আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-১৫

0
172

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১৫)
নুসরাত জাহান লিজা

“আমার দিকে এমন কইরা তাইকাইছস কী জন্যে? বুঝতে পারছি, তোর দৌড় ওই চোখ রাঙানো পর্যন্তই। আসল কথা হইল তুই আমারে ডরাস!” অয়নের চোখ রাঙানোকে আরও উস্কে দেবার চেষ্টায় নেমেছে জুনায়েদ।

অয়ন একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলল, নাকের পাটা ফুলে আছে, হাতের মুঠো শক্ত করে রেখেছে আগে থেকেই। এরপর সরাসরি জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাপুরষ তো তুই। একজনের সাথে লাগতে আসিস অথচ কয়েকটা করে চামচা সাথে নিয়ে আসিস সবসময়। কে ভয় পায় সেইটা তো স্পষ্টই।”

চোখে আর ঠোঁটের বাম পাশে একটা হাসি, তাতে ভস্ম করে দেবার অঙ্গীকারের সাথে মিশে আছে তাচ্ছিল্য। অয়নের এই কথা আর অভিব্যক্তি জুনায়েদকে তাতিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

অয়ন খুব ভালো করে জুনায়েদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে, তাকে উস্কে দিতে চাইছে, যেন রেগে অয়ন অনর্থের সূত্রপাত করে। তাহলে দোষটা তার ঘাড়ে চাপানো যাবে। কিন্তু অয়ন আজ সেই ফাঁদে পা দিল না। খুব ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো বলল। জুনায়েদ প্রথমে রেগে গেলেও অয়নের কৌশল ধরতে পারল, কারণ মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিল। সেও একইভবে হেসে পাশের সাগরেদকে বলল,

“অন্তি রোজ এই পথেই ভার্সিটিতে আসে, তাই নারে রাজু?”
এবার অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ওরে আমার খুব পছন্দ বুঝলি অয়ন? তুই তো জানসই! কিন্তু তোদের বাপ চাচার যা অহংকার, আমারে পাত্তাই দিল না। তুই একটু সেটিং, ফিটিং করায়ে দে। তোর একটা দায়িত্ব আছে না?”

“মুখ সামলায়ে কথা বল, জুনায়েদ। আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে তোরে আমি এনেই পুইতা ফেলব।”

জুনায়েদ এগিয়ে এসে অয়নের কাছাকাছি দাঁড়ালো, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “এত রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না রে। তোর ব্যবস্থা করা লাগব না৷ এই পথেই তো যায়। কীভাবে কী করতে হবে আমি খুব ভালো করে জানি।” জুনায়েদের মুখে অত্যন্ত বিশ্রী একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি।

অয়নের আর সহ্য হলো না, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জুনায়েদের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল। দুই পক্ষের এই হাতাহাতিতে জুনায়ের তিনটা সাগরেদও যোগ দিল। কেবি কলেজ পাশেই ছিল, এই সময় রাস্তাঘাটে কিছু লোকও ছিল, সবাই এগিয়ে এসে তবেই থামাতে পারল অনাহূত গণ্ডগোলটা। অয়নের বাম চোয়াল থেকে রক্ত ঝরছে, জুনায়ের থুতনিতে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। অয়ন এখনো উন্মত্ত ক্রোধে ফুঁসছে। মেয়েদের নিয়ে কেউ বাজে কথা বললেই ওর মাথা গরম হয়ে যায় আর এটা তো অবন্তীকে নিয়ে বলেছে। জুনায়েদকে এই মুহূর্তে খুন করে মাটিতে পিষে ফেলতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। অক্ষম রাগে ফুঁসে ওঠে অয়ন। জুনায়েদ আর তাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল লোকজন, সেও ফিরছিলই কিন্তু জুনায়েদ হুট করে এগিয়ে এসে যা বলল তাতে অয়ন থমকে গেল,

