আমি ফাইসা গেছি পর্ব-৮+৯

0
169

#আমি_ফাইসা_গেছি(০৮)
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

আমরা তিনজনই ফাইসা গেছি স্যার।এই তিন কাল নাগিনী আমাদের ফাসিয়ে দিয়েছে।প্লিজ আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিন।

ইন্সপেক্টর শাহিনের কথা শুনে বললো, কি সব পাগলের মতো ভুলভাল বকছেন?কথা ক্লিয়ার করে বলেন।

তুহিন তখন বললো স্যার আগে কথা দিন আমাদের কে বাঁচাবেন তা না হলে বলবো না কিছু।

ইন্সপেক্টর তখন তার হাতের বন্দুক টি তুহিনের মাথায় ঠেকিয়ে বললো, ওই মিয়া,ফাজলামি করিস আমার লগে?যা বলার তাড়াতাড়ি বল।

তুহিন তার মাথায় বন্দুক ঠেকানো দেখেই তো ভয় পেয়ে গেলো।সে আর কি কথা বলবে?

মাহিন তখন বললো স্যার আগে বন্দুক টা নামিয়ে রাখুন তারপর আমরা ক্লিয়ার ভাবে বলবো।আসলে আমরা সবাই ভীষণ ভিতু।একটু উচ্চস্বরে কথা বললেই তো আমরা ভয় পাই।তার উপর কেনো এই বন্দুকের ভয় দেখাচ্ছেন স্যার?

শাহিন, মাহিন আর তুহিনের কথা শুনে ইন্সপেক্টর না হেসে পারলেন না।তিনি তার বন্দুক টি নামিয়ে বললেন,তোরা কি পুরুষ মানুষ?না অন্য কিছু? আমার কেনো জানি সন্দেহ হচ্ছে ভীষণ।

শাহিন তখন বললো স্যার,আমরা আগে এরকম ছিলেন না।এই বাড়ির জামাই হয়ে আসার পর থেকে আমরা এমন ভিতু হয়ে গেছি।

মাহিন তখন এগিয়ে এসে বললো,
আমাদের কে প্রতিদিন নানা রকম টর্চারের মধ্যে রাখে আমাদের বউয়েরা।যার কারণে আমরা অন্য কারো উচ্চস্বরে কথা শুনলেই ভয় পেয়ে যাই।

তুহিন তখন বললো, আপনাদের কাছে নিশ্চয় নারী নির্যাতনের মামলা যায়।কিন্তু পুরুষ নির্যাতনের মামলা কি কখনো গিয়েছে?আমরা কিন্তু প্রতিদিন পুরুষ নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছি?স্যার, যার কারনে আমাদের মেধাশক্তিও দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে।আমরা কাপুরুষ দের মতো বেঁচে আছি।

ইরা, মিরা,লিরা হঠাৎ এগিয়ে এসে যে যার স্বামীর কাছে দাঁড়ালো।আর বললো,আসলে স্যার আমরা আমাদের স্বামীদের নিয়ে এই বাড়িতেই থাকি।এটা আমাদের বংশের একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে।এরা সবাই জেনেশুনেই বিয়ে করেছে আমাদের।এই বলে ইরা শাহিন কে, মিরা মাহিন কে, আর লিরা তুহিন এর দিকে তাকিয়ে বললো,তাহলে আজ কেনো সেটা স্যার দের কাছে কম্পিলিন করছো?তোমরা তো জানতেই বিয়ের পর তোমাদের ঘর জামাই থাকতে হবে।

তিনজন তখন একসাথে বলে উঠলো হ্যাঁ জানতাম।কিন্তু রান্না করা,কাপড় ধোয়া,ঘর গোছানো,মেঝে মুছে দেওয়া এগুলোও তো করতে হয় আমাদের।এসবের কথা তো আগে বলো নি তোমরা?

ইন্সপেক্টর তখন শাহিন,মাহিন,তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,তোরা কি আর কিছু বলবি?না এটাই তোদের কম্পিলিন?

শাহিন তখন বললো,স্যার আমরা মুক্তি চাই এদের থেকে।আমরা আর ঘরজামাই থাকতে চাই না।
শাহিনের দেখাদেখি মাহিন আর তুহিনও সেম কথা বললো।

জারিফ চৌধুরী এতোক্ষণে মুখ খুললেন।তিনি এতোক্ষন চুপচাপ শুনছিলেন সব।
তিনি বললেন,এটা সম্ভব না কখনো।হয় তোমাদের আমার মেয়েদের ডিভোর্স দিতে হবে তা না হলে এই বাড়িতেই আমাদের মেয়েদের সাথে থাকতে হবে।

ইন্সপেক্টর তখন বললো,এটা আবার কি ধরনের নিয়ম জারিফ চৌধুরী?

জারিফ চৌধুরী তখন বললো হ্যাঁ এটাই নিয়ম এই পরিবারের।আর আমিও একজন ঘরজামাই।এই যে বিশাল বাড়ি,ফ্যাক্টরি আর সম্পদ দেখছেন সব আমার শশুড়ের।এগুলোতে আমার কোনো অধিকার নাই।আমি নিজেও কামিনী কে বিয়ে করে ফেসে গেছি।এখন না পারছি সরতে না পারছি থাকতে?

জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে তোড়া যেনো আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলো।তার শশুড় এসব কি বলছে?সে তো ভেবেছে সবকিছু তার শশুড়ের। সেজন্য তোড়া সবসময় ভাবে এই সম্পদে কুশানের অধিকার সবার আগে।কিন্তু এ তো দেখছি পুরো উলটো।সবকিছু তাহলে কামিনীর?সেজন্য তার এতো বেশি অহংকার?আর সেজন্যই ওনার কথামতো পুরো সংসার চলে?

ইন্সপেক্টর তখন শাহিন,মাহিন আর তুহিন কে বললো, তাহলে তোমরা এখন কি করবে?ডিভোর্স দিবে না ঘর জামাই থাকবে?

ইন্সপেক্টরের কথা শুনে শাহিন,মাহিন আর তুহিন বললো,আমাদের আর কিছু বলার নাই স্যার।কারণ ডিভোর্স দিতে হলে ১৫ লক্ষ করে দেনমোহরের টাকা তাদের দিতে হবে।এতো টাকা আমরা কই পাবো?

