আরশি পর্ব-৩১

0
2531

#আরশি
#Part_31
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ। শুভ্র নীল আকাশের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ। গোলাকৃতি আকারের সূর্যটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। চারদিক নিস্তব্ধ। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসছে কাকের কর্কশ কন্ঠ। আমি ডেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিকাবটা ঠিক করছি এর মধ্যে অহনা তাড়া দিয়ে উঠে,

— আম্মি!! তারাতারি করো। দেরি হচ্ছে আমাদের।

আমি অহনার দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলি,

— তোমার বাবাই এসেছে?

অহনা মাথা ঝাঁকিয়ে না সূচক উত্তর দেয়। আমি এইবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— তাহলে এত তাড়া কিসের? বাবাই আসুক আগে।

অহনা বিরবির করে বলে,

— তো আগে ভাগে রেডি হলে সমস্যা কোথায় বুঝি না?

অহনার কথাগুলো আমি ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে বলি,

— কি বলছ বিরবির করে?

অহনা আমার কথা শুনে ভড়কে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

— কই কিছু না তো। তুমি রেডি হও।

এই বলে অহনা দৌড়ে বিছানার উপর গিয়ে বসে। আমি আর কিছু না বলে হিজাবটা আবার ঠিক করে নিকাবটা পড়তে থাকি। নিকাব পড়া শেষে আমি বিছানার কাছে আসতেই অহনা বলে উঠে,

— বাবাই আসে না কেন? উফফ! সবাই এত লেটলতিফ কেন?

আমি অহনার দিকে ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— সবাই লেটলতিফ না, সবাই সবার জায়গায় ঠিকই আছে। তুমিই বরং আগে রেডি হয়ে গিয়েছ।

অহনা ভাব নিয়ে বলে,

— তাহলে সবাইকে উচিৎ আমার মত হওয়ার।

আমি অহনার নাক টেনে বলি,

— বড্ড কথা বলা শেখেছ।

অহনা কথা ঘুরিয়ে বলে,

— বাবাইকে ফোন দাও তো। কখন আসবে দেখ তো।

— সময় হোক সে এসে পড়বে। আর তারও তো কাজ থাকতে পারে তাই না মামণি। তুমি না সব বুঝো তাহলে এখন কেন বাচ্চামো করছো?

অহনা মুখটা ছোট করে বলে,

— হুম!

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেই। মিনিট পাঁচেক বাদেই সাদের ফোন আসে। সাদ এসে পড়েছে নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কথাটা শুনে অহনার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে দ্রুত নিচে নেমে যায় আর আমিও ওর পিছে পিছে চলে যাই।

_________________________

রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে ফাহাদ। তার আর ভালো লাগছে না কিছু। একদিকে ফারদিনের অসুস্থতা আরেকদিকে নিজ মনের অশান্তি। সেই সাথে নিজের অসুস্থতা তো আছেই। ফারদিনের নিউমোনিয়া হয়েছে৷ খুলনায় ডাক্তাররা রোগটা ধরতে পারছিল না বল সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেনি। যার ফলে এখন ওর অবস্থা গুরুতর। আপাতত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে তাকে। কিছুদিন সেখানেই রাখতে হবে তাকে। ফাহাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে এক পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তার পা আর চলছে না৷ সে আপাতত একটু বিশ্রাম নিতে চায়। খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায়। সকল দুশ্চিন্তা ও অশান্তি থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি চায় সে। কিছুদিন যাবৎ ধরে নিজেকে নিজের কাছেই বোঝা লাগে। সবকিছু ভেঙ্গে চুড়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে পারে না। সে জানে তার আয়ু হয়তো বেশি নেই। হাতে গোণা ক’টি বছরই হয়তো আছে। আর তার আয়ু শেষ হওয়ার আগেই সে বেশ কিছু কাজ শেষ করে যেতে চায়। সেই সাথে এই ক’টি বছর সে ভালো ভাবে বাঁচতে চায়। শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু এইটা আদৌ সম্ভব কিনা তার জানা নেই।

