আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-০৬

0
221

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা

অয়নকে বাইরে বের হতে দেখেই অবন্তী পিছু নিল, দেখল সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাবার তাল করছে। তাই মরিয়া হয়ে ডাকল। অয়ন ফিরে তাকাতেই বলল, “অয়ন, তোর সাথে আমার কথা আছে। ভীষণ জরুরি।”

অয়নের চোয়ালে কালসিটে পড়ে গেছে। চোখমুখ কেমন ম্লান হয়ে আছে। তবুও উদ্ভটভাবে হেসে হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “খুন্তি, আমাকে একটা চিমটি কাট তো? আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাকি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি সেটা বুঝতে পারছি না!”

“একদম ফাজলামো করবি না। তোর এখন বাইরে যাওয়া হবে না। চল ছাদে যাই। এখানে বলতে পারব না।” ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলল অবন্তী।

অয়ন কেন যেন চেয়েও আজ আর উপেক্ষা করতে পারল না। ইউটার্ন নিয়ে ছাদে যাবার সিঁড়ি ধরল। অবন্তী বাইরে থেকে ভালো করে দরজা টেনে দিয়ে অয়নের পিছু নিল। দ্বিধা আর শঙ্কায় অবন্তীর হৃদপিণ্ডে যেন দামামা বাজছে। মনে হলো যেন একটা গোপন অভিসারে যাচ্ছে প্রিয় মানুষের সাথে। কিন্তু উল্টো প্রান্তের মানুষটার মনোভাব জানে না বলেই অনুভূতির এই অসাড়তা।

যত বেলা বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সূর্যের তেজ। এবার বোধহয় গরমটা বেশিই পড়েছে। তবে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে বলেই রক্ষে, নইলে গরমে হাপিত্যেশ করেই প্রাণ খোয়াতে হতো!

ঘুরে কার্নিশে হেলান দিয়ে অবন্তীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অয়ন তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলল, “আজ তো প্রতিদিনের মতো গ্রহ-নক্ষত্র সব ঠিক কক্ষপথেই ঘোরার কথা, কিন্তু তোকে দেখে কেমন যেন বিশ্বাসে অটল থাকতে পারছি না।”

অবন্তী এবার কটমটিয়ে তাকালো, সে যার চিন্তায় মরে যাচ্ছে, তার বিন্দুমাত্র কোনো হেলদোল নেই। আর সে কিনা প্রাণপাত করে ফেলছে! ক্ষণকালের জন্য কথাগুলো এখন বলবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল। তবে সাথে সাথেই সেটা বাতিল করে দিল। আজ বলতে না পারলে সারাজীবন একটা খেদ থেকে যাবে, মনে হবে হয়তো একবার বললেই সব অন্যরকম হতে পারত! অবন্তী সেই অনুতাপে পুড়তে চায় না। বরং নিজের দিকের সমস্ত চেষ্টা তো করেছিল, উত্তর যাই হোক না কেন, তাতে মনকে প্রবোধ দিতে পারবে।

“অয়ন, তুই কিছুক্ষণের জন্য একটু সিরিয়াস হবি, প্লিজ?” এমন নমনীয় আর কাতর গলায় অবন্তী অয়নের সাথে কোনোদিন কথা বলেনি।

“আমি ভীষণ সিরিয়াস, এই যে দেখ, আমি আর হাসব না।” কপট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে করতে ফিক করে হেসে ফেলল। অবন্তীর কাছে অয়নের হাসিটা কেমন যেন মেকি মনে হলো, নাকি ওর মনের ভুল সেটা বুঝতে পারল না। হৃদয়ে অদ্ভুত এক দোলাচাল!

