আমার একলা আকাশ পর্ব-০৫+০৬

0
297

#আমার একলা আকাশ
#পর্ব-০৫+০৬
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
সুমনা বেগম চা-নাস্তা এনে সামনে রেখে নিজেও অপজিট সোফায় বসলেন। তার ঠিক পেছনে ক্রুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদনান।

‘নিন, নাস্তা করুন।’ সবার উদ্দেশ্যেই বললেন সুমনা বেগম।

রায়হানের বাবা বললেন,’নাস্তা তো করবই। এরপর থেকে তো সম্পর্ক আরো গভীর হবে আমাদের দুই পরিবারের।’

‘ঠিক বুঝলাম না ভাই।’ বললেন সুমনা বেগম।

রায়হানের মা এবার হেসে বললেন,’বুঝেননি বোন? আপনার মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নিতে এসেছি।’

সুমনা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। স্বল্প সময়ের জন্য কথা বলার ভাষাও যেন তার লোপ পেয়েছিল। তিনি কিছু বলার পূর্বেই রায়হানের মা বললেন,

‘তাছাড়া ছেলে-মেয়ে দুজনই যখন দুজনকে পছন্দ করে আর ভালোবাসে তখন শুভ কাজে দেরি করে লাভ কী বলেন?’

এই পর্যায়ে আদনান আর কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারল না। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। কাঠকাঠ গলায় সে উত্তর দেয়,

‘আপনার একটু ভুল হচ্ছে আন্টি।সম্পর্ক ছিল। এখন আর নেই।’

রায়হানের বাবা-মায়ের দুজনেরই হাসি হাসি মুখটা অন্ধকার হয়ে আসে।

‘এই ছেলে কে?’ গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন রায়হানের বাবা।

সুমনা বেগম পড়েছেন মাঝ সমুদ্রে। মনে হচ্ছে সবটাই কী রকম মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। রায়হানের সাথে প্রাপ্তির সম্পর্ক আছে, অথচ তিনি জানেন না! এমনকি টেরও পায়নি। এদিকে আদনানের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ও সবটা জানত। জানুক, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। ঘরে মেয়ে থাকলে বিয়ের প্রস্তাব আসবেই; মেয়ের কোনো সম্পর্ক থাকলেও আসবে, না থাকলেও আসবে। তবে মাঝখানে আদনানের হুট করে বলা কথাটি সুমনা বেগমের মনঃপুত হলো না ঠিক। না জানি, সামনের মানুষগুলো কী না কী ভেবে বসে আছে।

সুমনা বেগম একটু হাসার চেষ্টা করলেন। সহজ-স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,’আমার ভাগিনা।’

রায়হান তখন আদনানের কথার উত্তর দিতে গিয়ে একটু হেসেই বলল,’জি, একটু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে আমাদের মধ্যে। সব সম্পর্কেই তো ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া হয়। তাই বলে কি সম্পর্ক শেষ? প্রাপ্তি আমার ওপর অনেক রেগে আছে জানি। তাই আমি চাচ্ছি রিলেশনের ইতি ঘটুক বিয়ের মাধ্যমে।’

হুট করে এমন সিচুয়েশনে পড়ায় সুমনা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। রায়হানের সাথে প্রাপ্তির সম্পর্ক ছিল এটা যদি একবার ওর বাবার কানে যায় তাহলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে যাবে। মানুষটা এমনিতে ভীষণ ভালো। একমাত্র সন্তান এবং একমাত্র মেয়ে হওয়ায় প্রাপ্তিকে তিনি মাথায় তুলে রাখেন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ভালোবাসেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি মেয়েকে দিয়েছেন। তার মানে তো এই নয় যে, প্রাপ্তির রিলেশন তিনি মেনে নেবেন। তিনি সর্বদাই প্রেম-ভালোবাসার বিরুদ্ধে। কস্মিনকালেও সে প্রেমকে পছন্দ করেন না। সমর্থন করেন না। সেখানে প্রাপ্তি এমন একটা কাজ কী করে করল!

‘আপনি কিছু বলছেন না কেন আন্টি? প্রাপ্তিকে আমায় দেবেন না?’ সুমনা বেগমের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়হান।

আদনান ক্ষিপ্রকণ্ঠে বলে উঠল,’কখনোই না। প্রাপ্তি তোমার মতো চরিত্রহীন কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না।’

এরপর সে রায়হানের বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’আঙ্কেল, আন্টি মাফ করবেন। চা, নাস্তা খেয়ে অন্যান্য কথা থাকলে বলতে পারেন। নতুবা আসতে পারেন আপনারা। অপরাধ নেবেন না দয়া করে।’

রায়হানের মা রাগান্বিত স্বরে বলেন,’তুমি কে আমার ছেলের চরিত্র নিয়ে কথা বলার?’

‘আমি কেউ না। তবে যেটা সত্যি সেটাই বলেছি।’

সুমনা বেগম আদনানকে ধমক দিয়ে বললেন,’আহ্! আদনান, তুই কী শুরু করেছিস এসব?’

‘আন্টি তুমি জানো না এই ছেলের উদ্দেশ্য কত্ত খারাপ! আমি বলতে পারছি না তোমায়।’

‘বলতে পারছ না বললে তো হবে না। বলতেই হবে। আমার ছেলেকে ব্লেইম দেওয়ার সাহস হয় কী করে।’ বললেন রায়হানের বাবা।

রায়হান বিষয়টাকে ধামাচাপা বা আটকানোর চেষ্টা করেও পারল না। ওর বাবা-মা দুজনেই ক্ষেপে গেছেন। বাবা চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই বললেন,

‘এখানে যেচে অপমানিত হতে আসিনি আমরা। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের বংশ, টাকা-পয়সা কীসের কমতি আছে? কিচ্ছুর নেই। আমার ছেলে দেখতে, শুনতে মাশ-আল্লাহ্। শিক্ষিত। এমন ছেলের জন্য, এমন পরিবারের ছেলের জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে বলে ধারণা? বরঞ্চ আপনাদের মেয়ের চেয়েও বেটার বেটার মেয়ে রয়েছে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে শুধুমাত্র ছেলের পছন্দ বলে এই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। সেখানে আপনার ভাগিনা, না কে সে আমাদের এভাবে অপমান করছে!’

