আমার প্রিয়দর্শিনী তুমি পর্ব-১০

0
265

#আমার_প্রিয়দর্শিনী_তুমি(১০)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

তাকিয়া’র চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না।যার ফলে মাথাব্যথা করছে,গলা ধরে যাচ্ছে। নিচে বসে ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে।এর মধ্যে মাগরিবের আজান কানে ভাসছে। খুব কষ্ট হচ্ছে,বসা থেকে দারানো শক্তি টুকুও যেন পাচ্ছে না। এই সময় তো তাঁকে নামাজ পড়তেই হবে, নামাজ পড়ে তার প্রিয় স্যারের জন্য দু’হাত তুলে মোনাজাত করতে হবে!মহান রাব্বুল আলামীন কে তো বলতে হবে তার প্রিয় স্যার কে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করতে।
এমনিতেই তাকিয়া বিনা কারণে নামাজ কাজা করে না, কিন্তু এখন তো আরো আগেই কাজা করবে না।
অনেক সময় নিয়ে নিজেকে শক্ত করে,পিছনে রেলিংয়ের ওপর হাত রেখে, কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ালো তাকিয়া। তারপর কাঁপা কাঁপা পায়েই নিচে নেমে আসল। শেষ শিড়ীতে এসে হোঁচট খেতে নিলেই,ইসরাক ধরে নিল।আর বললো,
-“আপনি কোথায় ছিলেন বলুন তো?

তাকিয়া জবাব দিলো না।ইসরাক কে ছাড়িয়ে বাথরুমে গিয়ে অযু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।

সেই কখন আযান হয়েছে,ইসরাক মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে গেছে অথচ তাকিয়া এতোক্ষণে নামাজ পড়ছে।যে তাকিয়া আযান হ‌ওয়ার সাথে সাথেই নামাজ আদায় করে নেয়, তার আজকে এতো লেইট?

ইসরাক কিছুই বুঝতে পারলো না। তাকিয়া’র নামাজ শেষ হ‌ওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল। তাকিয়া কে তার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না, তাই জানতে হবে কি হয়েছে তাকিয়া’র।

নামাজ শেষে তাকিয়া যে মোনাজাতে কাঁদছে তা বেশ বুঝতে পারলো ইসরাক। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না, কারণ তাকিয়া মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে তার কষ্ট গুলো বলছে। একজন মুসলমান হিসেবে সেখানে হস্তক্ষেপ করা ইসরাকের কাম্য নয়।তাই ছটফটানি নিয়েও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

মোনাজাত শেষ করে তাকিয়া দুই হাতে মুখ চেপে ধরে রেখেছে।ইসরাক আর বসে না থেকে জায়নামাজের পাশে বসে তাকিয়া’র হাত দুটো ধরে সরিয়ে নিল।
ছোট ছোট চোখ দুটো অশ্রুতে ডুবে আছে।
ইসরাক বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“কি হয়েছে আমাকে বলা যায় না?

তাকিয়া আর নিজেকে আটকাতে পারলো না, ইসরাক’কে ঝাপটে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল।যেন এতক্ষন এই স্থানটির‌ই অপেক্ষা করছিল কাঁদার জন্য।ইসরাক তাকিয়া’র চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
-“এই যে সবুজিনী কাঁদছো কেন? বলো আমাকে। না বললে কিভাবে বুঝবো বলোতো?
কিন্তু না ইসরাক ব্যার্থ। তাকিয়া’র কান্নার কোন থামাথামির নাম নেই।ইসরাক তো জানেই না কি কারণে তাকিয়া কাঁদছে।ঘটনা সম্পর্কে অবগত থাকলে তো শান্তনা দিতে পারবে,এখন কিছুই না জেনে কি শান্তনা দিবে?
ইসরাক আপাদত চুপ করে, তাকিয়া’র চুলে বিলি কাটতে লাগল।
আলিয়া অর্পি পর্যন্ত এসে জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে? কিন্তু কোন জবাব নেই।এক‌ই ভাবে কাঁদছে তাকিয়া। আলিয়া আর থাকলো না,ইসরাক সামলে নিবে ভেবে অর্পি কে গিয়ে চলে গেল।
এর প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট পর ইসরাক খেয়াল করলো তাকিয়া চুপ করে আছে আর কাঁদছে না।
ইসরাক তাকিয়া’র ওরনা টা মুখ থেকে সরিয়ে দেখে,বেচারি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।ইসরাক মুচকি হেসে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে খাটে শুয়ে দিল। তারপর এসে জায়নামাজ টা গুছিয়ে রাখলো।

সুমাইয়া কে কল করে বেলকনির দিকে গেল। অনেক বার কল করেও সুমাইয়া রিসিভ করলো না। ইসরাকের বিশ্বাস সুমাইয়া নিশ্চ‌ই কিছু জানবে!তাই ফাহাদ কে কল করে বললো, সুমাইয়ার খোঁজ নিতে।

