আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-০৭

0
305

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৭.

দিনটা শুক্রবার।নয়নার বন্ধুরা ছোট্ট একটা বনভোজনের আয়োজন করেছে।কাল রাতেই নয়না সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে বৈশাখীকে সাথে নিয়ে।বাকিরা সকলে বাড়িতেই আছে।ব্যস্ততা নেই আজ কারো।আসলেমি সিক্ত ঘর জুড়ে বাড়ছে কুহেলীর পদচারণা।ভেতর সিড়িতে উপর থেকে নিচ আর নিচ থেকে উপর উঠছে আর নামছে কুহেলী।শেষ রাতটা তার কাছে জাহান্নামের মতোই ছিল।অস্থিরতায় ঘুম হয়নি একটুও।একটা মানুষের প্রতি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা অনুভূতি,আস্থা,আসক্তি নিঃশেষ করে দেয়া টা কি এতোটাই সোজা!নাকি সহজ মন থেকে সরিয়ে দেয়া?পারা যায় চোখের সামনে সেই লোকটাকে প্রতিবেলা দেখেও চোখের ভাষা লুকিয়ে ফেলা!এতটা সোজা?না সোজা না।কুহেলীর এখন মনের হচ্ছে শতসহস্র সৈন্য সামন্ত নিয়ে বিশাল যুদ্ধে নেমে, এখন যেন সে বড্ড একা।কোথায় তার সৈন্য কোথায়ই বা যুদ্ধ থেকে পালাবার ঘোড়া!তবে বাঁচতে হলে তো তলোয়ার তাঁক করতেই হবে‌।তবে হেরে যাচ্ছে সে। তছনছ হচ্ছে ভেতরটা।এক দিনের ব্যবধানে হাজারো হাহাকার বুকে জমা হয়ে দলা পাকিয়ে গেছে।সব এলো মেলো করে দিচ্ছে কুহেলীর।ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে পুরনো সময়ে, বাবার কাছে।বুকে মাথা রেখে খুব করে বলতে ইচ্ছা করছে।

‘তোমার কুহেলী ভালো নেই বাবা,একদম ভালো নেই।একদম না।’

কি করবে এখন সে!না জেনেই যে লোকটাকে সে মনের আনাচে কানাচে বিচরণ করতে দিয়ে ফেলেছে।সময়টা এখন থমকে গিয়েছে বটে,তবে স্থির নয়।ডাক্তারী পড়তেই চট্টগ্রাম শহরে পা ফেলা তার।বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে এখানে এসেছে কুহেলী।গ্রামের কুৎসিত চেহারাগুলোর বিকৃত মনকে দেখাতে এসেছে তার বিশাল ঝাপটানো পাখা।সমারোহ জীবনে উদয় হয়েছে মানে তো আর এই নয় যে তার জন্য কুহেলীকে থেমে থাকতে হবে!কুহেলী সামলে নিবে সবটা।যন্ত্রনার তীক্ষ্ণ তীরে ক্ষত হয়েও মানিয়ে নিবে।ভালোবাসা তো মানুষের শক্তি হওয়ার কথা,পিছুটান না।ভালোবাসলে ত্যাগ করাটাও শিখতে হবে।এটা বাস্তবতা,ভুল তো সে নিজেই করেছে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ভেতরে পুরে নিয়ে দুই তলার দিকে পা বাড়ায় কুহেলী।ফজরের আজান পড়বে একটু পর।শর্মিলা কুহেলীর ঘরেই ঘুমিয়েছে রাতে।শর্মিলাকে ডেকে নিয়ে সালাত আদায় করে কুহেলী।নামাজের পর জায়নামাজে বসেই ধর্মীয় আলাপ করে।শর্মিলার আগ্রহ দারুণ খুশি করেছে কুহেলীকে।ধর্মীয় এটা-ওটা কতো কিছু কুহেলী তাকে বলছে,বুঝাচ্ছে।শর্মিলা খুশি মনে শুধু শুনেই চলেছে।

