আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-০৯

0
200

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ৯)
নুসরাত জাহান লিজা

শেফালী দরজা খুলে জামাতাকে দেখে কিছুটা থমকে গেলেন, তুহিন হাসিমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শেফালির মনে কেমন যেন একটা আশঙ্কা হলো!

“ভালো আছেন মা? আপনার শরীর, স্বাস্থ্য সব ঠিক আছে তো?”

“আমি ভালো আছি।”
এরপর নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও বললেন,
“ভেতরে আসো।”
সরে গিয়ে জায়গা করে দিলেন।

শিউলি ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়ে এসেছিল, ছাদ থেকে নেমে তুহিনকে দেখে একমুহূর্তে পা নিশ্চল হয়ে গেল, এরপরই নিজেকে ধাতস্থ করে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে এলো। খানিক বাদেই দেখল তুহিন পিছু নিয়ে এখানে চলে এসেছে। সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতো কাপড়গুলো ভাঁজ করায় মন দিল।

“তোমার এত তেজ কীসের সেইটা আমার মাথায় ঢুকে না। এমন একটা ভাব করো মনে হয় যেন তুমি শিউলি না, মহারানী ভিক্টোরিয়া। তুমি তো তা না। তাই ভাব কমাও আর আমার সাথে আসো।”

এবার চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তুহিনের দিকে তাকালো শিউলি। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “তুমি কী জন্য আসছো এখানে?”

“এতকিছুর পরেও তোমারে নিতে আসছি। তোমার কপাল ভালো, এইটা বলতেই হবে।”

“হ্যাঁ, এত ভাগ্য আমি কই রাখি! তা এইবার কয় টাকার দাবি আছে আমার বাপের কাছে?”

“আমি টাকার কথা বলছি কিছু? সব সময় বেশি বুঝো। এইটা তোমার বড় দোষ।”

সশব্দে হেসে ফেলল শিউলি, “ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তুমি যে এইখানে ছ্যাঁচড়ার মতো হাত পাততে আসবা এইটা না জানার মতো কোনো কিছু না।”

“নিজের ভালো পাগলেও বুঝে, এখন দেখতেছি তুমি তারও অধম।”

“হাহ্! তুমি কি মনে করছো তোমার এইসব কথা, ধামকি শুনে আমি সুড়সুড় করে ব্যাগ গুছায়ে তোমার পিছু পিছু ড্যাং ড্যাং করে রওনা দিব? তোমার মতো মতলববাজ মানুষরে আমার হাড়েমজ্জায় চেনা আছে।”

“কী বলতে চাও তুমি? আমি কিন্তু চাইলে অনেককিছু করতে পারি। মেয়ে মানুষের এত সাহস ভালো না।”

“এই যে, এইবার লাইনে আসছো। তুমি পুরুষ মানুষ, রাজা! আর মেয়েরা কি তোমার দাসী বাদী? তোমার বউ, দূর্বল একটা মেয়েমানুষ। ইচ্ছা করলেই যারে গালমন্দ করা যায়, গায়ে হাত তুলা যায়, সে কিনা তোমারে উস্টা দিয়ে তার জীবন থেকে বাইর করে দিছে! এইটা তোমার পৌরুষে আঘাত লাগছে! এইটাই কারণ তো? তোমার দৌড় আমার ভালোই জানা আছে৷ এখন আমার বাড়ি থেকে বাইর হও। এক্ষণ!”

“বেশি বাড় বাড়ছে না তোমার? পিপীলিকার পাখা গজালে কী হয় জানো? মরার সময় চলে আসে! তোমারও সেইরকম সাধ জাগছে মনে হয়!”

চলে যাচ্ছিল তুহিন, শিউলি পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “কথাটা তুমিও মনে রাইখো।”

প্রচণ্ড রাগে শিউলির মাথায় যেন জ্বলন্ত আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। এমন জঘন্য মানসিকতার একটা লোকের সাথে একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় এতগুলো দিন কাটিয়েছে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করতে লাগল।

শাফিন বাসায় এসে মায়ের কাছ থেকে সব শুনল, বোনের ঘরে এসে দেখল শিউলি শুয়ে আছে চোখের উপরে হাত রেখে।

“আমি কাল না গিয়ে আর দুই দিন পরে যাই নাহয়। এই অবস্থায়…”

তড়াক করে উঠে বসল শিউলি, “তুই যাবি না কেন? আমারে এত অসহায় ভাবিস না। আমাকে আমার মতো করে সব গুছাইতে দে৷ বাকি জীবন যখন একাই চলতে হবে তাইলে শুধু শুধু এসব করে কী লাভ?”

