আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
308

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৩.

ফকফকে পরিষ্কার আকাশের মাঝে দু’চারটে গুচ্ছ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।যেন কারো পাঠানো চিঠি খুব সাবধানে পৌঁছে দিচ্ছে তার প্রিয়সীর কাছে।ঠিক যেন আকাশ মোড়ানো চিরকুট! কুহেলীর ও পাঠাতে ইচ্ছা করে চিঠি।আর কাউকে নয়, নিজের পাশের মানুষটিকে; সমারোহকে।কাছে থেকেও অনেক সময় মুখে কিছুই বলা যায় না। পাশাপাশি থেকেও হাতটা ছোঁয়া যায় না,চোখে চোখেও কথা হয়না আর না হয় মনের সুপ্ত বাসনা আদান-প্রদান!মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেও মানুষটাকে বলা যায় না তোমায় চাই! শুধুমাত্র তোমাকেই আমি চাই‌।বলা বারণ কিংবা বলেও যদি না পায় তাই হয়তো বলা হয়ে ওঠেনা।আর নয়তো প্রিয় জিনিস প্রকাশ করলে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকেই মানুষ তার প্রিয় জিনিসটা সবার কাছ থেকে লুকাতে চায়। অদ্ভুত হলেও এটা বাস্তবতা।

কুহেলী একপলকে চেয়ে দেখে সমারোহ।একটু আগের সমারোহ নয়, ক্লান্তি ঘেরা এক মানুষকে।স্কলারশীপ পায়নি বলে মন খারাপ সমারোহর।মুখ গুমোট করে ভাবনায় মত্ত হয়ে আছে।কুহেলী পাশে বসে আছে সমারোহের।ঠিক পাশে। সমারোহ ক্লান্তি জড়ানো কন্ঠে বলে,

‘মানুষ পথ চলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়ে পড়বে,ব্যাথা পাবে তাও তাকে উঠে দাঁড়াতেই হয়, তাইনা?’

‘না দাঁড়ালে আবার এগিয়ে যাবে কি করে!’

সমারোহ সচকিত হয়ে দেখে কুহেলীকে।এভাবে তাকানোতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কুহেলী। সাধারণত সমারোহর কথার জবাব কুহেলী দেয়না‌, চুপচাপ শুনে যায়‌। হঠাৎ উত্তর করাতে চমকায় সমারোহ।তারপর আবার সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘হুম।’

একটু থেমে আবার বলল,
‘আমি খুব কষ্ট করেছিলাম কুহেলী। দিনরাত পড়েছি।’

আবার পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে যায় দুজনাকে।কুহেলী চেয়েও কিছু বলার শব্দ খুঁজে পায়না। মাগরিব নামাজ পড়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে এসেছে সমারোহ আর কুহেলী। সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হয়নি।সন্ধ্যার এই সময়টাতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। মানুষজন কিছুটা কমেছে। কোলাহল কলরব নেই বললেই চলে। শুধু বিশাল বিশাল ঢেউয়ের শব্দ।হিমশীতল মোহময় গন্ধ!বিশাল বড় একটা পাথরের উপর বসে আছে দুজনে। কষ্ট ভাগাভাগি করার চেষ্টা করছে হয়তো। সমারোহরকে এতটা নিরব আর বিধ্বস্ত কুহেলী আর কখনো না দেখেনি।কুহেলী কান্না পায় সমারোহকে এভাবে দেখে। আবেগী হয়ে সে বলে,

‘একটা পরীক্ষা বিফলে গিয়েছে তো আরো হাজারটা পরীক্ষার সুযোগ আছে।এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়বেন?’

সমারোহ মৃদু হেসে বলে,
‘আমি এটার জন্য মন খারাপ করছিনা‌। আমার নিজের মেধার উপর এতো টুকু বিশ্বাস আছে,আজ নয় কাল আমি ভালো কিছু করবোই।’

‘তাহলে?’

‘আমার চলার পথে এতো এতো অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হয় যাতে আমি নিজেই ঘাবড়ে যাই আমার কি করা উচিত আর কি করছি।’

‘কি নিয়ে ভাবছেন আপনি?’

‘আ…।’

বলতে নিয়েও থেমে যায় সমারোহ।কুহেলীর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে।মেয়েটা কি মনে ভেবে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সমারোহ চিন্তিত হয়‌।আলোকে সে মন থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য সবকিছু করেছে। ঘৃণার চোখে দেখে সে আলোকে।আসলেই কি!নাকি এখনো আলোর জন্য এর মনে ভালোবাসা আছে!
সমারোহ জানে নেই।তাহলে সারিকা কেনো বললো সে এখনো আলোকে ভালোবাসে? সমারোহর মাঝে এমন কিছু দেখেছে সে?বিষিয়ে আসে মনটা।
সমারোহ একবার কুহেলীর হাত ধরতে গিয়েও ধরে না।কুহেলীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘যদি বুঝতে চাও তুমি কাউকে চাও কিনা কিভাবে বুঝবে?’

কুহেলী আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুনিয়ে বলে,
‘শুধু তার হাসির দিকে একবার তাকিয়ে দেখবো,তা যদি আমার কাছে মূল্যবান হয় তবে তাকে আমি চাই।’

সমারোহ ঘাবড়ে যায়। ভীষণ রকম ঘাবড়ে যায়।বুকটা ছলাৎ করে উঠে। অকস্মাৎ বোধ হয় শুধুমাত্র কুহেলীর হাঁসিই তার কাছে খুব মূল্যবান মনে হয়‌,বিভ্রম জাগায়।তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে সমারোহ বলে,

‘উঠে এসো।রাত হয়ে যাবে নয়তো বাড়ি যেতে‌।’

__________________
পরিবেশ তেমন একটা ভালো না।একটু আগেই বৃষ্টি নেমেছিল।কুঞ্জা বৃষ্টিতে ভিজেছে খুব প্রফুল্ল মনে। বৃষ্টিতে ভিজলে তার কঠিন জ্বর আসে। কিন্তু এবার আসেনি। রমলা, হাসনাহেনার হাজার বারন আজ সে শুনেনি। হাসনাহেনা অবশ্য এ নিয়ে বকেছেন খুব।পরশু থেকে স্কুলে বার্ষিক। এমনিতেই যা সব কান্ড হলো এরপর আবার অসুস্থ হলে যা নয় তা একটা অবস্থা তৈরি হবে। রমলা কয়দিন যাবৎ কুঞ্জার মধ্যে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। কিন্তু তেমন একটা গুরুত্ব দেননি‌।সবার ধ্যান ফিরল যখন পরীক্ষা দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে।

দিনটা বৃহষ্পতিবার।রজব গরুগুলোকে নিয়ে মাঠে গেছে ঘাস খাওয়াতে।খোর্শেদ আর কুঞ্জা স্কুলে, আজ থেকে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে।হাসনাহেনা গাছ থেকে কচি লেবু আর বাড়ির পিছনে অযত্নে অবহেলায় বড়া হওয়া কচুর লতি নিয়ে এসে রান্না চড়ান।কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ আর আলু দিয়ে পুঁইশাকের ফুল রাঁধবেন আজ; রজবের খুব প্রিয়।রমলা পুকুরঘাটে বসে থালাবাসন মাজেন।
হঠাৎ খোর্শেদের গলা পেয়ে হতচকিত হয়ে ওঠেন হেনা।আরো দেড় ঘণ্টা বাকি পরীক্ষা শেষ হতে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর খাতাপত্র গুছিয়ে রেখে আসতে আসতে আরো সময় লাগবে।এখনি বাড়ি আসার তো কথা না।হেনা রান্নাঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে খোর্শেদকে দেখে বলেন,

‘এতো তাড়াতাড়ি আইস্সা পড়লেন যে!আপনেরে ডিউটি দেয়নাই আজকে?নাকি শরীরটা খারাপ করছে?’

খোর্শেদ তড়িঘড়ি করে ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

‘তাড়াতাড়ি বোরকা-নিকাব পইড়া লও।কুঞ্জা আবার অজ্ঞান হইয়া গেছে,মুখ থাইক্কা ফেনা পড়তাছিল। হাসপাতালে নিয়া গেছে জুলেখা আপা আর হাসান মাস্টরে। তোমারে নিতে আইলাম। তাড়াতাড়ি করো।’

হাসনাহেনার যেন পায়ের নিচের মাটি সরে যায় খোর্শেদ কথা শুনে।চোখ উপচে অশ্রু ঝরে। দৌড়ে গিয়ে খোর্শেদের বুকে দুই হাত রেখে আর্তনাদ করে বলেন,

‘কি হইছে আমার কলিজার?আমার মাইয়ার কি হইছে। আল্লাহ্! আমার মাইয়াটার কতো কষ্ট হইতাছে!’

খোর্শেদ হাসনাহেনাকে চেপে ধরেন নিজের সাথে।বুকটা তারও জ্বলছে‌।তার হৃদয় দুই অংশে বিভক্ত হয়ে দাবানলের দাবদাহে পুড়ছে।তার দুই পৃথিবী কেমন যেন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।কুহেলীকে চোখের সামনে পাচ্ছে না আর কুঞ্জা চোখের সামনে থেকেও কষ্ট পাচ্ছে খোর্শেদ কিছুই করতে পারছেন না।নিরবে চোখের কার্ণিশ চিকচিক করে তার।বাবা হওয়ার এই যন্ত্রণা, মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারেনা আবার শক্ত খোলস ছুড়ে ফেলে নিজের অনুভূতিটা প্রকাশও করতে পারেন না। কারণ বাবারা তো সন্তানের কাছে বটবৃক্ষের ন্যায়। তাদের বুকে সন্তানেরা আশ্রয় নেবে।তাকে ভেঙে পড়লে তো চলবে না!

হাসনাহেনাকে নিয়ে হসপিটালে আসেন খোর্শেদ।কুঞ্জা তখন মোটামুটি সুস্থ।হাতে সেলাইন লাগানো। হাসনাহেনাকে দেখে মুচকি হাসে সে। হাসনাহেনা মেয়ের কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দেন আর নিরবে কাঁদেন।কুঞ্জার বেশ কয়েকটা টেস্ট করান ডাক্তাররা,তারপর বাড়ি যেতে দেন। টেস্টের রিপোর্ট দিবে দুইদিন পর। আপাতত কুঞ্জাকে তাদের সুস্থই মনে হয়েছে। ক্লান্ত শরীরে রাত জেগে পড়ার কারনে হতে পারে এমনটা।
কুঞ্জাকে সেদিনই বাড়ি নিয়ে আসা হয়‌। রমলা এবার খোর্শেদকে রাগ দেখিয়ে বলেন,

‘সেই কবে আমি আইতে কইছিলাম হুজুরের।এখনো আনোস নাই।উনি একবার দোয়া কইরা যাক মাইয়াটার লাইগ্গা।না আমার কথা তো শুনি না।বুড়ি মানুষের কথায় দাম আছে নি!’

