আরশি পর্ব-২৮

0
1912

#আরশি
#Part_28
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— কথাটা আপনারা কিভাবে নিবেন জানি না কিন্তু অনেকদিন ধরেই আমার মাথায় এই কথাটা ঘুরছিল। আজ সবাই একসাথে আছি বলে তাই কথা না বলে থাকতে পারলাম না। আমি চাই সাদের সাথে আরশির বিয়ে দিতে।

কথাটা সকলের কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই সকলে স্তম্ভিত হয়ে যাই। সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। সাদের চেহেরায় এক বিচলিত ভাব ফুটে উঠে। সম্ভবত সে এমনটা আশা করে নি অথবা এই বিষয়টি হতে সে অবগত ছিল। আমি সব শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রই। ঘটনাটা বুঝে উঠার চেষ্টা করি। এমন সময় মামা বলে উঠে,

— তা কিভাবে হয় আপা? আপনি তো জানেন এই আরশি একজন সিঙ্গেল মাদার। তার সাত বছর বয়সী এক মেয়ে আছে। তা সব জেনে শুনে আপনি কিভাবে সাদের জন্য আরশিকে চাইছেন?

শোভা আন্টি একটু নরম সুরে বলে,

— কেন চাইতে পারি না? এমন তো নয় সাদ অবিবাহিত আর আমি আমার অবিবাহিত ছেলের জন্য আরশির হাত চাইছি।

— তা না! কিন্তু…

মামা কথাটা বলে আমার দিকে ঘুরে তাকায়। আমি তখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মামার সাথে আমার চোখাচোখি হয়। মামা হয়তো বা আমার চোখ পড়তে চাইছিলেন কিন্তু আমার চোখ যে আজ নির্জীব। মামা তা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। শোভা আন্টির দিকে তার দৃষ্টি স্থির করেন। শোভা আন্টি তা দেখে বলেন,

— আমি বুঝতে পারছি আপনাদের মনোভাব। বিষয়টা আপনাদের কাছে অতি সহজ নয়। সিঙ্গেল মাদার তো আমিও ছিলাম। আমি জানি কেমন হয় লাগে এমন প্রস্তাব আসলে। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? এই সমাজে সিঙ্গেল মাদারদের মাথা উঁচু করে বেঁচে চলা খুব কঠিন। কেন না এইটা একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এইখানে যে কেউ কাউরো পরিচয় জানতে চাইলে তার পরিচয়ের পর বাবার পরিচয় জানতে চায়। সে কি করে না করে এইসব জানতে চায়। একটা ফর্ম ফিলাপের সময়েও বাবার নাম, পরিচয়ের অপশন দুইবার দেওয়া হয়, যেখানে মায়েরটা একবার। এইখানে সর্বদাই বাবার নাম পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। মায়ের না। সাদ নিজেই বাবা ছাড়া বড় হয়েছে। ওকেও ছোট থেকে এমন অনেক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। যেখানে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে কিন্তু সে কিছু বলতে পারেনি। সে জানে তখন কতটা কষ্ট হয়। আমিও জানি।
তাই আমি চাইছি অহনা যাতে এইসব ফেস না করে। এমন না যে আরশি ওকে একা হাতে বড় করতে পারবে না। সে অবশ্যই পারবে। কিন্তু তাও আমি এই প্রস্তাব রাখছি কারণ আমি আরশি আর অহনাকে নিজের ঘরে তুলতে চাই। দুইজনকে আপন করতে চাই।

মামা সব শুনে বললো,

— আপনার মনোভাব জেনে খুব ভালো লাগলো। অহনা আর আরশির প্রতি ভালবাসা থেকে আমরা অবগত নই। আপনি নিশ্চয়ই দুইজনের ভালো চেয়েই এইসব বলছেন কিন্তু সিদ্ধান্ত তো আর আমার হবে না। যার হবে তাকেই না হয় জিজ্ঞেস করা হোক।

ভাইয়াও তাল মিলিয়ে বলে উঠে,

— হ্যাঁ ঠিক তাই। আর এইখানে আমাদের মতামত তো এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যাদেরকে নিয়ে এই কথা হচ্ছে তাদেরও তো সম্মতি থাকা দরকার।