শাফিন বোনের দিকে তাকালো, তার এই বোনটার মধ্যে হটাৎ করে একটা স্ফুলিঙ্গ এসে ভর করেছে যেন। অদ্ভুত একটা প্রত্যয়ে চকচক করছে মুখটা। এই কয়েকদিনে চোখে অসহায়ত্বের যে ছাপ ছিল সেখানেও আশ্চর্য দৃঢ়তা।

“তুই এই কয়দিনেই অনেক বদলে গেছিস আপু!”

“সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয় রে। পৃথিবীতে দুর্বলদেরকেই মানুষ দমিয়ে রাখতে চায়। এইটা খুব ভালো মতো বুঝতে পারছি। তাই নিজের দুর্বলতার সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না রে। ওর মতো একটা নোংরা মানুষকে তো আরও নয়।”

শাফিন একইসাথে বিস্ময় আর স্বস্তি নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। শিউলি একসময় একা একা কোথাও যেতে পছন্দ করত না, পারত না বোধহয়। এখন সেই মেয়েটার চোখে জীবনের বন্ধুর পথটাই একাই কাটানোর সংকল্প! দেখতে ভালো লাগছে খুব! যে ভাঙ্গনের দায় তার নয়, সেটার জন্য মিছে গ্লানিবোধ মনে পুষে রাখার কোনো অর্থ নেই।

শাফিন নিশ্চিন্ত বোধ করল, নির্ভার লাগছে কিছুটা।

***
দুদিন থেকে এই বাসায় রীতিমতো নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। যা সচরাচর দেখা যায় না, প্রায় বিরল অভিজ্ঞতা। অয়ন নিজের ঘর থেকে বের হয়নি খুব একটা। বড়চাচা বেরিয়ে যাবার পরে সে খেতে এসেছে৷ আবার নিজের ঘরে গিয়ে ডুব দিয়েছে। তবে আজ সবাই একসাথেই খেতে বসেছে। অবন্তী দেখল অয়ন আজ আবার যেন আগের মতো সপ্রতিভ।

বড়চাচা বললেন, “মজিদ ভাইয়ের মেয়েটা এবার বিসিএসে রিটেনে টিকল। আমার ঘরেরটার কাছে সেটা আশা করা বৃথা।”

অয়ন হেসে বলল, “ওই যে আনন্দ মোহনে পড়ত যে, সে?”

বড়চাচা কটমট করে তাকালেন, “তোর তো আনন্দ মোহনে পড়ার যোগ্যতাও হয়নি, হতচ্ছাড়া।”

“না, মানে আপনি তো বলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে নাকি কোনো ফায়দা নেই, জীবন বৃথা। তাই বললাম আরকি।” মুখে গা জ্বালানো হাসিটা বহাল তবিয়তে বিদ্যমান আছে।

অবন্তী মনে মনে শিউরে উঠল, এই বুঝি আবার ঠোকাঠুকি লাগল। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। বড় চাচা আজ কিছুটা শান্ত, আরেকবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানো ছাড়া তেমন কিছু হলো না।

সবাই উঠে চলে গেলে অবন্তীও উঠল। আজ শাফিন আসবে ক্লাসে, দেখে দেখে সবগুলো ক্লাস খাতা ব্যাগে ভরল। এই কয়দিনে অনেককিছু মিস করে ফেলেছে ছেলেটা। সবকিছু তাকে বুঝিয়ে, গুছিয়ে দিতে হবে।

বেরুবার মুখে দেখা হলো অয়নের সাথে, অবন্তী ভেতরে ভেতরে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলেও দ্রুত সামলে নিয়ে মুখে কাঠিন্য ফিরিয়ে নিয়ে এলো। অয়নকে যে বার ক্রিকেট খেলার জন্য বড়চাচা মেরেছিলেন তখন ওর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হয়েছিল। যেবার খেলাটাই বাদ দিতে হলো, তখন সেই মায়াটা প্রগাঢ় হলো।

অবন্তীর মনে আছে তখন প্রায়ই অয়ন অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, নিজের অপূর্ণতাগুলো আকাশে ভাসিয়ে দেবার চেষ্টা করত হয়তো। অবন্তী মাঝেমাঝে অয়নের সেই মগ্নতা না ভেঙে দূর থেকে লুকিয়ে দেখত। একদিন অয়ন দেখে ফেলায় সে মুখ ঝামটা দিয়ে অযুহাত দিয়ে বলেছিল, “রাতে আমি প্রায়ই ছাদে হাঁটাহাঁটি করি, তুই জানিস না?”

