আঙুলে আঙুল পর্ব-৭+৮

0
172

আঙুলে আঙুল

পর্ব (৭)

নিজের নামের এমন বিকৃতি উচ্চারণে সঞ্জয়ান হতভম্ব হলো। পর মুহূর্তে দাঁতের পাটি সংলগ্ন শক্ত হয়ে এলো। ক্রোধে চোখজোড়া জ্বলে উঠলেও সংযত করে বলল,
” প্রথমত, আমার নাম সঞ্জয়ান সাখাওয়াত। সাজনা শাক নয়। দ্বিতীয়ত, সাজনা একটি সবজি। শাক নয়। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী হয়ে সবজি ও শাকের মধ্যে পার্থক্য বুঝ না? তুমি রুহানিয়াতে চান্স পেলে কীভাবে? ”

অপমান ফিরে পেয়ে শূভ্রার মন ও মস্তিষ্ক দুই জায়গায় বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠল। যার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে সঞ্জয়ান বলল,
” তোমার শুধু মেধা নয়, ব্যবহারেও সমস্যা আছে। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এই শিক্ষাটা এখনও হয়নি। ”
” চুরির শিক্ষাটাও হয়নি। যেটা আপনার হয়েছে। ”
” মানে? ”
” আপনি চোর। আমার আইডি কার্ড চুরি করেছেন। ”

সঞ্জয়ান থতমত খেল। সরাসরি দোষারোপ করায় বিচলিতও হলো। কপালের মাঝে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
” আমি আইডি কার্ড চুরি করেছি? মিথ্যা আরোপ দিচ্ছ কেন? সমস্যা কী তোমার? ”

শূভ্রা কাঁধের ব্যাগের ফিতাটা ঠিক করে নিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল
” মিথ্যা না সত্যি। সেদিন হলের সামনে আমার আইডি কার্ড পড়ে গেছিল। আপনি কুড়িয়েছেন, কিন্তু অফিসে জমা দেননি। আবার বাবার কাছে নালিশ ঠিকই করেছেন। কেন? ”

সঞ্জয়ানের মনে পড়ল, সেদিন সত্যি সে মেয়েটির আইডি কার্ড পেয়েছিল। সেখানে মেয়েটির বাবার নাম লেখা থাকায় বুঝতে পারে শূভ্রা অসীউল্লাহর মেয়ে। অসীউল্লাহ কেরানি পদে থাকলেও সে মন থেকে খুব শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। কলেজে আসলে দেখা করে, কথাও বলে। এই সাধারণ সম্পর্ক থেকে তার পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কেও জানে। এর আগে কারও সাথে দেখা হয়নি। সেই প্রথম শূভ্রার সাথে দেখা। অসীউল্লাহ এত কষ্ট করে মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, আর মেয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হলে এসে ছবি দেখছে। ঘটনাটি তার একদমই পছন্দ হয়নি। তাই সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীর বাবাকে কল দেয়। কিন্তু নালিশটা করা হয়নি। ভেবেছিল, পরে এক সময় মেয়েটিকে ডেকে কথা বলবে। বুঝাবে। কল যেহেতু করেই ফেলেছে, সেহেতু আইডি কার্ডের কথাই তুলেছে ও বলেছে, অফিস রুমে জমা দিবে। শূভ্রা যেন নিয়ে নেয়। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়ায় কলেজে যাওয়া হয়নি। আইডি কার্ডটিও জমা দেওয়া হয়নি। সে মনে মনে দোষ স্বীকার করলেও সামনাসামনি প্রকাশ করল না। বলল,
” কাল জমা দিব। এখন আমার সাথে নেই। ”

শূভ্রাও মানার পাত্রী নয়। গোঁ ধরে বলল,
” আমার আজই চাই। নাহলে চিৎকার-চেঁচামেচি করব। ”

এই সময় সঞ্জয়ানের ব্যক্তিগত গাড়িটি এসে দাঁড়াল পাশে। ড্রাইভার নেমে এসে দরজা খুলে দিলে সে বলল,
” যা খুশি করো। আমি কোনো যাদুকর নই যে, তুমি বললে যাদু দিয়ে আইডি কার্ডটি হাজির করব। ”

বলতে বলতে সঞ্জয়ান গাড়ির মধ্যে বসে পড়ল। ড্রাইভার ছুটে চলার পূর্বে বলল,
” তোমার ক্লাস করতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কল করে বলে দিব। ”

রাগে-ক্ষোভে শূভ্রার অন্তরের ভেতর জ্বালা ধরে গেল। ঘন ঘন তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
” করব। কিছু তো একটা করবই। ”