শর্মিলা বেশি দুষ্ট প্রকৃতির।কুহেলীর কাছে তার দুষ্টুমিগুলো প্রশ্রয় পেয়ে ওঠেছে খুব সহজেই।তাই দুজনেই দুজনার প্রিয়।গতরাতে গল্পের আসরে কথায় কথায় জেনেছে কুহেলী বেশ ভালো রাঁধতে পারে।তাই সকাল থেকে আনরুবার পিছু নিয়েছে যাতে কুহেলী রান্না করে।কালক্ষণ মুখভার করে রাজিও হয়ে যায় আনরুবা।শর্মিলা,সেযুঁতি সাহায্য করে রান্নায়।আনরুবার আজ ছুটি।এতে অবশ্য জহির মনে মনে বেশ খানেক খুশিই হয়েছেন।ফুরফুরে মেজাজে তিনি আনরুবাকে বলেন,

‘তাহলে তো বেশ হইলো।চলো দুইজন একটু ঘুরে আসি?’

আনরুবাও বিনা বাক্য ব্যায়ে রাজি হয়ে গেলেন।তৈরী হতে যান ঘরে।
কুহেলী গ্রামের মেয়ে বলে রান্নায় বেশ পটু।শুকনো কড়কড়ে লাল মরিচ দিয়ে শুটকি মাছ বেটে ভর্তা করে আর শর্মিলা বসে বসে শীলপাটার ঘষার শব্দ শুনে।সেযুঁতি পিঁয়াজ কুচি করছে আর সমানে কেঁদে চলেছে।সান্দ্র মাইশার সাথে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হেলে দুলে নিচে আসছিল।সেযুঁতিকে কাঁদতে দেখেই কল কেটে দৌড়ে যায় সেদিকে।গিয়ে কিন্তু মোটেই জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো না ‘বোন তোর কি হয়েছে।’
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যপারটা ভালো করে দেখে চেঁচিয়ে বলে,

‘আম্মা,ও আম্মা!আব্বা! সমারোহ, নিচে আয় তাড়াতাড়ি।’

শর্মিলা একবার উঁকি দিয়ে সান্দ্রকে দেখে বললো,

‘কিরে ছোটদা,এমনে ষাড়ের মতো চিল্লাস কেন?’

ততক্ষণে সমারোহ নিচে চলে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে সমারোহর সেই কখন থেকেই ঘর থেকে বের হয়ে কুহেলীর চেহারাটা আরেকবার দেখতে ইচ্ছা করছিল।মেয়েটার সাথে তার কথার লেনাদেনা নেই। তবুও বারবার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে কুহেলী কি কষ্ট পেয়েছে,রেগে আছে!নাকি অভিমান করেছে মাত্র।তাই ডাকার আগেই ছুটে চলে এসেছে।নিচে আসা মাত্র সমারোহর সবার আগে সমারোহর চোখ পড়ে কুহেলীর উপর‌।উরনা কোমরে বাঁধা।চুলের বিশাল খোঁপা আধখোলা হয়ে পড়ে আছে কাঁধে।কপালের কাছটায় ছোটো ছোটো চুল গুলো উড়ছে।কিছু চুল আবার উন্মুক্ত হয়ে লেপ্টে পড়ে আছে ভেজা গলায়।চুলের গোড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে চকচক করছে‌।সমারোহর চোখ ধাঁধিয়ে যায়।মুচকি হাসির ঝলক ওঠে ঠোঁটে।কুহেলী তাকে মুগ্ধ করার মন্ত্র ভালোই রপ্ত করেছে!
আনরুবা একপ্রকার চেঁচামেচি করতে করতেই ঢুকলো রান্নার ঘরের দিকে।কুহেলী বাড়ির অতিথি।তার উপর ছোট একটা মেয়ে। রান্নাঘরে কেনই যাবে সে।

‘আমি বলছিলাম তোদের রাঁধতে হবে না।তাও আমার কথা কেউ কি পাত্তা দিলি?কেউ কি হাত-টাত কেটে ফেললি নাকি?’