এই কথার মাঝে ভাবী কিছু বলতে নিয়ে ভাইয়া চোখ গরম করে তার দিকে তাকায়। ভাইয়ার ওমন চাহনি দেখে ভাবী দমে যায়। যা আমার চোখ এড়ায় নি। কিন্তু তাও আমি কোন রিয়েকশন দিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় আমার আর সাদের দিকে। একবার সবাই সাদের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আমার দিকে। অথচ আমরা দুইজনই চুপ। কাউরো মুখে নেই কোন কথা।

_____________________

ছাদটা কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। চারদিকে জমে আছে বৃষ্টি পানি। তার উপর ভাসছে স্বচ্ছ নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি। বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেজা মাটির মিষ্টি গন্ধ। আমি চুপটি মেরে সাদের পাশের চেয়ারে বসে আছি। সাদও আজ নিশ্চুপ। পিন পিন নীরবতায় হাহাকার করে উঠছে গাছের পাতাগুলো। সাদের সাথে আমার একান্ত কথা ছিল বিধায় ছাদে আসা। কিন্তু এইখানে এসে যেন দুইজনেই কথা হারিয়ে ফেলেছি। কথার চেয়ে প্রশ্নের ঝুলি ভারী হলেও আপাতত কোন কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। কেমন জড়তা কাজ করছে নিজের মধ্যে। অস্বস্তি নামক পোকাটি যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিলবিল করছে। স্বাভাবিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছি কিন্তু হতে পারছি না। বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছি কিন্তু আদৌ তা কাছে আসছে না। শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকিয়ে রই। তপ্ত মস্তিষ্ক যদি এতে একটু স্থির হয় সেই আশায়। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই থাকলাম। অতঃপর নীরবতা পেরিয়ে সাদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠি,

— তুমি কি সত্যি এই বিয়ে করতে চাও?

হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে যাওয়ায় সাদ ভড়কে উঠে। সে চঞ্চল দৃষ্টিতে একবার চারপাশে তাকায়। অতঃপর নিজেকে স্থির করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

— আমি নিজেও এর উত্তর জানি না।

আমি নীরবে সাদের দিকে তাকাই। সাদ আমার দৃষ্টির বক্তব্যটা বুঝতে পেরে বলে,

— বিয়ে করতে চাই কিনা জানি না কেন না তিন্নির জায়গায় অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব না। কোন কালেই না। কিন্তু এইটাও সত্য যে আমি অহনা বাবা হতে চাই। ওর মুখে দুই অক্ষরের সেই মধুর ডাকটি শুনতে চাই। ওকে পৃথিবীর সকল খুশি এনে দিতে চাই। এর জন্য যদি আমায় তোমাকে বিয়ে করতে হয় তাহলে ঠিক তাই।

— কিন্তু আমি চাই না। দ্বিতীয় বারের মত সংসার নামক দায়িত্ব-কর্তব্যের মাঝে পিসে যেতে চাই না। সত্যি বলতে আমার সংসার নামক জিনিসটা থেকেই মনটা উঠে গিয়েছে। ভয় লাগে এখন এইসবকে। দশটা বছর! ভাবতে পারছো তুমি? দশটা বছর ছিলাম এক সংসারে। কত কি না সহ্য করেছি আমি সেই সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। নিজের সব আত্নসম্মান,আত্নগ্লানি বিসর্জন দিয়েছিলাম এই সংসারের শিকড়ে আবদ্ধ থাকার জন্য। কিন্তু সর্বশেষ কি হলো? সেই শিকড় আমায় ছাড়তেই হলো।

সাদ অতি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— এই কথাটা আমিও জানতে চাই কেন ছাড়তে হলো তোমার সংসার? এতদিন জিজ্ঞেস করি নি তুমি কষ্ট পাবে বলে কিন্তু আজ যেহেতু কথা উঠেছে সেহেতু আজ তোমার কাহিনী আমি শুনতে চাই।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আমার অতীতের কালো অধ্যায় তুলে ধরতে শুরু করি। একদম গোড়া থেকে। আমি বলছি আর আমার জীবন থেকে সেই কালো অতীতের পাতাগুলো এক এক করে ছিঁড়ে দিচ্ছি। জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাইছি সেই কালো অধ্যায়ের পাতাগুলো। ফাহাদের অমানুষিক আচরণের কথাগুলো বলতেও আজও গা ঘিন ঘিন করে উঠেছে। মনের মাঝে ঘৃণাগুলো উপচে পড়ছে। আবার অহনার কথা উঠতেই বিষাদে মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে। নিজের মধ্যে ঘৃণা আর বিষাদের এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। অসহ্য হয়ে উঠছি ধীরে ধীরে। অবশেষে সেই তিক্ত অতীতের অবসান ঘটে। আমিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠে। স্বাভাবিক কন্ঠেই সাদকে বলি,

