আর একটিবার পর্ব-৪+৫

0
290

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৪

আজ ইর্তেজার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। সাগরিকা তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে ভার্সিটিতে যেতে লেইট হলে। ইর্তেজা ফ্রেশ হয়ে বাহিরে এসে দেখে নাশতা আজ রেডি। টি টেবিলে খাবার সাজানো। সে ভ্রু কুঁচকাল। তখনই ইরিনাকে নিয়ে ঝর্ণা রান্নাঘর থেকে বের হলো। ইর্তেজা হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে রাগী দৃষ্টি বানিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা তার চাহনি দেখে হেসে বলল- “এভাবে দেখার কিছু নেই। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাই ভাবলাম আজ নাশতা আমি বানাই।”
“তোমাকে কতবার বলেছি বিশ্রাম করতে?”
“এই বেশি কথা বলবি না। খুব বড়ো হয়ে গেছিস তাই না? কথায় কথায় শুধু বকিস আমায়।”
ইরিনা মন খারাপ করে ফেলল। ইর্তেজা মুচকি হেসে বোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। ইরিনা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ইর্তেজা ইরিনার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমো খেয়ে বলল-
“তুমি জানো তোমাকে নিয়ে আমি কত চিন্তা করি। আমার বোন অসুস্থ আর আমি তাকে দিয়ে কাজ করাবো? এত পাষাণ হতে পারবো না বাবা।”
ইরিনা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালো। বলল-
“ঢঙ করিস না ইর্তেজা। আমার এত চিন্তা থাকলে আমার কথা তুই শুনতি।”
“কি? আমার দ্বারা এত বড়ো পাপ? আমি তোমার কোন কথা না শুনিনি? একটু মনে করিয়ে দাও তো।”
“আগে ওয়াদা কর আমি যা বলবো চুপচাপ মেনে নিবি।”
“ওয়াদা ওয়াদা ওয়াদা”
ইরিনা খুব আগ্রহী হয়ে বলল- “প্লিজ ইর্তেজা বিয়ে করে নে৷ তুই কি আমার এই কথা মানবি না? দেখ তুই কিন্তু ওয়াদা করেছিস।”
ইর্তেজা হাসলো। ইরিনা বিরক্ত হলো তার হাসি দেখে। ইর্তেজা হাসতে হাসতে বোনের গাল ধরে আস্তে করে টেনে বলল- “আমার কলিজার টুকরোটা। আমি জানতাম তুমি এমনই কিছু বলবে।” ইর্তেজা হাসি থামিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলে হাসি মুখে বলল- “আচ্ছা আমি রাজি।”
ইরিনার চোখে মুখে খুশির চমক ফুটে উঠল। সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল-
“সত্যি বলছিস তো?”
“হুম, কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
ইরিনার হাসি উড়ে গেল। সে জানে ইর্তেজা এমন কোনো শর্ত বলবে যেটা মেনে নেয়া খুব মুশকিল। ইর্তেজা মুচকি হেসে বলল- “আমার বিয়ের আয়োজন তুমি এবং আমার দুলাভাই মিলে করবে।”
ইরিনা বিরক্ত হয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ইর্তেজা আবার ইরিনার হাত মুঠোয় বন্দি করে বলল-
“আমি জানি না তুমি নিজেকে এত ছোটো নজরে কেন দেখো? প্যারালাইজড বলে? আরে আমার বোন সেই মেয়ে যে নিজের কলেজ, ভার্সিটি লাইফে ম্যারাথন রেসে প্রতিবার জয়ী হয়েছে।”
“সে আর মেয়ে আর বেঁচে নেই।”
“জানো, তুমি যতবার এ কথা বলো ততবার আমার নিজেকে প্রাণহীন মনে হয় আপু।”
কথাটা বলার সময় ইর্তেজার গলা কেঁপে উঠল। ইরিনা ইর্তেজার দিকে অশ্রু চোখে তাকাল। ইর্তেজা খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে রেখেছে। ইরিনা মাথা নিচু করতেই গাল বেয়ে তার পানি পরলো৷ ইর্তেজার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে বোনের চোখে পানি দেখে। সে আলতো করে ইরিনার চোখের পানি মুছে বলল- “আমার বোন একদিন নিজের পায়ে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে।”
ইরিনা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ইর্তেজাও হেসে ইরিনার পায়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।
.
.
রাগে গজগজ করছে সাগরিকা। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হতে ২০ মিনিট বাকি। আজ সে লেইট হলে ইর্তেজার খবর করে ছাড়বে। শ্রাবণ আজ তারাতাড়ি অফিস চলে গিয়েছে। সাগরিকা ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসলো। হঠাৎ ভাবলো যদি ইর্তেজার কারণে তার ভার্সিটি যেতে লেইট হয় সে ইর্তেজাকে বের করার রাস্তা পাবে। সাগরিকা সোফায় আয়েস করে বসে ঘড়ির দিকে তাকাল। মিনতি করছে সে সময় যাতে তারাতাড়ি ঘনিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ইর্তেজা আসলো দৌড়াতে দৌড়াতে। সে সোফার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাত রেখে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। সাগরিকা ঘড়ির দিকে তাকাল। ক্লাস শুরু হতে ৫ মিনিট। তারপর আড়চোখে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল- “ক্ষমা করবেন ম্যাম। চলুন ভার্সিটি যাওয়া যাক।”
“সময় দেখেছো কয়টা বাজে?”
ইর্তেজা উত্তর দিলো না। জবাব না পেয়ে সাগরিকা দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“আই এম কাস্কিং ইউ সামথিং রাইট?”
ইর্তেজা চোখ তুলে সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল- “সরি ম্যাম আর এমন হবে না।”
সাগরিকা চিৎকার করে উঠল- “তোমার দেরি করে আসা আমার একদিনের পড়ার ক্ষতি করলো তার খেয়াল আছে তোমার?”
