আমি সেই চারুলতা পর্ব-১৬

0
244

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১৬ (প্রথম অংশ)
_______________________

একটা কাপড় দিয়ে চারুর চোখ শক্ত করে বেধে দেওয়া হলো। এতটাই শক্তভাবে বাধা ছিলো যেনো মনে হচ্ছিলো চোখ দুটো একেবারে ভিতরে চলে যাবে। সে অবস্থাতেই জামাল হোসেন আর পুলিশ অফিসারটি তাকে কোথাও একটা নিয়ে এলো। চোখ বাধা অবস্থায়ও চারু বুঝতে পারছে এইটা কোনো সাধারণ জায়গা নয়। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটি চলছে এখানে। চারু জানে, ইংরেজিতে সংক্ষেপে এটাকে এসি বলা হয়। পায়ে কোনো জুতা ছিলো না বিধায় অনুভব করছিলো তার পায়ের নীচে টাইলস করা মেঝে। জামাল হোসেন তাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলো। আচমকা এমন কিছুর জন্য চারু প্রস্তুত ছিলো না তাই বেশ ব্যথা লাগলো তার। এমন সময়েই চারু একটি যুবকের পরিষ্কার কণ্ঠে বলা কথাটি শুনতে পেলো,
– এই মেয়েকে আরো কিছুদিন সময় দিতে চেয়েছিলাম মানিয়ে নেওয়ার জন্য কিন্তু এত অবাধ্য মেয়ে আমি আমার সারাজীবনেও দেখিনি। এর ব্যবস্থা খুব দ্রুত করতে হবে নইলে আমাদের পঁচিশ বছরের পরিশ্রম মাটিতে মিশে যাবে।
রাগ মিশ্রিত গম্ভীর স্বরে বলা কথাটা শুনে এক মূহুর্তের জন্য কেপে উঠলো চারু। তার বুঝতে বাকি নেই এই লোকটাই বস কিন্তু অবাক করা বিষয় তার কণ্ঠস্বর চারুর চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছেনা।
– এখন ওরে কি করমু বস?
– আপাতত আমার কাছে রেখে যাও। তোমরা গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। ওর সাথে আমার কথা আছে।
– আমরা থাকি না বস।
– এক কথা আমি দ্বিতীয় বার বলা পছন্দ করিনা। বাইরে যাও।
চারু দরজা খোলার আওয়াজ পেলো অর্থাৎ এ দুজন চলে যাচ্ছে। চারু বারবার মনে করার চেষ্টা করছে আওয়াজটা সে কোথায় শুনেছে। আবছা ভাবে কিছু মনে হচ্ছে তো কিছুক্ষণ পরেই আবার কণ্ঠস্বর ভিন্ন মনে হচ্ছে আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে এমন গলার স্বর সে কখনো শোনে নি কিন্তু চারু নিশ্চিত এই লোকটা ওর পূর্বপরিচিত।
– কেমন আছেন মিসেস চারুলতা জামাল হোসেন।
– আমি চারুলতা। শুধু চারুলতা। শুনেছেন আপনি? আমার সাথে ওই জঘন্য লোকটির নাম মেশাবেন না।
– ওকে। মেশালাম না। জামাল সত্যিই বড় বেমানান তোমার মতো সুন্দরীর সামনে। তোমার তো আমাকে বিয়ে করে নেওয়া উচিত ছিলো। হ্যান্ডসাম বসের পাশে তার সুন্দরী স্ত্রী।
– আপনার মতো জঘন্য লোকের স্ত্রী হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।
চারুর কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে ফেললো সামনে থাকা লোকটি। চারু বেশ বুঝতে পারলো লোকটি বিদ্রুপের সাথে বলছে,
– তুমি সত্যিই এক আজব মেয়ে চারুলতা। তোমার সত্যিই মনে হয় তোমাকে আমি বিয়ে করবো? তুমি কি আমার যোগ্য? সুন্দরী হলেই বসের পাশে মানানসই হওয়া যায়না। তাকে হতে হয় স্মার্ট ও ফ্রি মাইন্ডেড। তোমার মতো হাজারো সুন্দরী মেয়ে প্রতিনিয়ত আমি নিজের বিছানায় আনি। তবে তুমি তাদের মধ্যে কিছুটা ভিন্ন। তাদের সুন্দরী হতে প্রতিমাসে অগণিত টাকা খরচ করতে হয়। এই স্পা করো, এই হেয়ার স্ট্রেইট করো, এই ফেসিয়াল করো, এই প্রতিনিয়ত পার্লারে যাও, এমন অনেক কাজ। আর তুমি হলে নেচারাল বিউটি। এমনিতেই সুন্দর। তাতে কি? আমার কি টাকার অভাব যে টাকার অভাবে আমি আমার রক্ষিতাদের সাজগোজের টাকা দিতে পারবোনা? নাকি আমি কিপটে? বাই দা ওয়ে, রক্ষিতা চেনো তো? অবশ্যই চিনবে, ছোট হলেও বেশ ম্যাচিয়ুর তুমি। অন্য কোনো মেয়ে হলে এতক্ষণে কেদেকেটে অস্থির হয়ে যেতো আর তুমি সুন্দর মতো বসে আছো আবার জোর গলায় কথাও বলছো।
– কি চান আপনি? কেনো আমার পেছনে এভাবে পড়ে আছেন? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার?
– আস্তে কথা বলো চারুলতা। আস্তে! তোমার কাছে আমার কিছুই চাওয়ার নেই। তোমারও আমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তুমি সর্বোচ্চ হলে আমার এক রাতের সঙ্গী হতে পারো।
– আপনাকে খু*ন করে ফেলবো আমি।
– স্বপ্ন দেখা ভালো। তুমিও দেখো স্বপ্ন। অবশ্য অনেকেই আমাকে খু*ন করার স্বপ্ন দেখে। আমার সাক্সেস সহ্য হয় না তাদের।
– কি দোষ করেছি আমি? কেনো আমার জীবনটা এমন নরকতুল্য করে দিলেন আপনি?
