আর একটিবার পর্ব-১০+১১

0
208

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১০

কাওকে কিডন্যাপ করা কি খুব সহজ কাজ? শ্রাবণ ইর্তেজাকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিলো৷ ইর্তেজা ধীরপায়ে হাঁটছে রাস্তায়। জমিন মালিকের স্ত্রীকে কিডন্যাপ করতে হবে। ২/৩ ঘন্টার জন্য তাকে লুকিয়ে রাখবে ইর্তেজা। আর আরেকদিকে শ্রাবণ তার স্বামীকে ভয় দেখিয়ে জমিন কিনে নিবে। এমন উল্টা পাল্টা ভাবনা একমাত্র শ্রাবণ আহমেদই ভাবতে পারে৷ ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ভালো যে কাওকে মেরে ফেলার কথা বলেনি শ্রাবণ। ইর্তেজা সব পারবে কারো হত্যা করতে পারবে না। কিন্তু কাওকে কিডন্যাপ করা তো ভালো না। উপর দিয়ে মানুষটা নারী। ইর্তেজার মাথা কাজ করছে না। বাসায় পৌঁছে দেখে ঝর্ণা এখনো যায় নি। ইরিনা চুপ করে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছু চিন্তা করছে৷ ইর্তেজা এসেছে সে খেয়াল করেনি। ঝর্ণা বলায় ইরিনা ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজাকে দেখার সাথে সাথে হাসিবের কথাগুলো ইরিনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ইর্তেজা গিয়ে ইরিনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। ইরিনা তাকিয়ে আছে ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা ইরিনার চাহনি দেখে বলল-
“কি ভাবছো?”
“একটা কথা জানতে চাই। আশা করছি মিথ্যে বলবি না।”
“ঠিক আছে, বলো।”
“তুই শ্রাবণ আহমেদের সাথে কাজ করিস?”
ইর্তেজার মুখের হাসি উড়ে গেল ইরিনার কথা শুনে। ইরিনা ইর্তেজার জবাবের অপেক্ষা করছে। জবাব না পেয়ে আবার বলল- “তার মানে আমি যা শুনেছি সব সত্যি।”
“কি শুনেছো?”
“তুই ক্রিমিনাল হয়ে গিয়েছিস।”
ইর্তেজা তাকিয়ে রইল ইরিনার দিকে। ইরিনা আবার বলল- “কেন ইর্তেজা? তুই তো সবসময় বলতি জীবন বিসর্জন দিতে পারিস কিন্তু সম্মান ধুলোয় মেশাতে পারবি না। এখন তোর মানসম্মান কোথায় জানতে পারি?”
ইর্তেজা ইরিনার হাত ধরে বলল-
“আপু বিশ্বাস করো আমি এমন কোনো কাজ করছি না যাতে তোমার বা আমার মানসম্মানে দাগ লাগবে।”
“তাহলে আমাকে পুরো কথা বল। কি কাজ করিস শ্রাবণ আহমেদের সাথে?”
ইর্তেজা মাটিতে বসে বলল-
“আচ্ছা শুনো, মনে আছে হসপিটালে যখন বস আই মিন শ্রাবণ আহমেদের সাথে দেখা হয়েছিল? সেদিন উনি আমাকে দেখে নিজের ফ্যাক্টরিতে কাজ দেয়৷ আমি ৯ মাসের মতো উনার ফ্যাক্টরিতে কাজ করছিলাম৷ একদিন উনি আমাকে বলে আমাকে উনার স্ত্রীর বডিগার্ড হিসেবে কাজ করতে হবে৷ এর জন্য আমাকে টাকা বাড়িয়ে দেবে। তোমার চিকিৎসার জন্য আমার টাকা প্রয়োজন। কোনো রাস্তা খুঁজে না পেয়ে আমি রাজি হয়ে গিয়েছি। আপু বিশ্বাস করো এর চেয়ে বেশি আর কিছু না। আমি প্রতিদিন উনার স্ত্রীকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসি আবার বাসায় নিয়ে যাই। আর এর মাঝে উনি কারো সাথে দেখা করে কি-না সেটার খবরই শ্রাবণ আহমেদকে জানাই।”
ইরিনা তাকিয়ে রইল ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা ইরিনার পায়ে মাথা রেখে বলল-
“তোমার ভাই কখনো তোমাকে কষ্ট দেয়ার মতো কাজ করবে না।”
“তাহলে কি শ্রাবণ আহমেদের স্ত্রী-ই কি সেই মেয়ে যার জন্য দিন-রাত চিন্তা করিস।”
ইর্তেজা ইরিনার দিকে তাকাল। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকাল। ঝর্ণা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা বলল-
“তুমি আমার দিকে এভাবে কি দেখছো? যাও খাবার নিয়ে আসো ডিনার করবো আমরা।”
“ভাইজান আমি কাওরে বলুম না আপনে বলেন।”
ইর্তেজা কিছু বলার আগেই ইরিনা বলল-
“ইর্তেজা কথা ঘোরাবি না, বল আমায়।”
“ঠিক ভাবলে, তার জন্য চিন্তা করার কারণ হচ্ছে মেয়েটার জীবনে অভাব নেই। তবুও সে একা। কিছুদিন আগে তার বাবা মারা গিয়েছে। শ্রাবণ আহমেদকে না জানিয়ে সে গিয়েছে বাবার লাশ দেখতে। শ্রাবণ আহমেদ খুব ভয়ংকর মানুষ। তাই আমার কেন যেন চিন্তা হয় যদি উনি সাগরিকার ক্ষতি করে? বিশ্বাস করো আপু এর থেকে বেশি না। মায়া হয় তার জন্য এই আর কি।”
“তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ভেবেছি কোনো সাধারণ মেয়ে হবে। কিন্তু না, একজন মাফিয়ার বউ, আস্তাগফিরুল্লাহ্।”
“আপু…”
ইর্তেজা পুরো কথা বলার আগেই ঝর্ণা বলল-
“ভাইজান বিয়াইত্তা মাইয়ার প্রেমে পরা ভালা না।”
“তুমি চুপ থাকবে?”
ইর্তেজার ধমক শুনে ঝর্ণা দ্রুত গতিতে হেটে রান্নাঘরে চলে গেল। ইর্তেজা ইরিনার দিকে তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“তাকে ভালোবাসি না। আসলে আপু এত বছর একা থাকতে থাকতে আমার মন মানসিকতায় ধুলো জমে গিয়েছে৷ সাগরিকার পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে আমি তার মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি। মেয়েটা অনেক ভালো আপু। শ্রাবণ আহমেদ জানো কি বলেছে? যদি সাগরিকার সম্পর্কে এমন তেমন কিছু জানতে পারে তাকে নিজের হাতে মেরে ফেলবে তবুও অন্য কারো হতে দেবে না। তারা দুই স্বামী স্ত্রী দুজনই জেদি। তাদের জেদের মাঝে সবসময় আমি ফেঁসে যাই যে কার পক্ষ নেবো।”
