আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-০৬

0
3498

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_06
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

চেয়ারে সাথে হাত পাগুলো খুবই শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে এক যুবক ছেলেকে। চোখ আর মুখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। ছেলেটি ক্রমাগত ছটফট করেই চলেছে যার জন্য হাতে আর পায়ে তার কিছুটা নীলচে দাগ বসে গিয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে গোঙ্গাচ্ছে সে। তার থেকে তিন হাত দূরেই মাথার উপর একটি নিম্ন মানের হলুদ বর্ণের বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় রুমটা আবছা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বিচ্ছিরি এক গন্ধ নাকে এসে প্রতিনিয়ত বারি খাচ্ছে। সম্ভবত রুমের কোনো এক কিনারে ইদুর মরে আছে। গন্ধে ছেলেটির দমবন্ধ হয়ে আসছে। ভিতরের নাড়িভুঁড়ি সব উল্টিয়ে আসছে। মন চাচ্ছে রুমটি থেকে কোনমতে দৌঁড়ে পালাতে। কিন্তু এইটা কি আদৌ সম্ভব?
বেশকিছুক্ষণ পর দরজার খুলার শব্দে যুবকটি স্থির হয়ে যায়। পায়ের আওয়াজ মৃদু থেকে ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হচ্ছে। যুবকটি মনে এইবার একটু একটু করে ভয় এসে ভীর করতে শুরু করে। কাঠ গলায় কয়েকবার সে ঢোক গিলে নেয়। লোকটির উপস্থিতিটি তীব্র ভাবে অনুভব করতে থাকে সে। লোকটি হুট করে যুবকটির চোখ এবং মুখ খুলে দেয়। শক্ত করে চোখ বাঁধা ফলে চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। বেশকিছুক্ষ্ণ সময় লাগে নিজের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে। অতঃপর সামনেই তাকাতে দেখে একজন সুগঠন দেহের মানব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যার উপর থেকে নিচ কালোর আবরণে ঘেরা আর মুখে কেমন এক উদ্ভট মাস্ক পড়া। মুখটি মাস্কের আড়ালে লুকায়িত থাকলেও নয়ন দুইটি তার স্পষ্ট। রক্তিম বর্ণ চাহনিতে তার হিংস্রতায় পরিপূর্ণ। বা হাতে তার ধারালো ছুরি। যা সে অনাবরত ঘুরিয়ে চলেছে। ছেলেটি প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষণে সাহস জুগিয়ে বলে,

— কে আপনি? আমাকে এইখানে কেন আনা হয়েছে?

মাস্ক পরিধানিত ব্যক্তিটি অতি তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
— জিনিসটা কোথায় এবং কার কাছে?

কথাটি শুনার সাথে সাথে ছেলেটি থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিন্তু তাও মুখের ভাবভঙ্গিতে তা প্রকাশ না করে বলে,
— আমি জানি না আপনি কিসের কথা বলছেন। আমি এইসব সম্পর্কে কিছু… আয়ায়ায়া!!

কথাটি শেষ করার আগেই মাস্ক পরিধানকারী লোকটি যুবকটির হাতের উপর সেই ছুরিটা গেধে দেন। যুবকটি ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। বার বার আর্তনাদ করতে থাকি। কিন্তু তাতেও মাস্ক পড়া ব্যক্তির বিন্দুমাত্র মায়া হয় না। সে অতিশান্ত গলায় বলে,

— এখনো বলবি যে তুই কিছু জানিস না? সময় থাকতে বলে দে। তানা হলে পরিনতি খুব বাজে হবে।

এই বলেই হাতে গেথে থাকা ছুরিটা সে হাল্কা মোচড় দেয় সে। সাথে সাথে যুবকটি আর্তনাদভরা চিৎকার দিয়ে উঠে আর বলে,
— ভাই আমি সত্যি জানি না সেটা এখন কই। শুধু এতটুকু জানি লাস্ট সেটা মিড মাফিয়া রিকের কাছে আছিল। যে এখন নিখোঁজ। সূত্র থেকে জানা গেছে যে তাকে শেষবারের মত চট্টগ্রামে দেখা গিয়েছিল। এরপর থেকেই সে লাপাত্তা সাথে সেটাও।

