আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-১০

0
188

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১০)
নুসরাত জাহান লিজা

রাস্তায় জুনায়েদের সাথে সহসাই অয়নের দেখা হয়ে গেল, এতে মেজাজটা একেবারে খিঁচড়ে গেল। জুনায়েদ ক্যাটক্যাটে হাসি ঠোঁটের কোণায় ঝুলিয়ে পাশে দাঁড়ানো সাগরেদের উদ্দেশ্যে বলল,
“রাস্তাঘাটে এখনো যারা বাপের হাতে মাইর খায়, তার তো দুধের দাত এখনো পড়ে নাই। তারা আবার আমার সাথে লাগতে আসার সাহস দেখায়। কী যে দিনকাল আসলো, তেলাপোকারাও বাঘের সাথে টক্কর দিতে চায়।”

অয়ন দাঁতে দাঁত চেপে একবার জুনায়েদকে জরিপ করল, এরপর বিরস গলায় বলল, “ভুলভাল কথা বলে লোক হাসানো বন্ধ কর। মনে মনে যারা নিজেদের বাঘ ভাবে তারা বেশিরভাগ সময় বেড়ালই হয়। আরেকটা কথা, তোর সাথে ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো আজাইরা সময় আমার নাই।”

জুনায়েদ যে আজ সহজে নড়বে না, অয়নকে ইচ্ছাকৃতভাবে উস্কে দিচ্ছে এটা সে বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে। কিন্তু অয়নের মন এসবে সায় দিচ্ছে না, কিছুদিন থেকে কোনোকিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছে না। মনটা তেতো হয়ে আছে। জুনায়েদের সাথে এই বাদানুবাদ কেমন যেন ফিল্মি মনে হচ্ছে। আচ্ছা সে কোন গোত্রে পড়বে, নায়ক নাকি ভিলেন? এই পরিস্থিতিতে নিজের এমন অদ্ভুত অমূলক চিন্তায় মনে মনে একচোট হেসেও ফেলল। সিরিয়াস পরিস্থিতিতে অয়নের মনে কেন যেন বেশিরভাগ সময়ই এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটে। নিজেকে কিছুটা পাগলাটে মনে হচ্ছে।

“তোর বাপটা জোস রে ভাই। একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম তুই আগেও কয়েকবার মাইর খাইছিস। এমন রাস্তাঘাটে মাইর খাস, আবার বুক ফুলায়ে ঘুরতে লজ্জা করে না? অবশ্য লজ্জা শরম থাকলে কি আর বাইরে আসতি, ছি, ছি! আমি হইলে তো ঘর থেকেই বাইর হইতাম না, কাউরে মুখই দেখাইতে পারতাম না।”

অয়নের পক্ষে মেজাজের পারদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না, বিস্ফোরণ ঘটবে যেকোনো সময়। ওর বাবা ওপরে যে রাগটা পুষে রেখেছে সেটাও যেন জেগে উঠল। অয়ন পাল্টা জবাব দেবার জন্য মুখ খুলতেই জুনায়েদের কথায় থেমে গেল,

“দুনিয়ার কোন বাপ এমন হয় বল? তোর বাপটা একটা সাক্ষাৎ হারামি। তোরে…”

জুনায়েদ আর বলতে পারে না, চোয়াল বরাবর একটা ঘুষি খেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেছে। অয়নের মাথায় তখন জ্বলন্ত আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। বাবার প্রতি ওর রাগ আছে, অভিমান আছে, চাপা জেদও আছে যা তুঙ্গ স্পর্শী। তবুও অন্যের মুখে তার নিন্দা, তার অপমান সইবার মতো মানসিকতা তার নেই।

ক্রুদ্ধ অয়ন পাল্টা মার খেয়ে সম্বিতে ফিরল। জুনায়েদের দুজন সাগরেদ ততক্ষণে অয়নকে দুদিক থেকে চেপে ধরেছে। জুনায়েদের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণ সহজেই অনুমেয়, এটা দুজনের কারোরই নিজের এলাকা নয়। এটা যেহেতু প্রায় নিরিবিলি রাস্তা, জন সমাগম খুব কম। অল্প যেটুকু আছে তারা কেউ স্বাক্ষী দেবে না। একা একা তিনজনের সাথে পেরে উঠা সম্ভব নয়। তাই অয়ন কিছুক্ষণ যুঝে আজকের নিয়তিটা মেনে নিল।

কিন্তু খানিক বাদে আনোয়ার সাহেবকে একটা রিকশায় করে এদিকে আসতে দেখল, সাথে বোধহয় একজন কলিগ আছেন। অয়নের মনে পড়ল এই পথে তার বাবা রোজ অফিসে আসা-যাওয়া করেন।

