আমার চারু পর্ব-০২

0
338

#আমার_চারু
#পর্ব-২
#ফারজানা নিলা(writer)

রাত প্রায় ১২টা।
হঠাৎ কানের কাছে কে যেন ফিস ফিস করছে, আপনার চাকরী হলো তো।
আচমকা ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে উঠলো কাব্য।

উফ মাথাটা ধরে এসেছে।কেউ কি ছিলো আমার ঘরে।নাকি স্বপ্ন দেখছি।

কাব্য উঠে মুখে চোখে জল দিলো।একবার ঘুম ভাঙলে আর সহজে ঘুম আসেনা।কানে কেমন একটা মিষ্টি সুর ভেসে আসছে।

কি ব্যাপার,এতো রাতে কিসের সুর ভেসে আসছে।সুরটা অনেক প্রশান্তির।চোখ বুঝলেই ঘুম চলে আসবে।
কাব্যর ঘরটা ছিলো বাড়ির উপর তলায়,একদম ছাদের সাথে।তার পাশে আরো একটি বাড়ি আছে।সেই বাড়ির ছাদটি কাব্যর ঘরের সাথেই।চাইলেই এই ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাওয়া যায়।
কোথা থেকে যেন,সারদের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে।
কিন্তু এতো রাতে কে বাজাবে সারদ।

কাব্য বেশ কিছুক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এই সুর অনুভব করলো।কেমন যেন প্রশান্তি,সব ক্লান্তি নিমিষে দূর করে দিলো।কিন্তু এই সুরের স্থান টা আবিষ্কার করতে পারলো না।
কাব্য গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
কে যেন, অতি আদরে ঘুম পারিয়ে দিলো।


আজ কাব্যর প্রথমদিন চাকরীতে।তাই আজ তাড়াতাড়ি যেতে হবে।প্রথমদিন তাড়াতাড়ি যাওয়া ভালো,না হয় আবার বদনাম রটবে।
অফিসে নিয়ম আছে,বড় বাবুদের মতো সুট প্যান্ট পড়ে যেতে হবে।
কাব্য আজ আবারো সেই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়েছে।ভালো জামা আর নেই।আর যা আছে তা দিয়ে অফিসে গেলে, সবাই খুব হাসবে।
আজকে মদন কাকাকে রুই মাছের পেটি খাওয়ানোর কথা ছিলো।তা আজ আর হবে কিনা কে জানে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কাব্য, একটা অটো পেলে অফিসে যাবে।শহরে মানুষের এতো ভিড় যে গাড়িই পাওয়া বড় মুশকিল।

এই ভাই দাড়াও আমাকে একটু সামনে নামাই দিও।

কলকাতার গাড়িতে ভাড়া হিসাব হয় মিটার দিয়ে।শহরের মানুষ গুলো কেমন যেন পুতুলের মতো।সবাই কেমন চুপ করে থাকে।
কাব্য গাড়িতে উঠে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।যাওয়ার সময় চোখ পরলো, সেই মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আরে,ইনি তো সেই।আজকেও কথা বলতে পারলাম না।
আজও সাদা শাড়িতে।আজ চুলে বেনুনি করেছে।দূর থেকে ঠিক বুঝা যায়নি,কপালে টিপ কি ছিলো নাকি ছিলো না।

কাব্য অফিসে ঢুকলো।তাকে একটা কার্ড দেওয়া হলো যেখানে নাম আছে কাব্যর।এই অফিসে যারা যারা কাজ করে তাদের সবার আছে এমন কার্ড।
প্রথমে বড় বাবুর রুমে গিয়ে সই করতে হবে।যারা যারা অফিসে আসবে, সবার সই করতে হবে।
সই না করলে, বুঝবে যে আজ অনুপস্থিত।
আর বড় বাবু তো বলে দিয়েছেন,একদিন না আসলে, একদিনের বেতন কাটা।


কাব্যর আজ অনেক খাটনি হয়েছে কিন্তু ফিরতি পথে মদন কাকার জন্য রুই মাছের পেটি নিতে হবে।