__________

সকালের নাস্তা শেষ করে অরুণিমা তৈরি হচ্ছে। আয়নায় মুখটার দিকে তাকাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ডানগালে ব্রনগুলো এখন বাম গালেও ছড়িয়েছে! একটা বড় হয়ে বেশ ফুলেছে। ভেতরে সাদা তরল জমে আছে। এত বিশ্রী দেখাচ্ছে! অরুণিমা সেটাতে হাত লাগাতে নাজিয়া বেগম ধমকে ওঠলেন,
” আবার খুঁটছিস? নিষেধ করেছি না? দাগ হলে বুঝবি। পুরো মুখে ছড়াবে তো। ”

অরুণিমা হাত সরিয়ে নিল। ভার স্বরে বলল,
” মেকাপ করব কিভাবে? দেখা যাবে তো, মা। ”

নাজিয়া বেগম কাছে এগিয়ে এলেন। মেয়ের মুখটা ভালো করে দেখে বললেন,
” তুই তো দেখতে, এমনি অনেক সুন্দর। মাশ-আল্লাহ! এসব ছাইপাঁশ না মাখলে হয় না? ”

অরুণিমা হেসে ফেলল। বলল,
” না, হয় না। আমার কাজই তো এটা। সেজেগুজে দোকানে বসে থাকা। নাহলে কাস্টমার বিশ্বাস করবে, ভালো জিনিস বিক্রি করছি? নিজেকে মেখে বিশ্বাস করাতে হয়। ”

নাজিয়া বেগম কিছু একটা বলতে চাইলেন। তার আগেই শূভ্রা ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল,
” আমার আই-লাইনারটা শেষ হয়ে গেছে। আপু, নিয়ে এসো তো। ”

অরুণিমা অবাক স্বরে বলল,
” গত সপ্তাহে না এনে দিলাম, এর মধ্যে শেষ? ”

শূভ্রার ঘুম উড়ে গেছে। কাঁথার তলে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মনে পড়ল, শেষ হয়নি। ব্যাগে ছিল, হারিয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বলল,
” আমি কি মিথ্যা বলছি? তুমি এত জেরা করছ কেন, আপু? তোমার দোকানে কি অভাব পড়েছে? কষ্ট করে শুধু এনে দিবে। ”

অরুণিমা স্মরণ করে দিল,
” ওটা আমার দোকান নয়। আমি কর্মচারী। ”

শূভ্রা শোয়া থেকে উঠে বসল। শ্রুতিকটু গলায় বলল,
” একটা আই-লাইনারের জন্য কথা শোনাচ্ছ? ”

নাজিয়া বেগম দ্রুত কদমে ছোট মেয়ের কাছে গেলেন। মাথায় হালকা চাপড় মেরে বললেন,
” কয়টা বাজে দেখেছিস? নাস্তা দেওয়া আছে, জলদি খেয়ে তৈরি হ। কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

মেয়ের শরীর থেকে কাঁথাটা টেনে ভাঁজ করতে করতে বড় মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” নতুন আনতে হবে কেন? তোর আছে না? ওটা থেকে দিবে। পরে এক সময় কিনে দিস। ”

শূভ্রা সঙ্গে সঙ্গে তেজে উঠে বলল,
” না, দিব না। আপুর ব্যবহার করা জিনিস আমি দিব না, নিবও না। যদি নতুন দিতে পার দেও, নাহয় দিও না। ”

সে গোসলখানায় ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকে দিল। নাজিয়া বেগম মেয়ের কাণ্ডে অবাক হয়েছেন। হতভম্ব গলায় বললেন,
” ওর ব্যবহারটা দেখেছিস? দিন দিন খারাপই হচ্ছে। তোর বাবাকে বুঝাতে বুঝাতে আমারই ধৈর্যের সীমা পার হয়ে যাচ্ছে। কোন দিন না গায়ে হাত তুলে বসি। ”

অরুণিমা মায়ের কাছে এগিয়ে এলো। শান্ত স্বরে ভরসা দিয়ে বলল,
” চিন্তা করো না। আমি ওর সাথে কথা বলব। মনে হয়, কোনো ঝামেলা হয়েছে। ভয়ে আমাদের বলতে পারছে না। ”
” তাই যেন হয়। শীঘ্রই কথা বলে ঠিক কর। ”