– আরে বাবা আস্তে কথা বলো না। কানে শুনতে পাই আমি। এত তেজ কেনো তোমার? সবুজকে অবধি মেরে হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়েছো। মেয়ে হয়েও এত জোর কেনো তোমার বলো তো? যাই হোক, তোমার দোষ তুমি খুবই গরীব এবং গ্রামের সুন্দরী মেয়ে।
– মানে?
– মানে কিছুই না। তুমি যদি বড়লোক আর ফ্রি মাইন্ডের হতে তাহলে তুমি আজ এখানে না আমার স্ত্রী রূপে থাকতে কিন্তু এমন অজপাড়া গায়ের মেয়েকে তো আর আমি বিয়ে করতে পারিনা বলো। তাই তোমার আজ এ অবস্থা। যাই হোক, তুমি আর তোমার ভাই দুজনেই প্রচন্ড রকমের জেদী। তুমিও তো এসব মেনে নিয়ে সুন্দর ভাবে থাকতে পারো কিন্তু থাকবেনা আর অপরদিকে তোমার ভাই। হায়রে তার বোনের প্রতি ভালোবাসা, দুইদিন পর পরই তোমাকে খুজতে চলে আসে। আরে বাবা এক বছর তো হয়ে এলো এইবার নাহয় আশাটা ছেড়ে দে কিন্তু নাহ, সেটা ছাড়বে কেনো? এত জেদি কেনো বলো তো? আর মৃত্যুর আগে মনোরমা কি এমন বলেছিলো হামিদকে যে হামিদ এতটা বদলে গেলো? তোমার ভাইয়ের জন্য আমাকে কত বড় একটা প্ল্যান ক্যানসেল করতে হয়েছে জানো? আমি ভেবেছিলাম হামিদকে মোটামুটি টাকার লোভ দেখিয়ে তোমাকে তার কাছ থেকে কিনে নেবো। সহজ ছিলো ব্যাপারটা। কিন্তু মনোরমার মৃত্যুর পর সে তো পুরোই বদলে গেলো। টাকা নিয়ে তোমাকে দেওয়া তো দূরে থাক, তোমার শরীরে কখনো একটা আচর অবধি লাগতে দিতোনা। আমার তো মনে হয় ওকে খু’ন করে ফেললেও ও তোমাকে দিতো না। মায়ের মতোই হয়েছে। তোমরা দুই ভাই-বোন শুধু বাপের চেহারাটাই পেয়েছো বাকি সব তোমাদের মায়ের। মনোরমা মহিলাটাও ভালো ছিলেন। ও তোমাকে তো একটা চমৎকার নিউজ দেওয়াই হয়নি। তোমার ভাই কিন্তু বিয়ে করেছে সেটা জানো? বেশিনা এক মাসের মতো হবে বিয়ে হয়েছে।
– আপনি এইসব কিভাবে জানলেন? ফলো করছেন আমার ভাইকে?
– আরে ধুর! আমার কি ওত সময় আছে নাকি তাকে ফলো করতে যাবো? তোমার ভাই যেখানে থাকে আমার একজন লোকও সেখানে থাকে। সেই আমাকে মাঝেমধ্যে টুকটাক খবর দেয়।
– কোথায় আমার ভাই?
– এখনো মারিনি তাকে। কি লাভ বলো? তবে ভবিষ্যতে যদি সে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে খু*ন করতেও পারি। তাকে মারতে কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগবে। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো।
– আমার ভাইয়ের গায়ে একটা আচরও যদি লাগে আমি আপনাকে খু*ন করে ফেলবো।
– আগে নিজে তো বাচো মিস। তারপর নাহয় আমাকে মেরো। যাই হোক, শেফালীর গায়ের রঙ ময়লা হলেও বিছানায় সার্ভিস কিন্তু বেশ ভালো দেয়। তোমার গায়ের রঙ তো পরিষ্কার দেখি তোমার সার্ভিস কেমন। উপস, সরি তোমাকে তো শেফালী নামক নোংরা মহিলার সাথে তুলনা করে ফেললাম। এখন কি হবে?
নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হেসে ফেললো লোকটি। চারুর ঠোঁটে আঙুল ছোয়াতেই চারু সুযোগ বুঝে কামড়ে দিলো আঙুলে।
– বাহ! দাতে দেখি বেশ জোর। তোমার টুথপেষ্টে নিশ্চয়ই নুন আছে।
– আমাকে ভুলেও ছোয়ার চেষ্টা করবেন না। দূরে যান আমার কাছ থেকে।
– ছোয়ার চেষ্টা করলে কি করবে তুমি?
কথাটা বলতে দেরি হলেও লোকটি চারুর স্পর্শকাতর অংশগুলোতে স্পর্শ করতে দেরি করলোনা।
– তুমি কিন্তু আমার বেশ অনেক দিনেরই আকাঙ্ক্ষিত চারুলতা। আজ ফাইনালি তুমি আমার বিছানায় আসতে চলেছো। তুমিই প্রথম মেয়ে যার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। একটু তো স্পেশাল হতেই হয় আজকের দিনটা। কি বলো?
– আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন। আপনার কি কোনো বোন নেই? তারসাথে এমন হলে কি করতেন?
– আহারে! সত্যিই তো কি করতাম? কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য চারুলতা, আমার কোনো বোন নেই। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এক ছেলে। আমার কোনো ভাই বা বোন নেই। যাই হোক, তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো তোমার হাত পা দুটোই খোলা শুধু চোখ দুটোই বন্ধ? আজই তোমার সুযোগ। আজ শুধু আমিই তোমাকে অত্যাচার করবোনা, তোমারও হাত পা খোলা। ট্রাই করে দেখতে পারো কিন্তু।
– আপনি খুবই জঘন্য একজন মানুষ। আমি নিশ্চিত আমি আপনাকে চিনি। সত্যিই করে বলুন তো আপনি কে?
