আষাঢ়ে প্রণয় সন্ধি পর্ব-০৩

0
227

#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৩

“মিস আজ একটু কম পড়ি।সন্ধ্যায় আমার একজন বান্ধবীর জন্মদিন। আসলে না গেলে রাগ করবে”

চিত্রা মৃদু হেসে বলল,,,আচ্ছা ঠিক আছে।আজ কম সময় পড়াবো।তাহলে ঝটপট নিজের পড়াগুলো দিয়ে দাও।কিছু অংক করিয়ে ছুটি আজ”

রুবাইয়া আঁখিজোড়া খুশিতে চিকচিক করে উঠে।দ্রুত নিজের পড়া দিয়ে দেয়।চিত্রাও কয়েকটি অংক করিয়ে বিদায় নেয়।বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হুট করে রুবাইয়ার চাচাতো ভাই আরান চিত্রার হাত ধরে ফেলে।চিত্রা মেজাজ বিগড়ে যায়। আগেও ছেলেটা তাকে বিরক্ত করেছে।সে ছাড় দেয়নি। তবে আজ মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছে এই ছেলে।হাত ছাড়িয়ে নেয় সে।আরান আবারও চিত্রার হাত ধরতে চায়।সে করুন কন্ঠে বলে,,,

“চিত্রা আমি সত্যি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি। দয়া করে আমাকে গ্রহণ করে নাও।তোমাকে সুখী রাখবো বিশ্বাস করো”

চিত্রা বহু কষ্টে এতোক্ষণ নিজেকে সংযত করে রেখেছিলো।এবার আর পারলো না থা*প্প*ড় মেরে বসলো তাকে।আরান গালে হাত দিয়ে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো চিত্রার পানে।চিত্রা আরানের কলার ধরে টেনে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।ছিপছিপে পাতলা শরীর হওয়ায় আরান চিত্রাকে বাঁধা দিতেও পারেনি।লম্বা চিত্রার মতোই।চিত্রার সাথে পেরে উঠার কোনো কারণও নেই।চিত্রা ফাইট জানে।সব পদ্ধতি, কৌশল তার শেখা।ফ্লোরে ফেলে দিলো।বসার ঘরে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে পরে।চিত্রা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আপনাদের এই অসভ্য ল*ম্প*ট ছেলেকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলবেন।আজ থা*প্প*ড় মেয়েছি কাল হাত ভেঙে দিবো।আমাকে স্পর্শ করার সাহস কোথা থেকে পায়?”

রুবাইয়া ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু শুনে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালো।রুবাইয়ার মা তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।রুবাইয়াদের যৌথ পরিবার।সবাই একসাথে থাকেন।রোহানের বাবা এসে তাকে থা*প্প*ড় মেরে বলল,,
“ছি ছি ছি এই দিন দেখার জন্য তোকে মানুষ করেছিলাম।বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে। চিত্রা মা আমরা সবাই ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে ক্ষমা করে দিও”

“আঙ্কেল আপনার ছেলেকে বলবেন আমার আশেপাশেও যেন তাকে না দেখি। যে পুরুষ নারীকে সম্মান করতে পারে না সে পুরুষ বলে গন্যই হয় না। আর আন্টি আমি আর রুবাইয়াকে পড়াতে পারবো না”

রুবাইয়ার মা দ্রুত চিত্রার কাছে এসে ওর হাত ধরে বলল,,“দয়া করে আমার মেয়েটাকে পড়িও মা। রোহান যা করেছে তার জন্য আমার সত্যি খুবই দুঃখিত। ক্ষমা করে দিও”

“দুঃখিত আন্টি আমি পারবো না। তবে আমাদের বাসায় যদি পড়তে পারে তাহলে আমি পড়াতে পারবো নাহলে না”

চিত্রা কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে আসে।রাস্তা আনমনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করছে সে,নারীদের সম্মান কেনো দিতে পারে না পুরুষ।কিছু হলেই যাচাই বাছাই না করেই দোষ দেয় নারীর। নারীই কেনো শুধু মুখ বুঝে সহ্য করবে সব।চিত্রা হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে চলে আসে।বাজে হয়তো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।কলিংবেল দিলে মরিয়ম সুলতানা এসে খুলে দেন দরজা। আজ আরেকটা মেয়ে পড়বে না।আগেই ফোন করে জানিয়েছে।বসার রুমে আরমান রহমান বসে চা খাচ্ছেন।চিত্রা ব্যাগ রেখে বাবার পাশে বসে।আরমান সাহেব বুঝতে পারেন মেয়ের কিছু একটা হয়েছে।চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে মেয়েকে নরম কন্ঠে বললেন,

“কি হয়েছে আম্মা তোমার। মন খারাপ নাকি?”

