আরশি পর্ব-০৫

0
2420

#আরশি
#Part_05
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে অহনা। সামনে থাকা ব্যক্তিটির বিনয়ী সুরে ওর কান্না থামানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে,

— কাঁদে না মামণি। কিছু হয় নি।

অহনা কাঁদো কাঁদো সুরে বলে,

— আম্মি যাব।

লোকটা এইবার আশে-পাশে একবার তাকিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকায়। অতঃপর দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি এক হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— ব্যথা যা মামার বাড়ি, কষ্ট ফেলে যা চাচার বাড়ি।

কথা শুনে অহনা কান্না থামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটি একটু প্রশান্তির হাসি হেসে আলতো হাতে অহনার কান্না মুছে দিয়ে বলে,

— কান্নায় দেখায় পেত্নী, হাসিতে দেখায় নাতনি।

কথা শুনে অহনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। লোকটি তার পকেট থেকে খয়েরী রঙের একটা রুমাল বের করে অহনার বা পায়ের হাটুতে বেঁধে দেয়। তারপর সেই জায়াগায়টার উপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে,

— বেশি ব্যথা করছে?

অহনা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। লোকটি মিষ্টি হেসে বলে,

— তারাতারি চলে যাবে। তোমার মত ছোট পরীর কাছে কি ব্যথা বেশিক্ষণ থাকতে পারে?

অহনা জোরে মাথা দুলাই। যার অর্থ না। লোকটি এইবার হেসে বলে,

— আমাকে ভয় পেতে হবে না। আমি খারাপ আঙ্কেল নই।

অহনা তার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,

— তাহলে আপনি কেমন আঙ্কেল?

— আমি চকলেট আঙ্কেল। ছোট ছোট পরীদের ম্যাজিক ক্যান্ডি দেই আমি।

— ম্যাজিক ক্যান্ডি কি?

— ওয়েট!

এই বলে লোকটি মুষ্টিবদ্ধ হাতটি একটু ঘুরিয়ে অহনার সামনে ধরে। অতঃপর মুষ্টিবদ্ধ হাতটি খুলতেই সেখান থেকে দুইটা ‘পালস ক্যান্ডি’ বেরিয়ে আসে। অহনা বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটি এক হাসি দিয়ে বলে,

— এই যে এসে পড়লো ছোট পরীর জন্য ম্যাজিক ক্যান্ডি।

অহনা বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে উঠে,

— এইটা কিভাবে হলো?

লোকটি মিষ্টি হেসে বলে,

— ম্যাজিক!

বলে অহনার হাতে ক্যান্ডিটা ধরিয়ে দেয়। সাথে সাথে অহনা তা ফিরিয়ে দিয়ে বলে,

— আম্মি বলেছে কাউরো কাজ থেকে কিছু নিতে না।

লোকটি মুচকি হেসে অহনার নাক টেনে দিয়ে আবার ওর হাতে ক্যান্ডি দিয়ে বলে,

— আম্মি জিজ্ঞেস করলে বলবে এইগুলা চকলেট আঙ্কেল দিয়েছে। তখন দেখবে আম্মি কিছুই বলবে না।

অহনা অবিশ্বাস্য চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে রয়। অতঃপর জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— আপনি আমার আম্মিকে চিনেন?

— উঁহু! কিন্তু তুমি বললে চিনে যাব নে। তা এই ছোট পরীটির নাম কি জানতে পারি?

অহনা আদো আদো কন্ঠে বলে,

— আমার নাম অহনা।

— বাহ! বেশ মিষ্টি নাম তো। তাহলে আমি তোমায় অহুপরী ডাকব কেমন।

অহনা মাথা দুলায়। লোকটি মিষ্টি হেসে বলে,

— তা তোমার আম্মি কোথায়? অনেকক্ষণ তো হলো। সে নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজছে। চল তার খুঁজার আগে আমরাই তাকে খুঁজে ফেলি।

অহনা খুশি হয়ে বলে,

— আচ্ছা।

লোকটি অহনাকে কোলে নিয়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বেশ সামনে যেতেই অহনা এইবার চেঁচিয়ে উঠে, “আম্মি!” লোকটি সামনে তাকাতেই দেখে একজন বোরকা ও নেকাব পরিহিত মহিলা এইদিক ওইদিক বার বার তাকাচ্ছে আর কার নাম যেন ধরে ডাকছে। সম্ভবত কাউকে খুঁজছে। লোকটি অহনার দিকে তাকাতেই দেখে সে নামতে চাইছে। লোকটি অহনাকে নিজ কোল থেকে নামাতেই অহনা দৌঁড়ে সেই মহিলার দিকে ছুটে চলে যায়।