আদনান বেশ শান্ত হয়েই বলল,’সত্যি কথা সবসময় একটু তেতোই হয় আঙ্কেল। তাছাড়া আমি যথেষ্ট ভদ্রভাবে, সুন্দর করে কথা বলেছি। তবুও আপনি যখন এতগুলো কথা বললেন। বংশের, টাকার, ছেলের এত গুনগান গাইলেন তখন সত্যিটা না হয় আমি বলেই দেই। আপনার সব কথাই ঠিক মেনে নিলাম। আপনার ছেলে সুন্দর, শিক্ষিত এগুলোও ঠিক আছে। সমস্যাটা হচ্ছে গিয়ে আপনার ছেলের চরিত্রে। টাকা না থাকলেও ডাল-ভাত খেয়ে সুখে থাকা যায়। কিন্তু চরিত্র খারাপ হলে ইহকাল, পরকাল দুটোই জাহান্নাম হয়ে যায়। আপনার ছেলের চরিত্র এতই ভালো যে, যাকে সে ভালোবাসি বলে দাবি করছে, যাকে সে বিয়ে করবে বলে এই বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে…সেই তাকেই আপনার ছেলে তার জন্মদিন উপলক্ষে একদিনের জন্য চেয়েছে। যেমন-তেমনভাবে চায়নি। ফিজিক্যালি ইন্টিমেট হতে চেয়েছে। এটাকে আপনি ভালোবাসা বলবেন? একটা মেয়ে একটা ছেলেকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসলে কী চায় জানেন? সম্মান আর শ্রদ্ধা। কিন্তু আফসোস! প্রাপ্তি এমন এক ছেলেকে ভালোবাসলো যে সম্মান তো দেবে দূরের কথা; উলটো বিয়ের আগেই ইন্টিমেট হতে চেয়েছে।
আপনাদের সামনে আমার মুখে এসব কথা হয়তো শুনতে বড্ড তিতকুটে লাগছে। কিন্তু আ’ম স্যরি টু সে, আপনাদের এবং প্রাপ্তির পরিবারের জানা উচিত কেমন ছেলে এসেছে প্রাপ্তিকে বিয়ে করতে।’

কথাগুলো শুনে রায়হানের বাবা-মা দুজনেই বিস্মিত হয়ে রায়হানের দিকে তাকায়। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রেখেছে রায়হান। সুমনা বেগম স্তব্ধ। বাসার কলিংবেলের শব্দ সকলেই একটু নড়েচড়ে বসে। আদনান গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সেতু এসেছে। আদনানের রাগান্বিত চোখ-মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে? রেগে আছো কেন?’

আদনান কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে আসে। সেতুও পিছু পিছু আসে। আর এসে উপস্থিত রায়হান ও ওর বাবা-মাকে দেখে বেশ অবাকই হয়। অস্ফুটস্বরে রায়হানের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,

‘তুই এই বাড়িতে!’

‘রায়হান আর প্রাপ্তির যে সম্পর্ক ছিল এটা জানতিস তুই?’ প্রশ্নটি করে থমথমে দৃষ্টিতে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুমনা বেগম।

সেতু থতমত খেয়ে একবার সুমনার দিকে, আরেকবার আদনানের দিকে তাকায়। রায়হানের বাবা-মা উঠে পড়ে তখন। কোনো কিছু না বলেই দুজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রায়হানও বিনাবাক্যে উঠে পড়ে। আদনান ওর সঙ্গে যায়। বাড়ির বাইরে গিয়ে হাত টেনে ধরে মুখোমুখি দাঁড়ায়। শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলে,

‘মানুষের খারাপ হওয়ারও একটা লিমিট থাকে। কিন্তু তুমি লিমিটলেস! উদ্দেশ্য সফল হয়নি বলে ডিরেক্ট বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছ? কারণ তুমি তো ভালো করেই জানো, ঐ ঘটনার পর প্রাপ্তি আর কখনোই তোমার কাছে ফিরে যাবে না। ওর দেওয়া জবাবগুলোও নিশ্চয়ই তোমার ইগোতে লেগেছে? আর তাই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য হোক কিংবা রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য হোক; গুটি হিসেবে বিয়ে নামক সম্পর্কটাকে বেছে নিয়েছ। আমি কি ঠিক বলছি?’

আদনানের হাত সরিয়ে দিয়ে রায়হান বলল,’সবকিছুতে তুমি কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছ বলো তো? ভালোবাসো তুমি প্রাপ্তিকে?’

আদনান বাঁকা হাসে। বলে,’তুমি এবং তোমার উদ্দেশ্য সৎ হলে কখনোই আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াতাম না। কোনো অসৎ দৃষ্টি আমি প্রাপ্তির ওপর পড়তে দেবো না। আর হ্যাঁ, ভুলেও আর কোনো নতুন বুদ্ধি আঁটতে যেও না প্রাপ্তিকে পাওয়ার জন্য। তাহলে কিন্তু ফল সত্যিই ভালো হবে না। সেদিন প্রাপ্তি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিল আর আজ আমি দিচ্ছি। আমি আবার অতটাও ভালো মানুষ নই। নেহাৎ-ই বাড়ি বয়ে এসেছ, সঙ্গে আবার তোমার বাবা-মা’ও আছে। মূলত প্রাপ্তির কোনো বদনাম না হোক এজন্যই আজ সুস্থভাবে যেতে দিচ্ছি। পরের বার একই ভুল করলে নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসব।’

‘কাজটা ভালো করলে না। তোমার ধারণাও নেই আমি প্রাপ্তির সাথে ঠিক কী কী করতে পারি।’

‘এক্সাক্টলি! তাই তো আমিও বলি, প্রাপ্তির সাথে খারাপ কিছু করার পূর্বে নিজের বোনের কথাটাও মাথায় রেখো কেমন। আগেই বলেছি, আমি মানুষটা খুব একটা ভালো নই। এখন আসতে পারো।’ বলে আদনান ভেতরে গিয়ে দরজাটা শব্দ করে লাগিয়ে দেয়।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে সেতু সুমনা বেগমের পায়ের কাছে বসে কান্নাকাটি করছে। সুমনা বেগমের চোখেও পানি। আদনান কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,

‘কান্নাকাটি কোরো না আন্টি। ভালোবাসা কখন কার প্রতি হয়ে যায় কেউ কি এটা বলতে পারে?’

