আজ_তার_বিয়ে
# লেখিকা -নাইমা জাহান রিতু
# পর্ব -১০
-“মা, কি করবো এখন?”
-“ইফতেখার কে একটা কল দে।”
-“দিচ্ছি তো। কিন্তু ফোন ধরছে না। প্রাপ্তির
বাবা কেউ দিলাম। কিন্তু..”
আয়েশা বেগম হতাশ হয়ে ইতির দিকে
তাকিয়ে বললো
-“বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে।
ইমতির আজ বিয়েটা হয়ে গেলে আমি অদ্রির
সামনে কিভাবে মুখ দেখাবো?”
ইতি এবার তার মার দিকে ভ্রু কুঁচকে বললো
-“তুমি বারবার নিজেকে এভাবে দোষ দিচ্ছো
কেন? তোমার এখানে কি দোষ? দোষ যদি
থেকে থাকে তাহলে সেটা ইমতি আর অদ্রির।
নিজেদের কন্টোল করতে না পারলে বিয়ের
আগে এভাবে মেলামেশা করবে কেন! তার
উপর এসব কুকীর্তি করে এরা এখন দুজন
সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেদের নাকি বিয়ে
করবে না! শরীর টা কি এতোই সস্তা যে
সাময়িক আবেগের কাছে অদ্রি সেটা
বিলিয়ে দিল? মানলাম ওরা দুজন একে অপরকে
ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসার সাথে
শরীরের কি সম্পর্ক!”
ওপাশ থেকে আয়েশা বেগমের উত্তর না পেয়ে
ইতি আবারো বলতে শুরু করলো
-“আর তোমার ছেলে কে দেখছো? ব্যাটা
হারামি একটা। একজনের সাথে শুয়ে পেট
বাধিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে আরেকজন কে
বিয়ে করতে গেছে। ও আমার সামনে আসুক
আজ। ওরে শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত আমার গাঁ
জ্বালা কমবে না।”
আয়েশা বেগম এ পর্যায়ে মুখ খুললেন। মেয়ের
দু টো হাত জোরে চেপে ধরে বললেন
-“এখানে ওদের কোনো দোষ নেই। ওরা তো
একে অপরের সাথে জীবন সাজানোর স্বপ্নই
দেখেছিল। এতে ভুল কিছু আমি দেখছি না।”
-“কোনো মায়ের কাছেই তার ছেলে মেয়ের
কুকীর্তি খারাপ মনে হয় না। আর সেখানে
তোমার দু চোখের মণি ইমতি। তাই ওর দোষ
গুলো তোমার চোখে পড়ছে না। এতোদিন আমি
ওকে সব বিষয়ে সাপোর্ট দিলেও এই কাজ টায়
ওর হয়ে কথা বলতে পারছি না মা। আজ যদি
ওর বিয়ে টা হয়ে যায় তাহলে অদ্রির কি হবে
ভাবতে পারছো?”
-“অশুভ কথা বলিস না।”
-“সত্য তিতা হলেও সত্য। আর তুমি কি মনে করো
এতোক্ষণেও তোমার ছেলের বিয়ে হয় নি?
তাহলে প্লিজ এটা ভেবো না। আমার মনে
হচ্ছে এতোক্ষনে ইমতি বৌ নিয়ে বেরিয়ে
পড়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।”
আয়েশা বেগম মেয়ের কথা শুনে একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-“ইতি, আজ আমি তোদের কিছু বলতে চাই।”
ইতি মায়ের কথার দিকে তাল দিল না। একটু
আগে যখন সে অদ্রির প্রেগনেন্সির খবর
পেয়েছিল তখন বিস্ময় আর ভয়ে তার হাত পা
কাঁপলেও এখন আর সেরকম হচ্ছে না। উলটো
এখন রাগে তার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে।
ইমতি আর অদ্রির এই বোঝাপড়ার মাঝে আজ
একটি শিশুকে পিষতে হচ্ছে। যে এখনো
দুনিয়ার মুখই দেখে নি। আদৌ দেখতে পারবে
কিনা এটা নিয়েও একটা সংশয় কাজ করছে।
হঠাৎ ইতির মনে হলো, আচ্ছা অদ্রি কি তার
প্রেগনেন্সির ব্যাপার টা জানে? হয়তো
জানে হয়তো বা জানে না। অবশ্য ৪ মাস চলছে
অদ্রির আর তার নিজের ভেতরে একটা
অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে আর অদ্রি জানবে না
এটা ভাবা অহেতুক। কিন্তু অদ্রি যদি
প্রেগনেন্সির ব্যাপার টা না জানে তাহলে
কিভাবে জানাবে ইতি তাকে? ভাবতেই বুকের
ভেতর কেপে উঠলো তার।
মেয়ের ঝাপসা দৃষ্টি দেখে আয়েশা বেগম
মেয়েকে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো
-“শুনছিস আমার কথা?”
