আমার প্রিয়দর্শিনী তুমি পর্ব-০৩

0
344

#আমার_প্রিয়দর্শিনী_তুমি(০৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

তাছাড়া ইসরাক একজন আর্মি অফিসার! বর্তমানে সে রাজশাহী সেনানিবাসে আছে, তাহলে বিয়ে করলো কখন?…..

তোমার কোন ধারণা আছে, তুমি কার সম্বন্ধে কি ক‌ইতাছো?
শান্ত কন্ঠে বললেন জামাল। ভিতরে যদিও আকাশ সমান রাগ, কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করলেন না।

ভয়ে শরীর কাঁপছে তাকিয়ার, আজকে তার পাশে ইসরাক থাকলে হয়তো সেই সব কিছু ম্যানেজ করে নিত। কোথায় আছে ইসরাক? এতো অভিমান তাকিয়ার প্রতি!

লাবিবা আনন্দে আত্মহারা, এতো দিন সবাই তার ছেলে কে বাজে মন্তব্য করে আসছে। অপরদিকে মুনতাসির এর প্রশংসা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল! এবার খুব শান্তি শান্তি লাগছে।শুধু তাই নয় এই আনন্দে ফকির মিশকিন কে দশ টাকা দিবে বলে ঠিক করলেন!

খলিল ব্যাপারি নির্বাক হয়ে বসে রইলেন, এতো দিন ভাতিজার এতো প্রশংসা করে এসে এখন এতো বড় একটা খবর ঠিক নিতে পারছেন না।এ নিয়ে লাবিবা ও কথা শুনাতে ছাড়বে না, সেখানে গ্রামের মানুষজন কি বলবে?আল্লাহ জানেন।

ইসহাক ব্যাপারি বলল তোমার কাছে কোন প্রমাণ আছে?যা তুমি বলছো।

জ্বি, আছে।

কোথায় দেখাও,দেখি!

তাকিয়া সবাই কে অপেক্ষা করতে বলে, রুমে যায়। তারপর দ্রুত পায়ে আবার ফিরে আসে। এসে ফোনের গ্যালারি গেটে, ইসরাক মুনতাসির আর তাকিয়া’র বিয়ের ছবি দেখায়। সবাই ছবি দেখে হতভম্ব।
সাহারা ছেলের এরকম কান্ড সহ্য করতে পারলো না, আঁচল গুঁজে কেঁদে দিল।
বিচার সমাবেশ এখানেই স্থগিত হয়ে গেল। জামাল ব্যাপারি থমথমে মুখে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সাহারা অনেক আগেই স্থান ত্যাগ করেছেন।লাবিবা আনন্দ পেলেও বাহিরে প্রকাশ করলেন না। বাড়ির বড়রা সবাই যার যার ঘরে চলে যায়।

আনাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ার দিকে! তারপর সেও ঘরে চলে যায়।

বড়রা যেতেই,ছোট গুলা সব হামলে পড়ে তাকিয়া’র উপর। সাথে আছে সোহেলের ব‌উ টুম্পা,তারা খুশিতে আটখানা হয়ে তাকিয়া কে ঘরে নিয়ে গিয়ে,ঘিরে ধরে।

আনাসের বোন আনিসা আর আরিসা, দু’জনেই জমজ।আরিসা বললো,
-“ভাবীমণি তুমি কত্ত কিউট।
আনিসা বললো,
-“আল্লাহ ভাইয়া বিয়ে করছে আর আমরা জানতেই পারলাম না, আমার তো বিশ্বাস হ‌ইতাছে না।

আমার নিরামিষ দেবর কেমনে তোমারে বিয়ে করলো ক‌ও তো?

টুম্পা’র কথায় বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়া বললো, -“নিরামিষ দেবর?
-“হুম,নিরামিষ ই তো। তুমি জানো না ওকে যে মেয়েরা প্রপোজ করতো তাদের কে ও কানে ধরিয়ে ছারতো!
আচ্ছা মুনতাসির তো সেনানিবাসে আছে, সিলেট। তাহলে তোমাদের বিয়ে কিভাবে হলো?ও কি ছুটিতে এসেছে?
আর আসলেই বা মুনতাসির কোথায়?
তুমি একা আসলে যে এখানে?
-“আচ্ছা ভাবী,উনি সেনানিবাসে কি করেন?

