আজ তার বিয়ে পর্ব-০১

0
4315

# আজ_তার_বিয়ে
# লেখিকা -নাইমা জাহান রিতু
# পর্ব -১

-“মা,আমি না এলেই কি হতো না?”
-“না হতো না।তোর ফুপু ফুপা কি ভাবতো?আর
তোর বাবা ও রেগে যেত।আর এসে তো তোর
কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।”
একরাশ হতাশা নিয়ে অদ্রিকা তার মা
শাহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো
-“আমার ভালোলাগছে না মা।মাথাটা
ঘুরাচ্ছে।এই শরীরে আমাকে তোমরা বিয়ে
বাড়িতে না আনলেও পারতে।”
-“এটা কি ধরণের কথা অদ্রি!একমাত্র ফুপুর
ছেলের বিয়েতে আসবি না?”
-“আসবো না সেটা বলি নি।কিন্তু..”
শাহানা বেগম এ পর্যায়ে ভ্রু কুচকে বললো
-“বেশি কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাক।
এতোটাও অসুস্থ না তুই।আমি একটু তোর ফুপুর
কাছ থেকে ঘুরে আসি।”
অদ্রিকা মায়ের কথা শুনে চুপচাপ লক্ষ্মী
মেয়ের মতো শুয়ে পড়লো।ইদানীং তার শরীর
টা ভালো যাচ্ছে না।জ্বর,ঠান্ডা,শরীর
ব্যথা,মাথা ঘোরানি,বমি বমি ভাব সহ আরো
অনেক রোগ লেগেই আছে।অবশ্য এগুলো তো
শরীরের রোগ,মেডিসিন নিলে ধীরেধীরে
ঠিক হবে।অথচ তার মনে যে রোগটা হয়েছে
তার কি হবে?এটার জন্য কি কোনো মেডিসিন
আছে??
কটকটে সবুজ রঙ এর সিলকের
পাঞ্জাবি,চোখে মোটা ফ্রেমের গ্লাস পড়ে
ছাদের এক কোনায় বসে আছে ইমতিয়াজ।মাথা
ভর্তি চুল গুলো আগোছালো।বোঝাই যাচ্ছে
তার সোজা সোজা চুল গুলো জেল দিয়ে খাড়া
করে রাখার চেষ্টায় সে আজ ব্যর্থ।মৃদু
বাতাসে তার সামনের কিছু চুল ফর্সা কপাল
বেয়ে চশমার উপর এসে পড়ছে।গোল দুটো ছোট
ছোট চোখ দিয়ে সে একমনে তাকিয়ে
আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছে।আর পুরু ঠোঁট
দিয়ে সিগারেট শুষে নিচ্ছে।হঠাৎ পিছনে
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে তাকিয়ে
সিগারেট টা হাত থেকে ফেলে মুচকি হেসে
বললো
-“কিছু বলবে মা?”
-“হ্যা।তুই কি আখি কে একবার কল করে কথা
বলতে পারবি?”
