আর একটিবার পর্ব-২+৩

0
369

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আড়চোখে ইরিনার দিকে তাকাল সাঈদ। ইরিনা আপেল কাটছে বসে। আপেল কাটতে কাটতে ইরিনা সাঈদের দিকে তাকাতেই সাঈদ চোখ সরিয়ে ফেলল।
“তোমার তো বিয়ে ঠিক ছিল অস্ট্রেলিয়ায় এক মেয়ের সাথে। ইর্তেজা বলল তুমি বাংলাদেশে এসে পরেছো সবসময়ের জন্য।”
“জি, মেয়েটা অলরেডি অন্য কারোর সাথে রিলেশনে ছিল। আর এমনিতেও আমার তাকে পছন্দ ছিল না। ভাবলাম নিজ দেশের মেয়েকেই বিয়ে করবো।”
“তোমার এই ডিসিশনটাই ভালো৷”
ইরিনা মুচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপেলগুলো ধুয়ে নিয়ে আসো। আর ইর্তেজাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো ও কোথায়।”
“জি আপা”
ঝর্ণা চলে গেল। সাঈদ চায়ের কাপ ট্রের উপর রেখে ইরিনার দিকে তাকাল। ইরিনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ একবার কেশে বলল-
“কি ভাবছেন?”
ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল-
“কিছু না, সময় খুব তারাতাড়ি চলে যায় সেটাই দেখলাম। আচ্ছা তোমার কাজ কর্ম কেমন যাচ্ছে?”
“এখন কাজ বন্ধ৷ অস্ট্রেলিয়া আর ফিরে যাব না। ভাবছি এইখানে নিজের একটা কাজ শুরু করবো। ইর্তেজা একবার বলেছিল সে না-কি পাঞ্জাবির ব্যবসা করতে চায়৷ ভাবলাম ওর সাথে কাজ করবো।”
“হ্যাঁ, ও তো বলেছিল। কিন্তু এখন না-কি অন্য একটা কাজ পেয়েছে। কিন্তু কী কাজ পেয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করায় বলেনি।”
“আজ হয়তো ওর সাথে দেখা হবে না। আমি নাহয় আর একদিন আসবো নি।”
“আর কিছুক্ষণ বসো, দুপুরের খাবার খেয়ে যেও।”
“না না, মা অপেক্ষা করছে আমার।”
তখনই ঝর্ণা আসলো আপেল নিয়ে। ইরিনা বলল-
“আপেল খেয়ে যাও।”
“আমি আসার পর থেকে খেয়েই যাচ্ছি। আর একটু খেলে ফেটে যাব।”
সাঈদের কথা শুনে ইরিনা খিলখিল করে হেসে উঠলো৷ সাঈদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইরিনার দিকে। ইরিনা হাসতে হাসতেই বলল- “তুমি আর পরিবর্তন হলে না সাঈদ।”
সাঈদ হেসে মাথা নিচু করলো।
.
.
পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজলো। প্রত্যেক ক্লাস থেকে পরীক্ষার্থীরা বের হচ্ছে। ইর্তেজা গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সবার সাথে সাগরিকাও বের হলো তার বান্ধবীদের সাথে। ইর্তেজা তাকে দেখে গাড়ির দরজা খুলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সাগরিকা সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। ইর্তেজা ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্ট বাঁধছিল তখনই সাগরিকা বলল-
“পাশে একটা কফিশপ আছে না? সেখানে চলো।”
ইর্তেজা আয়না দিকে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। ইর্তেজা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কফিশপ গেল। সাগরিকা গাড়ি থেকে বের হয়ে হনহন করে ভেতরে গেল। ইর্তেজা তার পেছনে আসতেই সাগরিকা ঘুরে তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। ইর্তেজা শান্ত কন্ঠে বলল- “আমি আমার ডিউটি পালন করছি।”
“বাহিরে যাও”
“না”
“আমি চিৎকার করে মানুষজন ডাকালে তোমার কী অবস্থা করবে তারা তুমি জানো?”
“হুম জানি”
“তো বাহিরে যাও আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি।”
বলেই সাগরিকা এগিয়ে গেল। ইর্তেজাও গেল তার পেছনে। ইর্তেজা তার পেছনে আসছে বুঝতে পেরে সাগরিকা দাঁড়াল। তার মনে হচ্ছে কেও তার মাথায় গরম পানি ঢেলে দিয়েছে। রাগে শরীর জ্বলছে তার। ঘুরে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজা এখনো শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাগরিকা নিচু কন্ঠে বলল-
“আমি সিন ক্রিয়েট করতে চাই না। প্লিজ যাও বাহিরে।”
“কার সাথে দেখা করতে আসছেন আপনি?”