ইর্তেজা মাথা নিচু করে রাখলো। তার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। শ্রাবণ বলেছে সাগরিকা এমনই৷ বদমেজাজি আর কি। সাগরিকা তালিচ্ছ্যের হাসি দিয়ে আবার বলল- “তোমাদের মতো মুর্খরা পড়া লেখার মর্ম বুঝবে না জানি।”
হঠাৎ ইর্তেজা ফিক করে হেসে দিলো। সাগরিকা ভ্রু কুঁচকাল তার হাসির শব্দ শুনে। ইর্তেজা খুব কষ্টে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। সাগরিকা রাগী কন্ঠে বলল- “হাউ ডের ইউ লাফিং? সাহস কী করে হলো আমার সামনে হাসার?”
ইর্তেজা সিরিয়াস চেহারা বানিয়ে সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল- “মাফ করবেন ম্যাডাম একটা কথা মনে এসে পরেছিল। আপনি আসুন আমি গাড়ি বের করছি।”
ইর্তেজা চলে গেল। সাগরিকা কাচুমাচু খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না ইর্তেজা এমন কেন। গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনে সাগরিকা বাহিরে গেল। ইর্তেজা গাড়ির দরজার খুলে দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা গিয়ে বসলো। ইর্তেজা ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রতিদিনের মতো পুরো রাস্তায় সাগরিকা চুপ ছিলো। মেয়েটার মাথায় কি ঘুরছে ইর্তেজার জানতেই হবে। তার বস জানতে চায় সাগরিকা কার সাথে দেখা করতে যায়। ইর্তেজা নিরবতা ভেঙ্গে বলল-
“ম্যাম একটা কথা জিজ্ঞেস… ”
ইর্তেজা পুরো কথা শেষ করার আগেই সাগরিকা বিরক্ত কন্ঠে বলল- “খবরদার মুখ বন্ধ রাখো।”
ইর্তেজা আর কিছু বলল না। এখন কিছু বললে তার ১২ টা বাজিয়ে দেবে সাগরিকা। সে তার গার্লফ্রেন্ডের ন্যাকামোও ততটা সহ্য করেনি যতটা সাগরিকার করছে। ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
.
.
ইরিনার সাথে দেখা করার সুযোগ খুঁজে বেড়ায় সাঈদ। আজ কোন বাহানায় যাবে সকাল থেকে ভাবছে কিন্তু মাথা কাজ করছে না। হঠাৎ তার মনে আসলো আর মাত্র দু’দিন বাকি। তার বাবা বলেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ শুরু করতে হবে। সাঈদ মহা চিন্তায় পরলো। ইর্তেজার সাথে দেখা করে তার লাভ নেই বুঝতে পেরেছে। সাঈদ মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তার এক চেনা লোককে কল করলো। অপর পাশ থেকে একটা ভারী কন্ঠ ভেসে আসলো- “হ্যালো”। সাঈদ ঢোক গিলল। লোকটা তার কলেজের প্রিন্সিপাল। সে ভীষণ ভয় পায় উনাকে। ফোনের ওপার থেকে কারো কথা না শুনতে পেরে উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন- “এমন ফাজলামো করার জন্য কল করেন আপনারা? বেয়াদব।”
প্রিন্সিপাল স্যার কল কাটার আগেই সাঈদ ভীতু গলায় বলল- “আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কে?”
“আমি সাঈদ বলছি।”
স্যার কিছুক্ষণ ভাবতে থাকলো কোন সাঈদ। চিনতে পেরে হাসিমুখে বললেন- “ওহো সাঈদ তুমি, হাউ আর ইউ মাই বয়?”
“আলহামদুলিল্লাহ স্যার, আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো ভালো, বাংলাদেশী নাম্বার তার মানে তুমি দেশে?”
“জি স্যার, ১ মাস হয়ে আসছে এসেছি।”
“১ মাস হয়েছে এসেছো আর স্যারের কথা আজ মনে পরলো। তুমি ইর্তেজা দুজনই ভুলে গেছো আমায়।”
“না স্যার এমন কিছু না, আমরা দুজনই আপনাকে খুব মনে করি। ইর্তেজা তো কাজ পেয়ে গিয়েছে। তাই সে ব্যস্ত। আমিই বেকার বসে আছি।”
“বেকার? তুমি তো বিদেশে পড়াশোনা করেছো। তোমার তো চাকরি তারাতাড়ি পেয়ে যাওয়ার কথা।”
“আসলে স্যার, আমি ডিগ্রি কমপ্লিট করি নি। তার আগেই এসে পরেছি।”
“বোকা ছেলে, মানুষ সুযোগ পায় না। আর তুমি হাতছাড়া করলে।”
“সরি স্যার, স্যার আপনাকে কিছু বলার ছিল।”
“হ্যাঁ বলো”
“মাস্টার্স তো আমি কমপ্লিট করেছি। আমি কি আপনার কলেজ বা স্কুলে চাকরি পেতে পারি?”
“তুমি এত ভালো আইডিয়া আমাকে আগে দাও নি কেন? এমনিতেও কলেজে শিক্ষক লাগবে। তোমাদের দোয়ায় কলেজ স্কুল ধীরে ধীরে আরো প্রচলিত হচ্ছে।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ, তো স্যার কবে আসবো সিভি নিয়ে?”
“আজই এসে পরো আমি কলেজের জন্য বের হচ্ছি।”
“ওকে স্যার অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে৷ আপনি আমার অনেক বড়ো সাহায্য করলেন।”
“এর বদলে চা পান করাতে নিয়ে যেতে হবে।”
সাঈদ হেসে সম্মতি জানালো। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সে কল কেটে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। এখন তার শান্তি লাগছে। চাকরিটা পেলে ইরিনার সাথে দেখা করতে যাবে৷
.