– আমি কি বলেছি তুমি আমাকে চেনো না? খুব ভালো ভাবেই চেনো তুমি আমাকে। খুব ভালো ভাবে। একটু বেশিই ভালোভাবে।
– কে আপনি?
– আমি বস। তবে সময় হলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পারবে। আমাকে দেখার পর তোমার রিয়েকশন কেমন হয় সেটা আমি অবশ্যই দেখতে চাই।

মেঝেতে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছে চারু। দুচোখ এখনো বাধা। নিজের এই বিভৎস জীবনের কোনো মানে খুজে পাচ্ছেনা সে। এখনো তার সতেরো বছর সম্পন্ন হয়নি। এরই মাঝে কতকিছু দেখতে হচ্ছে তাকে। যে বয়সে একটা মেয়ে বাবা-মায়ের আদরের সন্তান হিসেবে বড় হয়। ভাই-বোনের সাথে ভালোবাসাময় সময় কাটায়। লেখাপড়া করে নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে তোলে। যেটা জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হয় সেই সময়টাই চারুর জীবনে সবচেয়ে কষ্টের মূহুর্ত। এ কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে সে? মনোরমাকে খুনের? সে শাস্তি কি এতটাই ভয়ংকর? এভাবে জীবনটা শেষ হয়ে গেলো? জীবনের এ পর্যায়ে এসেই কেনো তার জীবনটাকে শূন্য বলে মনে হচ্ছে? চারু দেখতে পারছেনা কিন্তু অনুভব করতে পারছে তার সামনে বসে থাকা ২৫-২৬ বছর বয়সী কোনো এক যুবককে,
– এভাবে আর কতক্ষণ পড়ে থাকবে বলো তো? উঠে পড়ো। জামাকাপড় পড়ে নাও এইবার। অবশ্য না পড়লেও ক্ষতি নেই কিন্তু আমার আবার মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে। এখন অনেক কাজ। তোমাকে নিয়ে মেতে থাকলে সেসব তো লাটে উঠবে।
– আপনি কোনোদিন সুখে থাকবেন না? মর্মান্তিক ভাবে আপনার পতন ঘটবে। এমনভাবে সব হারাবেন কিছুই আর ফিরে পাবেননা।
– ওরে বাব্বা! অভিশাপ দিচ্ছো নাকি? দাও দাও সমস্যা নেই। এমনিতেই অনেক পাপ করেছি। তোমার একটা অভিসাপে ভেসে যাবোনা আমি।
– ভেসে যাবেন আপনি। আমি যদি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করি আর তিনি যদি থেকে থাকেন তবে আপনি ভেসে যাবেন। নিজের প্রিয় মানুষটির কাছেই সর্বহারা হবেন আপনি। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আমি যদি মরেও যাই আপনি ছাড়া পাবেননা।
– কি যে বলোনা তুমি। তুমি মরবে কেনো? তুমি আমার পঁচিশ বছরের পরিশ্রম।
– আমি পঁচিশ বছরের পরিশ্রম? কিন্তু আমার বয়স তো কেবল সতেরো।
– সত্যিই আজব এক মেয়ে তুমি। এই অবস্থায় এসেও রহস্য ভেদ করতে চাও?

জিপ গাড়ির উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে চারু। আশেপাশে বেশ কিছু লোকজনের কথার আওয়াজ কানে আসছে৷ তারা বেশ কাছাকাছিই আছে চারুর। এখনো সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পায়নি সে। কেমন এক বিভৎস স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। এরই মাঝে চারু তথাকথিত বসের আওয়াজ পায়। কথাগুলো অস্পষ্ট কিন্তু চারু ঘোরের মধ্যেই দেখতে পেলো ছোটবেলার এক দৃশ্য। চারু একেবারে ছোট। তিন কি চার বছর বয়স হবে। এরই মাঝে কোথাও থেকে একটা ছেলে এসে ওকে কিছু লজেন্স দিলো। চারু খুশি হয়ে সেগুলো নেওয়ার পর ছেলেটা তার সাথে খেলা শুরু করলো। এই স্মৃতি গুলো চারুর মনে ছিলো না। মস্তিষ্ক খুবই পুরোনো স্মৃতি চারুকে স্বপ্ন আকারে দেখাচ্ছে। তবে কি এই ছেলেটাই বস? এই ছেলেটা কে? পরেরবার কোথায় দেখেছিলো তাকে? চারু হিসেব মেলাতে পারেনা। এরপর আর কখনো দেখা হয়নি ছেলেটার সাথে। না না এরপরেও একবার দেখা হয়েছিলো। চারু তখন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া একটা মেয়ে। তখন সুন্দর কাপড পরহিত এক সুদর্শন ছেলে এসেছিলো তার কাছে। চারু অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিলো ছেলেটার দিকে। কোনো মানুষ এতটাও সুন্দর হতে পারে? কিন্তু কে এই ছেলেটা? মুখ চেনা চেনা লাগছে কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা কেনো? এমন সময়েই চারু অনুভব করলো গাড়ি থেমে গেছে। একইসাথে বস সম্মোধন করা সেই যুবকটির কথা,
– আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আধা ঘন্টার আগে কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করবেনা।
তথাকথিত সেই বস চারুকে কোলে তুলে নিলো। চারুর মনে হচ্ছিলো সে শূন্যে ভেসে আছে। কিন্তু এই শূন্যে ভেসে থাকা তার ভালো লাগছেনা। সে বন্দি অবস্থায় আকাশে উড়তে চায়না, সে মুক্ত অবস্থায় খোলা আকাশের নীচে হাটতে চায়। তথাকথিত সেই বসটি তাকে নিয়ে এসেছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে কোনো এক জায়গায়। চারু বোঝার চেষ্টা করছে লোকটাকে কোথায় সে দেখেছে। চারু অনুভব করছে লোকটার শরীর ছিপছিপে ধরনের। হামিদের চেয়েও চিকন। সম্ভবত তার চেয়ে কিছুটা লম্বা কিংবা একই সমান হতে পারে। এমন লোক কোথায় দেখেছে সে? তবে সে যেমনই হোক বেশ শক্ত-সামর্থ্য মানুষ। চারুকে নিয়ে এতটা হেটে যেতেও তার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসছেনা। চারুকে মাটিতে ফেলে দিয়েই সে চারুর ওড়না দূরে ছুড়ে ফেললো। চারু সব বুঝতে পারছে কিন্তু বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। শেষবারের মতো একবার সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে চারু সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি মারলো লোকটার বুকে। সে এইটার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা তাই কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে গেলো। এই সুযোগে চারু নিজের চোখের বাধনটি খুলে ফেললো। লোকটার মুখে একটা কালো মাস্ক। চেহারা দেখা যাচ্ছেনা তার। সে একটু এগিয়ে আসতেই চারু অর্ধভাঙা একটা ইট ছুড়ে মারলো লোকটার মাথায়। মাথায় হাত দিয়েই মাটিতে পড়ে গেলো সে। চারু কোনোরকমে দৌড়াতে শুরু করলো। বেশ অনেকক্ষণ যাবত ধরে দৌড়াচ্ছে ও কিন্তু দুঃখের বিষয় ও কোথায় আছে, কোথায় যাবে কিছুই জানেনা। কিন্তু যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। চারু আবারও দৌড়ানো শুরু করলো। আশেপাশে কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। নাহ, দেখা যাচ্ছে একজনকে। ওইতো কিছুটা দূরে কেউ একজন এদিকে এগিয়ে আসছে। এই লোকটা কে? সে কি ভালো হবে? এখন তার কাছেই সাহায্য চাইতে হবে চারুর। সে দৌড়ে যেতে লাগলো সেদিকে কিন্তু তার পা আর চলতে চাইলোনা। কিছুটা দূরে গিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। জ্ঞান হারানোর আগেই দেখলো লোকটা ছুটে আসছে তার দিকে। কে জানে এইবার তার জীবনটা কোন দিকে মোর নেয়।

রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে চলেছে হামিদ। কোন দিকে যাবে সেই ঠিকানা নেই তার। কে জানে এত রাতে সে আদেও খুজে পাবে কি না চারুকে। আচ্ছা চারু কি এখনো জানেনা হামিদ ওকে খুজছে? যদি জানে তাহলে এখনও কেনো আসছেনা গ্রামে? প্রায় প্রতিসপ্তাহেই তো সে আসে। আশেপাশের গ্রাম গুলোর খোজখবর নেয়। হঠাৎই হামিদ লক্ষ্য করলো দূর থেকে কেউ দৌড়ে আসছে তার দিকে। ভূত নাকি? ভূত হলে তো হাওয়ায় ভেসেই আসতে পারে দৌড়ানোর কি দরকার? হয়তো এক্সারসাইজ করছে। ভূতেরাও এক্সারসাইজ করে নাকি? কথাটা ভেবেই হেসে ফেললো হামিদ। চারুর সাথে থাকতে থাকতে ওর চিন্তাভাবনাও চারুর মতো হয়ে গেছে। মাঝখান থেকে শুধু চারুটাই নেই। হঠাৎই দেখতে পেলো তার সামনে থাকা অবয়বটি মাটিতে পড়ে গেলো। হামিদ দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। কোনো একটা মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে, হামিদ কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা ধাক্কা খেলো। এইটা আর কেউ নয়, চারু। ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা সত্যিই ও চারুকে পেয়ে গেছে কিন্তু পরক্ষণেই থমকে গেলো সে। চারুর গায়ে বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন, ছেড়া জামা, গায়ে ওড়না নেই, চুলগুলো এলোমেলো আর মুখটা মলিন। এই অবস্থা কেনো হয়েছে চারুর? হামির দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো চারুকে,
– চারু, কি হইছে তোর চারু? চোখ খোল আমারে দেখ।
হামিদ নিজের কাছে থাকা পানির বোতলটি নিয়ে চারুর চোখেমুখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে যেনো একটু একটু করে চোখ খুলছে সে।

বিঃদ্রঃ খুব বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে বিধায় গল্পটা দুই অংশে লিখলাম। খুব শীঘ্রই দ্বিতীয় অংশ দেওয়ার চেষ্টা করবো।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১৬(খ)
_______________________

অবচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে শাওন। তার পাশেই বসে রয়েছেন ছোট জমিদার সাহেব। খুবই সহজ সরল নিরীহ প্রকৃতির লোক তিনি। কোনো ঝামেলার সামনে পিছনে নেই। সহজেই লোকের কথার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যান তিনি। তার খুবই আদরের শাওন। আজ সাতদিন যাবত ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে ডাক্তার তাকে। উঠলেই ছেলেটা কেমন পাগলামি শুরু করে দেয়। ইশ! কি মায়াবী মুখ তার। এমন কেনো হলো কে জানে? আজও ছোট জমিদার সাহেবের শাওনের জন্মের দিনটির কথা মনে আছে। জমিদার গিন্নি যখন শিহাবকে জন্ম দেন তার বয়স তখন সবেমাত্র পনেরো। কম বয়সে বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় মরতে মরতে বেঁচে যান তিনি কিন্তু তার পরবর্তীতে সন্তান জন্মদানে সমস্যা দেখা যায়। অনেকবার চেষ্টা করেও বাচ্চা হচ্ছিলো না। বাসার সবাই খুব করে শিহাবের পর আরেকটা সন্তান চাইছিলো। এমন সময়েই জানা যায় শাওনের গর্ভে আসার সংবাদটি। সবাই একেবারে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো। নয় বছর পর জমিদারের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে শাওন জন্ম নিলো। সকলের আদর ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে লাগলো সে। জমিদার গিন্নি আর কখনো সন্তান জন্ম দিতে পারেননি কিন্তু বাসার সকলে শাওন আর শিহাবকে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো৷ বংশের দুই প্রদীপ তো আছেই। আর কি চাই? আর আজ সেই আদরের শাওনের কি অবস্থা। অবস্থা শোচনীয় শিহাবেরও। কোনো কাজেই আজকাল মনোযোগ দিতে পারেনা সে। ঘন্টার পর ঘন্টা এসে ভাইয়ের পাশে বসে থাকে। শাওন তো শিহাবেরও খুব আদরের। হাসপাতালের কেবিনে প্রবেশ করলো শিহাব।
– কাকা তুমি এখানে?