“নন অফ ইওর বিজনেস। গেট আউট রাইট নাও।”
ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা হাত মুঠো শক্ত করে রেখেছে রাগে। ইর্তেজা তার পাঞ্জাবি পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল-
“ম্যাম, আমি আপনার রক্ষক। আপনার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। খবর পেয়েছি আপনি আমার বসের সাথে প্রতারণা করছেন। আমি তার টাকায় নিজের ঘর চালাচ্ছি৷ আমি উনার কথার বিরুদ্ধে যেতে পারবো না।”
বলেই ইর্তেজা চোখের ইশারায় সাগরিকাকে নিচে তাকাতে বলল। সাগরিকা চোখ ঘুরিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে ইর্তেজা তার পকেট থেকে রিভলবার বের করে সাগরিকাকে দেখিয়ে আবার রেখে দিলো। সাগরিকা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“আমি যার সাথে সংসার করছি সে তোমার থেকেও ভয়ংকর মানুষ। তাকেই আমি ভয় পাই না তোমাকে কেন পাব? হুমকি অন্য কাওকে গিয়ে দাও আমাকে না।”
“আমি আপনাকে মারার হুমকি দিচ্ছি না। যার সাথে দেখা করতে এসেছেন তার কলিজায় ভরে দেবো সব গুলি।”
সাগরিকা চমকে উঠলো। ইর্তেজার কথা শুনে তার রাগ ভয়ে পরিনত হয়েছে। ইর্তেজা মুচকি হেসে বলল-
“ম্যাম, বাসায় যাবেন না?”
সাগরিকা ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। ইর্তেজা সরে দাঁড়িয়ে সাগরিকাকে হাতের ইশারায় বলল যেতে। সাগরিকা ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর সেই মানুষটাকে দেখে ঘুরে দ্রুত হাঁটা ধরলো। ইর্তেজাও চলল তার পেছনে।
.
.
“ইর্তেজার তরফ থেকে আমি মাফ চাচ্ছি সাঈদ। তাকে এতবার কল করেও পেলাম না।”
“সমস্যা নেই, নতুন কাজ শুরু করেছে ব্যস্ত থাকা স্বাভাবিক। আমি আর একদিন আসবো নি। আসি তাহলে আল্লাহ হাফেজ।”
“এরপর আসলে দুপুরে না খাইয়ে যেতে দেবো না বলে দিলাম।”
সাঈদ ইরিনার কথা শুনে জবাবে মুচকি হেসে চলে গেল। ইরিনা সাঈদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। ঝর্ণা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইরিনার ঘরে আসলো। ট্রে-তে কাঁচের গ্লাস তুলতে তুলতে বলল-
“আপা, ইনি কে? আগে তো কহনো দেহিনি।”
“কয়বার বলবো? সাঈদ আর ইর্তেজা ছোটোবেলার বন্ধু৷ সে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল তাই কখনো দেখোনি তুমি।”
“একটা কথা কই?”
“বলো”
“ছ্যারার নজর ভালা না। কেমনে জানি তাকায় আপনের দিকে।”
ইরিনা চমকে উঠল। থতমত খেয়ে বলল-
“আস্তাগফিরুল্লাহ ঝর্ণা, পাগল হয়ে গেলে তুমি? যা মুখে আসছে বলছো। তুমি জানো ও আমার থেকে ছোটো। সে সবসময় আমাকে বড়ো বোনের মতো সম্মান করে।”
“মনে লয়েন না আপা। আমার ক্যা জানি ছ্যারার নজর ভালা লাগে নি।”
“তুমি তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও। দেখবে সবার নজর ভালো লাগতে শুরু করবে।”
ঝর্ণা আর কিছু বলল না। ট্রে নিয়ে হাঁটা ধরলো। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
“আপা, মানলাম ছ্যারা আপনেরে বড়ো বোইনের মতো দেহে৷ কিন্তু একবারো তো আপনেরে আপু বইলা ডাকলো না। ব্যাপারটা আজব।”
ইরিনা ধমকের স্বরে বলল-
“অন্যের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজের সংসার সামলাও। যাও এখান থেকে এখন। কাজ করো গিয়ে।”
ঝর্ণা মাথা নিচু করে চলে গেল। ইরিনা রাগে ফুঁসছে। কিন্তু ঝর্ণার কথাটা গভীরভাবে ভাবতেই সে এলোমেলো হয়ে গেল।
.
.
সাগরিকা নিজের ঘরে এসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে ছুঁড়ে মারলো খাটের উপর। রাগে সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে৷ খাটে বসে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে শ্রাবণকে কল করলো৷ শ্রাবণ কল রিসিভ করতেই সাগরিকা গর্জে উঠলো-
“আপনি কী চান আমি মরে যাই?”
“নাউজুবিল্লাহ্ সাগরিকা, কী বলছো তুমি এসব?”
“আপনি ওই বডিগার্ডকে বের করবেন না-কি আমি আত্মহত্যা করবো, কোনটা?”
“এই সামান্য বিষয়ে কেও আত্মহত্যা করে?”
“এটা সামান্য বিষয় না। সে লোকটা আমার পার্সোনাল কাজে ইন্টারফের করছে।”
“কারণ আমি তাকে বলেছি।”
“শ্রাবণ, আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনি প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করুন।”
শ্রাবণ সাগরিকার কথার জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে কল কেটে দিলো। সাগরিকা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মোবাইল রেখে কপালে হাত দিয়ে বসে রইলো। কলিজা ছিঁড়ে কান্না আসছে তার। চোখ বন্ধ করতেই চিরচেনা এক চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মানুষটা বলছে- “চলে যাচ্ছো যাও। তোমাকে থামানোর ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু মনে রেখো, যেদিন ক্ষমতায় আসবো তোমাকে ওর চোখের সামনে থেকে নিয়ে আসবো সে কিছু করতে পারবে না।”

রাতেরবেলা…..
