আবার প্রেম হোক পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
447

#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম

১৪.
কালো উত্তরিতে আবৃত রাতের শর্বরী।অদৃশ্য সেই উত্তরীয়তে বোধহয় জ্বলজ্বল করছে কিছু তারকারাজিও?সেই সাথে পূর্ণ থালার ন্যায় শশী আধারিয়া অম্বরকে করে তুলেছে অভূতপূর্ব।এ যেনো মেঘশূন্য রাত্রির অপার সৌন্দর্য!বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে কফি হাতে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততার মাঝেও রাতের আকাশ দেখে নিজের মন আর মস্তিষ্ককে শান্ত করার চেষ্টা করছে চাঁদ।রাতে কফি খাওয়ার তেমন অভ্যেস নেই।তবুও কারণ আছে বলেই আজ খাচ্ছে।ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করছে তার।খুব একটা ধনী পরিবারের মেয়ে সে না।একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট সন্তান সে।বাবা-মা আর ভাইকে নিয়েই তার পরিবার।ভাই বর্তমানে অফিসে চাকরি করে।বাবাও মার্কেটে চাকরি করেন।মা একজন পরিপূর্ণ গৃহিণী।বাবা চাকরি থেকে এসে আবার সন্ধ্যায় টুকটাক কাজ করেন যাতে সংসারটা কোনোমতে চলে যায়।ভাইও বাসায় এসেই দৌড় দেয় টিউশনে।মোটামুটিভাবে আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালোই আছে তারা।তবুও চাঁদের কষ্ট হয়।বাবার জন্য,মায়ের জন্য,ভাইয়ের জন্য।সবার জন্যই কষ্ট হয়।বাবার বয়স হচ্ছে।বোঝার বয়স হওয়ার পর থেকেই তিনি পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিজ কাধে নিয়েছিলেন।এখনও ঠিক তাই করছেন।তখন করেছেন বাবা-মা-ভাইবোনদের জন্য।এখন নিজের সংসারের জন্য।চাঁদের স্বপ্ন ছিলো সে ডাক্তার হবে।ডাক্তার হয়ে বাবা-মাকে গর্ববোধ করাবে।তাদের দুঃখ ঘুচাবে।তাদেরকে একটু হলেও সাহায্য করবে।যদিও তারা চান না মেয়ের কোনো কষ্ট হোক।তবে চাঁদের সাথে তর্ক করে কখনোই কেউ জিতেনি।তারাও পারেননি।চাঁদ নিজের চেষ্টা,বড়দের দোয়া আর আল্লাহর ইচ্ছার জন্যই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে।বাংলাদেশের টপ মেডিকেলের স্টুডেন্ট সে।পুরো বাংলাদেশের মেডিকেল এডমিশন হিস্ট্রিতে তার রেজাল্টই হায়েস্ট।মিডিয়া অনেক চেষ্টা করেও তাকে সবার সামনে আনতে পারেনি।সে ইচ্ছা করেই আসেনি।তার এসব নাম-খ্যাতির কোনো দরকার নেই।তার পরিবার আর এক সৃষ্টিকর্তাই তার পরিশ্রমের ফল দেখেছেন তাতেই সে খুশি।রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পরই সে একটা হাসপাতালে চাকরি নিয়েছে।বেতন তেমন একটা না হলেও যা পায় তাতেও অনেক।বিকালের ডিউটিতে জয়েন হয়েছে সে।সেই সাথে সময় বুঝে সপ্তাহে তিনদিন করে স্টুডেন্টও পড়ায়।নিজের পড়াশুনা,অন্যদের পড়ানো,চাকরি আবার আজ থেকে কলেজও।সবকিছু মিলিয়ে ধকল গেছে অনেক!বড্ড ক্লান্ত সে।এজন্যই মূলত মাথা এতো ধরেছে।চাঁদের মাথাব্যথার সমস্যা আগে থেকেই।একবার ধরলে সহজে কমেনা।তাই বাধ্য হয়েই কফি নিয়ে বসেছে।বিশাল বড় ফ্লাটে না থাকলেও,চাঁদ যে বাড়িতে থাকে বেশ সুন্দর বাড়িটা।পনেরোতলা পর্যন্ত আছে।তারা থাকে এগারোতলায়।অবশ্য লিফট দিয়েই উঠে।তেমন একটা অসুবিধা হয়না।দুটো বেড রুম,একটা ড্রয়িংরুম,দুটো বাথরুম আর একটা কিচেন নিয়েই ফ্লাট টা।চাঁদের বাবা-মা এক রুমে আর চাঁদের ভাই এক রুমে থাকে।চাঁদের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাইয়ের রুমেই থাকে।ভাই সারাদিন বাসায় থাকেনা।রাতের দিকে আসে।সেই সুবাদেই রুমটা তারও।চাঁদ ড্রয়িং রুমের এক কোনে একটা সিংগেল খাটেই ঘুমায়।ভাই চেয়েছিলো সে ঘুমাবে সেখানে কিন্তু চাঁদের পড়া নিয়ে জোর করায় সে রাজি হয়েছে নাহলে বোনকে কষ্টে রেখে ভাই মোটেও আয়েশ ভোগ করতে পারেনা।ড্রয়িংরুমে ফ্যানসহ তার পড়ার টেবিলও আছে।ট্যাবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সেখানেই রাতে অথবা ভোরে সে নিজের পড়া পড়ে।কারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো চাঁদের কাছে অপছন্দনীয়।সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে,অন্তত এতোটুকু তো জানাই আছে যে ঘুম না হলে শরীর কতটা অবসাদগ্রস্ত থাকে।সবাইকে নিয়ে চিন্তা করলেও নিজেকে নিয়ে ভাববার একটুও সময় হয়না তার।তিন-চার ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারেনা ছুটির দিন ছাড়া।অভ্যাস হয়ে গেছে এসবে।তার বিশ্বাস একদিন আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে দিবেন যা তারা কখনো কল্পনাও করেনি তার চাইতেও বেশি!আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখেই সে প্রতিনিয়ত চলছে।তাছাড়া খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া নামাজ কাযা করেনা সে।যখনই মন অশান্ত থাকে নামাজ পড়ে সময় পেলে কুরআন শরীফ নিয়ে বসে।এখনো তার মন অশান্ত।খুব বেশিই অশান্ত।তাই সে কফি খেতে খেতে আকাশ পানে তাকিয়ে ভাবছিলো কি করলে শান্তি লাগবে।মাথা ব্যথাটা কমবে?কাউকে বলতেও পারছেনা।কারণ বললেই সবাই বলবে এতো পরিশ্রম করলে হবেটা কী?আর তার চিন্তায় সবাই হবে চিন্তিত।তার কষ্ট হলে যে তারাই বেশি কষ্ট পায়।মাথা ব্যথা হলে তো কথাই নেই!তারা জানেন চাঁদের মাথা ব্যথা মানে অস!হ্যকর য!ন্ত্রণা।তাই কাউকে কিছু বলেনি।চুপচাপ কফি বানিয়ে আকাশ দেখতে বসে পড়েছে।বাবা,ভাইয়ের রুমে ঘুমাচ্ছেন।মা আর ভাই, মায়ের রুমেই আছে।মা বোধহয় টিভি দেখছেন আর ভাই টিউশন থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সবেই মোবাইলে একটু ব্যস্ত হয়েছে।সম্ভবত ফেসবুকিং করছে।চাঁদ বারান্দার গেট লাগিয়ে দিয়ে কফি খাচ্ছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে খুবই আস্তেসুরে বলছে,

