আরশি পর্ব-০৬

0
2428

#আরশি
#Part_06
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— দুইজন মানুষের খরচ তো আর কম না। দেখছই তো এইবার খরচ বেশি হয়ে গিয়েছে আরিফ। চলতে এখন হিমসিম খেতে হচ্ছে।

ভাবীর কথা শুনে ভাইয়া বলে উঠে,

— জানি কিন্তু যেভাবে হোক মেনেজ তো করতেই হবে।

— কিভাবে করি বলো? তোমার সম্পত্তি বলতে বাবার দেওয়ার এই ফ্ল্যাটটাই আছে আর ব্যাংকে আদ্র এর ভবিষ্যতের জন্য জমানো কিছু টাকা। এ ব্যতীত কি আছে আমাদের? তুমি জবও করো সামান্য বেতনের। সেই বেতনেই আমার পানি,গ্যাস,বিদ্যুৎ,নিউজপেপার,ঢিস,নেটের বিল দিতে হয়। বাজার ও টুকটাক সদাই-পাতি কিনতে হয়। আদ্রের স্কুলের ফি,প্রাইভেটের ফি, বই খাতা, যাতায়াত খরচ সবই দিতে হয়। মাঝে মধ্যে ওর জামাকাপড় ও খেলনাও কিনতে হয়। তোমারও তো খরচ কম না। আমারটা না হয় বাদই দিলাম। এখন নতুন করে দুইজনের খরচ।

— তো কি করবো বলো? ওদের ফেলে দিব?

— আমি কখন এই কথা বললাম?

— তো কি বলতে চাইছো তুমি?

— আমি বলতে চাচ্ছি ও আর এইভাবে কত দিন থাকবে?

— তুমি কি বাই এনি চান্স ওকে দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার কথা বলছো?

— দেখ তুমি খারাপ ভাবে বিষয়টা নিও না। আমি শুধু বুঝাতে চাচ্ছি, ও এইভাবে একা আর কত দিন থাকবে? তার উপর একটা মেয়ে নিয়ে। ওর কাউরো না লাগলেও অহনার তো বাবা বলার একটি মানুষ লাগবে। আর এইভাবেও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সিঙ্গেল মাদার হওয়া সহজ না। সিঙ্গেল মাদারদের কেউ ভালো চোখে দেখে না। সকল স্থানেই নিন্দারপাত্র হতে তাদের। জীবনে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়। তার উপর পরের বছর অহনা স্কুলে ভর্তি হবে তখন ওর সব জায়গায় আগে বাবার নাম জানতে চাইবে। বাবার পরিচয় চাইবে। মায়ের না। আরশি সব সহ্য করে গেলেও অহনা কি আদৌ সবকিছু সহ্য করতে পারবে?

— তুমি যেই কথা বলছো তা একবারে ফেলনা না কিন্তু আরশিকে আমাদের আরেকটু সময় দেওয়া উচিৎ। কিছুদিন আগেই তো ওর ডিভোর্স হলো। আরও কিছু সময় যাক তারপর না হয় কথাটা উঠিয়ে দেখবো। অহনার জন্য হলেও ওর আরেকটা বিয়ে করা উচিৎ।

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। এলোমেলো পায়ে ফিরে এলাম নিজের রুমে। ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। অশ্রুগুলো বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়তে চাইছে। কথাগুলো গলার মাঝে কুন্ডুলি পাকিয়ে আসছে। দুঃখে-কষ্টে শরীর মৃদু পরিমাণে কাঁপছে। হাত পা ছড়িয়ে সেই হৃদয় ভাঙ্গা কিশোরীর মত কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভাবীর বলা কথাগুলো বার বার মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। এতদিনে শুনে এসেছিলাম এই পৃথিবীতে মেয়েদের নিজের বাড়ি বলতে কিছু নেই। তারা সর্বদাই ভাসমান। আজ কথাটার জীবন্ত প্রমাণ পেলাম। বিয়ের আগে নিজের বাড়ি বলতে বাবার বাড়ি বুঝায় আর বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি। কিন্তু আদৌ কি বাড়িগুলো আমার নিজের? নিজের পরিচয় বলতেও তো আমাদের কিছু নেই। প্রথম পরিচয় আসে বাবার কাছ থেকে দ্বিতীয় পরিচয় আসে স্বামীর কাছ থেকে। মানুষ চিনেও সেই দুইজনের পরিচয়ে। তাদের নিজের পরিচয় বলে আছে কি?
ভাবী ঠিকই বলেছিল আসলেই আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। কেন না নারীর উপর যদি কোন পুরুষের ছায়া না থাকে তাহলে তাকে এই সমাজ কখনোই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে না। শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় না। সবসময় তাকে সর্ব জায়গায় নিচু করা হয়। আর সে যদি হয় সিঙ্গেল মাদার প্লাস ডিভোর্সি তাহলে তো কথাই নেই। আচ্ছা সবাই তো নারী অধিকার নিয়ে কথা বলে কিন্তু কত জনেই বা সেই কথায় আমল করতে পারে? এই সমাজের বিপক্ষে গিয়ে একজন নারীর পাশে দাড়াতে পারে? মুখে মুখে কথা বলাটা যতটা না সহজ তা আমল করা ততটাই কঠিন। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। অতঃপর আবার ভাবীর শেষ কথাগুলো ভাবতে শুরু করলাম।

