আমার চারু পর্ব-০১

0
721

#আমার_চারু
#পর্ব-১
#ফারজানা_নিলা (writer)

কি ম্যাডাম এতো রাতে আকাশে কি খুঁজছেন?
-কিছু ছেলে জিন এসেছিলো কবরস্থান থেকে।তাদের সাথেই আড্ডা দিচ্ছিলাম।
-এহ!!!!😳



সাল ১৯৯৭…..

ভোর পাচঁটা বাজতেই এলার্ম এর বিকট শব্দ বেজে উঠলো।প্রতিদিন পাচঁটার এলার্ম লাগিয়ে কাব্য ঘুমিয়ে পড়ে।আবার সকাল হলে এলার্ম বাজতেই, কানে বালিশ চেপে ধরে।
আজ কাব্যের চাকরির পরীক্ষা আছে।তাড়াতাড়ি পরীক্ষার জায়গায় পৌছাঁতে হবে,দেড়ি করলে সেখানকার বড় বাবুরা ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দেয় না।

কাব্য তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে আর এক ভদ্রমহিলার সাথে ধাক্কা।বয়স হবে,এই ২৩ কি ২৪.।বেশ সুন্দরী তবে।

-আমি দেখতে পাই নি।আপনি ব্যাথা পেয়েছেন?
-আমিতো ব্যাথা পাইনি কিন্তু আপনি এতো তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কিছু ফেলে যাচ্ছেন কিনা দেখেন?
-মানে?
-মানে ব্যাগ খুলে দেখুন।


কাব্য ব্যাগ খুলে দেখে তার জরুরী কাগজ গুলো সে না নিয়েই চলে যাচ্ছে।তাকিয়ে দেখে ভদ্র মহিলাটি নেই।কাগজ নিয়ে রাস্তায় গাড়িতে উঠে গেলেন।যাওয়ার পথে দেখলেন সেই ভদ্র মহিলা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

কাব্যর ইচ্ছে করছিলো,মহিলাটিকে একবার ধন্যবাদ দেওয়ার,কিন্তু আর দেওয়া হলো না।
কাব্য পরীক্ষার জায়গায় গেল।আর মাত্র মিনিট পনেরো বাকি, গিয়ে বসতে হবে।
কাব্য চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে বের হলো।বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে।হঠাৎ এক চেনা অচেনা গলা।

-কি ব্যাপার আপনার মুখ শুকনো দেখাচ্ছে যে,পরীক্ষা ভালো হয়নি?
-হয়েছে আবার হয়নি।জানিনা। আচ্ছা আমি এলাম।



কাব্য বাসায় ফিরে গেল।তার পরীক্ষা তেমন ভালো হয়নি।আর চাকরীর বাজারে চাকরী পেতে অনেক কাঠ খর পোড়াতে হয়।
বাসায় এসে বাসি শার্ট প্যান্ট ছেড়ে গোসল করে শুয়ে পরলো।

আমাদের পরীক্ষা ভালো না হলে সেদিন আমাদের খিদে পায় না।পায় তবে অনেক পরে।ঠিক আজ কাব্যের ও খিদা পায়নি।

বালিশে মাথা রেখেই এক ঘুম। দু ঘন্টার লম্বা ঘুমে কাব্যের ঘুম ভাঙে তাও হুট করে।কাব্যের মনে পরলো সেই মহিলার কথা….

আচ্ছা মেয়েটি জানলো কিভাবে, আমি পরীক্ষা দিতে গিয়েছি আর আমার পরীক্ষা ভালো হয়নি,সেটাই বা কেমনে জানলো।
ধুর কিসব ভাবছি।ভালো লাগে না।



কাব্য যখন একদম ছোট,বয়স আট।তখন তার বাবা মারা গিয়েছেন।জন্মের সময় মা ও হাড়িয়েছে।এরপর থেকেই তার জেঠু তাকে মানুষ করেছেন।কাব্যর কোনো ভাই বোন নেই।তবে তার জেঠতুতো ভাই বোন আছে।রিমা আর জয়।
রিমা হলো খুবই শান্তো প্রকৃতির আর জয় হলো শয়তানেরও শয়তান।

