আমার ভুল পর্ব-০২

0
291

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২

প্রাপ্তিদের বাসার ছাদটা খুব বেশি বড় না হলেও চলনসই। হলুদের অনুষ্ঠান ছাদেই করা হলো। বিকেলে ওয়েডিং প্ল্যানাররা এসে স্টেজ সাজিয়ে দিয়ে গেলো। অনুষ্ঠান শুরু হলো রাত বারোটায়।

বান্ধবীদের কাছ থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত বিশেষণে বিশেষায়িত হওয়ার ভয়ে আমিও বেশ সাজগোজ করলাম। ওরা নিজ উদ্যোগেই আমাকে সাজিয়ে দিলো। ফলশ্রুতিতে, তিন বান্ধবীর সাথে পাল্লা দিয়ে সাজগোজের বাহার আমারও কিছু কম হলো না।

কিন্তু পাল্লাটা কেবল সাজগোজ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইলো। এর বেশি আর এগোতে পারলাম না। ওরা নাচে, গানে, হাসিঠাট্টায় সব দিক থেকে আমার চেয়ে এগিয়ে। স্টেজে উঠে স্টেজ কাঁপিয়ে দিলো নাচের পারফরমেন্স দিয়ে। ধুমধাড়াক্কা গান আর হিপহপ ড্যান্স! হাতে তালি, মৃদু শীষ, চিৎকারে আমন্ত্রিত অতিথিরা ওদের প্রতি নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে কোনরকম কৃপণতা করলো না।

বাকিদের মত আমি শুধু বসে বসে অনুষ্ঠান দেখলাম। প্রাপ্তির কয়েকজন আত্মীয় তো জিজ্ঞেসই করে বসলো আমি নাচ কেন দিচ্ছি না?’

জবাবে আমি সামান্য একটু হাসলাম। নাচ জিনিসটা আমার ক্ষমতার বাইরে। তারওপর রক্ষণশীল পরিবারের কনজারভেটিভ মেন্টালিটি তো আছেই। আমাকে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠতেই দিলো না।

চারদিক থেকে এত উচ্ছ্বাস দেখে হঠাৎ করে নিজের মধ্যে এক ধরনের অক্ষমতা অনুভব করলাম। বাংলায় যদিও ‘যস্মীন দেশে যদাচার’ এই প্রবাদটি আমি বহুবার পড়েছি কিন্তু নিজের জীবনে এর প্রতিফলন কখনোই ঘটাতে পারি নি। আমার সবসময়ই কুয়োর ব্যাঙ প্রকৃতির জীবনযাপন করে এসেছি।
তবুও বান্ধবীদের দেখে মনে আফসোস জাগলো। জীবনে কেবল পড়াশোনাই নয় আরো অনেক কিছুই জানা প্রয়োজন। কি লাভ এত পড়াশোনা করে যদি লাইফটাকেই এঞ্জয় করতে না পারি!
আহা! কি বিয়ের অনুষ্ঠানে কি কদরই না দেখছি আমার তিন বান্ধবীর!

ইয়াং বয়সী যতগুলো ছেলে স্টেজে ছিলো আমার বান্ধবীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি প্রাপ্তির পাশে চুপচাপ বসে রইলাম।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন স্টেজ থেকে বান্ধবীরা এসে প্রাপ্তিকে ওদের সঙ্গে টেনে নিয়ে গেলো। আমাকেও জোরাজুরি করলো কিন্তু আমি উঠলাম না। কনজারভেটিভ মেন্টালিটির টানাপোড়নেই উঠতে পারলাম না! চুপচাপ বসে রইলাম। প্রাপ্তি স্বাচ্ছন্দ্যে ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করলো।

নিচে কেবল আমি একা বসে আছি। বান্ধবীরা সবাই আনন্দ করছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো কেঁদে ফেলি। এত অকওয়ার্ড লাগছিলো। আমার অবস্থা বোধহয় প্রাপ্তি বুঝতে পারলো। নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার বিব্রত অবস্থা কাটানোর জন্য ও আমার হাত ধরে খুবই মন্থর গতিতে পা দোলাতে শুরু করলো। হালকা বাহু ঝাঁকালো যাতে আমি তাল মেলাতে পারি। প্রাপ্তির দেখাদেখি আমার বাকি তিনবান্ধবীও নেমে এলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে এত আদরে গালে চুমু খেলো যে আমার মনে হলো আমি ওদের যত্নে সাজানো কোন আহ্লাদী পুতুল। সব দুঃখ নিমিষেই ভুলে গেলাম।