আনরুবার কথা শুনে একপর্যায়ে হেঁসে উড়িয়ে দিল সান্দ্র। বললো,

‘আম্মা এইজন্যই , এইজন্যই আমি তোমারে বলি মেয়েগুলোরে আমরা-কাঠের ঢেকি বানাচ্ছো।একটু পিঁয়াজ কেটেই এমনভাবে কাঁদতেছে যেন জামাই মারা গেছে।’

সেযুঁতি কটমট করে রেগে বললো,

‘দেখছো আম্মা!কেমন করে।আর তুই নিজে যে খালি প্রেম করা ছাড়া আর কিছুই পারোস না?’

‘তাও তো সেটা ভালো ভাবেই পারি।তুই তো সেটাও পারোস না।’

‘প্রেম করা মনে হয় ভালো?’

‘তোর মতো খালি পইড়া পইড়া খাওয়ার চেয়ে এটা ঢের ভালো।’

মুহূর্তেই তাদের ঝগড়া বহুদূর এগিয়ে গেল। আনরুবা আল্লাহর নাম নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।এই ঝগড়া থামানো তার সাধ্যের বাইরে। অন্যান্য সময় সমারোহই ঝাড়ি দিয়ে চুপ করায়।এবার সেও কিছু বলছে না। চুপচাপ দেখছে এক ইঞ্চি পিচ্চিটার কি রাগ!কি অভিমান,জেদ!সমারোহ দাঁড়িয়ে আছে তাও একটাবার তাকাচ্ছে অব্দি না।উল্টো কাজ করে চলেছে আর সান্দ্রর সেযুঁতিকে জব্দ করা নিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কিছুক্ষণ ঝগড়া করার পর মাইশা আবার কল করলো সান্দ্রকে।এদিকে সেযুঁতির সাথে শর্মিলাও যোগ দিয়েছে ঝগড়ায়‌।নিজের দলের জোর কম দেখেও ভাব দেখিয়ে সান্দ্র বলে ওঠলো,

‘যাহ!যাহ! এইবারের মতো চেরে দিলাম।’

‘কেন ছাড়বি কেন?এখন কথায় পারস না বলে হার মানছিস?’ সমান তালে বললো সেযুঁতি।

‘আরে যা,যা!’

না শোনার ভান ধরে চলে গেল সান্দ্র।সেযুঁতি বিড়বিড় করে বললো,
‘কেমন শয়তান দেখছোস শর্মিলা।খালি আমার আর নয়নার পিছে পড়ে থাকে ঝগড়া করতে‌‌।’

কুহেলীর ভর্তা বানানো হলে বাটিতে করে ডাইনিং টেবিলে রাখতে আসতেই সমারোহ ধীর কন্ঠে বললো,

‘আমার ঘরে আসো তো একটু।কথা ছিল।’


বসা ভাত রেঁধেছে কুহেলী।সাথে আলু, শুটকি, বেগুন, ডাল, সিম, লেবু আর ধণিয়া পাতার ভর্তা।প্রায় সকলেই আঙ্গুল চেটেপুটে খেয়েছে একমাত্র সমারোহ বাদে।খাবার টেবিলে বসে দুই লোকমা খেয়েই ভালো হয়নি বলে চলে গিয়েছে ঘরে।কুহেলীর মনটা আরো খারাপ হলেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে।সত্যিই ভালো হয়নি রান্না?গ্রামে আব্বা তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিতে না পড়ার সময় নষ্ট হবে বলে,অথচ যেদিন সে রাঁধতো সেদিন বলতো,

‘আমার ছোট মায়ের হাতের রান্না সবচেয়ে মজার।’