ইর্তেজা খাবার গরম করছে বোনের জন্য৷ ইরিনা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে রান্নাঘরের দরজার সামনে আসলো। বোন এসেছে টের পেয়ে ইর্তেজা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-
“তুমি আসলে কেন? ঘরে যাও আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
“আগামীকাল গিয়ে সাঈদের সাথে দেখা করে আসিস। ছেলেটা তোর সাথে কাজ শুরু করতে চেয়েছে।”
“আপু আমি অলরেডি একটা কাজ করছি। কিভাবে আর একটা কাজ করি বলো।”
“কী কাজ ইর্তেজা?”
ইর্তেজা ঘাড় ঘুরিয়ে চুলা বন্ধ করে বলল-
“আপু তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখো। আমি কোনো অবৈধ কাজ করছি না।”
“তাহলে নিজের কাজের সম্পর্কে বলিস না কেন তুই?”
“সময় আসলে তারপর বলবো। এখন ঘরে যাও আমি আসছি।”
ইরিনা আর কথা বাড়ালো না। সে চলে গেল নিজের ঘরে। ইর্তেজা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্লেটে খাবার বেড়ে ঘরে গেল। ইরিনা ড্রয়ার থেকে ফটো এলবাম বের করছে। ইর্তেজা মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে খাটের উপর প্লেট রাখলো। ইরিনা হুইলচেয়ার নিয়ে খাটের দিকে এগিয়ে আসলো। সে এলবাম বের করে আগের ছবি গুলো দেখতে লাগলো। ইর্তেজা খাটে বসে ভাত মাখিয়ে বোনের মুখে তুলে দিলো। সারাদিনে একবার হলেও ভাইয়ের হাতে না খেলে ইরিনার ঘুম আসে না। চুপচাপ ভাইয়ের হাতে খেয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ নিরবতা থাকার পর ইর্তেজা বলল-
“আপু, তুমি কিছুদিন পর পর এই একই এলবাম বার বার দেখো। কেন বলো তো?”
ইরিনা ছবির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল- “কারণ ছবিগুলো দেখলে মনে হয় আব্বু আম্মু আমার সাথেই আছে।”
“উনারা কখনো ফিরবে না এটা আমাদের মেনে নিতেই হবে।”
“আমি অস্বীকার করছি না। আমাকে কাঁদতে দেখিস উনাদের মনে করে?”
“কী জানি? আমি তো সারাদিন বাসায় থাকি না। কাঁদলেও দেখবো না।”
“ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করিস।”
ইর্তেজা হাসলো। ইরিনাও হেসে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইরিনা বলল- “ভাই, একটা কথা বলি?”
“বলো”
“বিয়ে করে নে, একা থাকতে আমার ভালো লাগে না।”
ইর্তেজার মুখের হাসি উড়ে গেল। চোখ ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল- “তুমি চাও তোমার আগে আমি বিয়ে করি?”
“হুম, এতে সমস্যা কোথায়?”
“না, আগে তোমার বিয়ে তারপর আমার বিয়ে।”
“আমাকে কে বিয়ে করবে শুনি?”
ইর্তেজা বোনের দিকে ঝুঁকে মুচকি হেসে বলল- “আমার রাজকন্যার জন্য রাজপুত্র নিয়ে আসবো আমি।”
“প্যারালাইজড রাজকন্যা”
ইরিনা বলেই হাসা শুরু করলো। ইর্তেজা কিছু বলল না। সে জানে তার বোনও মনে কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে যা তার সামনে প্রকাশ করে না।
.
.
গালে হাত দিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে সাঈদ। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভাসছে ইর্তেজা, ইরিনা ও তার ছবি। ছবিটা সাঈদের বড়ো ভাইয়ের বিয়েতে তুলেছিল তারা৷ তখন ইরিনা একদম সুস্থ ছিলো। আর তার বাবা মা-ও জীবিত ছিলেন। সাঈদ চিত হয়ে শুয়ে ল্যাপটপ পেটের উপর রাখলো। আগের দিনগুলো ফিরে পেলে কতই না ভালো হতো। ইর্তেজার বাবা মা খুব ভালো ছিলেন। সাঈদ ইরিনার ছবির উপর হাত বুলালো। ভাবছে সেদিন যদি এক্সিডেন্টে ইরিনার কিছু হয়ে যেত? সাঈদ কখনো এমনটা মেনে নিতে পারবে না। বড্ড ভালোবাসে সে ইরিনাকে। ছোটোবেলায় সে যতবার ইরিনাকে দেখতো ভীষণ লজ্জা পেত। ধীরে ধীরে বড়ো হতে হতে সে ভাবে ইরিনার প্রতি তার শুধুই মোহ। কিন্তু না সময়ের সাথে সাথে তার অনুভূতিও পরিবর্তন হয়েছে ইরিনার প্রতি। কিন্তু তার বলতে ভয় করে। প্রথমত ইরিনা কখনো মানবে না আর দ্বিতীয় ইর্তেজা তার সাথে বন্ধুত্ব ভেঙে ফেলবে। তখন তো ইরিনাকে চোখের দেখাও সে দেখতে পাবে না। সাঈদ উঠে বসলো। ভালোবাসা কী বয়স দেখে হয়? হ্যাঁ সে ইরিনার থেকে ৩ বছর ছোটো। তাই বলে কী মেয়েটার সাথে সারাজীবন কাটানো যাবে না? সাঈদ লম্বা নিশ্বাস ফেলে খাট থেকে নামলো। মা তাকে ডেকেছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরে গেল। মা বাবা দুজনই টিভি দেখছে।
“মা ডেকেছিলে আমাকে?”
