আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-০৭

0
3926

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ আর রহিম। তাদের পিছনে আরও দুই একজনকে দেখা যাচ্ছে। সামনের চেয়ারেই পায়ের উপর আরেকটি পা তুলে বসে আছে সেই মাস্ক পরিধানকারী মানবটি। বাম হাতে তার একটি রিভোলভা বিচরণ করছে। ডান হাতে মোবাইল। সম্ভবত কাউকে ফোন করছে সে। আকার ভঙ্গিমা তার অত্যন্ত স্বাভাবিক। তার এমন স্বাভাবিক আচরণেই সকলে ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। আসিফ আর রহিম বার বার শুকনো গলায় ঢোক গিলছে। সেই ব্যক্তিটির এমন স্বাভাবিক আচরণ হতে তারা অবগত নয়। বেশ কিছুক্ষন এইভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ হয়। সাথে সাথে মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি কথা বলে উঠে,

— মিড মাফিয়া রিক এই কি সেই ব্যক্তি যে তোমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ছিল? যদি সেই হয়ে থাকে তাহলে আমাকে আগে জানানো হয় নি কেন?

অপরপাশে কি বললো তা শুনা গেল না। মাস্ক পরিধানকারী ব্যক্তিটি এইবার গম্ভীর গলায় বলে,

— ওয়েল! ওয়েল! রিকের ব্যাপারে সকল ইনফরমেশন আমি চাই। সে আগে কি করতো না করতো, কোথায় যেত। কোন কোন গ্রুপের সাথে ও সংযুক্ত ছিল সব।

এতটুকু বলে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা ছেয়ে রইলো চারপাশে। এরপর মাস্ক পরিধানকারী ব্যক্তিটি এইবার হাল্কা চেঁচিয়ে বলে,

— উল্টো প্রশ্ন করার অধিকার আমি তোমাদের দেই নি। আগেই বলেছি আমরা কাছ থেকে কখনো কোন ধরনের জবাবদিহি তোমরা আশা করবে না। সো যা বলেছি তা করো।

তারপর আবার কিছুক্ষণ নিরবতা। মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি এইবার রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে,

— যা তোমাদের প্রয়োজন তা আমারও প্রয়োজন। নিশ্চয়ই জানো এইটা। এত সময় তো আর অযথা ব্যয় করছি না। নিজেদের মত কেয়ারলেস মনে করবে না আমায়। সামান্য একটা জিনিস সামলে রাখতে পারলে না তোমরা। উল্টো নিজের দলেই কালসাপ পুষে বসে ছিলে। জাস্ট রিডিকিলাস!

অপর পাশে থাকা ব্যক্তি কি বলছে তা এখনো অজানা। অতঃপর মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলে,

— তোমাদের এই ষ্টুপিড বিশ্বাসের পরীক্ষার জন্য আমরা কতটা পিছিয়ে গিয়েছি তা কি তোমরা জানো? এই পর্যন্ত এসেছি নিজের যোগ্যতায়। কাউরো দয়াতে নয়। আমি এইখানে তোমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে নয় বরং নিজের উদ্দেশ্য অর্জন করতে এসেছি। তোমাদের আগেই বলা উচিৎ ছিল রিকের কথা আমাকে। তাহলে এতটা সময় আমার ওয়েস্ট হতো না।
আমার উপর তোমাদের বিশ্বাস থাকুক আর নাই থাকুক আই রেয়ইলি ডোন্ট ইভেন কেয়ার। আমার যা চাই তা আমি অর্জন করেই নিব।

অতঃপর অপরপক্ষের কথা শুনে মাস্ক পরিধানকারী ব্যক্তিটি একটু শান্ত হয়। তার পর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে,

— নেক্সট টাইম আমি এই সব সহ্য করবো না। মাইন্ড ইট! এখন আমি যা বলছি তা করো। বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও। বায়!

