আমার হিয়ার মাঝে পর্ব-০১

0
496

#সূচনা_পর্ব
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি

কলেজের নবীন বরণে কেনা শখের এই লাল জামদানি শাড়িটি আজ চরম বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে অধরার। অনাকাঙ্খিত ভাবে এই শাড়ি পরেই বধূ বেশে নিজের ঘরে বসে আছে সে। স্তব্ধ নয়নে নির্লিপ্ত হয়ে বসে একমনে তাকিয়ে আছে হাতের উপর র/ক্ত লাল গোলাকৃতি আলতার উপর। বউ হিসেবে তার সাজ শুধু এইটুকুই।
দোয়ারের ওপাশ হতে ভেসে আসছে কিছু অপরিচিত কণ্ঠস্বর। ফিসফিস করে তারা যেন একে অপরকে বলে যাচ্ছে,
‘এমন সাদামাটা বউয়ের সাজ তো দেখিনি..। বিয়েটা কি মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে নাকি? একটা বিয়ে বাড়ি! অথচ বাড়িতে বিয়ের কোন আমেজ নেই। মানছি বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই হচ্ছে, তাই বলে এমন..?’

কথাগুলো কানে আসতেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। হঠাত করেই জীবনের এমন পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না অধরা। এইতো ঘণ্টা খানেক আগেও ক্লাসে বসে প্রিয় বান্ধবীদের সাথে খুনসুটিতে ব্যাস্ত ছিলো সে। কে জানতো বাড়ি ফিরতেই নিজের বিয়ের খবর জানতে হবে তাকে। জীবনের এতো বড় একটি সিদ্ধান্ত তার অজান্তেই কিভাবে হুট করে নিতে পারলো বাবা মা!
মনে মনে তাদের প্রতি অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে থাকলেও পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে সে। তাই বলেই অধরা দমে থাকার মেয়ে নয়। যে বাবা মা তাকে ছোট থেকে বুঝিয়েছে জীবনে সম্মানিত হতে চাইলে নিজেকে আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, সেই মা বাবাই আজ কেনো তাকে মাঝ পথে বিয়ে দিয়ে দায়সারা হতে চাইছে?

‘অধরা তোর বর চলে এসেছে!’

ছোট্ট একটি কথা শুনতেই বুকে ধক করে উঠলো অধরার। তোর বর! শব্দটা কানে বেজে উঠতেই চমকে উঠলো সে। সত্যি বলতে এতোক্ষণ ধরে একবারও তার মাথায় আসেনি যে বিয়েটা কার সাথে হচ্ছে বা তার পরিচয় কি? যার সাথে তার নতুন জীবনের সূচনা হতে চলেছে, যার হাত ধরেই হবে তার আগামীর পথচলা সেই মানুষটি এখনও তার কাছে অচেনা অজানা।
মুহূর্তেই বাড়ির ড্রইং রুম থেকে ছোটখাটো হৈচৈ ভেসে আসে। সবাই হয়তো এখন মেহমানদের আপ্যায়ন করতেই ব্যতিব্যস্ত।

ঘন্টাখানেক নিঃস্বঙ্গতায় থাকার পর ঘরে আগমন ঘটে অধরার মায়ের। তিনি হন্তদন্ত হয়ে অধরার মাথায় একটা লাল ওরনার আঁচল দিয়ে ঢেকে দেয়। অধরার মনের অবস্থা তিনি ঠিকই বুঝতে পারছেন তাই তো শান্ত নয়নে মেয়ের পাশে বসে স্নেহময় কণ্ঠস্বরে বললেন,
“জানি মা, এই বিয়ে তোমার মনে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। হয়তো জানতে চাইছো হঠাত করেই তোমার সম্মতি ছাড়া এই বিয়ে কেনো হচ্ছে। অধরা, আমি আর তোমার বাবা কখনও তোমার কষ্ট দেওয়ার মতো কোন কাজ করবো না। এই বিয়ের পেছনে অনেক কারণ আছে যা তুমি সময়ের সাথে সাথে সব জানতে পারবে। এখন শুধু তোমার কাছে একটাই অনুরোধ মা, বিয়েটা মেনে নাও তুমি ভালো থাকবে। মায়ের বিশ্বাস আছে তোমার উপর।”