.
ইর্তেজা হেলান দিয়ে সিটে বসে আছে। প্রতিদিন তার এই ডিউটি ভালো লাগে না। কিন্তু তার এটা করতেই হবে। ইরিনাকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাবে চিকিৎসার জন্য৷ এর জন্য টাকা দরকার। ভার্সিটি শেষ হতে আরো ১ ঘন্টার মতো বাকি। কিন্তু তার আগেই সাগরিকা দ্রুত হেটে আসলো। ইর্তেজা তাকে দেখে গাড়ি থেকে নামতেই সাগরিকা এসে ঘনঘন নিশ্বাস নিতে নিতে বলল-
“ইর্তেজা আমি তোমার সামনে হাতজোড় করছি। আমাকে হসপিটাল নিয়ে চলো।”
“ম্যাম আপনি ঠিক আছেন তো?”
“আমি ঠিক আছি। প্লিজ চলো। আর তোমার স্যারকে কিছু বলো না প্লিজ।”
ইর্তেজা জবাব দিলো না। তাকিয়ে রইলো সাগরিকার দিকে। সাগরিকার চোখে অশ্রু দেখে তার অবাক লাগছে। সাগরিকা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল-
“ঠিক আছে, বলার হলে বলে দিও। কিন্তু এখন আমাকে নিয়ে চলে।”
সাগরিকা গাড়িতে উঠে বসলো৷ ইর্তেজা আর উপায় না পেয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাগরিকা ঠোঁটের উপর হাত রেখে কেঁদেই চলেছে। ইর্তেজা আয়না দিয়ে বার বার তাকে দেখছে। হঠাৎ কি হলো তার মাথা কাজ করছে না। সাগরিকার কাছ থেকে হসপিটালের নাম জেনে সে সেখানেই গেল। সাগরিকা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে গেল। ইর্তেজার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। নিশ্চয়ই ভয়াবহ কিছু হয়েছে তাই সাগরিকা এমন করছে। ইর্তেজাও দ্রুত গেল সাগরিকার পেছনে।
.
.
সাঈদ খুশি মনে বাইক চালাচ্ছে। সে আর বেকার নয়। আগামী সপ্তাহ থেকে কলেজ জয়েন করবে আইসিটি স্যার হিসেবে। ভাবতেই তার আনন্দ লাগছে। মিষ্টির দোকানের সামনে বাইক থামিয়ে ইরিনার জন্য রসগোল্লা আর দই কিনে নিলো। এই দুটো জিনিস মেয়েটার খুব পছন্দ সাঈদ জানে। সাঈদ দ্রুত বাইক চালিয়ে ইরিনার বাসায় আসলো। কলিংবেল বাজিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণা এসে দরজা খুলল। সাঈদ ভেতরে ঢুকে বলল- “উনি উঠেছেন?”
ঝর্ণা মিষ্টি করে হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। ঝর্ণার হাসি দেখে সাঈদ অপ্রস্তুত হলো মেয়েটা খুব আজব। এক সময় তাকে দেখলে মুখ বানায় আর সময় হাসে। তখনই ইরিনা আসলো। এসে দেখে সাঈদ আর ঝর্ণা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। হঠাৎ রাগ হচ্ছে তার৷ ভীষণ রাগ। গম্ভীর কন্ঠে বলল- “ঝর্ণা, আমি চা বানাতে বলেছিলাম।”
ঝর্ণার হুশ ফিরলো। সে এক নজর ইরিনাকে দেখে দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেল। সাঈদ হাসিমুখে সালাম দিলো। ইরিনার বিরক্ত কন্ঠে উত্তর দিয়ে বলল-
“তুমি আজও এসেছো? প্রতিদিন কেন এসে পরো বলো তো।”
সাঈদের হাসি উড়ে গেল। কষ্ট পেল সে ইরিনার কথা শুনে। তবুও আবার মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল- “এইভাবেই, বেকার বসে ছিলাম এতদিন তাই সময় কাটাতে আসতাম।”
“সময় কাটানোর জন্যে এই বাসায় আসার লজিক মাথায় ঢুকলো না।”
বুক ভারী হয়ে আসলো সাঈদের। তার বলতে ইচ্ছে করছে ইরিনাকে যে সে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য আসে৷ সাঈদ মিষ্টি আর দই টি টেবিলের উপর রেখে বলল- “আমি একটা কলেজে চাকরি পেয়েছি। এই খুশিতে আপনার আর ইর্তেজার জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছিলাম। আগামী সপ্তাহ থেকে জয়েন করছি। তখন থেকে আর আসবো না।”
সাঈদ হাসি মুখেই বলল কথাটা। কিন্তু ইরিনার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। রাগের মাথায় সে কি বলে ফেলল নিজেও বুঝলো না। সাঈদ ঘড়ি দেখে বলল- “আমার এখন বাসায় যেতে হবে। আসি, ভালো থাকবেন।”
সাঈদ চলে যেতে নিলো তখনই ইরিনা বলল-
“এসেছো যেহেতু চা খেয়ে যাও।”
সাঈদ শুধু মাথা ঘুরিয়ে ইরিনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল- “না, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি।”
সাঈদ চলে গেল। তাকিয়ে রইল ইরিনা। সে বুঝতো পারছে না কিছুক্ষণ আগে তার কী হলো। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে সে এত গভীর চিন্তা কিভাবে করতে পারে? তার ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করতে৷
.
.