আখির কথা শুনে ইমতিয়াজের ঠোটের এর
হাসি এক নিমিষে মিলিয়ে গেল।সে বিব্রত
ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো
-“পারবো”।
-“নাম্বার টা না নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
হাটা থামিয়ে দিয়ে ইমতিয়াজ তার মা
আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো
-“মা,আমার ফোনে কথা বলা টা পছন্দ না।”
-“আজ বাদে কাল ওর সাথে তোর বিয়ে।অথচ ওর
সাথে একবারো দেখা করলি না তুই।অন্তত
ফোনে কথা টা তো বলতে পারিস”।
-“বিয়ের পরেই না হয় একবারে কথা বলবো”।
-“একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর ব্যাপার
আছে,ইমতি।সব বিষয়ে এমন উদাসীন হলে চলে
না।”
-“তুমি দেখে শুনেই ঠিক করেছো।নাম্বার টা
দাও”।
নাম্বার টা একটি কাগজে লিখে এনেছিল
আয়েশা বেগম।ছেলের হাতে কাগজের টুকরো
টা দিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছেলের গমন
পথে তাকিয়ে রইলো আয়েশা বেগম।ঢাকার
মাঝে নিজস্ব বিশাল এক ৮ তলার বাড়িতে
স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করে সে।এই যুগে
ঢাকা শহরে নিজস্ব বাড়ি থাকা মানেই অনেক
কিছু।অবশ্য তাদের শুধু এখানেই না,গ্রামেও ২
টা বিশাল বিশাল বাড়ি আছে।টাকা পয়সার
অভাব নেই বললেই চলে।কোন দিন টাকার
অভাব কি সেটা বুঝতে ও দেয় নি তার স্বামি
আফজাল সাহেব।পড়শু তাদের ছোট ছেলে
ইমতিয়াজ এর বিয়ে।এটাই তাদের বাড়ির শেষ
বিয়ে। তার বড় এক ছেলে আর মেয়ের
বিয়েটাও সেরে ফেলেছে এর মাঝে।শেষ
বিয়ে হিসেবে তেমন একটা হৈচৈ অবশ্য হচ্ছে
না।পুরো বাড়ির বাইরে আলোক সজ্জায় ভরে
আছে।অথচ বাড়ির ভেতর টা কতোটাই না
নির্জন।অবশ্য যার বিয়ে তার নিজেরই মনে
কোনো হৈচৈ নেই,প্রফুল্লতা নেই।সেখানে
বাড়ির অন্যজন আর কি করবে!আয়েশা বেগম
যখন এসব একমনে ভাবছিল ঠিক তখনি শাহানা
বেগম তাকে ডাকতে ছাদে এল।আয়েশা
বেগমরা দুই ভাই বোন।তার ছোট ভাই আজিজ
সরকার গ্রামের একটা স্কুলের মাস্টার।
ইমতিয়াজ এর বিয়েতে যে তারাও এসেছে
এটা একদম ভূলেই গিয়েছিল আয়েশা বেগম।
কিন্তু তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী শাহানাকে
দেখে মনে পড়লো তার।অনেকটা কেপে উঠেই
বললো সে
-“কখন এসেছো তোমরা?”
-“জ্বি আপা,কিছুক্ষণ হলো।মেয়েটার শরীর
একদম ভালো না আপা।আসতেই চাইতেছিল না।
জোর করে আপনার ভাই নিয়ে এসেছে।তার
একটাই কথা,ভাগনের বিয়েতে কি দেড়ি করে
এলে হয়!আরে এখানে দেড়ির কি হলো আপা
বলেন তো?মেয়েটার দিকেও তো তাকাতে
হবে।আর মেয়ে আমার গতকালই ভার্সিটি
থেকে গ্রামে আসছে আর আজই জোড় করে
ঢাকায় নিয়ে এল।আপনার ভাই টা খুব বেশি
বাড়াবাড়ি…..”
অন্যমনস্ক হয়ে আয়েশা বেগম চুপচাপ তাকিয়ে
রইলো শাহানা বেগমের দিকে।শাহানা
বেগমের কথা গুলো তার এখন আর কানে আসছে
না।সে এখন গভীর এক চিন্তায় ডুবে আছে।এই
চিন্তার শেষ কোথায়?
পুরো নাম অদ্রিকা সরকার।সংক্ষেপে সবাই
অদ্রি বলে ডাকে অদ্রিকাকে।আজিজ
সরকারের আদরের একমাত্র মেয়ে অদ্রি।
রাজশাহী ভার্সিটিতে সাইকোলজি
ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্স করছে সে।৩য়
বর্ষের পরীক্ষা শেষে গতকালই গ্রামের
বাড়িতে এসেছিল কিছুটা সময় কাটাতে।কিন্তু
তা আর হয়ে উঠলো না।বাবা মার
চাপাচাপিতে ঢাকায় আসতে হলো তার
ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে এটেন্ড করতে।
বিয়েতে এসেছে ঠিকই।কিন্তু কিছুতেই
বিয়েটা এঞ্জয় করতে পারছে না সে।শরীর টা
সায় দিচ্ছে না কিছুতেই।অদ্রি বিছানায় শুয়ে
কানে ইয়ারফোন গুঁজে কুয়াশা শুনছিল।কুয়াশা
টা শুনতে তার কেন যেন খুব বেশি ভালো
লাগে।সময় পেলেই কুয়াশা নিয়ে বসে সে।
বিশেষ করে রাতে।হোস্টেলে থাকতে অদ্রি
আর শেফা মিলে আলো বন্ধ করে কাথার
মাঝে মাথা ঢুকিয়ে ফুল সাউন্ড দিয়ে চুপচাপ
কুয়াশা শোনে।আর এক একটা গল্পে ভয়ে
কেপে কেপে উঠে শরীর।তারপর ও রাত জেগে
কুয়াশা শোনা টা তাদের দুই বান্ধবীর
অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।দরজায় কড়ার
আওয়াজ শুনে অদ্রি চোখ মেলে তাকিয়ে
হাসি মুখে উঠে বসতে বসতে বললো
-“কেমন আছো ভাবি?”