ইন্সপেক্টর তখন বললো, এটা তোমাদের বিয়ের সময় ভাবা উচিত ছিলো।এখন কিছুই করার নাই।তবে আমি একটা উপকার করতে পারি তোমাদের তা হলো আজ থেকে তোমরা আর এসব ঘরের কাজ করবে না।হয় অফিসে যাবে তা না হলে ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকবে।এরপরও যদি কেউ তোমাদের দ্বারায় এসব কাজ করায় তখন আমাকে জানাবে।ওকে?

–ইয়েস স্যার।তিন জনই ভীষণ খুশি হয়ে গেলো।

ইন্সপেক্টর এবার তোড়াকে বললো,
তোড়া?তুমি যেহেতু এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছোই বড়দের মুখের উপর কোনো তর্ক করবে না।তারা যেভাবে চলতে বলবে সেভাবেই চলবে।তবে কেউ যদি বাজে কথা বলে বা তোমার উপর নির্যাতন করে তখন সেটা সাথে সাথে জানাবে।এর থেকে বেশি কিছু করতে পারবো না আমরা।এইভাবে পুলিশ সবকিছু মিটমাট করে চলে গেলেন।

ইন্সপেক্টর চলে যাওয়ার সাথে সাথে ইরা,মিরা,লিরা তোড়ার কাছে এসে বললো, শুনলি বাবা তখন কি বললো?এই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক আমার আম্মু।আর তুই তার সাথেই পাঙ্গা নিতে চাস?আশা করি ভবিষ্যতে আর বেশি বাহাদুরি করবি না?চুপচাপ থাকার হলে থাকবি না হলে চলে যাবি।

তোড়া ইরা,মিরা লিরার কথা শুনে রাগে গজ গজ করতে করতে তার রুমে গিয়ে কাপড় গোছাতে লাগলো।সে ঠিক করলো আর কিছুতেই এ বাড়িতে সে থাকবে না।কারন এ বাড়িতে সে কামিনী আর ইরা,মিরা লিরার হুকুম মেনে কিছুতেই চলতে পারবে না।

তোড়াকে কাপড় গোছাতে দেখে কুশান এগিয়ে এলো।আর বললো, এখন বুঝলে কেনো তোমাকে বিয়ে করতে চাই নি?কারণ আমি চাইতাম না তুমি আমার আম্মু আর বোনদের অপমান সহ্য করে এই বাড়িতে পড়ে থাকো।আমি তো নিজেও বন্দি হয়ে পড়ে আছি।না পারছি কিছু করতে না পারছি কোথাও চলে যেতে।

তোড়া তখন হঠাৎ করেই তার কাপড় গোছানো বাদ দিয়ে কুশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আর বললো,তুমি কি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো?

;হ্যাঁ অবশ্যই। কিন্তু তুমি তো বিশ্বাস করো না।

–আমার মাথা ছুঁয়ে বলো।

কুশান তখন বললো মাথা ছুঁয়ে বলতে হবে কেনো?আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।

তোড়া তখন বললো,তাহলে তুমিও তোমার কাপড় গুছিয়ে নাও।আজ থেকে তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকবে।

;মানে কি তোড়া?পাগল হইছো তুমি?

তোড়া তখন বললো কেনো?পাগল হবো কেনো?তোমাদের বাড়ির মেয়েরা যদি জামাই নিয়ে বাবার বাড়ি থাকতে পারে তাহলে আমি কেনো আমার জামাই রে নিয়ে আমার বাবার বাড়ি থাকতে পারবো না?

;ইম্পসিবল। এ হয় না তোড়া?

–কেনো হয় না কুশান?অবশ্যই হবে।আর হ্যাঁ, ভয়ের কোনো কারণ নাই।আমি তোমাকে দিয়ে রান্নাবানা করা,ঘর ঝাড়ু দেওয়া,মেঝে মোছা,কাপড় ধোয়ার কাজ করে নিবো না।তুমি একদম আরাম আয়াশে কাটাবে।উলটো আমি তোমার সেবা করবো।

কুশান সেই কথা শুনে বললো তা হয় না তোড়া।আমার আম্মু যত খারাপই হোক না কেনো মা তো মা ই।আমার আম্মুকে রেখে আমি কোথাও যাবো না।কারণ আম্মু আমাকে একদিন না দেখলে কিছুতেই থাকতে পারবেন না।

তোড়া তখন বললো শাহিন,মাহিন আর তুহিন দুলাভাই এর কি তাহলে কোনো ফ্যামিলি নাই?তোমার বাবার ও কি তাহলে কোনো ফ্যামিলি নাই?
তারা যেভাবে আপনজন ছেড়ে এ বাড়িতে এসে পড়ে আছে তুমিও ঠিক সেভাবেই আমাদের বাড়ি থাকবে।

;আমি পারবো না যেতে।এই বলে কুশান চলে যেতে ধরলো।

তোড়া তখন বললো ওকে।তাহলে আমি একাই চলে যাচ্ছি।আমি থাকবো না আর এ বাড়িতে।যে বাড়িতে আমার কোনো আত্নসম্মান বোধ নেই সে বাড়িতে আমি কি জন্য থাকবো?

কুশান তোড়ার কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলো।আর তোড়ার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বললো,কোথাও যাবে না তুমি।আর কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।কথা দিলাম আমি এবার থেকে প্রতিবাদ করবো।

তোড়া তখন বললো তুমি বললে আর হলো নাকি?আমি যখন ঠিক করেছি এ বাড়িতে আর থাকবো না তাহলে থাকবোই না।কারো বাপের ক্ষমতা নাই আমাকে আটকানোর।আর হ্যাঁ,এটাই আমাদের কিন্তু শেষ দেখা।ঠিক সময়মতো তোমাকে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো।

কুশান হঠাৎ তোড়ার মুখ টিপে ধরে বললো কি সব যা তা বলছো?ডিভোর্স?কিসের ডিভোর্স? তুমি আমার জীবনের না পাওয়া ধন,সেই ধন পেয়ে আমি হারাতে চাই না।আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তোমাকে আমি বউ করে এনেছি।সেই তুমি কি করে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবলে?