রাস্তাঘাটে মারামারি করার মতো গর্হিত অপরাধে আজও বোধহয় কিছু উত্তম-মধ্যম ওর কপালে আছে, যদিও এখন আর সেসবে গা করে না। তবুও তিক্ত মনটা যেন বিষে বিষে নীল হয়ে গেল।

কাছাকাছি এসে বাবা আর তার সাথের ওই আঙ্কেল দু’জনই রিকশা থেকে নেমে এদিকে আসতেই অয়নকে ছেড়ে জুনায়েদ সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে পগার পার।

“আনোয়ার ভাই, আপনি ওরে নিয়ে যান, আমি অন্য একটা রিকশা দেখি। মোড়ে গেলেই পাবো।”

বাবা কেবল সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন, অয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রিকশায় ওঠ।”

“আপনাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমি বাসায় চলে যেতে পারব।”

“রাস্তাঘাটে তামাশা না করতে চাইলে যেইটা বললাম সেইটা কর। মেজাজ এমনিতেই মহা গরম হয়ে আছে।”

অয়ন রিকশায় বসলে তিনিও বসলেন। কিন্তু দু’জনের মধ্যে আর একটাও ভাব বিনিময় হলো না। মৌন ব্রত পালনের কঠোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যেন কারোর কাছে! কথা বললেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ! বাবা-ছেলেতে এক হিমালয় সম দূরত্ব কমানোর প্রচেষ্টা একজনের মধ্যেও দেখা গেল না।

***
সুফিয়া ভাতের চাল ধুচ্ছিলেন, রোকেয়া সবজি কাটছিলেন। রান্নাঘরে দু’জনের জমে ভালো। তবে হঠাৎ হঠাৎ কিছুটা তাল কেটে যায় এবং সেটা বেশিরভাগ সময়ই খুব সামান্য, ঠুনকো কোনো কারণে। আজ বোধহয় তেমনই একটা দিন।

সামন্য কী একটা বিষয়ে তুমুল কথা কাটাকাটি লেগে গেল। অবন্তী পড়তে বসেছিল, ছুটে এসে থামাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

এরইমধ্যে অয়ন আর বড়চাচাকে একসাথে এভাবে থমথমে মুখে বাসায় আসতে দেখে শিউরে উঠল ভেতরে ভেতরে। তবে কেউ কিছু না বলে যার যার ঘরে চলে গেলে একটা স্বস্তির শ্বাস টানল, দেখল বাকি দু’জনও সন্তর্পণে নিজেদের স্বস্তি গোপন করল৷

“আজ আবার কী হলো রোকেয়া?”

“তুমি চিন্তা কইরো না ভাবি। বড় কিছু হলে ঘরে কুরুক্ষেত্র লাগত। কিছু যেহেতু হয় নাই, তারমানে বড় কিছু না।”

“আমার আর এগুলা ভাল্লাগে না। কেউ কিছু বুঝতে পারে না। আছে ঠোকাঠুকি নিয়ে।”

“তুমি একটু বসো, ভাবী। মাথা ঠান্ডা করো।”

চম্পা কাপড় ধুয়ে ফিরতেই রোকেয়া বললেন “চম্পা, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দে তো ভাবীরে।”

অবন্তী মা আর চাচীর এই বিষয়টা ধরতে পারে না, তবে ভীষণ ভালো লাগে। প্রত্যেকটা সংসারে টুকটাক কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য হয়ই। সেসব নিয়ে কত ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা আসেপাশেই শুনেছে। কিন্তু এই দুজনের কেউই সেসব ধরে রাখে না। এই যে কী সুন্দর মিলে গেল! এখন কে বলবে একটু আগে তারা গলা চড়িয়ে ঝগড়া করছিল! এজন্যই বহু বছর ধরে একসাথে থাকতে পেরেছে পরিবারের সবাই মিলে। এখন কয়টা পরিবার এটা পারে! হঠাৎ করেই অবন্তীর মন ভালো হয়ে গেল!

***
শিউলি হুমকি ধামকি দিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাবার পরে তুহিনের টনক নড়ে। তবুও ভেবেছিল, সেখানে আর কয়দিন থাকবে! চক্ষুলজ্জার ভয়ে শ্বশুর ঠিকই ওর সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে চাইবেন। তখন নিজের চাওয়াটা পূরণ করতে বরং আরও সুবিধা হবে। হাতটান চলছে, পকেট গরম করা দরকার। জুয়ার আসরে হেরে অনেক টাকা খুইয়েছে৷ সেসব শোধ করা সম্ভব হচ্ছে না৷