হ্যাঁ এইটা ঠিক অহনাকে স্কুলে ভর্তি করানো হলে সকলেই ওর কাছে ওর বাবার নাম জানতে চাইবে। ওর বাবার পরিচয় জানতে চাইবে। কিন্তু আদৌ ভাবী এই ভাবনাটাই মাথায় রেখে কথাটা বলেছিলেন? উঁহু! সে বরং এই ভেবে কথাটা বলেছিল যে অহনা যদি স্কুলে ভর্তি হয় তাহলে ওর খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তখন সেই খরচ দিবে কে? সে তো এখনই আমার আর অহনার খরচ বহন করতে হিমসিম খাচ্ছে তখন কি করবে? সবাই সবার ভালোটা আগে বুঝবে এইটাই নিয়ম। কেউ কাউরো বোঝা টানতে রাজি নয়। কথায় আছে, ‘ বিপদেই মানুষের আসল রুপ চিনা যায়।’ কথাটা শতভাগ সত্যি। আমার ভাইয়া ভাবীদের প্রতি ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ কি নিয়ে? তারা তাদের ভালোটা দেখছে তো এতে তাদের দোষ কোথায়? আর কত টানবে আমাদের বোঝা? বাবা-মা নিরস্বার্থভাবে আজীবন সন্তানের বোঝা টানতে পারে কিন্তু সেই সন্তানই বাবা-মায়ের বুড়ো বয়সের সঙ্গী হতে পারে না। সেখানে এর সামনে তো বোন শব্দটিই ঠুকনো।
হঠাৎ ফাহাদের কথাটা টনক নেড়ে উঠলো, “দুইদিন পর যখন সকল জায়গায় থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে তখন আমার কথাই মনে পড়বে।” কথাটা স্মরণ হতেই বুক চিড়ে কান্না বেড়িয়ে আসে। আজ ফাহাদ প্রত্যক্ষ ভাবে না হলে পরোক্ষভাবে ঠিকই জিতে গেল। আজ আল্লাহ এর কাছে বার বার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, “কেন আমার ভাগ্যে এতটা কষ্ট লিখেছেন তিনি? আমি কি সামান্য সুখ পাওয়ারও যোগ্য না? কি দোষ আমার?” প্রশ্নগুলো মনের মাঝে আসতেই সাথে সাথে তবা করে নিলাম। এমন প্রশ্ন করা মানে আল্লাহকে অবিশ্বাস করা। নিজের ইমান বিনষ্ট করা। নিজেকে বার বার বুঝাই, “আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।” আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন। কিন্তু কথাগুলো আনুগত্য করার পরও ধীরে ধীরে কষ্ট গুলো আমার উপর ভারী হয়ে আসতে শুরু করে। অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। মনটা বেজায় ছটফট করে উঠে। ক্ষণেকেই অশান্ত হয়ে উঠেছি। কান্না করতে চাচ্ছি কিন্তু মন খুলে কান্না করতে পারছি না। হঠাৎ মায়ের কথাটা টনক নাড়ে,
” যদি কখনো মনের মধ্যে থাকা কষ্টগুলো যখন তোর উপর ভারী হয়ে আসছে বা আল্লাহ এর কাছে তুই অতি নীরবে কিছু চাইতে চাচ্ছিস তখন মধ্যরাতে জায়নামাজ বিছিয়ে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে নিবি। মোনাজাতে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আল্লাহ কাছে চাইবি। মন খুলে কাঁদবি। দেখবি তখন আল্লাহ তোকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সবসময় মনে রাখবি যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে।”

আমি আর দেরি না করে উঠে বসি আরওয়াশরুমে চলে যাই। ওযু করে এসে জায়নামাজটি বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি আল্লাহর দরবারে৷ অন্য কোথায় শান্তি না পেলেও এইখানে আমি ঠিকই আমার শান্তিটা খুঁজে পাব। মোনাজাতে বসে আমি কেঁদে দেই। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছি আর আল্লাহর কাছে আমার সকল অভিযোগগুলো তুলে ধরছি। তাঁর কাছে নিজেকে শক্ত ও ধৈর্যশীল হওয়ার তৌফিক চাচ্ছি। জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী কিন্তু এতটুকু চাইচ্ছি যাতে কোন পরিস্থিতিতে আমি ভেঙ্গে না পড়ি। আমাকে শক্ত হতে হবে। বাঁচতে হলে ও অহনাকে বড় করতে হলেও আমায় শক্ত হতে হবে।