অধরার প্রতিউত্তর প্রকাশের ভাষা নেই। চোখের কোণে অশ্রুকণা টুইটুম্বর। তবুও তা আড়ালে মুছে অধরা মায়ের সাথে সকলের সামনে এসে হাজির হয়। দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবৃত্ত হলেও অনুভব করতে পারছে সকলের চাহনি তার দিকেই সীমাবদ্ধ। হঠাত মায়ের বয়সী একজন মহিলা তার কাছে এসে,
‘মাশাআল্লাহ! অধরা মাকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে। এসো তো দেখি আমার আশ্বিনের পাশে তোমায় কেমন লাগে।’

হঠাত উনার মুখে আশ্বিন নামটা শুনে চমকে উঠলো অধরা। কি বললেন উনি? বিস্ময় ভরা চোখে সে মাথা তুলে সামনে তাকাতেই চেনা পরিচিত সেই মুখ দেখতে পেয়ে মুহূর্তেই চোখ জোড়া গোল গোল হয়ে যায় তার। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্পষ্ট ভাবে বেরিয়ে যায়, ‘আপনি..?’
আশ্বিনও হয়তো অবাক হয়েছে তাকে দেখে, সেও বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে বললো,
‘তুমি..!’

দুজনের প্রতিক্রিয়া দেখে আশ্বিনের মা কিছুটা অবাক হয়, ‘কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে দুজন দুজনকে আগে থেকেই চিনিস?’
মায়ের কথায় কোন প্রতিউত্তর দেয়না দুজন। কি বলবে তারা? অবাকতার চরম শীর্ষে পৌঁছে আছে দুজনেই। আশ্বিনের বাবা বিষয়টা সামলে নিয়ে,
‘আরে এটা কেমন প্রশ্ন করলে তুমি আশা? দুজন একই মেডিকেলে পড়েছে, চেনা জানা তো হতেই পারে। কি বলিস আশ্বিন?’
বাবার কথায় আশ্বিন মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।

তাই বিষয়টা সহজ ভাবে নিয়ে আশ্বিনের মা অধরার হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিলেন আশ্বিনের পাশে। এতগুলো দিন পর আবারও নিজের অতীতের মুখোমুখি হয়ে রাগে শরীর রি রি করে উঠছে অধরার। রাগের বশেই আড়চোখে একনজর ফিরে তাকায় মহাশয়ের দিকে।
তিনি শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে নির্বিকার ভাবে মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছেন। আশ্বিনের এরূপ কর্মকান্ডে আরো বেশি রাগ হচ্ছে তার।
কি নিশ্চিন্তে বসে আছেন তিনি! যেন তিনি ভুলেই গিয়েছেন অতীতের সকল কথা। এতো সব কিছুর পর কীভাবে অধরাকে বিয়ে করতে চাইছে আশ্বিন! প্রশ্নটা ভাবাচ্ছে অধরাকে। আড়চোখে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলো অধরা। হঠাত কানে এসে পৌঁছে ফিসফিস শব্দের এক ভরাট কন্ঠস্বর,

‘এভাবে আড়াল থেকে লুকিয়ে আমার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমার অস্বস্তি বোধ হয়। এভাবে তাকিয়ে থাকার কি খুব প্রযোজন? আমাকে দেখার তো অনেক সময় পাবে।’

আশ্বিনের কথায় চোখ যেন চড়াক গাছ অধরার। কি বললেন উনি? উনি কি মজা করছেন? বধূ বেশে তাকে দেখার পরেও কি এই বিয়েটা আশ্বিন সত্যিই করবেন নাকি?
তাছাড়া আশ্বিনের দৃষ্টি তো এদিকে ছিলো না, তবে কখন খেয়াল করলেন তার এরূপ চাহনি? অধরার রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। যাকে বিয়ে করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই, তার মোহে পুনরায় আকৃষ্ট হওয়ার তো প্রশ্নই উঠছে না।
আশেপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো আশ্বিনের বলা কথাটা আর কারো কানে যায়নি। তবুও রাগ মিশ্রিত লজ্জায় কানগুলো গরম হয়ে আসছে তার। শুধু পারছে না এক ছুটে নিজের ঘরে চলে যেতে।
————–

এর মাঝেই কাজি সাহেব চলে আসায় বিয়ের কাগজপত্র ঠিকঠাক করে বিয়ে পড়াতে শুরু করেন। তিনি অধরাকে কবুল বলতে বললে, সে মা বাবার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই কি তার বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে আশ্বিনের সাথেই? একটা সময় যার মুখোমুখি না হওয়ার পণ করেছিলো সে, আজ সেই কিনা হতে যাচ্ছে তার বর! সত্যিই বলে, ভাগ্যকে খন্ডন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