“তোর মরণ তো আমার হাতেই লেখা আছে, তবে মরার আগে আগে দেখতে পারবি অন্তির সাথে আমি…”

অয়ন একবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো, জুনায়েদ কথাটা খুব আস্তে আস্তে বলেছে বলে তেমন কেউ বুঝতে পারেনি। অয়ন প্রতিউত্তরে আবার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল কিন্তু লোকজন আবার এগিয়ে এসে থামিয়ে দিল। ছোটখাটো একটা জটলা বেঁধে গেছে এরইমধ্যে। জুনায়েদও উল্টো দিকের পথ ধরল।

অয়ন যেতে যেতে অবন্তীর নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। জুনায়েদের বিশ্বাস নেই, সে কতটা জঘন্য হতে পারে এটা সে খুব ভালো করে জানে।

আজ সূর্য যেন তার সমস্ত তাপ পৃথিবীতে ঢেলে দিয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, সাথে মাথাটাও দপদপ করছে তীব্র ব্যথায়। বাসায় গিয়ে গোসল করে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে। নয়তো মস্তিষ্ক সচল হবে না। তবে মনে মনে অবন্তীর জন্য আতঙ্কিত হলো। নিজের জীবন নিয়ে কোনো আশা ওর নেই, কিন্তু অবন্তী তো…

অয়ন আর কিছু ভাবতে পারে না, দুই হাতে মাথা চেপে ধরল, ব্যর্থ আক্রোশ নাকি অপারগতার অসহায়ত্ব সে জানে না!

***
শিউলি পুরো রাস্তায় একটাও কথা বলেনি, দৃষ্টিতে এক পৃথিবী শূন্যতা। শাফিন এটা সেটা নানারকম কথা বলে বোনকে বোঝাতে চাইল কিন্তু লাভ হলো না কোনো। শিউলি সেই গুম হয়েই রইল।

বাসায় এসেও কারোর সাথে কথা বলল না, ধীরস্থির ভাবে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বহুক্ষণ পরে চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নামল। মাথাটা এখনো ভার হয়ে আছে, মনে হচ্ছে গোটা হিমালয় পর্বতটাই ওর মাথায় চেপে বসে আছে। যন্ত্রণা নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

ততক্ষণে শাফিন বাবা আর মাকে সব খুলে বলেছে। শেফালি বললেন, “আমি আগেই বলছিলাম, কিছু একটা ব্যবস্থা করতে। তখন কেউ শুনলা না। এরজন্য সে সাহস পাইছে। ভাবছে যা ইচ্ছা তাই করব আর পার পায়ে যাব।”

“যাই হোক, মেয়েটা ভালো আছে, আলহামদুলিল্লাহ।” এমদাদ নিজের মেয়ের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি ভেবেই স্বস্তি বোধ করলেন।

“ভালো করে খোঁজখবর নিলা না, কয়জনের কাছে ভাসা ভাসা জানাশোনাতেই বিয়ে দিলা। ফল কী হইল?”

এমদাদের খুব অনুশোচনা হয় মেয়েটার জন্য। একটু বোধহয় অবিচারই করে ফেলেছেন। সাঁতার না জানা একজনকে অথৈ পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের আর কয়দিন, নিঃশ্বাস থাকতে থাকতেই মেয়ের জীবনটা আবার গুছিয়ে দেবেন। খুব সহজ হবে না সেটাও বুঝতে পারেন।

শিউলির ঘুম যখন ভাঙলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। এখন মাথা কিছুটা হালকা লাগছে। ভাগ্যিস তুহিন লোভী আর বোকা ছিল, তাই আজ পৃথিবীর সৌন্দর্য এখনো উপভোগ করতে পারছে, নইলে কী হতে যাচ্ছিল ভেবেই শিউরে উঠল আরেকবার। এই রুমে এটাচড বাথরুম নেই, তাই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ফ্রেশ হয়ে আসতেই বুঝল ক্ষুধায় পেট চোঁ-চাঁ করছে।

