আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-০৫

0
227

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা

দুপুরে খেতে বসেছিলেন এমদাদ আর শেফালি দম্পতি। তখনও ভাবেননি আজ তাদের স্বাভাবিক জীবনে এমন ছন্দপতন ঘটবে।

মেয়ে শ্বশুর বাড়ি নিজের সংসারে ব্যস্ত, ছেলে পড়াশোনার জন্য অন্য শহরে। নিজেরও এখন অখণ্ড অবসর। দুইজনের সময় কাটে একাকিত্বের মধ্যেই। তবুও তারা সেখান থেকেই যেন খুঁজে নিচ্ছেন বেঁচে থাকার রসদ।

বহুবছর আগে দু’জনে টোনাটুনির সংসার পেতেছিলেন। সেই সময়টা যেন এই শেষবেলায় এসে আবার ফিরে এসেছে তাদের জীবনে। অনেকটা বিষাদ আর টুকরো টুকরো কিছু আনন্দ নিয়ে ঠিকই দিন চলে যাচ্ছে তার নিজের নিয়ম মেনেই।

তাদের এই সরল ছন্দবদ্ধ জীবনে সহসাই ছন্দপতন ঘটল দরজায় আনাহূতের মতো বিষণ্ণ, মলিন চেহারার মেয়েকে দেখে।

“তুই আজ আসবি বলিস নাই তো! হুট করে…”

শেফালি বাকিটা বলতে পারেলেন না। তাকে থামিয়ে দিয়ে শিউলি থমথমে মুখে বলল, “কেন? আমাকে ফেলে দিছিলা, সেখান থেকে উঠে আবার তোমাদের ঘাড়ে ভর করলাম বলে মন খারাপ হলো?”

মেয়ের কথায় দু’জনেই থতমত খেয়ে গেলেন। এমদাদ আলী বললেন, “আচ্ছা, থাক। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। তুই জার্নি করে আসলি। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া কর, তারপর শুনব সব।”

শিউলি আর কিছু বলে না। ব্যাগটা টেনে বসার ঘর পর্যন্ত এনে নিজের ঘরে চলে এলো। কতদিন পরে নিজের পরিচিত গণ্ডিতে ফিরল। ঘরের অনেককিছুই অন্যরকম করে রাখা, কিন্তু তবুও এখানে যেন ওর নিজের অস্তিত্বের একটা অংশ মিশে আছে। পা দিতেই এতক্ষণের গুমোট মেঘ কিছুটা সরে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে এসে মা’কে বলল,

“আমি খাব না এখন। জার্নির পরে পরে আমি কিছু খেতে পারি না। গা গুলিয়ে আসে।”
নিজের ঘরে এসে বিছানায় শ্রান্ত গা এলিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ল।

ঘুম ভাঙার পরে দেখল শাফিন এসেছে। শিউলি বাসে উঠে ছোট ভাইকে ফোন করেছিল। বাবা-মা’কে নিজে থেকে বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। শাফিন বোনের ঘর ভাঙার আভাস পেয়ে আর দেরি করতে পারেনি, মনের তাগিদে ছুটে এসেছে।

“আমি ওই হারামজাদার নামে মামলা করব। তুই এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করিস না।”

“শোন ভাই। আমি কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না। ওই জানোয়ারটার ছায়াও আর দেখার ইচ্ছা নাই। আমারে কিছুদিন আমার নিজের মতো করে সব গুছাইতে দে।”
শাফিন আর কথা বাড়ায় না, বোনের মলিন মুখ দেখলে বুকটা হুহু করে উঠে।

অন্যদিকে দুই সন্তানের অসময়ে বাসায় আগমনের হেতু খুঁজে পান না। এমদাদ আর শেফালির কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হয়! আশঙ্কার পালে জোর হাওয়া লাগে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার পরে শাফিনের কাছ থেকে সব শুনে সেই আশঙ্কা সত্যি হয়।

রাতে মেয়ের সাথে আলোচনায় বসেন তারা। শিউলির মুখ তখনও থমথমে, “বাবা, আমি আর সেইখানে যাব না। আপনারে কোনোদিন বলি নাই সেইভাবে। আজ বলতেই হলো।”