‘তাই বলে তোরা সব জেনেও এভাবে লুকালি আমার থেকে? ও না হয় ভয়ে বলেনি। কিন্তু তোরা কেন আমাকে জানাসনি? আজ যদি প্রাপ্তি এই সম্পর্কে অনেক বেশি সিরিয়াস থাকত তাহলে কী হতো? তাহলে তো সেদিন ঠিকই রায়হানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেত।’

‘হয়নি তো! আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে না? আল্লাহ্ ওর সাথে ছিল। মানুষ ভুল করে। প্রাপ্তিও ভুল মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল করে ফেলেছে। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আর প্লিজ, ও বাড়িতে আসার পর ওর সাথে কোনো রকম রাগারাগি কোরো না।’
.
.
দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ধরেছে প্রাপ্তির। আজ রোদের এত বেশি উত্তাপ যে, মনে হচ্ছে মাথা ফেটেই যাবে। তৃধা আর অঙ্কিতা প্রাপ্তিকে নিয়ে গাছের ছায়ায় বসে। টং দোকান থেকে তিনজনে তিন কাপ চা পান করে। প্রাপ্তির কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগবে। কিন্তু এখনো বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনেকটা পথ বাকি। অঙ্কিতা প্রাপ্তির কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘খুব বেশি খারাপ লাগছে দোস্ত?’

প্রাপ্তি দু’হাতে মাথা ধরে বসে আছে। তৃধা গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি কিনে আনে। প্রাপ্তির মাথাটা নিচু করে মাথায় পানি ঠেলে দেয়। ওড়না দিয়ে চুলগুলো দুজনে মুছেও দেয়।

‘এখন কি একটু ভালো লাগছে দোস্ত?’ জিজ্ঞেস করল তৃধা।

প্রাপ্তির একটুও ভালো লাগছে না। ক্রমশ শরীর যেন দুর্বল হয়ে আসছে। গায়ের তাপমাত্রাও বাড়ছে। মনে হচ্ছে শরীর থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। জ্বর আসবে কিনা কে জানে! কিন্তু প্রাপ্তি আর তৃধার এত আন্তরিকতা দেখে সত্যিটা বলতে খারাপ লাগল প্রাপ্তির। তাই সে মিথ্যে করেই বলল,

‘হ্যাঁ, একটু ভালো লাগছে এখন।’

অঙ্কিতা জানতে চাইল,’আদনান ভাইয়াকে একটা ফোন করব?’

প্রাপ্তি বলল,’আরে না! একটা রিকশা ঠিক কর। একাই যেতে পারব।’

‘কত যে একা যেতে পারবি তা তো বুঝতেই পারছি। দাঁড়া রিকশা নিয়ে আসি। আমরাই তোকে দিয়ে আসছি।’ বলল তৃধা।

অঙ্কিতা আর তৃধাই প্রাপ্তিকে বাড়িতে দিয়ে যায়। সুমনা বেগম প্রচণ্ড রেগে ছিলেন। কিন্তু প্রাপ্তির বেহাল অবস্থা দেখে রাগ উধাও হয়ে যায়। উলটো আরো বেশি অস্থির হয়ে যান তিনি। প্রাপ্তিকে ধরে রুমে নিয়ে যায়। মাথা ব্যথার ওষুধ খাইয়ে মাথায় পানি দিয়ে দেয়। সঙ্গে বারবার করে বলছেন,

‘রাতে ঠিকমতো ঘুমাবি না। ফেসবুক চালাবি, মুভি দেখবি তোর মাথা-ব্যথা হবে না তো কার মাথা-ব্যথা হবে? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করিস না। আর দুইদিন পরপর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তোকে নিয়ে আমি পড়েছি যন্ত্রণায়।’

অঙ্কিতা করুণস্বরে বলল,’থাক আন্টি আর বকা দিয়েন না।’

‘বকা দিয়েই আর কী হবে মা? আমার কোনো কথা কি ও শোনে? যাই হোক, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খেতে দিচ্ছি।’

‘না, না আন্টি। আমরা বাড়িতে গিয়েই খাব।’

‘এখান থেকে খেয়ে আবার বাড়িতে গিয়ে খেও। সমস্যা নেই। ফ্রেশ হও দ্রুত।’

এরপর তিনি সেতুকে প্রাপ্তির কাছে বসিয়ে কিচেনে যায় খাবার সাজাতে। অঙ্কিতা আর তৃধাকে না খেয়ে যে যেতে দিবে না এটা একদম পরিষ্কার। তাই ওরা-ও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সেতু একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সকালের ঘটনাটি এখনই প্রাপ্তিকে বলবে নাকি পরে বলবে! অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল, পরেই বলবে। সে প্রাপ্তির মাথায় সুন্দর করে হাত বু্লিয়ে দিচ্ছে।
________
সাঁঝের বেলায় জানালার ধারে বসে উপন্যাসের একটা বই ঘাটছিল আদনান। তার ধৈর্য বরাবরই কম। সম্পূর্ণ বই পড়ার ধৈর্য নেই বলে এই লাইন, সেই লাইন, একটা বাদ দিয়ে অন্যটা এভাবে পড়ে। কখনো কখনো বইয়ের সম্পূর্ণ সারমর্ম বুঝতে পারে তো, কখনো আবার কিছুই বোঝে না। এসব নিয়ে অবশ্য তার কোনো মাথা ব্যথাও নেই। তার যা স্বভাব, সে তো তা-ই করবে।

রুমানা বেগম রুমে আসেন তখন। চাপাস্বরে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,’প্রাপ্তিদের বাড়িতে কী করেছিস আজ?’