দাদু তখন হো হো করে হাসতেন।
আনরুবা বেশ ক্ষুব্ধ হোন ছেলের এমন ব্যবহারে।চিন্তিত হয়েছেন ও বটে।সমারোহ সাধারণত এমনটা করে না। খাবার নিয়ে তো মোটেই না।সবার খাওয়া শেষ হয়।কুহেলী রেঁধেছে তাই খাবার পরিবেশনও কুহেলীই করলো।সে,সেযুঁতি আর আনরুবা বাকি। শর্মিলা খাওয়া শেষ করে টেবিলে বসে বসে ফোন টিপছে।আনরুবা একবার ভাবে হয়তো শরীরটা বেশি ভালো নেই তাই ভর্তা খায়নি সমারোহ।আগে ছেলের জন্য রান্না করে নিবেন তারপর তিনি খাবেন।দৃঢ় পদক্ষেপে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে সেযুঁতি বলে,

‘আম্মা, ওইদিকে কই যাও?খাবা না এখন? আমার তো সেই কখন থেকে পেট ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে এতো ঘ্রাণ শুনে!কত্তো প্রশংসা করলো সবাই।’

আনরুবা চিন্তিত কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলেন,
‘আব্বা আমার না খাইয়া চলে গেল দেখলি না!দেখি সাদা ভাত করি আগে।তোদের খাওয়ার আগে আমি খাইছি কোনদিনও?তুই আর কুহেলী খেয়ে নে।আমি ভাত রেঁধে নেই।’

কুহেলী আনরুবার কথাগুলোতে সামান্য ইতস্তত বোধ করলো।কেন যেন মনে হচ্ছে তার জন্যই ঘটলো বিষয়টা। সমারোহ তখন ডেকেছিল।কুহেলী রাগ দেখিয়ে যায়নি।অবশ্য তার এখনো মনে হচ্ছে না যেয়ে ঠিকই করেছে।তাই এখন ওর হাতের রান্না খেলো না।যাওয়ার সময় কুহেলীর দিকে রেগে কটমট করে তাকিয়ে ছিল‌ সমারোহ। কি রাগ লোকটার!এখন তার জন্য আনরুবা কষ্ট করবে আবার!

কুহেলী এবার আগ বাড়িয়ে আনরুবাকে বললো,
‘আন্টি আপনার আবার রাঁধতে হবে না।আমি একবার খাবারগুলো নিয়ে যাই ভাইয়ার ঘরে?না খেলে জোর করে খাইয়ে দিব।’

কুহেলীর কথা শুনে চকিতে তাকায় আনরুবা।মনে মনে ভাবেন সমারোহর জেদ সম্পর্কে হয়তো এই বাচ্চা মেয়েটার ধারণা নাই তাই এই কথা বলতে পারলো।একবার যখন বলেছে খাবেনা তখন আবার খাবার নিয়ে গেলে কি হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধাবে ভেবেই ভয়ে গলা থেকে পেট অব্দি শুকিয়ে আসে আনরুবার।খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে আনরুবা বলেন,
‘মা তোমাকে যেতে হবে না।পরে আবার রেগে যাবে ছেলেটা।ও এমনটা করে না কখনো হঠাৎ কেন করলো বুঝলাম না।তুমি মনে কিছু নিও না।’

বিশাল প্রস্বস্ত হাঁসি হেঁসে কুহেলী বলে,
‘আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি।বকবেন না।আর তাছাড়া আমার সাথে রাগ করে আছে।আমি গেলেই তো খাবেন।’

শেষের কথাগুলো একদম বিড়বিড় করে বললো কুহেলী। আনরুবা তা বুঝতে না পারে বলে,
‘কি বললে?শুনি নাই।’

‘কিছুনা কিছুনা।আপনি এসে বসুন তো।আবার কষ্ট করতে যাচ্ছেন।আমি ভাইয়াকে বলবো আপনি খাবেন না উনি খাওয়ার আগে।ঠিক খেয়ে নিবেন।আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