এই বলে খট করে সে ফোনটা কেটে দেয়। মোবাইলটা সাইড টেবিলে রেখে ডান হাত দিয়ে কিছুক্ষণ মাথা চেঁপে বসে সে। তারপর রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে,

— আসিফ আর রহিম তোরা দুইজন পরের সপ্তাহ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হবি। সাথে আরও তিন-চারজন নিয়ে যাস। সেখানে গিয়ে ভালো মত সব তদন্ত করবি। আই নিড অল ইনফরমেশন গোট ইট? নাও লিভ!

আসিফ আর রহিম দুইজনেই মাথা নাড়ায়। তারপর দ্রুত পায়ে সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি এইবার চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। আজকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার।

____________________________________________

মেডিক্যালের ক্যান্টিনে বসে আমি এবং আনিশা সিঙ্গারা চিবুচ্ছি আর গল্প করছি। পাশেই পায়েল কোল্ড ড্রিংক্সের স্ট্র চিবুচ্ছে আর আমাদের কথা গুলো শুনছে। এমন সময় একটা হ্যাবলা টাইপের ছেলে এসে আমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। টেবিলের পাশে কাউরো উপস্থিতি বুঝতে পেরে আমরা তিনজনই মাথা তুলে তাকাই। দেখতে অতিসাধারণ একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, ডানদিকে সিথি কেটে চুলগুলো আঁচড়ে নিয়েছে। পড়নে ঢিলেঢালা একটি টি-শার্ট আর জিন্স পড়া। টি-শার্ট এর উপর এপ্রোন পড়ে আছে সে। বা হাতে কিছু বই ধরে আছে সে। দেখতেও একদম নিরহ ছেলেদের মত। আমি একবার তাকে ভালো মত দেখে চোখ ঘুরিয়ে সিঙ্গারা খাওয়াতে মনোযোগ দেই। আনিশা সেই ছেলেটির দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

— কি চাই?

আনিশার এমন সুক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে ছেলেটা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। সে আমতা আমতা করে আমার দিকে ইশারা করে বলে,
— এনাকে চাই!

কথাটি বুঝার সাথে সাথে আমি বিষম খেয়ে উঠি। মানে ছেলেটা বলে কি? আমাকে চাই মানে? এইদিকে পায়েল আর আনিশা ছেলেটার কথা শুনে ইয়া বড় হা করে তাকিয়ে থাকে। এমন কিছু একটা শুনার জন্য হয়তো ওরা কেউ প্রস্তুত ছিল না। আমি তো অনবরত কেশেই চলেছি। কেউ আমায় পানি এগিয়ে দিচ্ছে না বলে আমি একটানে পায়েলের কোল্ড ড্রিংক্সটা কেড়ে নেই তারপর তার গটগট করে খেয়ে নেই। অতঃপর নিজেকে সামলিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওই ছেলেটির দিকে তাকাই। দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— আমাকে চাই মানে কি? দেখতে তো নিরিহ প্রাণীর মত দেখতে কিন্তু কথাবার্তা এমন উড়নচণ্ডী টাইপ কেন?

ছেলেটা আমার কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,
— আপনি যা ভাবছেন তা না। আসলে আপনাকে চাই মানে আপনার সাথে আমার কিছু দরকার ছিল।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলি,
— কি দরকার শুনি?

ছেলেটা ভয়ে এক ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নেয়। তারপর ভীতু ভীতু কন্ঠে বলে,
— আই নিড ইউর হেল্প। আমি “এনাটমি” এর থার্ড চ্যাপ্টারটা তেমন ভালো বুঝি না। কয়েকটা পয়েন্ট তি একদম বুঝি না। আপনি তো “এনাটমি” সাবজেক্টটাতে বেশ পারদর্শী। তাই বলছিলাম কি আমাকে যদি একটু বুঝিয়ে দিতেন।

ছেলেটার এমন ভীতু ভিত্তিক কন্ঠ শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পায়। আমি হাসি থামিয়ে রাখতে না পেরে হেসে দেই। আমার সাথে সাথে পায়েল আর আনিশাও হেসে দেয়। আমাদের তিনজনের এমন দম ফাটানো হাসি দেখে ছেলেটা বোকাবনে যায়। আমি কোন মতে হাসি থামিয়ে বলি,

— জাস্ট এতটুকু কথা এত ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে হয়? সোজাসাপটা ভাবে বললেই হতো। তুমি ক্লাস শেষে ক্লাসেই থেক আমি বুঝিয়ে দিব নে। আর আমরা তো ব্যাচমেট তাই আমাকে আপনি বলতে হবে না।

ছেলেটা প্রতিউত্তরে মেকি হাসি দেয় আর দুই পাশে মাথা দুলায়। আমি স্মীত হেসে বলি,
— তোমার নামই তো জানা হলো না। তোমার নাম কি?