তাকিয়া’র এরকম প্রশ্ন শুনে, টুম্পা, আনিসা আরিসা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে…যেন তাকিয়া কোন জোকস্ বললো।তাকিয়া বোকার মতো তাকিয়ে রইলো,সে কিছুই বুঝতে পারলো না।

-“তোমার উনি একজন আর্মি অফিসার! তুমি জানো না?

টুম্পা’র কথা শুনে তাকিয়া বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!কি বলে? উনি আর্মি!

সেই ছোট্ট বেলা থেকে তাকিয়ার ভিশন পছন্দ, পুলিশ, আর্মি।যদিও এখন আর পুলিশ ভালো লাগে না।

আনিসা বললো,
-“ভাবীমণী তুমি সত্যি জানতা না ভাইয়া যে আর্মি?
-“না।
-“আচ্ছা সেসব নিয়ে পরে কথা হবে।এখন বলো কিভাবে কি হলো?

টুম্পা’র সাথে আনিসা আর আরিসা উৎসাহ নিয়ে বললো,ভাবীমণী কেমনে কি হলো ক‌ও তো?

খাটের মাঝে সব গুলো ঘিরে বসে তাকিয়া’র।
তাকিয়া বললো,
-“আচ্ছা আমি তো তোমাদের পরিচয় জানলাম না এখনও?

আনিসা আরিসা’কে দেখিয়ে বললো,
-“আমি আর ও তোমার দুই মাত্র ননদিনী।
বুঝলে?
-“হুম।

তারপর টুম্পা বললো,
-“আমি তোমার একমাত্র জা। মানে মুনতাসির এর ভাইয়ার (সোহেল)ব‌উ। এইবার শুরু করো, তোমাদের লাভ স্টরি!

বিনিময়ে তাকিয়া সবাইকে হাসি উপহার দিয়ে যেই বলতে যাবে তখন পিছন থেকে কেউ একজন এসে তাকিয়া’র মাথায় গাট্টা মারে।আউচ বলে মাথায় হাত দিয়ে ঘুরে দেখে,একটা ছেলে হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেনা নেই জানা নেই হঠাৎ এরকম কান্ডে হতভম্ব হয়ে যায় তাকিয়া।

আরিসা ধমক দিয়ে বললো,
-“এই এ.বি.র বাচ্চা তুই কার লগে দুষ্টামি করোস,বেক্ক’ল! উনি আমাদের মেজ ভাবি। উনার সাথে অন্তত দুষ্টামি বাঁধ দে?

ছেলেটা ভেংচি কেটে বললো,
-“তো কি হইছে? ভাবির সাথেই তো আরো বেশি দুষ্টামি করে মানুষ।
তাকিয়া বললো কে ও?
আনিসা বলল,
-“ইনি এ বাড়ির সয়তানের হাড্ডি,ইতর ছোট পোলা এ.বি.
-“এ.বি.আবার কেমন নাম?
-“এ.বি. মানে আবু বকর সিদ্দিক।আমরা ওকে এ.বি. বলে ডাকি।
-“ওহ্ আচ্ছা,মা শা আল্লাহ সুন্দর নাম।
তাকিয়াও দুষ্টুমি করে বললো, আমি প্রথমেই বুঝতে পারছি এ যে একটা সয়তানের হাড্ডি,
হা হা হা….

এ.বি. বললো,
-“আমার ও দিন আসবে… তারপর চলে যায়। সবাই হাসতে হাসতে শেষ।
তারপর তাকিয়া শুরু করে…

“অতিত”

কাকলি ব্যাস্ত পায়ে, কাজের মহিলা কে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তাকিয়া বললো,
-“আম্মু আজকে কি বলতো?
-“ঐ ছেলেটা তোকে পছন্দ করেছে। আজকে তাঁরা আংটি পরিয়ে বিয়ের ডেইট পাকা করে যাবে।

-“আম্মু তুমি না ক‌ইছিলা(বলেছিলে),দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না। এখন কেন এসব ক‌ইতাছো?
-“ছেলেটা খুব ভালো, বিয়ের পর পরই ইতালি নিয়ে যাবে তোকে।
-“এখানেই তো প্রবলেম আম্মু! আমি আমার দেশ ছেড়ে কোথাও যাইতে চাই না। নিজের দেশকেই এখন অবধি দেখি নাই। সেখানে অন্য দেশে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই।
-“আমি কি একবারও তোর ইচ্ছে জানতে চাইছি?চাইনি তো!
-“আমমমু….