আদনান ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’কই? কিছু না তো!’

‘তোর বাবা তাহলে এত রেগে আছে কেন তোর ওপর?’

‘আমি কী জানি?’

‘ডাকছে তোকে। শুনে আয়।’

বই রেখে আদনান রুমানা বেগমের সঙ্গে রুম থেকে বের হয়। আসাদ রহমান চা পান করছিলেন তখন। আদনানকে দেখেই খিটখিটে মেজাজে বললেন,

‘এসেছ। বসো, বসো।’

আদনান একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বাবার মুখোমুখি বসল। চায়ের কাপ রেখে আসাদ রহমান ছেলের উদ্দেশ্যে কর্কশকণ্ঠে বলেন,

‘তোমার সমস্যা কী আদনান? তুমি সেতুর বিয়ে উপলক্ষে এসেছ আমি কিছু বলিনি। কিন্তু এসে উলটা-পালটা ঝামেলায় নিজেকে কেন জড়াচ্ছ?’

আদনান কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,’আমি কী করেছি আব্বু?’

‘কী করেছ জানো না? প্রাপ্তির জন্য নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল আজ। তুমি সেখানে অযথা কেন তর্ক করতে গিয়েছ?’

‘আব্বু সেখানে আমার কথা বলাটা জরুরী ছিল।’

‘কোনো জরুরী কিছু ছিল না। ওদের মেয়ে ওরা বুঝবে। তোমার এত মাথা-ব্যথা কীসের? মা-ছেলের জান বের হয়ে যায় ঐ পরিবারের জন্য।’

আদনান কিংবা রুমানা বেগম কেউই কিছু বললেন না। আসাদ রহমানও ক্ষণকাল নিশ্চুপ থেকে বললেন,’তুমি চট্টগ্রাম যাচ্ছ কবে?’

‘আগামীকাল।’

‘খুব ভালো। দয়া করে নিজের ভালো বুঝতে শেখো। অন্যের ঝামেলা নিজের কাঁধে এনো না।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

‘তুমি এসব জানলে কী করে?’

আসাদ রহমান বাইয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। আদনানের প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন। পিছু ফিরে তাকিয়ে বলেন,

‘মনে করো বাতাসেই সব কথা আমার কানে আসে। তোমাকে যা বলেছি, সেসব মাথায় রেখো।’

তিনি চলে যাওয়ার পর রুমানা বেগম আদনানকে চেপে ধরে সবকিছু জানতে চায়। মায়ের কাছে সবটা ক্লিয়ার করে আদনান। প্রাপ্তি যে রিলেশন করত এটা বিশ্বাস করতে রুমানা বেগমেরও একটু কষ্ট হয়েছে বটে! যদিও বড়ো কোনো অন্যায় সে করেনি! আসলে প্রাপ্তির থেকে কেউই এটা আশা করেনি।

আদনানও বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ঐ বাড়ির খবর নেওয়া হয়নি। দুপুরের দিক দিয়ে বাড়িতে এসে ঘুমিয়েছিল। একটু আগে উঠেছে। যাওয়ার পথে জবা ফুলের গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই গাছটা প্রাপ্তি লাগিয়েছিল। দুইটা জবা ফু্ল গাছের চারা সে কিনে এনেছিল।একটা নিজেদের বাড়ির সামনে লাগিয়েছে, আর একটা আদনানদের বাড়ির সামনে লাগিয়ে দিয়েছিল। তবে সমস্যা বেঁধেছিল অন্য জায়গায়। প্রাপ্তির গাছে থোকায়, থোকায় সাদা জবা ফুল ফুটলেও, এতদিনেও আদনানদের গাছে কোনো ফুল ফোটেনি। এটা নিয়েও আদনান প্রাপ্তিকে কত কথা শুনিয়েছে! প্রায়ই সে বলত,

‘তুই একটা হিংসুটে প্রাপ্তি। হিংসা করে একটা ব্যাটা জবা ফুল গাছ আমাদের বাড়ির সামনে লাগিয়ে দিয়েছিস। আর নিজেদের বাড়ির সামনে মহিলা জবা ফুল গাছ লাগিয়েছিস। যাতে তোর গাছের ফুল দেখে জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাই তাই না?’

প্রথম প্রথম প্রাপ্তি কথাগুলোর প্রতিবাদ করলেও একসময়ে আর কিছুই বলত না। কেননা সে খুব ভালো করেই জানত, যত-ই সে বলুক যে কোন গাছে ফুল হবে আর কোন গাছে ফুল হবে না এটা তো সে জানত না; এসব আদনান কোনোকালেই বিশ্বাস করবে না।

আজ গাছটি দেখে অতীতের কথাগুলো মনে পড়ে যায় আদনানের। আনমনেই সে হেসে ফেলে। হাসির কারণ হচ্ছে এতদিন সে অযথাই প্রাপ্তিকে বকত। কেননা এতদিন বাদে তাদের গাছটিতে একটা টকটকে রক্তজবা ফুল ফুটেছে। পাতার আড়ালে থাকায় এতদিন চোখেই পড়েনি। আজ হঠাৎ করে দৃষ্টিটা একদম গাছের আড়ালে থাকা ফুলটার দিকেই পড়েছে। সে ফুলটা ছিড়ে খুব সন্তর্পণে শার্টের বুকপকেটে রাখল যাতে ফুলটি ছিঁড়ে না যায়।

ঐ বাড়িতে যাওয়ার পর দরজা খুলে দেয় সুমনা বেগম। আদনান ভেতরে যেতে জিজ্ঞেস করে,’প্রাপ্তি কোথায়?’

‘ওর রুমে।’

‘কালকে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি আন্টি তাই দেখা করতে আসলাম।’

‘কাল যাবি, আর দেখা করে যাচ্ছিস আজ? কাল কি আসতে বারণ নাকি?’