মাস্ক পরিধান ব্যক্তি এইবার পৈচাশিক হাসি হাসে। তার যা জানার দরকার ছিল তা সে জেনে গিয়েছে। ফুল ইনফরমেশন না পেলেও যা পেয়ে সেটাই অনেক। মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি এইবার সটান হয়ে দাঁড়ায়। তারপর অতিশান্ত স্বরেই বলে,

— থেংক্স আ লোট ফোর দ্যা ইনফরমেশন। নাও ইউ আর ফ্রি।

কথাটি শুনে যুবকটা কিছুটা স্বস্তি পায়। সে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিতে চারদিকে গুলির বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। পর পর চারটে গুলির আওয়াজ শুনা যায়। এর পর সব আগের ন্যায় সর্বশান্ত। মাস্ক পরিধান ব্যক্তিটি রিভোলভার ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,

— কাম খাতাম জারুরাত ভি খাতাম।

এই বলে সে শিস বাজাতে বাজাতে চলে যায়। আর চেয়ারের উপর পড়ে থাকা সেই যুবকটির লাশ। মাথার মাঝ বরাবর দিয়ে গড়গড়িয়ে পড়ছে লাল রক্ত।

_____________________________________________

পড়ন্ত বিকেলের শেষ ভাগ চলছে। আকাশ আজ পুরো রক্তিম লাল। পশ্চিম আকাশ হতে সূর্যের মৃদু রশ্মি এখনো বিধ্যমান। দূর আকাশে কিছু সংখ্যক পাখিদের ঝাঁক দেখা যাচ্ছে। হয়তো নিজ নিজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছে তারা। চারদিকে ভ্যাপ্সা গরম। মাঝে মধ্যে মৃদু মৃদু বাতাস বইসে। রাস্তায় এখনো প্রচুর জ্যাম। বার বার গাড়িচালকেরা অকারণেই হর্ণ বাজিয়ে চলেছে। যা আস্তে আস্তে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের আনাগোনায় রাস্তায় এখনো অনেক।এই গরমে সকলের অবস্থা একদম বীভৎস। অবশ্য হওয়ারই কথা। ঢাকা শহর যে পরিমাণে কোলাহলপূর্ণ।

ছাদের একটি কোনে দাঁড়িয়ে এইসবই আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। বিল্ডিংটা রাস্তার পাশে হওয়ায় এইসব সচরাচর চোখে পড়ে। হঠাৎ কাকের কর্কশ কন্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠি। পাশে তাকাতেই দেখি একটি কাক ছাদের কার্নিশের অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। কাকটি আমায় দেখার সাথে সাথে উড়ে চলে যায়। হয়তো এই মুহূর্তে ছাদে সে কাউকে আশা করে নি৷ আমি এইবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছাদের দিকে নজর বুলাই। ছাদের বেশির ভাগ কোনা জুড়েই হরেক রকমের ফুলের গাছ। আমি আমার পাশে তাকাতেই গন্ধরাজ আর রজনীগন্ধা গাছটি চোখে পড়ে। ফুল ফুটে উঠেছে তাতে। আমি একটু নিচু হয়ে ফুলটির গন্ধ নেই। তারপর পাশে তাকাতেই সাদা কাঞ্চন , বেলী, জবা, কামিনী, নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী ফুলের গাছগুলো চোখে পড়ে। সারাবছর জুড়েই এই ফুলগুলো ফুটে বিধায় তাদের প্রতি কেউ তেমন আকর্ষণবোধ করে না। তাই কাছেও আসেও না তেমন। কিন্তু আমার কেন জানি এইগুলো বেশি ভালো লাগে। আমি আলতো হাতে ফুলগুলো ছুঁয়ে দিলাম। অতঃপর একটা বেলিফুল ছিঁড়ে নিজের কানের পাশে গেধে নেই। হুট করেই নিজেকে দেখার তীব্র আকাঙ্খা জাগে যে আমায় কেমন দেখাচ্ছে। তাই ছুটে যাই নিচে। বাসার ভিতরে ঢুকে একবার চারদিক পর্যবেক্ষণ করে নেই। পুরো বাসাটা জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। হওয়ারই কথা। আঙ্কেল রাতে আসবে। আন্টির ননদের শ্বাশুড়ি নাকি হসপিটালে এডমিট তাই তিনি তাকে দেখতে সেখানে গিয়েছে। ডাঃ রিয়ান রুমেই আছেই কিন্তু বন্ধ দরজার আড়ালে কি করছেন আল্লাহ মাবুদ জানে। আমি তেমন কিছু না ভেবে নিজের রুমের দিকে যেতে নেই। এমন সময় কানে গিটারের মধুর ধ্বনি এসে বারি খায়। সাথে সাথে আমি থমকে যাই। ধ্বনিটি ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। আমি সর্তক দৃষ্টিতে এইদিক সেইদিক তাকাই। বুঝার চেষ্টা করি কোথ থেকে ধ্বনিটা আসছে। বুঝতে পারি আওয়াজটা ড্রয়িংরুমের বারান্দা থেকে আসছে। আমি এইবার সেইদিকে ছুটি। দরজার কাছেই আসতে দেখি রিয়ান গিটার হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বাজাচ্ছে। আর গুনগুন করে গাইছে,