“আমার বিয়ের ব্যাপারে ভাবতেছে আব্বু, আম্মু। আজকে আমাকে দেখতে আসবে।”

অয়নের হাসিকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত প্রসঙ্গে চলে গেল, কে জানে এই ছেলের কর্মকাণ্ডে কখন রাগ মাথায় চড়ে বসবে, পাছে আসল কথাটাই আর বলা হবে না। সে কোনো ধরনের রিস্ক নিতে চায় না।

অয়নের হাসি মুহূর্তের জন্য থমকে গেল, এরপর আবার হাসল। তবে এবারে মুচকি হাসি।
“বা রে! তুই তো তাহলে বিয়ের কণে? সর্বনাশ! কোন গোবেচারার কপাল পুড়ছিস রে?”

অয়নের এমন গা ছাড়া ভাবের কারণে অবন্তীর ভেতরে ভেতরে কান্না উথলে উঠছে। কিন্তু সেটাকে প্রাণপণে চেপে রেখে বলল, “তোর কিছু বলার নেই অয়ন? আমাকে কিছু বলতে চাস না?”

অয়ন সুদূরের আকাশ পানে চোখ মেলে দিল, সেই চোখে আঁতিপাঁতি করে শূন্যতা খুঁজল অবন্তী। কিন্তু সেটা পেল না। বরং অদ্ভুত একটা নির্লিপ্ততা সেখানে।

“হ্যাঁ, চাই তো। ওই বেচারাকে তোর অত্যাচার থেকে রেহাই দিস। আহারে, বেচারা! আই ফিল পিটি অন হিম।”

অবন্তী বাস্তবতার মাটিতে হোঁচট খেয়ে পড়ল। ভেবেছিল একই অনুভূতি, একই টান হয়তো অয়নের মধ্যেও দেখবে! কিন্তু তার ছিঁটেফোঁটাও দেখল না। কী ভুলই না ভেবেছিল!

“আমার বিয়ে নিয়ে তোর কোনো মাথাব্যথা নেই?”

“মাথাব্যথা কেন থাকবে? তুই আমার হাড় জ্বালাতন করতেছিস এখন। তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই তো আমার শান্তি! আহ্! কী নির্ঝঞ্ঝাট জীবন!”

অবন্তী ভাঙলো তবু যেন মচকাতে চাইল না। মরিয়া হয়ে হৃদয়ের সব আকুলতা কণ্ঠে ঢেলে বলল, “আমি তোকে ভালোবাসি অয়ন, এখন বিয়ে টিয়ে করতে চাই না।”

অয়ন মুহূর্তের জন্য যেন কিছুটা থমকে গেল। তারপরই তুমুল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। এমনভাবে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসছে যে ভীষণ মজার কোনো স্ট্যন্ডআপ কমেডি শো চলছে। অবন্তীর নিজের উপরেই লজ্জা হলো, কেন যে লজ্জার মাথা খেয়া কথাগুলো বলেছে!

ঝাপসা হয়ে আসা চোখে তাকিয়ে প্রবল ছন্দে হাস্যরত ছেলেটাকে দেখতে থাকল। হাসি কিছুটা থামিয়ে অয়ন বলল,
“খুন্তি, এতক্ষণ আমাকে ফাজলামো না করতে বলে এখন তুই নিজেই সেটা শুরু করলি? তোর জরুরি কথা থাকলে বল। আমার সত্যিই কাজ আছে। দেরি হয়ে যাবে।”

অবন্তীর হঠাৎ কী হলো জানে না, মরিয়া হয়ে বলল, “আমি সিরিয়াস অয়ন। এত সিরিয়াস আমি কোনোদিন ছিলাম না। এটা আমার জীবন মরণের প্রশ্ন। এটা নিয়ে হেঁয়ালি করিস না। একটু ভেবে উত্তর দে?”

অয়নের উত্তর না পেয়ে আবারও বলল, “তুই একবার রাজি হলেই আমি আব্বুকে বলে সব ঠিকঠাক করে নেব। প্লিজ, অয়ন। বি সিরিয়াস।”

অয়ন ঘুরে দাঁড়ালো, অবন্তী এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। রাস্তার পাশের নর্দমার ধারে একটা কুকুর নিঃসঙ্গ হাঁটছে। রাস্তায় ব্যস্ত মানুষের পদচারণা। একটা গাছে জোড়া শালিক বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, দুটোতে ভালোবাসার বন্ধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! কী যে সুন্দর লাগছে! এমন ভালোবাসাময় একটা জোড়া অবন্তী কী অয়নের সাথে বাঁধতে পারবে!