ছেলেটা হাল্কা নড়েচড়ে উঠে বলে,
— শুভ।

আমি হাল্কা হেসে আমার পরিচয় দেই সাথে আনিশা আর পায়েল এরও। সে কুশল বিনিময় করে নেয়। আমরা ওকে আমাদের সাথে বসতে বললে সে প্রথমে সংকচ করছিল কিন্তু অতঃপর বসে। অল্প সময়ের মাঝেই বেশ মিশে যায় আমাদের সাথে। ছেলেটা ভারী লাজুক প্রকৃতির। তাই কথাটা কমই বলে। কিন্তু বেশ মিশুক। কথায় কথায় জানতে পারি সে গ্রাম অঞ্চল থেকে এসেছে। আমরা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যাই।

_____________________________________________

ক্লাস শেষে আমি শুভকে পড়া বুঝিয়ে দিতে থাকি। আনিশা আর পায়েলের দেরি হচ্ছিল বিধায় তারা চলে যায়। ক্লাস রুমে আমি আর শুভ বাদে আরও কয়েকজন ছিল। ওরাও পড়ছিল। বেশকিছু ক্ষণ পর ডাঃ রিয়ান আসে রুমে। রিয়ানকে দেখার সাথে সাথে অন্যসব স্টুডেন্টরা দাঁড়িয়ে যায়। আমি আর শুভ শেষ সারির দিকে কিনারে বসেছিলাম বিধায় ডাঃ রিয়ানকে আমাদের তেমন চোখে পরে নি। তিনি সবাইকে বসতে বলে চারদিকে চোখ বুলাতে শুরু করে। অবশেষে শেষ সারির দিকে তাকাতেই আমাকে দেখতে পায়। আমিও তখন শুভর সাথে হেসেই কথা বলছিলাম। হুট করে সামনে তাকাতেই ডাঃ রিয়ানের সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে যায়। বেশ তীক্ষ্ণ ছিল তার দৃষ্টি ভঙ্গি। তার দৃষ্টি দেখেই আমার বুঝতে দেরি নেই যে সে আমার খোঁজেই এইখানে এসেছেন। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকি। সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় শুভর ডাকে আমার ধ্যান ভাঙ্গে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে স্মীত হেসে আবার পড়া বুঝিয়ে দিতে থাকি। ডাঃ রিয়ান তখন কিছু না বলে গটগট করে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর যখন পড়া বুঝানো প্রায় শেষের দিকে তখন পিওন এসে বলে যে ডাঃ রিয়ান আমায় ডাকছে। আমি মাথা দুলিয়ে বলি ঠিক আছে। আমি শুভকে বলি যে বাকি পড়া আমি কালকে বুঝিয়ে দিব নে। আজকে যেতে হবে। শুভ আচ্ছা বলে ব্যাগ গুছাতে থাকে। আমি ওর পাশ কাটিয়ে চলে আসি। ডাঃ রিয়ানের কেবিনের সামনে এসে টোকা দেই। একটু পর দরজা খুলে আসে। আমি ভিতরে প্রবেশ করতেই ডাঃ রিয়ান বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে দেন। তার এহেম কান্ডে আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। অতঃপর আমি তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে করার চেষ্টা করতে নিলেও তার রক্তিম জোড়া চোখ দেখে চুপসে যাই। শুকনো গলায় ঢোক গিলতে থাকি। সে ধীর গতিতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে আর আমি পিছে যেতে থাকি।

#চলবে