আয়েশা বেগমের বড় ছেলে ইফতেখারের স্ত্রী
শিমা অভিমানী স্বরে বললো
-“কথা বলিস না একদম।এসে একবারো আমার
খোজ নিতে গিয়েছিলি?”
অদ্রি তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বললো
-“সরি ভাবি।আসলে শরীর টা ভালো না।”
-“হয়ছে।আর অজুহাত দেখাবি না।এসেই
মহারানী ভিক্টোরিয়ার মতো রুমে এসে
উঠেছিস।”
-“বের হতাম একটু পর।ভাইয়া কেমন আছে?”
-“ওর কথা আর বলিস না।মনে হচ্ছে ওর ভাইয়ের
না নিজের বিয়ে।এত লাফালাফি করছে।অসহ্য
লাগছে একদম।আর ওদিকে বর মহাশয় চুপ করে
ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে আছে।”
-“অহ”।
-“অহো!আসল কথাই তো বললাম না।আমি
পার্লারে যাচ্ছি।তুই ও চল।দিনে দিনে
চেহারার কি হাল করেছিস?কাল হলুদ।আজকের
মাঝে চেহারাটা পালটে ফেলবি।উঠ।”
অদ্রি হাই তুলতে তুলতে বললো
-“সম্ভব না।আমি এখন ঘুমাবো।”
-“উঠ বলছি এখনি।”
অদ্রির কোনো কথা না শুনে শিমা অদ্রিকে
হাত ধরে টেনে উঠিয়ে পার্লারের উদ্দেশ্যে
বের হলো।অদ্রি ও তেমন একটা বাধা দিল না।
অদ্রির শিমা ভাবিকে খুব বেশি ভালো
লাগে।কতোটা মিশুক হলে এতটা আপন করে
নিতে পারে সবাইকে এটা শিমাকে না
দেখলে জানতো না অদ্রি।বড় লোক ঘরের
মেয়ে,এ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তার
জুড়ি নেই,যথেষ্ট স্মার্ট,স্টাইলিশ।তবুও এ নিয়ে
তার মনে কোনো অহংকার নেই।সবার সাথে
কতো স্বাভাবিক ভাবেই না মিশে সে।অবশ্য
এতে ইফতেখার ভাইয়ার হাত ও আছে।ভাইয়া
যদি পথ চলতে তাকে সাহায্য না করতো
তাহলে এতোটা পথ সে একা এতোটা সহজ
ভাবে পেড়িয়ে আসতে পারতো না।প্রত্যেকটা
স্বামীরই উচিৎ তার স্ত্রীর প্রত্যেকটা
পদক্ষেপে তার পাশে দাঁড়ানো।তেমন স্ত্রীর
ও উচিৎ স্বামীর প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তে তার
সাথে থাকা।আর সেই কাজ টা ইফতেখার ভাই
আর শিমা ভাবি অনেক ভালো করেই করে এটা
তাদের মাঝের বন্ধন টা দেখেই বোঝা যায়।
-“হ্যালো?….
হ্যালো?”
