বিস্বাদপূর্ণ জীবনে তুমি পর্ব-০১

0
643

#বিস্বাদপূর্ণ জীবনে তুমি
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা

দেশের মাটিতে পা রেখে মনে কেমন যেন এক প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। দীর্ঘ সাত বছর পর এইরকম প্রশান্তি অনুভব হলো রিয়ার। লন্ডনে থাকাকালীন এইরকম প্রশান্তি অনুভব হয় নি কখনো। হয় তো এটাই জন্মভূমির প্রতি টান। কিন্তু আবার হঠাৎ অতীতের কথা মনে পরতেই আবার বিস্বাদ পূর্ণ হয়ে গেল সব রিয়ার কাছে।

(আসুন পরিচয় পর্ব সেরে নেই মেয়েটির নাম রিয়া চৌধুরী। লন্ডনে তার বিজনেস আছে। কিছু অন্ধকার অতীতের জন‍্য সে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব গম্ভীর আর রাগী হয়ে উঠেছে। একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে ও। লন্ডনে ও একাই থাকে। প্রায় সাত বছর পর সে বাংলাদেশে ফিরল শুধুমাত্র তার দাদুর জন‍্য। কাল ওর চাচা আজিজুল চৌধুরীর মুখে দাদুর অসুস্থতার কথা শুনে ছুটে আসে ও। অন্য কারো উপর কোনো মায়া কাজ না করলেও দাদুর উপর ঠিকই মায়া কাজ করে ওর। যাইহোক গল্পে ফিরি আসি এবার। )

রিয়া এয়ারপোর্ট থেকে চৌধুরী বাড়িতে যাওয়ার জন‍্য রওনা হলো। গাড়িতে উঠার পর থেকে ওর পি.এ আরিফ বকবক শুরু করেছে। “মেম এতো জরুরি কি এমন কাজ পরল যে আপনি আরজেন্ট বাংলাদেশে আসলেন। কি হয়েছে ব্লা ব্লা.” রিয়া বিরক্তিভরা কন্ঠ গম্ভীরতা নিয়ে বলল-

”যেখানে যাচ্ছি সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে সব। এখন চুপ থাকো”

রিয়ার বিরক্তভরা চেহারার দিকে আরিফ একবার তাকিয়ে সে চুপ করে রইল। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে রিয়া যখন একবার বলেছে পরে বুঝে নিতে তার মানে তার মুখ থেকে এখন একটা কথাও বের হবে না।

সে এসব ভাবনা অন্যদিকে ফেলে ড্রাইভিং এ মনোনিবেশ করল। রিয়া পিছনে সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল যে কিভাবে সে ওই চৌধুরী বাড়িতে যাবে। ওখানে গেলেই তো আবার তার অন্ধকার অতীতগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াবে। আর কিছু ভাবতে পারছে না ও।

হঠাৎ আরিফের ডাকে রিয়ার ভাবায় ছেদ পরল। ও গাড়ির জানালা দিয়ে দেখল ও চৌধুরী বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। ও ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে পরল। বাড়ির চারপাশে ও চোখ বোলাতে লাগাল। বাড়িটা প্রায় আগের মতোই আছে। তবে আশেপাশের পরিবেশটা বেশ ভিন্ন লাগছে। লাগারই কথা সাত বছর তো কম কথা না। ও ওর কোর্টটা নিজের ডান হাতে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আর আরিফ রিয়ার ব‍্যাগ নিয়ে ওর পিছু পিছু যেতে লাগল।

রিয়া বাড়ির কলিংবেল বাজাতেই চৌধুরী বাড়ির একজন সার্ভেন্ট রহিমা এসে দরজা খুলে দিল। সে দরজা খুলে দেখতে পেল একটা মেয়ে আর পিছনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে সাদা লেডিস শার্ট আর ব্লাক লেডিস জিন্স চোখে সানগ্লাস হাতে একটা ব্লাক কোর্ট। চুলগুলো সেটা করা। দুধেআলতা গায়ে যেন এক অন‍্য রকম সুন্দর লাগছে রহিমার চোখে। রিয়াকে রেখে পিছনের ছেলেটির দিকে তাকালো। সে ও একদম ফরমাল লুকে দাঁড়িয়ে আছে। রহিমা বেগম ওদের দরজায় রেখে রিয়ার চাচিকে ডাকতে গেল। রিয়ার বিরক্তি এখন রাগে পরিণত হচ্ছে। আর কতো এইরকম ও দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকবে। রিয়া আর কিছুর তোয়াক্কা না করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।

বসার রুমের সোফায় তাকিয়ে দেখল তার দাদু একটা ছোট বাচ্চার সাথে খেলছে। এইদৃশ‍্য দেখে ওর অতীত আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠল। সবকিছু তো ঠিকঠাকি ছিল কিন্তু কেন একটা ঝড় এসে সব উল্টাপাল্টা করে দিল। অতীত ঝেরে বর্তমান নিয়ে চিন্তা করতেই ওর কপাল কুচকে এলো। আজিজুল চৌধুরীর কথা মতো তার দাদু এমন অসুস্থ যে বিছানা থেকে উঠতে পারছেনা।