উৎকণ্ঠা নিয়ে অয়নের কথা শোনার জন্য অবন্তী তৃষিত হয়ে আছে। তার অপেক্ষার পালা একসময় ফুরালো, কিন্তু অবন্তীর মনে হলো এরচাইতে অপেক্ষাও বুঝি ঢের ভালো ছিল। সেখানে একটা অনিশ্চয়তা ছিল, এখন তো সব বালির বাধের মতো ভেঙেচুরে ভেসে গেল।

“অন্তি, তুই ভাবলি ক্যামনে এসব? তুই আর আমি? সিরিয়াসলি?”

কতদিন পরে অন্তি বলল অয়ন, কিন্তু আজ সেটা ওকে তাড়িত করতে পারল না। চোখে একরাশ হতাশা অবন্তীর। আহত দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকাল। অয়নকে সেই দৃষ্টি ছুঁতে পারল না।

অয়ন কাটা কাটা গলায় বলেই যাচ্ছে, “তোকে ভালোবাসার মতো একটা কারণ দেখা, যেটা তোর মধ্যে আছে? তুই যে পরিমাণ বদরাগী, যখন তখন ভয়াবহ আক্রমণ করে বসিস। কবে না জানি বুকে ছুড়ি চালিয়ে দিস।”

অয়নকে এমন সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলতে কোনোদিন দেখেনি অবন্তী। ওর হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত হলো, মনে হলো ধারালো ব্লেড বা চাকু দিয়ে কেউ ওর হৃদপিণ্ডটাকে ব্যবচ্ছেদ করছে। চোখ বেয়ে সমুদ্রের জোয়ার। সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াতে পারল না। দ্রুত হাঁটতে চাইলেও পা দুটোর তখন যেন শেকড় গজিয়েছে। অসাড় হয়ে আসা শরীরটাকে কোনো মতে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

এই অপমান সে কোথায় রাখবে! লজ্জায়, অপমানে অবন্তীর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এমন কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, যেখানে গেলে নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা যায়। অর্ধেক সিঁড়ি নেমেই তাতে বসে পড়ল। উড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে উদগত কান্নাকে রুখতে চাইল। কিছুক্ষণ পরে নিচের সিঁড়ি থেকে কারো পায়ের শব্দ পেতেই চোখ মুছল। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে অনেকগুলো জুতো দেখে বুঝল মেহমানরা চলে এসেছে।

ওর জীবন হুট করে এমন উল্টে পাল্টে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে, কিছুতেই ভাবতে পারেনি। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে কলিংবেল চাপল। মা দরজা খুলেই অবন্তীর হাত ধরে বললেন, “তোরে বললাম, একটু ঠিকঠাক থাক। ওরা তো এসে পড়ছে। মুখে একটু পাউডার দিলে কী হইত। কেমন শুকনা হয়ে আছে মুখটা। কই গেছিলি?”

অবন্তী অন্যসময় হলে মা’কে এসব নিয়ে কথা শোনাতো। কিন্তু আজ কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘ছাদে…”

মা ফিসফিসিয়ে বললেন, “আচ্ছা৷ তুই মুখটা একটু মুছে নে। ওরা এখানেই আছে।”

অবন্তী কলের পুতুলের মতো উড়নার একপাশ দিয়েই মুখটা মুছল। এরপর আগত অতিথিদের মুখোমুখি হলো। জীবনে প্রথমবার বুঝতে পারল, সে অভিনেত্রী হিসেবে ভীষণ পাকা। ভেতরের উত্তাল ঢেউ কী নিপুণ দক্ষতায় হাসিমুখে সামলে নিচ্ছে!

