#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_15
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
নিজের শ্বশুরবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে পায়েল। পাশেই তার আদিব। সামনের দিকে আদিবের বড় আপু আর দুলাভাই। চারজনের
চেহেরাতেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। বাসার ভিতরে ঢুকার পর ঠিক কি হতে পারে তাই নিয়েই সকলের যত শত চিন্তা। গুমোট ভয় বাসা বেঁধেছে সকলের মনে। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে আদিবের বড় আপু মিশ্মি অতি সাহস নিয়ে দরজার বেল টিপ দেন। বেশ কিছুক্ষণ পর এক মাঝ বয়সী মহিলা দরজা খুলে দ্যান। গায়ের রঙ শ্যামলা। পড়নে তার হাল্কা রঙের কুঁচিবিহীন সুতি শাড়ি। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। অতি মায়াবী তার মুখখানি। বয়সের ছাপ এখনো পড়ে নি। সম্ভবত তিনিই আদিবের মা। তিনি মিশ্মি আপুকে দেখার সাথে সাথেই চওড়া এক হাসি দেন। আদুরে সুরে মিশ্মি আপু ও তার বর রাশেদকে ভিতরে আসার জন্য আহ্বান জানান। তাদের কথা শুনে সিউর হওয়া গেল যেন তিনিই আদিবের মা ইসমি বেগম। মিশ্মি আপু আর রাশেদ ভাই দুইজনে স্মিত হেসে ঘরে ঢুকে পড়ে। অতঃপর আদিবের মা এর নজর যায় আদিব আর পায়েলের উপর। একটু নিচেই তাকাতেই তিনি দুইজনের হাত একত্রিত দেখতে পান। সে সেইদিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকেন। অতঃপর মাথা উঠিয়ে আদিব আর পায়েলের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকান। তারপর গলা ঝেড়ে আদিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
— বাবা এই মেয়েকে?
ইসমি বেগমের কথায় আদিব একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে বলে,
— ও আমার স্ত্রী আম্মু বিয়ে করেছি আমি ওকে।
___________________________________________
ড্রয়িং রুমের পরিবেশটা একদম ছমছমে। পিন পিন নিরবতা বিরাজমান করছে চারদিকে। সকলের মধ্যেই গাম্ভীর্যতা ছেয়ে আছে। সোফার এক পাশে একজন মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে। পড়নে সাদা পাঞ্জাবি পড়া, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। পান খাওয়ার ফলে তার ঠোঁট দুটো একদম টুকটুকে লাল হয়ে আছে। শরীরের বান এখনো বেশ শক্ত। বুঝাই যাচ্ছে যুবককালে বেশ পরিশ্রমী ছিলেন। চোখে মুখে তার গাম্ভীর্যতা ছেয়ে আছে। সাথেই অকপট রাগ। তিনি বরং আর কেউ নন আদিবের বাবা আমির শেখ। তারই পাশে ইসমি বেগম বসে আছে। তার চোখে মুখে থমথম ভাব। সাথে এক রাশ বিস্ময়। তিনি হয়তো আশা করেন নি যে তার ছেলে এমন এক এলাহি কান্ডের মত কিছু করতে পারে।
তাদের দুইজনের উল্টো পাশেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আদিব আর পায়েল। তাদের থেকে ছয় হাত দূরেই বা পাশের দিকে মিশ্মি আর রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাক তাদের ভাব-ভঙ্গি। অবশেষে নিরবতা পেরিয়ে আমির সাহেব গলা ঝেড়ে আদিবকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— আমি যা শুনেছি তা কি ঠিক? তুমি এই মেয়েকে বিয়ে করেছ?
আদিব মাথা নিচু করেই বলে,
— যা শুনেছ তাই ঠিক। আমি পায়েলকে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে করেছি।
আমির সাথে গভীর নয়নে আদিবের তাকিয়ে বলে,
— তোমাদের সম্পর্ক কত দিনের?