“এই আকাশের চাঁদ তোরও কি এই জমিনের চাঁদের জন্য কষ্ট হয়?আচ্ছা তোর কি মনে হয়?ঐ বিড়ালাক্ষী মানব মনে করে আমি খুব বইপোকা?বই নিয়েই বসে থাকি সবসময়?জীবনে কি বই বাদে আর কিছু নেই?সে হয়তো ভাবে আমি খুবই ধনী পরিবারের সেজন্যই কোচিং এ পড়েছি, অনেক বই কিনেছি,টিউটর রেখেছি তারপর ৯৮ পেয়েছি?সে কি কখনো জানতে পারবে এই নম্বরটা আমার কতটা জরুরী ছিলো?কতটা পরিশ্রম আর আল্লাহর কাছে চাওয়ার পর পেয়েছি?পাবলিকে চান্স পাওয়াটাই ছিলো মূখ্য উদ্দেশ্য?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ রুমে এসে ড্রয়ার থেকে দুইটা ডায়েরী বের করলো চাঁদ।দুইটাই লক সিস্টেম।ডায়েরীগুলো এনে বারান্দায় বসেই সে একটার পাসকোড দিয়ে কলম হাতে লিখতে বসলো,

“কেউ কখনোই জানতে পারবেনা এডমিশনে ৯৮ টার্গেট রেখে ৯৮ পাওয়াটা কতটা দুঃসাধ্য ছিলো!কেউ কখনোই জানবেনা ঠিক কি কি’র মধ্য দিয়ে আমি গিয়েছি।কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধও করিনা।যার যা ভাবার ভাবুক আই জাস্ট হার্ডলি কেয়ার!”

অপর ডায়েরী খুলে কিছু একটা লিখে দুটোই রেখে দিলো সন্তপর্ণে।এরপর ওজু করলো।করে নামাজে বসলো।মন শান্ত করতে চালালো আল্লাহর সাথে বিরাট লম্বা কথোপকথন!চোখের সাথে পরনের ওড়না আর জায়নামাজও ভিজিয়ে দিলো অশ্রুকণা দিয়ে।এরপর চোখমুখ মুছে মুখ-হাত ধুয়ে বাবাকে ডেকে সবাই একসাথে খেতে বসলো।মাথার যন্ত্রণা নিয়েই হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলো ছোট্ট পরিবারকে নিয়ে।প্রথমদিনের আনন্দময় মুহুর্তগুলোই বললো কেবল।তার নতুন বান্ধবী অবনীর বাচালময়তা নিয়েও পড়লো হাসির এক বিরাট রোল!খেয়েদেয়ে চুপচাপ সবার অগোচরে মাথা ব্যথার ঔষধ খেয়ে মাথায় বাম লাগিয়ে শুয়ে পড়লো চাঁদ।ভোরের দিকে উঠে পড়তে বসতে হবে।

রাত একটা বেজে সাত মিনিট,
ঘুম আসছেনা প্রণয়ের।রুমে এসে পাইচারী করতে করতে নজরে আসে অরণ তার টেবিলে বসে পড়ছে।তা দেখে বিরক্ত হয়ে সে বললো,

“আর কত পড়বি?পড়ে পড়ে কি পেজগুলো ভাসিয়ে দিবি?”

আড়চোখে তাকালো অরণ প্রণয়ের দিকে।তবে কিছু বললোনা।আবারও মনোযোগ দিলো পড়ায়।তা দেখে বেশ বিরক্ত হলো প্রণয়।চেয়ার টেনে অরণের সামনে বসে ধপাস করে বই বন্ধ করে দিতেই অরণ বললো,

“কি?”

“কি মানে?তুই জানিস না কি?”

“না জানিনা”

“ঘুম আসছেনা”

অরণ ঘড়ি দেখে বললো,

“সবে একটা দশ বাজে।যে ছেলে রোজ তিনটা চারটায় ঘুমায় তার কি করে একটায় ঘুম আসবে?”

“সেজন্য না”

“তাহলে কি জন্য?”

“এভাবে পেচাচ্ছিস কেনো?”

“আমি পেচাচ্ছিনা।তুই পেচাচ্ছিস।যাতো!মোবাইল গু*তা।আজকের লেকচার কমপ্লিটই হচ্ছেনা ধ্যাত!”

“এতো পড়ে হবে টা কী?”

“এমনভাবে বলছিস যেনো তুই পড়িস না।এমনি এমনি টপার হস”

“আমি কখন বলেছি যে পড়িনা।কথা ঘুরাবিনা বলে দিলাম”

অরণ আবারও বই খুলতে খুলতে বললো,

“তুই কী বলতে চাস সোজাসুজি বললেইতো হয়।আমার সাথে তোর এতো কিসের ফর্মালিটি বুঝতে পারছিনা”

আবারও ঠাস করে বই বন্ধ করে দিয়ে প্রণয় বললো,

“এই শা*লা তুই এখানে বই পড়তে এসেছিস?”

“তা দুলাভাই এখন আপনার বাড়ি এসে বই পড়লেও দোষ?”

“মেজাজ খারাপ করিসনা অরণ।তুই তখনও কিছু বলিসনি।এখনও নাটক করছিস।নাটকবাজ কোথাকার।কার থেকে শিখিস এসব?”

অরণ রুম কাপানো হাসিতে মত্ত হলো।প্রণয় অরণের মুখ চে!পে ধরে বললো,

“ভুতের মতো এতো রাতে হাসছিস কেনো?হয়েছে কী তোর?”

প্রণয়ের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বারান্দায় নিয়ে এসে বন্ধুকে চেয়ারে বসিয়ে অরণ নিজেও বসলো আরেকটায়।বসে বললো,

“ঐ চাঁদটা দেখছিস?”