শেফালি দুপুরের খাবার টেবিলে দিচ্ছিলেন। শিউলিকে দেখে বললেন, “তুই উঠেছিস? আয় খেয়ে নে চারটে।”
শিউলি কোনো উচ্চবাচ্য না করে এসে বসল।
“শিউলির বাপ, শাফিন, আসো৷ খাবার দিছি।” হাঁক ছেড়ে বাড়ির বাকি দুই সদস্যকে ডাকলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই উপস্থিত হলো, তবে অন্য দিনের মতো আজ কিছুই তেমন জমে উঠল না। শেফালির হাতের মজাদার রান্না, পেটে তীব্র ক্ষুধা থাকা সত্বেও গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। শিউলি উঠতেই যাচ্ছিল, কিন্তু এমদাদ থামিয়ে দিলেন।

“খাওয়া শেষ কর। উঠতেছিস কেন?”

“ইচ্ছে করছে না বাবা।”

“ইচ্ছের দ্বারা নিজে পরিচালিত না হয়ে ইচ্ছেকে তুই নিজে নিয়ন্ত্রণ কর। দেখবি ভালো থাকবি।”

শিউলি বসল, খাবার নাড়াচাড়া করছে ঠিকই কিন্তু মুখে দিচ্ছে না। শাফিন বলল,

“আপু, তুই রবি ঠাকুরের কবিতাটা পড়িসনি?
‘মন রে আজ কহ রে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যরে লও সহজে।’
ভালো, মন্দ সবটা তো জীবনেরই অংশ। যা ঘটে গেছে সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে দেখবি জীবন কেবল জটিল থেকে জটিলতর হবে। তার থেকে সব সহজভাবে দেখ না? ময়লা আবর্জনা কি আমরা ঘরে জমিয়ে রাখি? সেসব এমন জায়গায় ফেলি যেন সেসবের দুর্গন্ধ আমাদের স্পর্শ না করতে পারে। তবে তুই তোর জীবনের এসব পুঁতিগন্ধময় দিনের কথা মনে চেপে রাখবি কেন? ছুঁড়ে ফেলে দে না। জীবনটা এখনো খুব সুন্দর, সবটা সহজভাবে নে।”

শিউলি মুগ্ধতা নিয়ে ছোট ভাইকে দেখছে, এই তো সেদিন চকলেট না নিয়ে বাসায় এলেই কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলত। শিউলি কোথাও যেতে চাইলেই পিছু নিত। সে আজ কত বড় হয়ে গেছে, কত পরিণত তার চিন্তা ভাবনা। সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। কবে বড় হয়ে গেল শাফিনটা, সেই ছোট্ট নাদুস-নুদুস ভাইটা!

শিউলির চোখের কোণে পানির আভাস, সেটা লুকাতে ইচ্ছে হলো না। আসলেই তো ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে’, এই জীবনবোধ ভেতরে ধারণ করতে পারলে জীবন কতই না সহজ হতো৷ সবকিছু হারিয়ে যায়নি, নতুন শুরু হাতছানি দিচ্ছে। তুহিন ওর জীবনে দুর্গন্ধময় আবর্জনা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই মুহূর্ত থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সহস্র আলোকবর্ষ দূরে। যেখান থেকে আর সে তার অনুভূতিকে দগ্ধে মারতে পারবে না। এবার খাবারটা খেতে পারল, কষ্টটাও কমে গেল, বুকে অদ্ভুত একটা বল পেল।

***
দুপুরের দিকে আনোয়ার বাসায় ফিরছিলেন, মোড়ের দোকান থেকে বাসার দৈনন্দিন কিছু খুচরো জিনিসপত্র কিনবেন বলে দাঁড়ালেন। তার পাশের একটা দোকানে কয়েকজনের কথাবার্তা কানে এলো।

“আনোয়ার ভাই এত ভদ্রলোক, সবাই তারে মান্য করে। অথচ তার পোলাডা এক্কেবারে বেয়াদব হইসে।”

“হ, আমি মাঝে মাঝে রাস্তাঘাটে সিগারেট খাইতে দেহি। সালাম তো জীবনেও দিছে না।”

“এগুলা তো আছেই। এহন রাস্তাঘাটে মারামারি শুরু করছে৷ আইজকেও তো এক্কেবারে সেই হাতাহাতি শুরু করছিল।”

“তাই নাকি। আনোয়ার ভাইয়ের জন্য মায়াই লাগে।”

এবার তাদের নজরে এলেন তিনি, আলাপরত দুজনেই বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন।
“ভালো আছেন ভাই?”