আদিব নিচু স্বরেই বলে,
— কয়েকমাসের ব্যবধানে ২ বছর পূর্ণ হবে।
আমির সাহেব এইবার গলা উঁচু করে বলে,
— তা এইভাবে না জানিয়ে বিয়ে করার কারণ জানতে পারি কি? এমন তো নয় যে আমরা প্রেম বিদ্বেষী। তা না হয় মানা যেত তুমি আমাদের বলতে পারো নি। কিন্তু এইখানে তো এমন কিছুই নয় তাহলে না জানিয়ে বিয়ে করার মানে কি? তোমার মত দায়িত্ববান ছেলে যে এমন একটি কাজ করতে পারে তা ভাবাই বাহুল্য।
আদিব মাথা নিচু করে বলে,
— পরিস্থিতি এমন ছিল যে সেই মূহুর্তেই আমাকে চট জলদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যদি আমি তখন এমন এক ডিসিশান না নিতাম তাহলে হয়তো সারাজীবনের জন্য ওকে হারাতে হতো।
এই বলে আদিব আড়চোখে পায়েলের দিকে তাকায়। আমির সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করেন,
— কি এমন পরিস্থিতি ছিল যে তোমায় এমন এক স্টেপ নিতে হলো শুনি?
আদিব একবার পায়েলের দিকে তাকায় তারপর দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে শুরু থেকে সব বলতে শুরু করে। সব শুনে সকলে বাকরুদ্ধ। ইসমি বেগম অবিশ্বাস্য সুরে বলেন,
— তার মানে এই মেয়ে বন্ধ্যা?
ইসমি বেগিমের কথাটা যেন পায়েলের বুকে কথাটা তীরের মত গিয়ে বিঁধে। ভিতরটা একদম শূন্যতায় ভরে যায়। কান্নাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আসে। কথাটা তেতো হলেও সত্য। এক অপ্রিয় সত্য। যা সে কোন দিনও বদলাতে পারবে না। আদিব গলা সামান্য উঁচু করে বলে,
— হুম ও বন্ধ্যা। তো তাতে কি হয়েছে?
ইসমি বেগম উঁচু কন্ঠে বলে,
— এমন মেয়েকে বিয়ে করার মানে কি?
আদিব সোজাসাপ্টা ভাবেই বলে,
— ভালবাসি আমি এই মেয়েটাকে। তাই বিয়ে করেছি।
ইসমি বেগম কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলেন,
— যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা কি তুই জানিস? যেখানে কোন বাচ্চাই নেই সে সম্পর্ক কোন মায়া, টান কিছুই নেই। আর না সেই সম্পর্ক শক্ত। কিসের উপর টিকে থাকবে এই সম্পর্কটি? আর সবচেয়ে বড় কথা এই মেয়ে তো তোর যোগ্যই না।
কথাগুলো শুনে পায়েলের চোখ দিয়ে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। মাথা পুরোটাই নুয়ে আসে। পায়েল জানতো এমন কিছু কথাই তাকে শুনতে হবে। সেজন্যই সে আগে থেকে নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল। কিন্তু তাও এখন কথাগুলো নিয়ে পারছে না। দূর্বল হয়ে পড়ছে। এইদিকে আদিব কথাগুলো শুনে বেশ রেগে যায়। সে গলা উঁচু করে বলে,
— কিসের সাথে কি মিলাচ্ছ তুমি? তুমি এত অত্যাধুনিক চিন্তার মানুষ হয়ে কিভাবে এই কথাটি বলছো? তুমি কিভাবে বলতে পারো এই সম্পর্ক টিকবে না? বলো? একটা সম্পর্ক কখনো একটা বাচ্চার উপর টিকে থাকে না।
“একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে দুইজন ব্যক্তির বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। তাদের মনোভাবের স্নিগ্ধতা দিয়ে। দুইজনের প্রতি দুইজনের সম্মানই একটি সম্পর্কে মায়া, মহব্বত, টান সৃষ্টি করে।”
এইখানে তো বাচ্চার কোন অবদান নেই। নিজের জীবনসঙ্গীর প্রতি যদি সামান্য পরিমাণ সম্মান থাকে তাহলে সে সম্পর্কে যত যাই হোক ফাটল ধরতে পারে না। আর আমাদের সম্পর্কে সম্মান জিনিসটা শুরু থেকেই আছে। আর তুমি যেন কি বলছিলে ও আমার যোগ্য না তাই না? তাহলে তো আপুও দুলাভাইয়ের যোগ্য না তাই না? বিয়ের এত বছর হয়ে গেল তবুও আপুর এখন পর্যন্ত বাচ্চা হয় নি। তাহলে কি দুলাইভাইয়ের ও উচিৎ আপুকে ছেড়ে দেওয়ার? তার আর পায়েলের মধ্যে তফাৎ কোথায়?