অরণের কথায় তাকালো প্রণয় আকাশের দিকে।তাকিয়েই বললো,

“হিম”

“কি দেখছিস?বল”

বিরক্ত হয়ে প্রণয় বললো,

“রোজ যা দেখি তাই দেখছি”

“চাঁদেও কিন্তু অমাবস্যা লাগে।গ্রহণ লাগে”

“হ্যা লাগে তো?”

“অমাবস্যা কাটতে সময় লাগে তবে একসময় কেটে গিয়ে পূর্নিমা ঠিকই আসে।তবে গ্রহণ লাগলে কিন্তু চাঁদ নিজে থেকে না চাইলে কেউ তার সান্নিধ্য পায়না”

কপাল কুচকে প্রণয় বললো,

“তুই ডাক্তার হচ্ছিস নাকি চাঁদ গবেষক?”

“আমি কী হচ্ছি সেটা বিষয় না।আমি কী বলছি সেটা বোঝার চেষ্টা কর”

“পেচিয়ে বললে বুঝবো কি করে?”

“তোর কি মনে হয় যেই ছেলে মেয়েদের থেকে দশ হাত দূরে থাকে সে এমনি এমনি একটা মেয়ের অতোটা কাছে চলে গিয়েছিলো?”

থতমত খায় প্রণয়।কিছু বলতে চাইলে অরণ থামিয়ে দিয়ে বলে,

“ওদের সামনে আমার নাম নিয়ে ওদের ভুলভাল তো ঠিকই বুঝিয়েছিস।কিন্তু আমায়?আমায় কী বুঝ দিবি বল?আমাকে দেয়ার মতো উত্তর যে তোর কাছে নেই তা আমি জানি।এই উত্তর নেই বলেই কিন্তু আজ তুই মেয়েটাকে ই!নসাল্ট করেছিস”

“মিরার কথায় তাল মিলাচ্ছিস তুই”

“না মিলাচ্ছিনা।আমি যা দেখেছি তাই বলছি”

“কী দেখেছিস?”

“এটাই যে মেয়েটা তোতে ইন্টারেস্টেড না হলেও তোর পার্সোনালিটির গভীরে তোর অগোচরেই ঢুকে গিয়ে তোকে এলোমেলো করে দিয়েছে।যার জন্যই তুই চাচ্ছিস না মেয়েটা আর গভীরে যাক বা তোকে বুঝে ফেলুক।মেয়েটার ব্যক্তিত্ব যে তোকে মুগ্ধ করে ফেলতে সক্ষম তাও আমি জানি।এমন মেয়ে তুই কেনো আমি নিজেই প্রথম দেখছি।তাই অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে এই মেয়ের প্রেমে পড়তে তোর কোনোপ্রকার অসুবিধা হবে”

“এবার একটু বেশি ই ভাবছিস তুই।আমি পড়বো প্রেমে?সিরিয়াসলি?তুই এটা ভাবলিও কি করে?”

“ভাবাভাবির কিছুই নেই।তুইও মানুষ।মন আছে।সেই মন প্রেমে পড়তেই পারে।তাছাড়া আমার মতো বইপোকা পড়তে পারলে তুই কেনো পারবিনা?”

“তোর বিষয় আলাদা”

“মোটেওনা।আর তুই যে প্রেমে পড়ার ভয়েই মেয়েটাকে অ!পমান করেছিস তাও আমি জানি”

“অতিরিক্তই ভাবছিস।তোরা ভাবছিস আমি মেয়েটাকে কি*স করেছি।কিন্তু আমি তাকে কিস করিনি।তার গালের সাথে কেবল গাল মিলিয়েছিলাম।এমনটা কেনো করেছি আই রিয়েলি ডোন্ট নো।তাতে করেই তার গালে একটুখানি ঠোটের স্পর্শ হয়তো লেগে গেছিলো।মেয়েটা বুঝেছে ব্যাপার টা।কিন্তু তোরা বুঝছিস না।এমনকি তুইও?এখন এটাকে যদি চুমু বলিস তবে চুমুই।কিন্তু আমি কোনো মেয়েতেই ইন্টারেস্টেড না এটা মাথায় গেথে রাখ”

“এই শা*লা তুই কি ে*গ?”

“শা!ট আপ!”

“অমনভাবেই বলছিস!আমি কোনো মেয়েতেই ইন্টারেস্টেড না।তো কি ছেলেতে ইন্টারেস্টেড হবি? বে*কুব কোথাকার!”

“বই পড়ে পড়ে ব্রেইন টাকে জাস্ট বি!কৃ!ত করে ফেলেছিস!”

“কথা ঘুরাস না।শোন কী বলি”

“বাজে বকিস না”

“ঠিকটাই বকছি শোন”

“শুনছি”

“তুই মেয়েটাকে যেইভাবে হা!র্ট করেছিস।আর যেভাবে বলেছিস ওটাই তোদের শেষ কথোপকথন।আর কথা বলার দরকার পড়বেনা।ঐ মেয়েতো মনে হয় তোর সাথে আর টু শব্দও করবেনা”

“তো?”

“আর যেইভাবে বলেছিস সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে তোর আজব লাগছে,রীতিমতো যাকে অপমান বলে!আমার মনেতো হয়না ঐ মেয়ে ভুল করে আর তোর ত্রিসীমানায়ও আসবে”

“তাতে আমার কী?”

“তোর কী না?”

“হ্যা।ঐ মেয়ের ভাষায় ই বলছি।আই জাস্ট হার্ডলি কেয়ার বাউট হার!”

অরণ ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

“যেই মেয়ের প্রতিটা কথা মস্তিষ্কে হুবুহু ধারণ করে ফেলেছিস তাকে নিয়ে বলছিস ইউ জাস্ট হার্ডলি কেয়ার বাউট হার?যাই হোক।এমনদিন যেনো না আসে যে যার সাথে শেষ কথোপকথন করে এসেছিস তারই সাথে একটুখানি কথোপকথনের জন্য তৃষ্ণার্থ হয়ে যাস!যার সামনে দাড়ানোতে আজব লেগেছে তার থেকেই দূরে যাওয়ার কথা ভেবে দম বন্ধ হয়ে মৃ*ত!প্রা!য় হয়ে যাস!যাকে নিজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিস তাকেই একটাবার দেখার জন্য দিশেহারা হয়ে যাস!”