ইরিনা ইর্তেজার গালে হাত রেখে বলল-
“ওয়াদা কর এমন কোনো কাজ করবি না যাতে অন্য কারো বা তোর ক্ষতি হয়।”
ইর্তেজা ইরিনার হাত মুঠোবন্দি করে চুমো দিয়ে বলল-
“ওয়াদা ওয়াদা ওয়াদা, এখন প্লিজ ঝর্ণাকে বলো খাবার বাড়তে আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
“যা তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।”
ইর্তেজা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। ইরিনা চুপচাপ বসে আছে। ইর্তেজার সব কথা শোনার পর তার ভয় আরো বেড়ে গেল। যদি ইর্তেজার কোনো ক্ষতি হয়?
.
.
শ্রাবণ এখনো বাসায় ফিরেনি। সাগরিকা হলরুমের পায়চারি করছে৷ না সে শ্রাবণের জন্য চিন্তা করছে না। শ্রাবণের কিছু হবে না সে জানে। সে ভাবছে সূর্যকে বাসায় নিয়ে আসবে কি-না। শ্রাবণ খুব রাগী৷ যদি সূর্যের সাথে ঝগড়া হয় আর সে সূর্যের ক্ষতি করে? সূর্য ছাড়া সাগরিকার কেও নেই। সে পারবে না ভাইয়ের ক্ষতি হতে দেখতে৷ কিছুক্ষণ পর শ্রাবণের গাড়ির হর্ণ বাজলো। সাগরিকা গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রাবণ ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে। সাগরিকাকে দেখে সে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সাগরিকা দরজা বন্ধ করতে করতে বলল-
“ফ্রেশ হয়ে আসো খাবার বাড়ছি।”
শ্রাবণ দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা কথাটা বলেই ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। শ্রাবণ উঁচু স্বরে বলল-
“তুমি খেয়ে নাও আমার ক্ষুধা নেই।”
সাগরিকা ঘুরে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল-
“রাগ আমার উপর। তো আমার উপরেই তুলে নিও। এখন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।”
শ্রাবণ কিছু না বলে চলে গেল। সাগরিকা বসে অপেক্ষা করছে শ্রাবণের। আধাঘন্টার কাছাকাছি হয়ে গেল শ্রাবণ আসছে না। সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে প্লেটে খাবার সাজিয়ে ট্রেতে করে ঘরে নিয়ে গেল। শ্রাবণ মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছে। সাগরিকাকে দেখে কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে কল কেটে দিলো। সাগরিকা বিষয়টা বুঝতে পারলো কিন্তু কিছু বলল না। শ্রাবণ মোবাইল রেখে বিরক্ত হয়ে বলল-
“বলেছি না ক্ষুধা নেই? যাও এসব নিয়ে আমার ভালো লাগছে না।”
সাগরিকা খাটের উপর ট্রে রেখে বলল-
“জানতে চাও না কেন তোমাকে সহ্য হয় না? ঠিক এই কারণে৷ তুমি যেমন চেষ্টা করো আমার মনে জায়গা করার আমিও চেষ্টা করি তোমাকে মনে জায়গা দেয়ার। কিন্তু না, তুমি সবসময় এমন কোনো কাজ করো আগের থেকেও বেশি ঘৃণা হতে শুরু করে।”
শ্রাবণ হনহন করে হেটে গিয়ে সাগরিকার সামনে দাঁড়াল। সাগরিকা শ্রাবণকে দেখে তালিচ্ছ্যের হাসি দিয়ে বলল-
“রাগ হচ্ছে খুব? রাগ ঠান্ডা করার জন্য নিশ্চয়ই মারবে আমায়। এবার বেস্ট আইডিয়া দেই। কোমড়ের বেল্ট দিয়ে আজ পেটাও। দেখবে ৫ মিনিটে সব রাগ শেষ।”
শ্রাবণ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরিকার দিকে। কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। শ্রাবণের সাথে থাকতে থাকতে সাগরিকাও তার মতো হয়ে গিয়েছে। হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে সাগরিকা তাকিয়ে রইল শ্রাবণের দিকে। হঠাৎ শ্রাবণ সাগরিকাকে জাপ্টে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আবার সাথে সাথে ছেড়ে দিয়ে বলল-
“তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছে নেই।”
বলেই শ্রাবণ খাটে বসে প্লেট হাতে নিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো। সাগরিকা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
.
.
পরেরদিন…..
সাঈদের মাথায় গতকালের দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারেনি সে। আজ ভীষণ খারাপ লাগছে। ক্লাসে মন দিতে পারছে না। বোর্ডে কিছু প্রশ্ন তুলে স্টুডেন্টদের উত্তর লিখতে বলে সে বসে রইল মাথা নিচু করে৷ প্রতিদিনের মতো জেসমিন উঠে এসে সাঈদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
“স্যার বুঝিয়ে দিন। এটার নিয়ম খুব কঠিন।”
সাঈদ বিরক্ত হয়ে জেসমিনের দিকে তাকাল। সে অনেকবার এটা বুঝিয়েছে। সবাই বুঝেছে কিন্তু এই মেয়েটা বুঝে নি এখনো। সাঈদ লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“দাও বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
জেসমিন হাসিমুখে খাতা এগিয়ে দিলো। সাঈদ আবার বুঝাতে লাগলো জেসমিনকে। জেসমিন পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাঈদের দিকে। কল্পনায় হারিয়ে গেল। যখন প্রথমবার সাঈদকে দেখেছিল।