– শাওনরে দেখতে আইছিলাম।
– কেমন আছে ও? জ্ঞান ফিরেছে?
– ফিরছিলো। কয়েকঘন্টা পর আবার ঘুম পাড়ায়া দিছে।
– এভাবে বারবার ঘুম পাড়িয়ে দিলে তো সমস্যা।
– কি জানি? ওত কিছু আমি জানি না। ডাক্তারেরা যে কি করে কে জানে।
– চিন্তা করো না। এইটা খুবই ভালো হাসপাতাল। তুমি দেখো শাওন নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
– তোর হাতে কি হইছে?
– আরে আর বলো না। পরশু মা আর বাবা এসেছিলো। ভাবলাম নিজে কিছু রান্না করে খাওয়াই। সবজি কাটতে গিয়ে হাতই কেটে ফেললাম।
– কি যে করস না তুই। এমনে একা একা একটা ফ্ল্যাটে পইড়া থাকস। কাউরে সাথে নিলেও তো পারস।
– কাকে নিবো?
– এক কাম কর, মিলিরেই নিয়া যা। ভাই বইন একসাথে থাকবি। তোরও কিছু সাহায্য হইলো আর মিলিও কাজকাম কিছু শিখলো। বয়স তো কম হইলো না বিয়া দিতে হইবো এহন।
শিহাব ছোট একটা শ্বাস ফেললো। ওর ছোট চাচার বুদ্ধি কম সেটা মোটামুটি সবাই জানে কিন্তু তাই বলে এভাবে ওর সাথে থাকতে বলবে এটা শিহাব আশা করেনি। মিলি বড় হয়েছে এখন। যতই আলাদা রুম হোক, এভাবে এক ফ্ল্যাটে তো আর থাকা যায়না। তিনি হয়তো এত কিছু ভাবেননি। এখনো ছোটবেলার মতোই সব ভেবে যাচ্ছে। ছোট বেলায় ওরা সব ভাই বোনেরা কত একসাথে ঘুমিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।

★★★

চারু চোখ খুলতেই দেখতে পেলো হামিদ ওর কাছেই বসে আছে। চারুর যেনো ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চাইছেনা। হামিদ আসলেই এসেছে নাকি এইটা স্বপ্ন? যদি স্বপ্ন হয় তো এই স্বপ্ন কখনো না ভাঙুক। না স্বপ্ন না এইতো হামিদ ওকে ডেকে চলেছে তারমানে হামিদ সত্যিই এসেছে। এতদিন পর ভাইকে দেখে চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চারুর। কোনোমতে একবার উচ্চারণ করলো,
– আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।
– কি হইছে চারু? কে মাইরা ফেলবো? আমারে বল কি হইছে?
– আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।
– হ নিয়া যামু। তোরে নিতেই তো আসছি। কিন্তু কে তোরে মারতে চায়?
– পরে বলবো সব আমাকে নিয়ে যাও।
হামিদের কেমন নিজেকে দিশেহারা লাগছে। এখানে কি হচ্ছে কিছুই তার বোধগম্য হলোনা তবুও সে চারুর কথা মেনে এখান থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। চারু হাটাচলার অবস্থায় নেই। সবচেয়ে ভালো হবে ওকে কোলে তুলে নেওয়া। কোলে তুলে নিতেই আরো একবার অবাক হলো সে। সাস্থ্য নিয়ে যেই চারুকে একসময় বারংবার খেপাতো সে এখন সেই চারুর একেবারে ওজন নেই বললেই চলে। ও চলে যাওয়ার পর কি হয়েছিলো চারুর সাথে? শেফালী কিছু করেছে কি? হামিদ মনেমনে পণ করলো শেফালী যদি বিন্দুমাত্র চারুর ক্ষতি হয় এমন কিছুর সাথে জড়িত থাকে তাহলে একেবারে খুন করে ফেলবে সে তাকে। এইটুকু একটা মেয়েকে যে কষ্ট দেবে তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। সে যেই হোক! শেফালী, নাজিমুদ্দিন কিংবা চারুর তথাকথিত সেই বর।

হামিদ চারুকে নিয়ে লোকালয়ের মধ্যে একটা জায়গা খুজছে। গ্রাম থেকে বের হওয়ার শর্টকাট পথ ছিলো এই জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা। সেখান দিয়েই শহরে যেতে চাইছিলো হামিদ কিন্তু রাস্তায় সে এভাবে চারুকে পেয়ে যাবে এইটা সে কল্পনাই করেনি। নিজের মনেই ভেবে নিয়েছিলো সে বোধহয় আর চারুকে খুজে পাবেনা কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি একেবারে। বেশ কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পরেই একটা ছোট কুড়েঘর দেখলো। হামিদ জানেনা সেখানে যাওয়া ঠিক হবে কি না কিন্তু এখন উপায় নেই। হামিদ গিয়ে সেই দরজায় কড়া নাড়লো। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধা মহিলা। তিনি চারুকে দেখে বিষ্ময় নিয়ে হামিদের দিকে তাকালেন।
– আমি আর আমার বইন খুব বিপদের মধ্যে আছি। একটু দয়া কইরা আমাদের সাহায্য করেন।
বৃদ্ধা ভ্রু কুচকে গভীর দৃষ্টিতে একবার চারু আর হামিদের দিকে তাকালেন। তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন হামিদ সত্য বলছে কি না। চারুর মলিন মুখটা দেখে তার মনে হলো আসলেই বোধহয় সে বিপদে আছে তবে হামিদের মুখে রয়েছে দ্বিধা। থাকারই কথা, সে তো জানেই না কি হয়েছে। শুধুমাত্র চারুর কথা মেনেই তাকে লোকালয়ে নিয়ে এসেছে সে।
– ওর কি হইছে?