নাজিয়া বেগম রুম থেকে চলে গেলেন। অরুণিমা সাজসামগ্রীর কাছে চলে গেল। আয়নায় তাকাতে মনে হলো, মাইমূন তার এই মেকাপের যাদুতেই হয়তো মুগ্ধ হয়েছে। কৃত্রিম সৌন্দর্যের জন্যই এতসব পাগলামি। এগুলো বন্ধ করতে হলে এই সাজ থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থাকতে হবে। অরুণিমা ভাবনামতো, প্রয়োজনীয় সাজ সামগ্রী ঝটপট ব্যাগে ভরে নিল। বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে যেতেই মাইমূনের ক্লাবটি পড়ল। বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছে, ভেতরে বেশ কয়েকজন আছে। কিছু সময় পর পর কেউ বের হচ্ছে, ঢুকছে। কিন্তু ভুল করেও কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। অরুণিমা প্রায় মিনিটের মতো সময় নিয়ে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। তবুও কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। অবশেষে বাধ্য হয়ে ডাকল,
” এই ছেলে, শোনো। ”

ছেলেটি মাত্রই ক্লাবের ভেতর থেকে বেরিয়েছে। চোখ-মুখ গম্ভীর। অঙ্গভঙ্গিতে ব্যস্তভাব। এক মুহূর্ত দ্বিধায় জড়িয়ে এগিয়ে এলো। সালাম প্রদর্শন করে সুধাল,
” ভাবি, কিছু বলবেন? ”

অরুণিমা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে ধারণা করেছিল, তারা হয়তো তাকে ভুলে গেছে। অথবা মিয়া ভাই ‘ ভাবি ‘ ডাকতে নিষেধ করেছে। সেই ধারণা ভুল হওয়ায় একটু বিরক্ত হলো। জিজ্ঞেস করল,
” মিয়া ভাই আছেন? ”
” জি। ডাকব? ”

অরুণিমা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আজ অনেক মানুষ দেখছি যে। ”

ছেলেটির মুখের গম্ভীর ভাব কেটে গেল। স্মিত হেসে বলল,
” হ্যাঁ, মিটিং হচ্ছে। ”
” কিসের? ”
” মিয়া ভাইয়ের ক্যাম্পাস থেকে বড় ভাইরা এসেছেন। ”

অরুণিমার কৌতূহল বাড়ল। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”

ছেলেটি উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা ভেবে বলল,
” ভাবি কি আর কিছু বলবেন? খুব ব্যস্ত আছি। ”

অরুণিমাও আর কথা বাড়াল না। হাতঘড়িতে চোখ বুলাল দ্রুত। অনেকটা সময় পার করে ফেলেছে। এখনই না এগুলে নয়। সে চটপটে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দিল ছেলেটির হাতে। বলল,
” আমার নাম করে, এটা মিয়া ভাইকে দিবে। বলবে, জরুরি। ”

চলবে

আঙুলে আঙুল

পর্ব (৮)

সঞ্জয়ান ঢাকা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করেছে দুই বছর হতে চলল। এর মধ্যেই বাবার কৃষি-পণ্য ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, পালনও করছে। চাল থেকে শুরু করে লেবু পর্যন্ত পাঠাচ্ছে সারা বাংলাদেশে। এই কাজের সূত্রে প্রায়শই শহরে যেতে হয়, থাকতেও হয়। রাত্রীযাপনের জন্য বাবার পক্ষ থেকে দুই কামড়ার বিশাল প্লটও উপহার পেয়েছে। আসবাবপত্র সুসজ্জিত সেই বাসায় কদাচিৎ থাকা হয়; সেটাও বেকায়দায় পড়লে। অন্যথা কাজ শেষ করে ছুটে চলে যায় পিতৃভিটা ‘ ছায়া নীড় ‘ এ। পিতা ও মাতার স্নেহছায়া আকণ্ঠ ডুবে থাকে পরম নিশ্চিন্তে। সুখ, শান্তি, নির্ভরতা সবটায় একই সাথে অনুভব করা যায় এখানটায়। সঞ্জয়ান ছায়ানীড়ে পৌঁছায় প্রায় শেষ রাতে। জননী দরজা মেলে হাসিমুখে বললেন,
” হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে যা একেবারে। তোর বাবা অপেক্ষা করছে। ”

সঞ্জয়ান গায়ের কোটটা খুলতে খুলতে বলল,
” বাবা খায়নি? ”
” তুই আসবি শুনলে একা একা খেয়েছে কখনও? ”

সে তাৎক্ষনাৎ ঘড়ি দেখল। তিনটা পার হয়েছে। বিস্ময় প্রকাশ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই বাবার গলা পাওয়া গেল,
” আদুরী? তোমার ছেলে কি ফিরল? ”