মায়ের ঝাঁকুনি তে চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে
এল ইতি। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-“হুম।”
-“আমার কারণেই আজ অদ্রি এই কাজ গুলো
করতে বাধ্য হয়েছে। এতোদিন তোর বাবার
কথায় মুখ বন্ধ করে সব সহ্য করলেও আজ থেকে
আমি আর সহ্য করবো না। তোরা বড় হয়েছিস।
যে যার মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবি।
তোদের নিয়ে আমার আর কোনো টেনশন নেই।
তাহলে কেন আমি এভাবে চুপ করে অন্যায় সহ্য
করবো! তোর বাবার মতো অমানুষ এর সাথে ৩৫
টা বছর কাটিয়ে আজ আমি হাপিয়ে উঠেছি।
আর সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয় আমি
করতে পারবো না। লোক দেখানো ভালো
থেকে আমি হাপিয়ে উঠেছি। আমি এখন এই
সংসার থেকে মুক্তি চাই। তোর বাবার সাথে
আর একদিন ও আমি বসবাস করতে পারবো না
এক ছাদের নিচে।”
বলেই কিছু টা দম নিল আয়েশা বেগম। ওদিকে
মায়ের কথা হতভম্ব হয়ে শুনছিল ইতি। আয়েশা
বেগম থামতেই ইতি বলে উঠলো
-“মা, কাহিনী কি? আমাকে পুরো ঘটনা টা
বলো তো।”
আয়েশা বেগম তার সাথে ঘটে যাওয়া
নিত্যদিনের ঘটনা গুলো বলতে শুরু করলো
ইতিকে। তার স্বামীর অত্যাচার, মেয়ে নিয়ে
আড্ডাবাজি কোনো কিছুই বাদ দিল না
আয়েশা বেগম। অবশেষে ইমতির আর অদ্রির
জীবনের অভিশপ্ত দুই মাস আগের কথাটাও
বললো সে ইতিকে। কথা গুলো মেয়েকে বলতে
এক সময় গলাটা ধরে আসলো আয়েশা বেগমের।
সব শুনে হতভম্ব হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো
ইতি। তার চোখে একরাশ ঘৃণা। এখনো সে
বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না কথা গুলো।
ভালো মানুষের মুখোশ পরে এতোদিন তার
বাবা তাদের সামনে থাকলেও পিছনে তার
ছিল এক ভয়ংকর রূপ। ভাবতেই গাঁ টা ঘিনঘিন
করে উঠছে ইতির। বিশেষ করে তাদের বাড়ির
কাজের মেয়ে বিলকিস, বয়স ১৭/১৮ হবে।
তাকেও রেহায় দেয় নি আফজাল সাহেব।
প্রতি রাতে তার মাকে ফেলে রুম থেকে উঠে
গিয়ে সে যে বিলকিস কে ডেকে রাত কাটায়
এটা ভাবতেই রাগে দুঃখে নিজের গায়ের
চামড়া টেনে নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে
ইতির। ছি!! এই শয়তান টা তার বাবা!!
অদ্রির জ্ঞান ফিরেছে। সে এখন তার দুর্বল
শরীর লুটিয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের
বেডে। ইতি আর আয়েশা বেগম কে নার্স খবর
দিতেই তারাও করিডোর থেকে কেবিনে চলে
এল। অদ্রির পাশে বসতে বসতে আয়েশা বেগম
বললো
-“এখন কেমন লাগছে মা?”
-“জ্বি, ভালো।”
-“কিছু খাবি?”
অদ্রি জবাব দেবার আগেই ইতি তার মা
আয়েশা বেগম কে বললো
-“ওর স্যালাইন চলছে মা। তুমি এক কাজ করো।
মামিকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। ডাক্তার
বললো ওকে রাতেই রিলিজ করে দিবে। আমি
এদিক টা সামলিয়ে অদ্রিকে নিয়ে আসছি।”
আয়েশা বেগম বললো
-“না, না। থাকি আমরা। এক সাথেই যাব।”
ইতি বিরক্ত মুখ নিয়ে বললো
-“যেটা বলছি সেটা করো। ছেলের বৌ কে
নামাবে না? আর তুমি একা একা সামলাতেও
পারবে না এতো কিছু। তাই বলছি মামি কে
নিয়ে যাও। অদ্রি তো ভালই আছে। আমি
থাকি ওর পাশে।”
শাহানা বেগম ইতির কথায় সায় দিয়ে বললো
-“জ্বি, আপা। ইতি ঠিকই বলছে। ইমতির বৌ কে
তো নামাতে হবে।”
অদ্রির জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে
হাসপাতালের বেডে দেখে প্রথমে কিছুটা
চমকে উঠেছিল সে। পরবর্তীতে নিজেকে
সামলে নিলেও ইমতির যে আজ বিয়ে এটা
একদমই ভুলে গিয়েছল। মাত্র ইমতিকে নিয়ে
কথাবার্তায় আবারো মনে পড়ে গেল সব
অদ্রির। আজ তার বিয়ে ভাবতেই চোখ টা
ছলছলে হয়ে উঠলো। পরমুহূর্তে নিজেকে
সামলে নিয়ে মনে মনে বললো ‘এটা তো
হওয়ারই ছিল। একদম কষ্ট পাবি না অদ্রি।’
ইতি শাহানা বেগম আর আয়েশা বেগমকে
কোনো রকম বুঝ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে
আবার কেবিনে ফিরে এল। তারপর অদ্রির
পাশে বসে অদ্রির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে
তাকিয়ে বললো
-“তোরা পেয়েছিস টা কি?”
