরত কেঁপে চলেছে কুহেলীর।
পাতলা গোলাপী ঠোঁটের কাঁপুনী যেন সমারোহ ভেতরে এক আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি করছে।কুহেলী এমনিতেই চুপচাপ।আজ আরো বেশিই নিস্তব্দ হয়ে আছে।ব্যপারটা প্রথম থেকেই বিচলিত করছে সমারোহকে।সকালে কুহেলীর এভাবে চলে যাওয়াটা এখনো ধোঁয়াশার মাঝেই আছে।তবে অত সব স্মরণের সময় এখন নেই সমারোহ।লাল আলোর আভা কুহেলীর দুধে আলাতা মুখে প্রতিফলিত হয়ে আরো রোমাঞ্জকর করে তুলেছে বিষয়টা।ঘন পাপড়ির কাজল কালো চোখের পিটপিট চাহনী সমারোহ চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।অগোছালো চুলের খোঁপা।কতো মায়াময় মেয়েটা!বিধাতা যেন নিজ হাতে কুহেলীর সৌন্দর্য্য ঢেলে দিয়েছে স্নিগ্ধতা।আর তা আস্বাদনের ক্ষমতাই খুঁজে ফিরছে সমারোহ।
কুহেলীর অপর পাশে সমারোহ বসে থাকলেও আজ যেন বেশ খানিকটা অগ্রাহ্য করে চলেছে কুহেলী তাকে।আসা থেকে এখন পর্যন্ত একটিবারের জন্যও ফিরে তাকায়নি কুহেলী তার দিকে।না চাওয়া সর্ত্যেও একই কথা বেঁজে চলেছে সমারোহ’র মন জুড়ে,
‘এতো রাগ কেন হবে একটা বাঁচ্চা মেয়ের!’
মেয়েদের অনুভূতির মূল্য এর আগে সমারোহ এর আগে খোঁজেনি।অভ্যাসবশত সে ‘মেয়ে’ নাম সৃষ্টি থেকে যথা সম্ভব বেঁচে চলার চেষ্টা করে।কিন্তু এই পিচ্চি মেয়ের জেদ উপেক্ষা করার মতো শক্তি আজ সে পাচ্ছে না আর রাগ ভাঙ্গানো মন্ত্রও তার অজানা।
কিছু সময় পর শর্মিলার সাথে বেশখানিক মিশুক হয়ে ওঠে কুহেলী।বৈশাখী একটু দূরত্ব বজায় রেখেছে।কুহেলী প্রফুল্ল মনে তার গ্রামের বর্ণণা দিচ্ছিল শর্মিলাকে।এটা যেন অনেকটাই বিরক্তিকর মনে হলো সমারোহ।কেন একটা মেয়ে তাকে অবগ্যা করবে?তাকে একবার দেখবে পর্যন্ত না!
সমারোহ হঠাৎ করেই বলে ওঠে,
‘গান শুনবি তোরা?গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে।তোরা চাইলে কিন্তু গাইতে পারি।’
সান্দ্র ভূত দেখার মতো লাফিয়ে ওঠলো।হন্তদন্ত হয়ে ওঠে গিয়ে সমারোহর কপালে হাত রেখে বলে,
‘শরীর ভালো আছে তোর?নাকি মাথা তার টার ছিঁড়া গেছে কয়েকটা।’
সমারোহ রাগি চোখে দেখে সান্দ্রকে।সান্দ্র দাঁত কেলিয়ে হাসে।চাপা গলায় বলে,’পিচ্চিরে শোনাইতে নাকি?’
সমারোহ সান্দ্রের মাথা চাঁটি মেরে বলে,
‘পাকছোস বেশি?গিটার আন তোর।যা ভাগ।’
সান্দ্র হালকা হাসে।সমারোহর গান সেই ছয় বছর আগে শুনেছিল।আজ আবার ভাগ্য হবে!ভাই তার স্বাভাবিক হবে তাহলে!সেযুঁতি,নয়নাও অবাক হয়ে।বৈশাখী খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
‘আমি কতো ভালোবাসি তোমার গান!কতো শুনাতে বলেছি।পাত্তাই তো দাও না।বলতে যে আর শুনাবাই না।আজ হঠাৎ মত পরিবর্তন!’
কুহেলী বৈশাখীর কথা শুনে আড়চোখে একবার তাকায় সমারোহর দিকে।সমারোহ ও দেখছিল কুহেলীকে।অসময়ে চোখে চোখে কিছু বার্তা আদান-প্রদান হয়ে গেছে।কুহেলী অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।সমারোহ তখনো সরায় না।কুহেলী আরেকবার দেখে।তখনো সমারোহ দেখছে তাকে।এবার ভীষণ লজ্জা আবৃত করে ফেলে কুহেলীকে।মাথা নিচু করে চোখ নামায় কুহেলী।মনে গভীনে ওঠে হাজারো উত্তাল ঝড়।ভাবে কতো বেশরম লোক!সবার সামনে এভাবে চেয়ে আছে।সান্দ্র গিটার নিয়ে এলেই সমারোহ গিটারে সুর তুলে,
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।’
চলবে.