“তোর বাবা ডেকেছে।”
সাঈদ বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। বাবা যা বলে সে মাথা পেতে মেনে নেয়। বাবা সাঈদের দিকে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে বলল-
“তুমি বাংলাদেশে আসার আগে বলেছিলে ব্যবসা শুরু করবে। ১ মাস হয়ে আসছে। কোনো কাজ করার ইচ্ছে আছে না-কি নেই?”
সাঈদ মাথা নিচু রেখেই বলল-
“জি বাবা আছে, আমি ভাবছি পাঞ্জাবির ব্যবসা শুরু করবো। ইর্তেজার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম কিন্তু তার সাথে দেখা হয়নি।”
“১ সপ্তাহ সময় দিলাম৷ যা করার দ্রুত করো।”
“জি বাবা”
“যাও গিয়ে ঘুমাও।”
সাঈদ মাথা নিচু করেই নিজের ঘরে এসে পরলো। কাজ তো তার করতেই হবে৷ ইরিনাকে বিয়ে করতে হলে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে সর্বপ্রথম। মাকে কোনো মতো মানাতে পারলেও বাবাকে মানাতে তার ভীষণ কষ্ট করতে হবে। সাঈদ ল্যাপটপের দিকে তাকাল। ইরিনার ছবি ভাসছে৷ সাঈদ মুচকি হাসলো।
.
.
পরেরদিন…..
সাগরিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আছড়াচ্ছে। গতকালের কথা ভাবলেই তার রাগ হয়। শ্রাবণ বাথরুম থেকে বের হয়ে সাগরিকার দিকে এগিয়ে গেল। সাগরিকা আয়নায় এক নজর শ্রাবণকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। শ্রাবণ মুচকি হেসে সাগরিকাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। সাগরিকার রাগ হলো কিন্তু প্রকাশ করলো না।
“মন চাচ্ছে তোমাকে নিয়ে ঘুরে আসি।”
“আমার এক্সাম আছে এখন সম্ভব না।”
সাগরিকা নিজেকে ছাড়িয়ে খাটে দিকে এগিয়ে গেল। ব্যাগ গুছিয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। শ্রাবণ সাগরিকার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল-
“এক্সাম শেষ হলে আমরা কোথাও ঘুরতে যাব। কোথায় যেতে চাও ভেবে আমাকে জানিও।”
“আমার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই।”
শ্রাবণ সাগরিকার হাত ধরে কাছে টেনে নিলো। সাগরিকা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। শ্রাবণ মন খারাপ করে বলল-

“আমি কী অনেক খারাপ?”
“আমি কিছু বলেছি তোমাকে?”
“আমাকে ভালোবাসা যায় না?”
“ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আগে ভালো মানুষ হতে হয় জানো না?”
“আমি যা করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য করেছি।”
“পেয়ে তো গিয়েছো। আর কী চাও আমার থেকে? আমার জীবন, দেহ সবই তো তোমার।”
“তুমি আমাকে বাধ্য করেছো খারাপ হতে। কী এমন হতো জোর করার আগেই বিয়ের জন্য রাজি হলে?”
সাগরিকা শ্রাবণকে দূরে ঠেলে দিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল-
“তোমার কী এমন ক্ষতি হতো আমাকে মুক্ত করে দিলে? তোমার কারণে আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। কিছু নেই এখন আমার কাছে কিছু না।”
“আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। আর তুমিও আমার পাশে থাকবে চিরকাল।”
সাগরিকা শ্রাবণের দিকে কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। শ্রাবণ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে আছে। টেবিলের উপর থেকে মোবাইল নিয়ে ইর্তেজাকে কল করলো। ইর্তেজা কল রিসিভ করতেই শ্রাবণ বলল- “তাকে নিয়ে ভার্সিটি যাও৷ আর হ্যাঁ আজ সে যার সাথে দেখা করতে চায় যেতে দিও। মানুষটা কে আমার জানতেই হবে। তার ডিটেইলস আমি চাই।”
কল কেটে শ্রাবণ খাটে বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলে বাঁকা হাসি দিলো।

চলবে……

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩

রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। সাঈদ বাইকের উপর বসে আছে। রোদের কারণে সে ঘেমে একাকার। অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় জ্যাম। তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ইরিনা হয় তো অপেক্ষা করছে তার৷ সে সকালেই কল দিয়ে বলেছে সে আসছে বাসায় ইর্তেজার সাথে দেখা করতে। কিন্তু ইরিনা বলেছে ইর্তেজা সকাল সকালই বেরিয়ে গিয়েছে প্রতিদিনের মতো। সাঈদ বলেছে সে তবুও আসছে ইর্তেজাকে কল দিয়ে বলতে৷ বসে থেকে জ্যামের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে সে। হঠাৎ সাঈদের দিকে একটা কাগজ উড়ে আসলো। সাঈদের গায়ে লেগে কাগজটা মাটিতে পড়ে গিয়েছে। সাঈদ এক নজর কাগজটা দেখে আশে পাশে চোখ বুলালো। কিন্তু সে বুঝতে পারলো না কাগজটা কে ছুঁড়ে মেরেছে। সে ভাবছে, কাগজটা কী তুলবে? কিছুক্ষণ পর জ্যাম ছুটে গেল। সামনের গাড়ি গুলো এগিয়ে যাচ্ছে৷ সাঈদ দ্রুত কাগজটা তুলে বাইক স্টার্ট দিলো। কিছুটা দূর গিয়ে বাইক থামিয়ে কাগজটা খুলে দেখে কিছু লিখা আছে। লিখাটা পড়ে তার ভ্রু কুঁচকে গেল, “হোয়াইট শার্টে আপনাকে বেশ দেখায় মিস্টার সাঈদ ইব্রাহিম।”
সাঈদ ভাবছে কে হতে পারে। তার নাম পর্যন্ত জানে মানুষটা।
.