‘কি যে কও আম্মা, হুজুরে আসতে বলছিলাম সময় পায় নাই হয়তো। আবার ব্লু আজকে নামাজে গেলে।’ বলেন খোর্শেদ।

হুজুর আসেন বাড়িতে।দোয়া পড়েন,পড়া পানিও দিয়ে যান।রমলার মন এবার ক্ষান্ত হয়।পরপর দুইদিন ছুটি থাকায় স্কুলে যেতে হয়নি।কুঞ্জা এবার পুরোপুরি সুস্থ। পড়ালেখাও করে মন দিয়ে। কিন্তু পরের পরীক্ষাতেও জ্ঞান হারায়। পানির ঝাপটা দিয়েও জ্ঞান ফিরানো যায় না। কিছু সময় পর আবার সুস্থও হয়ে যায়।পরপর চারটা পরীক্ষা মিস হয়ে যায় এভাবেই‌। মেডিক্যাল রিপোর্ট সব ঠিকঠাক, কোনো সমস্যা নেই।কি হচ্ছে,কেন হচ্ছে কোনো কুলকিনারা পায়না খোর্শেদ। হাসনাহেনাও কুঞ্জার চিন্তায় পাগল প্রায়।

এর মাঝে ঘটে আরেক ঘটনা, পুকুর পাড়ে সখ করে গোসল করতে গিয়ে আবার জ্ঞান হারায় কুঞ্জা।রমলা আর পাশের বাড়ির কুঞ্জার বান্ধবী চৈতি ছিল সাথে।হাসনাহেনা মেয়েকে কোথাও একা ছাড়তে ভয় পান এখন। সেদিন বিকালে জসীম হায়দার আসেন বাড়িতে।কুঞ্জাকে তখন ঘুম পাড়িয়ে দরজার সামনে মোড়াতে বসে কাঁথা সেলাই করছিলেন হাসনাহেনা।খোর্শেদ স্কুলের পরীক্ষার খাতা কাটছিলেন বাড়ির উঠানে বসে আর রজব খাতায় প্রাপ্ত নম্বর রোগ করে সামনে লিখে দিচ্ছে।
জসীম হায়দার বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলেন,

‘খোর্শেদ মিয়ার মাইয়্যাটা নাকি অসুস্থ শুনলাম?’

জসীমের পেছন পেছন ছাতা নিয়ে রহমান আসে।লোকটার চেহারা দেখতে বিদঘুটে, ক্ষোয়া যাওয়া লালচে দাঁতে বিশ্রি হাঁসি হাসে সে। ময়লা শার্ট আর ছিড়া একটা লুঙ্গি পড়া।খোর্শেদ জোরপূর্বক হেঁসে বলেন,

‘অনেকদিন থেইক্কাই।’

জসীম উঠানের মাঝামাঝি আসলে রহমান দূর থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে তাকে বসতে দেয়। জসীম বসতে বসতে বলেন,

‘আমার পোলাডারে তোমার বউ সেইদিন রামদা দিয়া কুপাইতে আইছিল,এরপরো আমি তো তোমাগোরে মাফ কইরাই দিসিলাম।আমার দয়ার শরীর।তয় আল্লাহ ছাড়ে নাই!’

জসীম কথাটা শেষ করে কটমটে চোখে তাকায় হাসনাহেনার দিকে। হাসনাহেনা তার পানে তাকাতেই আবার চোখে নরম করে বলেন,

‘ডাক্তার দেখাইছোনি মিয়া? আমার তো মনে কয় ডাক্তার-টাক্তারে কিছু হইবো না,মাইয়্যার উপর ভুতের আছর পড়ছে। নদীর ধারে যাইয়্যা নাকি বইয়্যা থাকে,গেরামের মাইনষে কয়?’

খোর্শেদ চুপ করে থাকেন। কিছু আর বলতে ইচ্ছা করে না।মূলত হাসনাহেনার বিষয়টা তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। হাসনাহেনার অমন একটা কাজে যদি জসীম হায়দার গ্রামে সালিশ বসাতো তাহলে হয়তো তাদের গ্রাম ছাড়াই হতে হতো। তার যুক্তিমতে কেউ কারো ক্ষতি করতে চাইলে দিন শেষে আল্লাহ অনিষ্টকারীর উপরেই তার অন্যায় ছুঁড়ে ফেলেন।
খোর্শেদকে চুপ থাকতে দেখে তৃপ্তি হয় জসীমের।এই বাড়ির প্রত্যেককে কোনঠাসা করে তবেই তিনি তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন। জসীম হাস্য উজ্জ্বল চেহারায় বলেন,

‘তা তোমার বড় মাইয়্যা কি আর আইবো না? আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা লইতে যাইয়ো না, আমার লগে পাইরা উঠবা না বুঝলা!পড়ে এমন আবার না হইলো গেরামের কারোর কাছে মুখই দেখাইতে পারলা না।’

জসীমের কথায় ছ্যাৎ করে উঠে খোর্শেদের বুকে। তেঁতিয়ে উঠে বলেন,

‘কি কইতে চাইতাছেন?’

জসীম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

‘যতদিন মাইয়্যারা কাছে আছে আদর কইরা সামলাইয়্যা রাখো বুঝলানি মাস্টার মশাই, কবে কি হইয়া যায় কে জানে! টগবগে মাইয়া একটারে কোনহানে নিয়া থুইয়্যা আইছো!আরেকটা যুবতী হইতাছে।’

পান খাওয়া কালসিটে দাঁতে হাসে জসীম।পানের পিক উঠানে ফেলতে নিয়েও ফেলে না।বলে,

‘আজকা চললাম আমি। আবার আমু। তোমার বড় মাইয়্যার লাইগ্গা আমার ষাঁড়ের লাহান তেজি পোলাটা বিলাই হইয়্যা বইয়া আছে। কতদিন আর লুকাইবা, টগবগে সুন্দরী মাইয়্যা।’

কথাগুলো বলতে বলতেই খোর্শেদের বাড়ি ত্যাগ করেন জসীম।খোর্শেদের বুকে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়‌। হাত-পা কাঁপতে থাকে, চারিদিকে আঁধার নেমে আসে।চোখ বুজে আসতে চায়।
তার মেয়েরা তার পৃথিবী।
বড়ই আদরের!
বড়ই সোহাগে মাখা!

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৪.

আটতলায় ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রিমা। দূরের, অনেক দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এক নজরে।আজ প্রথম সে শাড়ি পড়েছে। হলুদ আর লাল মিশেল কাতান শাড়িটা মাখামাখি হয়ে আছে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে।আবিরের খুব পছন্দের রং দুটো। চুল খোলা, এলোমেলো হয়ে আছে।চোখ দুটি ঢাকা পাতলা ফ্রেমের চশমার আড়ালে।চন্দ্রিমার কেনো জানিনা বুকের মাঝখানটা চাপ দিয়ে আছে;ব্যাথা হচ্ছে। আকাশের বিশালতা দেখে কি তার হিংসে হচ্ছে?নাকি দূরের নদীটা দেখে মন বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে!রাতে যদি জোনাকি আসে তবে ঝলমলে লাগবে এই নদীটা! রহস্যময় হবে কি?ঢাকা শহরে আবার জোনাকি আছে নাকি,যতসব উটকো ভাবনা।আবির চুপিসারে এসে দাঁড়ায় চন্দ্রিমার পাশে। চন্দ্রিমা তাকায় না,আবিরও তাকে দেখে না।চোখ বুজে রেলিং এ দুই হাত ভড় দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আজ চলে যাচ্ছি, অনেক দূরে।’

‘হুম।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর চন্দ্রিমার।

‘আর কেউ হয়তো জ্বালাবে না তোমাকে। আগামী পাঁচ-ছয় বছরে আসা হবে না হয়ত।’

‘ওহ!’

চন্দ্রিমার উত্তরগুলো ক্ষতবিক্ষত করে আবিরকে।ছাদ ভর্তি গাছ।এমন কোন ফুল গাছ বোধহয় নেই যেটা আরশের ছাদবাগানে নেই।হালকা বাতাস এলেই রজনীগন্ধার পাপড়ি অগোছালো হয়ে ঝড়ে পড়ে এদিকওদিক।মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে বশীভূত করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয় গন্ধরাজ গাছটা। কিন্তু আবির তো ফুলে নয় তার রাতের চন্দ্রে ডুবতে চায়।আবির আবারো নিজেকে বেহায়া ভেবে বলে,

‘ভালোবাসাও আর ভিক্ষা চাইবে না কেউ।ভালো থাকবে না তুমি!এটাই তো চেয়েছিলে।মনে আছে চন্দ্রিমা আমি প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম! তুমি তো ঠিক করে দেখোনি হয়তো,তবে স্তব্দা লেগে গেছিলাম আমি।আমার চোখজোড়া সরছিলো’ই না তোমার থেকে। সেদিনও হলুদ জামার পড়েছিলেন।যেন সূর্যমূখী ফুল খেলা করে বেড়াচ্ছিল।পুরো বিয়ে বাড়ির জাঁকজমকতার মাঝেও আমার চোখ আটকে গিয়েছিল আমার পরীটাতে।’

চন্দ্রিমার চোখের কার্ণিশে কেনো যেনো জল উপচে আসে।আবির তার মনের অনেকটা জায়গা জোর করে দখল করে নিয়েছে। কিন্তু সে বাংলাদেশ ছেড়ে কিছুতেই যাবেনা।সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার মতো পাষান মন এখনো তৈরি করতে পারেনি চন্দ্রিমা,পারলে হয়তো যেতো।সে না পাড়ছে আবিরকে কাছে টানতে আর না পারছে আবিরের চলে যাওয়া মানতে।
গত পরশু চন্দ্রিমার বাবা-মা ঢাকা এসেছে আবিরের বাসায়। চন্দ্রিমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করে ঘোরোয়া ভাবে বিয়েটা করিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। গতকাল তাই চন্দ্রিমাকে নিয়ে এলো আরশ তবে মেয়েটা নাছোড়বান্দা।আবিরো জোর করতে চায়নি। অপেক্ষাই নাহয় করুক যতদিন না চন্দ্রিমা তার কাছে আসতে চায়।হয়তো চন্দ্রিমা তাকে ভালোবাসে না,তাকে বিয়েও করবে না।তবে ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়া আর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা দুইয়ের মাঝেই অনেক সুখ।
চন্দ্রিমা টানাটানা চোখের পানি লুকিয়ে নিতে সক্ষম হয়,শরীর মৃদু বাঁকিয়ে বলে,

‘আন্টি শাড়ি পড়ালো, আপনার জন্য। সবসময় তো যেচে এসে বলেন আজ বলবেন না কেমন লাগছে?’