অতীতের অংশ…..
আজ বাসায় মেহমান আসবে। মা বলেছিল বাবার কলেজের কিছু স্টুডেন্ট দেখা করতে আসবে। স্কুলের ছুটি হতেই দৌড়ে ক্লাস থেকে বের হলো। তার গাড়ি এসে পড়েছে। গাড়িতে বসতেই বাবা তার দিকে একটা আইসক্রিম এগিয়ে দিলো। জেসমিন খুশীতে আত্মহারা। আইসক্রিম হাতে নিয়ে বলল-
“আব্বু তোমার মেহমান আসেনি। আমাকে নিতে আসলে যে?”
“আমার মামনি আমার দায়িত্ব। আসুক মেহমান।”
জেসমিন খিলখিল করে হাসলো। বাবা গাড়ি স্টার্ট দিলো বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে৷ বাসায় পৌঁছে তারা শুনে মেহমান এসে পড়েছে। জেসমিন গুনগুন করতে করতে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সে থেমে গেল। সোফায় দু’টো ছেলে বসে আছে। বরাবর বসে থাকা ছেলেটাকে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছেলে দুটো তার দিকে তাকাল। বাবা ভেতরে আসতেই তারা সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাবা এগিয়ে গেল তাদের দিকে। তারা সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। বাবা তাদের বসতে বলে জেসমিনকে ডাকলো। জেসমিনের ধ্যান ভাঙ্গতেই এগিয়ে গেল।
“ইর্তেজা সাঈদ, ও আমার মেয়ে জেসমিন।”
ইর্তেজা বলল-
“স্যার আপনি অনেক আগে একবার ওকে স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন তাই না? ও অনেক ছোটো ছিলো তখন। মাশা আল্লাহ্ বোন আমাদের বড়ো হয়ে গিয়েছে।”
জেসমিন মুচকি হাসলো ইর্তেজার কথা শুনে। সাঈদ বলল-
“কোন ক্লাসে পড়ো জেসমিন?”
জেসমিন আমতা আমতা করে বলল- “ক্লাস এইট”
“জেএসসি পরীক্ষা দেবে এবার৷ ভালো মতো পড়াশোনা করবে কেমন?”
“জি”
বাবা জেসমিনকে ভেতরে যেতে বলল। জেসমিন মাথা নাড়িয়ে দ্রুত হেটে ভেতরে গেল। ঘরে এসে সে থমকে বসে রইল। সেদিন তার কিশোরী মনে হঠাৎ করেই অজানা অনুভূতি হতে শুরু করে। সেদিনই ছিল প্রথম আর শেষ দেখা সাঈদের সাথে। এরপর জেসমিন জানতে পারে সাঈদ বিদেশ চলে গিয়েছে পড়াশোনার জন্য তাই দেখা করতে এসেছে স্যারের সাথে। ৪ বছর পর সে আবার সাঈদকে দেখে ট্রাফিকজ্যামে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সাঈদের দিকে। আগে থেকে আরো সুদর্শন দেখাচ্ছিল সাঈদকে। জেসমিন তখন কলেজ থেকে বাসায় যাচ্ছিল গাড়ি দিয়ে। খাতা থেকে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে লিখলো “হোয়াইট শার্টে আপনাকে বেশ দেখায় মিস্টার সাঈদ ইব্রাহিম।” কাগজটা বল বানিয়ে সাঈদের দিকে ছুঁড়ে মেরে দ্রুত গ্লাস উঠিয়ে দিলো। যার ফলে সাঈদ সেদিন জেসমিনকে দেখতে পায়নি।

বর্তমানে…..
সাঈদের ধমকে জেসমিনের হুঁশ ফিরলো। জেসমিন সাঈদকে রাগান্বিত দেখে ঢোক গিলে বলল-
“জি স্যার?”
“কোথায় হারিয়ে আছো তুমি?”
“কোথাও না স্যার”
“বুঝেছো এখন?”
জেসমিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সাঈদ জেসমিনের দিকে খাতা দিয়ে চলে যেতে বলল। জেসমিন মন খারাপ করে খাতা নিয়ে নিজের বেঞ্চে এসে বসলো। ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজতেই সাঈদ দ্রুত ক্লাস থেকে বের হলো। সে এখন ইরিনার সাথে দেখা করতে যাবে। তার জানতেই হবে ছেলেটা কে।
.
.
ইর্তেজা ইরিনার ঔষধ কিনতে বাহিরে এসেছে। তিনটে ফার্মেসিতে জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু ঔষধ নেই। তাই সে বাসা থেকে অনেকটা দূরের ফার্মেসিতে এসেছে। ঔষধ কিনে ধীরপায়ে হাঁটা ধরলো। আজ কোনো কাজ না করেই সে ক্লান্ত। মন অসুস্থ থাকলে শরীরও যেন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। একটা স্কুলের পাশ দিয়ে ইর্তেজা যাচ্ছিল তখনই দেখে একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে স্কুলের ভেতরে গেল। সাইকেলের পেছনে একটা মেয়ে বসা৷ ইর্তেজা দাঁড়িয়ে পরলো। আবারো তার ইচ্ছে হলো অতীতের আর একটি পৃষ্ঠা খুলতে।