হাসপাতালের করিডরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে কান্না করছে সাগরিকা। কিছুক্ষণ আগে তার বাবার ইন্তেকাল হয়েছে। ইর্তেজা এই সময় কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছে না। সে সাগরিকার থেকে কিছুটা দূর দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে সাগরিকার কষ্ট বুঝতে পারছে কারণ সেও তার বাবা-মা হারিয়েছে। কেবিন থেকে একটা ছেলে বের হলো। বয়স বিশ হবে। সে এসে সাগরিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল- “তুমি কেন আসলে আপু? শ্রাবণ জানলে তোমাকে মারধর করবে।”
ইর্তেজা ছেলেটার কথা শুনে হাতমুঠো শক্ত করে ফেলল৷ সে নারী নির্যাতন বিষয়টা সহ্য করতে পারে না। একটা সময় ছিল যখন তার বাবা খুব অত্যাচার করতো তার মায়ের উপর৷ ইরিনা বড়ো হওয়ার পর একদিন প্রতিবাদ করায় বাবা আর তার মায়ের উপর হাত তুলে না। সাগরিকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল- “কি বলছিস সূর্য? আমার বাবা মারা গিয়েছে আর আমি আসতাম না শ্রাবণের ভয়ে?”
“না আসতে না। আর ভুলো না এই সেই বাবা যে টাকার লোভে তোমাকে ওই অমানুষটার সাথে বিয়ে দিয়েছে।”
“এখন অতীত টেনে লাভ কি বল? যেমনই ছিলেন, ছিলেন তো আমার বাবা।”
সূর্য মুখ ঘুরিয়ে ইর্তেজার দিকে তাকাল। তারপর আবার সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল- “উনি কে আপু?”
“শ্রাবণের চামচা ভাবতে পারিস।”
ইর্তেজা কিছু বলল না। সূর্য ধীরপায়ে হেটে এসে ইর্তেজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল- “আমি জানি আপনি শ্রাবণকে বলে দিবেন আপু কোথায় এসেছিল। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, বলবেন না প্লিজ। নাহলে ওই অমানুষটা আমার বোনকে অকারণে মারধর করবে।”
সূর্য হাতজোড় করে কথাটা বলে কান্না করে দিলো। ইর্তেজা সাথে সাথে তার হাত ধরে বলল- “চিন্তা করবেন না৷ আমি বসকে কিছু বলব না।”
সাগরিকা এক নজর ইর্তেজাকে দেখলো। সূর্য মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানালো। বেশ কিছু সময় তারা হসপিটাল থাকলো। ভীষণ দেরি হয়ে গিয়েছে। ইর্তেজার ভয় করছে। শ্রাবণকে কী বলবে এখন? যদি সাগরিকাকে মারধর করে সে? দেরি হয়ে যাওয়ায় সূর্য জোর করে সাগরিকাকে পাঠিয়ে দিলো। ইর্তেজা গাড়ি চালাচ্ছে সাগরিকা এখন কিছুটা শব্দ করে কাঁদছে। ইর্তেজা কিছুক্ষণ ভাবলো কি করা যায়৷ এমন অবস্থায় সে সাগরিকাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে না। ইর্তেজা গাড়ি অন্য রাস্তায় নিলো। সাগরিকার সেদিকে খেয়াল নেই। সে কেঁদেই চলেছে। এক খোলা জায়গায় এসে ইর্তেজা গাড়ি থামালো। আশে পাশে মানুষ কম। ইর্তেজা গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এসে সাগরিকার পাশে দরজা খুলল। সাগরিকা ইর্তেজাকে দেখে বাহিরে চোখ বুলালো। সে জায়গাটা চিনলো না।
“কোথায় নিয়ে আসলে?”
“বের হোন।”
“কেন?”
ইর্তেজা সাগরিকার হাত ধরে গাড়ি থেকে বের করলো। সাগরিকা অবাক হবে না-কি রাগ নিজেও বুঝতে পারছে না। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে সাগরিকার হাত ছেড়ে বলল- “চিৎকার করে কাঁদলে না-কি মন হালকা হয়। তাই যত ইচ্ছা কাঁদুন।”
সাগরিকা চারপাশে চোখ বুলাল। এমন নিরব জায়গা শহরে সে আগে কখনো দেখেনি।
“ম্যাম”
ইর্তেজার ডাকে সাগরিকা তার দিকে তাকাল। ইর্তেজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুকভরা কষ্ট নিয়ে বলল-
“আমি আপনার কষ্টের সীমা অনুভব করতে পারছি। জানেন যেদিন বাবাকে হারিয়েছি সেদিন মন ভরে কাঁদতে পারি নি। যখন সময় পেয়েছি এখানেই এসে মন ভরে কান্না করেছিলাম।”
“তোমার বাবা নেই?”