To be continued…

#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম

১৫.
দূর থেকে ভেসে আসছে আযানের প্রশান্তিময় ধ্বনি।প্রত্যুষে সতেজ হাওয়া বয়ে বেড়ায় প্রকৃতিতে।ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে থাকে বলে কেউই এমন সময় নিজ কার্যের জন্য বের হয়না।থাকেনা কোনো কোলাহল।ব্যস্ত নগরী পরিণত হয় নিস্তব্ধ নগরীতে।পাখির কিচিরমিচির শব্দও যেনো তখন মনে হয় মনোমুগ্ধকর গানের ধুন!এরূপ নির্মল পরিবেশ চাঁদের নিকট খুবই পছন্দনীয়।নির্মল বায়ুর সংস্পর্শে এসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলে ভারী মস্তিষ্ক হালকা হয়ে যাবে ভেবেই আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে ঘুম থেকে উঠে পড়লো চাঁদ।মাথায় ঘোমটা দিয়ে খুবই ধীর গতিতে হেটে বারান্দায় প্রবেশ করলো।তাদের বারান্দার গ্রিলে ছিটকিনি আছে বিধায় সেটা খুলে হাতদুটো গ্রিলে রেখে মাথাসহ অর্ধেক শরীর বাইরের দিকে হেলে দিয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছে।

মিরা ঘুম থেকে উঠেই কল দিলো অরণকে।অরণ তখনও ঘুমে।অরণের রিংটোন বারবার বাজছে কিন্তু তার কোনো হুশই নেই।এদিকে অন্যজনের যে ঘুমের চৌদ্দটা বেজে গেছে এখন তার কি হবে?মেজাজ খারাপ করে ফোন রিসিভ করতেই সে শুনতে পায় মিরা বলছে,

“দোস্ত আজকে জলদি কলেজে আসবি বুঝেছিস?গতকাল চাঁদের সাথে দেখা হয়নি।মেয়েটা বোধহয় চলে গিয়েছিলো।আজ যাবো।আর তোকেও কিন্তু সাথে যেতে হবে।হ্যালো….অরণ?শুনছিস আমার কথা?….হ্যালো?”

গম্ভীর কন্ঠে প্রণয় বললো,

“অরণ ঘুমাচ্ছে”

মিরা অবাক হয়ে বললো,

“অরণ তোর বাসায়?”

“প্রায়ই তো আসে অবাক হচ্ছিস যেনো?”

“অবাক না।তোরা কেউই বললিনা।নাহলে দল বেধে যেতাম”

হেসে বললো মিরা।তা শুনে মৃদু হেসে প্রণয়ও বললো,

“তুমি যে মামি কেমন দল বাধতে তা ভালো করেই জানি।নে ওর সাথে কথা বল”

প্রণয় অরণকে ডাকতে ডাকতে বলছে,

“এই ডাবল ব্যাটারী?রাতভরে পড়ে দিনভরে না ঘুমিয়ে দেখ ক’টা বাজে।আজ তোর জন্য লেট হলো বলে!মিরা পর্যন্ত কল দিয়ে ফেলেছে”

মিরা প্রণয়ের কথা শুনে ঠোট চেপে হাসছে।প্রণয় নামক গম্ভীর ছেলেটা আর সবার সাথে গম্ভীর থাকলেও ওদের সামনে নিজেকে মোটেও গম্ভীর রাখতে পারেনা।আর অরণের কাছেতো সে যেনো এক খোলা বই!

অরণ ঘুমজড়ানো কন্ঠেই বললো,

“তুই বললি আর আমি বিশ্বাস করলাম?মিরাতো এমনি ই তাড়াতাড়ি উঠে।”

প্রণয় অরণের কথায় তোয়াক্কা না করে অরণকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

“মিরা কল দিয়েছে।নে কথা বল।আমি আবার শুচ্ছি।ডাকবিনা খবরদার!যেখানেই যেতে বলুক একা যাবি।আমায় ফাল/তু কোনো কাজে জড়াবিনা”

বলেই শুয়ে পড়লো।

অরণ ঘুমঘুম কন্ঠে ফোন কানে লাগিয়ে বললো,

“হু বল।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিরা বললো,

“না ঘুমিয়ে উঠে পড়।আজ তাড়াতাড়ি কলেজ যাবো”

অরণের জবাব না পেয়ে আবারও মিরা বললো,

“এই শুনছিস?”

“হু..হু..বল”

“উফফো!অরণের বাচ্চা!তুই উঠবি নাকি আমি প্রণয়ের বাসায় আসবো?”

অরণ আ!ৎকে উঠে বলে,

“বাঘিনীর মতো গ!র্জাচ্ছিস ক্যান ভাই?তুই কেন প্রণয়ের বাসায় আসবি।আমি ই আসছি বল কোথায় আসবো”

“তার মানে তুই আবারও ঘুমাচ্ছিলি?”

“হ্যা…না মানে ঐ আসলে”

“মানে টানে রাখ।শোন কাল চাঁদের সাথে দেখা হয়নি আমার।আজ যাবো আর তুইও যাবি আমার সাথে বুঝেছিস?”

“হ্যা যাবো।কখন যাবি?”

“আজ আগেই যাবো।আমি রেডি হচ্ছি।মিরকেও ঘুম থেকে তুলে রেডি হতে বলে এসেছি।ওরও নাকি চাঁদকে ভালো লেগেছে কথা বলবে”

“কিহ!মির আবার চাঁদের দিকে নজ…”

“ধুর না।ওসব না।মেয়েটাকে নাকি ইন্টারেস্টিং লেগেছে।তাছাড়া মিরতো চাঁদকে মামি ডেকে অস্থির!”

হাসতে হাসতেই বললো মিরা।অরণও হেসে কিছু বলতে নিয়েছিলো হঠাৎ পাশে থাকা প্রণয়ের দিকে চোখ পড়তেই ভাবে প্রণয়ের সামনে এসব না বলাই ভালো।তাই অরণ মিরাকে বলে,

“আচ্ছা আমি রাখছি।বের হয়ে তোকে কল দেবো”

চাঁদ রেডি হয়ে নাস্তা খেতে বসতেই তার মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আজ কি কলেজ তাড়াতাড়ি ই যাবি?আর তোর টিউশন?”

পরোটা চিবুতে চিবুতে চাঁদ বললো,

“আম…আরে আম্মু তেমন কিছুই…ইম….না টিউশন থেকে বাসা…আম…”

“আগে খেয়ে নে পরে কথা বল”

“হিম”

মুখের খাবার শেষ করে চাঁদ বললো,

“আমি ভেবেছি কি একবারে টিউশন থেকেই কলেজ চলে যাবো।বাসায় এসে আবার রেডি হয়ে তারপর যাওয়া একটু কষ্টসাধ্যই বৈকি!”

“হ্যা তোর যেভাবে সুবিধা ওভাবেই যা আর ধীরে সুস্থে খা”

মিরা আর মির রাস্তায় আসতেই মিরার ফোনে অরণের কল আসে।মিরা রিসিভ করেই বলে,

“বের হয়েছিস?”