অতীতের কিছু অংশ……
ইর্তেজা আজ লেইট। দৌড়ে সে কলেজ যাচ্ছে। ভার্সিটির গেইটে দেখা হলো মাহার সাথে। মাহা তখন তার গাড়ি থেকে নামছিল। ইর্তেজা হাসলো। মাহা-ও আজ লেইট। ইর্তেজা দ্রুত গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। মাহা তাকে দেখে দু’বার চোখের পলক ফেলে বলল-
“কি হলো তোর? হাঁপাচ্ছিস কেন?”
“দৌড়ে আসলাম তাই। তুইও লেইট আজ?”
“হ্যাঁ রাত জেগে মুভি দেখেছি সকালে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে।”
“তাই তো বলি তুই আমাকে আজ কল দিলি না কেন।”
“আমি কি তোর এলার্ম? নিজে নিজে উঠতে শিখ।”
ইর্তেজা দুষ্টুমি হাসি দিয়ে মাহার দিকে এগিয়ে গেল। মাহা ইর্তেজার বুকে হাত রেখে তাকে থামিয়ে বলল-
“দূরে থাক”
“এখন দূর ঠেলে দিচ্ছিস দে। একবার বিয়ে হোক আমাদের।”
মাহা কিছু বলল না। ইর্তেজা এমন কথা বললেই তার লজ্জা করে। তখনই একটা ছেলে আসলো বাইক চালিয়ে। পেছনে একটা মেয়ে বসে আছে। ইর্তেজা ও মাহা তাদের চেনে। মেয়েটা সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। ছেলেটা তার স্বামী। প্রতিদিন তাকে দিতে আসে। ইর্তেজা এক নজর তাদের দেখে মাহার দিকে তাকাল। মাহা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ইর্তেজা মাহার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল-
“তোর আবার কি হলো?”
“দেখ তাদের। কত সুন্দর জুটি তাই না? ইর্তেজা আমাদের বিয়ের পর আমরা একসাথে ভার্সিটি আসবো। তুই একটা বাইক কিনে নিস।”
ইর্তেজা কিছু বলল না। মাহার কথা শুনে সে আবার সেই জুটিটার দিকে তাকাল। সত্যি তাদের অসাধারণ দেখাচ্ছে। ইর্তেজা মুচকি হেসে বলল-
“নিতে পারবো কি-না জানিনা। কিন্তু চেষ্টা করে দেখবো।”
“এইরে দেরি হয়ে যাচ্ছে তারাতাড়ি চল।”
মাহা ইর্তেজার হাত ধরে টেনে ভার্সিটির ভেতর ঢুকলো।

পরেরদিন….
মাহা তার বাড়ির মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গিয়েছে গাড়ি নিয়ে আসতে। মাহা গুনগুন করছে আকাশে উড়ে বেড়ানোর পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা সাইকেল এসে তার সামনে থামলো। হঠাৎ আসায় মাহা চমকে তাকাল সেদিকে। হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-
“এটা কী ইর্তেজা?”
ইর্তেজা হেসে মাহার দিকে একটা লাল গোলাপ ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল-
“ভালোবাসি”
মাহা মুচকি হেসে ফুল হাতে নিয়ে বলল-
“আমিও, এখন বল এই সাইকেল কার?”
“ভালোবাসার চোখে দেখ। এটা সাইকেল না। এটা বাইক।”
“আমাকে পাগল কুকুর কামড়ায় নি যে আবল তাবল কথা বলবো।”
ইর্তেজা মুখ লটকিয়ে বলল-
“তোর জন্য আমি আমার পিগি ব্যাংক ভেঙ্গে সাইকেল কিনলাম তুই প্রশংসাও করছিস না।”
“আমার জন্য? হোল্ড অন, কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”
“গতকাল তুই বললি না আমার সাথে বাইক দিয়ে ভার্সিটি যেতে চাস? আমি ভাবলাম এই গরীবের তো বাইক কেনার সামর্থ্য আপাতত নেই তাই সাইকেল কিনে নিলাম।”
“ইর্তেজা আমি আমাদের বিয়ের পরের কথা বলেছি।”
ইর্তেজা মাহার হাত ধরে বলল-
“জানিস তো মানুষের আয়ুর উপর ভরসা করতে নেই। যে কোনো সময় ফুরিয়ে যেতে পারে। জানি না তোর সাথে আমি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবো কি-না। তাই তোর ছোটো থেকে ছোটো ইচ্ছা বিয়ের আগেই পূরণ করতে চাই।”
“এত কঠিন কথা কিভাবে বলিস তুই?”
“সেটা পরে বলবো। এখন এই গরীবের বাইকে বসে উদঘাটন করুন।”
মাহা হাসলো। তখনই ড্রাইভার আসলো গাড়ি নিয়ে। মাহা তাকে বলল সে গাড়ি দিয়ে আজ কলেজ যাবে না। সাইকেলের পেছনে সিটে বসে ইর্তেজাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে গাল ঠেকালো। ইর্তেজার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-
“এইভাবেই শক্ত করে ধরে রাখিস।”
মাহা শুধু মাথা নাড়াল। ইর্তেজা মুচকি হেসে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে গেল। পুরো রাস্তা দুজন চুপ। কিন্তু তাদের হৃদয় যেন একে অপরের সাথে ভালোবাসার আলাপ করছে। মাহা এক সময় মাথা তুলে বলল-
“তুই বলেছিলি এইবার ঈদে ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনবি বলে টাকা জমাচ্ছিস। কেন এমন করলি ইর্তেজা?”
“আরে আমার জান বললাম না আয়ুর উপর ভরসা করতে নেই। বেঁচে থাকলে সব সম্ভব। এই ভয়ে দ্রুত সাইকেল কিনলাম। কারণ মরে গেলে এই মুহূর্ত কখনো পেতাম না।”
“যদি আমরা বেঁচে থেকেও এক না হতে পারি তখন?”
ইর্তেজা নিশ্চুপ হয়ে গেল। সে প্রতিদিন এই কথা ভাবে৷ ভয় হয় তার। যদি মাহাকে হারিয়ে ফেলে? মাহা বুঝতে পারলো তার এমন প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল-
“দ্রুত আমরা লেইট হচ্ছি।”
ইর্তেজা হেসে সাইকেলের গতি বাড়াল। মাহা ভয়ে ইর্তেজাকে আরো শক্ত করে ধরে বসলো। ইর্তেজা মাহার হাতের দিকে তাকাল। তারপর আবার সামনে দেখলো। ভার্সিটি পৌঁছে সাইকেল থামালো। মাহা সাইকেল থেকে নেমে লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“সাইকেলে উঠেই ভয়ে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে গিয়েছে। থাক বাবা তোর বাইক কিনতে হবে না।”
“আমি তো কিনবোই। তারপর দুজন শুধু ভার্সিটি আসবো না। পুরো বাংলাদেশ ভ্রুমন করবো বাইক দিয়ে।”
মাহা ইর্তেজার গালে হাত রেখে বলল-
“জানিস তোর সাথে কল্পনার দুনিয়াতেও ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। বাস্তবতার কথা ভাবলে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।”
“এভাবে সারাজীবন ভালোবাসবি তো?”
“লিখে রাখ, মাহা ইর্তেজার না হলে কারো হবে না।”
ইর্তেজা মুচকি হাসলো।