তাকিয়া হাজার বলেও এনগেজমেন্ট আটকাতে পারল না। মুহিব রহমান এর কথা ও পাত্তা দেয়নি কাকলি।কাকলি তাকিয়া’কে,যত দ্রুত সম্ভব দেশ থেকে পাঠাতে চান।তার মতে তাকিয়া দেশে থাকলেই হারিয়ে ফেলবে!তাই এতো দ্রুত বিয়ের আয়োজন।

পাত্র সেদিন ই আংটি পরিয়ে বিয়ের ডেইট পাকা করে তার পর যায়।যাওয়ার পর নিশাত (পাত্র) কলে,সে কি আলাপ তাকিয়া’র সাথে। তাকিয়া তার আম্মুর ভয়ে ভালো করে কথা বলে ঠিক কিন্তু, মনে মনে বলে টাকলু তোকে যদি আমি পানিতে চুবাইতে পারতাম! তাহলে আমার রাগ কিছুটা হলেও কমতো‌।

নিশাত শাহরিয়ার এমনিতে সুদর্শন পুরুষ বটে কিন্তু, মাথার বেশিরভাগ চুল ঝরে গেছে অকালে।
“লোক মুখে শোনা যায়,টাকা ওয়ালা ছেলেদের নাকি মাথায় চুল থাকে না”।
নিশাত শাহরিয়ার এর ক্ষেত্রে কথাটা সত্যতা আছে।

যাই হোক,
বিয়ের দিন উপস্থিত হয়।তাকিয়া তার বাবা মুহিব রহমান এবং বেষ্টু সুমাইয়া যাকে ভালোবেসে সুমু বলে ডাকে তাকিয়া।সুমুর সাথে প্লান করে পালিয়ে যাওয়ার।তো পার্লার থেকে দুটো মেয়ে আনা হয় তাকিয়া’কে সাজানোর জন্য। কাকলি কোন রিস্ক নিতে চায় না তাই তাকিয়া আবদার করার পরও পার্লারে গিয়ে সাজানোর অনুমতি দেননি। বাসায় নিয়ে এসেছেন সাজানোর জন্য।
তাকিয়া আগে থেকে ঘুমের ঔষধ সংরক্ষণ করে রাখে প্লান মাফিক।
সাজানোর এক ফাঁকে মুহিব রহমান কে বলে, পার্লারের মেয়েদের জন্য ঠান্ডা পানিও দিতে।আর ইশারায় কিছু ইঙ্গিত করে দেয়।

মুহিব মেয়ের ইঙ্গিত বুঝে,নিজ হাতে খুব যত্ন সহকারে নিয়ে আসে ঠান্ডা কোকাকোলা। তারপর মেয়ে দুটি হাসি মুখে পান করে নেয়। তারপর আবার তাকিয়া’কে সাজানোতে মনোযোগ দেয়।
অনেক সময় পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মেয়ে গুলোর ঘুমের কোন নাম গন্ধ নেই। তাকিয়া চিন্তায় পড়ে যায়, মুহিব ঠিক মতো ঘুমের ঔষধ মিশাতে পারলো কিনা। তাকিয়া আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারছে না।সুমুর সাথে কথা হয়েছে মেসেজে সুমু বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

মেকআপ করা যখন প্রায় শেষের দিকে তখন মেয়ে দুটো ঘুমিয়ে পড়ে। তাকিয়া রুমের বাহিরে উঁকি দিয়ে কাজের মহিলা কে দিয়ে মুহিব কে ডেকে আনে। মুহিব এসে বললো, আমি তোর আম্মু কে দেখছি তুই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যা। তাকিয়া চোখে পানি নিয়ে বাবা কে জরিয়ে ধরে। মুহিব ও কেঁদে দেয়, তারপর তাড়া দিয়ে বলে সাবধানে থাকিস, কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবি। কেমন?
তাকিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে তারাতাড়ি করে একটা বোরকা পরে নেয়,বিয়ের শাড়ির সাথেই। তারপর আল্লাহ তা’আলা কে স্মরণ করে বেরিয়ে পড়ে।

গেইটে এসে বাদে বিপত্তি!দারোয়ান ব্যাটা বলল,ম্যাডাম বলেছেন উনার অনুমতি না নিয়ে যেন কাউকে বাসা থেকে বের হতে না দেওয়া হয়। তাকিয়া বুঝতে পারলো না এতো সিকিউরিটি কেন?তার মা কি কোন ভাবে সন্দেহ করেছে?

