আরশি পর্ব-০৭

0
2461

#আরশি
#Part_07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আপনি এইখানে মেনশন করেন নি যে আপনার মেরিটাল স্ট্যাটাস কি। তা আপনার মেরিটাল স্ট্যাটাস কি জানতে পারি? আর ইউ ম্যারিড ওর আনম্যারিড?

কথাটা শ্রবণ হতেই আমি চমকে উঠি। সুরু চোখে তাদের দিকে তাকাই। মনের মাঝে দামকা হাওয়া বইতে শুরু করলো। ভিতরটা মূহুর্তেই চুপসে গেল। অনুভূতিগুলো ভারী হয়ে আসতে শুরু করে। আমি নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে বলি,

— আমি ডিভোর্সি। ১ মাস আগেই আমার স্বামীর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে।

কথাটা বলার সাথে সাথে মনে হলো তারা ভরকে উঠে। কিন্তু তা বাহিরে প্রকাশ করে না। কিছুক্ষণ পরেই তাদের চেহেরা কৌতূহলী একটা ভাব ফুটে উঠে। বেশ গাঢ় কৌতহূল। তাদের মধ্যে একজনে নিজের কৌতূহল দমিয়ে না রেখতে পেরে জিজ্ঞেস করে বসে,

— ডোন্ট গেট মি রং বাট কতদিনের সংসার ছিল আপনার তা কি জানতে পারি?

আমি সোজাসাপটা ভাবে উত্তর দেই,

— ১০ বছরের।

সাথে সাথে তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। আপনা আপনি তাদের ওষ্ট দুটির মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। গোল গোল চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। এতে আমার মধ্যে অস্বস্তি ভাবটা নাড়া দিয়ে উঠে। সাথে সাথে আমি একটু নড়েচড়ে বসি। তাদের মধ্যে একজনে মুখ ফস্কে জিজ্ঞেস করে বসে,

— এত বছরের সংসার এইভাবে ভেঙ্গে গেল? অবিশ্বাস্য! কারণটা কি?

আমি সটান হয়ে বসে কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না আমি। সরি!

আমার এমন সোজাসাপটা উত্তরে হয়তো তিনি অপমানিতবোধ করলেন। কিন্তু এতে আমার মধ্যে ভাবান্তর নেই। হুট করে একজন চাপা কন্ঠে পাশের জনকে বলে উঠেন,

— আরেহ ভাই বুঝেন না কেন? মেয়েটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন খুঁত আছে নাইলে কি এত বছরের সংসার ভাঙ্গে?

এই বলে সে মৃদু হাসে। কথাটা আস্তে বলা সত্ত্বেও আমি শুনে ফেলি। কথাটা শুনার সাথে সাথে বুকটা হু হু করে উঠে। বুকের ভিতর থেকে এক চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে। কন্ঠস্বরটা ভারী হয়ে আসে। গা ঘিনঘিন করতে শুরু করে। তারা যে কোন ইঙ্গিতে কথাটা বলেছে তা বুঝতে আমার দেরি নেই। আমার চরিত্র নিয়েই তারা পরোক্ষভাবে মশকারা করছেন। তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,

” পুরো সত্যটা না জেনে কেন আমাকে নিম্ন চোখে দেখা হচ্ছে? কেন আমার ঘারে পুরো দোষটা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? আমি তো কোন দোষ করি নি। আর না সম্পর্কটা আমি ভেঙ্গেছি তাহলে কেন? আমি মেয়ে বলে তাই?”

কিন্তু আফসোস বলতে পারলাম না। আদৌ কি বলে কোন লাভ আছে? এইভাবে বলে কতজনের মুখ বন্ধ করানো যাবে? আদৌ কি যাবে? কেন বার বার একজন নারীকেই নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হবে? কেন? এইসব ভেবেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। চোখটা জ্বালা করে উঠে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেই। নিজেকে বুঝাই, “এইভাবে দূর্বল হলে চলবে না। দূর্বল হলেই মানুষ আমায় চেপে ধরবে। সুযোগ নিবে। আর আমি তা হতে দিতে পারি না।আমাকে শক্ত হতে হবে।” নিজেকে বুঝিয়ে আমি সটান হয়ে বসে রই। তারা বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে আমার দিকে তাকাই। আমি শান্ত হয়েই বসে আছি। তারা আমার দিকে ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

— এক্সট্রিমলি সরি বাট আপনার এই পোস্টের জন্য একজন আনম্যারিড মেয়েকে চাচ্ছিলাম। কোন ম্যারিড ওর ডিভোর্সি মেয়েকে না। হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড৷

আমি নিরবে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফাইলটা হাতে নিয়ে নেই। অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে আসি। বেরিয়ে আসার আগে শুনি কেউ একজন তাচ্ছিল্যের সুরে বলছে,

— কি মুখ নিয়ে যে এরা ড্যাংড্যাং করতে করতে এইখানে চলে আসি বুঝি না।

অন্যদের কথা কানে আসার আগেই আমি দ্রুত পায়ে সেই জায়গা প্রস্থান করি। এইখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার রুচিতে বাঁধছে।