সব পরিবারেই একজন খুব শান্তো আর আরেকজন খুব দুষ্টু থাকে।কেন হয় এমন তার ব্যাখ্যাও নেই।তবে এটি সত্য।


কাব্য গোবিন্দপুর থেকে কলকাতা শহরে চলে এলো চাকরীর খোজে।গোবিন্দপুরে কেউ কিছু না বললেও জেঠি সব সময় কথা শুনাতো।সব সময় যে কোনো কিছু নিয়ে খোটা দিতো।তবে,জেঠু কাব্যকে খুবই ভালোবাসতেন।জয়ের জন্য যা আনতেন ঠিক তেমনি কাব্যর জন্যও একই জিনিস নিয়ে আসতেন।
কারণ,তিনি চাইতেন, যাতে কাব্যর কখনো মনে না হয়,নিজের ছেলেকে বেশি দিয়েছে।কাব্যের মাঝে তিনি তার ভাইকে দেখতেন।



একদিন সকালে…..

গোবিন্দপুরে প্রচুর হিন্দু বাড়ি ছিলো।সেখানে কাব্য জয় সব সময় আসা যাওয়া করতো।একদিন সকালে লক্ষী পূজোর জন্য এক বন্ধু এসেছে কাব্যকে নিতে।কাব্য সেই বন্ধুর সাথে আড্ডা দিয়ে রাতে এসেছে বাসায়।
তখন ছিলো খাবার সময়….
-এই কাব্য এতো দেরি করে এলি যে।
-জেঠু বন্ধুর সাথে একটু বাইরে ছিলাম।
-আচ্ছা,যা গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস।
-আচ্ছা জেঠু।

অমনি কাব্যের জেঠি মা বলে উঠলেন-বাইরে থেকে গিলে এসেও বাপু শান্তি নেই, এখন আবার গান্ডে পিন্ডে গিলবে।
কাব্য এসব শুনেও কিছু বলেনি।শুনতে শুনতে হয়তো অভ্যাস।মানুষের যখন কিছু অভ্যাসে পরিণত হয় তখন সেই জিনিস কে এতো গুরুত্ব দেয় না।কারণ, সে জানে এটি সব সময় চলবেই।কিছু বলে ঝগড়ার দরকার নেই।

-ও জেঠি মা,দেখি দাও দুটো ভাত।প্যাটের সব ইঁদুর কিন্তু এখন বেড়িয়ে পরবে। এই বলে দিলাম।
বেশ মজা করে চারটি লুচি আর তরকারি খেয়ে কাব্য ঘুমোতে গেল।
বাসায় কি হতো না হতো সব সময় রিমা খেয়াল রাখতো।কিন্তু কিছু বলতোনা।
রিমা সব সময় কাব্যকে আড়াল থেকে দেখতো কিন্তু কাব্যর সাথে কখনো কথা বলেনি।
প্রয়োজন হলে, এসে বলেছে তারপর দৌড়।কথা বলতে চাইলেও বলতোনা।

কিছু কিছু মেয়ে থাকে যারা নিজের আনমনে থাকে।তারা হাসে ঠিকি কিন্তু কাউকে দেখায় না।রিমাও ছিলো তেমন।পড়ালেখা নিয়ে থাকতো,রুমের ভেতর থেকে বেরই হতো না।পাড়ার ছেলে মেয়েরা নাম দিয়েছে ghost room মানে ভুতের ঘর।রিমার ঘর টা সব সময় কেমন যেন অন্ধকার থাকতো।কেমন একটা লাল বাতি জ্বলতো খাটের পাশে।
মাঝে মধ্যে জানালায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের খেলা দেখতো, আবার আচমকা জানালা বন্ধ করে দিত।

রিমা একা থাকলেও রিমা খুবই গুণি মেয়ে।জেঠি মার ভয়ে সব কাজ শিখে নিয়েছে।

কিন্তু রিমা মাসে একবার কাব্যের দিকে দেখে একটা হাসি দিতো,যা খুবই ভয়ানক।।সেই হাসিতে অনেক রহস্য লুকিয়ে থাকে।হেসেই সে তার ঘরে চলে যায়।
কাব্য কিছু বুঝতে না পেরে, রিমা চলে যাওয়ার পর একটা হাসি দেয়।।


জানুয়ারি মাসের আজ ১২ তারিখ…..