‘তা নয়। অত সকালে তো তোমাদের ঘুম না-ও ভাঙতে পারে তাই আরকি!’

সুমনা বেগম মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’চা খাবি?’

‘হুম! খাওয়া যায়।’

তিনি রান্নাঘরে যাওয়ার সময় আদনান পেছন থেকে বলে,’তুমি প্রাপ্তিকে বকোনি তো?’

সুমনা বেগম পিছু ফিরে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকান। আদনান হাসার চেষ্টা করে বলল,’এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি যদি না বকে থাকো, তাহলে তোমার হয়ে আমি বকে দেবো।’

হেসে ফেলেন তিনি,’বকিনি। তবে একটু অভিমান করে আছি।’

‘তাই নাকি? অভিমান করা ভালো। এতে ভালোবাসা বাড়ে।’

তিনি আর কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। আদনান প্রাপ্তির রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে। প্রাপ্তি ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে,’কে?’

‘আমি।’

‘দরজা খোলা আছে।’

আদনান রুমে গিয়ে দেখে প্রাপ্তি আধশোয়া হয়ে ফোন চাপছে। চেয়ার টেনে বসে আদনান বলল,’সারাক্ষণ এত শুয়ে থাকিস কেন?’

‘এমনিই। ভালো লাগছে না।’

‘ভালো না লাগলে ঘুমাবি। ফোনে এত কী?’

প্রাপ্তি এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জানতে চাইল বাড়িতে আজ কী হয়েছে। আদনান একটু ঢং করেই বলল,’যা হওয়ার আরকি! তোর সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড তোকে বিয়ে করার জন্য ওর বাবা-মাকে নিয়ে এসেছিল। তোকে কে বলল? আন্টি?’

‘না। সেতু আপু। আম্মু তো আমার সাথে কথাই বলতেছে না।’

‘ঠিকই আছে। আরো কর জেদ করে রিলেশন।’

প্রাপ্তির মুখটা মলিন হয়ে যায়। আদনান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,’তুই আবার গলে-টলে যাসনি তো?’

‘মানে?’

‘মানে এইযে তুই সেদিন রায়হানকে এমন জবাব দিলি, সব জায়গা থেকে ব্লকও করলি; তারপরও মাত্র একদিনের ব্যবধানে সকাল হতে না হতেই রায়হান ওর বাবা-মাকে নিয়ে তোর বাসায় উপস্থিত হয়েছে। তোকে বিয়ে করবে। এসব শুনে তুই ইম্প্রেস হোসনি? মনে হচ্ছে না, ইশ! রায়হান তোকে কত ভালোবাসে! মন গলে যায়নি?’

‘পাগল নাকি তুমি? এতকিছুর পরও তোমার মনে হয় আমি গলে যাব? অসম্ভব! ওর প্রতি ঘৃণাটাও আমার ঠিকমতো আসে না। কোনো অনুভূতিই কাজ করে না।’

‘গুড। এখন থেকে সাবধানে থাকবি। একা একা কোথাও বের হওয়ার দরকার নেই।’

‘কেন? ওর ভয়ে?’

‘কারও ভয়েই না। নিজের সেইফ্টির জন্য। আন্টির সাথে মান-অভিমান মিটিয়ে নিস। জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলবি, স্যরি মা। খুব ভালোবাসি তোমায়। দেখবি মোমের মতো কেমন গলে যায়।’

আদনানের কথা বলার ভঙ্গি দেখে প্রাপ্তি হেসে ফেলে। আদনান কপাল কুঁচকে বলে,’এত হাহা হিহি করে হাসছিস কেন? তুই কি ভেবেছিস তোর হাসি খুব সুন্দর? একটুও না। তোর চেয়ে তো আমার হূরপরীর হাসি বেশি সুন্দর।’

প্রাপ্তি দু’হাত জড়ো করে সামনে রেখে বলে,’মাফ করো! জিন্দেগিতে আর তোমার সামনে হাসব না। তবুও তোমার হূরের গুণগান বন্ধ করো।’

‘তুই তো খুব হিংসুটে।’

‘হ্যাঁ, আমি হিংসুটে। আমি আরো অনেক কিছু। তবুও তোমার হূরের গল্প শুনতে চাই না।’

‘আচ্ছা চোখটা বন্ধ কর।’

‘কোন দুঃখে?’

‘করবি নাকি হূরের গল্প শুনাব?’

‘করছি, করছি!’

আদনান মুচকি হেসে বুকপকেট থেকে ফুলটা বের করে প্রাপ্তির কানের পিঠে গুঁজে দেয়। ফোনের ক্যামেরা অন করে একটু দূরত্বে রেখে প্রাপ্তির মুখ বরাবর সামনে ধরে বলে,’এবার তাকা।’

প্রাপ্তি চোখ মেলে তাকায়। ক্যামেরায় দেখতে পায় তার এলোমেলো চুলের পাশে কানে গুঁজে থাকা টকটকে লাল ফুলটি। সে একটু কেমন যেন মায়াভরা দৃষ্টিতে আদনানের দিকে তাকায়। আদনান হেসে বলে,

‘তুই আমার রক্তজবা।’