ইমতিয়াজ কি বলবে বুঝতে পারছে না।মায়ের
জোড়াজুড়িতে তো ফোন টা করলো আখি
নামের মেয়েটাকে।কিন্তু এখন গলায় এসে
কথা আটকে গেছে।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে
না।ফোনটা কি কেটে দিবে সে?না এটা
অভদ্রতা হয়।কিন্তু বলবে টা কি?অপাশ থেকে
আখি হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে।আচ্ছা
মেয়েটা এমন কর্কষ কন্ঠি কেন!দেখতে কেমন
হবে তাহলে?কালো,মোটা,নাক বোঁচা টাইপের
কোনো মেয়ে নাকি!হলে হবে।এতে এত ভাবার
কি আছে?মা যেহেতু ঠিক করেছে অবশ্যয়
স্ট্যাটাস বুঝে শুনেই কোনো মেয়েকে বৌ
করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ছোট্ট একটা
নিশ্বাস ছেড়ে ইমতিয়াজ ফোনটা কেটে দিল।
তার পরপরই ইমতিয়াজ এর ফোনে কল এল ওই
নাম্বার টা থেকে।ইমতিয়াজ আর কিছু না
ভেবেই রোবটের মতো ফোনটা কানে নিয়ে
বললো
-“আমি ইমতিয়াজ।নেটওয়ার্ক এর সমস্যা ছিল
হয়তো।কেটে যাচ্ছে বারবার”।
আখি ইমতিয়াজ এর কথা শুনে যেন প্রাণ ফিরে
পেল।এতোদিন হলো বিয়েটা ঠিক হয়েছে অথচ
ইমতিয়াজ নামের লোকটি একবারো ফোন
করেনি তাকে।দেখা করা তো দুরের কথা।
ইমতিয়াজ এর পরিবার তাকে দেখতে এলেও
সে নিজে একবারো আখিকে দেখে নি।
ইমতিয়াজ এর মার পছন্দেই তাকে হাতে
আংটি পড়িয়ে বিয়েটা পাকাপোক্ত হয়েছে।
আখি ও ইমতিয়াজ এর ছবি দেখে অমত করে নি।
এমন চেহারার ছেলে পাওয়া ভাজ্ঞের
ব্যাপার।আর সে নিজে যদি পেয়েই যায়
তাহলে অবশ্যয় না করবে না।কিন্তু যেহেতু
ইমতিয়াজ নিজে আখিকে দেখতে আসে নি
সেহেতু এখানে কিছু গড়বড় অবশ্যয় আছে।কিন্তু
ইমতিয়াজ এর পরিবার ব্যাবসায়ী ঝামেলা
বলে বিষয় টা কাটিয়ে দিয়েছে।আর সবাই
এটা মেনে নিলেও আখির মনের ভেতর কেমন
যেম খচখচ করছিল।কিন্তু মাত্র পাওয়া
ইমতিয়াজ এর ফোন টা পেয়ে তার মন টা
লাফিয়ে উঠেছে।নাম্বার টা আখির ফোনে
সেভই ছিল।বাবার ফোন থেকে চুপ করে
নাম্বার টা জোগাড় করেছে সে।তারপর
থেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনছিল।কবে কল দিবে
ইমতিয়াজ।অবশ্য আখি নিজেও কল করতে
পারতো।কিন্তু বিষয় টা ভালো দেখায় না।মনে
হয় বিয়ের জন্য পাগল হয়ে আছে সে।
-“কথা বলছেন না যে?”
ইমতিয়াজ এর কথায় আখির চিন্তায় ছেদ
পড়লো।তার এখন খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে।
কিন্তু এটা এখন সম্ভব না।কথা টা বলে তারপর
না হয় একটা ড্যান্স দেওয়া যাবে।তাই
আপাতত নাচার ইচ্ছা টা দমন করে আখি লাজুক
ভঙ্গিতে বললো
-“না মানে…আপনি ভালো আছেন?”
-“জ্বি।আপনি?”
-“এতোক্ষন ছিলাম না,কিন্তু এখন আছি।”
ইমতিয়াজ আর কি বলবে ভেবে না পেয়ে
বললো
-“অহ”।
-আমি কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক ছোট।এবার
এইচএসসি দিব।সো প্লিজ আপনি আমাকে তুমি
করে বলবেন”।
ইমতিয়াজ আখির কথা টা শুনে কিছুটা হতভম্ব
হয়ে গেল।এত ছোট মেয়ের সাথে তার বিয়ে!