আজ কাব্যের চাকরীর পরীক্ষার ফল বের হবে।পরীক্ষা যেহেতু ভালো হয় নি।তাই কোনো আশা নেই।কিন্তু তবুও কোথাও একটা আশা লুকিয়ে থাকে।মানুষ আশা ছাড়ে না কখনো।হবেনা জেনেও মনে মনে আশা করে যায়।যদি হয়ে যায়।


মাথা ধরানো সকাল পাচঁটার এলার্ম বেজে উঠতেই, কাব্যর ঘুম হারাম হলো।
সকালের ঘুম মানেই অমৃত।কোনো মতেই এই সুখ ছাড়া যায় না।তবুও ছাড়তে হয়।কাব্য উঠে মুখ হাত ধুয়ে কিছু নাস্তা করবে।নিচেই চায়ের দোকান আছে।সেখানে বিস্কুট, বনরুটি, কেক পাওয়া যায়।
এক কাপ চা তিনটাকা।
মদন কাকার চায়ের অনেক স্বাদ।সকালের শুরু যদি মদন কাকার চা দিয়ে না হয় তাইলে পুরো দিনটাই বিফল।

চাকরীর পরীক্ষায় যদি টিকে তাহলে, চিঠি পাঠাবে ঠিকানায়।তাই কোনো চিন্তা নেই।আপাতত কয়েকদিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যাবে।

-কি ব্যাপার কাব্য যে,
-হ্যা কাকা।এক কাপ কড়া করে দুধ চা দাও তো।মাথা টা ঝিম ধরে আছে।
-হ হ দিতাছি।তো আইজ কোথাও যাইবানা?
-না কাকা,আজ বাসায় আছি। নাকে তেল দিয়া ঘুমাবো আর তোমার হাতের চা খাবো।
-ঠিক আছে।

গরিব মানুষ গুলোর এই হাসিটাও খুব মনে লাগে।কাকার হাসিটা মন টা ভালো করে দিলো।


বেশ কদিন অপেক্ষা করলো।কিন্তু কোনো চিঠি আসলোনা।
তাই ধরেই নেওয়া যায়, চাকরীর পরীক্ষায় তেমন কোনো সুবিধা হলোনা।

দু দিনপর,

কাকা চা দাও।আর এই খবরের কাগজ টা দাও তো।
খবরের কাগজ দেখতে দেখতে একটা চাকরীর খবর দেখলো।
তেমন খারাপ না,মাসে ৩ হাজার টাকা দিবে।যদি পাই বেশ চলে যাবে।এই চাকরীর পরীক্ষা দেওয়া লাগবেনা।
কাকা একটা চাকরীর খবর পেয়েছি।
-অহ,ভালোই তো।
-হ্যা,কাকা।এই চাকরীর পরীক্ষা দেওয়া লাগবেনা।বড় বাবুরা কিছু প্রশ্ন করবে, সেগুলোর উত্তর দিতে পারলেই চাকরী হাতে।
-হ হ, পারবা তুমি।
-কাকা,যদি পাই তোমাকে রুই মাছের পেটি দিয়ে ভাত খাওয়াবো।

কাব্য খুব খুশী হলো,চাকরীর খবর মানেই আরেকটি সুযোগ।কাব্যর জেঠু, মাসে মাসে পাঁচশ করে পাঠায়।
কিন্তু চাকরীতো পেতেই হবে।
বড় হয়ে গেলে হাত পেতে টাকা নেওয়া মানে লাগে।
বেশ বাসায় গিয়ে, কাব্য সব পুরোনো বই নামালো বস্তা থেকে।সব ধূল পড়ে আছে।অবশ্য কাব্যের ঘরটাও একটা ধূলের কারখানা বললেই চলে।খায় আর ঘুমায়।কিছুই করে না।