তাকিয়া’র ভাবনার মাঝে দারোয়ান খালেক বললেন,
-“আমি ম্যাডাম কে কল করছি কিন্তু উনি রিসিভ করছেন না। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন আমি ম্যাডাম কে বলে আসছি।
তাকিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।খালেক চলে যেতেই তাকিয়া বেড়িয়ে যায় গেইট খুলে। ভাগ্যিস গেইটের ডুপলিকেট চাবি ছিল।
তারপর বাসা থেকে বের হয়ে সোজা সুমুর সাথে গাড়িতে উঠে যায়।

গাড়ি গিয়ে থামে কাজী অফিসের সামনে। তাকিয়া বিষ্ময়! নিয়ে প্রশ্ন করে এখানে কেন?
-“এখানে আসার কারণ আছে।শুন একটা ভালো বাসা পেয়েছি তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবি। তবে একটা কাজ করতে হবে!

সুমুর কথায় প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় তাকিয়া।
সুমু ভয়ে ভয়ে বললো, দোস্ত শোন না?
-“হুম বল, শুনছি।
-“তোকে বিয়ে করতে হবে!

কথাটা উচ্চারণ করে সুমু খিচে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তাকিয়া হোয়াট?বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তোর মাথা ঠিক আছে? বিয়ে করতাম না বলে বাসা থেকে পালিয়ে আসছি।আর তুই কিনা ক‌ইতাছস বিয়ে করতাম,কাকে?
-“রাগছিস কেন? আমার পুরো কথাটা আগে শুনে নে।
-“আমার কোন কথা শুনতে হবে না।

সুমু অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বললো,
-“শোন দোস্ত তুই যদি ছেলে টা কে বিয়ে করিস নিশ্চিন্তে থাকতে পারবি। তোদের বিয়েটা শুধু নামমাত্র হবে।

মাহিয়ারা বললো,
-“কেমনে সম্ভব?
-“কিছু সর্ত থাকবে যেমন ধর একে অপরকে টাচ করবি না।নিজেদের ইচ্ছামত চলাফেরা করবি।
তারপর নিজের ইচ্ছা মত যখন ইচ্ছা ডিবোর্স নিয়ে নিবে।আর যদি ইচ্ছা হয় সারাজীবন একসাথে থাকবি তো থাকবি।
-“ইম্পসিবল! তুই কেমনে ক‌ইতাছস এগুলা?চিনি না জানি না বিয়ে করে নিব?
-“আর কোন উপায় নাই দোস্ত।দেখ অন্য কোথাও থাকলে তোর আম্মু ঠিক খুঁজে বের করে তোকে আবার বিয়ে দিয়ে দিতে চাইবে। আর আমাদের বাসায় ও তো থাকতে পারবি না, আম্মু আব্বু আন্টি কে বলে দিবে।

তাকিয়া বিষয়টা ভেবে দেখলে আসলেই,এই মুহূর্তে কোথায় থাকবে? হোস্টেলে থাকার মতো ও সুবিধা নেই। হোস্টেলের মতো পরিবেশে কখনোই থাকতে পারবো না তাকিয়া।তাই কি করবে উপায় না পেয়ে থম মেরে বসে রইলো।

সুমু চান্স পেয়ে, আরো অনেক কিছু বলতে শুরু করে দিল।এক পর্যায়ে তাকিয়া বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল।সুমু কল করে কাউকে ঢেকে নিল। তারপর দুইটা ছেলে আসলে কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে।

তাকিয়া একবার নজর বুলিয়ে দেখে তার হবু স্বামীকে। দেখতে সুন্দর সুদর্শন পুরুষ বটে। কিন্তু তার পরেও তো সম্পূর্ন অচেনা একজন মানুষ।সাইন করার সময় নামটা দেখলো,
“ইসরাক মুনতাসির”…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।