“হ্যা মাত্রই হলাম।তোরা?”

“রিক্সাই নিচ্ছিলাম”

“ক্যাম্পাসে দাড়াবো?”

“না।গেটের সামনে দাড়াস”

“ঠিক আছে তোরা আয়।আর বাকিদের বলেছিস?”

“বাকিরা মনে হয়না ইন্টারেস্টেড আর ওদের ইচ্ছা হলে নিজেরাই বুঝে নেবে।তুই আয় জলদি”

“আচ্ছা সাবধানে আসিস”

মিরা হেসে বললো,

“মির আছে আমার সাথে”

“তাও”

“আচ্ছা তুইও সাবধানে আসিস”

বলেই মিরা কল কাটতে নেবে এমন সময় অরণ বলে,

“এই শোন”

“হ্যা বল”

“না থাক”

“আরে বল”

“দেখা হলেই বলবো।রাখছি।দেখে শুনে আসিস”

চাঁদ প্রায় মিনিট দশেক হেটে তার স্টুডেন্টের বাসার সামনে আসলো।যেইনা গেট দিয়ে ঢুকবে ওমনি ওপাশ থেকেও কেউ একজন বের হলো।দুজনের ধাক্কা লাগতে লাগতে বেচেছে মাত্রই!ছেলেটা মোবাইল কানে রেখেই বললো,

“সরি সরি।আসলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না তাই বাইরে আসছিলাম।আপনার লাগেনি তো?”

বলেই তাকালো চাঁদের দিকে।চাঁদ কিছু বলার পূর্বেই ফোনের রিংটোন বাজতেই দেখলো এ বাড়ি থেকেই ফোন আসছে।তবুও সে ধরলো।ধরে বললো,

“এক্সট্রিমলি সরি আন্টি।আসলে আজ একটু লেট হয়ে গেছি।আমি আপনাদের গেটের সামনেই আছি।আসছি এক্ষুনি”

ছেলেটা ভ্রু কুচকে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আপনি?”

চাঁদও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,

“আপনি?”

“আপনি কি মেহুর টিউটর?”

“আ…জ্বি।আপনি কে?আর ফোনটা?”

“এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম!আসলে আম্মু বললো আপনাকে যেনো কল করে বলি আসছেন না কেনো।আম্মু গোসল করছিলোতো।তাই ফোনটা আমি ই”

“আমিও সরি ভাইয়া চিনতে পারিনি।আসলে আপনাকে কখনো দেখিনিতো!তবে আই গেস আপনি মাহির ভাইয়া?”

“হ্যা”

“আর প্লিজ এভাবে ম্যাম বলে অপমানিত করবেন না।হয়তো আমি মেহুর টিচার ঠিকই বাট আপনার ছোটই।আপনি আমার এক ব্যাচ সিনিয়র”

“ইউ মিন তুমি…সরি আপনি ফার্স্ট ইয়ার?”

“জ্বি ভাইয়া”

“মেহুর মুখে অনেক শুনেছি আপনার নামে।চাঁদ আপু এই চাঁদ আপু সেই।আমিও আপুর মতো ডক্টর হবো আরও কতো কি!তো আপনি ই মেহুর চাঁদ আপু?”

“জ্বি ভাইয়া”

“আসলে আমিও চিনতে পারিনি।আপনাকে দেখেছি ই দু’বার।সম্ভবত বোরকাতে।তাই আরকি”

“সমস্যা না ভাইয়া।আসলে গতকাল থেকে ক্লাস শুরু হয়েছেতো তাই এখান থেকে ডিরেক্ট কলেজ যাবো।এজন্যই আরকি মানে”

“বুঝেছি।চলুন আপনার স্টুডেন্ট আবার চাঁদ আপু আসছেনা কেনো করে করে পা!গল হয়ে যাচ্ছে”

চাঁদ হেসে দিলো এ কথায়।হাসলো মাহিরও।দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।চাঁদ মেহেরুনের রুমে আসতেই মেহেরুন সেদিকে তাকিয়ে বললো,

“আপনি কে?চেনা চেনা লাগছে”

পেছন থেকে মাহির এসে বললো,

“নিজের চাঁদ আপুকে চিনতে পারিস না আবার বড় বড় কথা বলিস যে তার মতো নাকি ডাক্তার হবি?ধি!ক্কার ধি!ক্কার!”

“কি!‌!‌!”

মেহেরুনের চেচানোতে কান চেপে ধরে চেয়ারে বসতে বসতে চাঁদ বললো,

“আস্তে মেহু আস্তে।তুমিতো জানোই চুলে জট লাগলে সহজে ছাড়াতে পারিনা।বলেছিলাম না তোমায়?আমার চুল একটু বড়?তাই আরকি।এজন্যই দেরি হয়েছে।আজ ক্লাসে যেতে হবে একটু তাড়াতাড়ি ই।কি যেনো আছে।স্যার বলছিলেন সবাইকে জলদি যেতে স্পেশালি আমাকে।জানোইতো ক্যাপ্টেনদের জ্বালা বেশি?তাই একটু কম পড়াবো কেমন সোনা?”

মেহেরুন বললো,

“হ্যা হ্যা জানি আপু।সমস্যা নেই।তোমার কম পড়ানো মানেই অনেক।এই আপু দাড়াও না”

“কেনো?”

“প্লিজ?”

“আচ্ছা”

চাঁদ দাড়াতেই মেহেরুন চাঁদের পেছনে এসে চাঁদের হিজাবের নিচ দিয়ে চোখ বুলিয়ে হতাশ হয়ে বললো,

“চুলতো খোপা করা আপু।দেখবো কি করে?”

চাঁদ হেসে বললো,

“আমার চুল দেখার জন্য এতো ব্যাকুল?”

“হ্যা আপু।তোমার আইডিতে তোমার আগের অনেক ছবি দেখেছি ইশ কি সুন্দর চুল!সেটা সচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছা”

“অবশ্যই দেখাবো।একদিন আমার বাসায় যেয়ো গেলেই দেখতে পাবে।বাইরে সবসময় হিজাব পরি জানোইতো”

“হ্যা আপু।তোমাকে পুরোই পাকিস্তানি হিরোইনদের মতো লাগছে।ওদের মধ্যে একটু বিদেশী ভাব আর তোমার মধ্যে বাঙালীয়ানা।তবুও কি মিষ্টি!কালও কি এভাবেই গিয়েছিলে?”

“হ্যা।কিন্তু গতকাল লাল আর কালো পরেছিলাম”

“আজও তো লাল আর কালোই পরেছো”

“না।আজ কালো আর লাল পরেছি”

“ঐ একই তো?”