তোড়া তখন কুশানকে সরিয়ে দিয়ে বললো,তোর ঐ শুকনো কথায় আমার এই কঠিন মন কিছুতেই গলবে না।এই বলে তোড়া কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যেতে ধরলো।এদিকে কুশান বার বার তোড়াকে আটকাতে লাগলো।এক পর্যায়ে তোড়া কুশানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।

কুশানকে পড়ে যাওয়া দেখে কামিনী যেনো চিলের মতো দৌঁড়ে এলো।আর বললো,বাবা,বাবা।আমার বাবু।ব্যাথা পাইছিস তুই?

–না আম্মু।এই বলে কুশান আবার উঠলো।আর তোড়াকে আটকানোর চেষ্টা করলো।

তোড়া তখন বললো কুশান!প্লিজ আমাকে বাধা দিও না।তা না হলে আবার কিন্তু ধাক্কা দিবো।

কামিনী সেই কথা শুনে তোড়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ তোড়াকেই একটা ধাক্কা দিলো।আর বললো,তোর এতো বড় সাহস?আমারই চোখের সামনে আমারই ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিস।যে ছেলেকে আমি জীবনেও একটু আঁচড় দিয়ে দেখি নি?

কুশান তোড়াকে পড়ে যাওয়া দেখে তুলতে ধরলো।তোড়া তখন কুশানকে সরিয়ে দিয়ে বললো লাগবে না ধরা।আমি একাই পারবো উঠতে।তুমি বরং তোমার মায়ের আঁচলের তলে গিয়ে লুকাও।এই বলে তোড়া বেরিয়ে গেলো।

কুশান তখন চিৎকার করে বললো, তোড়া প্লিজ যেও না।শোনো আমার কথা।

ইরা,মিরা,লিরা তোড়াকে চলে যাওয়া দেখে দৌঁড়ে তাদের ভাই এর কাছে এসে বললো, যে চলে যাচ্ছে তাকে যেতে দে ভাই।ঐ মেয়ে তোর একটুও যোগ্য না।এই পরিবারের সাথে মানায় না ঐ মেয়েকে।আমরা তোকে আবার বিয়ে দেবো।তুই দেখিস সেই মেয়ে অনেক ভালো হবে।তোকে অনেক ভালোওবাসবে।

কুশান তার বোনদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তার রুমে চলে গেলো।সত্যি তার মাথাতেই খেলছে না তার এখন কি করা উচিত?
কামিনী ও সাথে সাথে কুশানের রুমে প্রবেশ করলো।কিন্তু কুশান টেনশনে শুধু পায়চারি করতে লাগলো।কামিনী তা দেখে বললো, বাবা কি হয়েছে তোর?এমন কেনো করছিস?

কুশান তখন বললো, আম্মু তুমি দেখলে না তোড়া চলে গেলো আমাকে ছেড়ে।সে আর নাকি আসবে না এ বাড়িতে।আর আমাকে কিছুদিন পর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে।

কামিনী সেই কথা শুনে বললো তাহলে তো ভালোই হবে।আপদ এমনি এমনি বিদায় নিলো।আমাদের কে আর কিছুই করতে হলো না।তোকে এবার অনেক ভালো একটা মেয়েকে দিয়ে বিয়ে দেবো।বল তো তুই কাকে বিয়ে করতে চাস?তোর যামিনী আন্টির মেয়ে যুথিকে না তোর আব্বুর বন্ধুর মেয়ে রুবাইয়াকে?

কুশান তখন কামিনী কে জড়িয়ে ধরে বললো আম্মু আমি তোড়াকেই প্রচন্ড ভাবে ভালোবেসে ফেলেছি। আমার ওকেই চাই।তোমরা কেনো ওর সাথে এমন ব্যবহার করতেছো?তুমিও দেখতে পারো না,আপুরাও দেখতে পারে না।অথচ তোমরা নিজেরাই ওকে পছন্দ করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছো।

কামিনী তখন বললো আমরা কি আর জানতাম এই মেয়ে এমন হবে?আমরা তো ভেবেছিলাম সহজ সরল মেয়ে সে।কি সুন্দর সাবলীল ভাবে কথা বলছিলো সেদিন।আর এখন বিয়ের এক দিন পরেই আমার সংসারের ভালোমন্দ বিচার করতে আসে?

কুশান তখন বললো আমি অতোসব বুঝি না।আমার তোড়াকে এনে দাও।

কামিনী তখন কুশানকে ধমক দিয়ে বললো, তোকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।তুই হলি আমার সবচেয়ে আদরের সন্তান।কিন্তু তাই বলে তোর এই আবদার আমি মেনে নিতে পারলাম না।কারন তোড়াকে আমার সুবিধের মেয়ে মনে হচ্ছে না।ও যদি নিজের থেকে নাও যাইতো আমি তবুও ওকে পাঠাতাম।এই বলে কামিনী রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
🖤
তোড়া তার বাড়ি পৌঁছে গেলো।
তোড়াকে এভাবে হঠাৎ করে দেখে চামেলি বেগম দৌঁড়ে এলেন।কারণ কোনো মেয়েই বিয়ের পরের দিনই এভাবে শশুড় বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি একা একা যায় না।

চামেলি বেগম এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন।তিনি কাউকেই দেখতে পেলেন না।তখন তিনি বললেন, মা জামাই কই?জামাইকে দেখছি না যে?

তোড়া তার মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।সে সোজা তার নিজের রুমে চলে গেলো।আর কাপড়ের ব্যাগ টা মেঝেতে ফেলে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে রুমে বসে কাঁদতে লাগলো।তোড়াকে ঘরের দরজা দেওয়া দেখে চামেলি তোড়ার নাম ধরে ধরে ডাকতে লাগলো।মা তোড়া?দরজা খোল মা।
কিন্তু তোড়া কিছুতেই দরজা খুললো না।
এদিকে চামেলি বেগমের ডাকাডাকির শব্দ শুনে তোড়ার কাজিন স্বর্ণা এগিয়ে এসে বললো, চাচি তোড়া এসেছে?আপনি তোড়া তোড়া করছেন কেনো?