❤️ আমার সকল অভিযোগে তুমি
তোমার মিষ্টি হাসিটা কি আমি?
আমার না বলা কথার ভাঁজে
তোমার গানের কত সুর ভাসে!

তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বোনা আছে!
আমার হাতের আঙুলের ভাঁজে
তোমাকে নিয়ে কত কাব্য রটে!

ভুলিনি তো আমি
তোমার মুখে হাসি
আমার গাওয়া গানে তোমাকে ভালোবাসি

আসো আবারও কাছে
হাতটা ধরে পাশে
তোমায় নিয়ে যাব আমার পৃথিবীতে
এই পৃথিবীতে….❤️❤️

আমি দরজার পাশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গানটা অনুভব করছি। গানের প্রতেকটা লাইন একদম বুকে গিয়ে লাগছিল। গানের প্রত্যেকট লাইন আবেগপূর্ণ ছিল। তার গলা যে এত মিষ্টি তা আমার আগে জানা ছিল না। হঠাৎ করেই টনক নাড়ে যে তিনি এত আবেগ নিয়ে কার জন্য গাইলেন। তাই আমি আর থাকতে না পেরে আনমনে বলে উঠি,

— এত আবেগ নিয়ে কার জন্য গাইলেন আপনি?

আমার আওয়াজ শুনে ডাঃ রিয়ান কিছুটা চমকে উঠে। দরজার পাশেই আমাকে দেখতে পেয়ে নিজেকে সামলে নেয় সে। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বললেন,
— যার জন্য আমার আবেগ কাজ করে তার জন্য। যে আমার প্রত্যেক অনুভূতির ভাঁজে বাস করে। গানের প্রত্যেকটা লাইনেই তো তার জন্য ছিল। প্রত্যেকটা চরণ তাকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া। কিন্তু এইটা সে আদৌ বুঝবে কি না জানি না।

ডাঃ রিয়ান কথা গুলো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন। তার চাহনি ছিল আবেগপূর্ণ। কিছু না পাওয়ার আকাঙ্খা। আমি কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু কন্ঠে বলি,

— একদিন সে ঠিকই বুঝবে। আর সেইদিন নিজের হাতটিও এগিয়ে দিবে আপনার পৃথিবীতে যাওয়ার জন্য।

ডাঃ রিয়ান মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাল্কা ফু আমার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দেন। তারপর অতিমিষ্ট স্বরে বলেন,

— সুন্দর লাগছে তোমায়।

এই বলে তিনি আমার পাশ কাটিয়ে চলে যান। কিন্তু আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। গাল দুটো লাল হয়ে আসছিল। তার কথায় কেন যেন আমার বেশ লজ্জা করছিল। তার অতিসামান্য একটি মনের মধ্যে ভালো লাগার ঢেউ তৈরি করে দিচ্ছিল। এতক্ষণ নিজেকে আয়নাতে দেখার জন্য বেকুল হয়ে গেলেও এখন আর আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। তাও বেহাইয়া মনটি বার বার জানতে চাইছে, ” আসলেই কি সুন্দর লাগছে আমায়?” কিন্তু না আমি তো আজ নিজেকে দেখবো না। থাকুক না কিছু জিনিস অজানা। আমি চোখ বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলি,

— আজকের জন্য আয়না দেখা আমার জন্য নিষিদ্ধ। একদম নিষিদ্ধ!

#চলবে