আমার প্রিয়দর্শিনী তুমি পর্ব-০২

0
413

#আমার_প্রিয়দর্শিনী_তুমি(০২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

গাড়ি থেকে নেমে,অজানা ভয়ে ঘা শিহরণ জাগে তাকিয়ার। মতলব এক্সপ্রেস থেকে নেমে, আরো দুটি গাড়ি চেঞ্জ করতে হয়েছে। এখন রাত সোয়া নয়টা বাজে।চারিদিকে অন্ধকারে ডুবে আছে।শুধু সামনে থাকা কয়েকটা মুদি দোকানের আলো জ্বলছে। দোকানে লোকজন চায়ে চুমুক দিতে দিতে,কেউ বা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে খোশ মেজাজে গল্প গুজব করতে ব্যাস্ত।
এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় তাকিয়া। দোকানের কাছাকাছি গিয়ে কি বলবে ঠাওর করতে পারছেনা। একটু ভেবে বলল আচ্ছা এখানে ব্যাপারি বাড়ি কোন দিকে একটু বলবেন?

নিজেদের গল্প বাদ দিয়ে সবার নজর মেয়েটার দিকে যায়। একজন বলল,বেহারি (ব্যাপারি)বাড়ি তো এই গেরামে(গ্রামে)দুইডা।আন্নে কোন বাইত যাইবেন?

তাকিয়া বললো,
-“ইসরাক দের বাড়িতে যামু (যাব)

ইসরাক নামে তো এই গেরামে কেউ নাই?

এরকম বিয়ের শাড়ি পরিহিত মেয়েকে দেখে, অনেকে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন রকম আলোচনা শুরু করে দিয়েছে।

এদিকে লোকটার কথায় থমকে গেল তাকিয়া। তাহলে কি সে ভুল ঠিকানায় চলে আসছে?একজন লোক দোকানে এসে বলল, -“মফিজ চাছা (চাচা)এক কেজি চিনি দেন তো? তখন দোকানে বসা একজন বলল, -“দুলাল মিয়া তুমি তো জামাল বেহারি বাড়িত ফরমায়েশ খাট।তো ঐ বাইত ইশরাক নামে কেউ আছেনি?

দুলাল জবাব দিল,
-“ক্যান দরকার কি?

ঐ মাইয়াডায় খোঁজ নিতে আইছে।

দুলাল এতক্ষণ তাকিয়া কে খেয়াল করেনি, লোকটার ইঙ্গিত অনুসরণ করে ঘার ঘুরিয়ে দেখে তাকিয়া কে।তাকিয়া কে দেখেই বুঝে যায়,নিশ্চ‌ই কোন ঘাপলা আছে। এখন ইসরাক ভাইয়ের কথা বললে, গ্রামের মানুষ কুটনা রটাতে দ্বিতীয় বার ও ভাববে না।তাই চিনি নিয়ে দুলাল বললো,
-“আমার লগে আহেন আমি আন্নেরে নিয়া যামুনে।

আশার আলো দেখতে পেয়ে,এক কথায় দুলালের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে তাকিয়া।
দোকানের লোকজন পিছু ডাকে কিন্তু দুলাল জবাব না দিয়ে তড়িগড়ি করে সামনে এগিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বলল,আন্নে মুনতাসির ভাইরে কেমতে (কিভাবে)চিনেন?

তাকিয়া এবার বুঝতে পারলো, ইসরাক কে গ্রামের মানুষজন মুনতাসির নামে চিনে।যার পুরো নাম “ইসরাক মুনতাসির”।

দুলাল তাকিয়ার থেকে কোন জবাব না পেয়ে, মনে মনে উশখুশ করছে জানার জন্য।তাকিয়া নিজের ভাবনা তে মগ্ন হয়ে আছে,তাই দুলালের প্রশ্ন একপ্রকার ভুলেই গেছে। তারপরের ঘটনা তো জানাই।