ইসরাক ফোন রেখে,তাকিয়া’র পাশে বসে তাকিয়া’র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আর অপেক্ষা করতে লাগলো,ফাহাদ কি খবর বলে।
______
পঁচিশ মিনিট পর ফাহাদ কল করে বললো ঘটনা কি ঘটেছে। তাকিয়া’র স্কুল টিচার ফখরুল আলম রাস্তায় গাড়ির মধ্যে চা’পা পড়ে মৃ’ত্যু বরণ করেছেন। অনেকের ধারণা ইচ্ছাকৃত ভাবে উনাকে গাড়িতে চা’পা দেওয়া হয়েছে!ঘটনা স্থলে আশেপাশের দোকানের লোকজন তাই বয়ান দিয়েছে পুলিশ কে। কিন্তু ভি’কটিমের পরিবারের লোকজন কোন শ’ত্রুর সন্ধান দিতে পারেনি। এমন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাথে কোন ন’রপ’শু এমন কাজ করেছে তা একমাত্র উপর‌ওয়ালাই জানেন।

মৃ’ত ফখরুল আলম তাকিয়া’র প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ধর্ম বিষয় ক্লাস নিতেন তিনি তাকিয়াদের।তেনার মুখে ইসলামের বাণী, হাদীস শরীফ সম্পর্কে শুনে শুনে তাকিয়া নিজেকে ধার্মিক মেয়ে হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় আছে। সেই শিক্ষকের এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত মৃ’ত্যু মেনে নিতে পারছে না তাকিয়া তাই তো এতো কান্নাকাটি।
সুমাইয়া তখন ছাদে কল করে এই শো’ক সংবাদ টাই দিয়েছিল তাকিয়া কে। তাকিয়া খবর টা শুনে যেতে চেয়েছিল ওখানে কিন্তু সুমাইয়া জানায় সেখানে তাকিয়া’র আম্মুর ভাড়া করা গু’ন্ডাদের দেখতে পেয়েছে।তাই আর যাওয়ার সাহস করতে পারেনি তাকিয়া।
তাছাড়া সুমাইয়া কে বেশ কয়েকবার তাকিয়া’র আম্মুর ভাড়া করা গু’ন্ডা গুলো জেরা করেছে। তাঁরা নিশ্চিত সুমাইয়া জানে তাকিয়া কোথায় আছে!কিন্তু সুমাইয়ার বাবার ক্ষমতার কাছে তারা পেরে উঠবে না বলে,বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারছেনা।
______

রাত অনেক হয়েছে তাকিয়া এখনো ঘুমে বিভোর। তাকিয়া যখন খুব বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে তখন এভাবেই ঘুমে বিভোর হয়ে থাকে। ইসরাক রুমেই এশার নামাজ পড়ে নিয়েছে। মসজিদে চলে গেলে যদি তাকিয়া ঘুম থেকে যায় উঠে যায় তাই আর মসজিদে যায়নি। কিন্তু আর কতো? নামাজের জন্য হলেও তো তাকে ডাকতে হবে, না হয় ইসরাকের উপরেই রেগে যাবে সে। অলরেডি সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে বারোটার পর তো নামাজের সময় থাকবে না তাই ইসরাক তাকিয়া কে ডাকলো। কিন্তু তাকিয়া নড়েচড়ে আবার পুনরায় ঘুমিয়ে গেল তাই ইসরাক তাকিয়া’র গালের সাথে গাল ঘষে দিল!ফলে ইসরাক এর খোঁচা খোঁচা দাড়ি তাকিয়ার গালে বিধতেই তাকিয়া’র ঘুম দৌড়ে পালানো।
শোয়া থেকে ওঠে বসে গায়ের ওরনা ঠিক করলো।ইসরাক বললো,
-“নামাজ পড়বে না বারোটা বেজে যাচ্ছে।

তাকিয়া চমকে তারাতাড়ি করে বাথরুমে গেল।ফ্রেশ হয়ে অযু করে নামাজে দাঁড়ালো।ইসরাক এর মধ্যে ওভেন থেকে খাবার গরম করে, রুমে নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখে।
আলিয়া বলেছিলেন, তাকিয়া’র ঘুম ভাঙ্গলে তাকে যেন ডেকে নেয় ইসরাক। কিন্তু অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুম ভাঙ্গানো ঠিক হবে না ভেবে ইসরাক আর ডাকলো না।
নামাজ শেষে তাকিয়া আবার মোনাজাতে কাঁদতে থাকে। তারপর ইসরাক অনেক বুঝিয়ে খাবার খাইয়ে দিতে শুরু করে নিজ হাতে। খাওয়ার মাঝে মনে হলো,ইসরাক খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে? প্রথমে জড়তা কাজ করলো জিজ্ঞাসা করতে। তারপর জড়তা কাটিয়ে বললো,
-“আপনি খেয়েছেন?
-“আমি না খেলেও আমাকে খাইয়ে দেওয়ার মতো তো কেউ নেই!

তাকিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে র‌ইলো।বুঝলো ইসরাক খায়নি।
ইসরাক খাবার মুখের সামনে ধরে হা করতে বলছে তাকিয়া কে, তাকিয়া আসছি বলে ওঠে গেল। তারপর তিন মিনিটের মধ্যে এসে প্লেট থেকে খাবার মেখে ইশরাকের সামনে তুলে ধরে বললো,
-“হা করেন?
ইসরাক বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অটোমেটিক তার মুখ হা হয়ে যায়। এবার দুজন দুজনকে খাইয়ে দিতে লাগলো। তাকিয়া দু’লোকমান নিয়ে বললো আর খাবে না। আর ইসরাক ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
-“আমার তো পেট ভরে নাই
-“আচ্ছা নেন?
-“আরো লাগবে,প্লেটের গুলোতে হবে না।
-“আচ্ছা এগুলো তো আগে খাইয়া নেন।

প্লেটের গুলো শেষ হলে তাকিয়া বিরক্ত নিয়ে ওঠে যায় কিচেনে।ইসরাক সুযোগ পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করছে তা ঢের বুঝতে পারছে সে। কিন্তু কোথাও একটা মায়াও কাজ করছে।
এদিকে ইসরাক ও খুব খুশি তার প্রিয়তমা সবুজিনী তাকে খাইয়ে দিচ্ছে এর থেকে সুখের আর কি হয়?

খাওয়া শেষে ইসরাক আরেকটা দুঃসাহসী কাজ করে বসলো! তাকিয়া’র আঙুল গুলো জীব দিয়ে চেটে খেল!আকস্মিক ঘটনায় তাকিয়া কিছু বলার সুযোগ পেয়ে ওঠলো না। শেষে রেগে বললো,
-“ইয়াক, কি করলেন এটা?
-“কি করলাম?

যেন কিছুই হয়নি। ইসরাকের কাছে এটা স্বাভাবিক বিষয়।

-“খাবার খাওয়ার পর আপনি এভাবে খান না?
-“তাই বলে আমার হাত মুখে ঢুকিয়ে দিবেন? নিজের টা নিজে এভাবে চেটে খায়,অন্যের টা এভাবে খায় নাকি?
-“তো কি হয়েছে? আপনি তো আমার অর্ধাঙ্গিনী! আমি করতেই পারি।

তাকিয়া নিশ্চুপ হয়ে প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেল। কিচেনে গিয়ে হাত ধোয়ার পরও যেন মনে হচ্ছে ইসরাকের স্পর্ষ রয়ে গেছে,কেমন একটা শিহরণ জাগে তাকিয়া’র।
________

বিয়ের ঊনিশ দিন পর,
আজকের দিনটা কেমন জানি, অন্য রকম অনুভুতি কাজ করছে তাকিয়া’র।এর মাঝে চার দিন ইসরাক ছিল না তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলো। ইসরাকের গ্রামের বাড়ি মতলব উত্তরে। সেখানে কিভাবে যায় তাকিয়া ডিটেইলস জেনেছে। তাছাড়া আর কিছু জানা হয়নি। তাকিয়া ঠিক করেছে ইসরাকের থেকে সব কিছু জানবে। গতকাল বিকালে ঢাকায় ফিরেছে ইসরাক। এখন বাসায় নেই, তাকিয়া’র ইচ্ছে করছে ইসরাকের আনা জর্জেট থ্রিপিস টা পরবে। এখনো অবধি কিছুই ব্যাবহার করেনি তাকিয়া।
ইসরাকের প্রতি এক অনুভূতি তৈরি হয়েছে তাকিয়া’র! হয়তো এটা বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাব। আবার ভাবছে সে এক পাক্ষিক ইসরাকের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে না তো? তাহলে তো দুর্ভোগের সীমা থাকবেনা।এক পাক্ষিক মায়ায় জড়ানোর পরিনতি যে খুব কষ্টদায়ক!
তারপর আবার সব কিছু ভুলে, ভাবলো ইসরাক কে না হয় পরীক্ষা করে দেখা যাবে।
আর বসে না থেকে শাওয়ার নিয়ে এসে সিলিং ফ্যান চালিয়ে তার লম্বা চুল গুলো শুকিয়ে বেনুনি করে, ঠোঁটে পিঙ্ক কালারের লিপস্টিক দিয়ে পরিপাটি হয়ে রুম থেকে বের হলো।ড্রয়িং রুমে এসে যাদের দেখলো! মোটেও প্রস্তুত ছিল না তাতে!…..

#চলবে…ইনশা আল্লাহ।