দাদা রুই মাছের পেটি হবে?
-হ্যা হবে,কত টুকু দিবো?
-দুজনের জন্য।
-এই নিন।আশি টাকা হয়েছে।
-আশি টাকা!!এতো দাম।

দাম বেশি হলেও নিতে হবে।মদন কাকাকে কথা দিয়েছে।আর কথা দিলে রাখতে হয়।
বেশ সন্ধ্যা হয়েছে।হাতের ঘড়ি টাও গেল নষ্ট হয়ে।কটা বাজে ঠিক বলতে পারছেনা।মদন কাকা আবার নয়টার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন।

-ও কাকা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
-মাত্র তো ৭ টা বাজে,এতো তাড়াতাড়ি কি আমি ঘুমাই নাকি।আরো দের আছে।
-কাকা,তোমার জন্য কি এনেছি দেখো।
-কি আনছো?
-রুই মাছের পেটি।বলেছিলাম না চাকরী পেলে খাওয়াবো।

কেন জানি, মদন কাকার চোখে জল চলে এলো।হয়তো রুই মাছের পেটি এনেছি তাই খুশি হয়েছেন।
-কাকা তুমি কাঁদছো?
-না রে, এ জল খুশির।বুড়ি সব সময় কইতো, ওগো আমারে একদিন রুই মাছের পেটি আইন্না দিও আমি রাইন্দা খাওয়ামু।আইজকা বুড়ি নাই,আমি আছি।

কাকার কথা শুনে কাব্যও মন খারাপ করে ফেললো।
খাওয়া দাওয়া করে কাব্য বাসায় চলে গেল।কাকার দোকান বন্ধ করতে আরো কিছুক্ষণ সময় আছে।
মুখ হাত ধুয়ে ছাদে, পায় চারি করছে কাব্য।

যখন কেউ থাকে না, মানুষ তখন একা একা কথা বলে।বা বলা যায় নিজের সাথে কথা বলে।কাব্যও ঠিক তাই করে।রোজ ঘুমানোর আগে ছাদে এসে খানিক আকাশ দেখে আর নিজের সাথে কথা বলে।
আজও ঠিক তাই,মদন কাকার কথা গুলো শুনে কাব্যের মন টা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছে।ছাদে এসেছে আকাশ দেখতে।
আকাশ দেখলে নাকি মন ভালো হয়ে যায়।রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কাব্য।আজ আকাশে অনেক তারা।হঠাৎ সেদিনের সেই সুর আসছে কানে।
মনে হচ্ছে যেন, পাশের এই বাড়ি থেকেই আসছে।কিন্তু ছাদে যে ঘর টি রয়েছে সেটিতো বন্ধ মনে হচ্ছে।কোনো আলো জ্বলছেনা।
কাব্য মনে মনে ভাবছিলো-
আমি কি একবার ঘর টায় গিয়ে দেখব।যদি কেউ না থাকে। থাক যাব না।

কাব্য পাশের বাড়ির ছাদে যেতে চাইলেও আর যায় নি।কিন্তু সুর এই ঘর থেকেই আসছে।এটা বোঝাই যাচ্ছিলো।তবুও মনে একটা ভয়।


কাব্য নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছিলো আর কেমন যেন একটা ঠান্ডা বাতাস কানের পাশ দিয়ে গেল।ঠান্ডা বাতাসটা কানে কিছু একটা বলে গেল মনে হচ্ছে,থমকে দাঁড়ালো কাব্য।
পুরো শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ঠিক কেন হলো বুঝতে পারলোনা কাব্য।কাব্য একটু শক্ত হলো

ধুর কি যে হচ্ছে আমার সাথে।সব কিছু নিয়ে এতো যে ভাবি।পাগল হয়ে যাব।

কাব্য ঘরে ঢুকার সময় খেয়াল করলো,সেই সুর এখন আর আসছেনা।
কি ব্যাপার,এতোক্ষন বাজাচ্ছিল। এখন যে বন্ধ হয়ে গেল।


কাব্য বিছানায় শুয়ে পরলো
।ঘুম আসছেনা কেন জানি।এপাশ থেকে ওপাশ।কিন্তু ঘুমাতে হবে। না ঘুমালে সকালে উঠতে আবার দেরি হবে।
চোখ বন্ধ করলেও ঘুমের কোনো দেখা নেই।বেশ ঘন্টাখানিক পার হয়ে গেল।অমনি কাব্যের কানে ভেসে আসছে, সেই সুর।যেন এক সাগর প্রশান্তি।
কাব্য ঘুমিয়ে পরলো।


ভোর পাচঁটা……

এলার্ম বেজেই চলেছে কিন্তু কাব্যর কোনো খবর নেই।গভীর ঘুম।
অবশেষে ঘুম ভাঙলো।কাব্য উঠে বসলো।সকালের ঘুমটা খুবই আলসি আনে।তবুও উঠতে হবে।
কাব্য রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল,

আজ মনে হচ্ছে দেরি হবে।উফ কেন যে এতো ঘুমাতে গেলাম।দেরি করলে আবার জরিমানা ভুগতে হয়।যাওয়ার পথে জেঠু কে টেলিফোন করে নিব।

-একা একা কথা বলছেন?
-কে?আপনি?
-হ্যা আমি।
-আপনি এখানে কি করেন প্রতিদিন?
-অপেক্ষা করি।
-কার জন্য?
-আছে একজন।
-তো আপনার নাম টা ঠিক জানা হলো না।

কাব্য পিছোনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই।এদিক সেদিক তাকানোর পর দেখে, বা দিকের রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।

উনি কি আমার কথা শুনতে পায়নি নাকি ইচ্ছে করেই উত্তর দিলেন না।


কাব্য অফিসে গিয়ে কাজে তেমন মনোযোগী হতে পারেনি।কেমন জানি মনের মধ্যে হুস খুশ করছে।কি যেন নেই। তবুও অফিসে অনেক কাজ।সব করতে হয় ঠিকভাবেই।
প্রায় ৮ টা হলো বাসায় ফিরতে ফিরতে..

চোখে মুখে সব অন্ধকার দেখছে।কোনো রকমে চাবি দিয়ে দরজা টা খুলে। ঢুকেই দেখে একটা রজনীগন্ধা, শুকিয়ে গিয়েছে প্রায়।

-রজনীগন্ধা!! আমার ঘরে। কোত্থেকে এলো।

প্রচন্ড ক্লান্তি তাই আর বেশি কিছু না ভেবেই ফুলটি রেখে দিলো।


পরদিন বিকেলে….
কাব্য আজ আবার টেলিফোন বুথে গেলো জেঠুকে টেলিফোন করতে।বেশ ক বার চেষ্টার পর জেঠিমা কল ধরলেন…
-হ্যালো কে?
-জেঠিমা আমি কাব্য।
-অহ তুই। তো কি হয়েছে কি?এতোবার টেলিফোন করে তো কানের বারোটা বাজালি।
-জেঠিমা একটা খবর দেওয়ার ছিলো।এজন্য কল দিয়েছি।
-কি খবর?
-আমি চাকরী পেয়েছি।জেঠুকে বলিও।
-অহ, তাইলেতো কামাই করবি।এবার তাইলে ঘাড় থেকে নাম।আর কত ঘাড়ে বসে বসে খাবি।

(কি গো, কে টেলিফোনে)
-এই কাব্য ধর তোর জেঠু এসেছে।
-হ্যালো জেঠু।
-কিরে বাবা,এতোদিনে মনে পড়লো। তুই ভালো আছিস তো,টাকা পয়সা লাগবে?
-জেঠু আগে শুনো আমার কথা,আমি চাকরী পেয়েছি।মাইনেও ভালো।এবার গোবিন্দপুর যাওয়ার সময় তোমার জন্য কিছু নিয়ে যাব।
-ঠিক আছে ঠিক আছে।তুই সাবধানে থাকিস।আর আমি মাসের টাকাটা তোকে দিয়ে দিব।ওটা তুই জমিয়ে রাখিস।