একটু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বললেও বেশ সহজসরল আছে শিউলি, তুহিন তেমনই ভেবেছিল৷ কিন্তু সপ্তাহ ঘুরলেও যখন কেউ যোগাযোগ করেনি তখন শঙ্কিত হলো। বুঝতে পারল নিজের স্ত্রীকে চিনতে ভুল করেছিল। ওই মেয়ের মানসিক দৃঢ়তা অন্য ধরনের। মায়ের সাথে আলোচনা করলে সফুরা বললেন,

“তোর বউ একটা ঘাড়ত্যাড়া মাইয়্যা। সে নিজে আসব না৷ মামলা করে দিলে উল্টা তোরেই ট্যাকা পয়সা ঢালতে হবো।”

তুহিন চিন্তা করে দেখল তাতে একূল ওকূল দুটোই হারাবে, তারচাইতে বরং আরেকটু হুমকি দিয়ে দেখা যাক। ভাবতেই শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু এই মেয়ের তেজ একটু বেশি। এটা তুহিনের মেল ইগোতে চরম আঘাত করেছে। একটা শিক্ষা শিউলিকে না দিয়ে ছাড়বে না সে, কিছুতেই না।

নানারকম কুটিল ভাবনা মাথায় ঘুরতে লাগল। স্থির হয়ে বসে সঠিক প্ল্যান ঠিক করে এগুতে হবে। জগতের কত বড় আর ভালো কাজ যে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সফল হয়নি, হারিয়ে গেছে! সেসবের জন্য যেন ভারি আফসোস হলো তুহিনের!

***
সেমিস্টার ফাইনালের ফরম হোয়াইট হাউস, ব্যাংক এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে তুলে পূরণ করে সেটা হল প্রভোস্টের সাইনের জন্য হলে জমা দিয়ে অবন্তী বেরিয়ে এসে শাফিনের সাথে নদীর পারে গিয়ে বসল।

অবন্তী শাফিনকে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আবার আলোচনা থেমে গেছে সেটা সেদিনই জানিয়েছে। অয়নের ব্যাপারটা জানাতে পারেনি৷ নিজের সফল না হওয়া ভালোবাসার গল্প আরেকজনকে শুনিয়ে কী লাভ হবে! কিছু কষ্ট একান্তই নিজের নাহয় থাকুক, এই ভেবে আর বলা হয়নি।

“দোস্ত, এইবার তোর প্রিপারেশন কেমন?”

“টেনেটুনে থ্রি তুলতে পারলেই খুশি আমি।” স্মিত হেসে শাফিনের জবাব।

“হ্যাঁ, তুই তো প্রত্যেকবার টেনেটুনে থ্রি তুলিস। শেষে দেখা যায় ফোরের কাছাকাছি। ঢং!” কপট রাগ অবন্তীর মুখাবয়বে।

“আচ্ছা অন্তি, তুই কাউকে ভালোবেসেছিস কখনো?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে থমকে গেল অবন্তী, ভালোবাসা ওর জন্য মস্ত একটা ধাঁধা, জটিল ধাঁধা। অনেক খুঁজেও যার সমাধান সে বের করতে পারেনি।

“হয়তো। কিন্তু সত্যিই কী ভালোবাসা বলে কিছু আছে শাফিন?”

শাফিনের মনে হলো কথাগুলো অবন্তী নয় যেন অন্য কেউ বলছে। তবে কী সে অন্য কাউকে ভালোবাসে! বুকে টনটনে ব্যথা হলো।

অবন্তীকে আজ ভীষণ অচেনা মনে হলো, প্রাণোচ্ছল, হাসি-খুশি অবন্তীকেই সবসময় দেখে এসেছে, আজ তার চোখে ফুটে উঠা তীব্র বিষাদের ঘনঘটা শাফিনের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। এখনো অনেককিছু জানার বাকি রয়ে গেছে।

কিন্তু সত্যিই যদি অবন্তী অন্য কাউকে ভালোবেসে থাকে, তবে তার কী হবে! সে তো এই শ্যামলা মুখশ্রীর মায়াময় মেয়েটার ভালোবাসার অতলে ডুবে গেছে! এক তরফা ভালোবাসার মহাসমুদ্রে!

ওর ওই সুন্দর মনটাকে একবার ছুঁয়ে দেখার আকুলতা শাফিনকে যেন নিঃস্ব করে দিচ্ছে! এমন অসহায় কখনো মনে হয়নি নিজেকে! হাতে ফুচকার প্লেট হাতেই পড়ে রইল, গলা দিয়ে নামছে না ফুচকা। সামনে থাকা নতুন দেখা বিষণ্ণ অবন্তীর দিকে তাকিয়ে মন কেমন করে উঠল। অথৈ শূন্যতা গ্রাস করল শাফিনকে!
…….
(ক্রমশ)