ফাহাদ একটি বেঞ্চিতে বসে গা এলিয়ে দে। মাথা ভনভন করছে। সে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পেরুতেই এক অতিপরিচিত কন্ঠ কানে এসে বারি খায়। এই কন্ঠটা চিনতে সে ভুল করতে পারে না। সে চটজলদি চোখ খুলে তাকায়। চঞ্চল চোখে চারদিকটা বুলিয়ে দেখতে থাকে। ডান দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় একজন বোরকা পরিহিত মেয়ে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তাকে দেখার সাথে সাথে ফাহাদের মনে মাঝে একটি নাম টনক নাড়ে। সে চকিতে চায় আরেকবার সেইদিকে। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপটি মেরে বসে থাকে সে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে আর দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সেই দিকে।

____________________

নিরিবিলি পরিবেশ। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। ছোট বাচ্চাদের হালকা হৈ-চৈ এর শব্দ বাতাসে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কে এসেছি প্রায় ঘন্টাখানিক হলো। সাদ আর অহনা আমার থেকে নয়-দশ হাত দূরেই ফুটবল খেলছে। আমি তাদেরকেই খুব সুক্ষ্মভাবে পরোক্ষ করে চলেছি। এমন সময় আমার মুঠোফোনটি বেজে উঠে। আমি তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ব্যাগ হাতড়ে মুঠোফোনটা খুঁজার চেষ্টা করি। মুঠোফোনটা হাতের নাগালে পেতেই আমি তাতে চোখ বুলাই। বেকারি থেকে ‘সোহেল’ ফোন দিয়েছে। আমি চটজলদি কলটা রিসিভ করি। বেশ কয়েকবার হ্যালো বললাম কিন্তু কোন রেসপন্স পেলাম না। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক আপ-ডাউন করছে। বাংলালিংক সিমে এই এক সমস্যা। যখন তখন নেটওয়ার্ক আপ-ডাউন করে। আমি নেটওয়ার্ক পেতে উঠে দাঁড়ালাম। অতঃপর হাটতে হাটতে বা-দিকটা চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে ফুল নেটওয়ার্ক পেতেই আমি সোহেলকে ফোন করলাম। এতক্ষণে ওর কল কেটে গিয়েছে। দু’বার রিং হতেই কলটা রিসিভ হয়। কথা শেষ করে আমি পিছে ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে যাই। পা দুটো জমে যায়। আমি স্থির দৃষ্টিতে সামনে দিকে তাকিয়ে রই। চোখের সামনে ভেসে উঠে এক অনাকাঙ্ক্ষিত চেহেরা। এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত তার সাথে আমার দেখা। প্রথমবার দেখা হয়েছিল সেই ছয় বছর আগে। আর আজ আবার ছয় বছর পরে। আমার সামনে সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে যার সাথে নাকি একদা আমি আমার জীবনের দশটা বছর কাটিয়েছিলাম। আমার সন্তানের আসল পিতা সে। ফাহাদ! অবশ্য সে এখন আমাদের স্মৃতির মাঝেই বিরাজমান করে না। ‘ফাহাদ’ নামের কোন ব্যক্তি যে ছিল আমাদের জীবনে তা আমাদের মনেই নেই। আমি আর অহনা অতীতকে পিছে ফেলে যে যার মত এগিয়ে চলে গিয়েছি। এখন যে আর আমাদের অতীত টানে না। আমি দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফাহাদকে না দেখার ভাণ করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ফাহাদ করুণ সুরে বলে উঠে,

— কেমন আছো?

সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। চকিতে চাই তার দিকে। তার এমন করুণ কন্ঠ শুনে শরীরটা মৃদু কম্পন দিয়ে উঠে। নিজেকে একটু ভিতরে ভিতরে গুছিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— জ্বী আমাকে বলছেন?

ফাহাদ ম্লান হেসে বলে,

— হ্যাঁ। কেন আমাকে চিনতে পারো নি বুঝি? খুব কি অপরিচিত হয়ে গিয়েছি?