‘না।’

‘কেনো?’

‘তখনো ভাবতাম তুমি আমার হবে। তোমার মনে হয়তো আমার জন্য জায়গা রয়েছে একটু হলেও। আমি হয়তো অধিকার খাটাতে পারি চাইলেই। আমার সব আশাই ভেঙে যাচ্ছে।’

‘এতো সস্তা অধিকারবোধ নিয়ে আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেন? চমৎকার।’

আবির হতাশ হয়।মেয়েটার সাথে সে পারেনা। চন্দ্রিমা কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে আসে।ঘরে এসে অনেকক্ষন কাঁদে। সবকিছু গুছানো শেষ।আজ হয়তো আবিরের সাথে তার জিনিসপত্রও গুছানো হতো। আবিরের সাথে পুরোটা জীবন কাটাবার উদ্দেশ্য পাড়ি দেয়া হতো অনেক দূরে।আবিরের স্ত্রীও সে হতে পারতো।এতো এতো রঙিন ভালোবাসার মালিকানা থাকতো কেবল চন্দ্রিমার নামে। কিন্তু সময়টা রঙিন হয়নি,হয়েছে পুরনো ছায়াছবির ন্যায় সাদাকালো।চন্দ্রিমা তার কথায় অনড়। বিদেশ যাবে না সে,তাই আবিরকেও বিয়ে করবে না। চন্দ্রিমার বাবা-মাও রাগে কথা বলছেন না মেয়ের সাথে। আজকাল ভালো ছেলে পাওয়াই দায়, সেখানে আবির এতো নম্র-ভদ্র ,সৎ , চন্দ্রিমাকে ভালোবাসে তাও মেয়ের এতো জেদ কেনো থাকবে!
আবিরের ফ্লাইট রাত তিনটায়।বাসা থেকে বের হবে রাত বারোটা নাগাদ।ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবার থেকে বিদায়ও নিয়ে নিয়েছে সে।চন্দ্রিমা শুধু তার ঘর থেকে বের হয়নি‌। আবির আর চন্দ্রিমার বাবা-মা ,আরশ যাবে তাকে সি অফ করতে।আবির শেষ বারের মতো বিদায় দিতে। চন্দ্রিমার ঘরে দু-তিন বার নক করেও ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসে না। চন্দ্রিমাকে ডাকলেও উত্তর করেনা সে।বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে আবির আর সঙ্গে সঙ্গে হতচকিত হয়ে যায়।
ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা চাপিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই হাওয়ার গতিতে এসে তাকে ধাক্কা দেয় চন্দ্রিমা। দরজার সাথেই জোরে বারি খায় আবির।নিজে সামলে নেয়ার আগে তার বুকে সজোরে আবারো ধাক্কা দিয়ে বলে,

‘বলেছি না আমার থেকে দূরে থাকুন? বারবার কেনো এসে দাঁড়ান আমার সামনে?যান চলে যান।আর কোন দিন আমার সামনে আসার চেষ্টা করবেন না।’

আবিরের চোখে এবার জল চলে আসে।চন্দ্রিমাকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘চ-ন্দ্রি-মা আমি…।’

আবিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই চন্দ্রিমা হাত জোড় করে চেঁচিয়ে উঠে,
‘আপনি বুঝেন না আমি কি বলি?চলে যান।সহ্য করতে পারি না আমি আপনাকে। আপনার কিছুই আমার সহ্য হয়না।আমাকে একটু শান্তি দিবেন?’

আবির আর মুহূর্ত থাকতে পারে না সেখানে।মরে যেতে ইচ্ছা করে তার।চোখের জল মুছতে মুছতে বের হয়ে আসে ঘর থেকে।যাওয়ার সময় খুব জোরে লাথি দিয়ে দরজা আটকে দিয়ে যায়‌‌। চন্দ্রিমা আর চুপ থাকতে পারে না এবার। দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে মাটিতে বসে ঢুকরে কেঁদে ওঠে।জোরে শব্দ করে কাঁদতে থাকে।বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, আমার সহ্য হয়না। আমার সহ্য হয়না আপনার চলে যাওয়া দেখতে।কেনো থেকে যেতে পারেন না আমার জন্য?কেনো?আমি সত্যিই সহ্য করতে পারি না।’

___________________

কাল রাতে বাড়িতে কথা হয়েছে কুহেলীর।আব্বা‌ আর আদরের ছোট বোনটা অসুস্থ।একটু না অনেক বেশি।মন অস্থির অস্থির লাগছে।পড়াতে মন বসে না অস্থিরতা নিয়ে।ইশঃ একটাবার যদি দেখতে পেতো!কি হয়েছে না হয়েছে কিছুই বলেননি আম্মা। শুধু বলেছে টেনশন না করতে। চন্দ্রিমাও নেই যে কথাগুলো শেয়ার করবে। মেডিক্যাল থেকেও বাড়ি একা ফিরতে হবে। সমারোহ নেই, নাইট ডিউটি ছিল তার।কুহেলী ক্লাসে মন বসাতে পারেনি একদম।আর কিছুদিন পরেই ফার্স্ট সেমিস্টার ফাইনাল শুরু।পড়া জমেছে আকাশ সমঃ। হাতে সময় নেই কিন্তু সে এখন রিডিং ব্লকে আছে। বিরক্তি লাগে সবকিছুর প্রতি।কারন সমারোহ নামক জটিল সমীকরণ। সমারোহকে সে যত না ভেবে থাকতে চায় ততটাই বেশি ভাবে।মনে ভূত জেঁকে বসেছে। সমারোহ ভূত,মাথাটা যেন তাঁর মতোই চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।লাইব্রেরীতে বসে “Netter Atlas of human embryology” বইটার একেরপর এক পাতা উল্টে যায় কুহেলী।প্রতি পাতায় যেন সমারোহ হালকা করে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে,যাচ্ছে তা একটা অবস্থা।কুহেলীর মনে হয় তার একটা ভালো ডক্টর দেখানো উচিৎ। কিন্তু ডক্টরই তো মাথা নষ্ট করেছে আরেক হবু ডক্টরের।কুহেলী মনে মনে আওড়ায় , আচ্ছা সমারোহ যখন অপারেশন থিয়েটারে থাকে তখন অন্যান্য মেয়ে ডক্টররা রোগীকে মন দিতে পারে!কুহেলী হলে তো হা করে ওই গম্ভীর মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রোগী মেরে ফেলতো।হঠাৎ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কিছু একটা হাতে লাগে কুহেলীর।বইয়ের ফাঁকে সেখানে একটা নীল খাম পায় কুহেলী।খামটার উপর সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ,
‘আমার লাজুকতার জন্য’

কুড়েলী চরম রকমের অবাক হয়।ভাবে খুলে দেখবে কিনা খামটা,পড়ে আবার ভাবে অন্য কারো জন্য হতে পারে। লাইব্রেরীতে তো শুধু সে একা বই পড়ে না,একই বই অনেকের হাতে যায়।কেউ হয়তো তার প্রেমিকা উদ্দেশ্য করে লিখে ভুল করে রেখে গেছে। কিন্তু কামটা খুলে না দেখা অব্দি তো কিছু বুঝার উপায়ও নেই।কুহেলী খাম সহই বইটা বন্ধ করে রেখে দেয় সেল্ফে। লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে এসেও ব্যাপারটা তার মনে সংশয় তৈরি করে।অন্য কারো হলে তো এর আগেও থাকতো। দু-তিন যাবৎ রেগুলার বইটা পড়েছে সে লাইব্রেরীতে এসে।

কুহেলী আবার ঢুকে গ্রন্থাগারে।গিয়ে এমব্রয়লজি বইটা বের করে চিঠিটা নিয়ে ব্যাগে রেখে দিল।তারপর আবার বের হয়ে এলো লাইব্রেরী থেকে।বাড়ি গিয়ে দেখবে যদি অন্য কারো মনে হয় তাহলে নাহয় রেখে দেয়া যাবে আবার।কলেজ থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কুহেলী। হঠাৎ মোবাইলের রিং বেজে উঠলো।বৃথাই থেকে ফোন বের করে দেখে অচেনা নম্বর।ফোনটা তুলে কুহেলী বলে,

‘ আসসালামুয়ালাইকুম।কে বলছেন?’

‘ অলাইকুম আসসালাম। তুমি তো দেখি আস্তো একটা গাধা!না না মেয়েরা তো গাধী হয়‌। তুমি গাধী।’

ভ্রুঁ কুঞ্চিত হয়ে যায় মুহূর্তেই।চিনে না জানে না একটা নম্বর থেকে কল করেই বলা শুরু করেছে গাধী! অদ্ভুত!কুহেলীর ইচ্ছে করে ফোনের ভিতর হাত ঢুকিয়েই লোকটার মাথার সব চুল টেনেটুনে ছিঁড়ে টাক বানিয়ে দিতে। বাজখাঁই গলায় কুহেলী বলে,

‘কে আপনি হে?আমাকে গাধা বলেন কোন সাহসে?’

‘গাধা বলতে আবার সাহসের প্রয়োজন আছে নাকি!আর থাকলে ফোনগত সাহসে,ফোনে গাধা বললে কিছু করতেও পারবেনা।’

‘অদ্ভুত তো! মেয়েদের নম্বর টের পেলেই হলো ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করতে অনেক ভালো লাগে।লুইচ্চামি শুরু হয়ে যায় না?’

‘অনেক ভালোলাগে।’

‘মজা নিচ্ছেন?’

‘সুন্দরী মেয়ে দেখলে আমার মজা না আরো অনেক কিছু নিতে ইচ্ছে করে।এই যেমন…’

থেমে যায় লোকটা।কুহেলী নাক ফুলিয়ে বলে,
‘হ্যা বলেন দেখি,শুনি একটু।’

‘না থাক।লজ্জা পাবে। বাচ্চা মেয়ে তো।অতো বলতে নেই। গোলাপি রঙে তোমাকে খুব মানায়‌,যেন গোলাপি পরী একটা!’

