আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-১৭

0
665

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৭

গভীর রাত সময়টা অজানা।ঘড়ি দেখলে বলা যাবে কটা বাজে।রুপ্সিতা আলিফের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।আলিফ একহাতে রুপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে রুপ্সিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।দৃষ্টি তার রুপ্সিতার মুখপানে আবদ্ধ।অজস্র মায়া জড়িয়ে আছে এই মুখটিতে।আনমনেই আলিফ রুপ্সিতার কপালে গভীর চুমু এঁকে দুহাতে নিজের বুকের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নেয়।

প্রতিদিনের ন্যায় ভোরের দিকে রুপ্সিতার ঘুম ভেঙে যায়।ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আলিফের বাহুডোরে আবিষ্কার করে।নিজের জায়গায় স্থির থেকেই আলিফের আর নিজের দিকে তাকায়।এতদিন এদের মাঝখানে বর্ডার না থাকলেও দুজন খাটের দু’মাথায় অবস্থান করতো আর এখন একে অপরের একদম কাছাকাছি।এতটাই কাছাকাছি যে আলিফের হার্টের কম্পনরত ধ্বনি রুপ্সিতার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।আলিফের উন্মুক্ত বুকের দিকে তাকিয়ে কালরাতের কথা মনে পড়ে গেলো রুপ্সিতার।ভালোলাগা আর লজ্জা মিশ্রিত হাসি ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠতেই দুহাতে মুখ ঢেকে নেয় রুপ্সিতা।

কিছু একটা মনে পড়তেই রুপ্সিতা চট করে মুখ থেকে হাত সরিয়ে খুব সাবধানে আলিফের হাতের বাধন থেকে সরে আসে।আযান হয়ে গেছে অনেক আগেই তাই রুপ্সিতা দেরি করতে চাইছেনা।দ্রুত গোসল সেরে নামায আদায় করতে হবে।চটজলদি গোসল সেরে আলিফকে ডাকতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি।আলিফকে ডাকতে কেমন লজ্জা লাগছে আজ।লজ্জাকে একপাশে ঠেলে রেখে মৃদুস্বরে আলিফকে ডাকতে লাগলো নামাযতো পড়তে হবে।

এই যে শুনছেন?আলিফ উঠুন!

আলিফ নড়েচড়ে উঠে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,উমম!ঘুমোতে দাও না।
রুপ্সিতা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,আগে উঠে নামায পড়ে নিন।নামাযের সময় চলে যাচ্ছে।না উঠলে কিন্তু গায়ে জগের পানি ঢেলে দেবো।
আলিফ লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামে।ওয়াশরুম যেতে যেতে বলে তোমার খবর আছে আগে নামায পড়ে নিই।
রুপ্সিতা নামায শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বসলো।আলিফও গোসল সেরে নামায পড়ে নিলো।খাটে গিয়ে রুপ্সিতাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে রুপ্সিতার দুহাত চেপে ধরে বলল,কি বলেছিলে যেন?আমার গায়ে পানি ঢেলে দিবে?আচ্ছা চলো পানি ঢালতে হবেনা দুজনের যাতে আবার শাওয়ার নেওয়া লাগে সেই ব্যবস্থাই করি।রুপ্সিতা চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে বলল,একদম না।উঠুন আমার উপর থেকে অসভ্য লোক কোথাকার!

আলিফ সরে না গিয়ে রুপ্সিতার উপর আরেকটু ভর ছেড়ে দিয়ে ঘোরলাগা কন্ঠে বলে উঠে,তাহলে একটু অসভ্যতামি করাই যায় নাকি?রুপ্সিতার জান যায় যায় অবস্থা।আলিফ রুপ্সিতার গলায় মুখ গুঁজে আছে।আলিফের শ্বাস-প্রশ্বাস গিয়ে রুপ্সিতার ঘাড়ে পড়ছে।রুপ্সিতা আলিফকে সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে।আলিফ রুপ্সিতার ঘাড়ের দিকে কামড়ে ধরতেই রুপ্সিতা মৃদু চিৎকার করে উঠে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,কালরাত থেকেই আমাকে কামড়ে শেষ করেছেন এখনইও কামড়াচ্ছেন রাক্ষস কোথাকার।

আলিফ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,আর আমার শরীরে যে অজস্র নখের আচড় আছে সেগুলো কে দিয়েছে?
রুপ্সিতা আমতা আমতা করে বলছে,আব আমি আমি কিজানি?
আলিফ আবারও রুপ্সিতার গলায় বাইট দিতেই রুপ্সিতা চেঁচিয়ে বলে উঠে,আমি আমি দিয়েছি।
আলিফ মুচকি হেসে বাইট দেওয়া স্থানে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায়।রুপ্সিতা চোখজোড়া বন্ধ করে নিতেই আলিফ আরো গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হয়।