আমার অস্বস্তি যে এতক্ষণ অনেকেই লক্ষ্য করেছে সেটা বুঝতে পারলাম প্রাপ্তির মামির কথা শুনে। উনি আমাদের পাঁচজনকে উদ্দেশ্য করে হেসে উঠে বললেন,
-‘বান্ধবী হলে এরকমই হওয়া উচিৎ। এতক্ষণ কেমন দেখাচ্ছিলো! তোরা সবাই স্টেজে আনন্দ করছিস আর মেয়েটা একা একা নিচে বসে আছে।’
প্রাপ্তি মিষ্টি হেসে আমার গলা জড়িয়ে ধরল।হাত ধরে টেনে স্টেজের দিকে নিয়ে গেলো। বললো,
-‘এবার তুই আর আমি ডুয়েট গান গাইবো।’

গান শিখতে না পারলেও গানের গলাটা আমার ভালো। বলা চলে উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি। আমার বাবা অসম্ভব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন। উনার গুণের সামান্য ছিটেফোঁটা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে।
প্রাপ্তি বরাবরই ভালো গান গায়। দুজনে মিলে একটা আধুনিক বাংলা গান গাইলাম। যদিও বিয়েবাড়ির সঙ্গে আমাদের এই আধুনিক গানের কম্বিনেশনটা ঠিক মানানসই হলো কিনা জানি না তবে আমার জড়তা অনেকখানি কেটে গেলো। মোটামুটি ফ্রি হয়ে গেলাম সবার সঙ্গে। মনে মনে প্রাপ্তিতে ধন্যবাদ দিলাম।


নাচের প্রোগ্রাম রাত তিনটে পর্যন্ত অব্যাহত রইলো। আমার তিন বান্ধবীর একের পর এক নাচ আর অভিনয়ে মধ্যরাতে পুরো স্টেজে জমজমাট অবস্থা। প্রাপ্তির কাজিনরাও পারফর্ম করলো।

আমি আর প্রাপ্তি নিচে দাঁড়িয়ে শুধু তালি বাজালাম। মাঝেমাঝে তাল মেলানোরও হালকা চেষ্টা করলাম। প্রাপ্তি আমার পাশ থেকে একমুহূর্তের জন্যেও নড়লো না। ওর কাজিনদের সাথে ছবি তুলতে গেলেও আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলো।
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে হিন্দি, বাংলা গান প্লে করে ছেলেমেয়ে সবাই একসাথে নাচের পরিকল্পনা করলো। সেখানেও প্রাপ্তি আমার আমাকে কাছ ছাড়া করলো না।

কিন্তু রাতে আবার বাকি তিন বান্ধবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাকে নিয়ে হাসাহাসিও করলো।


বিয়ের দিন সকালে বউয়ের সঙ্গে পার্লারে আমরা পাঁচ বান্ধবীই গেলাম। একজনকে ফ্রিতে সাজানো হবে। প্রাপ্তি আমাকে সাজিয়ে দিতে বললো। যেহেতু বাকি তিনজন সাজগোজের ব্যাপারে আমার চাইতে অনেক বেশি এক্সপার্ট তাই শরণার্থী হিসেবে আমাকে চয়েস করা হলো।

আমি বাসা থেকে সি ব্লু কালারের একটা লেহেঙ্গা নিয়ে এসেছিলাম। বিয়ের দিন সেটাই পড়লাম। পার্লারের মহিলা নিজেই আমাকে ম্যাচিং করে সাজিয়ে দিলেন।

পার্লার থেকে আমাদের নেওয়ার জন্য প্রিন্স ভাইয়া আর প্রান্ত এলো। প্রিন্স ভাইয়াকে দেখে আমার বান্ধবীদের হাসাহাসির পরিমান বেড়ে গেলো। বিনাকারণেই রসিকতার চেষ্টা করছে ওরা। প্রিন্স ভাইয়া সব লক্ষ্য করেও চুপচাপ রইলেন।

আমি মনে মনে ভীষণ লজ্জিত বোধ করলাম। ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা আসলেই বেশ অসম প্রকৃতির। চাইলেও সবার মত ফ্রি ভাবে মেলামেশা করতে পারি না।

গাড়িতে সবার জায়গা হচ্ছিলো না। প্রান্ত নেমে সিএনজি জোগাড় করলো। বউকে যেহেতু সিনএনজিতে নেওয়া যাবে না। তাই প্রিন্স ভাইয়া প্রাপ্তিকে বললো আমাদের মধ্যে দুজনকে নেমে যেতে বলতে।