তার মা তো তাকে এটা জানাই নি।নাহ,হয়তো
জানিয়েছিল।অন্যমনস্ক থাকার ফলে হয়তো
বিষয়টা খেয়াল করেনি সে নিজে।কিন্তু এত
ছোট মেয়েকে বিয়ে করা কি সম্ভব?আখির
বাবা তো মন্ত্রী।মন্ত্রী রা কি এত অল্প বয়সে
তাদের মেয়েদের বিয়ে দেয় নাকি!এতো অল্প
বয়সে তো বিয়ে দেয় গরীব ঘরের মেয়েদের।
যাদের বাড়িতে রেখে ভাত দেওয়া টাই
বোঝা বলে মনে হয়।তখন গরীব ঘরের মেয়েদের
বিয়ে দিয়ে তারা বোঝা মুক্ত হয়।কিন্তু
এক্ষেত্রে তো আখি গরীব ঘরের মেয়ে না।
তাহলে সমস্যা টা কি হতে পারে?ইমতিয়াজ
খুব স্বাভাবিক গলায় বললো
-“হুম,জানি।তো এত অল্প বয়সে বিয়ে করছো
কেন?আর তোমার বাবাই বা দিচ্ছে কেন?”
-“কেন?অল্প বয়সে বিয়ে করা কি পাপ নাকি?
অল্প বয়সের মেয়েদের বুঝি বিয়ে করতে ইচ্ছে
করে না।”
বলেই জিহ্বা টা কামড় দিল আখি।হায় হায় সে
কি বলে ফেলেছে!
আখির কথা শুনে হেসে ফেললো ইমতিয়াজ।
হাসতে হাসতেই বললো
-“সেটা বলি নি।আসলে বড়লোক বাড়ির
মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে…”
ইমতিয়াজ কে থামিয়ে দিয়ে আখি বললো
-“আসলে আমি দেখতে অনেক বেশি রূপবতী
তো।তাই আমাকে এভাবে বাসায় বসিয়ে
রাখা রিস্ক।কবে না কবে আবার বিরোধী
দলের কেউ এসে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
তখন পরের দিন সংবাদপত্রে হেডলাইনে উঠবে
‘মন্ত্রির রূপবতী মেয়ের অপহরণ’।ব্যাপার টা কি
ভালো দেখাবে বলুন?”
আখির কথা শুনে যেন ইমতিয়াজ এর হাসি
থামছেই না।এত রসিকতা করতে পারে
মেয়েটা।আচ্ছা মেয়েটাকে কি বিয়ে করে
সে ভূল করছে?ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়েকে
কোনো ভাবেই কষ্ট দেওয়া যায় না।অবশ্য
এতোটা ছোট ও না।তারপরো তার তুলনায় তো
আখি অনেক ছোট।ইমতিয়াজ নর্থসাউথ থেকে ২
বছর হলো এমবিএ কম্পিট করে তার বাবার
মোহাম্মাদপুরের গার্মেন্টসের দেখা শোনার
দায়িত্বে আছে।গার্মেন্টস এর সব ঝামেলায়
এখন তার ঘারে।এই ২ বছর কোনো রকমের
ধানায় পানায় দিয়ে বিয়ে টা আটকে
রেখেছিল।কিন্তু এখন তো আটকে রাখার
কোনো মানেই নেই।তাহলে এখন সে কি বিয়ে
টা করবে না আখিকে?মানা করে দিবে?কিন্তু
মানা করেই বা কি হবে!একদিন তো বিয়ে টা
করতেই হবে।তাহলে আখির মতো মেয়েকে নয়
কেন?নতুন ভাবে জীবন টা সাজানোর জন্য
হলেও তাকে বিয়েটা করতে হবে।
খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠছে আয়েশা বেগম।
আজ তার ছেলের গায়ে হলুদ।গুলশান,শুট
িং ক্লাবে আজ বিকেলে হলুদের অনুষ্ঠান
করা হবে।সেই আয়োজনে কোনো যেন কমতি
না থাকে।এটা ভেবেই দম ফেলানোর সময় টুকু
নষ্ট করতে নারাজ সে।কিন্তু শত কাজের
মাঝেও বারবার মন টা কেপে উঠছে তার।তার
ছোট ছেলের সুখের কথা ভেবেই আজ এত সব
আয়োজন।সুখী হতে পারবে তো ইমতি??