কুহেলীকে যেতে দেখে সেযুঁতি শর্মিলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,
‘নাচতে নাচতে তো চলে গেলো। বেমালুম আজ ওর ধর গলা থেকে আলাদা হয়ে যাবে।’

শর্মিলা হু হা হো করে হেসে ওঠে সেযুঁতির কথা শুনে।সেযুঁতি ভ্রুঁক্রুটি করে তাকায় শর্মিলার দিকে।শর্মিলা বাঁকা হেঁসে বলে ,

‘আপুনি তোমরা তো একেকটা দেখি বলদ।এতো দিন দেখেও বুঝো না কি চক্কর?’

সেযুঁতি যেন আকাশ থেকে পড়লো শর্মিলার কথা শুনে।কয়েক গুন বিষ্ময় নিয়ে বলে,

‘কি বলস খোলসা করে বল তো।এতো প্যাঁচাস কেন কথা?’ শর্মিলা দুষ্টু হাসি হাসে।

‘আমরা যখন সান্দ্র ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছিলাম? তখন সমারোহ ভাইয়া ফ্রিজ থেকে আপেল নিয়ে গেল না?’

‘কি জানি!’

শর্মিলা নিজের কপালে হাত ঠেঁকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘এজন্যই তুমি গাধা।ভাইয়া চুপিচুপি টুক করে কুহেলীকে তার ঘরে যেতে বলেছিল।’

এই কথা শুনেই শর্মিলার কাছ থেকে লাফিয়ে দূরে সরে আসে সেযুঁতি। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিমায় বলে, ‘কিহ!’

‘হ্যাঁ তো।আর কুহেলী যায়নি বলেই তো রাগ করেছে।মনে হয় কিছু চলছে একটা!’

গালে শাহদাত আঙ্গুল রেখে বলে শর্মিলা।

সেযুঁতি চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,’ডাকতেই পারে।এ এমন কি?’

‘হুম সেই তো।ব্যাপারটা একটু দেখতে হবে।’

কুহেলী খাবার নিয়ে হেলে দুলে চলে এলো তো ঠিকই। কিন্তু মনের ভিতর হাজারটা হাতুড়ি পিটানো শুরু হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে।ভেতরে থাকে ভীতু ছোট্ট মনটা চেঁচামেচি করছে ‘যাসনা কুহেলী। কিছুতেই যাস না।তোকে চিলি সসে ভিজিয়ে ভিজিয়ে আস্ত খাবে লোকটা। তারপরও বুকে ফুঁ দিয়ে সমারোহর ঘরে গিয়ে নক করে কুহেলী।

‘এসো।’ দাম্ভিকতার সাথে বলে সমারোহ।

চমকে ওঠে কুহেলী।তার নক করার আগেই যেন সমারোহ যেতে বলে দিল,যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।ভেতরে ঢুকে কুহেলী স্তম্ভিত কন্ঠে বলে,

‘আপনি বুঝলেন কি করে আমি আসবো?’

‘তোমার মতো অত ছোট মাথা আমার না।’

কুহেলীর হা’ মুখ টুক করে বন্ধ হয়ে গেল সমারোহর কথা শুনে। আবারও ছোট্ট একটা অপমান আক্রমণ করলো তাকে।লোকটা কথায় কথায় তাকে ছোট খাটো অপমান করতেই থাকে খালি।কুহেলীকে থ’মেরে থাকতে দেখে সমারোহ কপট রাগ দেখিয়েই বললো,
‘তখন আসতে বললাম,আসনি কেনো?’