চামেলি তখন বললো হ্যাঁ এসেছে।আর এসেই কেন জানি ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।

তোড়ার চাচি মিসেস শিউলি বেগম তখন হুইসেল দিয়ে উঠলো,আল্লায় জানে শশুড়বাড়িতে কোন অঘটন ঘটে এসেছে সে।কারণ তোড়ার রাগ আর জিদের কথা পুরো এলাকার লোক জানে।এক বাপের এক মেয়ে হওয়ায় সে যখন যেটা চাইতো সেটাই তার বাবা পূরণ করে দিতো।অতিরিক্ত আহ্লাদে তোড়া এরকম হয়েছে।

চামেলি বেগম তখন শিউলিকে ধমক দিয়ে বললো কি যা তা বলছিস?নিজের ঘরেও কিন্তু মেয়ে আছে তোর।সব সময় পরের মেয়েকে নিয়ে দুই চার লাইন বলার আগে একটু ভেবেচিন্তে বলিস।তোড়া এতোদূর থেকে এসেছে সেজন্য বোধ হয় রেস্ট নিচ্ছে এই বলে চামেলি তার কাজে চলে গেলো।

শিউলি তখন স্বর্ণাকে বললো, কি রে তোড়া কি একা একাই এসেছে?না ওর জামাই ও এসেছে?

স্বর্ণা তখন বললো, তা কি আমি দেখেছি? এই বলে স্বর্ণাও চলে গেলো।

চামেলি এবার কুশানের কাছে কল করলো।কুশান তার শাশুড়ীর কল পেয়েই বুঝতে পারলো কেনো তিনি কল দিয়েছেন?
কুশান সেজন্য চামেলির কল রিসিভ করে বললো হ্যালো আম্মু,তোড়া কি পৌঁছেছে?
চামেলি সেই কথা শুনে বললো, হ্যাঁ বাবা পৌঁছেছে।তা তোড়া একা একা এসেছে কেনো বাবা?তুমি আসলে না কেনো?
কুশান তখন বললো আমার একটা জরুরি কাজ ছিলো আম্মু।সেজন্য ওকে আগে পাঠিয়ে দিলাম।

চামেলি তখন বললো তা তুমি আসবে না বাবা?

কুশান চামেলির প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সেটাই ভাবতে লাগলো।
এদিকে তোড়ার দাদি হেনা বেগম বললো এই কোন আজগুবি কথা বউ?বিয়ের পরের দিনই নতুন বউ একা একা কি করে বাপের বাড়ি আসে?তোড়া আবার ওর শশুড় বাড়িতে কারো কিছু করে আসে নি তো?

চামেলি বেগম সেই কথা শুনে রাগ করে বললো আম্মা আপনিও আবার এসব কথা বলা শুরু করলেন?জামাই এর দরকারী কাজ আছে সেজন্য আসে নি।

হেনা বেগম তখন চামেলি বেগমের থেকে ফোন টা কেড়ে নিয়ে বললো,কি এমন কাজ রে তোর?যা তোর বউ এর থেকেও দরকারী?এমন করে একা একা তোড়াকে পাঠানো তোর ঠিক হয় নি।নতুন বিয়ে তোদের,এখন তোরা সবসময় একসাথে থাকবি।তুই যেখানে থাকবি তোড়াও সেখানে থাকবে।তুই এখন এই মুহুর্তেই চলে আসবি।বুঝলি?

কুশান তখন বললো,আজকে কি যেতেই হবে?না গেলে হয় না দাদী?

দাদী তখন হেসে হেসে বললো, দূর বজ্জাত টা?আয় তাড়াতাড়ি।বউকে একা একা রাখতে নেই।অন্যজনের কিন্তু নজর লাগে তাতে।এই বলে হেনা কল কেটে দিলো।
🖤
কুশান একবার ভাবছে কামিনী কে বলে বের হবে।আরেকবার ভাবছে সে না বলেই চলে যাবে।কোনটা এখন করবে সে?কামিনী এক সেকেন্ডের জন্য ছেলেকে চোখের আড়াল করতে চায় না।এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কুশান রেডি হয়ে নিলো।

কুশান তার রুম থেকে বের হয়ে সোজা কামিনীর কাছে গেলো।আর বললো, আম্মু কিছু টাকা দাও তো?

–টাকা?টাকা কি করবি বাবা?

কুশান তখন বললো দরকার আছে।একটু বাহিরে যাবো।

কামিনী তখন তার ব্যাগ থেকে টাকা বের করে কুশানের হাতে দিতে দিতে বললো, বাবা যেখানেই যা বেশি যেনো রাত না হয়।তোর কিন্তু শত্রুর অভাব নাই।

কুশান তখন বললো রাতে আসবো না আজ আম্মু।তুমি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িও।

কামিনী সেই কথা শুনে কুশানের হাত থেকে টাকা গুলো নিয়ে বললো,তোড়াদের বাড়ি যাচ্ছিস নাকি আবার?
কুশান তখন বললো হ্যাঁ।গেলে কি হবে?

কামিনী সেই কথা শুনে বললো, আমার রুম থেকে বের হয়ে যা।যা আমার সামনে থেকে।

কুশান তখন কামিনী কে জড়িয়ে ধরে বললো, এতো রাগ কেনো আম্মু মেয়েটার উপর?আমাকে কত ভালোবাসো?আর তোড়ার নাম শুনলেই তোমার মাথায় আগুন উঠে যায়।কেনো আম্মু?

কামিনী তখন বললো আমার যাকে ভালো লাগে না তার নাম শোনামাত্র আমার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে।ওই মেয়ে এসেছে একদিন হলো আর এসেই আমার সংসার নিজের আয়ত্তে নিতে চায়।কত বড় সাহস দেখছিস?ও আমার এখন সবচেয়ে বড় শত্রু।ওকে দূর না করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না।

হঠাৎ চামেলি বেগম আবার কল দিলেন।কুশান সেজন্য সাথে সাথে কল কেটে দিয়ে কামিনী কে বললো,আম্মু দাও টাকাগুলো।আমি একটু বেড়াতে যাবো।

কামিনী তখন বললো আমি বিশ্বাস করি না।

কুশান তখন কামিনীর কথা শুনে রাগ করে বললো দরকার নেই তোমার টাকার।আমার বন্ধুরা পিকনিকে গিয়ে আনন্দ ফূর্তি করবে আর আমি চুপচাপ বসে থেকে ওদের আনন্দ দেখবো।আজ যদি নিজে ইনকাম করতাম তাহলে আর কারো কাছে এভাবে হাত পেতে টাকা চাইতে হতো না।কালকেই আমি চাকরি তে জয়েন করবো।চাকরি না পেলে দরকার হলে রিক্সা চালিয়ে উপার্জন করবো।তবুও এভাবে হাত পেতে কারো কাছে টাকা চাইবো না।