হামিদ বুঝতে পারছেনা এখন কি উত্তর দেওয়া উচিত। হামিদ নিজেই জানেনা চারুর কি হয়েছে এই বৃদ্ধার প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সে?
– আহো তোমরা আগে ভিতরে আহো।
বৃদ্ধার অনুমতি পেয়ে হামিদ চটজলদি ভিতরে চলে গেলো। বাসায় বৃদ্ধা ছাড়া আর কাউকে দেখা গেলো না। অর্থাৎ, সে এখানে একাই থাকে। আসবাব বলতে শুধু একটা চৌকি আর জামাকাপড় রাখার একটা আলনা। ঘরে বিশেষ কিছু নেই বলেই হয়তো তিনি এত সহজে হামিদ আর চারুকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দিলেন।
– ওরে এই চৌকিতে শুয়িয়ে দাও।
হামিদ বৃদ্ধার কথা মেনে নিলো। চারুর মুখমন্ডলে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। হামিদ নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। এ অবস্থায় চারুকে দেখা সহ্য হচ্ছেনা তার। মনোরমা ওকে বলেছিলো চারুর খেয়াল রাখতে কিন্তু ও পারেনি। একজন ভাই হিসেবে চরমভাবে ব্যর্থ প্রমানিত হলো সে।
– ও তোমার বইন?
হামিদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।
– তোমাগো দুইজনার চেহারায় তো অনেক মিল আছে দেহা যায়।
হামিদ কিছু বললো না। ছোট বেলা থেকেই এই কথা অনেকবার শুনেছে সে। হামিদ আর চারু দুজনের চেহারাই নাজিমুদ্দিনের মতো। ওদের দুজনকে যেই দেখতো সেই বলে দিতে পারতো ওরা নাজিমুদ্দিনের ছেলে মেয়ে।
– কি হইছে ওর? এই অবস্থা ক্যামনে হইলো?
– আমার জন্য সব হইছে।
– তোমার জন্য মানে?
– আমি যদি ওরে রাইখা শহরে চইলা না যাইতাম তাইলে আজ এমন হইতো না।
বৃদ্ধা আর কথা বাড়ালেন না। হামিদ বুঝতে পারছেনা ঠিক কি হয়েছে। রাত প্রায় তিনটা বেজে গেছে ইতিমধ্যে। সম্পূর্ণ দেশ এখন ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। একটা পিনপতন আওয়াজ অবধি শোনা যাচ্ছে। এমন সময় হামিদ শুনতে পেলো একটা জিপ গাড়ির আওয়াজ। হামিদের মনে পড়ে গেলো চারু বলছিলো কেউ একজন ওকে মেরে ফেলবে। তবে কি এত রাতে এই গ্রামে কোনো জিপ গাড়ি চারুর জন্যই এখানে এসেছিলো? কিন্তু চারুকে মেরে কার কি লাভ? হামিদের মাথা সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যাচ্ছে তবে জিপগাড়িতে কে সেটা দেখা প্রয়োজন। হামিদ উঠে যেতে চাইলো কিন্তু তাকে আটকে নিলো বৃদ্ধা,
– কই যাও?
– বাইরে গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যাইতাছে আমার মনে হয় ওইহানে কিছু আছে।
– যাইয়ো না। বড় বড় নেতারা মাঝে মাঝে খুন কইরা নদীতে লাশ ভাসায়া রাইখা যায়। কেউ যদি দেহে তো তারেও মাইরা ফেলে।
– আপনে কিভাবে জানলেন?