চলবে…

#আমার_একলা_আকাশ
#পর্ব_৬
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
আদনান চট্টগ্রাম চলে গেছে আজ তিনদিন। এই তিনদিনে প্রাপ্তি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আদনান চলে গেছে ঠিক এজন্য নয় বরঞ্চ রায়হানের মানসিক অত্যাচারে। বাড়ি থেকে বের হলেই ওর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। হুটহাট কোত্থেকে চলে আসে কে জানে! প্রাপ্তির মনে হয় সর্বদাই বোধ হয় ওর ওপর নজর রাখার জন্য লোকজন ঠিক করে রেখেছে রায়হান। বিরক্ত হয়ে ভার্সিটিতে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে প্রাপ্তি। তখন থেকে আবার শুরু হয়েছে ফোনের ওপর জুলুম। একের পর নতুন নাম্বার থেকে ফোন দিচ্ছে আর প্রাপ্তি ব্লক করে রাখছে। বিরক্ত হয়ে সিমও খুলে ফেলল। রায়হান তাতেও সন্তুষ্ট হলো না। এবার সে হোয়াটসএপে ঐসব নাম্বার থেকে কল, ম্যাসেজ করতে থাকে, ফেসবুকে কমেন্ট করে, ম্যাসেজ করে। প্রাপ্তি আর এসব নিতে পারছিল না। সে হোয়াটসএপ আনইন্সটল করে ফেসবুক আইডিও ডিএক্টিভেট করে রাখে। কেউ ওর সাথে যোগাযোগই করতে পারবে না। ভাগ্যিস বাড়িতে ওয়াইফাই আছে। তাই বোরিংনেস কাটাতে সে ইউটিউবে গিয়ে গান, মুভি, ভিডিয়ো দেখতে থাকে। তবে কোনো কিছুতেই স্বস্তি পায় না। এভাবে কতদিনই বা সে ঘরবন্দি হয়ে থাকবে? কতদিন সে সবার সাথে যোগাযোগ অফ রাখবে?

রায়হানের এমন পাগলামি দেখে খারাপও লাগে। আবার সে এটাও বুঝতে পারে যে, এই পাগলামিগুলো ভালোবাসা নয়। রায়হানের মনের ভেতর চেপে থাকা রাগ ও জেদ। সত্যিকার অর্থে সে প্রাপ্তিকে ভালোবাসে না এটা প্রাপ্তি ওর চোখ দেখেই বুঝেছে। এছাড়া রায়হানের হাভভাব কিংবা কথাবার্তায়, আচরণে কোত্থাও ভালোবাসার আভাস অনুভব করেনি। বিষয়টা সে ওর বাবা-মাকেও জানিয়েছে। দ্বিতীয় একটা সুযোগ চাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো রকম হ্যা’রা’জ করে না বলে তারা ভেবেছিল হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই তো ঠিক হয়নি। তাই প্রাপ্তির বাবা বলেছেন, রায়হান যদি ফের বিরক্ত করে তাহলে তারা পুলিশের কাছে যাবে। প্রাপ্তি এসব পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাইছিল না। এলাকায় তাদের একটা সম্মান রয়েছে। মানুষজন কীভাবে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলবে এটা সকলের ধারণারও বাইরে। প্রাপ্তির সাথে সুমনা বেগমও একমত পোষণ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় কোনো রাস্তাও তো নেই রায়হানকে সরানোর। তাই প্রাপ্তি ভাবে এবার সে নিজে রায়হানের সাথে কথা বলবে এবং সুন্দর করে বোঝাবে।

পূণরায় ফোনে সিম তুলে রায়হানকে ফোন করে। নিজে থেকেই দেখা করতে বলে। বিকেল চারটা নাগাদ ভার্সিটির সামনে থাকা রেস্টুরেন্টে দুজনে দেখা করে। প্রাপ্তি যাওয়ার আগেই রায়হান অপেক্ষা করছিল। প্রাপ্তি নিঃশব্দে গিয়ে রায়হানের সামনের চেয়ারে বসে।

‘কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করে রায়হান।

‘ভালো আর থাকতে দিচ্ছ কোথায়?’

রায়হান বাঁকা হাসে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বলে,’ব্যাক করতে বাধ্য হলে তাহলে?’

‘তোমায় কে বলল আমি ব্যাক করতে এসেছি? আমি সবকিছু মিটমাট করতে এসেছি।’

রায়হানের কপালে ভাঁজ পড়ে। হাসার চেষ্টা করে বলে,’মানে?’

‘মানে খুব সহজ। তোমার এইসব পেইন আর নেওয়া যাচ্ছে না। আমি বিরক্ত। তোমার প্রতি যেই অনুভূতি আমার ছিল সেটা আর নেই সেদিনের পর থেকে। কেন বুঝতে চাইছ না এই বিষয়টা? ভালোবাসি না আর আমি তোমাকে।’

রায়হান ক্রুর হেসে বলে,’তোমায় কে বলল ভালোবাসার জন্য আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাইছি?’

প্রাপ্তি অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’মানে?’

‘তার আগে এটা বলো তো, আমার চোখে কি তুমি তোমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাও?’

‘না।’

‘জানি। কারণ আমি যে তোমায় ভালোবাসিই না! যদি ভালোবাসতাম তুমি বুঝতে পারতে। তখন আর আমার থেকে দূরে থাকতে পারতে না। তুমি সব বোঝো বলেই নিজেকে স্ট্রং করে রাখতে পারছ। কিন্তু আমার যে তোমাকে চাই-ই। তোমাকে পাওয়ার জন্য কী না করেছি? বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত নিয়ে গেলাম সেখানেও আদনান বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। এখন আর কোনো ঝামেলা আমি চাচ্ছি না প্রাপ্তি। তুমি যদি বলো বিয়ে করবে তাহলে আমি তাতেও রাজি। যদি বলো বিয়ে করবে না, তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু কথা একটাই তোমাকে আমার চাই; সেটা এক রাতের জন্য হলেও!’

প্রাপ্তি স্তব্ধ হয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেণ্ড বাদে সজোরে থা’প্পড় বসায় রায়হানের গালে। রেস্টুরেন্টের উপস্থিত সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রাপ্তির চোখে পানি টলমল করছে অপমানে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ভেবেছিলাম অল্পকিছু মনুষ্যত্ব হলেও তোমার মাঝে আছে। কিন্তু এখন তো দেখছি তুমি বিকৃতি মস্তিষ্কের মানুষ। তোমার কি ধারণা তুমি ঠান্ডা মাথায় থ্রেড দিলেই আমি ভয় পেয়ে যাব? রাজি হয়ে যাব? ভেবেছিলাম তোমায় বুঝিয়ে বললে তুমি বুঝবে। কিন্তু এখন দেখছি তুমি শোধরানোর মতো ছেলে নও। এবার সত্যিই আমি পুলিশের সাহায্য নেব।’