অদ্রি অবাক হয়ে বললো
-“মানে?”
-“তুই যে প্রেগন্যান্ট এটা সবার থেকে লুকিয়ে
কি করতে চেয়েছিলি?”
অদ্রির কানে ইতির প্রেগন্যান্ট শব্দ টি
বারবার এসে বাজতে লাগলো। কি শুনছে
এগুলো সে? সে প্রেগন্যান্ট?
-“উত্তর দে অদ্রি।”
আমতাআমতা করে অদ্রি বললো
-আ..আমি প্রেগন্যান্ট?”
-“কেন তুই জানতি না?”
-“না।”
ইতি ডাক্তারের কথা গুলো খুলে বললো
অদ্রিকে। ইতির কথা শুনে অদ্রির কি এখন খুশি
হওয়া উচিৎ? নাকি তার ভেতর এখন অপরাধ
বোধ কাজ করা উচিৎ এটাই তার মাথায় আসছে
না। কি করা উচিৎ এখন তার?
-“তোর ভেতরে একটা সত্ত্বা বেড়ে উঠছে আর
তুই বললি তুই এটা বুঝতে পারিস নি?”
-“হ্যাঁ।”
-“এটা কি বিশ্বাস যোগ্য?”
অদ্রি করুণ চোখে ইতির দিকে তাকিয়ে বললো
-“আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি।”
ইতি ভ্রু কুঁচকে বললো
-“তুই একজনের সাথে শুয়েছিস, তোর পিরিয়ড
হচ্ছে না এই দু টো একসাথে করলেই তো..”
ইতিকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায়
অদ্রি বললো
-“এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে? আর
আমার এমনিতেই পিরিয়ড রেগুলার হয় না। তাই
ওভাবে কিছু ভেবে দেখি নি আমি।”
-“একদম কাঁদবি না। তোরা যেই কাজ করেছিস
তাতে ভালোভাবে কথা বলা যায় না তোদের
সাথে। বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হয়েছিস।
ভাবতে পারছিস কতো বড় একটা অন্যায় করে
ফেলেছিস তোরা? সমাজ কোন চোখে দেখবে
তোকে? আর তোর কথা বাদই দিলাম। তোর
পেটে যে এখন ইমতির বাচ্চা নিয়ে শুয়ে
আছিস তাকে কি বলবে আমাদের এই সমাজ?
জারজ বুঝিস? জারজ বলবে সবাই তাকে।”
আরো কিছু কঠিন কথা শোনানোর আগেই ইতির
ফোন টা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিতেই
ইতি দেখলো ইফতেখার এর কল এসেছে। আর
দেরি না করে ইতি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ
থেকে ইফতেখার বলে উঠলো
-“ফোন দিয়েছিলি?”
-“হ্যাঁ।”
-“বিয়ের ঝামেলা নিয়ে ছিলাম। যাই হোক
অদ্রির কি অবস্থা?”
-“ভালো।”
-“তাহলে মা কে বাসায় পাঠিয়ে দে। আখিকে
নামাতে হবে। আমরাও বেড়িয়ে পড়েছি।”
বলেই লাইনটা কেটে দিল ইফতেখার। কিছু
বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো ইতি। এখন এই সব
কথা জানিয়ে কি লাভ? যা করার তাকেই
করতে হবে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে
অদ্রির দিকে তাকিয়ে ইতি বললো
-“অদ্রি, আমার কথা মন দিয়ে শোন। যা হবার
হয়ে গেছে। এখন এগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে
চলবে না। তোর একটা লাইফ আছে। আমার
বদমাইশ ভাইটা তো অকর্ম করে কেটে পড়েছে।
বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে বাড়িতে পা
দিচ্ছে। তাহলে তুই কেন অযথা ঝামেলার
মাঝে পড়ে থাকবি? কেউ কিছু জানার আগেই
এবোরশন টা করে ফেল। রিস্ক থাকলেও অসম্ভব
কিছু না।”
(চলবে)