বেশ বই পত্র নিয়ে পড়াশুনা শুরু হয়ে গেল।কাব্য লেখাপড়ায় তেমন পাকানা।হালকা পাকা।আবার হালকা কাচা।তবুও পড়ে মগজে ঢুকানোর চেষ্টা করছে।পরশু সকাল দশটায় ইন্টার্ভিউ। যা পড়ার এর মধ্যেই নিতে হবে।

পরশু সকালে কাব্য তৈরি হয়ে বের হয়ে নিল।সাদা একটা ঢিলা শার্ট পড়েছে,তার সাথে কালো একটা প্যান্ট।রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য।আসার পথে হালকা চা পানিও খেয়ে নিয়েছে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ কাব্যের মনে পরলো, সেদিনের সেই মেয়েটির কথা।এদিক সেদিকও তাকাচ্ছিলো।অমনি আচমকা….

-আপনি আমাকে খুঁজছেন?
কাব্য হা হয়ে তাকিয়ে আমতা আমতা করছে।
-না, মানে হ্যা মানে না।আপনাকে খুজতে যাবো কেন।
-অহ আমাকে খুঁজছিলেন না তাহলে।
-না।
-আজকেও কি চাকরীর পরীক্ষা?
-হ্যা,কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?আর সেদিনও বললেন””!
– একটা কথা কি জানেন? আজকে আপনার চাকরী হয়ে যাবে।

কাব্য হা করে তাকিয়েই আছে।
মেয়েটি হেসে চলে গেল।কিন্তু নাম টি আর জিজ্ঞেস করা হলোনা।মেয়েটি সেদিনও সাদা শাড়ি পড়েছিলেন,আর আজও তিনি সাদা শাড়িতে।অবশ্য সাদা শাড়িটা ভালোই লাগছে।

ঘন্টাখানিক অপেক্ষার পর, কাব্য ইন্টার্ভিউ রুমে ঢুকলো।
বেশ মোটাসোটা ছয় জন বড় বাবু বসে আছেন।সবাই কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে।নাকের উপর চশমা, এর উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে চোখ বড় করে।এক এক জনের ভুড়ি গুলি মনে হচ্ছে এখনি প্যাট থেকে ছিড়ে পরে যাবে।

কাব্য সামনে বসলো….
এরপর শুরু হলো ইন্টার্ভিউ। বেশ সবকটা প্রশ্ন কাব্য খুব সহজেই বলে ফেলেছে।

আপনার চাকরী টি আমরা কনফার্ম করছি।শনিবার থেকে চলে আসবেন।এবার আসতে পারেন।

কাব্য কল্পনাও করেনি, সে চাকরী পেয়ে গিয়েছে।এতো খুশী যে বলার বাইরে।কাব্যর কাছে মোবাইল নেই।জেঠুকে জানালে অনেক খুশী হবে।
টেলিফোন লাইন থেকে ফোন করতে হবে।কিছু দূরেই টেলিফোন বুথ আছে।
পয়সা দিলে কল করা যায়।বেশ কয়েকবার কল করার পরও জেঠু টেলিফোন তুললোনা।

কাব্য আজ বেশ খুশী।
মদন কাকার দোকানে এসে সুখবর দিলো।
কাকা আমি চাকরী পেয়ে গিয়েছি।তোমাকে এবার রুই মাছের পেটি খাওয়াবো।এই খুশীতে মদন কাকা আজ ফ্রিতে এক কাপ চা খাওয়ালো।


সারাদিনের ক্লান্তির পর রাত ১১.০৭, বালিশে মাথা রেখেছে।চোখে অনেক ঘুম। চোখ বন্ধ হয়ে আসবেই,হঠাৎ কাব্যর কানে বেজে উঠলো-কে জানি ফিস ফিস করে বলছে,আপনার চাকরী হলো তো….

চলবে…..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।গল্প পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন কমেন্ট করে।পাশে থাকবেন।ধন্যবাদ)