সাজিদ ঠিক সকাল ১০ টার মাঝেই উপস্থিত
হলো ইমতিয়াজদের বাড়িতে।ইমতিয়াজের
ন্যাংটা কালের বন্ধু সে।একসাথে হাটতে
শিখেছে,খেতে শিখেছে,কথা বলতে
শিখেছে,একসাথে ব্যাট বল খেলতে খেলতে
বড় হয়েছে তারা।তারা যদি গ্রামে বেড়ে
উঠতো তাহলে হয়তো বলা যেত একসাথে
ন্যাংটা হয়ে পুকুরে ঝাপ দিয়ে সাতার
কাটতে কাটতে বেড়ে উঠছে তারা।যেহেতু
ঢাকায়ই তাদের বেড়ে উঠা তাই এই কথাটা
বলতে পারে না সাজিদ।সাজিদ ইমতিয়াজ এর
বাবার বন্ধুর ছেলে।সেই কারণেই তাদের
একসাথে বেড়ে উঠা।পাশাপাশি বাসায়
থাকতো আগে তারা।কিন্তু এখন আর সেটা
সম্ভব নয়।কারণ সাজিদের পরিবার
অস্ট্রেলিয়া তে সেটেল হয়েছে ১০ বছর হলো।
বন্ধুর বিয়েরে সুবোধেই হোক আর অন্য কারণেই
হোক ১০ বছর পর বাংলাদেশে পা দিল সে।
সবার সাথে দেখা করেই সাজিদ ইমতিয়াজ এর
রুমের দিকে এগুলো।দরজায় কড়া নাড়তেই
ইমতিয়াজ ঘুমঘুম গলায় বললো
-“মা,প্লিজ।এখন বিরক্ত করো না”।
-“আরে শালা দরজা খোল,আমি তোর কোন
জন্মের মা লাগিরে”?
সাজিদের গলার স্বর শোনার সাথে সাথেই
লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে দরজা
খুলে জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজ সাজিদকে।
-“এতদিন পর তোর দেশের কথা মনে পড়লো”?
-“আমি কিন্তু দেশের কথা ভেবে আসি নি।
এসেছি তোর কথা ভেবে”।
কিছুক্ষণ এভাবেই কথোপকথন চলার পর সাজিদ
বললো
-“আর সবাই কোথায়?ঈমন,নিলয়,লিখন ওরা”?
-“বিকেলে দেখা হবে”।
-“কত্তদিন পর তোদের সামনাসামনি
দেখলাম,ছুঁলাম।এতো ভালো লাগছে সেটা
বলার মতো না।বালের অস্ট্রেলিয়া।এত দিন
ভিডিও কলে কথা হয়ছে।তোদের ধরতে পারি
নি,একসাথে কিছুক্ষণ বসে আড্ডা দিতে পারি
নি।”
ইমতিয়াজ হালকা হেসে বললো
-“সিগারেট ধারাবি”?
-“দে”।
দুই বন্ধু মনের আনন্দে কিছুক্ষণ আড্ডা দিতে
দিতে সিগারেট টানতে লাগলো।একপর্যায়ে
সাজিদ বললো
-“সবাই কি চলে এসেছে”?
-“হুম,শুধু ইতি আপু আসে নি।হয়তো বিকেলের
মাঝেই চলে আসবে”।
-“ইতি আপুরা কোথায় থাকে এখন”?
-“সিলেট”।
-“তাহলে মোটামুটি সবাই এসেছে”?
ইমতিয়াজ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো
-“হুম”।
-“তোর যে মামা ছিল,সে এসেছে”?
-“হ্যা”।
-“তোর যে একটা মামাতো বোন ছিল”?
-“হ্যা,আছে তো”।
-“নাম টা যেন কি!!
….অহ হ্যা,অদ্রিকা।রাইট?”