আদিব একটু থেমে মিশ্মির দিকে তাকিয়ে বলে,
— সরি আপু! আমি তোকে মাঝে আনতে চাই নি আর না তোকে আঘাত করে কিছু বলতে চেয়েছি। শুধুমাত্র আম্মুকে বুঝানোর জন্য তোকে মাঝে আনতে হলো। আম্মুর বুঝা উচিৎ বাচ্চাই সব নয়। তুই আর দুলাভাই কি সুখী না তোদের সাংসারিক জীবনে। বাচ্চা কি আদৌ তোদের মধ্যে কোন ফ্যাক্ট বল?
মিশ্মি ধরা কন্ঠে ইসমি বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— মা তুমি না আমায় একবার বলেছিলে,
“একটা সম্পর্কে বাচ্চা ততোক্ষণ তুচ্ছ যতক্ষণ না আমরা সেই সম্পর্কে বাচ্চার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখি।”
তাহলে আজ আদিবের বেলায় এই কথা কেন? শুধু মাত্র আমি তোমার মেয়ে আর পায়েল অন্য বাড়ির মেয়ে বলে? “অন্যের ঘরে উঁকি দেওয়ার আগে নিজের ঘরের দিকে তাকাতে হয়।” ভুলে যেও না।
এই বলে মিশ্মি হুট করে ফুঁপিয়ে উঠে। রাশেদ তা দেখার সাথে সাথে তাকে আগলে নেয়। আর আদিবকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় সে মিশ্মিকে সামলিয়ে নিবে। আদিব কিছু না বলে ইসমি বেগমের কাছে চলে যায়। মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে ইসমি বেগমের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,
— আমি জানি আম্মু। তুমি যা বলছো তা সমাজের নিজের অবস্থানটা সামনে রেখে বলছো। আবার নিজের বংশবৃদ্ধির কথাগুলো ভেবে এইসব বলছো। কিন্তু একবার পায়েলকে আপুর জায়গাটা রেখে দেখ। ওকে আলাদা না ভেবে নিজের মেয়ে ভেবে দেখ। আপু যে কষ্টে আছে পায়েলও সেই কষ্ট আচ্ছে। আল্লাহ যদি রহমত প্রদান করে তাহলে হয়তো আপুর কষ্ট লাঘবও হতে পারে কিন্তু পায়েলের? ও তো সারাজীবনের জন্যই এই কষ্ট বয়ে বেড়াবে। ওর কষ্টটা কি আদৌ কেউ কখনো উপলব্ধি করতে পারবে? একজন নারীর কাছে মা হওয়ার সুখটা কেমন তা তোমার থেকে কে ভালো জানবে? তুমিও তো মা, তাই না! আপু আর পায়েলের মত মেয়েদের যদি সবাই এই সমাজ থেকে তুচ্ছ করে দেয় তাহলে ওরা যাবে কই? তাদের কি অধিকার নেই সংসার করার? একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার?
সমাজের চিন্তাভাবনা পাশে রেখ দাও আম্মু। যেই সমাজ এক বাচ্চা মেয়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের দায়ভার ওকেই ঘোষিত করে সেই সমাজ আর যাই হোক কখনোই ভালো কিছু করবে বলে আশা করা যায় না। তাই বলছি, আম্মু পায়েলকে এইসব তুচ্ছ বিষয়ের কারণে অবজ্ঞা করো না। এই একটা কারণের জন্য কখনোই ওকে জার্জ করো না। সকলের মধ্যেই কম বেশি ত্রুটি আছে। কেউ পার্ফেক্ট না আম্মু। বুঝার চেষ্টা করো। যদি আল্লাহ তৌফিক দান করে থাকেন, আমরাও কোন না কোন ভাবে বাবা-মা ডাকটা শুনতে পারবো। তুমি না বলো, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। তাহলে এখন কেন খারাপটা ভাবছো?