ফাহাদের কথাগুলো শুনে আমি ভড়কে যাই। কিন্তু তা প্রকাশ না করে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,

— অপরিচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তার উপর বিকৃতি মনের মানুষ ও তাদের সাথে জড়িত অতীতের স্মৃতি অচেনা করে দেওয়া উত্তম।

ফাহাদ কিছু না বলে চুপ করে যায়। অতঃপর পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

— কেমন আছো?

আমি এইবার ভালো মত ফাহাদের দিকে তাকালাম। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ একদম মলিন হয়ে আছে। গাল ভর্তি দারি। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। পড়নে অতি ঢোলা শার্ট আর প্যান্ট। দেখে বুঝাই যাচ্ছে সে ভালো নেই। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— জ্বী আলহামদুলিল্লাহ আপনি?

ফাহাদ আবারও ম্লান হেসে বলে,

— এইতো!

হঠাৎ মস্তিষ্কের মাঝে একটা প্রশ্ন টনক নাড়তেই আমি চট জলদি প্রশ্ন করে বসি,

— আমাকে চিনলেন কিভাবে?

— কিছু জিনিস না হয় অজানা এই থাক। তা অহনা কেমন আছে?

অহনা নাম তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হতেই আমার বুক কেঁপে উঠে৷ মনের মাঝে এক অজানা ভয় এসে ভীড় জমায়। সেই সাথে ভীড় জমায় একঝাঁক প্রশ্নের ঝুলি।
“সে কেন এত বছর পর অহনার খোঁজ করছে? যেই খোঁজ তার ছয় বছর আগে নেওয়ার দরকার ছিল তা এখন কেন নিচ্ছে? সে কি এতবছর পর তার থেকে তার অংশকে কেড়ে নিতে এসেছে?”
এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে মাথার ভিতর। মস্তিষ্ক কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ঠিক এমন সময় ফাহাদ আমায় আবার জিজ্ঞেস করে উঠে,

— বললে না যে অহনা কেমন আছে?

আমি কোনমতে নিজেকে সামলে বলি,

— আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। ফাহাদ হঠাৎ করুণ সুরে বলে,

— আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? জানি আমি তোমার আর অহনার সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। এতকিছুর পর ক্ষমা চাওয়াটা মোটেও যুক্তিগত নয় কিন্তু তাও চাইচ্ছি। নিজের করা ভুলের চরম শাস্তি তো পাচ্ছিই সেইসাথে অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি।

ফাহাদের কথা শুনে আমি স্থির হয়ে যাই। তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,

— আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো কিনা জানি না। কেন না আপনি যে শুধু আমার সাথেই নয় আমার সন্তানের সাথেও চরম অন্যায় করেছেন। আমার কথা হলেও আমি হয়তো বা ক্ষমা করে দিতাম কিন্তু অন্যায়টা তো আর আপনি একা আমার সাথে করেন নি। আচ্ছা বলতে পারেন কি? সেই ছোট পাঁচ বছর বয়সী নিষ্পাপ মেয়েটার কি দোষ করেছিল যার জন্য ওকে এতকিছু সহ্য করতে হলো? পিতার ভালবাসার জায়গায় অনিহা আর তাচ্ছিল্য মিললো?

ফাহাদ কিছু না বলে মাথা নত করে নেয়। অতঃপর ধরা কন্ঠে বলে,

— আমি যে কি বড় ভুল করেছি তা আমি এখন হারে হারে টেড় পাচ্ছি। আর এর জন্য আমি সত্যি অনুতপ্ত। প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। আমি এখন এর থেকে মুক্তি চাই। আর এই মুক্তি আমায় শুধু তুমি দিতে পারো। তোমার ক্ষমা দিয়ে। আর এর বদকে তুমি যে শাস্তি আমায় দিবে তাই আমি মেনে নিব।

— শাস্তি দেওয়ার আমি কে? সেটা প্রকৃতি নিজেই নেয়। আমার সাথে অবিচার ঠিকই করেছেন কিন্তু এর বিচার আমি না বরং আল্লাহ নিজে করবে। আর রইলো ক্ষমার কথা? সেটা আমি চেষ্টা করবো।

ফাহাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অহনা দৌড়ে এসে আমায় কোমড় জড়িয়ে ধরে। আর অভিমানী সুরে বলে,

— তুমি এইখানে কি করছো আম্মি? জানো আমি আর বাবাই মিলে তোমায় কতক্ষণ ধরে খুঁজছি?

আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,

— তোমার সোহেল মামার ফোন এসেছিল তার সাথেই কথা বলতে বলতে কখন যে এইদিকটায় এসে পড়েছি খেয়াল ছিল না। আম্মি এতগুলো সরি।

এরই মাঝে সাদ এসে বলে,

— এই তোমার কি মিসেস. ইন্ডিয়া হওয়ার ইচ্ছে জাগসে? হঠাৎ কোথায় হাওয়া হয়ে যাও তুমি।

আমি কিছু না বলে সাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাই। সাদ তা দেখে আড়চোখে আমাকে দেখে ফাহাদের দিকে তাকায়। ফাহাদের দিকে তাকাত্বি সাথে সাথে তার মুখে রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। চোখ দুটো কেমন যেন জ্বলে উঠে। অহনা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পিছে ঘুরে তাকাতেই ফাহাদকে দেখতে পায়। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ফাহাদের দিকে। অতঃপর আমার হাত টেনে জিজ্ঞেস করে,

— এই আঙ্কেলটা কে আম্মি?

অহনার কথা শুনে আমি চকিতে তাকাই ওর দিকে। অতঃপর চোখ তুলে একবার ফাহাদের দিকে তো আরেকবার সাদের দিকে তাকাই। অহনা যে ফাহাদকে চিনতে পারছে না তা আমার বুঝতে দেরি নেই। আর না চিনাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। আজ প্রায় ছয় বছর পর অহনা ফাহাদকে দেখছে। এতদিনে ওর মন মস্তিষ্ক থেকে ফাহাদ নামের মানুষটি প্রতিচ্ছবি পুরোপুরি ভাবে মুছে গিয়েছে। তাই তো আজ ফাহাদ ওর কাছে অজানা।

হঠাৎ আমার মনের মাঝে প্রশ্ন জেগে উঠে, “আচ্ছা, নিজের সন্তান যখন তার বাবাকে চিনতে পারে না, আর এই প্রশ্নটি করে তখন একজন পিতার ঠিক কতটা আহত হয়? এর চেয়ে তিক্ত অনুভূতি কি আর দুটো আছে এই পৃথিবীতে? ফাহাদেরও কি এখন সেই তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে? হয়তো না আবার হয়তো হ্যাঁ।” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— তুমি চিনবে না মামণি।

— অহহ আচ্ছা।

ফাহাদ এতক্ষণ চুপ ছিল। দুই নয়ন ভরে অহনাকে দেখছিল। হঠাৎ সে বলে উঠে,

— ও কি সেই ছোট অহনা?

আমি কিছু না বলে শুধু মাথা দুলাই। যার অর্থ হ্যাঁ। ফাহাদ এইবার হাটু গেড়ে বসে। অহনাকে কাছে ডাকে। কিন্তু অহনা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এক দৌড়ে চলে যায় সাদের কাছে। সাদ অহনাকে আগলে নিয়ে বলে,

— কি হয়েছে?

— আমার এনাকে ভয় করছে।

সাদ অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

— ভয় পাওয়ার কিছু নেই মাই এঞ্জেল। সে কিছু করবে না।

অহনা কিছু না বলে চুপটি করে থাকে। ফাহাদের দৃষ্টি হঠাৎ ছলছল করে উঠে। সে উঠে দাঁড়ায়। কৌতহূল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,

— এই ভদ্রলোকটি কে?

আমি কিছু বলার আগেই সাদ উত্তর দেয়,

— আমি অহনার বাবা।

ফাহাদ বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তুমি আবার বিয়ে করেছ?

সাদ চোয়াল শক্ত করে বলে,

— নান অফ ইউর বিজনেস।

ফাহাদ এইবার আহত চোখে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সাদের দিকে। সাদ তা দেখে বলে,

— এইখানে কেন এসেছেন আপনি মি. ফাহাদ হোসেন?

