আসমানী পর্ব-০১

0
292

#আসমানী
#পর্ব_১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

ছোট্ট বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছে মেয়েটি।মাথায় শুধু ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া।একটা সালোয়ার আর একটা ফ্রক শুধু গায়ে জড়ানো।নাতাশা একটু আগে খেয়াল করেছে ফ্রকের পিছনে সেলাই করা।সে তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এই কথাটা বুঝে নিতে পারছে না যে নতুন বউ কেন এইরকম পোশাক পড়বে।নতুন বউ তো পড়বে শাড়ি।তাও পড়েছে তো পড়েছে একটা ছেঁড়া ফ্রক।তার বাবা নিজের ঘরে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।আর মা নতুন বউ হয়ে আসা মেয়েটাকে সমানে বকে চলেছে আর নিজের ভাগ্যের জন্য বিলাপ করছে।বড় ভাইয়া মেয়েটাকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই কই যেন হাওয়া হয়ে গেছে।যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে, “ওকে আমি আজ বিয়ে করেছি।নিজের ইচ্ছেতে করিনি।বাধ্য হয়ে করেছি।একটু সময় অপেক্ষা করো।আমি একটা কাজ সেরেই আসছি।”

ভাইয়া একটু পর আসছি বললেও ঘন্টাখানেক হয়ে গেলেও তার আসার কোনো লক্ষ্যন দেখা যাচ্ছে না।এরমধ্যে নাতাশার ছোট ভাই নাবিল নিজেদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।মূলত মা ই তাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে। নিজেদের এলাকায় ঢোকার পর লোকের মুখের কানাঘুঁষায় বুঝতে পেরেছে মা যা বলেছে সেটাই সত্যি।কিন্তু নিজে চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তার।তার এতো ভালো ভাইয়া,যে কি না তার আদর্শ, বাবা-মায়ের সবচেয়ে ভালো ছেলে সে একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে।
নিজের ছোট ছেলেকে দেখে নাতাশার মা তার কাছে ছুটে গিয়ে বলে,”দেখ দেখ বাপ,কাম ডা করছে কি পোলাডা।এই মাইয়াডা আমার পোলার মাথা খাইছে।নাইলে আমার অতো ভালো পোলা নাকি এই মাইয়ার মতো মাইয়ারে ঘরের বউ করে।”
নাবিল প্রথমে কিছু বলতে না পারলেও মায়ের ঘ্যানঘ্যান সহ্য করতে না পেরে বলে,”আহ মা,থামো তো।উনাকে কি জিজ্ঞেস করেছিলে কিছু? ভাইয়াও কি কিছু বলেছে?”
এতোক্ষণে মুখ খুলে নাতাশা বলে,”ভাইয়া বলেছে মেয়েটাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে।”
“হ।আমার পোলাডা তাই কইয়া গেছে।নিশ্চয়ই এই মাইয়া আমার পোলারে ফান্দে ফালায়া বিয়া করছে।এহন কি ভালো সাজার ভাব ধরতাছে।”এরপর মেয়েটাকে ধমক দিয়ে বলে,” এই মাইয়া,কানতাছো কিয়ের লাগি?কান্না থামাও।নাটকবাজ মেয়ে।”

নাবিলের নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। মেয়েটাকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা সে।হাজার হোক,মেয়েটা এখন তার বড় ভাইয়ের বউ।আজকের করা তাদের এই ব্যবহার মেয়েটার সারাজীবন মনে থাকবে।সে তার ভাইকে চিনে।ভাই যেহেতু মেয়েটাকে বিয়ে করেছে,সারাজীবন তার দায়িত্বও পালন করবে।মেয়েটা তো সম্পর্কে তার ভাবী। বড় ভাবী।তার উপর মেয়েটা তার থেকে বড় হবে।তাকে তো আর মায়ের মতো ধমকানো যায় না।কিন্তু এই ভাইয়া না থাকাটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভাইয়া থাকলে হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করা যেতো এই মেয়েটার সাথে তার কত বছরের প্রেম যে হুট করেই তাকে বিয়ে করে ফেললো।মা মেয়েটাকে অনেক বকাবকি করছে।মেয়েটা কান্না করছে।ভয়ে নাকি লজ্জায় কান্না করছে সেটা নাবিল বুঝতে পারেনা।কিন্তু মেয়েটাকে তার কোনো কিছু বলা উচিত না নিশ্চয়ই। সে শুধু একটা কাজই পারে এখন।সেটা হচ্ছে মা কে থামানো।মা কি ভাষায়ই না কথা বলছে মেয়েটার সাথে।কিন্তু মায়ের মুখের ভাষা তো এতো খারাপ না। মা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে।যদিও এখন মা যে ভাষায় কথা বলছে,সেটাই তার মাতৃভাষা।মানে জন্মের পর মা তার মায়ের কাছে থেকে এই ভাষাই শিখেছে। আর শুদ্ধ ভাষা টা শিখেছে বিয়ের পর।যদিও সেটা নাবিলের স্কুল মাষ্টার বাবার অনেক দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।কিন্তু মা খুব বেশি রেগে গেলে এই ভাষা ব্যবহার করে।এই ভাষার যেমন অপকারিতা আছে,তেমনি উপকারিতাও আছে।অনেক শিক্ষিত ভদ্র দুশমনকে বিদায় করতে মায়ের এই ভাষাই যথেষ্ট।

কিন্তু নাবিলের আজ মায়ের এই ভাষা মোটেও ভালো লাগছে না।মেয়েটার সামনে মাথা কাটা যাচ্ছে তার।চেনা নাই জানা নাই বাইরের একটা মেয়ের সামনে এইভাবে কথা বলছে।আবার অনেক মানুষ বাইরে থেকে উঁকি মেরে কাহিনিও দেখছে।মেয়েটাকে যে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে,সেটা করার সুযোগও পাচ্ছে না।কিছু কি বলবে সে?বলা কি উচিত হবে?যদি কিছু মনে করে।নাবিলের হঠাৎ মনে হয়, এই মেয়েটা একদিন তাদের পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিজের হাতে পালন করবে।যেভাবে মা করে।হয়তো এই মেয়ের মাধ্যমেই সে ভাইজি, ভাইপো পাবে।কোনো এক অলস দুপুরে সে যখন বাড়ির সামনের আম গাছের নিচে বসে থাকবে,তখন হয়তো মেয়েটি তার ভাইজি বা ভাইপোকে আম গাছের নিচে নিয়ে এসে গোসল করিয়ে তারপর পায়ের উপর শুইয়ে দিয়ে তেল মালিশ করতে করতে বলবে,”বুঝলিরে মা,যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে এলাম,তোর দাদীর কি তেজ।সে তেজ দেখে আমি তো কেঁদেকেটে অস্থির।আর তোর কাকা?সেও কি কম যায় নাকি?মায়ের মতোই আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে করতে অস্থির করে তুললো।আমি কে?কোথা থেকে এলাম?কি করি?আর আজ দেখ,তোর দাদী আমার হাতের রান্না ছাড়া কোনো খাবার মুখেও দিতে পারে না।আর তোর কাকা তো এখনও বাচ্চা।উল্টো করে প্যান্ট পড়ে ঘর থেকে বের হয়।আমি না বলে দিলে কি ওর মান ইজ্জত থাকতো?”