বর্তমানে…..
হর্ণের শব্দ শুনে ইর্তেজার হুঁশ ফিরলো। রাস্তায় যানবাহন বেড়েছে। ইর্তেজা খেয়াল করলো তার চোখের কোণায় পানি জমে গিয়েছে। দ্রুত মুছে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। সে কোথাও পড়েছিল,
“Don’t let someone become your everything, because when they’re gone you have nothing” অর্থাৎ,
“কাউকে আপনার সবকিছু হতে দেবেন না, কারণ সে চলে গেলে আপনার কিছুই থাকবে না”

চলবে……

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১১

সাঈদ ইরিনার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবে কি-না ভাবছে সে। ভেতরে না গেলে সত্য জানতে পারবে না৷ আর সত্য না জানার পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না৷ হঠাৎ পেছন থেকে ঝর্ণার কন্ঠ ভেসে আসলো,
“আসসালামু আলাইকুম”
সাঈদ পেছনে ফিরে ঝর্ণাকে দেখে মুখে হাসি ফুটালো। ঝর্ণার হাতে বাজারের ব্যাগ। সাঈদ বলল,
“তুমি বাজারে গিয়েছিলে?”
ঝর্ণা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সাঈদ চিন্তিত হয়ে বলল,
“তার মানে উনি বাসায় একা?”
“কে! আপা?”
“হ্যাঁ”
“আরে আমি মাত্র গেলাম আর আইলাম। চিন্তা কইরেন না। আপনে বাইরে কি করেন? ভিতরে আহেন আমি চা রান্না করি।”
সাঈদ মাথা নাড়াল। তারা দুজন কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল। দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই ইরিনার ঘর থেকে কাচ ভাঙ্গার শব্দ আসলো। সাঈদের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল শব্দ শুনে। দৌড়ে গেল সে সেখানে। ঝর্ণাও সাথে যেতে নিলো কিন্তু তার নাকে পুড়া গন্ধ আসতেই সে রান্নাঘরের দিকে গেল। সাঈদ গিয়ে দেখে ইরিনা মাটিতে পড়ে আছে। পায়ে তার কাচ ভেঙ্গে গেঁথে আছে। সাঈদ দৌড়ে গেল। ইরিনা সাঈদকে দেখে তাকিয়ে রইল। সাঈদ কি করবে বুঝতে পারছে না। পা থেকে ভীষণ রক্ত ঝরছে। সে দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করে ইরিনার পা আলতো করে ধরে কাচ বের করার চেষ্টা করছে। ভয় করছে তার ভীষণ। ইরিনা সাঈদকে চিন্তিত দেখে বলল-
“পা প্যারালাইজড, ব্যথা অনুভব হয় না। টান দিয়ে বের করে ফেলো আমি ব্যথা পাবো না।”
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকাল। বুক কাঁপছে তার। কাচ ধরে চোখ বন্ধ করে টেনে বের করে ফেলল। ইরিনার মনে হলো সে কিছুটা ব্যথা অনুভব করেছে। যেহেতু ট্রিটমেন্ট সাকসেস হচ্ছে তাই এখন তার সুস্থ হওয়ার চান্স খুব বেশি। সাঈদ রুমাল দিয়ে ইরিনার পা চেপে ধরলো। ইরিনা তাকিয়ে আছে সাঈদের দিকে। সাঈদ ইরিনার দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“আপনাকে কে বলেছে খাট থেকে একা নামতে?”
“পুড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাসায় কেও ছিল না। কিছু বুঝতে না পেরে খাট থেকে নামার চেষ্টা করেছি। তখনই হাত লেগে গ্লাসটা পড়েছে সাথে আমিও।”
সাঈদ রাগান্বিত স্বরে ঝর্ণাকে ডাকলো।ঝর্ণা সাঈদের ডাক শুনে দৌড়ে আসলো।সাঈদ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে উঁচু স্বরে বলল,
“তুমি উনাকে একা রেখে কেন গিয়েছিলে?”
সাঈদের বকা শুনে ঝর্ণা ভয় পেয়ে গেল। ইরিনা সাঈদের উদ্দেশ্যে বলল,
“ওকে আমি যেতে বলেছিলাম। তুমি শান্ত হও। ওর সাথে এমন ব্যবহার করো না। ও খুব ছোটো।”
সাঈদ ইরিনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছোটো বলে কি মাথায় তুলে রাখবো? ওকে যে কাজের জন্য রাখা হয়েছে সেটা করতে পারে না?”
ঝর্ণা এক সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সাঈদ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এখন কান্না করে মামলা জিততে হবে না। যাও এখান থেকে তুমি।”
ঝর্ণা ফুপাতে ফুপাতে চলে গেল। সাঈদ ইরিনাকে ধরে তুলার চেষ্টা করতেই ইরিনা বাঁধা দিয়ে বলল,
“লাগবে না, ইর্তেজা এসে পরবে এখন। যাও তুমি এখন।”
“আপনাকে এভাবে একা রেখে চলে যাব?”
“কোথায় আমি একা? ঝর্ণা আছে আমার সাথে। আর তুমি ওর সাথে এমন ব্যবহার করে ঠিক করো নি। তুমি জানো না ও আমার কত খেয়াল রাখে।”
“আচ্ছা আমি মাফ চেয়ে নিবো। আসুন খাটে তুলে দেই আপনাকে।”
“না না লাগবে না”