আনোয়ার সাহেব উত্তর দিলেন না, থমথমে মুখে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। অগ্নিশর্মা আনোয়ার ভাবলেন অনেক হয়েছে। আজ যেভাবে তার মাথা কাটা গেছে, ছেলের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে হাতের বাইরে চলে যাবে। এখন তাও তো বাইরে বেরুতে পারছেন, কিন্তু ক’দিন পরে যদি মুখ দেখানোর মতো অবস্থা না থাকে! সময় থাকতেই লাগামটা শক্ত করে ধরতে হবে।

হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওই হতচ্ছাড়া নবাবাজাদাটা কই? আজকে ওর খবর আছে! কই সে? বাসায় আছে নাকি রাস্তায় রাস্তায় মাস্তানি কইরে বেরাইতাছে?”

অয়ন বাসায় এসে গোসল করে সবে একটু শুয়েছিল, ঘুম পাচ্ছে খুব৷ কিন্তু চেঁচামেচিতে ঘুম ছুটে গেল। পড়িমরি করে বেরিয়ে এলো। কারণ এই সুন্দর সুন্দর বিশেষনধারী মানুষ এই বাড়িতে একমাত্র সে-ই আছে।

“ডাকছেন কেন? বলুন।”

ছেলের ঔদ্ধত্যে তার ক্রোধ গেল শতগুণে বেড়ে।
“তুই কী ঠিক করছিস? আমার কষ্টে অর্জন করা মানসম্মান সব তুই ধূলায় মিশাইয়া দিবি আর আমি হাত পা গুটায়ে বসে থাকব? আমার বাড়িতে থাকতে গেলে তোরে আমার কথামতো চলতে হবে? নইলে বাইর হয়ে যাবি।”

ততক্ষণে বাসার সবাই এখানে জমায়েত হয়েছে। অবন্তী এখনো ফেরেনি, সে ছাড়া সবাই আছে। ছোট ভাই আজমলও আজ বাসায়।

অয়নও ততক্ষণে তেতে উঠেছে। চেঁচিয়ে বলল, “আপনার বাড়িতে আমার থাকার কোনো ইচ্ছাও নাই। অনেক পুতুল হয়ে থাকছি। আর থাকব না। আপনি থাকেন আপনার বাড়িতে আমি গেলাম।”

আনোয়ার ছেলের গায়ে সবেগে মেরে দিলেন। আজমল আটকালেন ভাইকে। অয়ন ভেতরে গিয়ে গায়ের গেঞ্জি বদলে একটা শার্ট পরে এলো, হাতে কেবল ছোট্ট একটা ব্যাগ।

“ব্যাগ চেক করতে পারেন। এতে পরার কিছু কাপড় ছাড়া অন্য কিছু নাই। আপনার ধনসম্পত্তি নিয়ে যাইতেছি না।”

আনোয়ার ব্যাগটা হাতে নিলেন, এরপর ছুঁড়ে মারলেন দরজার দিকে। “তোর চেহারাও আমি দেখতে চাই না, হারামজাদা।”

অয়ন ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। অয়নের মা থামানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছেলে কারোর কথা শুনল না। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

আজমল বড় ভাইকে বললেন, “ওরে বোধহয় চাপটা একটু বেশিই দেয়া হইসে।”

“এগুলা কী বলিস আজমল? আমি ওর ভালোর জন্যই শাসন করছি। শাসন করেই এই অবস্থা না হইলে আরও অমানুষ হইতো।”