কুহেলী ঘাবড়ে যায়। এদিক ওদিক তাকায় কাউকে দেখতে পায়না। রাস্তা একদম ফাঁকা।কুহেলী আমতা আমতা করে বলে,
‘এই আপনি কি আমাকে ফলো করছেন নাকি!’

অপর পাশের লোকটা খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলে যায়,
‘হ্যাঁ করছি তো। অনেকদিন ধরেই করছি।আমার মতো লুইচ্ছা মানুষের কাজই তো হলো সুন্দরী মেয়েদের পিছু নেয়া‌।তারপর তাদের একা পেলে ধরে…।

লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কুহেলী বলতে থাকে,
‘এই বেটা এই, আরেকবার যদি কল করছেন না আপনাকে আমি মরিচ মাখিয়ে চিবিয়ে খাব,সারা শরীরে বিছুটি মেখে দিব। আপনার নম্বর পুলিশে দিব বলে দিলাম।আমাকে তো চিনেন না হে!’

অপর পাশ থেকে চিকন সুরে খলখলে এক হাঁসির শব্দ শোনা যায়।কুহেলীর রাগ এবার তিড়তিড় করে বেড়ে যায়।মুখ কুঁচকে ছোট করে কুহেলী বলে,

‘কি আজবরে বাবা,হাসছেন কেনো এভাবে?’

‘আরে পাগলি মেয়ে, তোমার বামে দেখো, তোমাকে দেখেই কথা বলছি আমি।’

বলেই কট করে ফোন রেখে দেয় লোকটা।কুহেলী অবাক হয়ে বামে তাকাতেই পিলে চমকে উঠে,কালো গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমারোহ।ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসি।কুহেলীর কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। সমারোহ কে এতোক্ষণ এসব বলেছে সে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আবার ভালোলাগা কাজ করে অনেকটা। সমারোহ ওকে সুন্দর লাগছে বলেছে!
তবে অবাকও হয়।মনে মনে কুহেলী ভাবে সারারাত ডিউটি করেও এখন তাকে নিতে এল কেনো!রাস্তা পার হয়ে কুহেলী অপরপাশে সমারোহর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,

‘আপনার তো আজ নাইট ডিউটি ছিল,বাড়ি গিয়ে ঘুমাননি?’

‘হুম,ঘুমিয়েছি।’

‘এতো অল্প সময়!’

‘জ্বি ম্যাডাম, বেশি ঘুম এখন আমার কপালে নেই,আর এতক্ষণ যে ঝাড়িটাই না মারলেন,যা ঘুম ছিল সব কেটে গেছে।’

কুহেলী বিব্রতবোধ করে। হাল্কা লজ্জায় গাল,নাক লাল হয়ে যায়।ভারী ইনোসেন্ট গলায় সে বলে,

‘আমি ভেবেছি অন্য কোন ফালতু লোক ফলো করছিলো আমাকে,ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’

‘তুমি ভয় পেলে বুঝি!উল্টো আমায় পাইয়ে দিয়েছো।’

‘সরি।’

সমারোহ হো হো করে হেসে উঠে।কুহেলী মাথা নিচু করেই বলে,
‘আমি কিন্তু একাই যেতে পারতাম।’

‘কেনো আমি আসাতে ভালো লাগেনি বুঝি!’
‘না তা কেনো হবে!’

‘গাড়িতে উঠে পড়ো চট করে তাহলে।আজ তোমাকে ঘুরাবো চলো,মাইন্ড ফ্রেশ লাগছে।’

গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলে সমারোহ।কুহেলী খুশি হয়ে যায়। একপ্রকার দৌড়ে গিয়েই বসে গাড়িতে। হুড়মুড়িয়ে বলে,
‘কোথায় কোথায় যাব আমরা?’

‘আগে যাব রেস্টুরেন্টে,খেয়ে নিবে।তারপর মিরসরাইয়ে যাবে নাকি পাহাড় ঘেরা পৌরাণিক অঞ্চল সীতাকুণ্ডে?’

কুহেলী শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে গালে কয়েকবার টোকা দিয়ে বলে, ‘সীতাকুন্ড।’

‘ওকে, ৩৫ কিলোমিটার দূরে,অনেকটা সময় লাগবে ঘুরে দেখতে।ফিরতে রাত হলে সমস্যা নেই তো!’

‘আমার আবার কি সমস্যা থাকবে! ঘুরা ঘুরি করতে গেলে আমার আর কোনো কিছু লাগে না।এমনকি ক্ষুধাও পায় না।’

‘ওকে।’

তিনটায় পৌঁছে যায় সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে।বেশি সময় সেখানে কাটায়না।সহস্র ধারা এবং সুপ্তধারা নামে দুইটি অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণা দেখে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হয়,স্থানীয় মানুষের কাছে এই সৈকত ‘মুরাদপুর বীচ’ বলে সুপরিচিত। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার।সি বিচে পৌঁছে কুহেলীর মনে হয় কোন এক স্বপ্নের রাজ্যে এসে পৌঁছেছে সে। বিচটাকে সাজাতে প্রকৃতি কোন কার্পন্য করেনি। একদিকে দিগন্তজোড়া সাগর জলরাশি আর অন্য দিকে কেওড়া বন।কেওড়া বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের চারিদিকে কেওড়া গাছের শ্বাসমূল।কুহেলীর চোখ ধাঁধিয়ে যায় এ দৃশ্যে।বন সমুদ্রের অনেকটা ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে।
পরিবেশ অনেকটা সোয়াম্প ফরেস্টের মতো। যতদূর অব্দি চোখ যায় সবুজ গালিচার মতো ঘাস।বীচের পাশে সবুজ ঘাসের মাঠে প্রাকৃতিক ভাবেই জেগে উঠেছে আঁকা বাঁকা নালা।এই নালায় জোয়ারের সময় পানি ভরে উঠে। চারপাশে সবুজ ঘাস আর তারই মধ্যে ছোট ছোট নালায় পানি পূর্ণ এই দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
তখন ভাটা পড়েছে।কুহেলী আর সমারোহ সেই বিশাল নালাগুলোর পাশ ধরে হাঁটে অনেক দূর পর্যন্ত। জায়গাটা একদম ফাঁকা, নিরিবিলি। দুএকজন বিদেশি পর্যটক আর কাপল ছাড়া আর কেউ নেই।এজন্যই হয়তো ভালোলাগা আরো বেড়েছে।কুহেলী হাঁটতে হাঁটতে পাশে তাকিয়ে দেখে সমারোহ নেই।একটু ঘাবড়ে গিয়ে ভ্রুঁকুঞ্চন করে পেছন তাকিয়ে দেখে সমারোহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে। সমারোহ যেন এক মুহুর্তের জন্য আটকে গিয়েছিল কুহেলীর মাঝে।মেয়েটার ছন্দতুলে হাঁটা, কপালের গোঁড়ায় ছোট ছোট চুল,ওই পাতলা ঠোঁট,মসৃন খয়েরি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর এসে পড়া যেন উন্মাদ করে তুলতে চায় সমারোহকে।সমারোহ হারিয়ে যায়,কুহেলী গহ্বরের অতলে তলিয়ে হারিয়ে যায়।

কুহেলী সমারোহকে হাত দিয়ে ইশারা করে। সমারোহ যেন তা অগ্রাহ্য করে, তাকিয়েই থাকে। হালকা হেঁসে লতারশ্মির ন্যায় শরীর দুলিয়ে উল্টো পথে এসে সমারোহর পাশে দাঁড়ায়।বলে,

‘অসাধারণ, এতো সুন্দর একটা প্লেসে মানুষের আনাগোনা নেই বিষয়টা কেমন না?’

‘এখনো মানুষের কাছে ততটা পরিচিত না তাই!’

গুলিয়াখালী সি বিচে হাঁটাহাঁটি করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বিকাল গড়িয়ে আসে।কুহেলীকে নিয়ে যায় কুমারীকুন্ডে।পাহাড়ের রহস্যময় আবহে পূর্ণ এক ছড়ায় প্রাচীন এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ কুমারীকুন্ড নামে পরিচিত।

সমারোহ কুহেলীকে সেসব ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে পাথর দিয়ে বাঁধানো ৮-১০ ফুট গভীর স্বচ্ছ নীল পানির কূপের কাছে নিয়ে আসে।পরিষ্কার নীল পানির নীচ থেকে অনবরত নির্গত হচ্ছে গ্যাসের বুদবুদ আর অদ্ভুদ আকারের সব পাথর মন্দিরের চারপাশের দেয়ালে।প্রাচীনকালে হিন্দুরা উষ্ণ প্রস্রবণ বা হট স্প্রিং-কে খুবই পবিত্র মনে করতো।লবণাক্ষকুন্ড আর অগ্নিকুন্ডের মত বুদবুদ আকারে নির্গত গ্যাসে জালানো অগ্নিকুন্ডকে ঘিরে নির্মিত মন্দিরের সাথে কুমারীকুন্ডের মিল রয়েছে।সময়ের সাথে সাথে মূল তীর্থ স্থান এখানে থেকে অনেকটা সরে গেছে। আর মাটি চাপা পড়ে গেছে পুরনো ইটের তৈরী বিভিন্ন কাঠামো।

ঘুরাঘুরি করতে করতে প্রায় রাত নয়টা বেজে যায়। আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কালো মেঘ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে সাথে মৃদুমন্দা মেঘের গর্জন।দ্রুত বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েও পারেনা ওরা। সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে কোন একটা বিশাল ট্রাকের সাথে একটা বাসের সংঘর্ষ হয়েছে।মারা গিয়েছেন অনেকেই বাকিদের পাশের এক হসপিটালে নেয়া হচ্ছে দ্রুত।আধ ঘন্টা আগেই ঘটছে ঘটনাটা।তাই রাস্তা আপাতত বন্ধ,হয়তো দু-তিন ঘণ্টা পর খুলে দেবে।সমারোহর নিজের উপর রাগ হয় বড্ড,কেনোই বা এতো লেট করতে গেল সে!আর কিছুক্ষণ আগে পৌঁছালেই এই ঝামেলায় পড়তে হতো না।কুহেলী ভয়ে ভয়ে সমারোহকে বলে,

‘এই ততটুকু সময় কি আমরা এখানে অপেক্ষা করবো? কতো গুলো মানুষই না প্রাণ হারালো!’