.
সাগরিকার মন খারাপ ভীষণ। শ্রাবণের চামচা ইর্তেজা কখনো তাকে কারো সাথে দেখা করতে দেবে না সে জানে। ইর্তেজা গাড়ি চালাতে চালাতে আয়নায় সাগরিকাকে দেখলো। প্রতিবারের মতো সে এখনো মুখ লটকিয়ে বসে আছে। ইর্তেজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল- “ম্যাম কোথাও যাবেন?”
সাগরিকা বিরক্ত ভাব নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। ইর্তেজা বুঝলো সাগরিকা এখন রেগে আছে। ইর্তেজা কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে বলল- “ম্যাম কারো সাথে দেখা করলে বলুন।”
“হ্যাঁ আমি দেখা করি আর তুমি আমাদের দুজনকে মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দাও তাই তো?”
ইর্তেজা হাসলো । সাগরিকা রাগী দৃষ্টি বানিয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল-
“এই, এতে হাসার কি আছে। আমি কী জোকস বলেছি?”
“সরি ম্যাম, তো বলুন কী ডিসাইড করলেন?”
“বাসায় চলো”
“আর ইউ শিওর?”
“ইশশশ দুই ক্লাস পড়ে ইংলিশ ঝাড়ছে। তোমাকে লেকচার দিতে বলি নি। যা বলছি চুপচাপ তা করো।”
দুই ক্লাস? ইর্তেজা হাসলো। সাগরিকার কথার মতো গাড়ি বাসার দিকে নিয়ে গেল।
.
.
ইরিনা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। সাঈদের জন্য অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু এখনো ছেলেটা আসছেই না। ঝর্ণা ইরিনার অস্থিরতা দেখে বলল-
“আপা, মনে হয় সাঈদ ভাই আইবো না। আপনে চলেন আরাম করতে।”
“না, সে আসবে আমি জানি। ইর্তেজাকে কল করেছো?”
“ভাই তো ফোনই ধরে না।”
ইরিনা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো। ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল- “ফিরনি দেখো গিয়ে বেশি শুকিয়ে গেলে পুড়ে যাবে।”
“জি আপা”
ঝর্ণা চলে গেল রান্নাঘরে। ইরিনা ভাবলো ঘরে ফিরে যাওয়া যাক। সে হুইলচেয়ার ঘুরাতেই হর্ণের শব্দ আসলো। ইরিনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সাঈদ ভেতরে প্রবেশ করতেই ইরিনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সাঈদ কাছে এসে সালাম দিলো ইরিনাকে। ইরিনা সালামের জবাব নিয়ে বলল- “এত লেইট হলে যে? দেড় ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
“আপনি আমার অপেক্ষা করছিলেন?”
বেশ আগ্রহ নিয়ে সাঈদ প্রশ্ন করলো। ইরিনা সাঈদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটার চোখে মুখে অস্থিরতা দেখতে পেলো সে। ইরিনা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল- “না মানে, তুমি বলেছিলে ইর্তেজার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু তোমার বন্ধু কোথায় আল্লাহ তা’য়ালা ভালো জানেন। অনেকক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি ধরছেই না।”
সাঈদ মন খারাপ করলো। সে ভেবেছিলো ইরিনা বলবে যে সে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কষ্টের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল সাঈদ। ইরিনা সাঈদকে বসতে বলল। সাঈদ মাথা নাড়িয়ে চেয়ারে বসলো। ইরিনা ঝর্ণাকে ডেকে বলল সাঈদের জন্য নাশতা নিয়ে আসতে। সাঈদ চুপচাপ বসে আছে। ইরিনাও কিছু বলছে না। চারপাশ নিরবতা। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। নিরবতা ভেঙ্গে ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল- “বাসার সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন? ঔষধ ঠিক মতো খাচ্ছেন?”
“আমিও ভালো, আর ঔষধও ঠিক মতো খাচ্ছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না ঔষধের। মনে হয় না আর কখনো চলাফেরা করতে পারবো।”
ইরিনা কথাটা হাসিমুখে বললেও সাঈদকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তার বুক জ্বলছে, খুব জ্বলছে। তার যে ইচ্ছে করছে ইরিনার সব কষ্ট সব বেদনা নিজের নামে করে নিতে। যদি সম্ভব হতো সে তাই করতো। সাঈদ মাথা নিচু করে বলল-
“আপনি একদিন নিশ্চয়ই সুস্থ হবেন। শুধু আপনার একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”
সাঈদের কথা শুনে ইরিনা তার দিকে তাকাল। কেন যেন সাঈদের কথা তাকে ভীষণ শান্তি অনুভব করালো।
.