– আমি একদিন দেখছিলাম। ভাগ্য ভালা ওরা আমারে দেখে নাই।
হামিদ আর কিছু বললোনা। এখন এসব ঝামেলাতে না জড়ানোই ভালো। ভালোয় ভালোয় চারুকে এইখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে হবে। হামিদ সারারাত জেগেই রইলো। বৃদ্ধাকে কয়েকবার ঘুমাতে বললেও সে ঘুমালেন না। হামিদের সাথেই জেগে রইলেন। কথায় কথায় হামিদ জানতে পারলো বৃদ্ধার দুই মেয়ে এক ছেলে। সবাই বিয়ে করে নিয়েছে। দুই মেয়ে থাকে শশুড় বাড়ি আর ছেলে শহর একটা মেয়েকে বিয়ে করে এখন শহরেই থাকে। মা কে প্রতিমাসে বাজার করে দেওয়ার জন্য একজন লোক রেখে দিয়েছে। আবার মাঝে মাঝে কিছু টাকাও পাঠায়। বৃদ্ধা কিছুই বলেন না। ছেলে রেগে গিয়ে টাকা দেওয়া বন্ধ করলে তাকে না খেয়ে মরতে হবে। এখানে অসুস্থ হলে সেবা করারও কেউ নেই। ছেলের বউ আজ অবধি দেখেননি তিনি। ছেলে নিজেই পছন্দ করেছে তবে ছেলের বউ চায়না বৃদ্ধা তাদের সাথে থাকুক। হামিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ মনোরমা ওদের কাছে নেই। হামিদ যে মনেমনে কতবার মনোরমাকে খোঁজে সে হিসেব নেই আর এই বৃদ্ধার ছেলে কি না তার জান্নাতকে এভাবে একা ফেলে দিয়ে গেছে। আসলে যাদের নেই তারাই বোঝে আর যাদের আছে তারা কখনোই মূল্য দেয়না। মনোরমা যদি হামিদের কাছে থাকতো তাহলে সে মাথায় করে রাখতো ওর মা কে। হামিদের চোখ হঠাৎই গেলো চারুর দিকে। মনোরমার মতো চেহারা নয় তার কিন্তু তাও চারুকে দেখলে মায়ের মতোই অনুভূতি আসে। মনোরমার শেষ স্মৃতি চারু। মনোরমাকে তো আগলে রাখতে পারেনি কিন্তু চারুকে সে তার জীবন দিয়ে হলেও বাঁচাবে। চারুর মাঝেই মনে হচ্ছে যেনো মনোরমাকে খুজে পেয়েছে হামিদ।

চারু ঘুমিয়ে ছিলো নাকি অজ্ঞান ছিলো সেটা বলা গেলো না তবে চারু চোখ খুললো ভোর পাঁচটায়। সূর্য এখনো উদয় হয়নি। হালকা একটু আলো দেখা যাচ্ছে চারপাশে। চারু ঘুম থেকে উঠে হামিদের দিকে একবার তাকালো।
– এহন কেমন লাগতাছে?
– ভালো না। আমাকে কোথায় এনেছো? তোমার বাড়িতে? ওরা এখনই আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে।
– কে নিয়া যাইবো?
– ওই মুখোশ পড়া বস টা।
– কোন বস?
– আমি জানি না। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে তোমার বাড়ি থেকে সরাও।
– শান্ত হ চারু। আমরা এহন অন্য বাসায় আছি। আমার বাড়ি যাই নাই।
চারু চুপ করে গেলো। সে এখন অন্য বাড়িতে আছে সেটাই অনেক। হামিদ চারুকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। চারুর অবস্থা এখন খুব একটা ভালো না। ধীরে ধীরে সব জানা যাবে। বৃদ্ধা চারুকে বললেন গোসল করে আসতে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো না। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মাটি লেগে আছে। সে চারুকে তার মেয়ের একটা শাড়ি দিলেন। জামা দিলে সমস্যা হতো মাপ নিয়ে কিন্তু শাড়ির ক্ষেত্রে এমন কোনো সমস্যা হয়না। চারু কিছু না বলে চুপচাপ কলঘর থেকে গোসল করে নিলো। গোসল করার সময় পানি ঢালায় শরীরের প্রতিটা আঘাত যেনো তাজা হয়ে উঠছিলো। চারু বহু কষ্টে গোসল সম্পন্ন করে বেড়িয়ে এলো। নিজেকে বেশ হালকা মনে হচ্ছে। মানুষের জীবনে পয়সার মতো দুটো অধ্যায় থাকে। একটা ভালো অন্যটা খারাপ। ঠিক দিন রাতের মতো। চারুরও বোধহয় কষ্টের সময়টা কেটে গিয়ে সুখের সময় এলো। কিন্তু তার এখনো অনেককিছু জানার আছে, কে জানে সেসব জানার পর আদেও সে সুখী হবে কি না। চারু উঠোনে গিয়ে বসলো। তার পাশে এসে বসলো হামিদও। চারু কিছুই বললো না। তার এখনো বিশ্বাস হতে চায়না সত্যিই হামিদ তার সাথে আছে।
– সূর্য উদয় দেখবি চারু?
চারু একবার হামিদের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আকাশের দিকে তাকালো। ভোরের সূর্য উঠছে। সবাই তো কেবল সমুদ্র আর পাহাড় থেকেই সূর্যদয় দেখে কিন্তু এই গ্রামে সূর্যদয় দেখার সৌভাগ্য কয়জনের? মনে হচ্ছে যেনো তালগাছের পেছন থেকে সূর্য উকি দিচ্ছে। এমন সময়েই শোনা গেলো হামিদের কণ্ঠ,
– আমি চইলা যাওয়ার পর কি হইছে সেটা আমি জানতে চাইলাম না। আমি জানি তুই-ই সময় কইরা বলবি কিন্তু এখন এই সূর্য ওঠা দেখ। যেমন রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে সূর্য উঠলো তেমনি এই সূর্যটার মতো তোর জীবনের অন্ধকারও দূর হইলো। অতীতে কি হইছিলো সেটা ভুইলা যা, নতুন সূর্যের সাথে নিজের জীবনটাও সুন্দর কইরা নতুনভাবে সাজায়া নে।
– তুমি সেদিন আসোনি কেনো? আমি অনেক অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু তুমি আর কখনো আসোনি।
চারুর গলা ধরে এলো। হামিদ বুঝতে পারছেনা তার ঠিক কি বলা উচিত।