ফাহাদ নিজের নাম শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— আপনি আমায় চিনেন?

সাদ চোয়াল শক্ত করে বলে,

— আমার চেয়ে ভালো আপনাকে কে চিনবে?

— মানে?

— আপনি হয়তো আমায় চিনেন নি তাই না? ভুলে গিয়েছেন হয়তো আমায়। দ্যান লেট মি ইন্ট্রডিউস টু ইউ মাইসেফ। আমি মাহবুব হোসেন সাদমান। আপনার চাচা আজাদ হোসেনের ছেলে।

ফাহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— তুমি কি সেই সাদমান? মানে আজাদ চাচা আর শোভা চাচীর ছেলে?

সাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— আনফরচিনেটলি ইয়েস!

আমি সাদ আর ফাহাদের কথা শুনার সাথে সাথে আমার মাথা ঘুরে উঠে। পায়ের নিচের মাটিটা কেমন নড়বড় করে উঠে। আমি বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দুইজনের দিকে। এর মানে সাদ আর ফাহাদ চাচাতো ভাই? কিন্তু কিভাবে? কাহিনী কি? মাথা ভনভন করছে আমার। কোন মতে আমি নিজেকে সামলে নেই। পরবর্তীতে সাদ থেকে এই বিষয়ে আমি বিস্তারিত জানা যাবে আপাতত হাইপার হয়ে লাভ নেই। আমি লম্বা দুই-তিনটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলি।

চারদিকে নিরবতা। কাউরো মুখে কোন কথা নেই। আমি নিরবতা পেরিয়ে সাদকে বলি,

— তুমি অহনাকে নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াও। আমি দুই মিনিটে আসছি।

সাদ একবার আমার দিকে তাকিয়ে অহনাকে কোলে তুলে নেয়। অতঃপর ফাহাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আশা করি কোন প্রকার বারাবাড়ি আপনি করবেন না।

বলেই সাদ উল্টো পথে হাটা দেয়। তা দেখে ফাহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আমার দিকে ঘুরে বলে,

— তুমি হয়তো ঠিক। আল্লাহ হয়তো আমার বিচার করেছে। কঠোর বিচার করেছেন। আর তুমি আমায় শাস্তি না দিলেও প্রকৃতি কিন্তু আমায় ঠিকই শাস্তি দিয়েছে। ভয়ংকর শাস্তি। যা না পারবে কেউ সইতে, না পারবে মরতে।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,

— “রিভেঞ্জ অফ নেচার” বলে কিছু আছে তা জানতাম। কিন্তু আজ তা দেখেও নিলাম। আসলেই মানুষ সব ভুলে গেলেও প্রকৃতি কিন্তু কিছু ভুলে না। সে ঠিকই সময়মত তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। হোক সেটা পরোক্ষভাবে অথবা প্রত্যক্ষভাবে। কাউকে ছাড় দেয় না সে।

— আর এইটাই হয়তো প্রকৃতির প্রতি আমার নিষ্ঠুর প্রতিশোধ। আজ আমি বেঁচেও বেঁচে নেই, আমার আপন সন্তান আমায় চিনে না, বাবা বলে অন্য কাউকে চিনে, শেষ বারের জন্য তার আদরমাখা হাতের ছোয়াও পেলাম না, আমার প্রাক্তন স্ত্রী এখন আমারই চাচাতো ভাইয়ের অর্ধাঙ্গিনী, আমার আপন বলে এই পৃথিবীতে কেউ নেই। আসলেই প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় নিষ্ঠুর। সে যাই হোক, আমার কাউরো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। আমি আমার পাপের কর্মই পাচ্ছি। তা এখন তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ পারলে সবকিছুর জন্য আমায় ক্ষমা করে দিও। ভালো থেক।

এই বলে ফাহাদ দ্রুত সেই জায়গায় থেকে প্রস্থান করে। আর আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস৷ আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা দেই আমার গন্তব্যের দিকে।

#চলবে

গল্প কেমন হচ্ছে প্লিজ জানাবেন। ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিবেন।