শর্তনামা পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
304

#শর্তনামা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫

বাবার বাসায় এসেছে নিশা আর ওয়াসিফ। যদিও ওদের থাকার কথা কিন্তু ওর শাশুড়ী কথায় কথায় বলেছে তার ছেলের অফিস কামাই করে যাতে শশুর বাড়ী না থাকে। ওয়াসিফ কিছু বলে নি। তেমন আয়োজনের সুযোগ পেল না নিশার পরিবার। ওয়াসিফ থাকবে না আজ আর যেহেতু অফিস সংক্রান্ত বিষয় তাই আর জোর দিলো না তারা। খাওয়া দাওয়া শেষে ওয়াসিফকে নিয়ে রুমে গেলেন নিশার বাবা। কিছু বলার জন্য উসখুস করছে দেখেই ওয়াসিফ আগ বাড়িয়ে বললো,

— কিছু বলবেন বাবা? আমি তো আপনার ছেলের মতোই তাহলে সংকোচ কিসের?

ওয়াসিফের কথায় ভরসা পেলেন ভদ্রলোক। ছেলেটা বরাবরই শান্ত এবং মিষ্টভাষী। তার মেয়ের বিপরিত। একটু হেসে বলে উঠলেন,

— তুমি তো জানই বাবা আমার মেয়েটা কেমন। ও কিছুটা রাগী এবং স্পষ্টভাষী। যা বলার মুখের উপর বলে দেয়। তোমাকে যে এত তারাতাড়ি মেনে নিবে তা ভাবতে পারি নি। তুমি ওকে একটু দেখে রেখো। কিছুটা অবুঝ ও। জেদ করে বসে থাকে। একটু বুঝিয়ে নিও বাবা। তোমার কাছে আমার আমানত ও।

ওয়াসিফ ওনার দু হাত ধরে বললো,

— আপনার আমানত এখন আমার বাবা। তাহলে ওর ভালো মন্দ ও তো আমার। নিশ্চিত থাকুন আপনি।

নিশার বাবার যেন বুকটা হালকা হলো। ছেলেটা যথেষ্ট বুঝদার। নিশার মা একে একগাদা পরামর্শ দিলো যা আদও নিশা আমলে নিলো কি না এতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে ওনার। নিশা আপাতত নিশানের সাথে গল্পে মত্ত। ওয়াসিফ এগিয়ে এলো। পাশে বসে নিজেও আড্ডা দিলো কিছুক্ষণ। এরপর আস্তে করে নিশাকে যাওয়ার জন্য বললো। নিশাও না করে নি কারণ ওয়সিফ বলেছে ছুটি পেলে এসে থেকে যাবে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো দুজন। নিশার মনটা একটু হলেও খারাপ জানে ওয়াসিফ কিন্তু মেয়েটা সহজে কিছু প্রকাশ করতে নারাজ। তাই ওকে নিয়ে বাসায় না গিয়ে গাড়ি ঘুরালো অন্য দিকে। নিশা বাইরের প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত আপাতত কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে ওর তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিছুক্ষণ পরই গাড়িটা থামলো খোলামেলা একটা জায়গায়। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো আরো অনেক প্রেম জুটি আছে এখানে। নিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ওয়াসিফ ইশারায় নামতে বললো। দুজন নামতেই ওয়াসিফ ওর হাত ধরে সামনে এগুলো। পাশেই এত্তো এত্তো ফুলের দোকান। এটা যে শাহবাগ তা আর বুঝতে দেড়ী হয় নি নিশার। ওয়াসিফ এগিয়ে গিয়ে একটা রজনীগন্ধার গাজরা কিনে নিলো। নিশার খোলা চুলগুলো একত্রে করে তাতে পেচিয়ে দিলো সেই গাজরা। নিশার মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেল। দুজন মানুষ হাটতে লাগলো গন্তব্যহীন ভাবে। এক দিকে কিছুটা নীরব দেখে বেঞ্চে বসলো দুজন। ওয়াসিফের কাঁধে মাথা রাখলো নিশা। ওয়াসিফ ও পরম যত্নে আগলিয়ে নিলো ওকে। নিশা আস্তে করে ডাকলো,

— ওয়াসিফ।

— হুম।

— ভালোবাসি।

— আমিও ভালোবাসি।

নিশা হাসলো একটু। আবারও ডাকলো,

— ওয়াসিফ?

— হু।

— আপনি শর্তনামা পড়েছিলেন?

এমন মিষ্টি মুহূর্তে ঐ শর্তনামা নামক ফালতু জিনিসটাকে একদম অসহ্য লাগলো ওয়াসিফের। মেজাজ গেল বিগড়ে। নিজেকে শান্ত করে হালকা কন্ঠে বললো,

— কোন শর্ত কি ভেঙেছি?

— উহু।

— তাহলে?

— আগে বলুন পড়েছেন?

— না।

আবারও হাসলো নিশা। ও আগে থেকেই জানতো ওয়াসিফ তা পড়ে নি। তবুও বললো,

— কারণ?

দীর্ঘ শ্বাস ফেললো ওয়াসিফ। আরেকটু জড়িয়ে ধরলো নিশাকে। কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— আমার ভালোবাসা শর্তহীন নিশু। আমিটাই তোমার জন্য শর্তহীন। তাই তুমিও আমার কাছে শর্তহীন। তোমার শর্তনামায় যাই থাকুক না কেন আমি রাজি। শর্তহীন ভাবে পূরণ করব তোমার সকল শর্ত।

বলে টুপ করে একটা চুমু খেল গালে সাথে সাথেই টুপ করে এক ফোটা পানিও পরলো যা ছিলো নিশার চোখের। ওয়াসিফ তারাতাড়ি তা মুছে দিয়ে বললো,

— এই নিশু? কি হয়েছে? আমি বললাম তো সব পূরণ করব।

নিশা জড়িয়ে ধরলো ওয়াসিফকে। ওয়াসিফ ওর মাথায় চুমু খেল। চুল গুলো কানে গুজে দিয়ে ডাকলো,

— নিশু?

— হু।

— তুমি ওটাতে কিছু লিখ নি তাইতো?

নিশা তড়িৎ বেগে বুক থেকে সরে গেল। আশ্চর্য হয়ে তাকাতেই ওয়াসিফ ইশারায় ওকে দাঁড়াতে বললো। নিশাও দাঁড়িয়ে গেল। দুজন গাড়িতে উঠলো। এরপর আর কথা হলো না। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতেই রাত প্রায় ১টা বেজে গেল। বাইরে কেউ নেই। দুজনই রুমে ডুকে পড়লো। চেন্জ করে ওয়াসিফের কাছে আসলো নিশা। কিছু বলার আগেই ওয়াসিফ টান দিয়ে বুকে নিয়ে এলো ওকে। দু’জনের ওষ্ঠ মিলিত করে দিলো। আরেকটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগেই বাঁধ সাধলো নিশা। ঠেলে উঠে বসলো। ওয়াসিফ অসহায় চোখ করে তাকালো। নিশা ঠোঁট চেপে হাসলো কিন্তু তেজী কন্ঠে বললো,

— আপনি যদি নাই পড়ে থাকেন তাহলে বুঝলেন কিভাবে ওটাতে কিছু লিখা নেই?

ওয়াসিফ আবারও টান দিয়ে বুকে নিয়ে এলো নিশাকে। কানে মুখ লাগিয়ে বললো,

— সরকারি চাকরি করে যদি নকল স্ট্যাম্প না চিনি তাহলে কি হবে নিশু?

নিশা অবাক হলো। আসলেই তো রাহাম ওকে নকল স্টাম্প লাগিয়ে দিয়েছিলো আর ওয়াসিফ ওই দিন ক্যাফেতে শুধু ঐ স্টাম্পই দেখেছিলো। কতটা চালাক এই ওয়াসিফ। নিশা ওর দিকে রাগী চোখে তাকাতেই ওয়াসিফ চোখ টিপ মারলো। কানে চুমু খেয়ে নিলো আবারও। ঝটপট করে বললো,

— অনেক খেলেছি তোমার শর্তানামা শর্তনামা। এখন আদর চাই আমার। একদম কিপ্টামি চলবে না।

______________

— আপনার আম্মু মনে হয় আমাকে পছন্দ করেন না ওয়াসিফ।

সকাল সকাল নিশার মুখ থেকে এমন কথা শুনে টাইটা বেঁধে ওর কাছে এলো ওয়াসিফ। আগোছালো আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে বললো,

— কে বলেছে?