“বাবা মা কেও নেই। শুধু একটা বড়ো বোন আছে। এখন তাকে ঘিরেই আমার পৃথিবী।”
কথাটা বলেই ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকাল। সাগরিকাও তাকাল সেখানে। সূর্য্য ধীরে ধীরে ডুবছে।দুজনই তাকিয়ে রইলো সেখানে। হঠাৎ সাগরিকা ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। আজ চোখ বাঁধা মানলো না। বাঁধ ভেঙ্গে বেয়ে চলেছে নিঃশব্দে। ইর্তেজা তার দিকে এক নজর তাকাল। চোখের পানি দিয়ে সাগরিকার চোখের কাজল লেপ্টে আছে। ঘেমে চেহারা ভিজে একাকার। সূর্য্যের হলুদ আলোয় সাগরিকার চেহারা চিকচিক করছে। নিচের ঠোঁট কামড় দিয়ে ধরে চোখ হালকা বন্ধ করে কাঁদছে। ইর্তেজার মায়া হলো। ভীষণ মায়া। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। হঠাৎ ইর্তেজার মোবাইল বাজলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে শ্রাবণ কল করছে। সে আড়চোখে সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সূর্য্যের দিকে। থাকুক না মেয়েটা নিজের মতো। মন হালকা করে নিক। কিছুক্ষণ শান্তির নিশ্বাস নেয়ার পর নাহয় আবার নিয়ে যাবে সেই জাহান্নামে। ইর্তেজা কল কেটে পকেটে রেখে দিলো। তাকিয়ে রইল সে সাগরিকার দিকে। সাগরিকা সূর্য্য ডোবা দেখছে আর ইর্তেজা একজন মায়াবী কন্যাকে। দুই দৃশ্য-ই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।

চলবে……

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৫

গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে সাগরিকার চোখ লেগে গিয়েছে। ইর্তেজা গাড়ি চালাচ্ছে আর আয়না দিয়ে সাগরিকাকে বার বার দেখছে। তার চিন্তা হচ্ছে ভীষণ মেয়েটার জন্য। শ্রাবণ আজ কী করবে কে জানে। বাড়িতে পৌঁছে ইর্তেজা গাড়ি থেকে বের হলো। ঘুরে গিয়ে পেছনের দরজার খুলে সাগরিকাকে ডাকতে নিলো। মেয়েটার ঘুমন্ত চেহারা দেখে তার ইচ্ছে করছে না ডাকতে। কিন্তু ডাকতে তো হবেই। ইর্তেজা নিচু স্বরে সাগরিকাকে ডাকলো। বেশীক্ষণ হয়নি সাগরিকা ঘুমিয়েছে। দুবার ডাক দিতেই সে উঠে গেল। দু-হাত দিয়ে চোখ ডলে ইর্তেজাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল- “তোমার সাহস কি করে হলো আমার ঘরে এসে আমাকে ডাকার?”
“ম্যাম আপনি এখন গাড়িতে।”
সাগরিকা চারপাশে চোখ বুলালো। সত্যি তো সে গাড়িতে। হঠাৎ তার বাবার কথা মনে আসতেই তার বুক ভারী হয়ে আসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল- “আমার বাবা কি সত্যি মারা গিয়েছে ইর্তেজা?”
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার সময় সাগরিকার কন্ঠ কাঁপছিল। চোখের কোনায় তার পানি জমে আছে। ইর্তেজার মন খারাপ হয়ে গেল। সে মাথা নিচু করে ফেলল। সাগরিকার গাল বেয়ে পানি পরতেই সাথে সাথে চোখ মুছে নিলো।
“একটা হেল্প করবে প্লিজ?”
ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা মাথা নিচু করে বলল-
“আমার পরিবারে এখন আমার ভাই ছাড়া আর কেও নেই। বাবার জানাজা এশার পর। আমার ভাই একা এতকিছু পারবে না। ও খুব ছোটো। তুমি কি যাবে প্লিজ ওর সাহায্য করতে?”
ইর্তেজার বুক কেঁপে উঠল। বাবার মৃত্যু সাগরিকাকে এত বদলে দেবে ইর্তেজা কল্পনাও করেনি। সাগরিকা উত্তর না পেয়ে ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল- “তোমার সমস্যা হলে যাওয়া লাগবে না।”
“না ম্যাম, আমি যাব আপনার বাবার জানাজায়। আপনি চিন্তা করবেন না।”
সাগরিকার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ইর্তেজা মুচকি হাসলো তার হাসি দেখে। সাগরিকা গাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরলো। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে একা যেতে দিতে ভয় করছে তার। সাগরিকা তার ঘরে গেল। শ্রাবণ ইজি চেয়ারে বসে আছে সিগারেট হাতে নিয়ে। সাগরিকা ভেতরে আসতেই সে চোখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। সাগরিকা কিছু না বলে খাটের উপর ব্যাগ রেখে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো। তখনই শ্রাবণ প্রশ্ন করলো- “কোথায় ছিলে?”
সাগরিকা বিরক্ত ভাব নিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকাল। শ্রাবণ তার চাহনি দেখে রেগে গেল। হাতে থাকা সিগারেট নিভিয়ে উঠে সাগরিকার সামনে এসে দাঁড়াল। সাগরিকা এখনো বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল- “কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে।”
“তোমাকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
“তুমি বাধ্য কি-না তা কী এখন বুঝাবো?”
“কী করবে শুনি? মারবে আমাকে? শ্রাবণ আমি মরতে ভয় পাই না। আমার জীবন এমনিতেও জাহান্নাম।”
শ্রাবণ সাগরিকার হাত চেপে ধরলো। সাগরিকা ব্যাথায় ছটফট করছে। শ্রাবণ তার চোখে চোখ রেখে বলল- “তোমার ন্যাকা সহ্য করতে করতে আমি ক্লান্ত। সহ্যের সীমা পাড় করে ফেললে… ”
“আরে বাদ দাও, তুমি মারধর ছাড়া কিছুই করতে পারবে না আমি জানি। আর নাহলে জোর করে আমার দেহ ভোগ করবে। প্র্যাকটিস হয়ে গেছে যা মন চায় করো।”
শ্রাবণের মাথা গরম হয়ে গেল। সজোরে সাগরিকার গালে চড় মেরে দিলো। সাগরিকা টাল সামলাতে পারলো না। পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকালো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করলো না। হাত মুঠো শক্ত করে সে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ সাগরিকার দিকে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল- “আমি ভেবে নিয়েছিলাম আর কখনো তোমার গায়ে হাত তুলবো না। কিন্তু তোমার ব্যবহার আমাকে বাধ্য করেছে আজ। বলো এখন কোথায় গিয়েছিলে?”