কেউই সিএনজিতে যেতে রাজি হলো না। শেষে বাধ্য হয়ে আমি নেমে গেলাম। কিন্তু প্রান্তর সঙ্গে একা যেতে আমার অস্বস্তি হবে ভেবে প্রাপ্তি জোর করে শায়লাকে নামিয়ে দিলো। শায়লা আমাদের বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে অস্থির এবং স্টাইলিশ প্রকৃতির মেয়ে। প্রিন্স ভাইয়ার সঙ্গে সবার আগে ও-ই ফ্রি হতে পেরেছে। প্রাপ্তি জোর করে নামিয়ে দেওয়ায় মুখ চুন করে ফেললো।


সেন্টারে পৌঁছেই প্রাপ্তি আবার আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। বেচারি আমার জন্য বিয়ের মাঝেও বেশ ঝামেলা পোহাচ্ছে। চারপাঁচ বছরের বাচ্চাদের যেমন বাবা মায়ের কাছ থেকে হাতছাড়া করার জো নেই প্রাপ্তির অবস্থাও আমাকে নিয়ে তেমন। তিনবান্ধবীর ভরসায় আমাকে ছেড়ে দিয়ে ও নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না।

বিয়ে পড়ানো হলো জুমার নামাজের পর। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রাপ্তির বিদায় দেওয়ার সময় আমরা বান্ধবীরা কিছুটা দূরে সরে গেলাম। এই সময় পরিবারের লোকজনদেরই আগে স্পেস দেওয়া উচিৎ।

প্রাপ্তি কান্নাকাটি করে চোখেমুখের এক অবস্থা করে ফেললো। মেকাপ ল্যাপ্টে মুখ ভরে গেলো। প্রান্তর ওর অবস্থা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতন অবস্থা। প্রাপ্তিকে অনুকরণ করে সেও কান্নার ভান শুরু করে দিলো।
ইমোশোনাল একটা মুহূর্ত। সবাই কাঁদবে। এইমুহূর্তে প্রান্তর বাঁদরামি দেখে না চাইতেও হেসে ফেললাম আমরা বান্ধবীরা। প্রিন্স ভাইয়াও বোধহয় হেসে ফেলতেন। কিন্তু ‘বড়ভাই, বড়ভাই’ সুলভ একটা ইমেজের কথা ভেবে হাসি দমন করলেন।
প্রান্তর পিঠে সজোরে চাপড় মারলেন ওর দুষ্টুমি বন্ধ করার জন্য।

প্রান্তর বাঁদরামি তো থামলোই না উল্টো ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে শরীর দুলিয়ে হাসতে শুরু করলো। ওর কান্ড দেখে মনে হচ্ছে না প্রাপ্তি কাঁদছে। মনে হচ্ছে প্রাপ্তি বড়বড় একটা জোক শুনিয়েছে। প্রান্তর অবস্থা দেখে প্রিন্স ভাইয়াও বেশিক্ষণ হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। হাসি গোপনের জন্য দুই ভাই ভীড় থেকে দূরে সরে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে গলায় গলায় খাতির দুজনের।

প্রাপ্তি ভাইদের হাসি দেখে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলো। ও চলে যাচ্ছে আর ভাইয়েরা কেমন নির্দয়ের মত হাসছে। অভিমানে একটু বেশি করেই কাঁদলো।
এবারে প্রিন্স ভাইয়া প্রান্তকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত ওর কাছে এগিয়ে গেলেন। দুহাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
-‘ভাইয়া তো এমনি হাসছিলাম। প্রান্তটা বড্ড ফাজিল। শুধুশুধু হাসাচ্ছিলো! তুই জানিস না ভাইয়া তোকে কত ভালোবাসি? তুই চলে গেলে বুঝি ভাইয়ার ভালো লাগবে? প্রান্তর ও তো ভালো লাগবে না। তুই আমাদের দুই ভাইয়ের কত আদরের ছোট বোন! তোকে আমরা কত ভালোবাসি।’

প্রান্তও এলো। দুই ভাইকে পেয়ে প্রাপ্তি এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ওর কান্নায় আমরা থমকে গেলাম। মুহূর্তেই যেন পরিবেশ ভারী হয়ে এলো। বড় ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে পাঞ্জাবী ভিজিয়ে ফেললো ছোট দুইভাইবোন। প্রিন্স ভাইয়া নিঃশব্দে কাঁদছেন। আন্টির কোলে প্রাপ্তির ছোট বোন প্রীতি। সেও চিৎকার করে কাঁদছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে?
আমরা চার বান্ধবীও কেঁদে ফেললাম।
প্রাপ্তি চলে যাবার কষ্টে কিনা জানি না কিন্তু সবার কান্না দেখে নিজেদের আটকে রাখতে পারলাম না।

চলবে।