“না।বোঝোনি তুমি।আজ জামা পরেছি কালো,পায়জামা-ওড়না লাল।আর কাল জামা পরেছিলাম লাল,পায়জামা-ওড়না কালো।”

“অন্য ড্রেস নেই?”

“আছেতো”

“অন্যটা পরতে”

“কেনো?এটায় খারাপ লাগছে?”

“হুর!অসম্ভব সুন্দর লাগছে।এজন্যইতো অন্যটা পরতে বলছি যাতে কেউ নজর না দেয়।আচ্ছা কাল কয়টা প্রপোজাল পেয়েছো বলোনা?আজও নিশ্চয়ই পাবে!”

“ছেলেদের সামনে যাইনা বোকা”

বলেই মেহেরুনের মাথায় টোকা মেরে হাত টেনে চেয়ারে বসিয়ে আবারও বললো,

“অনেক হয়েছে গল্প এবার পড়তে বসো।পরশু অনেক গল্প করবো কেমন?”

মেহেরুন মাথা নেড়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তার ভাই এখনো দাঁড়িয়ে আছে।তা দেখে সে বলে,

“এখানে কী?যাও, তোমার রুমে যাও।আমার আপু এখন আমায় পড়াবে”

মাহির অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

“ওহ সরি মিস চাঁদ”

কথাটা চাঁদের কর্ণপাত হতেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে যাচ্ছে যা কোনোক্রমেই সে চায়না।তাই অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করলো মস্তিষ্কে।তবে কোনো লাভ হলোনা। ফলাফল শূণ্যের কোঠায় ই রয়ে গেলো।এতো দ্রুতগতিতে মাহিরের বাক্যটিকে মস্তিষ্ক ধারণ করলো যে মস্তিষ্কের নিউরণগুলো এক সেকেন্ডেরও পূর্বে সেখান থেকে স্নায়ু উদ্দীপনা নিয়ে পূর্ববতী কিছু জিনিস মেলাতে চেষ্টা করলো।অতঃপর সফলও হলো।দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠলো সেই বিড়ালাক্ষী মানবের নেত্রদ্বয়।এমন দৃশ্য দেখতেই আ!টকে আসতে লাগলো চাঁদের নিশ্বাস!বন্ধ হলো আখিজোড়া।মস্তিষ্ক অ!সাড় হচ্ছে যেনো!কপালের রগ ফুলে উঠলো।হাত দুটো হলো মুষ্টিবদ্ধ।রাগ যেনো তরতর করে বাড়ছে তার!

To be continued…

#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম

১৬.
কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত নগরীতে একটুখানি স্বস্তি খোজা মানে অযথাই সময় অপচয়ের অন্যতম মাধ্যম।রাস্তাঘাটে বের হলে যেনো মনে হবে,এর চাইতে বাসায় বসে ঘুমিয়ে সময় অপচয় করাও ঢের!ঘুমালে তাও মস্তিষ্ক ঠান্ডা থাকে কিন্তু রাস্তায় বের হলে বোঝা যায় মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে টগব!গিয়ে ব!লকা!য়!একেতো মানুষের ভিড় সেইসাথে যানবাহনের ব্যস্ততা,তার উপর মাথার উপর অবস্থিত সূর্যের প্রকোপ তাপ!এমতাবস্থায় চাঁদের মেজাজ ধীরে ধীরে বি!গড়ে যাচ্ছে।সে কেবলই হাটার চেষ্টা করছে।কিন্তু আশেপাশের মানুষদের জন্য হাটতে পারছেনা বলে বড্ড বিরক্ত হচ্ছে।তার মনে হচ্ছে এর তুলনায় কচ্ছপও বোধহয় দ্রুতগতিতে হাটে!আশেপাশের মানুষগুলো কচ্ছপের গতিতে হাটছে নাকি সে নিজেই খরগোশের গতিতে হাটছে বুঝার চেষ্টায় মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখতে মগ্ন চাঁদ।কারণ একটাই,তার মেজাজ হুটহাট ই বিগড়ে যায়।সে চাচ্ছেনা মেজাজ বি!গড়াক।কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হলোনা।পেছন থেকে এক লোক চাঁদের কোমড় স্পর্শ করার চেষ্টা করছে।অনেকক্ষণ যাবৎ ই চাঁদ সেটা অনুভব করছিলো। এবং!অবশেষে!অবশেষে মেজাজ তার বি!গড়েই গেলো!আগুনে সেই লোকটা যেনো ঘি ঢেলে দিলো।লোকটার হাত মো!চড়িয়ে তারই পিঠের দিকে নিয়ে আসতেই লোকটা ‘ওমাগো!’ বলে চে!চিয়ে উঠলো।লোকটার চেচানোতে চাঁদ পৈ!শাচিক আনন্দ পেলো যেনো!তার মস্তিষ্ক তার মনকে আরেকটু আনন্দ দিতে চাচ্ছে।তাইতো চাঁদ লোকটার হাত আরেকটু জোরে চে!পে ধরেই বললো,

“এখন মায়ের কথা মনে পড়েছে না?আগে মনে পড়লোনা যে আপনি একজন মায়ের গর্ভ থেকে জন্মেছেন?একজন স্ত্রীকে নিজের সহধর্মিণী করেছেন অথবা করবেন?একটা কন্যা সন্তানকে জন্ম দেবেন?একজন বোনের নিজস্ব রক্ষক আপনি?আরে ভাই!একজন রক্ষক ই যদি ভক্ষক হয় তবে সমাজটা র!সাত!লে যাবে কিনা?”

একজন লোক এসে চাঁদকে বললো,

“কি হয়েছে বোন?”

চাঁদ হেসে বললো,

“এখন বোন বলছেন?তখন চোখদুটো কি আসমানে ছিলো?যখন আপনার ই পাশের লোকটা বারবার একটা মেয়ের আপ!ত্তি!কর স্থানে হাত দেয়ার চেষ্টায় মত্ত ছিলো?তখন কেনো এসে লোকটার হাত দু!মড়ে-মুচ!ড়ে দিয়ে বললেন না?’কি হয়েছে ভাই?বাসায় কি বউ নাই?না থাকলে বাবা-মাকে বলে বিয়ে করে কাম!না বাস!না পূর্ণ করুন!”