— এতকিছুর পর কি আমার সংসারের প্রতি অনিহা আসাটা স্বাভাবিক না? ভয় হওয়া কি স্বাভাবিক না?

সাদ ক্রোধে বলে উঠে,

— একটা মানুষ এতটা জঘন্য কিভাবে হতে পারে? এইটা কি আদৌ মানুষের বাচ্চা? মানে নিজের আপন সন্তানের প্রতি মানুষের কিভাবে টান না থাকে? এতটা কাপুরুষ কিভাবে হতে পারে?

— এই প্রশ্নের উত্তর যে আমারও অজানা।

সাদ বিরবির করে বলে উঠলো,

— রক্ত রক্তকেই টানে।

আমি সাদের কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করি,

— কিছু বললে?

— না।

— অহ!

এরপর নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ পর সাদ বলে উঠে,

— জানি না তুমি কথাটা কিভাবে নিবে, কিন্তু আমি এখন সত্যি চাই অহনার বাবা হতে। হোক সেটা প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে। এখন এর জন্য যদি আমার তোমায় বিয়ে করতে হয় তাহলে আমি রাজি।

— কিন্তু….

সাদ আমায় কথা বলতে না দিয়ে বলে উঠে,

— আগে পুরো কথাটা শুনো। বিয়ে হলেও তুমি তোমার মত থাকবে আর আমি আমার মত। আমি কখনোই তোমার উপর স্ত্রীর অধিকার ফোলাবো না। তোমায় আমাকে নিজের স্বামী হিসাবেও পরিচয় দিতে হবে না। শুধু অহনার বাবা হিসাবে পরিচয় দিলেই হবে। তোমার নামের পাশে আমার নাম বসাতে হবে না। আমি চাই, সবাই তোমাকে তোমার নামেই চিনবে জানবে আমার নামে না। আমি শুধু অহনার বাবার পরিচয় পেতে চাই আর কিছু নয়। ওকে বাবার ভালবাসাটা দিতে চাই। আপন করতে চাই ওকে। অহনাকে যদি কখনো জিজ্ঞেস করা হয় তার বাবা কে তাহলে সে যাতে বাবা হিসাবে আমাকে চিনে, জানে। নাম নাহয় তোমারই থাকলো, মেয়েটা আমারই হলো।

আমি সাদের কথা শুনে স্তম্ভিত। চকিতে তাকিয়ে রই তার দিকে। হঠাৎ নিজের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। বুঝে উঠতে পারি না আমার কি করা উচিৎ? এর মাঝে সাদ আবার বলে উঠে,

— জানি হয়তো ভাবছো আমার এতটা টান কেন অহনার প্রতি? কেন আমি এমন করছি? তা উত্তর কিন্তু তোমার সামনে। তুমি জানোই তিন্নির সাথে অহনার খানিকটা মিল আছে। যা সবচেয়ে বেশি টানে আমাকে তার প্রতি। আমি অহনার মধ্যে আমার মৃত অনাগত সন্তানকে অনুভব করি। যতবারই অহনাকে দেখি তখনই ভাবি আমার মেয়েটা যদি বেঁচে থাকতো সে হয়তো অবিকল অহনার মতই দেখতে হতো। কথাটা ভাবতেই আমার মনের মাঝে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। শান্তি লাগে মনে। প্রতিটা মুহূর্ত আমি অহনার মধ্যে আমি তিন্নি ও আমার অনাগত সন্তান দুইজনকেই খুঁজে পাই। তাই তোমার কাছে আমি ওকে চাইচি। ওর বাবা হওয়ার অধিকার চাইছি। এখন সিদ্ধান্তটা তোমার উপর, তুমি কি দিবে আমায় একটা সুযোগ? দিবে অধিকার অহনার বাবা হওয়ার?

#চলবে