সব শুনে ইসমি বেগম ছলছল চোখে আদিবের দিকে তাকায়। পাশ থেকে আমির সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— আদিব যা বলছে তা ঠিকই বলছে মিশ্মির মা। যা হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে। এখন আর সে বিষয় নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। যা ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে।
ইসমি বেগম নিজের চোখ মুছে নিয়ে পায়েলের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে তার সামনে আসতে। পায়েলে তা দেখে গুটিগুটি পায়ে ইসমি বেগমের দিকে এগিয়ে যায়। পায়েল সামনে আসতেই তিনি দাঁড়িয়ে যান। অতঃপর নিজের হাতের সর্ণের চিকন চুড়ি দুইটি খুলে পায়েলের হাতে পড়িয়ে দেন। পায়েলের হাত চিকন-চাকন হওয়ায় চুড়িগুলো ওর হাতে ঢুকে যায়। পায়েল ছলছল চোখে ইসমি বেগমের দিকে তাকাতেই ইসমি বেগম পায়েলের গালে হাত রেখে বলে,
— একটু আগের বলা কথাগুলোর জন্য মাফ করে দিও। আমার কথাই নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছ তুমি তাই না।
পায়েল চটজলদি বলে উঠে,
— না না আন্টি! আপনি মাফ চাইবেন না। আমি কষ্ট পাই নি। একজন মা হিসাবে আপনি আপনার সন্তানের ভালোটাই বিবেচনা করেছেন। আর এইটাই স্বাভাবিক। তাই আমি কিছু মনে করি নি।
ইসমি বেগম স্মিত হাসেন। তিনি পুরোপুরি ভাবে না হলে আংশিকভাবে পায়েলকে মেনে নিয়েছেন। হয়তো সময়ের সাথে সাথে পায়েলকে পুরোপুরিভাবে আপন করে নিবে। আমির সাহেব গলা ঝেড়ে বলেন,
— এই বিষয় নিয়ে যেন এই বাসায় আর কোন কথা না উঠে। মিশ্মির আম্মু তুমি যাও নববধুকে স্বাগতম জানানোর ব্যবস্থা করো।
আদিব সংকোচ ভরা কন্ঠে আমির সাহেবকে জিজ্ঞেস করে,
— তার মানে বিয়েটা কি তোমরা মেনে নিয়েছ?
আমির সাহেব সামনে ঝুঁকে আদিবের পিঠে চাপড় মেরে বলেন,
— আপনার কি এতে সন্দেহ আছে?
আদিব মাথার পিছে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— না!
____________________________________________
আকাশে অজস্র মেঘের ভেলার রাজত্ব। অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে তারা ছুটে চলেছে। সূর্যমামাও সময় সুযোগ পেলে বেড়িয়ে আসছে মেঘের আড়াল থেকে। মৃদু পরিমাণে হিম বায়ু বইছে। গায়ের সাথে বায়ুর সংস্পর্শ হতেই কেমন শিহরণ কাজ করছে। আমি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে এপ্রোনটা ভালো মত জড়িয়ে নিয়েছি। হুট করেই বেশ শীত লাগছে। আবহাওয়া পরিবর্তন হওয়ায় এমনটা লাগছে। রিয়ানের আজ সার্জারী থাকায় সে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারবে না। যার জন্য আজ একাই যেতে হবে। রিকশা খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। বেশ কিছুক্ষণ পর রিকশা পেয়েও যাই।
রিকশা চলছে আপন গতিতে। আমি রিকশায় বসে মোবাইল গুতাচ্ছি। এমন সময় রিকশা কেমন নড়তে শুরু করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই রিকশার ডান পাশের চাকা খুলে যায় আর রিকশা ডান দিকে হেলে পড়ে। সেই সাথে আমি ছিটকে পড়ি রাস্তায়।
#চলবে