________

কান চেপে ধরে,”মিমা”বলে শোয়া থেকে ওঠে বসে তাকিয়া! আধো আধো ভাবে চোখে পাতা খুলে দেখে,এক জোড়া চোখ ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আশেপাশে চোখ বুলাতে, আরও অনেক মানুষজন দেখতে পায় তাকিয়া। সবাই গভীর আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে তাকিয়া’র দিকে।
সামনে বসা ভদ্রমহিলা বলল তুমি কে? আমাকে মিমা বলে ডাকলে কেন?
এমন প্রশ্নে বরকে যায় তাকিয়া! এখন কি জবাব দিবে সে?তার যে স্বপ্নের কথা কাউকে বলা ঘোর নিষেধ!
এর কোন জবাব না পেয়ে, চুপ করে বসে রইলো তাকিয়া।পাশ থেকে একজন ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল এই মাইয়া?এমনে চুপ ক‌ইরা আছো ক্যান,কতা (কথা)ক‌ও না?এমনে সং সাইজ্জা এবাইত আওনের মতলব কি?

________

তাকিয়া যখন সেন্সলেস হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তখন দুলাল চিৎকার করে সবাই কে ডাকে। বাড়ির সবাই তাকিয়া কে দেখে অবাক হলেও সেই মূহূর্তে সব ভাবনা নিজেদের মধ্যে রেখে,তাকিয়া’কে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর ইসরাকের চাচাতো ভাই সোহেল তাকিয়া’কে চ্যাক‌আব করে বলে, তেমন কিছু হয়নি। কোন কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিল তাই জ্ঞান হারিয়েছে, কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরে আসবে। সোহেল একজন ডাক্তার তাই তাকিয়া’র প্রাথমিক চিকিৎসা করে।

________

ভদ্রমহিলার কথায় তাকিয়া মিনমিনে গলায় জবাব দেয় আমি এ বাড়ির ছেলের বউ।
এমন সোজাসাপ্টা জবাবে, সকলে বিষ্ময়ে হাঁ হয়ে যায়।

যিনি কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করলেন, তিনি ইসরাকের চাচিমা “লাবিবা”।
তাকিয়া’র মুখে এবাড়ির ছেলের বউ কথাটা শুনে, হাউমাউ করে বিলাপ শুরু করে দিয়েছেন।আর বলছেন,বাবু’রে এ তুই কি করলি? তুই কাউরে না জানায়া শেষ মেষ বিয়া ক‌ইরা লাইলি! তোর বাপ তো আর বাড়িত জায়গা দিব না।এ তুই কি করলি বাবু?

তাকিয়া ভাবে, উনি কে? ইসরাক কে বাবু বলে সম্বোধন করছে!মা হয়তো। মায়েরা তো আদর করে কতো কিছুই বলে ডাকে।
বাবা আর আম্মু যেমন আমাকে মামনি বলে ডাকে।

রাত বেড়ে চলেছে,
তাই জামাল ব্যাপারি(ইসরাকের বাবা)সব কিছু শুনে বলল, আগামীকাল এর বিহিত করা হ‌ইবো।বাবু ছাড়া তো আর সমাধান করা যাইবো না,হেরে (তারে)ডাইকা এর বিহিত করন লাগবো।এহন সবাই সবার ঘরে যাওগা।

সবাই যেতে,তাকিয়া অনুভব করলো তার খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু কাউকে তো বলতে ও পারবে না। কি না কি মনে করে।
সেই দুপুর থেকে এক শাড়িতে আছে, শরীর ও কেমন মেচমেচ করছে।সব‌ই কপালের দোষ!ইসরাকের ভালোবাসা যদি আগে উপলব্ধি করতে পারতো, তাহলে এই দিনটা খুব মনমুগ্ধকর হতে পারতো।সে যাই হোক এখন তো আর কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় তাই সামনে কি হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে।

কিছুক্ষণ পর দরজা ঠেলে, একটা পাতলা ঘরনের চিকন কন্ঠের অধিকারী মেয়ে ঘরে ডুকে। মেয়েটার বয়স তের কি চৌদ্দ হবে, দেখতে খুব সুন্দরী। তবে মনে হচ্ছে, নিজের যত্ন নেওয়া হয় না।যার ফলে সৌন্দর্যটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
মেয়েটার হাতে খাবার প্লেট দেখে, খুশিতে তাকিয়া’র মুখমণ্ডল চকচক করে ওঠে।
মেয়েটা মুখে হাসি ধরে রেখেই কাছে এসে বলল,
লন(নেন)ভাবি খাইয়া লন।

খাবার প্লেট নিতে নিতে তাকিয়া জিজ্ঞাসা করে, তুমি ইসরাকের কি হ‌ও?

ইসরাক এর মা তার ছেলেকে ইসরাক বলে ঢাকে।আর বাকি সবাই মুনতাসির বলে ঢাকে।
সে জন্য মেয়েটার চিনতে ভুল হয়নি ইসরাক কে।তাই হেসেই বলল ভাবি আমি এ বাড়ির কেউ না। আমি কাম ক‌ইরা খাই এ বাইত।

আচ্ছা।
তোমার নাম কি?

মেয়েটা ছোট্ট করে জবাব দিল”সুখী”

বাহ্ খুব সুন্দর নাম তোমার।

নিজের নামের প্রশংসা শুনে সুখী খুশি হয় খুব। মেয়েটা আসলেই সুখী।যে সব সময় হাসিখুশি থাকে, সেই তো সুখী মানুষ।

সুখী কে খুব পছন্দ হয়,তাকিয়ার।খাবার খেতে খেতে বলল সুখী তুমি খাইছো?

হ’ ভাবি খাইছি।

সাহারা দরজার কাছে এসে বলল, সুখী এদিকে আয়? সুখী যাওয়ার পর সুখীর হাতে একটা শাড়ি দিয়ে বললেন,
-“মেয়েটা কে বল শাড়ি টা পাল্টে এটা পড়ে নিতে।
সুখী আইচ্ছা বলে, শাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকে। সাহারা এক পলক তাকিয়া’কে দেখে,স্থান ত্যাগ করে।

ততক্ষণে তাকিয়ার খাবার খাওয়া শেষ হয়। সুখী তাকিয়া’কে শাড়ি দিয়ে বলল,
-“বড় আম্মা ক‌ইছে,এইডা ফ‌ইরা নিতেন।

শাড়ি দেখে তাকিয়া মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সাহারার প্রতি। মানুষটা বাহিরে থেকে ঘম্ভির্য দেখালেও মনটা খুবই ভালো।সুখী কে জিজ্ঞাসা করে উনি ইসরাক এর কি হন?
-” উনিই তো ইসরাক ভাইয়ের আম্মা!

এ কথা শুনে তাকিয়া চমকে বিরবির করে বলে উনি তাহলে আমার শ্বাশুড়ি মা!
-“আচ্ছা সুখী বাথরুম টা কোথায়?
-“আমার লগে আহেন।

পুরোনো বাড়ি বলে,বেড রুমের সাথে এটাচ বাথরুম নেই। রুম থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই বাথরুম। সুখী দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-“কোন কিছুর দরকার হ‌ইলে আমারে ডাইকেন।

তাকিয়া সম্মতি দিয়ে, বাথরুমে ঢুকে যায়। বাথরুম টা তুলনা মুলক একটু বেশিই বড়। এখনকার দিনে যেই ছোট ছোট বাথরুম করা হয় তাও আবার এটাচ টয়লেট থাকে। কিন্তু এটাতে নেই।
যাই হোক,তাকিয়া হালকা করে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসে। এখন খুব শান্তি অনুভব করছে,ঘুম টাও ফুরফুরে হবে।

_______

জামাল ব্যাপারি এই গ্রামের একজন গন্যমান্য ব্যক্তি।এই গ্রাম থেকে শুরু করে আশেপাশের অনেক গ্রামের, দরবার কারবারে বিচারক হিসেবে তাকে ডাকা হয়। এখন যদি গ্রামের লোকজন জানতে পারে তার বাড়ির ছেলে এরকম কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে বসে আছে, তাহলে মানসম্মানের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
জামাল ব্যাপারি একজন বিচক্ষণ মানুষ।তাই ঠিক করলেন পরিবারের মধ্যেই যেন,সব কিছু ঠিক করে নেওয়া হয়।