সাঈদ ইরিনার কথা শুনলো না। হঠাৎ করে কোলে তুলে নিলো। ইরিনা অবাক হয়ে বলল,
“কি করছো নামাও আমাকে।”
সাঈদ ইরিনাকে খাটে বসিয়ে বলল,
“আপনি কি ভেবেছেন আপনাকে তুলে নিয়ে যাবো?”
“তোমার সাহস আছে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার?”
সাঈদ ইরিনার দিকে ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে বলল,
“দেখতে চান আমার সাহস?”
ইরিনা দু’বার চোখের পলক ফেলে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। সাঈদ মুচকি হেসে ইরিনার পাশে বসলো। পা থেকে রুমাল খুলে দেখে রক্ত ঝরা কমে নি। ইরিনাকে জিজ্ঞেস করে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে ঔষধের বক্স থেকে মলম বের করে আবার এসে ইরিনার পাশে বসলো। ইরিনার পা নিজের কোলে নিয়ে পরম যত্নে মলম লাগিয়ে দিতে লাগলো। ইরিনা চাচ্ছে বাঁধা দিতে কিন্তু মন বলছে এই মুহূর্তটাকে মন ভরে উপভোগ করতে।
.
.
শ্রাবণ খাটে হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে৷ সাগরিকা চা বানিয়ে নিয়ে আসলো৷ শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আগে গোসল করে বের হয়েছে সাগরিকা। চুল এখনো ভেজা। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ সাগরিকার হাত থেকে কাপ নিলো। সাগরিকা ঘুরে চলে যেতে নিতেই শ্রাবণ তার হাত ধরে ফেলল। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকাল। শ্রাবণের চাহনি দেখে থমকে গেল সে। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। শ্রাবণ সাগরিকাকে তার বরাবর বসালো। তার বেহায়া চোখ সাগরিকাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। সাগরিকা নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
“রান্না চুলায়, পরে কথা বলি।”
সাগরিকা উঠতে চাইল। শ্রাবণ আবার বাঁধা দিয়ে সাগরিকার কাছে গিয়ে বসলো। সাগরিকার হাত মুঠোবন্দি করে তাকিয়ে আছে। আজও সাগরিকার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। শ্রাবণ আলতো করে মুছে দিয়ে বলল,
“রান্না করতে হবে না। চলো আজ বাহিরে যাই৷ একেবারে ডিনার করে বাসায় ফিরবো।”
“আজ না। আগামীকাল যাবো। রান্না অলরেডি হয়ে গিয়েছে।”
“সেগুলো সার্ভেন্টদের প্যাক করে দিয়ে দাও তারা বাসায় নিয়ে যাবে।”
“আমাদের দুজনের জন্য শুধু রান্না করেছি এতজনকে কিভাবে দিই?”
“দিন দিন আনরোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো।”
বলেই শ্রাবণ সাগরিকার হাত ছেড়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। যেন অভিমান করেছে। সাগরিকা তা দেখে মনে মনে বলল, “ন্যাকামোর লিমিট থাকে শ্রাবণ।”
কিন্তু হাসিমুখে বলল, “তো এখন কি করতে পারি?”
শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “চলো বাহিরে যাব।”
“ঠিক আছে তুমি রেডি হয়ে নাও। আমি রান্নাঘর থেকে আসছি।”
শ্রাবণ হেসে সম্মতি জানালো। সাগরিকা যেতে নিলো আবার বাঁধা দিলো শ্রাবণ। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে মায়া মায়া চেহারা বানিয়ে তাকিয়ে বলল,
“আবার কি হলো তোমার? তুমি আমাকে এত জ্বালাও কেন বলো তো।”
শ্রাবণ সাগরিকার চুলের মাঝে মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে কাছে গেল। সাগরিকার কপালে ও গালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলো। তারপর ছেড়ে বলল,
“নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। এখন যাও।”
সাগরিকার নিশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। ছাড় পেতেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। শ্রাবণ হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলো।

সাগরিকা রান্নাঘরে এসে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। ইদানীং তার কি হয়েছে নিজেও জানে না। শ্রাবণের কাছে গেলে বিরক্ত লাগে। আবার দূরে গেলে অস্থিরতা হয়। সাগরিকা চুলা বন্ধ করে দিলো। একজন সাার্ভেন্ট ছিলো রান্নাঘরে। তাকে বলল সবাইকে বলে দিতে আজকের জন্য ছুটি। সে সাগরিকার কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো। সাগরিকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ভেসে উঠল।