শেফালী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আরেকটু চেষ্টা করে দেখি আমরা? যদি মীমাংসা করা যায়। সবাই তো নানারকম কথা বলব। এইগুলা কেমনে…”

শিউলি রেগেমেগে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই শাফিন বলল, “মা, এগুলা কী বলো তুমি? টাকার জন্য তোমার মেয়ের গায়ে হাত তুলত, মাতালটা একটা শয়তান। তার সাথে কীসের মীমাংসা? আমার তো ইচ্ছা করতেছে ওরে গিয়ে হাত পা ভেঙে দিয়ে আসি।”

শেফালী আবার কিছু বলার জন্য মুখ খুললেন, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে এমদাদ আলী বললেন, “আমি তো এখনো বেঁচে আছি, নাকি? তোর আর যাওয়া লাগবে না কোথাও।”

শিউলি মায়ের কথায় দমে গেলেও বাবার কথায় কিছুটা ভরসা পেল। তবুও মায়ের বলা কথাটা যেন ভেতরটায় খোঁচাতে লাগল। কে, কী বলল এসব ভেবে এমন অন্যায়ের সাথে আপোষ করলে জীবনে নিজের কাছেই তো নিজে মরে যাবে অপমানে, লজ্জায়, হতাশায়।

সে তো কোনো অন্যায় করেনি, বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। লোকজন কেন যে এমন উল্টো পিঠের যাত্রী হয়! অপরাধী তাদের চোখে পার পেয়ে যায়, তারা সবসময় কাঠগড়ায় দাঁড় করায় ভুক্তভোগীদের। কী নিষ্ঠুরতম নির্মমতা! কী অদ্ভুত মানুষের বিবেকবোধ!

এমদাদ বললেন, “মা রে, আমি তোরে সবসময় বলতাম যে নিজের কিছু সম্পদ হাতে রাখতে হয়। পড়াশোনা তোর সেই সম্পদ হতে পারত। তুই তো আমার কথা শুনলি না। গা ছাড়া জীবনটাই বেছে নিলি। অনার্সে ভর্তি হয়ে পড়া বাদ দিলি।”

বাবার কথাটা সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে অনেকদিন থেকেই। মনে মনে ভেবে নেয় আবার সব নতুন করে শুরু করবে। আগে ফালতু লোকটার সাথে কাগজে কলমে যেটুকু সম্পর্ক বেঁচে আছে সেটাকে ছেঁটে ফেলতে হবে। নতুন জীবনে সে নিজের মতো করে বাঁচবে, কোনো কীটপতঙ্গের ছায়া সেখানে পড়তে দেবে না।

***
অয়ন দু’দিন হয় লাপাত্তা। অবশ্য বাবার সাথে রাগারাগি হলেই সে মাঝেমধ্যেই এমন উধাও হয়ে যায়, পরে দেখা যায় কোনো বন্ধুর মেসে গিয়ে উঠেছে। কাজেই কেউ তেমন গা করে না এখন।

খাবার টেবিলে বসে বড়চাচা স্বভাবসুলভ চেঁচিয়ে বললেন, “ওই নবাব পুত্তুর কই থাকে শুনি? এইটা হোটেল না যে যখন ইচ্ছা আসলাম, যখন ইচ্ছা গেলাম। এইবার আসলে ওরে বাসায় ঢুকতে দিবা না বললাম। সবাই শুনে রাইখো।”

সবাই আগের মতোই চুপচাপ থাকল, কিন্তু বড়চাচার এই অভ্যাসটা বোধহয় এখন মজ্জাগত হয়ে গেছে। অয়ন বাসায় না থাকলেও তিনি ক্ষান্ত হন না। অয়নের প্রতি তার বিষেদগার চলতেই থাকে। পার্থক্য শুধু এটাই যে অয়ন সেসব শুনতে পায় না।

তিনি আবারও বললেন, “আমার বয়স হয়ে যাইতেছে, সেদিকে তার কোনো ধ্যান নাই। কয়দিন পরে সংসারের হাল ধরা লাগব ওর, ক্যারিয়ারে ফোকাস না করে উড়নচণ্ডীর মতো ভেসে বেড়াইতেছে। কী করব জীবনে? চিন্তায় চিন্তায় আমার ঘুম হয় না!”