_________________________________________________

চারদিকে পাগলের মত অহনাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজেই পাচ্ছি না। বার বার অহনার নাম ধরে ডাকছি কিন্তু সারা পাচ্ছি না। আশেপাশের প্রায় সকল মানুষই আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু কেউ আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে না কি হয়েছে। ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি আমি। দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি। মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে অহনাকে চাইচ্ছি। ঠিক এমন কেউ আমার পা জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। নিচে তাকাতেই অহনা। অহনাকে দেখা মাত্র আমার প্রাণে প্রাণ ফিরে আসে। আমি দ্রুত অহনার সামনে হাটু গেড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে দেই। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে থেকে ওকে ছেড়ে ওর গালে হাত রেখে উত্তেজিত কন্ঠে বলি,

— কোথায় ছিলে মামণি? তোমাকে না পেয়ে আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

— আমি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম আম্মি। তখন চকলেট আঙ্কেল এসে আমাকে উঠায় এবং ওই কিনারের বেঞ্চে নিয়ে যায় আর আমার পায়ে কাপড় বেঁধে দেন।

অহনার কথা শুনার সাথে সাথে আমি ওর হাতে পায়ের দিকে তাকাই। বা পায়ের হাটুতে খয়েরী রঙের রুমাল বাঁধা। সাথে সাথে আমি বিচলিত হয়ে যায়৷ অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— বেশি ব্যথা পেয়েছ? জ্বলছে?

অহনা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— আমি ঠিক আছি আম্মি। এত ব্যথা করছে না।

— ওই লোকটা কোথায় যে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল।

অহনা পিছে ঘুরে আঙুল দেখিয়ে বলে,

— ওই য..

কিন্তু কথাটা বলতে পারলো না। কেন না যেখানে সেই লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে সে দাঁড়িয়ে নেই। অহনা চারদিকে চোখ বুলিয়ে তার চকলেট আঙ্কেলকে খুঁজতে থাকে কিন্তু পায় না। অতঃপর ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

— এইখানেই ছিল কিন্তু এখন খুঁজে পাচ্ছি না।

আমিও চারদিকে চোখ বুলিয়ে তেমন কাউকে দেখতে পারলাম না। অতঃপর এইসব নিয়ে বেশি মাথা না ঘাটিয়ে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে অহনার কপালে চুমু এঁকে দিলাম। শান্ত কন্ঠে বললাম,

— হয়তো সে চলে গিয়েছে।

এই বলে চুপ রইলাম আমি। তারপর অহনার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— দোষ আমারই আমি তোমাকে একা রেখে না গেলে এইসব কিছুই হতো না৷ মাফ করে দিও মামণি। এর পর থেকে যত যাই হোক তোমায় একা ছাড়বো না। আর তুমিও এর পর একা একা কাউরে সাথে যাবে না বুঝেছ?

অহনা শুধু মাথা নাড়ে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ওকে কোলে তুলে নেই। রওনা হই বাসার উদ্দেশ্যে।

__________________________________________

রাত ঘনিয়ে এসেছে। ব্যস্ত শহরটি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে। কম বেশি সকলের চোখেই এসে ভীড় করেছে নিদ্রার সমুদ্র। সেই নিদ্রার সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়েছে অনেকেই। অহনাও তলিয়ে আছে সেই সমুদ্রে। আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। সে আমার সাথে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে। আমি কিছুক্ষণ তার মুখ পানে তাকিয়ে থাকি। একবারের পায়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। আজ যদি ওর কিছু হতো তাহলে আমার কি হতো তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। কেন যে এমন বোকামি করতে গেলাম কে জানে। অবশ্য কথায় আছে, “মানুষ ভুল থেকেই শিখে।” ছোট ছোট ভুল হতেই অনেক সময় আমরা বড় ধরনের ভুল করা থেকে বেঁচে যাই। আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে পড়ি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে চলে যায়। কোমড় অব্ধি চুলগুলো বিনুনি করে নেই। পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল বিধায় বাধ্য হয়ে রুম থেকে বের হই। ডায়নিং যাওয়ার সময় ভাইয়ার রুম মাঝে পরে। তার রুমের সামনে দিয়ে যেতে নিলে কিছু কথা শুনে থমকে যাই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই নিজের জায়গায়। শুনতে পাই ভাবী ভাইয়াকে বলছে,

— দুইজন মানুষের খরচ তো আর কম না। দেখছই তো এইবার খরচ বেশি হয়ে গিয়েছে আরিফ। চলতে এখন হিমসিম খেতে হচ্ছে।

#চলবে