সঞ্জয়ানের মায়ের নাম স্বর্ণলতা। তার বাবা মুনছুর সাখাওয়াত ভালোবেসে ডাকেন আদুরী। স্বর্ণলতা ছেলের কোটটা হাতে নিয়ে স্বামীর দিকে অগ্রসর হলেন। কাছাকাছি পৌঁছে বললেন,
” হ্যাঁ, ফিরেছে। আপনি বসে পড়ুন। ও আসছে। ”

সঞ্জয়ান খাবার টেবিলে বসে বলল,
” তুমি খেয়ে নিলেই পারতে, বাবা। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক তাকালেন ছেলের দিকে। তারপরে কাঁপা হাতে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
” তুইও তো ঢাকার বাসায়টায় থেকে যেতে পারতি। ”

মাঝখান থেকে স্বর্ণলতা বললেন,
” আমাকে দিন, ভাতটা মেখে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বিনা প্রতিবাদে প্লেটটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন। মাখামাখির কাজ থেকে মুক্ত পেয়ে ছেলের দিকে ঝুকে এলেন। কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিস স্বরে বললেন,
” আমার চিরুনি এনেছিস? ”

সঞ্জয়ানের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। স্মরণ হলো, সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় বাবা চিরুনি আনতে বলে দিয়েছিলেন। রুহানিয়া কলেজ থেকে ফুটপাত ধরে একটু এগুলে একটা খুচরা দোকান পাওয়া যায়। সেখানে বিভিন্ন রঙের ছোট চিরুনি পাওয়া যায়। গ্রামের দিকটায় এই চিরুনিগুলো আগে পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যায় না। তাই বাবার ফরমায়েশ পেলে শহর থেকে সঞ্জয়ান এনে দেয়। আজ কাজ শেষ করে কলেজে যাওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এটাও। তন্মধ্যে শূভ্রার সাথে দেখা, কথা কাটাকাটির মধ্যে পড়ে বেমালুল ভুলে গেছে। ছেলের নীরবতায় মুনছুর সাখাওয়াত উত্তর পেয়ে গেছেন। লুকোছাপা ভুলে চওড়া স্বরে বললেন,
” একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারিস না! ”

সঞ্জয়ান অপরাধ স্বীকার করে নিল সঙ্গে সঙ্গে। বলল,
” কাল এনে দিব। সত্যি বলছি, বাবা। এবার ভুল হবে না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ছেলের কথায় ভুললেন না। রাগটাও সংযত করতে পারলেন না। ভাত রেখে উঠে পড়লেন। রুমের দিকে এগুতে এগুতে বিড়বিড় করলেন,
” বাবার প্রয়োজন ভুলে যায়। এ কেমন ছেলে? আদুরীকে এত করে নিষেধ করলাম, বাচ্চা নেওয়া দরকার নেই। তবুও নিল। এখন সেই ছেলে পদে পদে আমাকে অপদস্ত করছে। ”

স্বামীর উঁচু কণ্ঠ পেয়ে ভাত মাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন স্বর্ণলতা। এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আবার কী করেছিস? ”

সঞ্জয়ান অভিমানে স্বরে বলল,
” চিরুনি আনতে ভুলে গেছি। এজন্য এতগুলো কথা শুনাল! এটা কী ঠিক, মা? সামান্য চিরুনির জন্য…”

স্বর্ণলতা কথা শেষ করতে দিলেন না। মাঝে বললেন,
” তোর কাছে সামান্য চিরুনি হতে পারে, তাঁর জন্য না। তাঁর জন্য বউকে বশ করার মন্ত্র। জানিস না? ”

কথাটা বলে তিনি হেসে ফেললেন। নিশী রাতে তার হাসির শব্দে সারা বাড়ি চমকে উঠল যেন! সঞ্জয়ানের সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। চল্লিশোর্ধ্ব রমণী ঝংকার তোলা মুক্ত হাসির মধ্য থেকে বললেন,
” কলপ আর চিরুনি দিয়েই তো তিনি চিরতরুণ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ”

সঞ্জয়ান বিরক্ত না হয়ে পারল না। তার বাবার বয়স ষাট পেরিয়েছে। চুল, গোফ, ভ্রূ সব পাকা। হাঁটা চলায় শারীরিক দুর্বলতা ধরা যায়। তবুও সপ্তাহে একবার চুলে কলপ দেওয়া চাই। শত কাজের মধ্যেও দুই মিনিট অন্তর অন্তর চিরুনি চালাতে ভুল হয় না।

” এখনও! কী দরকার, মা? ”

স্বর্ণলতা ভাতের প্লেটটা হাতে তুলে নিলেন। স্বামীর রুমের দিকে পা বাড়ানোর পূর্বে বললেন,
” ভয়। যদি আমি চলে যাই। অন্য কাউকে বিয়ে করে নিই? ”
” বাড়াবাড়ি লাগে না? ”