“ভাইজান, অন্য সবকিছুর মতো শাসনেরও একটা লিমিট আছে। তরকারিতে লবন বেশি হইলে কিন্তু তিতা হয়ে যায়, আবার ঘোড়াকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে লাগাম ছুটে যায়, পানের সাথে চুন বেশি খাইলে মুখ পুড়ে যায়। অতিরিক্ত টেনে ধরতে চাইছো বলেই মাথা বিগিড়ায়ে গেছে মনে হয়।”

“আমাদের বাপ মা আমাদের মারছে না? আমরা ওর মতো উচ্ছন্নে গেছিলাম? আরও বাপ মাও তো পোলাপাইনরে শাসন করে, কই তারা তো এমন বখে যায় না?”

“সবার সাইকোলজি তো এক না! একেকজন পোলাপানরে একেক ভাবে হ্যান্ডেল করা লাগে। কেউ শাসন বেশি পাইলে ভালো হয়, আবার কেউ তাতে বিগড়ে যায়৷ তাদের আদর করে, বুঝাইতে হয়। বাচ্চার সাইকোলজি বুঝে সে-ই অনুযায়ী তাকে ট্রিট করতে হয়। নইলে তাদের মনে একটা আক্ষেপ, হতাশা তৈরি হয়, যা একসময় জেদ বাসা বাঁধে। অয়নের ক্ষেত্রেও বোধহয় সেরকমই হয়েছে।”

আনোয়ার সাহেব সহসা উত্তর দিতে পারলেন না, তবে ছোট ভাইয়ের কথা তিনি মানতেও অপারগ। এতকিছুর পরে আজ কেবল ছেলেকে বুঝতে ইচ্ছে করছে। বুকের বাম পাশটায় ব্যথা হচ্ছে, ভয়ংকর ব্যথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিয়ে ছুটোছুটি পড়ে গেল।

***
অয়ন বাসা বেরিয়ে এসে রনিকে ফোন করল, রনি তখন মহিউদ্দিন ভাইয়ের ক্লাবঘরে। অয়ন সেদিকে পা বাড়ালো। আজ এমনিতেই মেজাজ খারাপ, সাথে ভয়াবহ চিন্তা, এ-র উপর বাবার চিৎকার সহ্য হয়নি। তাই এমন আচরণ করে ফেলেছে। এখন বেশ খারাপ লাগছে।

মহিউদ্দিনের ক্লাবঘরে ঢুকতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে স্বাগত জানালেন।

“তুমি আসছো? অয়ন, আমার হাত কিন্তু তোমার মাথায় সবসময় আছে। তুমি যে আসবা আমি জানতাম।”

আজও অয়নের দ্বিধান্বিত চেহারা দেখে বোধহয় কিছুটা হতাশ হলেন।
“আরে ব্যাটা, নে এইট ধর। বিপদে কাজে লাগবে।”

অয়ন আজ আর আপত্তি করল না, অয়নের বিশ্রী ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো কর্ণকুহরে ধাক্কা মারল। অবন্তীর জন্য হলেও এই জিনিসটা নাহয় সাথে থাকুক। জীবনে একবার একটা বাজি নাহয় ধরলই। সব দিক থেকেই তো সে নিঃস্ব! হারানোর তো কিছু নেই!

তবুও পিস্তলটা হাতে নিতেই ওর সংস্কারাচ্ছন্ন মনটা হুহু করে কেঁপে উঠল। এই হাতে তো সে বল তুলে নিতে চেয়েছিল, প্রতিপক্ষের উইকেট উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। সেই হাতে আজ মারণাস্ত্র তুলে নিল। শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। সেটাকে ভালো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। মহিউদ্দিন এটার ব্যবহার শেখাবে বলেছে। কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল মনে! অয়ন বুঝতেও পারল না, কোথায় জড়িয়ে গেল।
………
(ক্রমশ)