‘হুম, আচ্ছা তুমি একটু বসো গাড়িতে।গাড়ি লক করে দাও।আমি সামনে যাই,দেখে আসি কি অবস্থা।’

‘আচ্ছা।’

‘কেউ নক করলে খুলবে না।’

সমারোহ বের হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।কুহেলী বসে জায়গাটা ভালো করে দেখে। অনেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে আবার উল্টো পথে চলে যাচ্ছে।কুহেলীর মনে মনে ভাবে তাও হয়তো কিছুটা সময় বেশি থাকা যাবে সমারোহর পাশে।প্রায় বিশ মিনিট পর সমারোহ এসে গাড়িতে বসে।কুহেলীকে কিছু না বলেই গাড়ি ঘুরাতে শুরু করে।কুহেলী অবাক হয়ে বলে,

‘গাড়ি ঘুরাচ্ছেন কেনো?’

‘সবাইকে হসপিটালে নিবে, পুলিশ তদন্ত করবে,দেন ক্লিন করে রাস্তা ছাড়া হবে।কম করে হলেও তিন ঘণ্টার ব্যাপার।এতোটা সময় এখানে থাকার মানে হয়না।আর সেইফও না। দেখছো না রোডব্লক হাওয়ার পরও মানুষ কতো কম!’

‘তাহলে বাড়ি যাব না?’

সমারোহ হেঁসে ফেলে কুহেলীর কথায়।কুহেলী ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে। সমারোহ ঠাট্টা করে বলে,
‘তুমি খুব বেশি ভোলা-ভালা আর বোকা।’

কুহেলী মুখ ভেঙচি কাটে।সমারোহ গাড়ির মিররে কুহেলীকে দেখে।
‘যাব না কেনো! ততক্ষণ ব্লক থাকে ততক্ষণ নাহয় কোথাও বসে রেস্ট নিলাম। আশেপাশে অনেকগুলো রিসোর্ট আছে।সবাই এখন সেখানেই যাচ্ছে। ফাঁকা পাওয়া মুশকিল হবে হয়তো। খাওয়া-দাওয়া করে নাহয় কয়েকঘণ্টা সেখানে রেস্ট নিলে,চাইলে ঘুমিয়েও নিতে পারবে।’

কুহেলী সামনের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মত বলে,
‘আমি ঘুমাবো কেনো।আমার ঘুম পায়নি।’

‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’

‘এমনি।জায়গাটা একটু বেশিই নিরিবিলি স্তব্দ, দ্রুত চলুন।’

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৫.

আঁধারের নেশায় মত্ত পাহাড়গুলো ভারী ভয়ংকর রাক্ষুসে দেখাচ্ছে। সৌন্দর্য,রহস্য,ভয় সব যেন এখানেই শুরু আবার এখানেই শেষ। ঝিরঝির বৃষ্টি যেন আরো মায়ায় ঘিরে দিয়েছে পাহাড় গুলোকে।কুহেলী রিসোর্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে দূরের এই পাহাড়।এক্সিডেন্ট স্পট থেকে অনেকটা দূরে পত্রলেখা রিসোর্টে (কাল্পনিক) উঠেছে সমারোহ ওকে নিয়ে।একটা রুম নেয়া হয়েছে চার ঘণ্টার জন্য। এক্সিডেন্টের কারণে অনেক মানুষ আসছে তাই চট করে যেন রুম প্রাইজ করে দেয়া হয়েছে দ্বিগুণ।পুরো রিসোর্টটা কাঠের তৈরি।ওদের রুমটা হিল সাইড রুম বলে প্রাইজ আরো বেশি। এখান থেকে নাকি ভোরের ভিউ খুব সুন্দর দেখায়।রুমটা অনেক ছোট ছোট গাছ দিয়ে সাজানো।রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়েছে দুজন।কুহেলীর এখন নিজেকে সত্যিই খুব দুর্বল মনে হচ্ছে।ঠিক মতো খেতেও পারেনি,যা খেয়ে আবার বমি করে ফেলেছে।সমারোহ মাকে ফোন করবে বলে রুম লক করে চাবি নিয়ে চলে গিয়েছে।কুহেলীর বেশ ভালোই লাগে একাকী বেলকনিতে বসে কুঁচকে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ আর ভয়ংকর সুন্দর পাহাড় দেখতে। সমারোহ থাকলেও বিষয়টা মন্দ হতো না।সাথে ধোঁয়া ওঠানো এক কাপ চা। সমারোহ যখন ফ্রি থাকে তখনই বই পড়ে। এমনকি গাড়িতেও বই আছে দুচারটে। আচ্ছা এখানে কুহেলীর সাথে বসলেও কি বই পড়বে!নাহ,তাহলে সেটা কুহেলী মনে মনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে। সমারোহ আর ওর মাঝখানে কি আর কিছু থাকার দরকার আছে নাকি? দরকার থাকলেও থাকবে না।কুহেলীর ইচ্ছে করে সমারোহ শুধু তাকে দেখবে, কেবল কুহেলীকেই।

ইদানিং খুব অবাধ্য হয়েছে মনটা,বেহায়াও বটে।খালি সমারোহ সমারোহ করে।আচ্ছা ভালোলাগাতে কি বেহায়া হওয়া যায় না? শুধু ভালোবাসলেই হওয়া যায়!কুহেলী কি ভালোবাসে সমারোহকে?বাসলে ঠিক কতটা! সমারোহ নামক জটিল ভাবনায় ভুলে কখন যে দুই চোখের পাতা এক হয়ে আসে টেরই পায়না কুহেলী। মানুষ সবসময় জীবনের বড় সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে গেলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সমারোহও তার জীবনের একমাত্র বড় সমস্যা।

কুহেলীর ঘুম ভাঙ্গে বিকট একটা শব্দে।চোখ মেলতেই দেখে চারিদিক গাঢ় কালো চাদরে মুড়ে আছে।আবারো সেই বিকট আওয়াজ হয়ে আলোকিত হয় ঘর। বাইরে ভীষণ রকম বাজ পড়ছে।ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে কুহেলী।কাউচের পাশে ছোট টেবিল ল্যাম্পের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় একজোড়া চোখ তাকে দেখছে। অশরীরীর মতো গিলে খাচ্ছে।কুহেলী বুঝতে পারে এটা সমারোহ।বাইরে যে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে তাও বুঝতে পারে কুহেলী। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে খাটে শুয়ে আছে।এমা!সে তো বেলকনিতে বেতের চেয়ারে পা তুলে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল।বিছানায় এলো কি করে! সমারোহ কি তাকে কোলে করে…।

ভাবতেই মনে মনে ছিঃ ছিঃ করে উঠে কুহেলী।চুল বাঁধা ছিল।এখন খোলা।গায়ে হাত দিয়ে দেখে উড়না নেই। আশেপাশে তাকিয়েও পায়না,হয়তো বেলকনিতেই পরে আছে এক কোণে।সামনে একটা কাঁথা ছিল।দ্রুত সেটা নিজের গায়ে পেঁচিয়ে নিলো কুহেলী। অপরাধী চোখে সমারোহর দিকে তাকিয়ে দেখে সমারোহ তখনো তাকে দেখছে।হাতের একটা মোটা বই।কুহেলীর তখন সমারোহকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নির্লজ্জ লোকটা মনে হয়। এভাবে কেউ চেয়ে থাকে নাকি!কুহেলী মাটির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

‘কয়টা বাজে?’

‘সাড়ে তিনটা।’ চোখ সরায় না সমারোহ।

‘এতোটা সময়!আমি আসলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।’

‘হুম,ঘরে এসে দেখি বৃষ্টির মাঝেই ঘুমিয়ে গেছো।কি ঘুমরে বাবা!গায়ে পানি পড়ছে তাও ঘুমোচ্ছে।ডেকেছিলাম উঠোনি।’

‘আমার ঘুম খুব ভারী।’

‘সেটা তখনি বুঝেছি। বৃষ্টিতে ভিজেও যে কেউ দিব্যি ঘুমাতে পারে তা তোমাকে না দেখলে জানতামই না।’

কুহেলী বুঝতে পারে না কি বলবে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।মাটির দিকে তাকিয়েও সে স্পষ্ট বুঝতে পারে সমারোহ তাকে দেখছে, গভীরভাবে দেখছে।বুকে বিন্দু বিন্দু সাহস জুগিয়ে কুহেলী বলে,

‘আপনি মাঝে মাঝে আমায় এভাবে কেনো দেখেন?’

‘কিভাবে?’

কুহেলী সমারোহর দিকে তাকিয়ে দেখে সে বইয়ে মুখ গুঁজে আছে।কুহেলী তাকাতেই বইয়ের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে সমারোহ তাকে দেখে বলে,

‘বলো কিভাবে?’

কুহেলী থতমত খেয়ে যায়‌।তাহলে সমারোহ তাকে দেখছিলো না।নিজেই যে কেনো বেশি বুঝে!আর তার জন্য লজ্জিত হতে হয়।সমারোহ মৃদু হেসে বলে,

‘আমি তো বই পড়ছিলাম। তুমি ভয় পেয়ে উঠে গেলে বলেই তো…।’

‘আমাদের তো একটা অব্দি থাকার কথা ছিল না?’

কথার বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে কুহেলী। লোকটার সামনে এসব কথা বেশি না এগোনোই ভালো লজ্জা শেষে তাকেই পেতে হবে।
একেরপর এক বাজ পরেই চলছে বাহিরে।‌আকাশ আলোকিত হচ্ছে আবার হারাচ্ছে নিকষ কালো আঁধারে।এ এক আলো আঁধারের খেলা!প্রতিবারই ভয়ে হালকা করে চমকে উঠছে কুহেলী। সমারোহ বলে,

‘তুমি যে ঘুম দিলে, আমি তো ভেবেছি একেবারে রাত কাভার করে দিবে। তাই সারারাতের জন্য নিয়ে নিলাম। অবশ্য ভালোই হয়েছে। যা বৃষ্টি নেমেছে।বাজ পড়লে ভয় পাও নাকি!’