শেষের কথাগুলোতে তার ভেতরে লুকোনো আশঙ্কা যেন ঠিকরে বের হলো! এখন বড়চাচাকে পুত্রের ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় চিন্তাগ্রস্ত একজন অসহায় পিতা হচ্ছে! স্নেহটাও এখন বেশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, যার জন্য এই স্নেহ তাকে কখনো তিনি সেটা দেখান না। শাসনের একটা কঠিন বর্মে নিজেকে আবৃত রাখেন সবসময়।

অবন্তীর বেশ খারাপ লাগল। চাচা উঠে যেতেই চাচী বললেন, “এইবার অয়নের বাপের সাথে লাগার পরেও তো কিছুদিন বাসায়ই থাকল। হুট করে কী হইল আবার? এই ছেলে আমার হাড় জ্বালাতন করার জন্য জন্মাইছে।” মাতৃস্নেহের তারল্যের সাথে সাথে ক্ষোভটাও ঝরে পড়ল।

অবন্তীর মনে হলো সেদিন রাতের ঝগড়ার কথা, সেটার জন্য কী অয়ন বাড়ি ছাড়ল? না, তা কী করে হয়! তেমন ঠোকাঠুকি তো দু-জনের মধ্যে প্রায়ই লাগে। সেদিন তো প্রায় মিটমাট হয়েই গেল। তবুও মন কেমন কেমন যেন করতে থাকে! খাবার গলা দিয়ে নামে না। কোনোরকমে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে থাকে।

***
অয়ন যেই বন্ধুর মেসে ছিল সেটা ওদের পাশের এলাকাই, এবং একইসাথে জুনায়েদেরও এলাকা। এই পাড়ার অনেক মানুষ তাদের পরিবারকে সমঝে চলে। পারতপক্ষে কেউ ঝামেলা করে না। ফেরার পথেই জুনায়েদ সামনে পড়ল। অয়নকে দেখে এগিয়ে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো।

“সামনে থেকে যা।” চোখ রাঙিয়ে বলল অয়ন।

“কেন রে! শোন, তুই আর তোর বাপ, চাচারা আমারে যে অপমান করছিলি সেইটা আমার মনে আছে। আমি অপমান ভুলি না।”

“ভুলিসও না। সবসময় সেইটা মনে রেখে ভদ্র হয়ে চলবি।”

“তোর কাছ থেকে আমার ভদ্রতা শিখা লাগব? তুই কোত্থেকে আসছিস রে?”

এরপরই জুনায়েদ কিছু অকথ্য গালিগালাজ করল, এতে অয়নের মাথা গরম হয়ে গেল। তবুও নিজের ক্রোধকে সংবরন করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন অবন্তীর নামে বাজে কথা বলল, তখন নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। প্রচণ্ড রাগে হাত মুঠো করে জুনায়েদের চোয়াল বরাবর চালিয়ে দিল। জুনায়েদও পাল্টা আক্রমণ করে বসল। মুহূর্তেই হাতাহাতি লেগে গেল। জুনায়েদের সাঙ্গপাঙ্গরা এগিয়ে আসতেই মতিন ভাই তাদের থামিয়ে মধ্যস্থতায় উৎসাহিত করলেন। তিনি এখানে ঝামেলা করতে চাইছেন না। অয়নের সাথেও কিছু রাঘব বোয়ালের সখ্যতা আছে বলেই তিনি জানেন। এই ঘটনা বড় হলে এটা বিশাল বড় একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। তাই দ্রুততম সময়ে ওদের সাহায্য নিয়ে দু’জনকেই থামালেন। ফুঁসছে ওরা, জুনায়েদ হুমকি দিল,

“তোর খবর আছে! তোরে আমি দেখে নিব।”

“যা ইচ্ছা করিস, আমি ভীতু নই।”
পাল্টা তীর ছুঁড়ে অয়ন সেই জায়গা থেকে চলে এলো।

থুতনি থেকে রক্ত পড়ছে, সেভাবেই বাসায় এলো। তবে আজকের মারামারির জন্য কোনো অনুশোচনা হচ্ছে না, বরং আরও কয়েক ঘা লাগাতে পারেনি বলে আফসোস হচ্ছে। তখন মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল।