অয়ন সেদিন নিজেকে লুকায়নি। নিজের স্বপ্ন ভাঙার বেদনায় কেঁদেছিল খুব করে। সেই রাতে অদ্ভুত সুন্দর জোছনায় ভিজতে ভিজতে বিষাদী ছন্নছাড়া ছেলেটার জন্য যে মায়ার বীজটা অবন্তীর মনে জন্মেছিল, সেটা কবে, কখন ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে অবন্তীকে গ্রাস করে ফেলেছিল তার জানা নেই! যখন বুঝতে পেরেছে ততদিনে শিকড় সমেত সেই মহীরুহ বৃক্ষ উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি, কে জানে হয়তো উপড়ে ফেলতেই চায়নি। নাহলে অসম্ভব যত্নে অনুভূতিটাকে লালন-পালন করে আরও বেড়ে উঠতে দেবে কেন?

আজ অয়ন ই প্রথম মুখ খুলল, “খুন্তি রে, তুই তো দেখতেছি অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছিস। দেখাই যায় না।”

“বাব্বাহ্! তুই আমাকে খুঁজিস নাকি আজকাল?”

“হ্যাঁ, তোর সাথে ঝগড়া হয় না কতদিন জানিস? শুনলাম বিয়েটা নাকি ভেঙে দিয়েছিস?”

অবন্তীর ভেতরে সহসাই আগুন জ্বলে উঠল। কেন যে সেদিন মতিভ্রম হলো ওর! বাবা যে এত সহজে মেনে নেবেন সেটা জানলে কী আর এই তক্ষকের কাছে মনের আগল খুলত নাকি! এখন সেটা নিয়ে নানাভাবে খুঁচিয়ে মারবে। অবন্তীর ভারি শিক্ষা হয়েছে। পাশ কাটাতে হবে বলে ভাবল।

“হ্যাঁ, ভালো করেছি না?”

“একদম ঠিক করেছিস। বিয়েটা বোধহয় তোর জন্য নয়। অবলা একটা ছেলের ঘাড় ভাঙুক আমি তা চাই না।”

“যা তো এখন। কার ঘাড় ভাঙবে না ভাঙ্গবে জানি না, তবে এই মুহুর্তে আমার সামনে থাকলে তোর ঘাড় আস্ত থাকবে না।”

“তুই না সেদিন বললি আমারে ভালোবাসিস? যারে ভালোবাসিস তার ঘাড় মটকে দিবি কীভাবে? এই তোর ভালোবাসা?” নাটুকে ভঙ্গি অয়নের।

গেট পেরিয়েছে ওরা, তীব্র রোদে যেন ঝলসে দিল তাদের। অবন্তী হিঁসিয়ে উঠে বলল, “শোন অয়ন! আমার আবেগ নিয়ে ফাজলামো করার অধিকার তোর নাই। সেই আবেগটুকু আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি সেদিনই৷ আরেকবার যদি এটা নিয়ে কিছু বলিস তোর চোখ আমি ঠিক গেলে দেব।”

অবন্তী কথা শেষ করতেই অয়নের মুখে কেমন বিচিত্র একটা হাসি ফুটল। সেই হাসিটা না আনন্দের, না বিষাদের! অন্য একটা অনুভূতির ছাপ সেখানে, কীসের সেটা অবন্তীর বোধগম্য হলো না!

অবন্তী নিজের ভেতরে রাগ আর কষ্ট ধরে রেখেই অয়নের চলে যাবার পথে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল। এই ঝলসানো, খরতপ্ত রোদে পুড়তে পুড়তে ছেলেটা কেমন ছাতা ছাড়াই হাঁটছে। উদ্দেশ্যহীন, নিরানন্দ, বিরস এক পদচারণা তার!

অবন্তীর বুক ভারি হয়ে আসে, টনটনে প্রগাঢ় ব্যথা বাজতে থাকে সেখানটায়। হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে বিষাদী সুর বেজে উঠল, বাজতেই থাকল ক্রমশ!
…………..
(ক্রমশ)