‘খুব।’ ইনোসেন্ট গলা করে কুহেলী বলে।

‘আমার পাশে এসে বসতে পারো।’

কুহেলী কথা বাড়ায় না।উঠে গিয়ে চুপচাপ সমারোহর পাশে বসে।সমারোহ আবার বইয়ের পাতায় ডুব দেয়।কুহেলীর রাগ হয়। দেখার জন্য কি একমাত্র বই আছে পৃথিবীতে?আর কিছু নেই?কুহেলী নেই?
কুহেলী মনে মনে বলে লোকটা খারাপ, খারাপ, খারাপ।প্রায়সময়ই এক ধ্যানে ওভাবে চেয়ে থেকে লজ্জা দেয়। সেদিন লাইব্রেরীতে এভাবে তাকিয়ে ছিল,যখন খাবার দিয়ে আসতে রুমে গিয়েছিল তখনও এভাবে দেখেছে,আরো অনেক অনেকবার দেখেছে এভাবে।অথচ বলেই আবার লজ্জা পেতে হলো।কুহেলী সোফার পেছনে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে থাকে। ক্ষণিক সময়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গে সাড়ে পাঁচটায়।ভোরের কুসুমের ন্যায় সোনালী সূর্যের নরম মিষ্টি রোদ এসে মুখে পড়ছে কুহেলীর। আলসেমি করে চোখ খুলতেই সমারোহ চেহারা সবার প্রথম সামনে পড়ে কুহেলীর।ধবধবে সাদা শরীর, যেন একদম স্বচ্ছ!ক্লিন সেভ করা, চুলগুলো ছোট ছোট করে কাটা। মাদকতা ছড়ানো চোখ দুটো বোঁজা।ভ্রুঁ’র কাছে কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকানো।নীল সাদা মিশেল শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খোলা। লোমশ বুকের বাঁ পাশের তীলটা দেখে কুহেলীর বুকটা ধক করে ওঠে।এতো সুন্দর মানুষ কুহেলী আজ অব্দি কখনো দেখিনি।সৃষ্টিকর্তার বড়ই যত্নে গড়া সৃষ্টি।ছেলে মানুষের অত সুন্দর হতে নেই।তারা হবে কালো কিংবা শ্যাম বর্ণের,চোখে মুখে থাকবে নেশা। ছেলেরা সুন্দর হলে যে মেয়েদের হিংসে হবে।যেমন এই মুহূর্তে কুহেলীর হচ্ছে!কুহেলী মনে মনে কয়েক লাইনের একটা কবিতা আউড়িয়ে ফেলে,

‘মনে হয় বেঁচে থাকার না,
তোমার পাশাপাশি কাছাকাছি,
বুকের সাথে লেপ্টে থাকার লোভটাই আমার বেশি।
ঐ গাঢ়ো লোমশ বুকের বাঁ পাশের তীলটাতে চুমো খাবে বলেই হয়তো।
নয়তো রাতের পর রাত জেগে আমার চুলের ঘ্রাণ নিবে বলে!
কিংবা তোমার হাতের স্পর্শ মাখা শিউলি পেতে,
তোমার আবেশের দহন নিতে।’

কবিতা বানিয়ে আবার নিজেই লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে যায়‌।কেনো যেনো সমারোহর বুকে খুব জোরে একটা কামড় বসাতে ইচ্ছা করে।কি হবে! সমারোহ উঠে যাবে? লজ্জা পাবে কুহেলী! মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে যখন লজ্জা পায়নি তখন এখনো পাওয়া উচিত না।ইশঃ রাতে ঘুমের ঘোরে কাঁধে কেনো মাথা রাখলো,বুকে কেনো না!কুহেলীর নিজের কাছেই নিজেকে খুব দুষ্টু মনে হয়। সমারোহ কপাল কুঁচকে আরেকটু নড়েচড়ে ওঠে।কুহেলী দ্রুত ঘুমানোর ভান করে আবার পড়ে থাকে সমারোহর কাঁধে। সমারোহ ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ কচলে আশেপাশে দেখে।তার বাম হাতে ভর দিয়ে ঘুমাচ্ছে কুহেলী। একদম বাচ্চাদের মতো‌‌।কুহেলীর কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পরম যত্নে সরিয়ে দেয় সমারোহ।মৃদু আওয়াজ করে ডাকে,

‘কুহেলী!উঠবে না?’

কুহেলী উত্তর করে না,নড়েও না।সমারোহ আবার ডাকে।এবার কুহেলী চোখ খুলে তাকিয়ে ছিটকে দূরে সরে যায় সমারোহর কাছ থেকে। আলুথালু মুখ করে ঝটপট বলে,

‘আ-আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’

তারপর এক দৌড়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। সমারোহ খানিক অবাক হয়ে মুচকি হেসে হাত নাড়তে গিয়ে দেখে ব্যাথায় বারোটা বেজে গেছে হাতের।কাঁধ থেকে শুরু করে পুরো সাতটাই যেন অবশ হয়ে গেছে।

বিছানা থেকে উঠার শক্তিটুকু হারিয়েছেন খোর্শেদ।পেটের উপরের অংশ, কাঁধ, পিঠ, গলা, দাঁত ও চোয়াল এবং বাম বাহুতেও ব্যাথা আছে। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হয়,গড়গড়িয়ে বমি আসে‌।খাবারে রুচি নেই একদম। মাথায় ঝিম ধরা ব্যাথাও আছে সমান তালে‌। সেদিন সারাটা রাত খুব খারাপ কাটে খোর্শেদের।বুক ধড়ফড় করে।চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় দুই মেয়ের চেহারা, হাসনাহেনার মিষ্টি হাসি।খোর্শেদ ভাবে এই তার দিন শেষ হয়ে এলো। আল্লাহর কাছে পাড়ি জমানোর সময় চলে এসেছে কি! এতো দ্রুত চলে গেলে মেয়ে দুটোকে আল্লাহর ভরসায় রেখে যাবেন।ঐ বর্বর লোকগুলোর হাত থেকে তার দুই মেয়েকে রক্ষা করার আগেই তাকে চলে যেতে হবে!কুঞ্জাটা তো ছোট।সামাল দিতে পারবে সে নিজেকে?তাকে তো জীবন যুদ্ধে লড়াই করা শিখানো হলো না!তো কি?তার হেনা আছে‌। মেয়েদের দেখবে,শিখাবে।আম্মাও তো আছে,রজব আছে। আল্লাহ আছে, ফেরেশতা আছে।খোর্শেদের চিন্তা নেই।সে নিশ্চিত হয়ে মরবে।রজব দৌড়ে দৌড়ে ঘরের সব কাজ করে,খোর্শেদের ঔষুধ আনা,বাজার করা,রমলার দেখাশোনা করা। হুঁশ নেই তার আর। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে রাতে একটু জিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখে খোর্শেদের অবস্থা আরো বিগড়ে গেলে ডাক্তার ডাকা হয়।ততক্ষণে জ্ঞান হারা হয় খোর্শেদ।ডাক্তার এসেই রেগে যান এখনো হসপিটালে নেয়া হয়নি বলে।সেই রাতেই খোর্শেদকে নেয়া হয় হসপিটালে।গ্রামের হসপিটালে রাখা হয়না, অবস্থা অনেক খারাপ।বলে সদরে নিয়ে যেতে।সেই রাতেই বৃষ্টির শত ফোঁটা উপেক্ষা করে হাসনাহেনা আর রজব ছুটে খোর্শেদকে নিয়ে।স্বামী হারাবার ভয় জেঁকে পায় হেনাকে।হুরহুরিয়ে কাঁদেন তিনি।রজব যে তার সব‌! বাড়িতে বসে কাঁদে কুঞ্জা।তার গাঢ় আর্তনাদ,

‘আপা চলে গেলো তারপরই এতো খারাপ কেন হচ্ছে?আমি আব্বার কাছে মাফ। আমারে রাইখা গেলো কেন?আপারে আসলে কও।আপা আসলে আব্বা ভালো হইয়া যাইবো।আপারে…!’

কুহেলীর মোবাইলে হাজার চেষ্টা করেও নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল না।এক বাবা পাগল মেয়ে জানলোই না তা তার বাবা মৃত্যু পথযাত্রী হতে চলেছে।বাচ্চা মেয়েটা শান্ত করতে পারেন না রমলা‌। কিভাবে করবেন?তার নাড়ী ছেঁড়া সন্তানের মে মরণ দশা!দুই ছেলে মারা গেলো,রমলা বুকে পাথর চাঁপা দিয়ে ছিলেন।খোর্শেদ তার শেষ সম্বল।তার সাত রাজার ধন, বুকের মানিক।রমলা জায়নামাজের বসে অনবরত কেঁদে চলে। বৃষ্টির পর স্তব্ধ নিঝুম পরিবেশ।সারাটা রাত কাটে নির্ঘুম।দূর থেকে ভেসে আসে পেঁচার ডাক। রমলা ভয়ে কেবল আল্লাহর নাম ডাকেন ঘনঘন।কুঞ্জা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে,ওঠে আবার কাঁদে আবার ঘুমায়।
সকালে রজব তাড়াহুড়ো করে বাড়ি আসে।চোখ মুখ ফুলে আছে ছেলেটার।রমলা তখন সবে মাত্র ফজরের নামাজের পর বসে বসে তসবিহ পড়ছিলেন। রজবকে দেখে দৌড়ে বাহিরে এসে বলেন,

‘আমার পোলাডা কেমন আছে বাপ?ডাক্তার দেখাইছোস?ভালা হইয়া যাইবো কো! আল্লাহ!’

রমলার চোখে উপচে পানি আসে।ঘোলা চোখে পানি দেখলে মায়া হয় রজবের। মানুষ বুড়ো হলে চোখ ঘোলাটে হয়ে যায়।এটা বয়স হওয়ার প্রথম লক্ষন।খোর্শেদের চোখাও ঘোলাটে, সুন্দর। চোখ দেখলেই বুঝা যায় মানুষটা সৎ।রজবের কান্না পায়।সে এতিম। কিন্তু কাল রাতে সত্যি সত্যি বাপ হারানোর ভয় হইছে।কতোটুকু হৃদয়বিদারক সেটা কেবল সন্তানেরা বুঝে।তবে ডাক্তার বলছেন তাদের কুহেলীর আব্বা,কুঞ্জার আব্বা তার আব্বা ভালো হইয়া যাইবো।রমলা রজবকে চুপ থাকতে দেখে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেন।ভেজা কাঁপা কন্ঠে বলেন,

‘কস না কিছু। আমার তো কইলজা কামড়ায়।বুড়া বয়সে এতো কষ্ট লইতে পারি আমি?’