– এখন আইসা পড়ছিনা? এহন সব ঠিক হইয়া যাইবো দেখিস। আমি যহন শহরে যাই তখন দেখলাম গ্রামে সবকিছুর দাম যেমন সস্তা শহরে তেমন বেশি। এইহানে একজনের টেনেটুনে চলতেই পাঁচ হাজার টাকার বেশি লাগে আর আমার চাকরি মাত্র দুই হাজারের। ভাবলাম প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হইলেও বেশি কাজ কইরা ভালো একটা পর্যায়ে যামু। একমাসের মতো দিন রাইত পরিশ্রম করলাম। ম্যানেজারের বিশ্বাস অর্জন করলাম। আমার চেয়ে বড় পদের একটা শ্রমিক কাম ছাইড়া দেওয়ার পর ম্যানেজার আমারে ওই পদে লাগায়া দিলো। বেতন সাত হাজার টাকা। একমাসেই সাত হাজার বেতন হইবো সেটা আমি ভাবিই নাই। যহন তোরে আনতে যামু তহন আমার গাড়ির সাথে একটা ট্রাকের ধাক্কা লাগলো তারপর আর কিছু মনে নাই। চোখ খুইলা দেখি আমি হাসপাতালে। পরে শুনলাম এক্সিডেন্ট করছি পাঁচ মাস শেষ হইয়া গেছে। আর একদিনও অপেক্ষা করিনাই। ডাক্তার নার্স কারোর কথা না শুইনা সাথে সাথেই চইলা আসছি হাসপাতাল থেইকা। ওইদিনই গেছিলাম গ্রামে কিন্তু তোরে পাই নাই। হাজার বার চাওয়ার পরেও তোর ঠিকানা আমারে কেউ দেয় নাই। অনেক খুজছি বিশ্বাস কর।
চারু আর কিছু বললোনা। হামিদেরও বা কি দোষ? যা হয়েছে সব ভাগ্যে ছিলো। ভাগ্যটা এত খারাপ না হলেও পারতো।
– তুমি আগের চেয়ে মোটা হয়ে গেছো।
– আর কইস না শহরের সব কিছু ভেজাল। প্রথম প্রথম কিছু খাইতে পারতাম না। কতবার যে পেট খারাপ হইছে আমার নিজেরই হিসাব নাই। তারপর যহন খাইতে শিখলাম তখন থেইকা পেট ফুইলা ঢোল হইয়া গেছে।
হামিদ নিজের পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল কথাটা। হামিদের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো চারু।
– হাসিস না। বাইরের খাওন খাইয়া এই অবস্থা। নিজে রানলে অখাদ্য হয় আর বাইরে খাইলে পেট ফুইলা ঢোল হয়।
– তুমি নাকি বিয়ে করেছো? ভাবি রান্না জানেনা?
– হুম জানে কিন্তু মজা হয় না। এক মিনিট, তুই কেমনে জানলি আমি বিয়া করছি?
চারু উত্তর দেয়না। উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনা। চারু উত্তর দিলোনা বিধায় হামিদও জোর করে কিছু জিজ্ঞেস করলোনা।
– ভাবির নাম কি?
– ফাতেমা।
– পুরো নাম কি?
– ফাতেমা জাহান হিয়া।
– এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলে যে?
– ম্যানেজারের বইন ফাতেমা। আমি যহন কোমায় ছিলাম তখন আমার চিকিৎসার সব খরচ ম্যানেজারই দিছে। সে যহন কইলো তার বইনরে বিয়া করতে তহন আর মানা করতে পারিনাই। তাছাড়া ফাতেমারে বিয়া করার পর চাকরিও স্থায়ী হইয়া গেছে একপ্রকার। দুই একদিন কামে না যাইলে জবাবদিহি করতে হয় না।
চারু আর কথা বাড়ালো না। হামিদকে জানালো তার উপর কেউ একজন নজর রাখছে। ওখানে গেলে সবাই জানতে পেরে যাবে চারু কোথায়। হামিদকে কিছুটা চিন্তিত দেখালো। বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে চারুকে একটা বোরকা কিনে দিলো। আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ও ফাতেমার দাদি। আপাতত নতুন ঘর না পাওয়া অবধি এভাবেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো হামিদ। নতুন ঘর নিতে খুব বেশ সমস্যা হবে বলে মনে হয়না। ফাতেমার ভাই ঠিক করে দিতে পারে। তবে সমস্যা হলো ফাতেমা। বেশ বোকা একটা মেয়ে। সাধারণত বোকারা হয় বেশ সহজ সরল নিরীহ কিন্তু ফাতেমা একেবারে উল্টো অর্থাৎ সে বোকা হলেও কিছু হিংসুটে ধরনের মেয়ে। কারোর ভালো সহ্য হয়না তার। হামিদ চারুকে বিয়ে বাসায় যেতেই একজন শ্যামলা মতো মেয়ে দরজা খুলে দিলো। চারুকে দেখেই ভ্রু কুচকে তাকালো সে।
– উনি কে?
– চারু।
– আপনে তো কইছিলেন আপনার ছোট বইন তাইলে ওনারে এমন বৃদ্ধ লাগে ক্যান?
চারু মুখের উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দিলো। ফাতেমা একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারুর দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে গেলেন। কোনো আন্তরিকতা নেই। এমন একটা ভাব যেনো চারুর এখানে আসা সাধারণ একটা ব্যাপার।

বিঃদ্রঃ সবাই বলেন আমি দেরি করে গল্প দেই। এইটা আমার অপরাধ। মানছি এইটা অপরাধ কিন্তু থ্রিলার গল্প লেখা আর সাধারণ গল্প লেখার মাঝে বেশ অনেক পার্থক্য। থ্রিলার লিখতে হলে মাথায় অনেক চাপ পড়ে। প্রতিদিন লেখাও সম্ভব হয় না। আমি না হয় অপরাধী মানলাম। কিন্তু ইচ্ছাকৃত অপরাধ তো করিনা কিন্তু আপনারা যে গল্প পড়ে রেসপন্স করেননা সেটার কি হবে? গল্প পড়ে চুপিচুপি চলে যান। এইটাও একটা বড় অপরাধ। আপনাদের রেসপন্সই তো আমার লেখার প্রাণ। সবার কাছে রেসপন্স আশা করছি। পাঁচ মিনিটও লাগেনা কিন্তু গল্প লিখতে আমার পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়। রিচেক হয়নি। হ্যাপি রিডিং।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….