সাগরিকা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। শ্রাবণের রাগ বেড়েই চলেছে। সে উঁচু স্বরে বলল-
“ওই ইর্তেজাকে তো আমি ছাড়বো না। ওকে কল করেছি অনেকবার ধরেনি। টাকার লোভ দেখিয়েছো ওকে তাই না? ও তো টাকার গোলাম।”
সাগরিকার গা কাঁপছে রাগে। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। সাগরিকার চাহনি দেখে শ্রাবণ রাগে সাগরিকার চুলের মুঠো শক্ত করে ধরলো। সাগরিকা ব্যাথায় নিঃশব্দে কাঁদছে আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় আছে। শ্রাবণ সাগরিকার মুখ চেপে ধরে বলল-
“তুমি কোথায় গিয়েছিলে তার খবর তো আমি পেয়েই যাব। মাই ডিয়ার ওয়াইফ, আজ থেকে তোমার বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ। অনেক হয়েছে পড়াশোনা। অনেক দিয়েছি ছাড়। কিন্তু আর না।”

তখনই দৌড়াতে দৌড়াতে ইর্তেজা আসলো। সে ঘরের দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই এমন দৃশ্য দেখে থমকে গেল। শ্রাবণ ইর্তেজাকে দেখে সাগরিকাকে এক ঝটকায় ছেড়ে ইর্তেজার দিকে হনহন করে আসলো। ইর্তেজার দৃষ্টি সাগরিকার দিকে। সাগরিকা দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ কিছু বলার আগেই ইর্তেজা বলল- “বস আপনার ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে।”
কথাটা বলার সময়ও ইর্তেজার দৃষ্টি সাগরিকার দিকে ছিলো। শ্রাবণ অবাক হয়ে বলল- “বলছো কী? কোন ফ্যাক্টরিতে?”
ইর্তেজা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল- “বাড়ি থেকে কিছুটা দূর যেটা। খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি। আপনি যদি সেখানে গেতেন ভালো হতো।”
শ্রাবণ জবাব দিলো না দৌড়ে চলে গেল। ইর্তেজা জানে শ্রাবণ টাকাকে কত ভালোবাসে। তার জন্য তার সম্পত্তি সবার আগে। ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকাল। সাগরিকা দ্রুত মাটিতে বসে নিজের মাথা চেপে ধরলো। এমনিতেই কান্না করায় মাথা ব্যাথা। এখন চুলের মুঠো ধরায় আরো ব্যাথা করছে। সাগরিকা ধীরে ধীরে চোখ তুলে ইর্তেজার দিকে তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ইর্তেজা বলল- “সত্যি আগুন লেগেছে। আর এটা কো-ইন্সিডেন্স না। আমি করিয়েছি এই কাজ। সেই ফ্যাক্টরির এক কর্মী আমার খুব ক্লোজ। তাকে বলায় সে চুপি চুপি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বেশী ক্ষতি হবে না। এখনকার পরিস্থিতি সামলানোর জন্য এই আইডিয়াই মাথায় এসেছিল।
“আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করি নি।”
ইর্তেজা জবাবে মুচকি হাসলো। সাগরিকা তাকিয়ে রইল ইর্তেজার দিকে। তখনই চারপাশে এশার আযান ভেসে আসলো৷ ইর্তেজা হাসিমুখে বলল- “আমি আপাতত আপনার ভাইয়ের কাছে যাই। আর চিন্তা করবেন না৷ বস যখন ফিরবে একদম পরিবর্তন হয়ে ফিরবে। মাফ পর্যন্ত চাইবে আপনার কাছ থেকে।”
“কী করবে শুনি?”
“তেমন কিছু না। আচ্ছা আসি, আল্লাহ হাফেজ।”
ইর্তেজা চলে গেল। সাগরিকা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়াল। মাথা ব্যাথা করছে তার। ধীরপায়ে হেটে গিয়ে আলমারি থেকে জামা বের করে বাথরুমে চলে গেল।
.
.
সাগরিকার বাবার জানাজায় এসে ইর্তেজা সূর্যের প্রত্যেক কাজে সাহায্য করলো। সূর্য দেখতে পুরো তার বোনের মতোই৷ সাগরিকা বলেছে সূর্য ছাড়া এখন আর কেও নেই তার। সাগরিকার মা কোথায়? ইর্তেজার মনে প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কবরস্থান থেকে ফিরে সবাই চলে গেল ইর্তেজা বাদে৷ ছেলেটা অনেক ছোটো। সে ভাবলো কিছুক্ষণ তার সাথে থেকে যাক। ড্রইংরুমে বসে আছে তারা। ইর্তেজা চারপাশে চোখ বুলালো। তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট। দেখতে ভীষণ সুন্দর৷ এখন থেকে সূর্য একা থাকবে এই পুরো বাড়িতে। ইর্তেজার খারাপ লাগলো। সূর্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল- “আপনাকে ধন্যবাদ আপনি আমার অনেক সাহায্য করেছেন।”
“ধন্যবাদ দিতে হবে না। সূর্য তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন হচ্ছে। তুমি একা থাকতে পারবে?”
“পারবো, বাবা তো সারাদিন নেশায় ডুবে থাকতেন। আমিই ঘর সামলাতাম।”
“পড়াশোনা করো না?”
“করতাম, কিন্তু এখন আর করি না।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি যদি কিছু মনে না করো।”
“করুন”
“তোমার মা কোথায়?”