রিয়া হনহন করে হেঁটে ওর দাদুর সামনে দাড়াল। সামনে কারো উপস্থিতি পেয়ে আনিসুর চৌধুরী মুখ তুলে তাকাতেই থ মেরে বসে রইল। সে যে তার সাত বছর আগে মারা যাওয়া ছেলেটাকে আবার দেখছে শুধু পার্থক্য হচ্ছে রিয়া মেয়ে। আনিসুর চৌধুরী আর অপেক্ষা না করে জরিয়ে ধরল রিয়াকে। দীর্ঘ সাত বছর পর সে দেখছে রিয়া কে। কিন্তু তার চিন্তে একটু সময় লাগে নি ও কে! রিয়া ও ওর দাদুকে আলত করে জরিয়ে ধরল।

কিছুসময় অতিবাহিত হতেই দাদু রিয়াকে ছেড়ে “নিশি” বলে হাক ছাড়ল। এই নিশিটাকে তা রিয়ার ঠিক বোধগম্য হলো না। ও বিস্ময় দৃষ্টিতে ওর দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকলো। পলকের মধ্যেই একটা মেয়ে এসে হাজির হলো ওদের সামনে। মেয়েটির গায়ের রঙ শ‍্যামলা। লম্বা চুল খোপা করা। পরনে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। রিয়া একবার নিশির দিকে তাকিয়ে একটু দূরে বসা বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকাল দুইজনের চেহারার অনেকটাই মিল তবে বাচ্চাটার গায়ের রঙ সাদা। দাদু রিয়ার বিস্ময় কাটাতে বলতে শুরু করলেন –

“এটা শায়ানের( শুভ্রার চাচার বড় ছেলে )বউ নিশি আর ওইটা ওর মেয়ে কুহু ( দূরের বাচ্চাটির দিকে ইশারা করে )।”
দাদু নিশিকে উদ্দেশ্য করে বলল

“যাও রিয়া মাকে রুমে নিয়ে যাও,আর রিয়া মা তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে খেতে আস। নিশি মাথা নাড়িয়ে হ‍্যাঁ বোধক উত্তর দিল। নিশি রিয়াকে নিয়ে যেতে লাগলো। রিয়া অনেক কান্ত থাকায় সে তার দাদুকে আর কিছু জিঙ্গাসা করলো না। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে। নিচে নামতেই দেখলো খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে। রিয়া আজিজুল সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো

“তুমি আমাকে মিথ্যা বললে কেন? তুমি জানো না আমি মিথ্যা একদম সহ‍্য করতে পারিনা তারপরেও।”

আজিজুল সাহেব মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন

“আসলে সবাই তোকে দেখতে চেয়েছিলো। তুই কতো বড় হয়ে গেছিস সেটি দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো সবাই। রাগ করিস না মা। আর আমরা তো তোর আপন জন। আমাদের উপর রাগ করতে নেই মা।”

রিয়া কটমট করে বলল “মিথ্যা বলে এখানে আনার কোনো মানে ছিলো না চাচু; তুমি ভুলে যেও না আমার সঙ্গে কি হয়েছিলো!”

আজিজুল সাহেব বলল “আমার মেয়েটার বিয়েতেও তুই থাকবি না।”

রিয়া অবাক হয়ে বলল “কিহ জেরিনের বিয়ে! ওর পড়াশোনা তো এখনো শেষ হয় নি।”

একটা ভদ্র মহিলা খাবার টেবিলে বসতে বসতে বললেন “পড়াশোনা শেষ করেই যে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর ছেলে ভালো বিয়ের পরেও পড়াশোনা করাবে।”

রিয়া ওই মহিলাকে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো আর বলল “চাচু আমার কথায় কেউ নাক গলাক তা আমি পছন্দ করি না সেটা হয় তো কেউ ভুলে গিয়েছে।”

আজিজুল সাহেব রিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল “মামুনি ওনি তো তোমার মা হয়। ভুলে যাও না আগের সব কিছু।”

রিয়া হনহন করে রুমে চলে গেলো। জোরে করে দরজা আটকিয়ে দেয় ও। কিছু ভালো লাগছে না ওর। সব কিছু বিস্বাদময় লাগছে ওর কাছে। সে তো সব কিছু ভুলেই থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু কেন পরিস্থিতি তাকে আবার সব ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কেন কেন?

দীর্ঘ দুইঘন্টা পর রিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে রুম থেকে বের হলো। নিচে যাবে হঠাৎ সিঁড়িতে খেয়াল করতেই দেখলো কুহু একা একা পা নামিয়ে দিয়েছে। কুহু পরে যেতে নিলেই রিয়া দ‍ৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় কুহুকে। কুহু অনেকটা ভয় পেয়ে যায় তাই ও রিয়াকে জরিয়ে ধরে চুপ করে রইলো। কোথায় থেকে নিশি এসে কুহুকে কোলে নিয়ে অস্থির হয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয় কুহুকে। নিশির চোখে পানি চিকচিক করছে। পানি শুধু গড়িয়ে পরার অপেক্ষা। নিশি রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল

“তোমাকে যে আমি কিভাবে ধন‍্যবাদ দিবো বুঝতে পারছিনা। তুমি যে আমার প্রাণ বাঁচিয়ছো।”

রিয়াও হালকা মুখে হাসির রেখে টেনে বলল “ধুরু পাগলি মেয়ে এখানে ধন‍্যবাদ দেওয়ার কি আছে।”

আধো আধো কন্ঠে কুহু বলে উঠলো “ফুপিই”

কুহুর কন্ঠে ফুপি ডাকটা শুনে রিয়ার কেন যেন অনেক ভালো লাগলো। ও কুহুর গাল টেনে দিলো। কুহু খিলখিলিয়ে হেসে দিলো……

(চলবে)