বেশ অনেকদিন পর জেঠুর সাথে কথা বলে কাব্যর অনেক ভালো লাগলো।টেলিফোন এ বেশি কথা বলা যায় না।পয়সা দিয়ে কথা বলতে হয়।তবুও কথাতো বলা যায়।

কাব্য ভাবছে আজ কিছু কেনাকাটা করবে।প্রতিদিন এক জামা পড়ে যায়,তাই সবাই কিভাবে যেন তাকায়।কলকাতায় রাতও যেন দিনের মতো।বেশ মানুষ জন ঘুরা ফেরা করে।
কাব্য একটি কাপড়ের দোকানে ঢুকে দুইটা শার্ট কিনলো।একটা কালো, আরেকটা হালকা নীল।তেমন দামি না, তবে পড়া যাবে।
জামা কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।আজ অনেক বাতাস বাইরে,সারাদিন খুব গা জ্বালানো রোদ থাকে।সন্ধ্যা হলে হালকা বাতাস,আবার মাঝে মধ্যে ঝড়ও হয়।

কাব্য দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু গাড়ির জন্য হাত দেখাচ্ছেনা।বাতাসটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা হয়তো।হুট করে কেউ একটা পাশে এসে দাঁড়ালো
কাব্য পিছু ফিরে দেখে সেই মেয়ে
-আপনি?এখানে কি করছেন?
-আমি হাটছিলাম
-এতো রাতে একা একা হাটছেন?ভয় করেনা?
-ভয়?কিসের ভয়।আমি কাউকে ভয় পাইনা।
-অহ তাই নাকি।তো অইদিন হুট করে চলে গেলেন যে?
-কোনদিন আমার তো মনে পরছেনা। একটা কথা শুনবেন, আপনাকে নীল থেকে কালো তে বেশি মানাবে।

কাব্য ফিরে দেখে কেউ নেই।

উনি আবার কোথায় চলে গেলেন।উফ ভালো লাগে না।এবারও নাম টা জানা হলো না।কিন্তু উনি কি বলে গেলেন,কালো জামা। মানে,উনি কি ভাবে জানলেন।
উফ কোথায় চলে গেলেন।
হঠাৎ একটা গাড়ি সামনে এসে পরলো।আচমকা ভয় পেয়ে গেলো কাব্য।

বাসায় ফিরে শুয়ে পরলো,আজ কাব্যের মন ভালো, আবার ভালো নেই।কারণ জানেনা।
চোখ বন্ধ করে ভাবছে,
আজকেও উনি সাদা শাড়ি পড়েছিলেন।হাতে একটি লোহার চুরি ছিলো।অন্য হাতে কিছু ছিলো না।কপালে কোনো টিপ ছিলো না তবে চুল গুলো চোখের উপর এসে পরছিলো।
আরেকদিন দেখা হলে, হাত ধরে নাম জিজ্ঞেস করব।তারপর আর পালাতে পারবে না।

সারদের সুর টা মনে হচ্ছে আজকে অনেক কাছে।কাব্য এসব ভাবতে ভাবতে আর ঘুমাতে পারছেনা।এর মধ্যে আবার সুমধুর সুর।

ইস,যদি জানতে পারতাম কে বাজায় এতো সুন্দর সারদ।

কাব্যর এই সারদের সুর অনেক প্রশান্তির মনে হয়।আজকে ঘর থেকে একটি চেয়ার এনে বসেছে।ছাদে আবার মশাও আছে।চেয়ারে বসে চাঁদ দেখার মজা আলাদা।আজকের চাঁদ খুব বড়।

অবশ্য লোকে বলে চাঁদনী রাতে প্রেমও অনেক গভীর হয়।কাব্য সারদের সুরের তালে একটা সিগারেট জ্বালালো। পা দুলাচ্ছে আর ফু দিয়ে ধোয়া ছাড়ছে।অমনি পিছোন থেকে কে জানি বলে উঠলো

কাব্য”!!!

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হলো কমেন্ট করে জানাবেন।পাশে থাকবেন।ধন্যবাদ)