‘চাচা ভালো হইয়া যাইবো দাদু। অনেক চিন্তা করছিলো,ভয় পাইছিলো তাই এমন হইছে।পরাণটাতে কষ্ট পাইছে, হৃৎপিণ্ডে ব্যাথা করছে।কি যেনো কয়!হারট এটাক হইছে।’

রমলা অত কিছু বুঝেন না। শুধু বুঝেন তার ছেলে ভালো হইয়া যাইবো।এই সুখ। এখন ছেলে বাড়ি ফিরলে তার শান্তি। রজব আবার বলে,

‘এতক্ষন আগে চোখ মেলছিলো।কয়েকদিন হাসপাতালেই থাকবো।কুহু‌ আপারে ফুনে পাইনা পরে জহির কাকুর বাড়িতে ফুন দিয়া কইছি।কাকু তো কাইন্দাই দিছিল।বাড়িত নাই কুহেলী আপা।পরে কইবো আপারে।’

‘আইবো কবে মাইয়াটা?কতোদিন দেখিনা,চোখ দুইটা জুড়ায় না।’

রজবের মুখ চুপসে যায়। চোখে শূন্যতা স্পষ্ট। তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলে,
‘দেরি আছে গো বুড়ি।চাচি আসতে না কইছে। শয়তানগুলা যেমনে উতঃ পাইত্তা আছে।আইলে আপারে তুইল্লা লইয়া যাইবো কইছে।’

‘মাইয়া গুলারে আল্লাহ জেনার হাত থেইক্কা বাঁচাক।তুই বাড়িত এইলি ভালা করছোস।দুইটা খাইয়া তা বাপ।আমি রাইন্ধা দেই।হাত মুখ ধুইয়া আয়।’

থরথর করে কাঁপছে কুহেলির শরীর।আনরুবা ভয়ে চক্ষু চড়কগাছে তোলে দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির কাছে। ভবিষ্যত অনুসন্ধান করে ঘাবড়ে আছেন তিনি।জহির অনেক আমতা আমতা করে বলেন খোর্শেদের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।নিজে দূর্বল শরীরের বলে যেতে পারেননি প্রিয় বন্ধুর অসুস্থতার সময়ে, ছেলে সান্দ্রকে পাঠিয়েছেন দেখে আসতে।কুহেলী জহিরের কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়।প্রথম কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু জহিরের মুখের দিকে, কোনো কথা খুঁজে পায়না। বুকে সূক্ষ্ম এক ব্যাথার উদ্রেক হয়,ঠাওর করা যায়না ব্যাথার উৎস।চোখে জল নামে ধীরে ধীরে। হঠাৎ করেই এক হাতে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে কুহেলী।অপর হাত অজান্তেই পাশে থাকা সমারোহর বুকের শার্ট খামচে ধরে। মাটিতে বসে পড়তে নিলেই সমারোহ শক্ত করে ধরে ফেলে কুহেলীকে।কুহেলীর হুঁশ জ্ঞান থাকেনা। সমারোহকে জড়িয়ে ধরেই শব্দ করে কাঁদতে থাকে কুহেলী। সমারোহ কুহেলীকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে।সে নিজেও সর্বোচ্চ পরিমাণ চমকে গেছে। জহিরের চোখ ছলছল করে বেদনার আক্ষেপে।সবার অগোচরে চোখ মুছে নিয়ে কুহেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় জহির।কুহেলী উন্মাদের মতো ধাক্কা দিয়ে সমারোহকে সরিয়ে দিয়ে বলে,

‘আমি যাব।আমি বাড়ি যাব।আমি আব্বার কাছে যাবো। এখন কেমন আছে আব্বা?আমাকে ফোন দিলো না? আমার আব্বা কেমন আছে?’

কথা গুলিয়ে যায় সব।কান্নার দমকে হিঁচকি উঠে যায়।আব্বা তার শক্তি।এতো দূর আছে মানুষটার কাছে থেকে কিন্তু কুহেলীর প্রতি মুহূর্তে সে আছে।ছোট থেকে কুহেলী একটু অসুস্থ হলেই আব্বা আর কাছ ছাড়তেন না অথচ মানুষটাকে কুহেলী এখন দেখতেই পারছে না।প্রাণের মানুষ খারাপ থাকলে দম আটকে আসে,আঁধার নামে হৃদয়।কুহেলীর তেমনটা মনে হয়ে‌।দম আটকে আসছে তার।শ্বাস নিতে পারছে না কেনো? আশেপাশে তাকিয়ে দেখে জহির, আনরুবা তাকে অনেক কিছু বলছে, বুঝাচ্ছে।ঝাপসা সবার চেহারা।সমারোহ হালকাভাবে জড়িয়ে ধরে আছে। কিছুই সে শুনতে পাচ্ছেনা।শরীর ছেড়ে দিয়েছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলো কেন?সূর্য কি ডুবে গেলো?রাত হয়ে গেল? এক্ষুনি তো ফকফকে আলো ছিল চারিদিকে,সময়টা তো সুন্দর ছিল।জ্ঞান হারায় কুহেলী।

যখন জ্ঞান ফিরে দেখে সে আনরুবার ঘরে।মাথার এক পাশে আনরুবা বসে চুলে বিলি কাটছেন। জহির রোলিং চেয়ারে বসে আছেন। সারিকা,নয়না, সেঁজুতি সবাই সেই ঘরে।নয়না কুহেলীর পায়ের তালুতে গরম তেল মালিশ করে দিচ্ছে।কথা বলতে চেয়েও পারেনা কুহেলী।শরীর এতো দূর্বল হয়ে গেছে যে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।হাতে ব্যথা করছে।হাতে স্যালাইন লাগানো। সমারোহ কুহেলীর হাতের পালস চেক করে দেখে।কুহেলী খুব কষ্ট করে বলে,

‘আমি গ্রামে যেতে চাই।’

আনরুবা কুহেলীর কপালের চুল সরিয়ে চুমু খান। মমতা মাখা কন্ঠে বলেন,

‘মারে,এতো চিন্তা করতে হয়না। সান্দ্র গেল তো।ভাই এখন আগের থেকে সুস্থ আছে। উল্টো তুমি অসুস্থ হয়ে গেলা। শরীর এতো দূর্বল হইলো কেমনে মা? অতিরিক্ত টেনশন করো।’

‘আব্বা ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ, তোমার সাথে কথা বলবে একটু পর।’

‘কথা বলবে?’

আনরুবা হ্যা সূচক মাথা নাড়ল,
‘বলবে তো।এখন কথা বইলো না।স্যালাইন শেষ হোক।’

কুহেলীর চোখ দুটো আবার লেগে আসে।সবার উদ্দেশ্যে আনরুবা বলেন,

‘সবাই ঘরে যাও। জায়গাটা ফাঁকা করো। জহির তুমিও যাও। আমি আছি।’

সবাই ঘর থেকে বের হয়ে এলে সমারোহ চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসে পড়ে।আনুরুবা চরম পর্যায়ে আশ্চর্য হয় বলেন,

‘কিরে বসে পড়লি যে?যাবি না?’

সমারোহ খুব ইনোসেন্ট কন্ঠ করে বলে,
‘আমি থাকি আম্মু?প্লিজ।’

আনরুবা অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকেন সমারোহর দিকে।যে ছেলে মেয়ে দেখলে পালাই পালাই করে সে কিনা বলছে কুহেলীর কাছে থাকবে! ভূতের মুখে রাম রাম হয়ে গেলো না! আনরুবার চাহনি দেখে চোখ অশান্ত হয়ে ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায় সমারোহর।মুখে স্পষ্ট অস্থিরতার ছাপ। সমারোহ নরম গলায় বলে,

‘না মানে,যদি দরকার পরে।’

আনরুবার ভীষণ হাঁসি পায়‌।তার পেটে ধরা ছেলে দেখি এখন তাকে মিথ্যা বলতে শিখে গেছে। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে আবার ধরাও খায়। আনরুবা মনে মনে বলেন,
‘বাছা তুমি চলো ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়,জন্ম কি তুমি আমারে দিসো নাকি আমি তোমারে!’

আনরুবাকে তারপরও তাকিয়ে থাকতে দেখে সমারোহ ইতস্ততবোধ করে।ফুল হাতা শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আমি যাচ্ছি।’

আনরুবা ছেলের কান্ড দেখে কোনরকম হাসি আটকে বলেন,
‘না তুই থাক,আমিই যাই বরং।দেখি একটু স্যুপ রান্না করি মেয়েটার জন্য। ভালোমত খেয়াল রাখবি কিন্তু, একদম নড়বি না ঘর থেকে।’

আনরুবা চলে যান। সমারোহ একপ্রকার স্বস্তি পায়। চুপচাপ কিছু সময় কাটিয়ে দেয় সোফায় বসে।কি মনে করে আবার উঠে দরজা চাপিয়ে গিয়ে বসে কুহেলীর পাশে।মেয়েটা চোখ বুজলেই বিন্দু বিন্দু মায়ায় গড়া জাল বুনে তার চেহারায়।বুদ্ধিভ্রংশ মনে সেই মোহাচ্ছন্ন চেহারা অপলক চেয়ে দেখতে কার না ভালো লাগবে!
আনরুবা ঘর থেকে বের হয়েই জহিরের খোঁজে যান। বাড়ির পেছনের সাইডে বসে একমনে সিগারেট টানছিলেন তিনি। আনরুবাকে আসতে দেখে তা ফেলে দিলেন।আনরুবার দিকে ফিরে বলেন,

‘কিছু কইবা?মনটা ভালো লাগতেছে না কিছুতেই।খোর্শেদের খবর শুনে মেয়েটাও অসুস্থ হয়ে পড়ল। একবার খোর্শেদকে দেখতে পারলে ভালো লাগতো,পরাণটা জুড়াইত।যাক ,ভালো আছে তাতেই ভালো।আর কিচ্ছু লাগবো না।’

‘ঠিক বলছো।ভালো মানুষটার হুট করেই রোগবালাই বাঁধলো।’

আনরুবা একটু থামেন। থেমে মন প্রফুল্ল করে আবার বলেন,
‘আচ্ছা,হাসনা আপা কুহেলীরে নিয়া যাইতে না করলো কেন?সান্দ্রর সাথে ও যাইতো। তাহলে মেয়েটারও ভালো লাগতো হের বাপেরও ভালো লাগতো।’

‘ঘটনা তো কিছু হইছেই।ফোন দিছে রজব।তাই আর এতকিছু জিগাইনাই।

‘এইবার থেকে জিগাইতে হবে,জানতেও হবে।’

জহির কপাল কুঁচকায়। আনরুবা হেসে বলেন,
‘তোমার ছেলে তো কুহেলীর কাছ থেকে নড়েচড়ে না।’

জহির ভুত দেখার মত করে তাকান আনরুবার দিকে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত কথাটা আনরুবা তাকে বলে ফেলেছেন যেটা শুনে জহির মূর্ছা যাবেন। নিজের দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

‘মানে? কি কও তুমি?’