____________________________________________

দুপুরের কাঠফাটা রোদে চারিদিকটা খাঁ খাঁ করছে। ভ্যাপ্সা গরম ছড়িয়ে পড়েছে। গরম বাতাস বইছে। শহরের দালান নামক বন্দীশালায় বন্দী নগরবাসীরা হয়তো এখন দুপুরের আহার শেষে ভাতঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। উঁচু দেয়ালের কার্নিশ ঘেঁষে বসে আছে এক জোড়া কাক। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বার বার কা কা করে উঠছে। ইলেক্ট্রিক পোলের তারের উপর কিছু চড়ুই বসে ঝিমুচ্ছে। পরিবেশটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে। শূন্য রাস্তার ধার ঘেঁষে কিছু গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে এই নিস্তব্ধতাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার অভিযান চালাচ্ছে। আমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি আর গাড়ির এই অহেতুক হর্ণ বাজানো নিয়ে বিরক্তি পোষণ করছি। খালি রাস্তায় অহেতুক হর্ণ বাজানোর আদৌ কোন মানে আছে? এইভাবেই আজ মেজাজ চটে আছে তার উপর এইসব। অসহ্য! আবার এইদিকে নিকাবের ভিতরে আমি ঘেমে-নেয়ে একাকার। প্রচন্ড অস্বস্তিতে ভুগছি আমি৷ আপাতত বাসায় গেলেই বাঁচি। বাসার সামনে আসতেই দেখি আমেনা আন্টি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কোন এক মহিলার সাথে কথা বলছেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে তাকে সালাম দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে চলে আসতে নেই। তখনই কানে আসে যে সে বলছে,

— এই যে এই মাইয়াটিকে দেখছো না এর কয়েকদিন আগেই ডিভোর্স হয়েছে। একটা মেয়েও আছে। ভাবতেই খারাপ লাগে যে ১০ বছরের সংসার এইভাবেই ভেঙ্গে গেল।

তার পাশে থাকা মহিলাটি ব্যঙ্গ করে বলে উঠে,

— এত বছরের সংসার কি এইভাবেই ভেঙ্গে যায় নাকি? নিশ্চয়ই মেয়ের মধ্যে কোন দোষ আছে।

— কি জানি বাপু। কিন্তু ছোট থেকে দেখছি তো মাইয়াটাকে। বেশ নম্র আর ভদ্রই জানি।

— শুধু বাহির দেখলেই তো আর অন্তরের কথা বুঝা যায় না। কার মনে কি আছে কে জানে? যেই যুগ এসেছে আপা, এইখানে কে শেয়াল আর কে মুরগি তাই বুঝাই যায় না।

— হুম তাও ঠিক।

— যেই মেয়ে এত বছর স্বামীর সংসার করেও শেষে স্বামীর ভাত কপালে জুটাতে পারলো না সে নিশ্চয়ই কোন বড় ধরনের অন্যায় করেছে। হয়তো বিষয়টা চেপে গিয়েছে। আহারে! মায়ের জন্য মেয়েটারও কপাল পুড়লো।

আমি শুনতে পারলাম না দ্রুত পায়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসে বেল চাপলাম। অনবরত চেপেই চললাম। বার বার তাদের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কের ভিতর টনক নাড়ছে। কান্না পাচ্ছে প্রচুর। বুকের মাঝে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রাগে-দুঃখে মৃদু পরিমাণে গা কাঁপছে আমার। প্রতিবাদ করার তীব্র বাসনা জাগছে মনের মধ্যে। তাদের সামনে গিয়ে চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,

“একজন মেয়ে হয়ে অন্যের মেয়ে সম্পর্কে আপনারা এইসব কিভাবে বলতে পারছেন? একবারও কি বিবেকে বাঁধছে না? আসল সত্যটা না জেনে কিভাবে আমাকে দোষারোপ করছেন? আমার জন্য কিভাবে আমার মেয়ের কপাল পুড়লো শুনি? মেয়ের কথা আর এই সমাজের কথা ভেবেই তী আমি এতটা বছর ওই সংসারে পড়েছিলাম। কিন্তু শেষে কি পেলাম আমি? বলুন! এখন মনে হচ্ছে, এক নরক থেকে বেড়িয়ে এসে যেন আরেক নরকে এসে পড়েছি।”

কিন্তু এইসব বলার শক্তি আপাতত আমার নেই। কেন আমার যে সাপোর্ট করার কেউ নেই। পাশে দাঁড়িয়ে আমার হয়ে প্রতিবাদ করার মত নেই। আপন বলে যাদের এতটা বছর জেনে এসেছি আজ তাদের ঘাড়েই বোঝা আমি। হাইরে পৃথিবী! ক্ষণেকের মাঝে ভাবী এসে দরজা খুলতেই আমি তরতর করে বাসায় ঢুকে পড়লাম। নিজের রুমে যেতে নিব তখনই একজন অতি বিনয়ী সুরে আমার নাম ধরে ডেকে উঠে,

— আরশি!!

আমি সাথে সাথে থমকে যাই। পিছে ঘুরে তাকাতেই এক মধ্যবয়স্ক মানুষের মলিন মুখ আমার সামনে ফুটে উঠে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— মামা তুমি!

#চলবে