কামিনী কুশানের কথা শুনে বললো, বাবা রাগ করতেছিস কেনো?তুই যে পিকনিকে যাবি সেটা বলবি না আগে?এই নে ধর আরো বাড়িয়ে দিলাম।এই বলে কামিনী তার ব্যাগ থেকে আরো কিছু টাকা বের করলো।

কুশান তখন কামিনী কে আবার জড়িয়ে ধরে বললো এই না হলো আমার লক্ষ্ণী আম্মু।শুধু তার রাগ আর জিদ টা বেশি।
আম্মু ঔষধ গুলো সময় মতো খেয়ে নিও।তা না হলে কিন্তু ক্ষত শুকাতে দেরি হবে তোমার।
এই বলেই কুশান বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।

চলবে,

#আমি_ফাইসা_গেছি(০৯)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

তোড়াকে কাঁদতে দেখে মিসেস চামেলি বেগম আর গোলাপ সাহেব বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন মা কি হয়েছে তোর?এভাবে কাঁদছিস কেনো তুই?
কিন্তু তোড়া কিছু বলতে পারলো না তাদের।সে অনবরত কেঁদেই চলছে।

তোড়া মনে মনে ভাবতে লাগলো আর বলেই বা কি হবে?তার যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।সব তার নিজের ভুলে হয়েছে।সে যদি জিদ করে সেদিন কুশানকে বিয়ে না করতো তাহলেই সে ভালো থাকতে পারতো।

এরকম মেরুদন্ডহীন কাপুরষ ছেলের সাথে থাকতে এখন তার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে।তোড়া এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এই ছেলের সাথে সে এতোদিন প্রেম করেছে।যাকে সে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে সেই প্রেমিক তার স্বামী হয়েও আর হইলো না।যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না,নেড়ে কুকুরের মতো মা আর বোনের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায়, তারা যেটা করতে বলে সেটাই শুধু করে,যার নিজের কোনো কথা বলার ক্ষমতা নাই তাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না তোড়ার।তোড়া ফাইনাল ডিসিশন নিয়েই ফেললো সে আর যাবে না কুশানের বাড়িতে।সে কুশানকে সত্যি সত্যি ডিভোর্স দিবে।

হঠাৎ স্বর্ণা হাঁপাতে হাঁপাতে এলো তোড়ার রুমে।আর বললো,তোড়া আপু!তোড়া আপু!কুশান দুলাভাই কে আসতে দেখলাম।

চামেলি বেগম আর গোলাপ সাহেব জামাই আসার কথা শুনে খুশি হলেও তোড়ার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুঁটতে লাগলো।
চামেলি বেগম আর গোলাপ সাহেব সেজন্য রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।কিন্তু বাহিরে গিয়ে দেখেন কুশান এখনো আসে নি।তবে তারা একজন ভ্যানওয়ালাকে দেখতে পেলেন।ভ্যানের উপর ছিলো হরেক রকমের ফলমূল আর মিষ্টান্ন।

কুশান বিয়ের পর আজ প্রথম বার শশুড়বাড়িতে এসেছে।সেজন্য সে ব্যাগভর্তি ফলমূল আর হরেক রকমের মিষ্টি কিনেছে।তার এগুলো বহন করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো সেজন্য সে ভ্যান ভরে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষন পর কুশান ও আসলো।

কুশান চামেলি বেগম আর গোলাপ সাহেব কে দেখামাত্র তাদের পা ধরে সালাম করলো।কিন্তু গোলাপ সাহেব কুশানকে তার বুকে টেনে নিয়ে বললো,বাবা কি করছো?এভাবে পায়ে সালাম করতে নেই।তুমি আমার একমাত্র জামাই,তোমার স্থান সবসময় আমার বুকে।এই বলে গোলাপ সাহেব কুশানকে তার বুকে টেনে নিলেন।এদিকে চামেলি বেগম জামাই কে দেখে তার জন্য খাবার দাবার রেডি করতে গেলো।একমাত্র জামাই তাদের।তাছাড়া তোড়ার কোনো ভাই বোনও নাই।সে
জন্য কুশানকেই এখন তারা তাদের ছেলে ভাবে।

কুশান আসার কথা শুনে হেনা বেগমও এগিয়ে এলেন।কুশান তখন তোড়ার দাদীকেও সালাম করলো।
হেনা বেগম তখন বললো,লাগবে না সালাম করা।যা ঘরে গিয়ে বস।তোড়া ওর রুমেই আছে।আর হ্যাঁ,কোনোদিনও আর ওকে এভাবে একা একা পাঠাবি না।নতুন বিয়ে তোদের।সেজন্য দুইজনকে এখন থেকে একসাথেই আসতে হবে।

কুশান দাদীর কথা শুনে মাথা নাড়লো।

কুশান সবার এমন ব্যবহার দেখে মনে মনে ভাবতে লাগলো তোড়ার ফ্যামিলির লোকজন তাকে কত ভালোবাসে!অথচ তার ফ্যামিলির লোকজন তোড়াকে সহ্য করতেই পারে না।কতভাবে তাকে অপমান করে।আর সেও অপদার্থের মতো চুপচাপ শুধু দেখে যায়।মা আর বোনদের মুখে মুখে উচিত জবাব কেনো সে দিতে পারে না?

কুশান এবার সোজা তোড়ার রুমে চলে গেলো।সে জানে তোড়া তাকে দেখে ডাইরেক্ট একশন শুরু করে দিবে সেজন্য কুশান রুমে ঢোকামাত্র আগে দরজা লাগিয়ে দিলো।

তোড়া কুশানকে তার রুমে দেখামাত্র একদম বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেলো।আর কুশানকে ইচ্ছামতো মারতে লাগলো।
কুশান কোনো প্রতিবাদ করলো না।এমনকি তোড়াকে থামানোর ও চেষ্টা করলো না।সে জানে তোড়া তাকে মারতে মারতে এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে।
তোড়া কুশানকে চুপচাপ থাকা দেখে বললো, এই তোর কি লজ্জা শরম নাই?এইভাবে যে আমার হাতে মার খাচ্ছিস তবুও কিছু বলছিস না?তুই কি সত্যি পুরুষ মানুষ?
কুশান তখন বললো তোমার যত খুশি আমাকে আঘাত করো।যা মন চায় বলো। আজ আমি কিছুই বলবো না।কারণ এরপর থেকে তুমি অন্য কুশানকে দেখতে পারবে।

তোড়া তখন হাসতে হাসতে বললো,বিড়াল সবসময় ম্যাঁও ম্যাঁও করেই ডাকে।বিড়াল কি আর বাঘের গর্জন করতে পারবে?