“বাবা নেশা করতো বলে মা অনেক আগেই উনাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গিয়েছে। শুনেছি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। এখন হয়তো স্বামীর বাসায়।”
ইর্তেজা আর কিছু বলল না। সূর্যের সাথে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পরলো। এখন ফ্যাক্টরি যেতে হবে। শ্রাবণের মাথা থেকে রাগের ভূত নামিয়ে বাসায় যাবে৷ ইর্তেজার খুব জানতে ইচ্ছে করছে শ্রাবণের সাথে সাগরিকার দেখা কিভাবে হলো? সূর্য তো হসপিটালে বলেছিল তার বাবা টাকার লোভে তাকে বিয়ে দিয়েছে। ইর্তেজা ফ্যাক্টরি এসে দেখে চারপাশে লোকজন। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিভিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। অর্ধেকের মতো জিনিসপত্র জ্বলেছে। শ্রাবণ পুলিশের সাথে কথা বলছে। ইর্তেজা সেখানে গেল। পুলিশ ফ্যাক্টরির সম্পর্কে সব ডিটেইলস নিয়ে চলে গেল। শ্রাবণের চেহারায় কষ্ট স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ইর্তেজার কলিজা যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। খুব শান্তি লাগছে তার। সে শ্রাবণের কাঁধে হাত রেখে বলল- “বস, আপনি চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি খুব ভালো বিজনেসম্যান৷ আমি জানি আপনি আবার সব আগের মতো করে ফেলবেন।”
শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক ঝটকায় ইর্তেজার হাত সরিয়ে বলল-
“তোমাকেই খুঁজছিলাম। এখন সত্যি সত্যি জবাব দাও সাগরিকাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
“আজ ভার্সিটিতে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে তাই আসতে দেরি হয়েছে।”
“কি দূর্ঘটনা?”
“ম্যামের ফ্রেন্ড ভার্সিটির এক স্যারের সাথে রিলেশন করতো। এটা তার পরিবার জানায় মেয়েটাকে খুব বকাঝকা করে। শুধু তাই না। তারা ম্যামের উপর সন্দেহ করে যে ম্যামও এইসব বিষয়ে জানতো এবং মেয়েটাকে সাহায্য করেছে। প্রচুর তামাশা হয়েছে এই নিয়ে। আর আপনি তো জানেন ম্যাম কত সাহসি। উনি নিজেকে সত্য প্রমাণ করেছে। তাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। আই এম সরি।”
“আমার বউয়ের উপর এত বড়ো অপবাদ? কারা করেছে এই কাজ, নাম বলো। এখনই নাম বলো।”
“বস আপনার অবস্থা দেখেছেন? ঠিক এই কারণে আমি আপনাকে কল করি নি। আর আপনি অকারণে ম্যামের সাথে…”
ইর্তেজা মাথা নিচু করে ফেলল। শ্রাবণ নিজের চুল চেপে ধরলো। বলল- “আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু আমাকে ও কিছু বলেনি।”
“বললেও আপনি উনার সাথে এমনটাই করতেন। বলুন বস ঠিক বলছি না?”
শ্রাবণ করুণ দৃষ্টিতে তাকাল ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা মুচকি হেসে বলল- “উনার মন জেতার জন্য আপনাকে অনেক নরম মনের মানুষ হতে হবে। কথায় কথায় রাগ করলে হারিয়ে ফেলবেন উনাকে।”
“এভাবে বলো না। আমি ওকে হারাতে পারবো না।”
“তাহলে যান, গিয়ে মাফ চেয়ে নিন।”
শ্রাবণ একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ফেলে বলল-
“ঠিক বললে আমাকে ধৈর্য সহকারে সব সামলাতে হবে। বাসায় যাই তাহলে। তুমিও যাও।”
ইর্তেজা মাথা নাড়াল। শ্রাবণ চলে গেল। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে আছে। আজ অনেক বড়ো মিথ্যে বলেছে সে। শুধু মাত্র সাগরিকার জন্য। এমনিতে মিথ্যে বললে তার নিজেকে অপরাধী মনে হয়৷ কিন্তু আজ মিথ্যে বলেও তার শান্তি লাগছে।
.
.
খুব অস্বস্তি হচ্ছে ইরিনার। সাঈদ যাওয়ার পর থেকে তার মন খারাপ ছটফট করছে। তার উচিত হয়নি ছেলেটাকে এসব বলা। এখন সে কি করবে বুঝতে পারছে না। সাঈদকে কল দিতে চেয়েও দিচ্ছে না। আচ্ছা কল করা কি ঠিক হবে? ইরিনা নিজের চুল চেপে ধরলো। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তার৷ তখনই দরজা খোলার শব্দ আসলো। ইরিনা এগিয়ে গেল হুইলচেয়ার নিয়ে৷ বাহিরে গিয়ে দেখে ইর্তেজা আর সাঈদ প্রবেশ করলো। ইরিনা সাঈদকে দেখে কিছুটা অবাক হলো। রাত বাজে ১০ টা, সে এখানে আসলো কেন? ইর্তেজা সাঈদকে বসতে বলে ঘরে চলে গেল৷ সাঈদ অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই বলল- “আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, তুমি এই সময়?”
“মাফ করবেন আবার আসার জন্য। ইর্তেজা রাস্তায় দেখে আমাকে জোর করে নিয়ে আসলো।”
ইরিন জবাব দিলো না। সাঈদ একবারো তার দিকে তাকাচ্ছে না। অভিমান হলো ইরিনার। সাঈদ আবার বলল-
“আমি জানি আপনার ভালো লাগে নি আমি আসায়৷ আপনার ভাই কতটা জেদি তা তো জানেনই। তাই আসতে বাধ্য হলাম।”
ইরিনার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না তার কতটা ভালো লাগছে সাঈদকে দেখে। সকাল থেকে মনে কষ্ট চেপে বসে ছিলো। এখন সাঈদকে দেখে তার শান্তি লাগছে। কিন্তু সাঈদ হয়তো অভিমান করেছে তার সাথে। কিছুক্ষণ পর ইর্তেজা আসলো। পুরোটা সময় কেও কারো সাথে কথা বলেনি। ইর্তেজা এসে সাঈদের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলল-
“সো ব্রো হাউ আর ইউ?”