ওকে দেখে মা আঁতকে উঠলেন, “আবার কী করছিস? এমন ক্যামনে হইল? চুপ করে আছিস ক্যান? বল।”

“এমন অস্থির হওয়ার মতো কিছুই হয় নাই।”

মায়ের পিছুডাক উপেক্ষা করে দ্রুত পা চালিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করল। এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে ইচ্ছে করছে। একেবারে নিঃসঙ্গতায় মোড়া বিষণ্ণ একাকিত্বের মোড়কে নিজেকে সেঁধিয়ে দেবার তীব্র ইচ্ছেকে উপেক্ষা করা ঠিক নয়!

***
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ইউনিভার্সিটি যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখনই মায়ের আগমন।

অবন্তী মাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে আম্মু?”

তিনি ভীষণ জরুরি গলায় বললেন, “আজ ভার্সিটিতে যাওয়া লাগবে না। তুই বাসায়ই থাক।”

কেমন যেন খটকা লাগল, বলল, “কেন আম্মু? হঠাৎ…”

“আরে, তেমন কিছু না। তোর মাহমুদ মামারে দেখছিস না? ওরা সপরিবারে আজ বাসায় আসব।”

“আম্মু, তুমি ঝেড়ে কাশো তো। তারা আসলে তো দুপুরের আগে আসবে না, এসেই নিশ্চয়ই চলেও যাবে না। আমি ক্যাম্পাস থেকে এসেও তাদের সাথে দেখা করতে পারব।”

“সব সময় একটা সাধারণ কথা বললেও তুই প্যাচাস কেন?”

“তো সোজাসাপ্টা কথা বলো না কেন তুমি?”

নাছোড়বান্দা মেয়ের কাছে হার মেনে নিয়ে বললেন, “তোরে দেখতে আসবে। পছন্দ করলে বিয়ের ব্যাপারে কথা হবে।”

অবন্তী এমন কিছু ভাবলেও এতক্ষণ খুব একটা গা করেনি। কিন্তু এবার হৃদপিণ্ডে ধ্বক করে উঠল। কথারা সহজে ভাষা পেল না, গলার ভেতর থেকে জোর করে কথাগুলো টেনে নিয়ে বলল,
“এসব কী বলছো মা? আমার তো গ্র‍্যাজুয়েশনই শেষ হয়নি। এখনই এসব কেন?”

“ওরা তো তোর পড়ার মধ্যে বাঁধা দিতে আসব না। তাছাড়া তারা পরিচিত মানুষ। কেমন না কেমন ঘরে তুই যাবি এই ভেবে আমি আর তোর বাবা কত চিন্তা করছি। ভালোই হবে। তুই একটু পরিপাটি থাকিস।”

অবন্তীর পাল্টা উত্তর না শুনেই তিনি বেরিয়ে যান। এই মেয়ের মতিগতি ইদানিং তার ভালো মনে হচ্ছে না। অয়নের প্রতি মেয়ের টানে তিনি কেন যেন এখন অন্য কিছু দেখেন। যা তাকে শঙ্কিত করে। অয়নকে তিনি ভীষণ স্নেহ করেন। কিন্তু এমন একটা ছেলের হাতে নিজের আদরের মেয়েকে তুলে দিতে ভরসা পান না। জীবন নিয়ে কখনো ভাবে না ছেলেটা, নিজেকে দিনের পর দিন ডুবিয়েই যাচ্ছে! তিনি এখন এই বিয়েটা হলেই ভীষণ স্বস্তি পাবেন ।

অন্যদিকে অবন্তী যেন তখন নিশ্চল, নিস্তরঙ্গ রোবট। কিছুতেই এই বিয়েটা করা সম্ভব নয়। কী করবে সে এখন! মাথা যেন অসাড় হয়ে আসছে। শেষমেশ ভাবল অয়নের সাথে কথা বলবে আগে। অয়ন কীভাবে নেবে বিষয়টা, জানে না! দুরুদুরু হৃদয়ে ক্ষণ গুণতে লাগল, কখন আসবে মোক্ষম সুযোগ!
……..
(ক্রমশ)