–সেটা সময় হলেই দেখতে পারবে।

তোড়া তখন বললো আজেবাজে না বকে আগে বল কি জন্য এসেছিস এখানে?আমার বাড়িতে তোকে কে আসতে বলেছে?

কুশান তখন বললো আমি তোমার বাড়িতে কেনো আসতে যাবো?এটা আমার শশুড় বাড়ি।আমি আমার শশুড় বাড়িতে এসেছি।

কুশানের কথা যেনো শুনতেই ইচ্ছে করছে না তোড়ার।সে তখন রাগ করে বললো,যা বের হয়ে যা আমার রুম থেকে।শুধু রুম না তুই আমাদের বাড়ি থেকে এখনি এই মুহুর্তে চলে যাবি।এই বলে তোড়া দরজার ছিটকিনি খুলে কুশানকে বের করে দিলো।আর ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললো,আর আসবি না কখনো এ বাড়িতে।আমি আর জীবনেও তোর মুখ দেখতে চাই না।

তোড়ার এমন পাগলামি দেখে চামেলি বেগম আর গোলাপ সাহেব চিল্লাতে লাগলো।আর বললো, এই মা কি করছিস এটা?পাগল হয়ে গেলি নাকি?
তোড়া তখন নিজেও চিল্লাতে চিল্লাতে বললো হ্যাঁ আমি পাগলই হইছি।তোমরা এই অপদার্থ টাকে কেনো এই বাড়িতে উঠতে দিয়েছো?ওকে চলে যেতে বলো প্লিজ।তা না হলে কিন্তু ওকে আমি খুন করবো।

গোলাম সাহেব তোড়ার এমন ব্যবহার দেখে সবার সামনে তোড়ার গালে কষে কয়েকটা চড় মারলো।আর বললো, কোনোদিন কিছু বলি না দেখে একদম মাথায় উঠে গেছিস।নিজের স্বামীর সাথে কেউ এরকম ব্যবহার করে?

তোড়া তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, ও আমার স্বামী হয় না।আমি ওকে স্বামী হিসেবে মানি না।ও একটা অপদার্থ, কাপুরুষ।এই বলে তোড়া কাঁদতে কাঁদতে তার রুমে চলে গেলো।

চামেলি বেগম আর গোলাপ সাহেব এবার কুশানের হাত ধরে বললো বাবা কিছু মনে করো না তুমি।আমার মেয়েটার একটু রাগ আর জিদ বেশি।ও একটুতেই রেগে যায়।এটা ওর ছোটোবেলার অভ্যাস।

কুশান তার শশুড় শাশুড়ির কথা শুনে চুপ করে রইলো।
তোড়ার বাবা তখন হঠাৎ করেই বললো,কি হয়েছে বাবা? ও এই বাড়িতে দেখি আসার পর থেকে কাঁদছে?কিছু বলছেও না,শুধু কেঁদেই যাচ্ছে,কেঁদেই যাচ্ছে।আর তোমাকেও কেনো জানি সহ্য করতে পারছে না।

কুশান তখন বললো একটু ঝামেলা হইছিলো আম্মু আর আপুদের সাথে।আমি ওর পক্ষে কথা বলি নি দেখে তাই রাগ করেছে আমার উপর।সেজন্য একা একা চলে এসেছে।আর বলেছে সে নাকি আর ফিরবে না ওই বাড়িতে।আমাকে নাকি সে ডিভোর্স দেবে।

চামেলি আর হেনা বেগম কুশানের কথা শুনে মাথায় হাত রেখে বললো,ছিঃ ছিঃ কি সব অলুক্ষনে কথা?বিয়ের সপ্তাহ না পুরতেই ডিভোর্সের কথা?

চামেলি বেগম কুশানের কথা শুনে সোজা তোড়ার রুমে চলে গেলো।আর বললো,মাত্র একদিন হইছে বিয়ে হয়েছে।আর তাতেই শশুড় বাড়ির লোকের সাথে ঝগড়া করে এসেছিস?তুই কি বড় হবি না কখনো?
এখন তোর বিয়ে হয়েছে।বাস্তবতা বুঝতে হবে তো এখন।

তোড়া তখন বললো, আমি যে শশুড় বাড়ি থেকে ঝগড়া করে এসেছি সেটা তোমাদের কে বললো? ওই হাদারাম টা বলেছে তাই না?

চামেলি বেগম তখন তোড়ার মুখে হাত দিয়ে বললো,তুই জামাই কে কি বলছিস এসব?কিসের হাদারাম?জামাই বাবাজি একটু সহজ সরল মানুষ।কথা কম বলে।তাই বলে তুই তাকে হাদারাম বলবি?

তোড়া তখন বললো, আম্মু তুমি এবার জামাই এর গুনগান গাওয়া থামাবে।তুমি শুনতে চাও ওই বাড়ির ইতিহাস?শুনলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে?

–কেনো?কি হয়েছে?

তোড়া তখন বললো সবাইকে ডাকো।আমি বার বার এক কথা সবাইকে বলতে পারবো না।আব্বু,দাদী,চাচা,চাচি সবাইরে ডাকো।আজ আমি তোমাদের ওই বাড়ির সবার কথা বলবো।তোমরা কোন পরিবারে আমাকে বিয়ে দিয়েছো যা শুনলে নিজেরা কিছুতেই ঠিক থাকতে পারবে না।

চামেলি তখন বললো আগে আমাকে বল।কি হয়েছে?