‘বলছিলাম না কুহেলীই বদলাবে আমার সমারোহ কে!দেখলে তো।ওদের এবার একসাথে রাখতে হবে যত বেশি পারা যায়।’
আনরুবা হেসে বলেন।

বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙ্গে কুহেলীর। তাকিয়ে দেখে ঘরটা আবছা অন্ধকারে ডুবে।এত ক্লান্ত ছিল যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের খেয়াল রাখে না সে একদম, এই তার ফল। হালকা নড়েচড়ে ওঠে বসতেই দেখে সমারোহ তার পাশে বসে খাটের হেডবোর্ডে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।কুহেলী সামান্য মুহূর্ত সমারোহকে দেখে বিছানা ছাড়তে গেলেই সমারোহ টের পেয়ে যায়। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে বলে,

‘আহা!উঠলে কেনো? কেমন লাগছে এখন?’

‘ভালো।’

‘কিছু লাগবে, আমায় বলো?’

‘হ্যা, আমার ফোনটা?’

‘আঙ্কেলকে ফোন দিবে তো! আমি দিয়ে দিচ্ছি নেটওয়ার্ক পাওয়া বেজায় মুশকিল।’

দুইবার কল করার পর রিসিভ করে সান্দ্র।ব্যস্ত কন্ঠে নিজে থেকেই বলতে থাকে,

‘আঙ্কেল মোটামুটি সুস্থ।উঠে বসে খাবার খেলো একটু আগে।কাল বাড়ি নেয়ার ব্যবস্থা করছি। অনেক কাজ।ব্যস্ত আছি।পরে ফোনদে।’

‘আঙ্কেলের সাথে কথা বলা যাবে?কুহেলী অস্থির হয়ে আছে।’

‘ও হ্যা ও কেমন আছে এখন?তুই একটা চিজও ভাই, কি এমন করলি যে মেয়েটা একদম অসুস্থই হইয়া গেলো!’

ফোন তখন লাউড স্পিকারে ছিল।সান্দ্র কথা শুনে কুহেলী চমকে সমারোহর দিকে তাকায়।এক মুহুর্তের জন্য চোখাচোখি হয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে যায় দুজন।কুহেলী চোখ সরিয়ে নেয়। সমারোহ রাগে গিজগিজ করে বলে,

‘তোরে একবার পাই আমি বেয়াদব!মেরে হায় গুঁড়া গুঁড়া করবো।যা আঙ্কেলের কাছে যা।’

সান্দ্র হেসে ফেলে।খোর্শেদের সাথে কথা হয় কুহেলী। এতো দিন পর বাবার কন্ঠ শুনেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে কুহেলী।খোর্শেদ খুব ভালো করে মেয়েকে বুঝান এতো চিন্তা না করতে।ভালো করে পড়ায় মন দিতে।আর জসীম তার চ্যালাপ্যালা নিয়ে উতঃ পেতে আছে কুহেলীর জন্য।তাই কোনোভাবেই না গ্রামে না ফিরতে।শরীর একটু সুস্থ হলে তিনি নিজেই এসে দেখে যাবেন কুহেলীকে। হাসনাহেনাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।কুহেলীও বুঝতে পারে।

___________________
আবির নামক ভূতটা চন্দ্রিমাকে দু’দন্ড শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।লোকটা বিদেশে গিয়েও যেন মাথায় চেপে আছে তার। সমস্যাটা কি! আবির যাওয়ার পর এতো এতো কেঁদেছে যে জ্বর এসে গিয়েছে।দুদিন পর উঠলো বিছানা থেকে।কাল চট্টগ্রামে চলে যাবে। একপ্রকার পালানো যাকে বলে। চন্দ্রিমার বাবা,মা সবাই গ্রামে চলে গিয়েছে গতকাল, সে একাই বাকি।বাড়ির ছাদে এসে রেলিংয়ে হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে আকাশ দেখছে চন্দ্রিমা।দিনের বেশির ভাগ সময়ই তার আকাশ দেখে নয়তো বইয়ের একগুঁয়ে পাতায় চোখ বুলিয়ে কাটে।পানসে হয়ে গেছে সময়গুলো সব।একটা সুন্দর কন্ঠ শুনে সচকিত হয়ে পেছনে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নেয় চন্দ্রিমা।মিসেস রাহেলা এসেছেন,আবিরের মা। চন্দ্রিমা তার চোখে চোখ মেলাতে পারে না,উনি নিতান্তই ভালো মানুষ।মিসেস রাহেলা চমৎকার ভঙ্গিমায় বলেন,

‘সারা বাড়ি খুঁজেও তোকে পেলাম না‌।একটু কফি বানিয়েছি দুই বান্ধবীতে মিলে খাবো এটাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।নে নে তাড়াতাড়ি নে।’

চন্দ্রিমা ভড়কে যায় ‘বান্ধবী’ শব্দটা শুনে।বোকার মতো চেয়ে থাকে মিসেসে রাহেলার দিকে।বয়স তার পঞ্চাশের কাছাকাছি কিন্তু দেখে মনে হয় ত্রিশ। ধবধবে সাদা শরীর, হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা ঘন চুল,কাজল কালো চোখ, শক্ত চাহনি আর ঠোঁটে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া হাসি!দেহে স্বর্ণ অলংকারের চাকচিক্য নেই, হালকা সাজে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেকে। শরীরে চমৎকার রঙিন শাড়ি।বুড়ো হতে হতেও মানুষ এতো সুন্দর থাকে কি করে! ভদ্রমহিলার রুচি অতি আধুনিক। চকচকে শাড়ি পড়ে সবসময়,দেখে যে কেউ নতুন বউই ভেবে নিতে পারেন।একটু বয়স করে বিয়ে করেছে আরকি! চন্দ্রিমার বেশ লাগে তাকে। কিন্তু কথা বলতে ভয় হয়‌। তাঁরা সবাই চন্দ্রিমাকে কতো ভালোবাসে,কতো অপেক্ষা করছে শুধু তার মুখ থেকে একটা ‘হ্যাঁ’ শোনার জন্য অথচ মেয়েটা তার ছেলেকে কেবল কষ্টই দিয়ে যাচ্ছে!
চন্দ্রিমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি আবার বলেন,

‘কিরে বুড়ো হচ্ছি বলে কি বান্ধবী বানাবি না আমাকে? আমার ছেলের মতো আমাকেও বাতিলের খাতায় ফেলে দিলি নাকি!’

‘এমা, ছিঃ ছিঃ!কি যে বলেন আপনি।’

‘তাহলে দাঁড়িয়ে কি?আয় আমার পাশে এসে বোস।গল্প করি একটু!’

চন্দ্রিমা গিয়ে মিসেস রাহেলার পাশে বসে। চুপচাপ মগ তুলে নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে আবার চমকে ওঠে সে।এ তো কফি নয় অমৃত!এতো স্বাদ।রাহেলা কফি খেতে খেতে বলে,

‘আবির আমার চেয়ে ভালো কফি করে,ওই কিন্তু কফি বানানো শিখিয়েছে আমায়।তুই না ভালোই করেছিস বদমাশটাকে বিয়ে না করে।’

চন্দ্রিমা হতচকিত হয় রাহেলার কথা শুনে। তিনি কি রেগে বলছেন কথাগুলো?মুখ দেখে তা মনে হচ্ছে না। খুব শান্ত তার চোখ দুটি। রাহেলা এক চুমুকে পুরো কফিটা শেষ করে মগ টেবিলে রেখে বলেন,

‘সবার আগে নিজের ক্যারিয়ার গড়বি।এখন তোর সময়টা নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দেয়ার, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করেও পদে পদে গোটা খেতে হয়। আবিরের বাবা যখন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমি তখন অনার্স কমপ্লিট করে ফেলেছি। মাস্টার্সে ভর্তি হবো।সেই ঊনিশশ একাশি সালের কথা। তখন মেয়েদের এতো দূর পর্যন্ত পড়ালেখা করাটাই বিরাট বিষয়।সে তখন বুয়েটের প্রফেসর।তাও আমি আবিরের বাবাকে প্রথমে ফিরিয়ে দেই। কষ্ট তো আমারো হয়।বেচারা অপেক্ষা করবে বলে বসে থাকে। তারপর আমি মাস্টার্স করি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেই।ক্যারিয়ার কে ভালো পজিশনে নেই তারপর বিয়ে করি দুজন। মানুষটা আমার থেকে হাজারটা ভালো পেতো,রোজ মেয়ের বাবারা বিয়ে দিতে তাদের বাড়িতে ঘটক পাঠাতো। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা।শেষে বিয়েটা করেই নিলাম!’

হো করে হেঁসে উঠেন মিসেস রাহেলা। চন্দ্রিমাও হাসে। গল্প শুনতে শুনতে তার কফি ঠান্ডা ডাল হয়ে যায়। চন্দ্রিমা হাসি থামিয়ে বলে,

‘আমি তাকে কষ্ট দিতে চাইনি।’

‘জানিরে জানি, ভালোবাসলে কষ্ট দেয়া যায়না‌।তবে কষ্ট একটু পাওয়া দরকার তবেই না একে অপরের প্রয়োজন বুঝবে।’

চন্দ্রিমা থতমত খেয়ে যায়। কিছু বলতে নিলে আগেই রাহেলা বলতে শুরু করেন,

‘তুই সবাইকে মিথ্যে বল,এমন কি আবিরকেও।আমি তোর চোখ দেখে মন পড়ে ফেলতে পারি।’

চন্দ্রিমা কেঁদে ফেলে এবার। কাঁদতে নিলে তাকে বাচ্চাদের মতো‌‌ দেখায়। কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো কন্ঠে বলে,

‘আমি উনাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমি বিদেশে যেতে চাই না, একদম চাই না সবাইকে ছেড়ে যেতে।’

মিসেস রাহেলা মমতাময়ী হাসি হেসে কাছে টেনে নেন চন্দ্রিমাকে। আহ্লাদী সুরে বলেন,

‘ওরে আমার প্রাণের মেয়েটা কতো কষ্ট চেপে রেখেছে বুকে। কাউকে বলেনি!সেকি ন্যায় করলো সবাই তোর সাথে!তোর এই বান্ধবী থাকতে চিন্তা কি হে?এমন জাদু শিখাবো তোকে যে আমার ছেলে তোর কথায় উঠবে আর বসবে দেখিস। কাঁদে না, একদম কাঁদে না ওই ফাজিল টার জন্য।’

চন্দ্রিমা কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো কন্ঠে বলে,
‘একমাত্র আপনি আমাকে বুঝলেন আন্টি।’

‘কিসের আন্টি?মা বলবি।নাহলে আমিও বাকিদের মতো বুঝবো না।’

চন্দ্রিমা হেসে ফেলে।সুখ দুঃখের গল্পের মাঝে আরো কাছাকাছি চলে আসে দুই মা মেয়ে।কিসের আবির!এখন রাহেলাই চন্দ্রিমার ভরসা।

চলবে.