হঠাত কেউ একজন তার হাত আগলে ধরায় অধরা চমকে উঠে পাশ ফিরে দেখে আশ্বিন। আলতো এই স্পর্শই তার সমস্ত শরীরে শীতল ঠান্ডা বাতাস বয়ে দেয়, তবুও পুরনো দিনের তিক্ততায় সে রাগে অভিমানে সবার অগোচরে আশ্বিনের থেকে এক ছিটকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। এই মূহুর্তে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার আশ্বিনকে। সবকিছুর জন্য তো সেই দায়ি, আশ্বিন কখনো বুঝবে না তার মন ভাঙার সেই সময়টা ছিলো কত পীড়াদায়ক।
পরিবারের সবার উপরও রাগ হচ্ছে, কেনো কেউ বিয়ের আগে তার মনের কথাগুলো জানতে চাইলো না?

অবশেষে মনের বিরুদ্ধে যু/দ্ধে পরাজিত হয়ে অধরা কবুল বলে দিয়ে সংসার এবং পরিবার নামক শব্দকে আপন করে নেয়। হয়ে যায় আশ্বিন নামক এই মহাশয়ের অর্ধাঙ্গিনী।

‘আলহামদুলিল্লাহ! ফারজানা তোর মেয়ে কিন্ত আজ থেকে আমার মেয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে আমি দুই কন্যার মা।’
আশ্বিনের মায়ের কথায় ফারজানা বেগম হেসে উঠে। মেয়ের জন্য এমন এক পরিবারই চাইছিলেন তিনি যারা কিনা তার অধরাকে নিজের মেয়ে ভেবেই রাখবেন।
মায়ের কথার জের ধরেই আশ্বিনের ছোট বোন আরশি বলে উঠে,
‘মা নতুন ভাবিকে কিন্তু আজকেই আমাদের সাথে নিয়ে যাবো। প্লিজ না করো না তুমি।’
‘হ্যাঁ অবশ্যই! আমিও ভেবেছিলাম আজকেই অধরাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। এখন তুই কি বলিস ফারজানা?’
অধরার মা একনজন অধরার বাবার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে,
‘তোদের যেমনটা ভালো মনে হয়। তবে আমার মনে হয়..।’
কথাটা আর শেষ করা হলো না ফারজানা বেগমের। তার আগেই অধরা শান্ত কণ্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আমি আজই যাবো।’

মায়ের উপর অভিমানী হয়ে কথাটা বলার পর তার মনে হয় একি বলে ফেলেছে সে। নিচের থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে সবাই অবাক হয়েই তার দিকে তাকিয়ে আছে। না জানি কে কি ভাবছেন এখন! আরশি কিছুটা মজা করেই,
‘দেখেছো ভাইয়া, ভাবির কিন্তু আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য একদম রেডি।’

আরশির কথায় উপস্থিত সবাই একসাথে হেসে উঠে কেবল আশ্বিন ছাড়া। আশ্বিন বেচারা একনজর অধরার দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সে ভালো করেই বুঝতে পারছে অধরাকে বিয়ে করে সে তার জীবনের বাহ্যিক সকল সুখ শান্তি হারিয়ে ফেলেছে..।
অতিসয় চঞ্চল প্রকৃতির অধরা যে হুটহাট করেই ভয়ংকর কিসব কাজ করে ফেলে তা ভালো মতোই জানা আছে তার।

অধরা আড়চোখে একবার আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকাতেই দুজনের দৃষ্টি মিলে যায়। রাগী রাগী চোখে অধরা জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে এক ঝড়ের পূর্বাভাস জানান দেয়। মনে মনে সে শুধুই বলে যাচ্ছে,
‘খুব শখ না আমাকে বিয়ে করার? কি ভেবেছিলে আমি এখনও সেই আগের অধরাই আছি? আমার মনের অনুভূতি নিয়ে একবার খেলে গিয়েছো, সেই সুযোগ আর পাচ্ছো না তুমি। এখন সময় এসেছে সেই সব দিনের হিসাব পাই পাই করে নেওয়ার। আপনি শুধু দেখতে থাকুন ডাক্তার সাহেব, আগে আগে কি হয়।’

–চলবে