“হ্যাঁরে, তুই কোনো কথা বলছিস না কেন?তোকে ডাকলাম বিচার করার জন্য। আর তুই থাম্বার মতো দাঁড়িয়েই আছিস।”
মায়ের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলো সে।এতোক্ষণ কি সব আবোলতাবোল ভাবছিল সে?কিন্তু আবোলতাবোল হলেও এমনটা তো হতেও পারে।না বাবা।সে শান্তিপ্রিয় মানুষ। মায়ের দিকও দেখতে হবে।এই মেয়ের দিকও দেখতে হবে।কিন্তু মা এটা কি বললো এখন?বিচার করতে তাকে ডাকা হয়েছে?সে তো মায়ের কাছে সকাল বেলায়ও দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিল।আর এখন বিচারক? হায় আল্লাহ, এজন্যই তুমিই সেরা।সকাল বেলা ফকিররে তুই, আমির সন্ধ্যাবেলা।নিজেকে এখন অনেক বড় কিছু একটা মনে হচ্ছে তার।বোনের দিকে একটা ভাব নিয়ে তাকালো সে।কিন্তু পিঠাপিঠি ভাই-বোন হওয়ায় বোন তাকে মুখ ভেঙচি দিয়ে নাক সিটকালো।তাতে নাবিলের কিছুই যায় বা আসে না।ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ুয়া নাবিলকে মা যেটুকু সম্মান দিয়েছে,সেটুকুই তার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যেহেতু মা তাকে বিচারকের আসনে বসিয়েছে,তাই কিছু কথা হলেও তাকে বলা উচিত। নাবিল মনে মনে ঠিক করে নেয়,আপনি সম্বোধন করেই বলবে।একবার মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নেয় সে।মেয়েটা এখনও মাথা নিচু করে গুনগুনিয়ে কেঁদেই চলেছে।নাবিল একবার গলা খাঁকারি দিয়ে কিছু একটা বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই সেই ঘরে প্রবেশ করে তার বাবা বলে,”নাতাশা,তোমার মায়ের মুখের ভাষা সংযত করতে বলো।না হলে কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
বাবার কথায় মায়ের কিছুই যায় বা আসলো বলে মনে হলো না।সে এবার বাবাকে বলতে থাকে,”আমার মুখের ভাষাই আপনার যতো ঝামেলা।আর এই মেয়ে যে আমার সংসারে ঝামেলা হয়ে আসলো সেটা আপনার চোখে পড়ে না?আমার এতো ভালো ছেলেটার মাথা খেয়ে যে বাড়ি পর্যন্ত উঠে এলো,তার বেলায়?”
বাবা এবার বেশ গমগমে স্বরেই বললো,”আর তোমার গুনধর পুত্র যদি এতোই গুনের হয়,তাহলে এই মেয়েকে তার মাথা চিবুতে দিলো কেন?”
বাবার কথায় নাতাশার হাসি পায়।কিন্তু সে হাসে না।এমনিতেই তার হাসি রোগ আছে।সে অকারণে হাসে।শুধুশুধু হাসে পুরোনো হাসির কথা মনে করে।কিন্তু এখন এই সিরিয়াস টাইপ আলোচনায় হাসাটা একেবারেই বেমানান।হয়তো মা তাকে এই ঘর থেকেই বের করে দিবে।অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে সে।