প্রত্যেকটা মানুষেরই কী জন্মগত এমন অভিনয় প্রতিভা থাকে? থাকে বোধহয়। ভেতরে বয়ে যাওয়া প্রলয়, কষ্ট, বিষাদ ভেতরে চেপে রেখে পুরো দুনিয়ার কাছে হাসিমুখের অভিনয় করতে করতেই হয়তো জীবনের একটা অংশ কেটে যায়!

***
বিকেলে তারা চলে যাবার পরে অবশেষে যখন একা হতে পারল, তখন নিজের রুমের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে সেখানেই ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। এরপর প্রথমে একেবারে ভেঙে পড়ল। এরপরই রাগ হলো নিজের উপরে। কেন সেধে সেধে নিজেকে ছোট করল সেটা ভেবে।

অয়নের কথাগুলো একটু পরপরই মস্তিষ্ক ওকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। লজ্জায়, অপমানে ক্রোধান্ধ অবন্তী রীতিমতো দিশেহারাবোধ করল। হাত মুঠি করে, দাঁতে দাঁত চেপে সেটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। দুই হাতে মাথার দুই পাশে শক্ত করে চেপে ধরল। তাতেও কোনো উপশম হলো না। উঠে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসল। সেটার ড্রয়ার থেকে ডিসেকশন বক্স বের করল। একটা ধারালো ব্লেড পেয়ে গেল তাতে। সেটা হাতে নিয়ে খাতায় কাটাকুটি করতে লাগল। ব্লেডটা হাতের আঙুলে চেপে ধরা ছিল বলে সেখানে কেটে রক্ত পড়তে লাগল। তবুও মনের জ্বলুনি কমছে না। বাহ্যিক কষ্ট, অন্তপুরের কষ্টকে ঢাকতে পারল না।

খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে করে কেঁদে ফেলল। সেই কান্নায় মিশে থাকল এক পৃথিবী লজ্জা আর অপমান। তীব্র দহনে পুড়ে পুড়ে কেমন দগ্ধে যাচ্ছে ভেতরটা।

প্রথমে ভেবেছিল কথাগুলো বলে ফেললে অয়নের মতামত যেমনই হোক নিজেকে হয়তো স্বাভাবিক রাখতে পারবে। কিন্তু এই প্রত্যাখ্যান যে ওকে এভাবে ভেঙেচুরে, গুড়িয়ে দেবে সেটা ভাবতে পারেনি। শারিরীক অসুখের জন্য কতরকম ওষুধ আছে, ঝলসে যাওয়া মনের চিকিৎসা কী? এই ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া হৃদয়ের ছাই ওকে যেন পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

“তুই আমাকে কোনোদিনও বুঝতে পারলি না অয়ন, একটুও বুঝলি না।” বহুক্ষণ পরে অস্ফুটস্বরে এটুকুই বলতে পারল কেবল।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনোদিন নিজেকে ছোট করবে না। অয়নের সাথে কখনো কথাই বলবে না৷ মরে গেলেও না। যে অয়ন সবসময় ওকে খোঁচা মেরে কথা বলে মজা পায়, ওর কান্নায় তার শান্তি, তাকেই কিনা সে…! ছি! ছি! ছি! কী লজ্জা! কী লজ্জা! এমন বোকামি কেউ করে! সে এতটা বোকা কেন? নিজের আজকের করা এই ছেলেমানুষি তার সন্তাপকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মা এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন আর ডাকছেন, “অন্তি, কী হলো তোর? দরজা খোল।”

অবন্তী গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “এখন খুলতে পারব না। যা বলার বলো।”

“তুই শোন না, ওরা তোরে খুব পছন্দ করছে, ফোন করে বলল।”

এতক্ষণের এত রাগ, মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা সব কেমন খড়কুটোর মতো প্রবল স্রোতে ভেসে গেল। বুকটা ধ্বক করে উঠল। সত্যিই কী তবে হারিয়ে ফেলবে বহুদিন ধরে হৃদয়ের একান্ত গহীনে লালন করে আসা ভালোবাসা! স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইল দ্বিধান্বিত অবন্তী!
………..
(ক্রমশ)