সকালের নাস্তা সেরে আলিফ আর আরিফ নিজেদের অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে।ইরিন সানিকে খাবার খাওয়াচ্ছে রুপ্সিতা টিভি দেখছে বসে বসে।
বিকেলে আলিফ বাসায় এসে দেখে রুপ্সিতা নিজের পায়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে।আলিফ অফিসের ব্যাগ রেখে জিজ্ঞেস করলো,এভাবে কি দেখতেছো?
রুপ্সিতা ঠোঁট উল্টে বলল,পায়ে তিল থাকলে নাকি বিদেশে যায় আমার পায়েতো একটা নয় দুটো তিল আছে তাহলে আমি বিদেশে গেলাম কখন?
আলিফ রুপ্সিতার ঠোঁট উল্টানো দেখে হেসে দিয়ে বলে,ঠিক আছে আমরাও বিদেশে যাবো যখন আমাদের ব্যাটেলিয়নরা পৃথিবীতে আসবে।

রুপ্সিতা চোখ বড় বড় করে বলল,ব্যাটেলিয়নরা মানে?আপনি কয়টার কথা বলতেছেন ডজন খানেক নয়তো?
আলিফ চোখ ছোট ছোট করে বলল,তুমিইতো বললে দুজনের কথা।একজন রালিফ একজন আলিফা তাহলে ব্যাটেলিয়নরা হলো না?
রুপ্সিতা বলল,ওহ আচ্ছা!আমিতো ভেবেছিলাম আপনি ডজন খানেকের কথা বলছেন।আলিফ দাঁত কেলিয়ে বলল,ডজন খানেক হলেও আমার সমস্যা নেই।
রুপ্সিতা একটা বালিস নিয়ে আলিফের দিকে ছুড়ে মারে।আলিফ ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।

—————————
মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।রুপ্সিতার ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা চলে এসেছে।কিছুদিন বাদেই পরীক্ষা শুরু হবে।এখন পুরোদমে পড়ালেখা করছে ওর পড়ালেখার ব্যাপারে আলিফ ও বেশ জোরদার দিচ্ছে।

রিতার চেহারার রং দিন দিন কমেই চলেছে।অথচ প্রেগন্যান্সির সময়টাতে মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় কিন্তু রিতার ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত।খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করেনা সারাদিন চাুপচাপ থাকে।শোভনের সাথেও ঠিক করে কথা বলেনা শোভন ও নিজের প্রয়োজন ছাড়া কথা বলার চেষ্টা করেনা।মাঝে মাঝেই রিতা ঢুকরে কেঁদে ওঠে রুপ্সিতার সাথে করা অন্যায়ের কথা মনে করে।ইচ্ছে করে একবার বোনটার সাথে কথা বলতে কিন্তু কোন মুখে কথা বলবে?শোভনের বিষয়টা কাউকেই জানাতে পারছেনা সে রুপ্সিতার সংসার ভাঙার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে।একবার বোনের সাথে অন্যায় করে দ্বিতীয় বার তার সংসার ভাঙার কারণ হতে চায় না রিতা।

শোভন!শোভন!
শোভন বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো নিচ থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে শোভনের পিলে চমকে উঠে।তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,সাথী!তুমি এখানে কি করছো?বাবা মা কি মনে করবে তাদের পুত্রবধূ বিয়ের আগে বাসায় এসে এরকম চিল্লাচিল্লি করলে।আসো আমার সাথে বেরিয়ে আসো বাবা মা কেউ এখনো দেখেনি।সাথী শোভনের হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,কোথাও যাবো না আমি।আজ তোর মুখোশ খুলে দিয়ে তারপর আমি এখান থেকে যাবো।ডাক কোথায় আছে তোর বাবা,মা,বউ।

সাথীর কথা শুনে আলিফ চমকে উঠে বলে,বউ?আর তুমি কিসের মুখোশ খোলার কথা বলছো?
সাথী দাঁতে দাঁত পিষে বলল,একদম ন্যাকামি করবেনা।আমি সবকিছু জেনে গিয়েছি তোমার কয়টা মেয়ের সাথে এরকম রিলেশন আছে।বাড়িতে বউ রেখে এসব করতে লজ্জা লাগেনা?
এতক্ষণে শোভনের বাবা মা,রিতা নিচে নেমে এসেছে।
তাদেরকে দেখে শোভন সাথীকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।সাথী চিৎকার করে বলছে আমি আজ তোমার মুখোশ উন্মোচন করা ছাড়া কোথাও যাবোনা।রিতা সাথীকে দেখে চমকে উঠে ওর যতদূর মনে হয় শোভনের সাথে দুই মিনিটের ভিডিও ক্লিপে এই মেয়েটাই ছিলো।শোভনের বাবা মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তাদের কিছুই বোধগম্য হচ্ছেনা।সাথী শোভনের বাবা মায়ের সামনে গিয়ে বলে,ছেলে জন্ম দিয়েছেন অথচ ছেলে কি কি করে বেড়াচ্ছে সে খবর রাখছেন না।রিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে আর তুমি!তোমার স্বামী যে তোমাকে রেখে বাইরে মেয়েদেরকে নিয়ে ফূর্তি করে যাচ্ছে,দিনের পর দিন তোমাকে ঠকিয়ে যাচ্ছে সেখবর রাখো তুমি?