.
সাগরিকা গাড়ি থেকে নেমে মন খারাপ করে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইর্তেজা তাকিয়ে আছে সাগরিকার যাওয়ার দিকে। কারো মন খারাপ দেখলে তার ভালো লাগে না। আচ্ছা মেয়েটা তো ভালো। তাকে দেখে মনে হয় না কোনো ছেলের সাথে দেখা করতে যেতে চায়। এমনও তো হতে পারে তার পরিবারের কেও। ইর্তেজার হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করছে সাগরিকার সম্পর্কে। কিন্তু যদি শ্রাবণ জানতে পারে সাগরিকা তার পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে চায় সবাইকে মেরে ফেলবে। ইর্তেজা চায় না তার জন্য কারো মৃত্যু হোক। হঠাৎ ইর্তেজার মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে “Boss” লিখা ভাসছে। রিসিভ করে কানে ধরলো- “জি বস”
“তোমাকে বলেছিলাম প্রতি ঘণ্টার খবর আমাকে জানাতে। কোথায় তুমি?”
“ম্যামকে নিয়ে বাসায় আসলাম। উনি আজ কারো সাথে দেখা করার কথা বলেনি। তাই কল দেই নি আপনাকে।”
“অবাক হলাম, আজ সাগরিকা জেদ করলো না কারো সাথে দেখা করার।”
“আপনি বলায় আমি একবার হুমকি দিয়েছিলাম। সেদিন থেকেই জেদ ছেড়ে দিয়েছেন উনি।”
“যাক ম্যাডাম ধীরে ধীরে লাইনে আসছে। তোমাকে ধন্যবাদ ইর্তেজা। তুমি আমার অনেক সাহায্য করছো।”
“এটা আমার কর্তব্য বস। আচ্ছা বস শুনুন, ম্যামের খুব মন খারাপ। আজ আপনি নাহয় উনাকে ঘুরাতে নিয়ে যান। আপনি যত উনাকে সময় দিতেন তত উনি আপনার প্রতি দুর্বল হবে।”
“বাহ তুমি দেখছি লাভ গুরু-ও। তোমার কথার মতোই হবে। আজ আমি ওকে নিয়ে বাহিরে যাবো। এখনও কি মন খারাপ ওর?”
“হ্যাঁ খুব।”
“আচ্ছা এক কাজ করো। হয় তো এতে তার মন কিছুটা ভালো হবে….
.
.
“ফিরনিটা দারুন হয়েছে। আমি খুব মিস করছিলাম আপনার হাতের রান্না।”
“আজ অনেকদিন পর রান্না করলাম আমি। যদিও ঝর্ণা অনেক সাহায্য করেছে।”
সাঈদ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনাকে ধন্যবাদ উনার এত খেয়াল রাখার জন্য।”
ঝর্ণা লজ্জা পেল, “আঞ্জে অলকাম অলকাম।”

সাঈদ শব্দ করে হাসলো ঝর্ণার কথা শুনে৷ ঝর্ণা লজ্জা ভাব নিয়ে চলে গেল। ইরিনা অবাক, এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে সে বুঝলো না। সাঈদ ইরিনার চাহনি দেখে বলল- “কী দেখছেন?”
“তুমি ওর প্রশংসা করলে আর ও গলে গেল।”
সাঈদ লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিচু শব্দে বলল- “যাকে গলাতে চাই সে তো গলে না।”
“কিছু বললে?”
“জি? না কিছু না।”
সাঈদ ফিরনি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দৃষ্টি রান্নাঘরে দিতেই সে দেখে ঝর্ণা উঁকি দিয়ে সাঈদকে দেখছে। আর লজ্জামাখা হাসি দিচ্ছে। ইরিনা আরো অবাক হলো। এই মেয়েটাই কত কিছু বলছিল সাঈদের সম্পর্কে আর এখন নিজেই একা একা প্রেমের লাড্ডু খাচ্ছে। ইরিনার বিষয়টা মোটেও ভালো লাগলো না। এক কথায় বললে তার জেলাস হচ্ছে খুব। বিরক্ত ভাব নিয়ে বসে রইলো।
.
.
সাগরিকা গোসল করে বের হলো। এখন তার ভালো লাগছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে মরুভূমিতে আছে। ঘরে এসে দেখে তার বিছানায় একটা বড়ো বক্স রাখা। সাগরিকা ভ্রু কুঁচকালো। শ্রাবণ তো বাসায় নেই এটা কে রাখলো এখানে? সাগরিকা বক্সটা হাতে নিলো। কিছুটা ভারী। খাটে বসে সে বক্স খুলল। একটা গাড়ো নীল রং এর গাউন। সাগরিকা হা হয়ে গাউনের উপর হাত বুলাল। জামাটা তার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। খুশি মনে গাউনটা হাতে নিলো। খুবই সিম্পল গাউনটা৷ কিন্তু খুব সুন্দর। আয়নার সামনে গিয়ে গাউন গায়ে দিয়ে দেখল। পুরো তার মাপের। নিশ্চয়ই শ্রাবণ দিয়েছে এটা। মানুষটাকে সে ঘৃণা করে ঠিক। কিন্তু তার মানতে হবে শ্রাবণ পছন্দ খুব সুন্দর। না হলে কী তাকে ভালোবাসতো? গর্বিত হলো সাগরিকা। সে মোবাইল নিয়ে শ্রাবণকে কল করলো। ধন্যবাদ না জানালে বিষয়টা বাজে দেখায়। শ্রাবণ মিটিং-এ ছিলো৷ সাগরিকার কল দেখে মিটিং থেকে উঠে কিনারায় গেল। মুচকি হেসে রিসিভ করলো-
“হ্যালো ম্যাম, আশা করছি রাগ কমেছে আপনার।”
“আমার রাগ এত সহজে কমবে?”