সাগরিকার অতীত…..
এলার্ম বাজছে, সকাল সকাল এই শব্দ শুনে সাগরিকার ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু আজ তার ঘুম ভাঙ্গছে না। রাত জেগে ফোনালাপ করেছে। আর এখন ঘুমের কারণে কান দিয়ে শব্দ যাচ্ছে না। এলার্মের শব্দ শুনে সূর্য তার ঘর থেকে এসে এলার্ম বন্ধ করলো৷ সাগরিকাকে কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু সে উঠছে না। সূর্য কোমড়ে হাত দিয়ে উঁচু স্বরে বলল,
“আরে আজমাইন ভাইয়া আপনি? আপু তো ঘুম।”
আজমাইন নামটা যেন সাগরিকার কানের ভেতর গিয়ে ব্রেইনের সাথে ধাক্কা খেল। সাগরিকা ধরফরিয়ে উঠে বসে বলল,
“তুমি কেন আসলে?”
সূর্য মুখ টিপে হাসলো। সাগরিকা বোকার মতো এদিক সেদিক দেখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোথায় আজমাইন?”
সূর্যের জবাব দিলো না। শব্দ করে হাসতে হাসতে চলে গেল। সূর্য তাকে উঠানোর জন্য এমনটা করেছে সাগরিকা বুঝতে পারলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ নিমিষেই বেরিয়ে আসতে নিলো। কলেজ যেতে হবে। ক্লাস হয়তো শুরু। সাগরিকা দ্রুত খাট থেকে নেমে বাথরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে কলেজ ইউনিফর্ম পড়ে বাহিরে গেল। সূর্য নাশতা নিয়ে এসেছে। সাগরিকাকে বাসা থেকে বের হতে দেখে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো? নাশতা খেয়ে যাও।”
“সময় নেই যেতে হবে। টাকা আছে আমার কাছে কেন্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেবো। তুই আব্বুর খেয়াল রাখিস আল্লাহ হাফেজ।”
সাগরিকা দৌড়ে চলে গেল। আজ ভাগ্য তার খারাপ রিকশা পাচ্ছে না। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা দূর যেতেই খেয়াল করলো সামনে থেকে আজমাইন আসছে বাইক চালিয়ে। সাগরিকার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আজমাইন বাইক থামিয়ে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“আমি কলেজের বাহিরে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আর তুমি রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছো?”
সাগরিকা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
“আমার দোষ নেই। ঘুম দেরিতে ভেঙ্গেছে। প্লিজ আমাকে কলেজ দিয়ে আসো।”
“আর যেতে হবে না ক্লাস শুরু হয়েছে অনেক আগে। এখন গেলে লম্বা লেকচার শুনতে হবে। আর আমি চাই না তোমাকে কেও বকা দেক।”
সাগরিকা মুচকি হেসে এগিয়ে গেল আজমাইনের দিকে। আজমাইন সাগরিকার হাত ধরে কাছে নিয়ে এসে কপাল ছোঁয়া চুল সরিয়ে বলল,
“তোমার কন্ঠ থেকে এখনো ঘুম ঘুম ভাব যায় নি৷ পাগল বানাতে চাচ্ছো আমায়?”
সাগরিকা দ্রুত হাত সরিয়ে বলল,
“তুমি খুব আজব আজব কথা বলো আমার এসব পছন্দ না। আর আমার পারমিশন না দিয়ে হাত ধরেছো কেন?”
আজমাইন হাতজোড় করে বলল,
“মাফ চাই ন্যাকার রানী মাফ চাই”
সাগরিকা ভেংচি কাটলো। আজমাইন হেসে তার সানগ্লাস সাগরিকার চোখে পড়িয়ে বলল,
“সূর্যকে কল দিয়েছিলাম সে বলল তুমি কিছু না খেয়েই বেড়িয়ে পরেছো। চলো আমরা নাশতা করে আসি।”
সাগরিকা মাথা নাড়িয়ে বাইকে উঠে বসলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আজমাইনকে।

দুজন একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলো। সাগরিকার অভ্যেস চেয়ারে বসে পা নাড়ানো। আজমাইন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“পা ভেঙ্গে হাতে দিয়ে দেবো। বলেছি না পা না নাড়াতে এভাবে!”
“তো কিভাবে নাড়াবো শিখিয়ে দাও।”
আজমাইন সাগরিকার বিনুনি টেনে ধরে বলল,
“এত দুষ্টুমি কোথা থেকে শিখো তুমি হ্যাঁ?”
সাগরিকা আজমাইনের হাতে ইচ্ছে মতো থাপ্পড় মারতে লাগলো। কিন্তু এতে কাজ হলো না। অবশেষে তার হাত কামড় দিয়ে ধরলো। আজমাইন হাসতে হাসতে বলল,
“এই খরগোশের মতো দাঁত আমার ক্ষতি করতে পারবে না।”
সাগরিকা আজমাইনের দিকে মায়া মায়া চেহারা বানিয়ে তাকিয়ে বলল,
“ব্যথা পাচ্ছি”
আজমাইন সাথে সাথে ছেড়ে দিলো। সাগরিকা খিলখিল করে বলল,
“উল্লু বানিয়েছি তোমাকে। একটুও ব্যথা পাইনি।”
আজমাইন হাসলো। সাগরিকার হাতের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরলো। সাগরিকা তাকাল আজমাইনের দিকে। আবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকেই তাদের দেখছে। সাগরিকা লজ্জায় পরলো। মাথা নিচু করে ফেলল সাথে সাথে। আজমাইন মুচকি হেসে ওয়েটারকে ডাকলো। খাবার অর্ডার দিয়ে সাগরিকাকে বলল,
“কিছুদিন আগে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম মনে আছে?”
সাগরিকা মাথা তুলে আজমাইনের দিকে তাকাল। আজমাইন মুচকি হেসে বলল,
“চাকরি পেয়ে গিয়েছি। এখন তোমার বাবা আর না করতে পারবে না। উনাকে বলে দিও মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন পাবো এই চাকরিতে।”
“বলো কি? বাবাকে বললে আজই বিয়ে দিয়ে দেবে আমাদের।”
“কি আজব তাই না? মনে হচ্ছে তুমি আমাকে না আমার চাকরিকে বিয়ে করবে।”
“তোমার বেকারত্ব নিয়ে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু আব্বু কেমন তা তো জানোই।”
আজমাইন এই বিষয়ে আর কিছু বলল না। সাগরিকার মন খারাপ হয়ে যাবে নাহলে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“আচ্ছা শুনো, আগামী সপ্তাহ থেকে জয়েন করবো। আমি চাই তুমি তোমার এইচএসসির পরীক্ষার জন্য পড়ায় মনোযোগ দাও এবার।”
“পরীক্ষার এখনো ৭ মাস বাকি।”
“এখন থেকেই প্রস্তুতি নও। এ-প্লাস না পেলে তোমাকে আমি বিয়ে করবো না।”
“হাউ রুড”
সাগরিকা মুখ লটকিয়ে ফেলল। আজমাইন হেসে আশে পাশে তাকাল। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আজমাইন সাগরিকাকে কাছে টেনে বুকে ভরে নিলো। সাগরিকা আজমাইনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
“তুমি এত বেশরম কেন? পাবলিক প্লেসে এসব কি?”
“আমার হবু বউকে জড়িয়ে ধরেছি কার সাহস আছে কিছু বলার?”
“আর আমি যদি অস্বীকার করি যে তোমাকে চিনি না তখন?”
“বাপরে এত ডেঞ্জারাস কেন তুমি?”
“আমি এমনই”
আজমাইন মুচকি হেসে বলল,
“সবসময় এমনই থেকো। কখনো নিজেকে পরিবর্তন করো না। আর হ্যাঁ ছেড়ে যেও না কখনো আমাকে।”
“কোথায় যাবো বলো? যেখানে তাকাই তুমি ছাড়া আর কাওকে দেখতে পাই না।”
আজমাইন মুচকি হেসে সাগরিকার হাতে চুমু দিলো। সাগরিকা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।