ঠিক তখনি কুশান আবার এলো রুমে।সে তখন চামেলি বেগম কে বললো, আম্মু আপনি একটু বাহিরে যাবেন প্লিজ।আমি একটু তোড়ার সাথে কথা বলতে চাই।

চামেলি বেগম তখন বললো, আচ্ছা বাবা।এই বলে চামেলি বেগম চলে যেতে ধরলে তোড়া বললো, আম্মু আমিও যাবো তোমার সাথে।আমি এই ছেলেটাকে কিন্তু মোটেও সহ্য করতে পারছি না।

কুশান তখন চামেলি বেগমের সামনেই তোড়ার হাত ধরে বললো, বিয়ে যখন করেছো তখন সহ্য করতেই হবে।আমার থেকে পালানোর আর কোনো উপাই নাই।

তোড়া তখন কুশানের হাত ঝাটকা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো,কুশান ভালো চাইলে চলে যাও আমার সামনে থেকে।আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।

কুশান তখন বললো বলতেই হবে।
এই বলে দুইজনে আবার ঝগড়াঝাটি শুরু করে দিলো।

চামেলি বেগম তার মেয়ে আর জামাই এর এমন ঝগড়া দেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কুশান তখন সাথে সাথে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।

তোড়া তখন বললো কুশান দরজা খোলো বলছি।সবার সামনে এটা কি ধরনের অভদ্রতা?এমন ভাব দেখাচ্ছো যে তুমি একজন পারফেক্ট স্বামী আমার।

কুশান তখন বললো,তোমার জন্য আমিই তো পারফেক্ট তোড়া?এই যে আমাকে এতো এতো মারো অন্য কোনো ছেলে হলে মারতে পারতে?উলটো তোমাকেই মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলতো।এই যে বকাবকি গুলো করো অন্য ছেলে হলে নির্ঘাত তোমাকে জ্যান্ত পুতে ফেলতো।এই আমি দেখে কিছু বলি না।

তোড়া তখন বললো আমার এতো ভদ্র ছেলে লাগবে না।যে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে চুপচুপ বসে থাকে সেরকম ছেলে আমি চাই না।

কুশান তখন বললো, ওকে।আজ থেকে প্রতিবাদ করবো।এবার তুমি তোমার মাথাটা একটু শান্ত করো।তারপর আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো একটু।

–কিছুই শুনতে চাই না আমি।আর কিছু বুঝতেও চাই না।যা বোঝার সব বুঝে ফেলছি।আর যা করার এখন সে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলছি।

কুশান তখন বললো,ঠিক আছে।তোমার যা মন চায় করো তুমি।এখন ঝটপট রেডি হয়ে নাও দেখি।আমি তোমাকে নিতে এসেছি।

–মানে কি কুশান?আমি কি যাওয়ার জন্য এসেছি নাকি?এতোকিছুর পরও কি করে ভাবলে আমি ওই বাড়িতে যাবো আবার?আমি যাবো না ওই বাড়িতে।
শুধু আমি না।আমার আব্বু আম্মুও আর পাঠাবে না।আমি সবাইকে সবকিছু বলেছি।

কুশান তখন বললো, আমি জানি তুমি এখনো আব্বু আম্মুকে কিছু জানাও নি।আশা করছি কিছু জানাবেও না।ওসব কথা শুনলে ওনারা ভীষণ মন খারাপ করবে।সেজন্য ওনাদের না জানানোই ভালো।
কুশান এবার তোড়ার হাত ধরে বললো,আম্মু আর আপুরা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।আমি কি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি কখনো?তাহলে ওদের করা রাগ আমার উপর ঝাড়ছো কেনো?

তোড়া তখন বললো, তোমার আম্মু আর আপুরা আমাকে অপমান করবে আর সেটা আমি বসে থেকে শুনবো?যে বাড়িতে আমার কোনো দাম নেই, যে বাড়িতে আমি আমার স্বাধীন ভাবে চলতে পারবো না সে বাড়িতে যাবো না আমি।

কুশান তখন তোড়ার দুই হাতে তার নিজের হাত রেখে বললো,এখন থেকে তোমার যেভাবে মন চায় তুমি সেভাবেই চলবে।চলো আমার সাথে।এরপর থেকে কেউ কিছু বললে আমি প্রতিবাদ করবো।এই যে কথা দিলাম।

তোড়া তখন কুশানকে ধাক্কা দিয়ে বললো,লাগবে না প্রতিবাদ করা।আমি বলেছি যাবো না তো যাবো না।আমার তোমার মতো হাদারাম স্বামী চাই না,আর তোমাদের মতো এমন আজগুবি ফ্যামিলিও চাই না।

হঠাৎ হেনা বেগম তোড়া তোড়া বলে ডাকতে লাগলো।আর বললো,কি রে তোদের কি কথা বলা শেষ হয় নি?একটু বাহিরে আয় দেখি।
কুশান দাদীর ডাক শুনে নিজেই খুলে দিলো দরজা।

হেনা বেগম রুমে প্রবেশ করেই তোড়াকে বললো,ঘরের দরজা লাগিয়ে স্বামীর সাথে গল্প করলেই কি স্বামীর পেট ভরবে?না তাকে কিছু খেতে দিতে হবে?চল কুশান,আর তোড়া তুই ও আয়।এই বলে দাদী দুইজনেরই হাত ধরে বাহিরের রুমে নিয়ে গেলো।

চামেলি বেগম জামাই আসার কথা শুনে আগেই সবকিছু রান্না করে রেখেছেন।কুশান এতো এতো আয়োজন দেখে বললো, আম্মু,কতদিন ধরে এসব রান্না করেছেন?

চামেলি বেগম সেই কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো, দূর বোকা ছেলে?কত দিন ধরে রাঁধতে যাবো কেনো?তুমি যখন ফোন করে বললে আসতেছো তখন থেকে রান্না করা শুরু করেছি।

–এতো খাবার আমি কত বছরে শেষ করবো?

চামেলি বেগম তখন হাসতে হাসতে বললো,বসো তাড়াতাড়ি। খেয়ে নাও।তোমার যতক্ষন মন চায় ততোক্ষনই খাবে।

কুশান তখন বললো আব্বু কোথায়?আব্বু কে ডাক দিন।

চামেলি বেগম তখন বললো তোমার শশুড় একটু বাজারে গেছে বাবা।তুমি খেয়ে নাও।
তোড়া মুখ গোমড়া করে আছে।সে যে কাউকেই তার কষ্ট বোঝাতে পারছে না।কুশান তার পরিবারের সাথে এমনভাবে আচরণ করছে মনে হচ্ছে কিছুই হয় নি।সে যেনো স্বামীর সংসারে বেশ সুখেই আছে।

তোড়াকে চুপচাপ দেখে কুশান তার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললো, খাও।ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?আম্মু কি শুধু আমার একার জন্য রান্না করেছে?তোমার জন্যও তো করেছে।

তোড়া কুশানের এমন কান্ড দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো।কুশান তার মা আর দাদীর সামনে করছে টা কি?