কুহেলী খুঁজে পায়না কি বাহানা বানাবে।পেটে কথার পসরা সাজানো থাকলেও মুখে তার ছিটেফোঁটাও নেই।তাও চেষ্টা চালায়‌।মিনমিনে গলায় বলে,

‘আসলে আসতে নিয়েছিলাম।কি… কিন্তু শর্মিলা ই তো আবার টেনে নিয়ে গেল।তাই আসতে পারিনি।’

‘মিথ্যা খুব কাঁচা তোমার।’

কুহেলীর এবার মনে মনে যমের বাড়ি পাঠায় সমারোহকে। তার মাথার সুন্দর সুন্দর চুলগুলোকে সব টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।এতো কিছু কিভাবে বুঝে ফেলে লোকটা!সব সত্য কি তার চেহারায় লিখা নাকি?
সমারোহ মৃদু হেঁসে থমথমে গলায় বলল,

‘ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি।বলো বলো কেনো আসনি!’

চোখ বড় বড় হয়ে যায় কুহেলীর।এবারো বুঝেছে! মনে মনে আর কিছুই বলা যাবে না দেখি।নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে নত মাথায় অপরাধি গলায় কুহেলী বলে,

‘সরি।’

‘গুড।’

উরুতে চাপ দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় সমারোহ।কুহেলী ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে ঠায়ঁ দাঁড়িয়ে থাকে।আর কোন শব্দ কুহেলীর কানে আসে না।কিছু সময় অতিবাহিত হলে সামনে দিকে তাকিয়ে দেখে সমারোহ বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে কুহেলীর।কুহেলীর একবার মনে হয় সমারোহ যেন উল্কাবেগে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সমারোহর এহেন কান্ডে ঘাবড়ে যায় কুহেলী।ভয়ে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে জোরে জোরে। মনের মাঝে নামে ঝুমঝুমির বৃষ্টি। হঠাৎ হিঁচকি ওঠে যায়।হিঁচকি দিতে দিতেই লতারশ্মির ন্যায় শরীরটা হেলিয়ে-দুলিয়ে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে কুহেলী। সমারোহ বিনা দ্বিধায় পায়ের পর পা ফেলে এগিয়ে আসে।

পরপর দুই ছেলেকে আক্রমণ করার পরও চুপ থাকেন জসীম।মনে মনে ভীষণ বিগড়ে আছেন,নিজেকে কথা দিয়েছেন এই খোর্শেদকে গ্রাম ছাড়া না করে কিছুতেই ক্ষান্ত হবেন না তিনি।তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক রহমানকে ডেকে বলেন খোর্শেদের গোয়াল ঘরের দুইটা মোটাতাজা গরুর খাবার বিষ মিশিয়ে দিতে।রহমানও তাই করে।রাতের আধারে খুব সাবধানে বিষ মিশায় খোর্শেদের চার গরুর খাবারে।

ভোরে উঠে রোজ রজবকে সাথে নিয়ে মসজিদে যান খোর্শেদ,বাড়ি ফিরেন বাজার করে। সেদিন ভোরে একটু আগেই উঠেছিলেন তিনি,হাসনাহেনা তখনো ঘুমে বিভোর।কুঞ্জার কাছে গিয়ে দেখেন সেও ঘুমাচ্ছে।মেয়ের কাছে কিছু সময় বসে ঘুমন্ত কুঞ্জার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।তার মেয়ে দুটো যে মন শান্ত করার টনিক।কালক্ষণিক হাত বুলান মেয়ের মাথায়,কুঞ্জা আরাম পেয়ে নেড়েচেড়ে আবার ঘুমায়।ভোরের আলো তখনো ফুঁটবে ফুঁটবে করে ফোঁটেনি, চারদিক কালসেঁটে, নিস্তব্ধ।রজব বাড়িতে নেই দেখে পুকুরপাড়ের দিকে যান খোর্শেদ,হাতে সাদা টুপি।যেমন ধারণা করেছিলেন ঠিক তেমনটাই!পাকা করা পুকুর পাড়ে বসে পানিতে ঢিল ছুড়ছে রজব।খোর্শেদ শব্দ না করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চকিত হয়ে ওঠে রজব।উঠে দাঁড়াতে নিলে খোর্শেদ তার পাশে বসেন।দুজনই নিঃশ্চুপ, পুকুরের হিমশীতল পানি থেকে ধোঁয়া উঠছে, পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছের পাতায় জমানো শিশির টুপটাপ করে পানিতে পড়ছে,শব্দ হচ্ছে না; কোথাও কোনো রা নেই।পাখিরাও এখনো ঘুমোচ্ছে।খোর্শেদকে চুপ থাকতে দেখে রজব ও চুপচাপ রইলো, একদৃষ্টে চেয়ে থাকে পানির দিকে।খোর্শেদ বেশ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