শেষের কথাটা তীব্র রাগ নিয়েই বললো চাঁদ।সকলের মুখ বন্ধ হলো যেনো এ কথায়।চাঁদ সেই লোকটার হাত ছেড়ে দিয়ে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার চোখ বরাবর তর্জনী নিয়ে বলতে লাগলো,

“আর আপনি!কোথা থেকে আপনার উৎপত্তি আশা করছি ভুলে যাননি।ভুলার চেষ্টাও কখনো করবেন না।যদি ভুলে যানও আজকের এই দিনটার কথা মনে রাখবেন।মনে রাখবেন সাদা এপ্রোণ গায়ে একটা মেডিকেলে পড়ুয়া মেয়ে আপনার অস্তিত্ব কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে!কখনোই মেয়েদেরকে অস!ম্মান করার উদ্দেশ্য মনে আনবেন না।মনে রাখবেন,যে যেমন কর্ম করে সে তেমন ফল ই পায়।আপনি কোনো মায়ের সন্তান।কোনো স্ত্রীর স্বামী।কোনো বোনের ভা… আচ্ছা ধরলাম নাহয়,যে আপনার কোনো বোন ই নেই।তবে একদিন একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান ঘর আলোকিত করে আসতেও তো পারে?কেমন লাগবে যখন আপনার শরীরের ই অংশ,র*ক্ত মাংস পানি করে যাকে তিলতিল করে বড় করে তুলেছেন সে এসে বলবে ‘বা…বাবা আজ একটা বাজে লো…লোক আমায়!”

লোকটার চোখে পানি টলমল করছে।মাথা নিচু করে কাপা কাপা কন্ঠে সে বললো,

“চুপ করো মা চু….উপ করো!”

চাঁদ লোকটার কথা শুনে বললো,

“নিজের মেয়ের কথা ভেবে লোম দাঁ!ড়িয়ে গেলো নিশ্চয়ই?তাহলে ভাবুন আপনার সামনে যেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সেও তো কোনো না কোনো বাবার আদুরে মেয়ে?এই মেয়েটা কি করে তার বাবার কাছে গিয়ে বলবে ‘আব্বু আমাকে এক লোক….”

চাঁদকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা মাথা নিচু করেই হাত জোর করে বলে,

“আমারে মাফ করো মা মাফ করো!বড্ড ভুল হয়ে গেছে আমার”

চাঁদ এবার শান্ত হয়ে লোকটার হাতদুটো এক হাতে ধরে অপর হাত দিয়ে লোকটার নিচু মাথা উচু করে বললো,

“কোনো মেয়েই পছন্দ করবেনা কোনো বাবার মাথা নিচু হওয়া বা হাত জোর করা।আর আপনি কাদবেন না বাবা।”

“তুমি আমারে বাবা বললা?”

“হ্যা বললাম।আপনি আমায় মা বলে সম্মান দিতে পারলে আমি কেনো পারবোনা?”

“মা… মাগো!আমারে তুমি.. ”

“না বাবা।এবার আপনার এই মেয়েকে একটা ওয়াদা করুন”

“কী মা?”

“যে আপনি আজকের পর থেকে কোনো মেয়েকে অস!ম্মান করবেন না আর অসম্মানিত হতে দেখলে তার প্রতিবাদ করবেন।আর আমার মতোই অন্য আরেকজন পুরুষ অথবা মহিলা থেকে ওয়াদা নেবেন সেও যেনো এরূপ ওয়াদা করে এবং সেও যেনো কারো না কারো থেকে এরূপ ওয়াদা নেয়।বলুন করবেন?”

“ওয়াদা করলাম মা”

বলেই সবার উদ্দেশ্যে লোকটা বললেন,

“যারা যারা আমারে শুনতাছেন।আমার এই মেয়েটার কথা শুনতাছেন।ভাই-বোনেরা আপনারাও নিজেই নিজেরে ওয়াদা করেন আজকে থেকে আমরা নারীসমাজের রক্ষক হবো আর এমনিভাবে অন্যদের রক্ষক হওয়ার জন্য আহ্বান জানাবো।পারবোনা?”

সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

“পারবো!”

চাঁদ তৃপ্তির হাসি হাসলো।হেসে বললো,

“একজনের দৃষ্টিভঙ্গিও যদি আমি বদলাতে সক্ষম হই তাতেই আমার অনেক বড় পাওয়া।একজন একজন করেই গড়ে উঠবে গোটা সমাজ।এক পর্যায়ে পুরো ধরণী!”

সবাই চাঁদের জন্য হাততালিতে মেতে উঠলো।একজন লোক জিজ্ঞেস করলেন,

“মা তোমার নাম কী?আর কোন ইয়ারে পড়ো তুমি?”

“নামটা নাহয় অজানাই থাক আংকেল?আমি এম.বি.বি.এস প্রথম বর্ষের ছাত্রী আংকেল”

“এপ্রোণ দেখে ঢাকা মেডিকেলের লাগছে?”

“জ্বি আংকেল ঢাকা মেডিকেল ই।আজ আসি ধন্যবাদ সকলকে”

বলেই হাটা ধরলো সামনের দিকে।কোলাহলপূর্ণ এলাকা পার করে হাইওয়েতে এসে কল দিলো ইপ্সিকে।সাথে সাথেই ইপ্সি কল রিসিভ করে বললো,

“কোথায় তুই?আজই না তোকে জলদি যেতে হবে?দেরি করলি কোথায়?”

“আস্তে ভাই আস্তে!একটা একটা করে বল।দেরি হয়েছে কেনো সেটা দেখা হলেই বলছি।বিরাট লম্বা কাহিনী!তুই কোথায় সেটা বল?হাইওয়ের আশেপাশেও তোকে দেখছিনা আমি।অলরেডি ন’টা পাঁচ বেজে গেছে”

“নিজে যখন দেরি করলি তখন কিছুনা না?”

“তোকে কি আমি কিছু বলেছি?যেখানেই আছিস আয় আমি রিক্সা দেখছি”

“এখনই নিস না।আমরা আসছি”

“আমরা মানে?”

“মানে আমি আর অবু”

“অবনী তোকে পেলো কোথায়?”

“হাইওয়েতে তোর জন্য ওয়েট করছিলাম।অবু রিক্সা দিয়েই যাচ্ছিলো।আমাকে দেখে হুট করেই নেমে যায়।রিক্সা ভাড়া দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে তাড়িয়ে সে পণ করেছে আমাদের সাথেই যাবে।তখন থেকে দাড়াতে দাড়াতে গরমে সে!দ্ধ হচ্ছিলাম।ভাইরে এমন সকালবেলা এতো রোদ কি করে উঠতে পারে মগজে ঢুকেনা চু*ল!”

“আমার কাহিনী শুনলে শুধু চু*ল কেনো?বড় চুল,লম্বা চুল,কালো চুল,গোল্ডেন চুল,নাগিন চুল সব চু*লের গোষ্ঠী উ!দ্ধার করে ফেলবি বোইন!জলদি এসে আমাকে উ!দ্ধার কর প্লিজ!”