বাবা এবার নতুন বউ হয়ে আসা মেয়েটার দিকে ফিরে বলে,”আম্মা,আমার স্ত্রীর কথায় মনে কিছু নিও না।তার তোমার সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি।কিন্তু তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এমন টাই করতো।”
মেয়েটা কান্না থামিয়ে বাবার কথা শুনে।মাথা নিচু করেই থাকে।বাবা আবার তাকে জিজ্ঞেস করে,”তোমার নাম কি আম্মা?”
মেয়েটা আগের মতোই মাথা নিচু রেখেই জবাব দেয়,”#আসমানী।”
“আমি জানি শ্বশুর হিসেবে তোমাকে এই প্রশ্নগুলো করা উচিত না।কিন্তু আম্মা তোমরা এইভাবে পালায়ে আসলা কেন?তোমার বাবা মা কে জানাতে।আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করতাম।তোমার বাবা মা তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে না?”
মেয়েটা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বাবার পায়ের নিচে বসে পড়ে।বাবা অপ্রস্তুত হয়ে তাকে উঠতে বললেও সে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,” আমরা পালিয়ে বিয়ে করিনি।আমি তো আপনার ছেলেকে চিনতামও না।আজকে আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল।আমি আমার বাস মিস করায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম।সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমার ভীষণ ভয় লাগছিল।রাস্তায় আপনার ছেলেকে দেখে তাকে বলেছিলাম আমাকে যেন তার বাইকে করে সামনের বাস স্টপে ছেড়ে দিয়ে আসে।আপনার ছেলে আমার কথা রাখতে গিয়েই আজ এই দশা।”
মেয়েটির কথা শুনে সবাই অবাক।সবচেয়ে বেশি অবাক নাবিলের মা।জানালার বাইরে থেকে যে কয়েক জোড়া চোখ আর কান তাদের ঘরের ভিতর নজর রাখছে,সেটা বুঝতে পারে নাবিল।কিন্তু কিছুই বলেনা।সত্যিটা তারাও জানুক। না হলে তারা নিজেদের মতো করেই ভেবে নিবে সবকিছু।
বাবা আবার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,”তারপর কি হয় আম্মা?”
“রাস্তার পাশের এক জঙ্গলের কাছে এসে উনার বাইক নষ্ট হয়ে যায়।একে তো সন্ধ্যা বয়ে প্রায় রাত হয়ে গেছে,আবার ঐদিকে মানুষজনও তেমন আসে না।কিছু বখাটে ছেলে আমাদের দুজনকে ঐ নির্জন রাস্তায় দেখে ভাবে যে আমরা অনৈতিক কাজ করছি।তারা টাকা দাবি করে।আপনার ছেলের আর আমার ফোন কেড়ে নেয়।তারপর আরো টাকা দাবি করে।কিন্তু তেমন টাকা তাদের দিতে না পারায় তারা আশেপাশে থেকে মুরুব্বি নিয়ে এসে আমাদের নামে বদনাম রটায়।তখন ঐ মুরুব্বিরাই আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে।বিশ্বাস করুন,আমাদের কোনো দোষ ছিল না।”
মেয়েটির কথা শুনে উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে যায়।নাবিলের মা শাহেদা বেগম এবার একটু নরম হন তার উপর।যতোই হোক,সেও নারী।নারীর চরিত্রের উপর দাগ পড়লে কেমন লাগে সে সেটা ভালোভাবেই জানে।নারীর কাছে তার চরিত্র ছাড়া নিজের বলতে আর কিই বা আছে?শাহেদা বেগম মেয়েটার কাছে গিয়ে তাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে,”তোমার বাবা মা কে একটা কল দাও।এখানে আসতে বলো।তারা হয়তো দুশ্চিন্তা করছে।”
মায়ের নরম মন আর নরম ব্যবহারের পরিচয় পেয়ে মেয়েটি এবার মা কে জড়িয়ে ধরেই বলে,” আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই। মা,ভাই আর বোন দুই বছর আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে।আর বাবা সেই শোক সইতে না পেরে দুই মাসের মাথায় ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেছে।” মেয়েটা কান্না করতে করতে কাশতে থাকে।শাহেদা বেগম নাতাশাকে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসতে বলে।নাতাশা পানি নিয়ে এলে মেয়েটি ঢকঢক করে পানি খায়।যেন কতদিনের তৃষ্ণার্ত সে।
নাতাশার বাবা নাসিরউদ্দিন এবারর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখন থাকো কই মা?”
“আমি মেসে থাকি।টিউশনি করে নিজের খরচ চালাই।বহু কষ্টে নিজের গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি।”
“তোমাদের নিজেদের বাড়ি নেই?”
“আছে।”
“সেখানে থাকো না কেন?”
মেয়েটি এবার কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,”বাবার মৃত্যুর পর আমার বড় চাচা আমার বাবার শহরে যা ছিল,সব নিজের ছেলেদের নামে করে নিয়েছে উকিলকে ঘুষ খাইয়ে।আর আমাকে গ্রামের সামান্য জমি আর একটা ছোট্ট বাড়ি দিয়েছে।আমি সারাজীবন শহরেই থেকেছি।তাই কষ্ট হলেও এখন নিজের খরচ নিজে জুগিয়ে পড়াশোনা শেষ করে কোনোরকমে একটা চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছি।কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য আমার পিছু ছাড়লো না।এখন আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।

চলবে…..?