অন্যদিকে চামেলি বেগম লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো আম্মা আপনি একটু কুশান বাবাকে খাবার বেড়ে দিয়েন।আমার একটু কাজ আছে।এই বলে চামেলি চলে গেলো।

হেনা সেই কথা শুনে বললো আমাকেও থাকতে হবে না।ওরা দুইজন একা একাই নিতে পারবে।এই বলে হেনা বেগমও চলে গেলো।

সবাই চলে যাওয়ার পর তোড়া বললো,আমার বাড়িতে এসে কি বউ এর দরদ উছলে উছলে পড়তেছে?আম্মু আর দাদির সামনে খাবার তুলে দিলে কেনো মুখে?

কুশান তখন বললো সবাইকে বোঝাতে হবে না জামাই তাদের মেয়েকে কতখানি ভালোবাসে?

তোড়া কুশানের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো।কুশান তখন বললো দাঁড়ালে কেনো?কিছুই তো খেলে না?

তোড়া তখন বললো সবাইকে তো দেখালেই কত ভালোবাসো আমায়।আর কি জন্য থাকতে হবে এখন?
কুশান তখন নিজেও দাঁড়ালো।আর বললো,তোড়া আমি তোমাকে কিন্তু লোক দেখানো ভালোবাসি না।আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।প্লিজ রাগ করে থেকো না আর।তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে আমার সাথে চলো।

তোড়া কুশানের কথা না শুনে আবার তার রুমে চলে গেলো।

এদিকে চামেলি বেগম কামিনীর কাছে কল করলো।চামেলি চাইছিলো তোড়া আর কুশান কিছুদিন এখানেই থাক।পরে কুশানের পরিবারের লোকজন যেনো সময় সুযোগ বুঝে এদের দুইজনকে এসে নিয়ে যায়।সেজন্য দাওয়াত দেওয়ার জন্য কল করলো চামেলি।কিন্তু চামেলি তো আর জানে না কুশান কাউকে না বলেই শশুড় বাড়ি এসেছে।

চামেলি অনেক কয়বার কল দিলো কামিনী কে। কিন্তু কামিনী রিসিভ করলো না কল।চামেলি সেজন্য এবার জারিফ চৌধুরীর কাছে কল দিলো।জারিফ চৌধুরী কল রিসিভ করতেই কামিনী বললো,
আসসালামু আলাইকুম,বিয়াই সাহেব।কেমন আছেন?
জারিফ চৌধুরী তখন নিজেও হেসে উত্তর দিলো ওয়ালাইকুম আসসালাম বিয়াইন।জ্বি ভালো আছি।

চামেলি তখন বললো কুশান আর তোড়া যখন এসেছেই তাহলে কিছুদিন একটু থেকে যাক এখানে।

জারিফ চৌধুরী চামেলি বেগমের কথা শুনে বললো কুশান আপনাদের বাড়ি গিয়েছে?

–হ্যাঁ।কেনো আপনাদেরকে বলে আসে নি কুশান?

–হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছে।ও আমাকে না বলে কোথাও যায় না।

চামেলি তখন বললো বেয়াইন কই বিয়াই সাহেব?একটু দিন না ফোন টা।

জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো যা বলার আমাকেই বলেন বেয়াইন।ও একটু ব্যস্ত আছে।

চামেলি তখন বললো দুই তিন দিন পরে বেয়াইন কে সাথে করে নিয়ে তোড়াকে নিয়ে যায়েন।অগ্রিম দাওয়াত দিলাম কিন্তু।

জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো আমরা একটু ব্যস্ত আছি বেয়াইন।কুশান একাই নিয়ে আসতে পারবে।

–সেটা হয় নাকি বেয়াই?আপনাদের বাড়ি থেকে যে কাউকে আসতেই হবে।

–আচ্ছা দেখছি।

চামেলি বেগম তখন বললো ইরা,মিরা লিরা মা রা কই?ওদের কে না হয় আসতে বলেন।বা শাহিন,মাহিন,তুহিন বাবারা এলেও হবে।

হঠাৎ কামিনী প্রবেশ করলো রুমে।জারিফ চৌধুরী কে কথা বলা দেখে বললো,
এভাবে ফিসফিস করে কার সাথে কথা বলছো?

জারিফ চৌধুরী কামিনীর কন্ঠ শোনামাত্র কল কেটে দিয়ে বললো,কই কার সাথে কথা বলছি?

কামিনী তখন বললো ফোনটা একটু দাও তো।

জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো তুমি এই বয়সে এসেও কি আমাকে সন্দেহ করছো?এখন কি আমার প্রেম পিরিতি করার বয়স আছে?

কামিনী জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে বললো,দিন দুপুরে কি ভুলভাল বকছো?আজ আবার কিছু গেলো নি তো?

–তাহলে ফোন চাচ্ছো কেনো?

কামিনী তখন জারিফ চৌধুরীর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,আমার বাবু সোনাকে একটু কল করবো।বন্ধুদের সাথে পিকনিকে গেছে।দেখি এখন কতদূর?

জারিফ চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, আমি কথা বলেছি।এখনো পৌঁছে নি।এই বলে জারিফ চৌধুরী তার ফোন টা কেড়ে নিলো কামিনীর থেকে।

–তুমি কথা বললে হবে নাকি?দাও ফোন টা?এই বলে কামিনী আবার জারিফ চৌধুরীর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।

জারিফ চৌধুরী তখন আবার ফোন টা কামিনীর থেকে নিয়ে নিলো।আর বললো, আমার ফোনে টাকা নাই তো।কি দিয়ে কথা বলবে?

কামিনী তখন বললো, জারিফ?ব্যাপার কি?তোমাকে আজ কেনো জানি অন্যরকম লাগছে?হয়েছে টা কি?আজ বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছো আমার সাথে?আর বার বার ফোন কেড়ে নিচ্ছো?

জারিফ চৌধুরী তখন বললো, তা কি সারাজীবন শুধু নিচু গলাতেই কথা বলবো?আমাকে তো স্বামী হিসেবে একটুও মূল্যায়ন করো না।সেজন্য আজ তোমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে আমার সাহস দেখালাম।এই বলে জারিফ চৌধুরী রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

কামিনী কিছুই বুঝতে পারলো না।আজ হঠাৎ জারিফের কি হলো?

চলবে,