-“হুম,অদ্রি”।
-“চল তো দেখা করে আসি।সবার সাথেই দেখা
হয়েছে”।
-“তুই যা,আমি একটু ঘুমাবো”।
সাজিদ উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মেরে বললো
-“ঘুমাও ব্যাটা ঘুমাও।কাল থেকে তো আর
ঘুমাইতে পারবা না।ভাবির স্পর্শে তোমার ঘুম
হারাম হয়ে যাবে।শেষ ঘুম টা ঘুমিয়ে নাও”।
অদ্রির গলার স্বর ঠান্ডা,মিষ্টি।সাধারণ কথা
শুনতেও কি দারুণ লাগে।তার বাবা আজিজ
সরকারের মতো তার আঞ্চলিক কোনো সুর
নেই।অদ্রি কিছুটা জড়তা নিয়েই কথা বলছে
সাজিদের সাথে।অচেনা একটা লোকের সাথে
আর কিভাবেই বা কথা বলবে!আচ্ছা এখানে
শিমা ভাবি থাকলে কিভাবে কথা বলতো?
নিশ্চয় তুমি তুমি করে ডেকে কয়েক সেকেন্ড
এর মাঝেই পরিচিত হয়ে উঠতো দুজনে।আল্লাহ
মানুষকে কিছু আশ্চর্য গুন দিয়ে তৈরি করে।
তার মাঝের একটি গুণ ও কি তার মাঝে নেই?
সাজিদ একমনে তাকিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে
অদ্রির সাথে।বেশ ফরসা মেয়েটা,চেহারাটার
কাটিং ও সুন্দর।অতএব রূপবতী নারীর
তালিকায় তাকে ফেলা যায়।চেহারা টায় এক
ধরনের স্নিগ্ধতা আছে অদ্রির মাঝে।কিন্তু
চোখ টা দেখে কেমন যেন লাগছে।চোখটা
ফোলা ফোলা,চোখের নিচে কিছুটা কালিও
জমেছে।মেয়ে টা কি অসুস্থ নাকি কান্না
কাটি করেছে?ভাবতেই সাজিদের বুকটা
কেপে উঠলো।কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে
সাজিদ বলতে শুরু করলো
-“বিরক্ত হচ্ছো না তো”?
-“না”।
-“আসলে পরিচিত হতে এলাম।ছোট বেলায়
কতো গিয়ে থেকেছি ইমতিয়াজ এর সাথে
তোমাদের বাসায়।মনে আছে তোমার”?
অদ্রির প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছে।সেটা তার
চেহারা তেও সে ফুটিয়ে তুলেছে।তবুও
লোকটার যাবার নাম নেই।এত কথা মানুষ বলে!
তুই ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতে গিয়েছিস
ভালো করেছিস।আমাদের উদ্ধার করেছিস,এখন
ফোট।কথা টা মনে মনে বললেও অদ্রি
সাজিদের দিকে তাকিয়ে বললো
-“মনে নেই”।
-“তোমার কি শরীর টা খারাপ?চোখটা কেমন
যেন দেখাচ্ছে”?
অদ্রির ইচ্ছা করছে সাজিদ নামের লোকটার
মুখে কিছুদিয়ে বারি দিয়ে তার বোঁচা মুখটা
ভোতা বাবিয়ে দিতে।এমনি মাথার ব্যাথায়
কুল পাচ্ছে না সে।তবুও মুখে কিছুটা হাসি
ফুটিয়ে বললো
-“না ঠিকই আছি”।
-“তাহলে চোখের নিচে কালি পড়েছে কেন?
শশা ঘষবা।দেখবা চোখের নিচের কালিটা
আর নেই”।
এ পর্যায়ে অদ্রি কিছু না ভেবেই বিরক্ত
ভঙ্গিতে বললো
-“আপনার গায়ের রঙ টা তো শ্যামলা।আপনি
নিজেই শশার ট্রিটমেন্ট টা নিজের উপর
চালাচ্ছেন না কেন?তাইলে আর আপনি
শ্যামলা থাকতেন না।ফরসা হয়ে যেতেন”।
এতোটুকুতেই থেমে আবার মনে মনে সাজিদের
চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো অদ্রি।অদ্রির
কথায় এখনো নিজেকে ধাতস্থ করতে পারছে
না সাজিদ।সামান্য শশার কথাটাতেই যে
এভাবে রিয়াক্ট করে ফেলবে অদ্রি সেটা
সাজিদের জানা ছিল না।তাই আর কথা না
বাড়িয়ে উঠতে উঠতে বললো
-“আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটার উপর
প্রচণ্ড ডিস্টার্ব।সময় নাও।আশা করি
বিকেলের মাঝে নিজেকে আয়ত্বে আনতে
পারবে।চলি কেমন?বিকেলে দেখা হবে”।
সাজিদ রুম থেকে বের হয়ে যেতেই স্বস্তির
নিশ্বাস ফেললো অদ্রি।কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ
স্থায়ি হলো না।এর মাঝেই তার মা শাহানা
বেগম একটা শাড়ি হাতে তার রুমে এল।তার
দিকে শাড়িটা এগিয়ে দিয়ে বললো
-“বিকেলে এটা পড়বি।শিমার একটু পর
পার্লারের জন্য বের হবে।তোকে রেডি
থাকতে বলছে।”
স্নেহা বিরক্ত মুখে বললো
-“আমি কোথাও যাচ্ছি না।আমার শরীর টা
অসম্ভব খারাপ”।
-“কিছুক্ষণ এর জন্য গেলে কিছুই হবে না”।
বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল শাহানা বেগম।
অদ্রির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।সবাই
যে যার নিজের সিদ্ধান্ত কেন শুধুই তার উপর
চাপিয়ে দেয়!তার কি নিজের অস্তিত্ব নেই
তার জীবনে!