“রাখ তোর ব্রো, কয়বার এসে ফিরে গিয়েছি তুই জানিস?”
“সরি দোস্তো, নতুন কাজ তাই ব্যস্ত থাকি।”
“কি এমন কাজ করিস জানতে পারি?”
ইর্তেজা তার বোনের দিকে তাকাল। ইরিনা এক ভ্রু উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইর্তেজা হাসতে হাসতে সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল- “তোমরা আমার উপর সন্দেহ করছো?”
“হ্যাঁ করছি, কি কাজ করিস যে আমাদের বলা যাবে না?”
“সময় আসলে বলবো।”
“তুই চাইলে আমাকে বলতে পারিস। দেখ আমি তো তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু।”
ইরিনা সাঈদের দিকে তাকাল। সাঈদ ইরিনার চাহনি দেখে বলল- “ইয়ে মানে, এভাবে দেখার কী আছে? আপনি ওর বড়ো বোন হয়তো লজ্জা পাচ্ছে বলতে। আমাকে বলুক, আমি তো ওর বেস্টফ্রেন্ড।”
ইর্তেজা বিরক্ত হয়ে বলল- “বেশি বলছিস এখন। আমি এমন কোনো কাজ করছি না যার দ্বারা লজ্জিত হবো।”
“আমাদের বল তাহলে।”
“এখন না, আচ্ছা তোমরা বসো আমি খাবার সাজাই।”
বলেই ইর্তেজা চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি আবার অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। ইরিনা, সাঈদ দুজনই চুপ। সাঈদ বার বার আড়চোখে ইরিনাকে দেখছে৷ ইরিনার দৃষ্টি তার ওড়নায়। সে তার ওড়না আঙুলে পেচাচ্ছে আবার খুলছে। সাঈদ দু’বার কেশে বলল-
“আপনি না-কি ডাক্তারের কাছে যেতে চান না চেকআপের জন্য।”
ইরিনা মাথা তুলে বলল- “ভালো লাগে না। ইর্তেজাকে অনেকবার বলেছি এখন এসব করে লাভ নেই।”
“আপনি সবসময় অতিরিক্ত ভাবনা চিন্তা করেন। তাও নেগেটিভ। পজিটিভ ভাবতে পারেন না?”
“তুমি বুঝবে না।”
বলেই ইরিনা মাথা নিচু করলো। সাঈদ মুচকি হেসে বলল-
“আমি সব বুঝি, তাই তো চাই আপনি তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যান। আপনি যখন সুস্থ হবেন সেদিন আমরা তিনজন দূরে কোথাও ঘুরতে যাব। আপনার সমুদ্র খুব পছন্দ তাই না? আমরা সমুদ্র দেখতে যাব।”
ইরিনা চোখ তুলে সাঈদকে দেখলো। সাঈদ হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা চেষ্টা করছে নিজের দৃষ্টি সরানোর কিন্তু পারছে না। সাঈদও অপলকভাবে তাকিয়ে আছে ইরিনার দিকে। যেন একে অপরকে শত বছর ধরে দেখে না। এখন দেখে সব তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। হঠাৎ সাঈদ খেয়াল করলো ইরিনার চোখের সামনে একটা পাপড়ি ভেঙ্গে পড়ে আছে। সাঈদ ধীরে ধীরে ইরিনার কাছে যেতে লাগল। ইরিনা অবাক না হয়ে পারলো না। তার হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গেল মিনিটেই। সাঈদ আলতো করে পাপড়িটা নিলো। সাঈদের ছোঁয়া পেয়ে ইরিনা চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মনে হচ্ছে তার হৃদয়ে বিস্ফোরণ ঘটবে। সাঈদ মুটকি হেসে বলল- “পাপড়ি, নিন নিজের ইচ্ছা আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রকাশ করুন।”

ইরিনা চোখ খুলল। সাঈদের মুখে থাকা হাসি ইরিনাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল- “উনার কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করতে হয়? উনি তো সবার মনের খবর রাখেন। যেটা সঠিক সেটাই করেন আমাদের জন্য।”
“হ্যাঁ, একদম ঠিক বললেন। ফেলে দেই তাহলে।”
বলেই সাঈদ পাপড়িটা ফেলে দিতে নিলো। সাথে সাথে ইরিনা তার হাত খোপ করে ধরে ফেলল। সাঈদ অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ইরিনার দিকে। ইরিনা মুচকি হেসে সাঈদের হাত ছেড়ে নিজের হাত মুঠো করে সাঈদের দিকে এগিয়ে দিলো। সাঈদ ইরিনার হাতের উপর পাপড়িটা রাখল। ইরিনা এক নজর পাপড়িটা দেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। চারপাশ অন্ধকার। সে কী চাইবে ভাবতে পারছে না। হঠাৎ করে অন্ধকার চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সাঈদের চেহারা। ইরিনা সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলল। সাঈদ ইরিনার চাহনি দেখে হেসে বলল- “কি হলো? চেয়েছেন কিছু?”
ইরিনা জবাব দিলো না। তার দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন। সাঈদ আবার বলল- “চাওয়া হয়ে গেলে ফুঁ দিন।”
ইরিনা আস্তে করে ফুঁ দিয়ে সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল। হঠাৎ তার ভয় করছে, খুব ভয়। চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নিজেকে বুঝাচ্ছে সে যা অনুভব করছে সব মিথ্যে৷ ইরিনা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। কান্নায় গলা ধরে আসছে তার। কেন নিজের মনকে কাবু করতে পারছে না। সে যে সব সীমা অতিক্রম করার চেষ্টায় আছে।

চলবে……