বলতে না বলতেই পেছন থেকে এসে অবনী চাঁদকে বলে,

“টানটাডা!এসে পড়েছি।উদ্ধারও করে ফেলেছি বল এবার আমাদের কী দিবি?”

“তোমাকে দেয়ার মতো তেমন কিছুই নেই তবে হ্যা একটা উপদেশ দিতে পারি”

“তার আগে এটা নে।যেই গরম বাপরে!আমরা আইসক্রিম খেতেই গিয়েছিলাম।ভাবলাম তোর জন্যও নিয়ে আসি”

বলেই অবনী চাঁদের দিকে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিতেই চাঁদ ইতস্তত করছে দেখে অবনী বলে,

“এতো কিসের ফর্মালিটি ভাই?আমরা ফ্রেন্ড না?একদিন আমি খাওয়াবো একদিন তুই।সময়তে পুরো ট্রিটই তোর থেকে নেবো।এটাইতো বন্ধুত্ব তাইনা রে ইপ্সু?”

ইপ্সি আইসক্রিম খেতে খেতে বললো,

“ইমম….হিম ওটাই”

চাঁদ আইসক্রিমটা ছো মেড়ে নিয়ে খেতে খেতে বললো,

“থ্যাংক ইউ সো মাচ অবু!এটারই দরকার ছিলো।বাই দ্যা ওয়ে তুমি জানলে কি করে এই কোণ আমি স্ট্রবেরী,অরেঞ্জ আর চকোলেট মিক্সড টা পছন্দ করি?”

অবনী চাঁদের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

“তুই আমায় থ্যাংক্স কেনো বলছিস?একটু আগেই না বললাম নো ফর্মালিটি?আর কি তুমি তুমি করছিস।কালই না সবার সামনে মাইকে তুই করে বললি?”

গতকালকের কথা মনে করে গম্ভীরভাবে চাঁদ বললো,

“তখন আরকি এমনি বলে ফেলেছিলাম”

“এখনও এমনি ই বলে ফেলুন ম্যাডাম!”

“চেষ্টা করবো।আসলে আমি সহজে আরকি মানে…”

“সবার সাথে সহজ হতে পারিস না তাইতো?ইপ্সু আমায় বলেছে।আর তোর কোণের এই ফেভারিট ফ্লেভারের কথাও ও ই আমায় বলেছে”

ইপ্সি আইসক্রিম শেষ করে বললো,

“এখন তোদের লেট হচ্ছেনা?”

অবনী ইপ্সির মাথায় চা!টি মেরে বললো,

“ওরে চা*ন্দু!নিজের টা সুযোগ বুঝে শেষ করে এখন ঢং করা হচ্ছে না?”

চাঁদ হেসে বললো,

“আমার তরফ থেকেও দুটো লাগিয়ে দিলে মন্দ হবেনা কি বলিস?”

অবনী বললো,

“যো হুকুম মেরে আকা!”

বলেই আরও দুটো দিতেই তিনজনের মধ্যে খুনশুটি লেগে গেলো যেনো!

মিরা আর মির কলেজ গেটের সামনে আসতেই মিরার চোখ যায় গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়তে ব্যস্ত অরণের দিকে।মির রিক্সা ভাড়া দিতে দিতে মিরাকে বললো,

“সামনে গিয়েও দেখতে পারবি।এখন নাম”

মিরা রিক্সা থেকে নেমে মিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই মির বললো,

“কি হয়েছে?গি!লে ফেলবি নাকি?চোখ পা!কাচ্ছিস কেনো?”

“বেশি চু*ল পাকনামি না করলে পেটের ভাত হজম হয়না না?”

“তোর সাথে ঝগ!ড়ার মুড আপাতত আমার নেই।যে কাজের জন্য এসেছি ঐটা নিয়েই ভাবতে চাই বুঝেছিস?”

“ঐদিকেও যে তুমি তোমার বাম হাত ঢুকিয়ে চু*ল পাকনামি করবানা তার কি গ্যারান্টি?”

“দেখ মিরা… ”

“মিরা আপু”

“রাখ তোর আপু!আমি শুধু আমার চাঁদমামিকে নিয়েই ভাবতে চাই বুঝছিস?”

অরণ মিরের কাধে হাত রেখে বললো,

“তোরা আবারও লেগে গেছিস?আর কি নিয়ে ভাবতে চাস?”

মির অরণের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুই তোর এই ডা*কিনীকে বুঝা প্লিজ!জীবনটা জাস্ট তেজপাতা করে রেখেছে!”

মিরা বললো,

“সেই তেজপাতা দিয়ে আদা-চা করে খেয়ে ফেলে আমায় ধন্য করুন জাহাপনা!আর তুই?তোকে জীবনেও আমি টেক্সট বুক অর পড়া রিলেটেড বই ছাড়া অন্য বই পড়তে দেখিনি।কিসের বই পড়ছিলি তুই?”

“কিই….ইসের বই মানে?”

“তোতলাবি না বলে দিলাম!”

“ঐ আরকি এমনি বই।তোরা বল চাঁদকে নিয়ে কী করলি?আর তুই নাকি ওকে মামি ডেকে অস্থির?কোন মামার সাথে জুড়িয়েছিস আবার?”

মির ভ্রু কুচকে বললো,

“আমার মামা কয়টা?”

“কয়টা আবার?”

“বে!ক্কল কোথাকার!তুই,রবিন আর প্রণয় বাদে আর মামা আছে কয়টা?তুইতো ভুলেও এগুলায় নেই আর রবিনেরও গার্লফ্রেন্ড আছে।তো বাকি কে রইলো?”

“তুই আর প্রণয়?”

মির মেজাজ খারাপ করে বললো,

“তুই বই না পড়ে বইয়ের পাতাগুলো গুলিয়ে পানি দিয়ে খেয়ে ফেলতে পারিস না?আমার যদি ওকে ভালোই লাগতো মামি বলতাম নাকি আজব!ভালো লাগেনি এমন না।তবে সেটা লেগেছে মামি হিসেবে।শি ইজ পার্ফেক্ট ফর মাই গম্ভীর মামা”

“ইউ মিন?”

“ইয়েস!প্রণয় মামার চাঁদ মামি।দেখনা সবার থাকে চাঁদমামা।আর আমাদের গ্যাং এর হবে চাঁদমামি আর প্রণয়ের চাঁদ বউ।ইন্টারেস্টিং না?”

মিরের কথা শুনে অরণ আর মিরা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বিরক্তির সুরে একসাথেই বললো,

“ভেরি ইন্টারেস্টিং!”

To be continued….