আখি বাসা থেকে পার্লারের উদ্দেশ্যে বের
হয়েছে বেশ কিছুক্ষন হলো।জ্যামের কারণে
এখনো পৌছাতে পারে নি।অন্যদিন গাড়িতে
বসে বসে অপেক্ষা করা টা বিরক্তকর হলেও
আজ কেন যেন হচ্ছে না।কাল রাতে সে তার হবু
বর ইমতিয়াজ এর সাথে কথা বলেছে।বেশ
খানিকক্ষণ কথা হয়েছে দু জনের।আর সেটার
রেশ এখনো কাটেনি আখির।তার মাঝে যে
একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে সেটা তার
ভালই লাগছে।উপভোগ করছে সময়টাকে সে।
ইমতিয়াজ এর মতো হাজবেন্ড পাওয়া আসলেই
ভাজ্ঞের ব্যাপার।আর কাল রাতে কিছুক্ষণ
কথা বলেই বুঝতে পেরেছে আখি।তার
চেহারার সাথে সাথে তার মন টাও অদ্ভুত
সুন্দর।আচ্ছা,বিয়ের পর সে ইমতিয়াজ কে কি
বলে ডাকবে সে?তার মা তো তাকে ইমতি
করে ডাকে।তাহলে আখি ও কি ছোট করে
ইমতি করে ডাকবে?হ্যা এটাই ডাকবে।
জোছনার এক রাতে বলবে সে ‘এই ইমতি শুনছো?
আমাকে পাজকোলে করে নিয়ে ছাদে চল
তো।এক সাথে দুজনে জোছনা বিলাশ করি’।
ভাবতেই আখির কান আর গাল টা লজ্জায়
কিছুটা লাল হয়ে গেল।সাথে সাথে অসম্ভব
একটা ভালোলাগা দোলা দিয়ে গেল তার
মনে।ফরসা গোল মুখে তাকে দেখতে এখন ঠিক
একটা বাংগির মতো লাগছে।
অদ্রি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল টা
আচড়াচ্ছিল।একটু পড়েই শিলা ভাবির সাথে
বের হয়ে পার্লারে যেতে হবে তাকে।হাজার
বারণের পর ও তার এর থেকে নিস্তার নেই এটা
খুব ভালো করেই জানে অদ্রি।তাই কোনো
কথা না বলে চুপচাপ মাথা ব্যাথা থাকা
সত্বেও উঠে তৈরি হতে শুরু করলো অদ্রি।হঠাৎ
পিছন থেকে একটা হাত এসে তাকে পেঁচিয়ে
ধরলো।চিৎকার করার আগেই ঘারের উপর গরম
একটা নিশ্বাস পড়লো।এই নিশ্বাস টা তো
অদ্রির অচেনা নয়।টের পেতে আর বাকি রইলো
না কে এসে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে।
নিশ্বাস টা ক্রমে আরো উপরের দিকে উঠতে
শুরু করলো।কানের কাছে এসে থামতেই
ফিসফিসে গলায় বললো
-“এত নিখুঁত অভিনয় তুমি কিভাবে করো অদ্রি”?
(চলবে)