প্রাপ্তি বেরিয়ে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে। বাড়িতে না গিয়ে সোজা ফিরোজ ইসলামের অফিসে যায়। পথেই সে বাবাকে ফোন করে রাখে। ওখান থেকে বাবা-মেয়ে থানায় যায়। একটা মানুষকে বারবার সুযোগ দেওয়া ঠিক নয়। এটাও এক ধরণের অন্যায়।

ফিরোজ ইসলাম আর সুমনা বেগম চিন্তায় পড়ে যান। কতদিন এভাবে তারা প্রাপ্তিকে সামলে রাখবে? খারাপ মানুষেরা কতভাবেই তো ক্ষতি করতে পারে। কাছের আত্মীয়-স্বজনরা বুদ্ধি দেয় প্রাপ্তিকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলেও পরে তারাও এই সিদ্ধান্তে অটল হয়। ভালো একটা ছেলে খুঁজতে থাকে সবাই প্রাপ্তির অজান্তেই।

থানায় যাওয়ার পর থেকে রায়হান আর ফোন দেয়নি। বাড়ি থেকে বের না হওয়ায় দেখাও হয়নি। প্রাপ্তির মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয় আদনানের সাথে একটু কথা বলার। কিন্তু আদনান তো আদনানই। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ সে। ও চলে যাওয়ার পর যে এতকিছু হয়ে গেল তবুও একটাবার ফোন দিয়ে প্রাপ্তির সাথে কোনো কথা বলেনি। সুমনা বেগম আর ফিরোজ ইসলামের সাথেই ফোনে যা আলাপ করার করেছে। প্রাপ্তিকে একটু ফোন দিলে কী-ই বা এমন হয়?
.
সন্ধ্যায় রুমে বসে ড্রয়িং করছিল প্রাপ্তি। তার আর্ট করার হাত বেশ ভালো। তাই মাঝে মাঝেই সে রং, তুলি, পেপার, পেনসিল এসব নিয়ে বসে। মন খারাপ হলেও আর্ট করতে বসে। এতে সুবিধা এইযে, যতক্ষণ আর্ট করে ততক্ষণ মন আর অন্য কোথাও যায় না।

সুমনা বেগম মেরুন রঙের একটা শাড়ি এনে বললেন,’কী করছিস? আর্ট করছিস? পরে করিস। উঠে আয় এখন।’

প্রাপ্তি সোজা হয়ে বলল,’কেন? শাড়ি এনেছ কেন? কোথাও যাবে নাকি?’

‘আরে না! কিছু মেহমান আসবে।’

‘তো শাড়ি কেন?’

‘তোকে দেখতে আসবে।’

প্রাপ্তি চোখ দুটো কপালে তুলে বলে,’এসবের মানে কী? তোমরা সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে দিতে চাইছ?’

‘অসুবিধা কী? আর কেন চাচ্ছি তুই নিজেও সেটা ভালো করে জানিস।’

‘রায়হান তো এখন আর আমাকে বিরক্ত করে না, মা।’

‘এখন করে না মানে যে পরেও করবে না তার গ্যারান্টি কী? বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না প্রাপ্তি।’

‘মা প্লিজ! তাই বলে বিয়েই একমাত্র সমাধান নয় নিশ্চয়ই?’

‘তোর কথা পরে শুনব। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। তোর বাবা উনাদের এগিয়ে আনতে গেছে।’

এখন তর্ক করলে যে ঝামেলা বাড়বে প্রাপ্তি সেটা ভালো করেই জানে। তবে যা-ই হয়ে যাক না কেন, সে বিয়ে করতে চায় না এখন-ই। তার ইনটেনশন অন্যকিছু। জীবনে ভালো কিছু করার পাশাপাশি একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যি হচ্ছে সে আদনানকে ভালোবাসে। এতদিন এটা সে বুঝত আর আজ সেটা আরো বেশি উপলব্ধি করতে পারছে। যতবার সে কল্পনা করছে অন্য কারো সাথে তার বিয়ে হয়ে যাবে, ততবার তার বুক কেঁপে ওঠে। অসহ্য যন্ত্রণা হয়। সে আদনানকে ছাড়া অন্য কাউকে কী করে বিয়ে করবে?

প্রাপ্তিকে সাজিয়ে-গুজিয়ে ছেলেপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কয়েকজন-ই এসেছে। শুধু ছেলে বাদে। সবাই বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করে প্রাপ্তিকে। ভদ্রতা হোক বা সৌজন্যের খাতিরে হোক; প্রাপ্তি সব প্রশ্নের উত্তর দেয় ঠিকঠাক। সবার-ই প্রাপ্তিকে পছন্দ হয়। যাওয়ার আগে তারা স্পষ্টভাবে-ই বলে যায়, প্রাপ্তিকে তাদের পছন্দ হয়েছে এবং তারা ওদেরকেও বাড়িতে দাওয়াত করে ছেলে দেখার জন্য।
.
.
রুমে এসে শাড়ি-চুড়ি সব খুলে নরমাল ড্রেস পরে শুয়ে ছিল প্রাপ্তি। সুমনা বেগম খুশি খুশি মনে রুমে আসেন। তার হাতে কয়েকটা ছবি। প্রাপ্তি শোয়া থেকে উঠে বসে। সুমনা বেগম প্রাপ্তির চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলেন,

‘আমার সোনার টুকরা মেয়ে! সবার পছন্দ হয়েছে তোকে।’

প্রাপ্তি মলিন মুখে দৃষ্টি নত করে বসে আছে। তিনি ছবিগুলো প্রাপ্তির হাতে দিয়ে বললেন,’ছেলের ছবি। দেখ, সুন্দর আছে।’

তিনি চলে যাওয়ার পর অনিচ্ছায় ছবিটিতে একবার চোখ বুলাল প্রাপ্তি। হ্যাঁ, ছেলেটি আসলে-ই সুন্দর। কিন্তু সৌন্দর্যে কী আসে যায়? সে তো ভালোবাসে আদনানকে। আচ্ছা আদনান কি জানে প্রাপ্তির যে বিয়ের কথাবার্তা চলছে? সে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে আদনানকে কল করে। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। সারা রাতেও আদনানের নাম্বার আর খোলা পাওয়া যায়নি। পরেরদিন সকালে নাম্বার তো খোলা পাওয়া গেছে, কিন্তু কথা হয়নি। প্রাপ্তির কথা শোনার আগেই আদনান বলেছে,