বর্তমান…..
গালে ছোঁয়া পেয়ে সাগরিকার হুঁশ ফিরলো৷ পাশে তাকিয়ে দেখে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকার অনুভব হলো তার গালে পানি। দ্রুত মুছে বলল,
“তুমি রেডি হও নি এখনো?”
“আমি রেডি, কাঁদছো কেন?”
“কোথায় না তো।”
“বোকা পেয়েছো আমাকে? বলো কি হয়েছে?”
“কিছু হয়নি। তুমি যাও আমি খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে আসছি।”
শ্রাবণ সাগরিকার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরালো। সাগরিকার কন্ঠ কাঁপছে। শ্রাবণ বলল,
“আসার সময় সূর্যকে সাথে করে নিয়ে আসবো আমাদের সাথে।”
সাগরিকা চোখ তুলে শ্রাবণের দিকে তাকাল। গলা ধরে আসছে তার। শ্রাবণ মুচকি হেসে সাগরিকার গালে হাত রাখলো। সাগরিকার বুক ছিঁড়ে কান্না আসছে। মুহূর্তেই জাপ্টে ধরলো শ্রাবণকে। শ্রাবণের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শ্রাবণ অবাক হলো। সে তার কান্নার কারণ বুঝতে পারলো না। ভাবলো এখন জিজ্ঞেস করবে না। শক্ত করে বুকের সাথে ধরে রাখলো সাগরিকাকে।

রাতেরবেলা……
ইর্তেজা ছাদে এসেছে। আজ আকাশে তারার মেলা দেখা যাচ্ছে। চাঁদ একদম গোল আর আলোয় ভরপুর দেখাচ্ছে। ইর্তেজা রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। শত তারার মাঝে চাঁদ যেমন একা ঠিক তেমনই শত ভীরের মাঝে ইর্তেজা একা। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওয়ালপেপারের দিকে তাকাল। মাহার এই অভিমানী চেহারাটা বড্ড মনে পড়ছে তার। বড্ড ইচ্ছে করছে আর একটিবার মাহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে। ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। সে জানে এটা কখনো সম্ভব না। হঠাৎ মেসেজ আসলো মোবাইলে। শ্রাবণ মেসেজ দিয়েছে। ইর্তেজা মেসেজটা পড়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। শ্রাবণ একটা ছেলে হায়ার করেছে। সে ইর্তেজার জমিন মালিকের স্ত্রীকে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করবে। তার ডিটেইলস পাঠিয়েছে শ্রাবণ। আগামীকাল গিয়ে ইর্তেজা তার সাথে দেখা করবে৷ ইর্তেজা মোবাইল পকেটে রেখে আবার আকাশের দিকে তাকাল। সময় ডাকে এই পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। সে কখনো ভাবে নি কাওকে কিডন্যাপ করার মতো ঝঘন্য কাজ করবে।

পরেরদিন…..
ইর্তেজা ফ্যাক্টরির সামনে দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটার অপেক্ষা করছে। প্রায় আধঘন্টা হয়ে গিয়েছে কিন্তু ছেলেটার আসার নাম গন্ধ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে আসলো। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স খুব কম। সে ইর্তেজাকে দেখে বলল,
“মাফ করবেন দেরি হয়ে গেল।”
“তোমাকেই শ্রাবণ আহমেদ হায়ার করেছে?”
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে ইর্তেজার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল,
“সেই মহিলার ছবি। আপনি একবার চেক করে নেন। শুনলাম আগামীকাল সে পার্লারে যাবে পরিবারে কারো বিয়ে তাই। সে পার্লারে যাওয়ার সময়ই তাকে তুলে নিয়ে শ্রাবণ স্যারের কাছে যাবো।”
ইর্তেজা খামটা হাতে নিয়ে বলল,
“তোমার নাম কী?”
“বাদশাহ”
ইর্তেজার তার নাম পছন্দ হলো। বাদশাহ’র কাঁধে হাত রেখে বলল,
“খুব ইন্টারেস্টিং তোমার নামটা। আচ্ছা বাদশাহ কাল দেখা হবে তাহলে। তোমাদের ধন্যবাদ।”
“ভালো নাম পারভেজ। আম্মা ডাকে বাদশাহ। তাই সবাইকে বাদশাহ নামই পরিচয় দিই। আপনার নাম্বার আছে আমার কাছে। আমি কাল কল করবো আপনাকে।”
ইর্তেজা মাথা নাড়াল। বাদশাহ চলে গেল। ইর্তেজা খাম খুলে ছবি বের করলো।ছবিটা দেখে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে সে মানুষটাকে চেনে। কিন্তু মনে করতে পারছে না।

চলবে……