আমি মায়াবতী পর্ব-০১

0
517

আমি_মায়াবতী
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

বাবার উপর থেকে আমার ভালোবাসা সেদিনই উঠে গিয়েছিল, যখন মায়ের মৃত্যুর একদিন আগে মাকে ডিভোর্স পেপার এ সাইন করতে বলেছিল। মা ও বিনাবাক্যে সাইন করে দিয়েছিল। মায়ের চোখেমুখে বেদনার ছাপ। আর বাবার চোখে আনন্দ। যেন কতদিন পর ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামাতে পেরেছে। বাবার এই কান্ড আমি দরজার আড়াল থেকে দেখেছি। বাবা আমাকে দেখেনি। বাবা বাসা থেকে বের হয়ে যেতেই মা আমাকে কাছে ডেকেছিল। আমি মাথা নিচু করে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি। কিভাবেই বা পারবো? আমার মায়ের কষ্ট দেখতে যে আমার ভীষণ খারাপ লাগতো। আমি জানি, আর পাঁচটা স্বাভাবিক পরিবারের মতো, আমাদের পরিবার টা স্বাভাবিক না। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সেই সুবাদে আমার তো রাজকন্যার হালে থাকার কথা। কিন্তু আমি সেভাবে নেই। বাবা আমাদের সাথে থাকে না। আমি মায়ের আদরেই বড় হয়েছি। মাসের শেষের দিকে বাবা ভোর সকালে আমাদের বাসায় আসতো। পরের মাসের যাবতীয় যা যা দরকার হয়, সব কিছুর খরচ দিয়ে দুপুরেই চলে যেত। মাঝে মাঝে আমার সাথে সারাক্ষণ গল্প করত। তখন নিজেকে সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হতো। কিন্তু বাবা, মায়ের সাথে দরকার ছাড়া কোনো বিশেষ কথা বলতো না। মিথ্যা বলবো না, বাবা যে খরচ দিত, তার অর্ধেক ও আমাদের লাগতো না। কিন্তু, মায়ের তার স্বামীর অভাব আর আমার বাবার অভাব টা থেকেই যেত। আমি জানি, আমরা আলাদা রকম পরিবার। কেউ আমাকে কিছু বলেনি। বাবাও না, মাও না। কেউই বলেনি। কিন্তু আমি জানি, বাবার আরও একটা সংসার আছে। আরও একটা পরিবার আছে। যাদের সাথে বাবা থাকে। আমার মাঝেমাঝে বাবাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়,” বাবা, আমার কি আরও ভাইবোন আছে? তারা কেমন? তারা কি তোমাকে ভালোবাসে? তুমিও কি তাদের ভালোবাসো?”
কিন্তু আমি পারিনা। চাইলেও পারিনা। কেন যে পারিনা জানিনা। হয়তো আমাদের মাঝে চিরাচরিত বাবা মেয়ের সম্পর্ক নেই বলে।

সে যাই হোক, মা যখন আমাকে নিজের কাছে ডেকে পাশে বসিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,” আমি আর বেশি সময় বাঁচবো না তুমি জানোই মা। বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতে হবে। ”
আমার খুব কান্না পেল৷ আমি জানি মা মারা যাবে। মায়ের খুব কঠিন অসুখ হয়েছে। এইভাবে আমায় ছেড়ে চলে যাবে মা, আমি বিশ্বাস করতে পারিনি প্রথমে। কিন্তু এখন মেনে নিতেই হয়েছে। আমি জানি মা বাঁচবে না। তাই মায়ের সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি সবসময়। মনে মনে বাবাকে মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করি। বাবা একটু ভালোবাসলে মায়ের এই অবস্থা হতো না হয়তো।
” আমি জানি মা, তুমি আমার এই অসুস্থতার জন্য নিজের বাবাকে দায়ী করো। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, মানুষটা মোটেও এইসবের জন্য দায়ী নন। উনি অনেক ভালো। আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন এইতো অনেক।”
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগে মা আমাকে থামিয়ে দিয়ে ওয়ারড্রোব এর কাছে গিয়ে একটা ডায়েরি নিয়ে আসলো। আমার পাশে বসে সেটাতে গভীর মমতায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”এই যে ডায়েরিটা দেখছো, এইটা হচ্ছে আমার জীবন। আমার জীবনের সবকিছুই আমি এইখানে লিখে রেখেছি। আমি জানি মা, আমরা কেউ না বললেও তুমি জানো যে তোমার বাবার আরও একটা পরিবার আছে। সে তাদের সাথেই থাকে। আমার মৃত্যুর পর তুমি তোমার বাবার সাথে সেখানে যাবে। তোমার বাবার স্ত্রীকে এই ডায়েরিটা দিও মা। আর বলো যে আমাকে ক্ষমা করতে। ”
আমি অবাক নয়নে মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চোখে পানি। মা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো” আমাকে কথা দাও মা, সবকিছু জানার পর আমাকে ভুল বুঝবে না। আমি জানি, আমি ভুল করেছি। পাপ করেছি। যে পাপের ক্ষমা হয় না। কিন্তু আমি তো তোমার মা। তোমার জন্য বেঁচে আছি। না হলে তো কবেই মরে যেতাম। আর হ্যাঁ, যেখানে যাবে, সবাই যা বলবে, তাই করবে। সেখানে তো আর আমি থাকবো না তোমাকে দেখে রাখার জন্য। আর হ্যাঁ, তুমি যখন সবকিছু জানবে, তোমার বাবাকেও বলবে, আমাকে ক্ষমা করতে। পারবে না মা বলতে?”
আমি মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু কোনো প্রশ্নই করতে পারিনি। মায়ের শেষ সময়ে এসে তাকে কোনো প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাইনি।