খলিল ব্যাপারি ক্রোধ নিয়ে বলল,
-“তার আগে ওর কঠিন শাস্তি পাওন লাগবো।

লাবিবা ছেলের শাস্তির কথা শুনে আর্তনাদ করে ওঠে বলে,
-“তুমি কেমন বাপ?বাপ হয়ে ছেলের শাস্তির কতা ক‌ও!

খালিল ব্যাপারি রেগে বললেন,
-” এমন বখাটে ছেলের বাপ হ‌ইছি এডাই তো আমার পোরা কপাল। তোমার আস্কারা পাইয়া পাইয়া ছেলেডা আরো এমন হ‌ইছে।
“শনি মঙ্গলবারে সোহেল আর মুনতাসিরের পাওডি দুইয়া দুইয়া ওরে পানি খাওয়াতে পারো না? তাইলে যদি অগো মতো একটু অ‌ইতো!

আনাস উরফে বাবু,,সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে করতে বলল,
-“বড় আব্বা আমাকে ডাকছেন?

সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাবুর উপর। এতো স্বাভাবিক ভাবে বাবু কথাটা বলল যেন কিছুই ঘটেনি।
লাবিবা দৌড়ে এসে বলল,
-“বাবু তুই আমারে একবার ক‌ইতি তুই বিয়া করবি ঐ মাইরে!আমারে ক্যান ক‌ইলি না?
-“আম্মা পাগল হ‌ইলা নাকি!কি আবল তাবল কথা ক‌ইতাছো?

ইসহাক ব্যাপারি আগে আগে বললেন,
-“কেন তুই বিয়ে করিসনি?

বাবু বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!বিষ্ময় কাটিয়ে বললো,
-“ছোট আব্বু কে বলছে? এমন আজেবাজে কথা?নাম বলেন আমি তারে জে’ন্ত ক’বর দিমু!

রাগে শরীর রি রি করছে বাবুর।

জামাল ব্যাপারি বললেন,
-“সাহারা মাইয়াডারে এহানে নিয়া আইয়ো।

সাহারা সুখী কে ইশারায় আনতে বলে। সুখী আদেশ পেয়েই দৌড়ে যায়।সুখী বলতেই, ভয়ে ভয়ে তাকিয়া বসার ঘরে আসে।তাকিয়া কে দেখতে পেয়েই,জামাল ব্যাপারি বললেন,
-“এই মেয়ে অর লগে তোমার বিয়া অ‌ইছে ক‌ইছিলানা?
বাবু কে দেখিয়ে বলল কথাটা।
তাকিয়া জামাল ব্যাপারির হাত অনুসরণ করে তাকায়। তাকিয়ে দেখে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলে।সাথে সাথে বলে,
-“না না আপনারা ভুল ভাবছেন! উনার সাথে আমার বিয়ে হয়নি।

খলিল ব্যাপারি উত্তেজিত হয়ে বলল,
-“তাহলে কার লগে হ‌ইছে?

তাকিয়া একটু সময় নিয়ে বললো,
-“ইসরাক মুনতাসির”!

নামটা যেন সবার কানে প্রতিধ্বনি হতে থাকলো! সবার মাঝে পিন পিন নিরবতা। সবার মাথায় যেন বাজ পড়লো! কি বলল এই মেয়ে?দশ গ্রাম খুঁজেও ইসরাকের মত ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।অথচ এই মেয়ে বলছে, নিজের পরিবার কে না জানিয়ে ইসরাক বিয়ের মতো বড় একটা কাজ করেছে,এ যে অসম্ভব!

তাছাড়া ইসরাক একজন আর্মি অফিসার! বর্তমানে সে রাজশাহী সেনানিবাসে আছে, তাহলে বিয়ে করলো কখন?…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।