চিত্রা একটু সরে এসে বাবার বুকে মাথা রাখলো।এই মানুষটাকে সে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। আম্মা ডাকটা তার বুকে প্রশান্তির ঢেউ বয়ে আনে। তার বাবা তাকে বোঝে।এই যে তার এখন মন ভালো নেই তাও বুঝে ফেলেছে।আরমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার বলেন,,

“আম্মা তোমার মন কেনো খারাপ বলো আমাকে”

চিত্রা বাবাকে খুলে বলল সব। আরমান সাহেব মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বলেন,,
“তুমি একদম ঠিক করেছো আম্মা।কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করবে না।ছেলেটি তোমার হাত স্পর্শ করেছে কোন সাহসে।তুমি আরো দুই একটা থাপ্পড় মারতে।ওখানে পড়াতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আর”

“হুম আব্বু।সবাই কেনো এমন।নারীদের একটু সম্মান করলে কি হয়। আমরা ও তো মানুষ তাই না। ওরা মনে করে নারীদের মন নেই,পাথর”

“তুমি শান্ত হও আম্মা।সব পুরুষ সমান না।এখনো অনেক পুরুষই আছে যারা নারীদের সম্মান করে,শ্রদ্ধা করে।হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান নয় তেমনি সবাই এক না”

“হয়তো আছে আব্বু। তবে সমাজটা যদি একটু বদলাতো।আজ সকালে পাশের বাড়ির মেয়েটার সাথে বাজে একটা ঘটনা ঘটেছে।ছোট মেয়েটা কত ভয় পেয়েছিলো।ভ্যাগিস আমি ছিলাম”

“পাশের বাড়ি মেয়ে মানে যারা নতুন এসেছে?কি হয়েছে আম্মা”

চিত্রা সব বলল।তার আব্বুই তার বেস্টফ্রেন্ড।সব কথা সে তার আব্বুকে বলে।চিত্রা সোজা হয়ে বসলো।মরিয়ম সুলতানা চা নাস্তা এনেছেন।প্রহর ও ভদ্র ছেলের মতো সামনের সোফায় এসে বসেছে।সন্ধ্যার এই সময়টাতে সবাই একসাথে নাস্তা করে।আরমান সাহেব মেয়েকে উৎসাহিত করে বলেন,,

“তুমি এখানেও ঠিক করেছো।আম্মা আমি তোমাকে কখনোই বলবো না অন্যায়ের সাথে আপোষ করো।তুমি লড়বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাই হয়ে যাক না কেনো!”

চিত্রা মাথা নাড়ায়।আরমান সাহেব মেয়ের মন ভালো করতে প্রহরকে ফুসকা কিনে আনতে পাঠালো।প্রহর ও ভদ্র ছেলের মতো ফুসকা আনতে গেলো।আরমান সাহেব,চিত্রা এবং মরিয়ম সুলতানা বসে গল্প করছেন।চিত্রা কিছুক্ষণ গল্প করে নিজের রুমে চলে আসে।আকাশে চাঁদ উঠেছে। পূর্নিমার চাঁদ।আকাশের চাঁদটা যেমন একা সেও একা।নাহ!সে একা নয় তার বাবা আছে সাথে।যাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে,সম্মান করে এবং শ্রদ্ধা করে।

রাত বারোটা। শহরতলী অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে। রাস্তার পাশের বাতিগুলো বন্ধ। বিদুৎ নেই হয়তো।ছাদের কিনারা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা।পরনে হালকা গোলাপী রঙের সেলোয়ার-কামিজ।চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।তার নৃত্য দিনের অভ্যাস রাত বারোটায় ছাদে আসা। আশেপাশে গাছের পাতাগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে।দৃষ্টি তার সামনের রাস্তাতে স্থির। চিত্রার মন ভালো নেই।

আষাঢ় বিরক্ত হয়ে ছাদে এসেছে।রুমে মন টিকছিলো না।নতুন জায়গা মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।ছাদে এসে রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়ায় সে। নিস্তব্ধ চারপাশ।মৃদু হাওয়া বইছে। পরিবেশটা উপভোগ করছে আষাঢ়। হঠাৎ চোখ পড়ে তার পাশের ছাদে।যেখানে এক রমনী দাঁড়িয়ে আছে।চুলগুলো দুলছে বাতাসে।পেছনে ঘুরে থাকায় চেহারা দেখতে পেলো না আষাঢ়। তবে ধারণা করলো এটা চিত্রা।বাড়িটা যেহেতু চিত্রাদের এটা চিত্রা হতেই পারে। আবার না ও হতে পারে।তখনই চিত্রা সামনে ঘুরলো।আষাঢ় ঠিক ধরেছিলো এটা চিত্রা। চিত্রা আষাঢ়কে খেয়াল করলো। লোকটাকে তাকাতে দেখে বিরক্ত হলো চিত্রা।চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পিছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ শুনে পা দুটো আপনা আপনি থেমে যায়।

“মিস চিত্রা আমি কি আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?পরিচিত হতে পারি কি আমরা?”