“তা তো অসম্ভব, তো বলুন আর কী কী করতে পারি আপনার জন্য।”
“আপাতত আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ রাখো। পছন্দ হয়েছে গাউনটা।”
“উফফ আমি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম যে আমার ম্যাডামের জামা পছন্দ হবে কিনা। এখন আমি নিশ্চিন্তের নিশ্বাস নেবো। আচ্ছা শুনো, আজ আমরা ডিনার করতে বাহিরে যাব। জামাটা পড়ে তৈরী হয়ে থেকো।”
“ঠিক আছে, তারাতাড়ি এসো আমি অপেক্ষা করবো।”
“লাভ ইউ”
সাগরিকা উত্তর দিলো না। কল কেটে দিলো। শ্রাবণ লম্বা নিশ্বাস ফেলে মিটিং-এ ফিরে গেল।

রাতেরবেলা…..
সাগরিকা তার ঘড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছে কোনটা পড়বে। তখনই দরজা খোলার শব্দ আসলো। সাগরিকা দ্রুত পেছনে ফিরে দেখে শ্রাবণ প্রবেশ করছে ঘরে। শ্রাবণ ঘরে এসে থমকে গেল। বেহায়া নজরে তাকিয়ে আছে সাগরিকার দিকে৷ সাগরিকা হেসে আয়নার দিকে ফিরে একটা ঘড়ি নিয়ে হাতে পড়তে পড়তে বলল-
“এখন কোনো ফিল্মি ডায়ালগ দিয়ো না। লাইক তোমাকে আসমান থেকে নেমে আসা পরী লাগছে।”
শ্রাবণ এগিয়ে এসে সাগরিকার পাশে দাঁড়াল। সাগরিকা আয়নায় শ্রাবণকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। শ্রাবণ সাগরিকার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরালো। সাগরিকা তাকাল শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাগরিকাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। শ্রাবণের চোখে লোভ লালসা নেই৷ আছে তো শুধু ভালোবাসা । কিন্তু সাগরিকার শ্রাবণের ভালোবাসা পছন্দ না। শ্রাবণ হাসিমুখে বলল- “আমি তো বলেছিলাম লাল রং এর গাউন নিতে। এখন তো দেখছি নীল রং বেশ মানিয়েছে তোমার উপর।”
“মানে? এই জামা তুমি দাও নি?”
“হ্যাঁ আমিই দিয়েছি। কিন্তু কিনেছে ইর্তেজা।”
সাগরিকা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। শ্রাবণ তার চাহনি দেখে হেসে বলল-
“কি হলো এভাবে দেখছো কেন?”
“তুমি বলছো এই জামা তোমার ওই চামচা কিনেছে?”
“হ্যাঁ, আমিই বলেছিলাম তোমার জন্য সুন্দর দেখে একটা গিফট নিতে। বলতে হবে ছেলেটার চয়েজ সুন্দর।”
সাগরিকার মাথায় রক্ত উঠে গেল। এক ঝটকায় নিজেকে দূরে সরিয়ে দ্রুত গাউন খুলতে নিলো। শ্রাবণ তারাতাড়ি তার হাত ধরে বলল- “পাগল হয়ে গেলে। কি করছো?”
সাগরিকা ঝাড়ি মেরে শ্রাবণের হাত সরিয়ে বলল-
“ওই ছেলের সাহস কি করে হলো আমার জন্য জামা কেনার?”
“রাগ করছো কেন? আমি বলেছিলাম তাকে।”
“তুমি আমার স্বামী কিন্তু তুমি পরপুরুষকে দিয়ে আমার জন্য জামা আনিয়েছো। কেন শ্রাবণ কেন?”
শ্রাবণ সাগরিকার হাত ধরে কাছে টেনে নিলো।
“আই এম সরি, আই এম রিয়েলি রিয়েলি সরি। আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। নাহলে নিজে গিয়ে তোমার জন্য জামা নিয়ে আসতাম। ইর্তেজাকে বলায় সে গিয়ে জামা কিনেছে। কিন্তু টাকা তো আমি দিয়েছি।”
সাগরিকার রাগ তবুও কমছে না। শ্রাবণ হেসে সাগরিকাকে বুকে ভরে নিলো। সাগরিকা বন্ধ করে নিলো দু চোখ। শ্রাবণ তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
“থাক জান রাগ করে না৷ আমি ওয়াদা করছি আর কখনো এমন হবে না। আজকের জন্য মাফ করে দাও প্লিজ।”
সাগরিকা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। মাথা তুলে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল-
“শেষ সুযোগ এটা।”
“ওকে ওকে”
“আর হ্যাঁ, আজই প্রথম এবং আজই শেষ। আমি আর এ জামা কখনো পড়বো না।”
শ্রাবণ হেসে সম্মতি জানালো। সাগরিকা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল শ্রাবণকে তৈরী হয়ে নিতে। শ্রাবণ হেসে চলে গেল। সাগরিকা আয়নায় নিজেকে আবার দেখলো। খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু কেন সে জানে না। খাটে বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো।
.