____________________________________________

আমি জব করার সিদ্ধান্ত নেই। আমার যেই যোগ্যতা আছে তাতে অতি ভালো মানের না হলেও মোটামুটি একটা চাকরি পাওয়া সম্ভব। চাকরি পাওয়ার পর পরই আমি অন্য কোথাও বাসা নিয়ে নিব। থাকবো না আর কাউরো বোঝা হয়ে। নিজের আর নিজের মেয়ের খরচ একাই টানবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। ১ সপ্তাহের মাথায় আমি আমার অর্নাসের সার্টিফিকেটগুলো সংগ্রহ করে নেই। বাসায় এসএসসি আর এইচএসসির সার্টিফিকেটগুলো আগে থেকেই ছিল বিধায় এইগুলো যোগার করতে কষ্ট হয় নি। বাদ বাকি আরও কিছু কাগজপত্র বের করে নেই। সিভিও বানিয়ে নেই। অতঃপর লেগে পড়ি চাকরির খোঁজে। বেশ খুঁজা খুঁজির পর একটা চাকরির খোঁজ পেয়েও যাই। এইসকল কাজ গুলো আমি সকলের আড়ালেই করেছি। আড়ালে করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমি চাই না ভাইয়া বা ভাবী কেউ বুঝুক আমি তাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছি। হুট করে বললে তারা হয়তো অপমানিবোধ করতে পারে অথবা নাও করতে পারে। মানুষের মন তো আবার বুঝা বড় দায়। কখন কার মনে কি চলে কে জানে।

আমি সাত সকালে উঠেই তৈরি হয়ে নেই। আজ ইন্টারভিউ এর ডেট। তাই সময়ের একটু আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে চাচ্ছি। কাগজপত্র সব ঠিক করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেই। নিকাব আর বোরকা পড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসি। ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখি ভাইয়া টেবিলে বসে নাস্তা করছে। গায়ে চেক শার্ট আর প্যান্ট। শার্ট ইন করা আর গলায় একটা টাই ঝুলছে। সম্ভবত অফিসে যাওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছেন। ভাবী পাশেই সবজি কাটছেন। আমাকে দেখার সাথে সাথে ভাইয়া বলে উঠলেন,

— কি রে সাত-সকাল কই যাচ্ছিস?

আমি সোজাসাপটা ভাবেই উত্তর দেই,

— ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি ভাইয়া। ভাবছি একটা জব করবো। এইভাবে আর কত দিন?

কথাটা শুনার সাথে সাথে ভাবী সবজি কাটা রেখে আমার দিকে গোলগাল চোখে তাকায়। ভাইয়া বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— জব করবি মানে? কিন্তু কেন? কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?

শেষের কথাটা তিনি ভাবীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন। সাথে সাথে ভাবী নড়ে চড়ে বসে। অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। যার অর্থ এই সে আমাকে কিছুই বলে নি। আমি সব দেখে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— কেউ কিছুই বলে নি ভাইয়া। আমি নিজ থেকেই জব করতে চাইছি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছি। কাউরো ঘাড়ের বোঝা হতে চাচ্ছি না। আর এমনেও হাত গুটিয়ে রাখার চেয়ে ভালো কিছু একটা করা। পড়ালেখা যেহেতু করেছি একে কাজেও লাগাতে দাও।

— যদি নিজ থেকে কিছু করতে চাইছিস তাহলে আমি বাঁধা দিব না। কিন্তু যা করবি বুঝে শুনে ও সাবধানে থেকে। জানিসই তো আজকালকার দিন কেমন।

আমি কিছু না বলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে শুধু মাথায় দুলায়। অতঃপর ভাইয়ার রুমে গিয়ে দেখি আরশি আর আদ্র খেলছে। আমি আরশির কাছে গিয়ে ওর কপালে চুমু খেয়ে বলি,

— মামণি আম্মি একটু কাজে বাইরে যাচ্ছে। তুমি বাসায় ভালো মত থেক। মামীকে একটু জ্বালাবে না কেমন। ভালো বাবুর মত থাকবে কেমন।

অহনা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— ওকে আম্মি! তুমি সাবধানে যেও কেমন।

আমি অহনার কথা শুনে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াই। অতঃপর বিদায় নিয়ে চলে আসি। বাসার বাইরে বের হতেই দেখি কিছু মহিলা আমাকে আড়চোখে দেখছে আর কি যেন কানাঘুষা করছে। আমি সেইসব দেখে শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস নেই। মনে মনে বলি, “এ তো সবেমাত্র শুরু। এখনো অনেক কিছু দেখা বাকি আছে।”

___________________________________________

ইন্টারভিউ এর রুমে বসে আছি। সামনেই কিছু লোক বসে আছে। কথাবার্তা থেকে যতটুকু বুঝলাম এরাই নিজের কোম্পানির জন্য লোক নির্বাচন করবেন। আমি আমার সকল কাগজপত্র তাদের সামনে জমা দিলাম। তারা সকল কাগজপত্র চেক করতে লাগলেন। এর মধ্যে একজন আমার সিভি দেখে বলে উঠে,

— আপনি এইখানে মেনশন করেন নি যে আপনার মেরিটাল স্ট্যাটাস কি। তা আপনার মেরিটাল স্ট্যাটাস কি জানতে পারি? আর ইউ ম্যারিড ওর আনম্যারিড?

#চলবে

গল্পটা কেমন হচ্ছে প্লিজ জানাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলে খুশি হবো।