চিত্রা আষাঢ়ের দিকে ঘুরে শক্ত কন্ঠ বলল,,,“আমি পরিচিত হতে আগ্রহী নই।আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন”

চিত্রা ধপধপ পা ফেলে চলে গেলো।আষাঢ় হতভম্ব হয়ে চিত্রার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। মেয়েটা এমন কেনো বলল!সে তো শুধু কথা বলতে চাইছিলো। ওহ সে তো ভুলে গিয়েছিলো মেয়েটা আলাদা সবার থেকে। তার ধীরে সুস্থে কথা বলা উচিত ছিলো।মেয়েটার প্রতি এতোটাই আগ্রহ জন্মেছে যে সামনাসামনি দেখে উত্তেজিত হয়ে পরেছিলো।মাথা চুলকে হেসে নেমে পরে ছাদ থেকে।

চিত্রা রুমে এসে বিছানায় বসে আছে।লোকটাকে তার খারাপ মনে হয়নি।তবে সে কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে পারবে না।ভালো আছে সে। কখনো নিজের জীবনে কাউকে জড়াবে না।একা থাকাই সব থেকে ভালো।তবে লোকটা কেনো ডাকছিলো তাকে।চিত্রা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। এইসব নিয়ে মোটেও ভাববে না সে।তবুও লোকটার উদ্দেশ্য খারাপ মনে হয়নি।চোখ দেখে সে এতুটুকু বুঝতে পেরেছে।মেয়েদের যে বিশেষ ক্ষমতা আছে। তারা বুঝতে পারে কে খারাপ নজরে তার দিকে তাকাচ্ছে আর কে ভালো!

“ধোঁকা আমি আর খেতে চাই না। এখন কাউকে বিশ্বাস করতেও ভয় হয়। আমার জীবনে দুটো পুরুষ ছিলো আছে এবং থাকবে।আর কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই”

চিত্রা সকাল সকাল তৈরি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হলো।এখান থেকে রিকশায় করে যেতে তার ১০-১৫ মিনিটের মতো লাগে।ভার্সিটিতে এসে সাজিয়াকে খুঁজতে থাকে।কল করে সে সাজিয়াকে।তবে সাজিয়া রিসিভ করে না।ক্যাম্পাসের শেষ দিকে আসলে সাজিয়াকে দেখতে পায়।সাজিয়া নিরব হয়ে বসে আছে। জায়গাটা দু’জনের ভীষণ প্রিয়। চিত্রার সাজিয়া ব্যতীত কোনো বান্ধবী নেই।মিহি ছিলো। তবে চিত্রা তার সাথে খুব কম কথা বলতো। তবে মিহি মেয়েটা ভালো ছিলো।আর হয়তো দেখা হবে না তাদের।অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে চিত্রা।সাজিয়ার পাশে এসে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে পরে চিত্রা।

“কি হলো ফোন রিসিভ করছিস না কেনো?মন খারাপ তোর?”

সাজিয়া উত্তর দিলো না।চিত্রা এবার একটু চিন্তিত হলো।মেয়েটা কখনো এমন করে না। তবে আজ কেনো এমন করছে।সে কাঁধ থেকে মাথা উঠালো।সাজিয়ার মুখোমুখি বসে বলল,,

“কি হয়েছে তোর এমন কেনো করছিস?তোর মামী কিছু বলেছে?”

সাজিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো।যেই হাসিতে লুকিয়ে আছে হাজারো লুকায়িত অনুরক্তি।এরপর মৃদুস্বরে শুধালো,
“কি হবে বল তো।মামী আর কি বলবে।বয়স তো অনেক হলো।বিয়ে তো করতেই হবে তাই নয় কি।বাইশে পা দিয়েছি গতমাসে।আর কতকাল আমাকে খাওয়াবে বসিয়ে”

“তুই কি তাদের তাকায় খাস বলতো।শুধু থাকিসই না হয় তাদের বাড়িতে।আমি এখনই যাবো ওই মহিলাকে একটা শাস্তি না দিলে আর হচ্ছে না।মাত্রা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে।আবারও বিয়ে ঠিক করেছে না?”

সাজিয়া চিত্রাকে উত্তেজিত হতে দেখে ওর গালে হাত রেখে বলল,,“বাদ দে ছেলেটা ভালো তোদের এলাকাতে থাকে।মামা চাইছে বিয়েটা দিয়ে দিতে।আমিও রাজি হয়েছি।আর কতোদিন বল ওনারা আমায় নিজেদের কাছে রাখবে।তুই চিন্তা করিস না”

চিত্রা নিজেকে সামলে বললো,,,“ছেলের নাম কি?”

সাজিয়া রিনরিনিয়ে বলল,,,“নিশীথ আহমেদ”

#চলবে