— বলতে হবে কেন? আমি বুঝি।

— বেশি বুঝ তুমি। আম্মু একটু রাগী কিন্তু তোমাকে পছন্দ করে। এই যে আজ শাড়ী পরলা দেখো আদর করে দিবে তোমায়।

হু।

— নিশু।

— জ্বি।

— আমি জানি তুমি সংসারের ঝামেলায় যেতে চাও না। তবুও বলব একটু আকটু আম্মুর আশে পাশে থেক তাহলেই হবে।

— এভাবে কেন বলেন? আমি চেষ্টা করবো।

— আমি জানি তো। আমার নিশু চেষ্টা করবে।

বলে গাল টেনে দিলো ওয়াসিফ। দুজন বের হতেই নিশা প্রথমে শাশুড়ীর কাছে কিচেনে গেল। ওর শাশুড়ী আর দুই জা যেন ঝটকা খেল ওকে শাড়ী পড়ে কিচেনে দেখে। নিশা নিজেই বললো,

— আম্মু হেল্প করি?

ওর শাশুড়ী মুহূর্তেই খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো। এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— না আম্মু সব হয়ে গিয়েছে তুমি যাও টেবিলে।

নিশা তবুও জেদ করে জা দের সাথে এটা ওটা এগিয়ে নিলো টেবিলে। শাশুড়ীকে কোন মতে বেড়েও দিলো। ওর শাশুড়ী বুঝলো মেয়েটা আগে কখনো খাবার বেড়ে খায়নি। ঠিক মতো গুছাতেও পারে না। তাতে কি উনি নিজে শিখিয়ে দিবেন। ওয়াসিফ নিশাকে বেড়ে দিলো। সবাই একসাথে খেয়ে উঠলো। ওয়াসিফ অফিস চলে গেল। নিশার আজ ভার্সিটি অফ তাই শাশুড়ী আর জা দের সাথে সারাদিন টুকটাক কাজ করলো। দুই জা খুবই মিশুক। এত বড় তবুও নিশা যেন বান্ধবী বানিয়ে নিলো। দাদীকেও বাসায় আনা হয়েছে। তার সাথেও ভালো বনে গেল নিশার।শর্তহীন হলেও প্রত্যেকটা সম্পর্ক কিন্তু সুন্দর।

রাতে ওয়াসিফ আসতেই ওর মা নতুন বউয়ের প্রশংসা করলো ছেলের কাছে। কাজ না পারুক মেয়েটা কাছে কাছে ছিলো। সারা দিন গল্প করেছে। ওয়াসিফ জানতো ওর নিশু যেমনই দেখাক না কেন ভেতর থেকে নরম। সবার সাথে মিশে যায়। মাকে নিয়ে একটু টেনশনে ছিলো তাও আজ শেষ। রুমে ডুকতেই হুরতার করে হাতে শরবত নিয়ে হাজির হলো নিশা। ওয়াসিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শাড়ী পরিহিত হাতে শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। একদম পাক্কা গৃহিণী যাকে বলে। নিশা এগিয়ে এসে ওর হাতে শরবত দিয়ে বললো,

— আপনার জন্য।

— তুমি বানিয়েছো?

— আপানার আরো বউ আছে?

হঠাৎ এহেন কথায় হোচট খেলো ওয়াসিফ। মানে বুঝতে পেরে এক চুমুকে সবটুকু শেষ করতেই নজর গেল নিশার হাতে। ধরে সামনে আনতেই দেখলো কেটে গিয়েছে। ব্যাস্ত হলো ওয়াসিফ। অস্থির কন্ঠে বললো,

— কিভাবে হলো নিশু? ওয়েট তুমি কিচেনে কি কাটছিলে?

— আরে লেবু কাটতে গিয়ে এমন হলো। ব্যাপার না। ঠিক আছে।

ঠিক আছে বললেও কি আর ওয়াসিফ ঠিক আছে? ছোট্ট একটা পট্টি লাগিয়ে দিলো। কঠোর ভাবে নিষেধ করলো কাটাকাটি করার। নিশা মুখ ভেঙিয়ে বললো,

— আরে কত হাত পা কাটলো সামনে আরো কাটবে এতো ব্যাস্ত হচ্ছেন কেন?

— সামনে আরো কাটবে মানে?

— নেত্রী হবো না আমি। তখন তো মারামারি হবেই।

মুহূর্তেই মাথা ঘুরে উঠলো ওয়াসিফের। এই নিশুকে সহজে বুঝালে বুঝবে না। তাই কঠিন চাহনি দিয়ে বললো,

— কোন রাজনৈতি করবে না তুমি। ছাত্র রাজনীতি আমার পছন্দ না নিশা। স্টে আউট অফ দিস।

রাজনীতি করতে মানা করায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেও ওয়াসিফের মুখে নিশা ডাক শুনে বুকটা ধক করে উঠলো। ওয়াসিফ তো কখনো নিশা ডাকে নি তাহলে আজ কেন? একটু নরম স্বরে নিশা বললো,

— রেগে আছেন?

— না।

— তাহলে নিশা কেন ডাকলেন আপনি? ডাকবেন না নিশা বলে। আপনি কখনো আমায় নিশা নামে ডাকবেন না।

কথাগুলো বলেই চলে গেল নিশা। ওয়াসিফ শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। রাতে প্রায় ১২ টা তবুও নিশা রুমে আসে নি। অবশেষে ওয়াসিফ বের হলো। আশে পাশে কোথাও নেই। পরক্ষণেই দাদীর রুমে লাইট অন দেখে ওখানে গেল। যা ভেবেছিলো তাই। নিশা দাদীর পাশে আছে সাথে বাকি দুই ভাবী। ওয়াসিফ গলা পরিষ্কার করে ডাক দিলো,

— নিশু।

নিশা শুনেও উত্তর দিলো না। ওয়াসিফ ভেতরে ডুকে আবারও ডাকলো,

— রুমে চলো নিশু।

দুই ভাবী মুখ টিপে হাসলো। দাদী কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,

— বিয়ে তো করালাম তাও তোর শখ মিটলো না। যাও ছোট নাত বউ নাহলে আমার নাতিটা আজ নরবে না এখান থেকে।

ওয়াসিফ একটু লজ্জা পেল কিন্তু নিশার কোন হেলদুল নেই। আস্তে করে উঠে রুমে চলে গেল। চেঞ্জ করে ধুম করে করে শুয়ে পরলো। ওয়াসিফ লাইট অফ করে এগিয়ে এলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। নিশা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ওয়াসিফ আবার কাঁধে মুখ গুজে দিলো তাতেও নিশা নরলো না একচুল। ওয়াসিফ এবার ওকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। জড়িয়ে ধরতেই হালকা ফুঁপানোর শব্দ পেল। সবসময় তেজী প্রতিবাদী নিশা একমাত্র ওয়াসিফের সংস্পর্শে এসেই গলে যায়। ওয়াসিফ ওকে আদর করে আরেকটু জড়িয়ে ধরলো। কানে মুখ লাগিয়ে চুমু খেয়ে বললো,

— সরি নিশু। আর বকব না। লাভ ইউ না জান। প্লিজ কথা বলো।

— সরি বলতে হবে না। আমি…

নিশাকে থামিয়ে ওয়াসিফ বললো,

— রাজনৈতিক কোন দলের সাথে যেন না দেখি। তোমার ভালোর জন্যই বলছি নিশু। আবেগের বয়সে তোমার মনে হচ্ছে এসব কুল কিন্তু এর সাইড এফেক্ট ও আছে। প্লিজ এটা বাদ দাও। জেদ করো না।

নিশা কিছু বললো না। ওয়াসিফ কিছুক্ষণ পর ডাকলো,

— নিশু?

— হু।

— রেগে?

— না।

— ভালোবাসি।

— ভালোবাসি।

শর্তবিহীন শুরু হয়ে গেল নতুন দুটো জীবন। এক হয়ে গেল তাদের হৃদয়। নতুন সম্পর্কে শর্তের কোন প্রয়োজন নেই প্রয়োজন আছে শুধু বিশ্বাস, সম্মান আর অগাধ ভালোবাসার।

#সমাপ্ত…