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ইর্তেজা বাসায় ফিরলো। ইরিনা তারই অপেক্ষায় ছিল। ইর্তেজাকে দেখে সে দ্রুত হুইলচেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসলো। ইর্তেজা বোনকে দেখে মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসলো।
“ঘুমোও নি?”
“আমার ভাই সময়ের মতো বাসায় না আসলে আমার ঘুম হবে?”
ইর্তেজা ইরিনার পায়ে মাথা রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এই কোলটা তার ভীষণ প্রিয়। সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। ইরিনা ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“সাঈদ আজও এসে ফিরে গেল। তোকে কল দিলে তুই ধরিস না কেন বল তো।”
“কাজে ছিলাম আপু।”
“এটা কেমন কাজ ইর্তেজা যেখানে তোর এক মিনিটও সময় নেই বোনের সাথে কথা বলার৷ সত্যি করে বল ভাই তুই কি কাজ করিস?”
ইর্তেজা মাথা তুলে ইরিনার দিকে তাকাল। জবাবে মুচকি হাসলো। ইরিনা জানে সে আজও জবাব পাবে না। সময় আসলে ইর্তেজা নিজেই বলে দিবে। কিন্তু তার যে ভয় হয় খুব তার একমাত্র ভাইয়ের জন্য। যাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে। ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি। তারপর একসাথে খাবার খাবো।”
বলেই মুচকি হেসে ইর্তেজা চলে গেল। ইরিনা বসে আছে চুপচাপ। তার ভীষণ ভয় করছে ছেলেটাকে নিয়ে।
.
.
আজ সাগরিকার জন্য শ্রাবণ পুরো রেস্টুরেন্ট বুক করে ফেলেছে। খুব সুন্দর করে সাজানো চারপাশ। সাগরিকা বসে মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণ কোথায়। সাগরিকা গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। হঠাৎ গানের শব্দ ভেসে আসলো। বড়ো মিউজিক বক্সে সাগরিকার প্রিয় গান “তোর মন পাড়ায়” বাজছে। শ্রাবণ এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো সাগরিকার বরাবর। সাগরিকা মুচকি হাসলো। নীল রং এর কোর্ট, প্যান্ট এবং সাদা রং এর শার্ট পড়েছে শ্রাবণ। সাগরিকার জামার রং এর সাথে মিলিয়ে। আজ তাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। কিন্তু সাগরিকা যে এই রূপের প্রেমে কখনোই পরতে পারবে না। মন তো আর একজনের কাছে অনেক আগেই দিয়ে এসেছে। খুব সুন্দর এবং মধুর সময় কাটালো দুজন। সাগরিকার চেহারায় আজ সত্যিকারের হাসি দেখতে পাচ্ছে শ্রাবণ। তার মন যেন নেচে উঠছে সাগরিকাকে খুশি দেখে। রাত সাড়ে ১২ টায় তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। সাগরিকা গাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ক্লান্ত সে এখন। শ্রাবণ মুচকি হেসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সাগরিকার দিকে। আজ তার সময় ভালো কেটেছে একমাত্র ইর্তেজার জন্য। সে-ই তো আইডিয়া দিয়েছিলো। নাহলে তো শ্রাবণ বাসায় এসেই টিভি দেখে বা অফিসের কাজ নিয়ে বসে পড়ে। সাগরিকা একা বসে থাকে নাহয় পড়াশোনা করে৷ সাগরিকার কাছে থেকেও যেন সে দূর ছিল৷ তাই হয়তো সাগরিকা তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। আজ সব কাজ রেখে সাগরিকাকে সময় দেওয়ায় তার কতটা ভালো লাগছে সে বলে বোঝাতে পারবে না৷ শ্রাবণ মোবাইল বের করে ইর্তেজাকে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালো- “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

ইর্তেজা ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে তার সিগারেট৷ সিগারেটটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ইর্তেজার মন নেই৷ মেসেজ টন বাজায় ইর্তেজার ঘোর ভাঙলো। হাতে থাকা সিগারেট মাটির সাথে ঘষে নিভিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। শ্রাবণের মেসেজ দেখে মুচকি হেসে রিপ্লাই পাঠালো- “কর্তব্য ছিলো আমার, তবুও আপনাকে স্বাগতম।” মেসেজটা পাঠিয়ে ইর্তেজা তার ওয়ালপেপারের দিকে তাকাল। ওয়ালপেপারে একটি মেয়ের ছবি ভাসছে। মেয়েটা গালে হাত দিয়ে মুখ লটকিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ভীষণ অভিমান করেছে। ইর্তেজা মুচকি হেসে মোবাইল রেখে আবার আকাশের দিকে তাকাল। চোখের কোণায় পানি জমে গিয়েছে তার। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু বুকের ভেতর অনুভব করা চিনচিন ব্যাথা তাকে স্বাভাবিক থাকতে দিলো না। দু-চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো তার।

চলবে……