স্টপ সাথী!আই সেইড স্টপ!চিল্লিয়ে বলে উঠলো শোভন।তারচেয়ে দ্বিগুন জোরে চিল্লিয়ে সাথী বলল,তুমি চুপ থাকো।
তারপর একেরপর এক ঘটনা গুলো বলতে থাকে।

এই ছেলে একটা মেয়েবাজ।মেয়েদেরকে ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে বিয়ে করবে বলে বেড পর্যন্ত নিয়ে যায়।নিজের ঘরে বউ রেখে অন্যনারীতে আসক্ত হয় শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য।আমাকেও বিয়ে করবে বলে আমার সব কিছু কেঁড়ে নিয়েছে।কথাটা বলতেই সাথীর চোখ পানিতে টলমল করে উঠে।আমি কিছুই জানতাম না প্রথমে যখন আমার ফ্রেন্ড ইশান আমাকে এগুলো বলেছিলো তখন আমি কিছু বিশ্বাস করিনি।উল্টো ইশানকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করেছি।তারপরেও ইশান থেমে থাকেনি যেসকল মেয়েদের সাথে শোভনের সম্পর্ক ছিলো ওদেরকে একসাথ করে আমাকেও সেখানে নিয়ে যায়।সবার বলা ইনফরমেশনে ইশানের কথাগুলো মিলে যায়।পরে আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি শোভন বিবাহিত তার উপর ওর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।মেয়েগুলো দ্বিতীয়বার শোভনের সামনে আসতে চায় না তাই আমি একাই এসেছি।

শোভন ওর মা বাবার কাছে গিয়ে বলে এই মেয়ে সব মিথ্যা বলতেছে।তোমারা কিছু বিশ্বাস করবেনা।শোভানের বাবা মার মাথা হ্যাং হয়ে আছে কি শুনছে নিজের ছেলের নামে এগুলো।তাদের এসব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছেনা।তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেনা।
এবার রিতা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,কিছুই মিথ্যা না সব সত্যি কথা।ওই জানোয়ার আমার বোনের সাথেও একই কাজ করার চেষ্টা করেছিলো।আমার বোন রাজি না হওয়ায় আমার বোনকে সবার চোখে নিচ আর ছোট করেছে।এতদিন আমি চুপ ছিলাম কারণ ওই জানোয়ার আমার মুখ বন্ধ রেখেছিলো।আমি মুখ খুললে আমার বোনের সংসার ভাঙতেও দু’বার ভাবতোনা।
এবার ওই জানোয়ারের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করবো।

শোভন আর কাউকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো না।ডাইনিং থেকে ফল কাটার ছুরি হাতে নিয়ে পেছন থেকে সাথীর গলায় চেপে ধরলো।আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই শেষ করে দেবো।রিতার দিকে তাকিয়ে বলল,তোকেতো আমি পরে দেখে নেবো দেখি এবার কিকরে নিজের বোনের সম্মান আর সংসার দুইটাই টেকাতে পারিস।

শোভনের বাবা মায়ের এতক্ষণেও ছেলের প্রতি যে বিশ্বাস ছিলো তা শোভনের এই মুহূর্তে করা কাজে ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেছে।শোভনের বাবা এগিয়ে আসতে নিলেই শোভন জবাব দিলো,একদম না কেউ জায়গা থেকে নড়বেনা।আমার কথার হেরফের হলে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো সবগুলোকে।সবাই আতঙ্কিত হয়ে আছে।শোভনের বাবা মায়ের নিজেদের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে এই ছেলেকে দুনিয়ার মুখ দেখিয়ে।

সাথীর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি।শোভন সাথীকে হাসতে দেখে বলল,মরার ভয়ে পাগল হয়ে গেলি নাকি?
সাথী ঠোঁটেের কোনে আগের মতোই হাসি স্থির রেখে বলল তোর জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সেজন্যই হাসছি।
শোভন ভড়কে গেলো সাথীর কথায়।সারপ্রাইজ মানেতো নিশ্চয়ই সাথী কিছু একটা প্ল্যান করে রেখেছে।
শোভন সাথীর গলায় ছুরিটা আরেকটু চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,কি প্ল্যান করেছিস বল নয়তো আর এক সেকেন্ডও বাঁচার সুযোগ পাবিনা।
সাথী শান্ত স্বরে জবাব দেয়,রিল্যাক্স!এতো তাড়া কিসের?আরেকটু অপেক্ষা কর দেখবি সারপ্রাইজ তোর সামনে।

#চলবে……..।
ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।