সেইরাতে বাবা আর বাসায় ফিরেনি। এমনিতেও সে আমাদের বাসায় রাতে কখনোই থাকে নি। কিন্তু অনেক মানুষ এসেছিল। তারা নাকি আমার মায়ের আত্মীয়। কেউ আমার নানা, নানী, খালা, মামা, মামী, আর তাদের বাচ্চারা। আমাদের ২ রুমের ছোট্ট কামরা টা কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। নানী নামের মানুষটা মাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। মা এমনভাবে তাদের সাথে কথা বলছিল, যেন তারা তার কত আপন। আমি শুধু চুপচাপ সবকিছু দেখছিলাম। নানী নিজে হাতে মাকে খাবার খাইয়ে দিল। মায়ের চুলে বিলি কেটে দিল। তেল দিয়ে দিল। খালামনি মাকে নতুন জামা পড়িয়ে দিল। আমি যেন চোখের সামনে থেকেও আড়াল হয়েছিলাম। কিন্তু একসময় সবাই আমার দিকেও নজর দিল। মা নানীর হাত ধরে বললো,” আমি চলে গেলে ওর বাবাকে খবর দিও মা। ওকে ওর বাবার সাথে পাঠিয়ে দিও।”
” কেন? ওর সাথে কেন ওকে দিব? আমরা কি মরে গেছি নাকি? এতোদিন শর্তানুযায়ী আমরা কেউ কিছু করতে পারিনি তোর জন্য। কিন্তু তোর মেয়ে আমাদের দায়িত্ব। আমাদের কাছে থাকবে ও।” মামা বললো।
” না ভাইয়া। আমি চাই না ও তোমাদের সংসারে যাক। ওর খুব ইচ্ছে ওর বাবা মায়ের সাথে থাকা। কিন্তু আমার জন্য তা সম্ভব হয়নি৷ এইবার থাকবে।”
” আপু, তোর কি মনে হয় ওর বাবার বউ ওকে ভালোবাসবে?”
” ভালো না বাসলেও ওকে ভালো রাখবে। এইটুকু আমি জানি। সবাই তো আমার মতো খারাপ বা স্বার্থপর না।” বলেই মুচকি হাসলো মা।
” আহ! আজকের দিনে এইসব কথা কেন?” রাশভারী গোছের নানা নামের মানুষটার এক ধমকে পরিবেশ টা বেশ ভারী হয়ে উঠলো।
***
এর পরের কাহিনি খুব সংক্ষেপ। তার পরের দিন রাতেই আমার মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। সে রাতেই বাবাকে খবর দেওয়া হলো। বাবা ভোর রাতের আগেই বাসায় এসে পৌঁছোল। সেই প্রথম বাবার চোখে মায়ের প্রতি একটু কষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু বাবাকে আমার একদমই সহ্য হচ্ছিল না। বারবার মায়ের বলা কথাগুলো আর বাবার ব্যবহার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছিলাম। নানু আর খালার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। আর আমি ছিলাম নির্বাক। কিন্তু মায়ের খাটিয়া যখন নিয়ে যাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো আমার জীবনটাকেই নিয়ে যাচ্ছে। হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম আমি।

৭ দিন নানীরা আমাদের সাথে ছিল। তারপর বাবার সাথে কথা বলে চলে গিয়েছিল। বাবা আমার স্কুল থেকে সব কাগজ পত্র নিয়ে আমাকে নিয়ে এখন চলেছে ঢাকার পথে। আমি জানিনা আমার ভাগ্যে কি আছে। সামনে কি হতে চলছে। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে সবাই যে আমাকে সহজে মেনে নিবে না, সেটা জানি। আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর মায়ের ডায়েরিটাকে সঙ্গী বানিয়ে আমি চলেছি আমার নতুন ঠিকানায়। পেছনে ফেলে আমার মা আর আমার মায়ের স্মৃতিগুলোকে…

চলবে।