‘অফিসে আছি প্রাপ্তি। ভীষণ ব্যস্ত এখন। একটা প্রজেক্ট নিয়ে খুব সমস্যায়ও আছি। চাকরীটা নাও থাকতে পারে বুঝলি! একটু দোয়া করিস প্লিজ।’

প্রাপ্তির উলটো মন খারাপ হয়ে গেল আদনানের কথা শুনে। নিজের মন খারাপের কথাটি আর বলা হয়ে উঠল না। শুধু ছোটো করে বলল,’আচ্ছা।’

ভার্সিটিতে গিয়ে তৃধা আর অঙ্কিতাকেও বিয়ের কথা শেয়ার করল প্রাপ্তি। সব শুনে ওরা দুজনও বলে,

‘বিয়েটা করে ফেললেই তো ভালো হয় প্রাপ্তি। যা শুনলাম ছেলের অবস্থা তো ভালোই। বিয়ের পরও পড়াশোনা করা যায়। তাহলে আর সমস্যা কী বল?’

প্রাপ্তি করুণ দৃষ্টিতে তাকায় বান্ধবীদের দিকে। সবাই ওর ভালোটাই দেখছে। কিন্তু কেউ মনের খবরটা জানতে চাইছে না, বুঝতে চাইছে না। সে মুখ ফুটে এই কথাটি বলতেও পারছে না কাউকে। সে না হয় আদনানকে ভালোবাসে। কিন্তু আদনান! আদনানও কি প্রাপ্তিকে ভালোবাসে?
.
প্রাপ্তির সাথে আদনানের কথা হলো রাতে। অনেক ভয়ে ভয়ে আদনানকে ফোন করেছে। ভেবেছে রাগ-টাগ দেখাবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। উলটো আদনান বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে-ই জিজ্ঞেস করেছে,

‘কী ব্যাপার? কেমন আছিস?’

প্রাপ্তি ছোটো করে বলল,’ভালো। তুমি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌।’

‘খেয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

কথা আগাচ্ছিল না। আদনান বোধ হয় এখনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত। প্রাপ্তি একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,

‘গতকাল পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল আমায়। রায়হানের জন্য সবাই চাচ্ছে আমায় বিয়ে দিয়ে দিতে।’

আদনান ভাবলেশহীনভাবে বলল,’জানি।’

অবাক হয় প্রাপ্তি। জেনেও এত স্বাভাবিক রিয়াকশন। সে বিস্মিতকণ্ঠে-ই জানতে চাইল,’তুমি জানো?’

‘সব-ই জানো। ছেলে এবং ছেলের পরিবার তোকে অনেক পছন্দ করেছে। তোর বাড়ির লোকজনেরও ছেলেকে এবং ওর পরিবারকে ভালো লেগেছে। আজকে ছেলে দেখতে গেছিল তোর বাবা জানিস? কাল-পরশু বিয়ের জন্য ফাইনাল ডেটও ফিক্সড করে ফেলবে। আর তোর জন্য একটা সুখবরও আছে। বিয়ের পর বরের সাথে পার্মানেন্ট কানাডায় থাকবি। আরামে, সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাবি। কী কপাল রে তোর প্রাপ্তি!’

প্রাপ্তি স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আদনানের কথা বলার ভঙ্গিতে-ই বোঝা যাচ্ছে, প্রাপ্তির বিয়ে হবে শুনে সেও খুশি। আদনান একটু আনমনা স্বরে বলল,

‘ভাবতেই কেমন অবাক লাগে তাই না? সেই ছোট্ট প্রাপ্তি নাকি এত বড়ো হয়ে গেছে যে, তার এখন বিয়েও হবে।’

প্রাপ্তি ফোনের লাইন কেটে দিলো। আর কিছু বলার নেই তার। আদনান দু’বার কল ব্যাক করা সত্ত্বেও প্রাপ্তি আর ফোন রিসিভ করেনি। দু’চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার। কেন এত কষ্ট হচ্ছে কে জানে! আদনান না ভালোবাসুক তাতে তো সমস্যা নেই। কিন্তু আদনান ব্যতীত অন্য কাউকে সে বিয়ে করবে এটা তো ভাবতেই পারছে না। কল্পনা করাও দুষ্কর।
_____________
ঘুমানোর আগে সুমনা বেগম প্রাপ্তির রুমে একবার আসেন। মন খারাপ করে শুয়ে ছিল প্রাপ্তি। সুমনা বেগম পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

‘ছেলেকে দেখে এসেছে আজ তোর বাবা। ছেলে ভদ্র, সুন্দর। পরিবারও অনেক ভালো। দুই পরিবারের-ই সম্মতি আছে। ছেলেও তোকে খুব পছন্দ করেছে। রায়হানের সাথে তোর এখন আর সম্পর্ক নেই জানি। কিন্তু তবুও জানতে চাচ্ছি, তুই কি রায়হানকে এখনো ভালোবাসিস কিংবা অন্য কাউকে?’

প্রাপ্তির চোখের কোণা বেয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখের দৃশ্যপটে আদনানের মুখটি ভেসে ওঠে। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’না।’

‘যাক, আলহামদুলিল্লাহ্‌। বিয়েতে অমত আছে?’

‘না।’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, আলহামদুলিল্লাহ্‌, আলহামদুলিল্লাহ্‌।’ বলে তিনি প্রাপ্তির মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

‘ছেলে তোকে ফোন দিবে আজ। কথা বলিস। আর তোরা কাল সময়-সুযোগ বুঝে দেখা করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিস।’

প্রাপ্তি আর কিছুই বলল না। সুমনা বেগম যাওয়ার আগে রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে যায়। অন্ধকার রুমে হুহু করে কেঁদে ওঠে প্রাপ্তি।

চলবে…