‘তোকে নিষেধ করেছিলাম না? ভোরের শীতে পুকুরপাড়ের দিকে আসবি না?ঠান্ডায় ধরলে তারপর বুঝবি!’

রজব দাম্ভিকতার সাথে বলে,
‘কুহু আপার সাথে রোজ বসতাম তো হেল্লাইগা অভ্যাস হইয়া গেছে।’

খোর্শেদ হাসেন কিন্তু কিছু বলেন না মুখ ফুটে কিন্তু তবুও মনের যন্ত্রণা মাখা আকাশ চোখে মুখে সুস্পষ্ট হয়।রজব খোর্শেদকে দেখে কেমন নির্লিপ্ত নির্বিকার হয়ে গেছেন মানুষটা।তারপর বলে,

‘কুহেলী একবার আইতে পারে না এই গেরামে?আমাগোরে কি দেখবার ইচ্ছা করে না?মন একটুও কান্দে না?ওরে কও না একবার আইতে।’

রজব যেন তার নিত্যদিনকার আবদার করছে খোর্শেদকে।আশঙ্কায় মন বিষিয়ে আসে মোরশেদের।আতংকের বিষাক্ত সফেন উথলে উঠে তার মনে,ছোবল দেয় তাকে,বিষাক্ত ছোবল।মেয়েটা কেমন আছে কে জানে?ঠিকমতো খাচ্ছে কি? আচ্ছা সে কি বাবার কথা ভেবে কাঁদে রোজ?পড়ে ঠিক মতো?খোর্শেদের ধ্যান খুব বেশি সময়ের জন্য হয়নি কুহেলিতে।গোয়াল ঘরে গরুর চিৎকার শুনে সম্মতি ফেরে তার।গলা ছেড়ে ডাকছে গরুগুলো।খোর্শেদ বলেন,

‘দেখ তো রজব, গরুগুলো এমনে কখনো তো ডাকে না! শেয়াল আসলো নাকি? ইদানিং শেয়ালের উপদ্রব যা পড়েছে!এইতো সেদিন আম বাগানের মালিক রামবাবুর একটা আস্ত ছাগল নিয়ে গেল শেয়ালে!’

রজব দ্রুত উঠে এলোমেলো পায়ে চলে যায়,খোর্শেদ ও যায় পিছুপিছু।
গোয়াল ঘরে গিয়ে চমকে উঠে রজব,চোখ আকাশে উঠে যায় তার!তিনমাস আগে জন্ম নেওয়া বাছুরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা।খোর্শেদ পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন, গোয়ালঘরে তার সাপ ঢুকলো কি না!রজব গিয়ে হাসনাহেনাকে ডেকে তোলে, তারপর যায় ডাক্তার ডাকতে।

গোটা শিমুলপাড়ায় পশুর ডাক্তার মাত্র একজন, বহুকাল ধরে এ পাড়ায় থাকতে থাকতে তার নাম হয়েছে মিঠু-গরুর-ডাক্তার। অবশ্য ব্যাপারটা হাসির হলেও এতে তার কোনো ভাবান্তর নেই।যার যা খুশি ডাকুক না!
মিঠু গরুর ডাক্তার এসে ছোট্ট বাছুড়টাকে পরীক্ষা করে বললেন তার খাবারে কেউ হয়তো বিষ মিশিয়ে দিয়েছে!

চলবে.