ছেলের প্রশ্নে তিনি মিটিমিটি হাসলেন। খুব সুন্দর করে বললেন,
” না। মনে হয়, বয়স বাড়েনি। পরিবর্তন আসেনি। ”

সঞ্জয়ান বাবাকে ভালোবাসে না এমন নয়। বরঞ্চ উল্টো। বাবাকে খুব ভালোবাসে, মানেও। শুধু বাবা-মায়ের মধ্যকার যে সম্পর্কটা সেটা অদ্ভূত লাগে। মনে হয়, পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও তাদের মতো এমন স্বামী-স্ত্রী খুঁজে পাবে না। সে খাওয়া শেষ করে রুমে ঢুকল। কোটটা পরে বেরুতে নিলে মায়ের সাথে দেখা। তিনি অবাক হয়ে সুধালেন,
” কোথাও যাচ্ছিস? ”

সঞ্জয়ান অপরাধি সুরে বলল,
” বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে। ঘুম আসবে না। মন্ত্রটা নিয়ে আসি। ”

স্বর্ণলতা ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। আদুরে স্বরে বললেন,
” এখন যেতে হবে না। কাল একসময় নিয়ে আসিস। তিনি আর রাগ করে নেই। ”

মায়ের বাঁধাটাকে ডেঙাতে পারল না। একটুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল,
” বাবা খেয়েছে? ”

তিনি মৃদু স্বরে উত্তর করলেন,
” খেয়েছে। ”
” রাগ ভাঙলে কী করে? ”

ছেলের কণ্ঠে কৌতূহল, জানার তীব্র ইচ্ছা। স্বর্ণলতা উত্তর দিলেন না। মিষ্টি হেসে চলে গেলেন।

সেই রাতে সঞ্জয়ান পুরো ঘরে তল্লাশি চালাল। কিন্তু শূভ্রার আইডি কার্ড পেল না কোথাও। ভোরের দিকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

__________
‘ কোথায় আসব? ‘

মেসেজটা এসেছে অচেনা নাম্বার থেকে। অরুণিমা পুরো নাম্বারটা কয়েকবার পড়ল। তবুও চিনতে পারল না। মেসেজটা ডিলেট করার জন্য চেপে ধরতে আরেকটা মেসেজ আসল,

‘ খুব ঝামেলায় ছিলাম। তাই যোগাযোগ করতে দেরি হলো। আমি চাচ্ছিলাম না, ঝামেলা সঙ্গে নিয়ে দেখা করি। প্রথম বার আলাদাভাবে দেখা করতে চাচ্ছ। যতক্ষণ তোমার সাথে থাকব ততক্ষণ শুধু তোমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই। ‘

এতক্ষণে অরুণিমার টনক নড়ল। বুঝতে পারল, এটা অন্য কেউ নয়। মাইমূন। কিন্তু সে তার নাম্বার কোথায় পেল? কাগজটাতে কোনো নাম্বার লিখে দেয়নি। কিছু সেকেন্ড পেরুতে নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। যে তার গতিবিধি সর্বক্ষণ নজরে রাখে, তার পক্ষে নাম্বার যোগাড় করা কোনো ব্যাপার না।

অরুণিমা চিরকুট পাঠিয়েছিল দুইদিন আগে। এত দেরি করে উত্তর পাওয়া সত্ত্বেও সে পরবর্তী পরিকল্পনা করেনি। সে ভেবেছিল, অন্য সময়ের মতো এবারও মাইমূন হুট করে তার সামনে চলে আসবে। তেমনটা না ঘটায় এবার চিন্তায় পড়ে গেল। দেখা করার মতো কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে পারছে না। শেষে ফিরতি মেসেজ পাঠাল,
” আপনি বলুন। ”

সঙ্গে সঙ্গে মাইমূন লিখে জবাব দিল,
” সময়টা বলো। ”

অরুণিমা একটু ভেবে নিয়ে লিখল,

” আমার ছুটির পর। ”
” তাহলে তোমাদের ছাদে আসব। অপেক্ষা করো। ”

অরুণিমা খুব খুশি হলো। মল থেকে বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এই সময় একটা ছেলের সাথে অন্য কোথাও গিয়ে দেখা করা বিপদ্দজনক। মাইমূন নিজেই তো এক আস্ত বিপদ। বিপদ সঙ্গে থাকলেও জায়গাটা নিরাপদ হয়েছে। অরুণিমা নিশ্চিন্তে কাজ করতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে এটাও ভাবছে, কী বলে মাইমূনকে মানাবে। নিজের থেকে দূরে সরাবে।

[ চলবে।]