মাতৃত্ব পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
243

#মাতৃত্ব
দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব:

কলমে: মম সাহা

মেয়ের হবু বর যখন সিদ্ধান্ত শিরোধার্য করল যে রিনা হোসাইন বর্তমানে গর্ভের বাচ্চাটা নিতে পারবেন না তখন রিনা হোসাইনের পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন কবির সাহেব। স্ত্রীর ভরসার কাঁধ হয়ে বললেন,
“সন্তান তো আমাদের, সিদ্ধান্ত তুমি দিচ্ছো যে!”

এবার কিছুটা দমে এলো হিমেল। কিন্তু থেমে যাওয়ার পাত্র সে না। নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“সমাজে তো আমাদেরও থাকতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত না মত জানাচ্ছি।”

“তোমার মতামত তুমি জানাতেই পারো কিন্তু মনে রেখো, সে মতামত তুমি কারো উপর চাপিয়ে দিতে পারো না।”

“ফুপা, হিমেল তো কিছু ভুল বলেনি! আপনি, ফুপি তো লোক হাসানোর মতন কথা বলছেন। এই বয়সে কেউ বাচ্চা নেয়! ছি, ছি, লজ্জারও একটা ব্যাপার আছে।”

নিজের বড়ো ভাইয়ের স্ত্রীর কথায় যেন জোর পেলো হিমেল। এই সবকিছুতেই নীরব শ্রোতা হয়ে রইল তুবা। এবার হিমেলের বাবা গুরু-গম্ভীর কণ্ঠ ছুঁড়লেন,
“বেয়াই মশাই, আমরা এত কথা বলতে চাই না। আমাদের একটাই কথা, আমরা লোক হাসানোর মতন কাজকে কখনো সাপোর্ট করব না। আপনারা যদি বাচ্চাটা রাখার সিদ্ধান্তই নেন তাহলে বিয়েটার কথা আর আগানো যাবে না।”

রিনা হোসাইন এবার আড়চোখে মেয়ের দিকে চাইলেন। যদিও তিনি মাত্রই মুখ খুলতেন, জানাতেন বাচ্চাটা তিনি আর রাখবেন না কিন্তু তার আগে কথা বলল তুবা। হিমেলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“তোমারও কী এক মত?”

“অবশ্যই, তুবা। আমি জানি তুমি এখনের জেনারেশনের মেয়ে। কখনোই এসব অসামাজিক কাজকর্ম সহ্য করবে না।”

“একদম তা-ই। কখনো এসব অসামাজিক কাজকর্ম সহ্য তো আমি করবোই না। তাই ভালোই ভালোই বলছি তোমরা এখনি, এমুহূর্তে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।”

তুবা তীক্ষ্ণ কথা যেন বোধগম্য হলো না কারো। তার হবু যা ওরফে নিপা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“কী বলছিস? আমরা বেরিয়ে যাব মানে?”

“হ্যাঁ, তোরাই বেরিয়ে যাবি। বাড়ি বয়ে এসে, কে বাচ্চা নিবে নাকি নিবে না তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়াটা কোনো সামাজিক কাজ বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। তাই এক্ষুনি, এমুহূর্তে তোরা এসব অভদ্রতা বন্ধ দিয়ে বেরিয়ে যাবি।”

পরিবেশ, পরিস্থিতি থমকে গেল। রিনা হোসাইন চোখ বড়ো বড়ো করে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটার চোখ-মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছে! হিমেল রেগে গেল,
“তুমি আমাদের সাথে এভাবে কথা বলছো কোন সাহসে, তুবা? এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

হিমেলের ধমকে হু হা করে হেসে উঠল মেয়েটা। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“তা ফল কী খারাপ করবে শুনি? বিয়ে ভেঙে দিবে? আমার বদনাম হয়ে যাবে? হোক। তোমার মতন নিম্নমানের লোকের সাথে থাকার অভিশাপ থেকে তো মুক্তি পাবো। এটাও বা কম কিসের? যে ছেলের রুচি, মানসিকতা এত নিচ তার সঙ্গে আমি সংসারই বা করতাম কীভাবে? ভাগ্যিস উপরওয়ালা দয়া করেছেন আমার উপর। নাহয় জীবনটা আমি নরকে ঠেলে দিতাম এমন একটা ফ্যামিলিতে গিয়ে। তুমি সিদ্ধান্ত কিংবা মতামত দেওয়ার কে হিমেল? তোমার ফ্যামিলিরও বা এত বড়ো সাহস কেন হবে যে আরেকজনের ব্যাক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে আসছে! আমার আম্মু তার সদ্য গর্ভে আসা সন্তান রাখবে কি রাখবে না সেটা একান্তই আমার আম্মুর মতামত। তোমরা কে হও সেই মতামতে হস্তক্ষেপ করার? আর মা হওয়াটাকে তোমরা লজ্জার বিষয় মনে করছো? কোনদিক দিয়ে লজ্জার এটা? মা হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো আশীর্বাদ আর তাকে তোমরা এত বিশ্রী ভাবে প্রেজেন্ট করছো? আমার মা-বাবার ইচ্ছে হতেই পারে তারা নতুন করে অভিভাবক হবেন, তাতে তোমাদের কী? সমাজের কী? হ্যাঁ? যে সমাজ অন্যের ব্যাক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করে, সে সমাজকে আমরা পরোয়াও করি না। গো-ভাগাড়ে গিয়ে মরুক সেই সমাজ। আর নিপা আপু তুই আমার আম্মুকে লজ্জার কথা বলছিস! তুই? আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তোর বিয়ে হয়েছে আজ পাঁচ বছর। কম তো চেষ্টা করিসনি একটা সন্তানের জন্য! তবুও তো উপরওয়ালা দেননি। তোকেও তো এই সমাজ ছেড়ে কথা বলেনি। যেখানে মা হতে না পারার পেছনে তোর কোনো হাত নেই। কিন্তু সমাজ বুঝেছিল তোর সেই যন্ত্রণা? বরং যে কাজ তুই করিসনি তার জন্য তোকেই দায়ী করা হয়েছে। বারংবার অপদস্ত করা হয়েছে তোকে, কেন তুই মা হতে পারিসনি। আমার আম্মুর কোল আলো করে নতুন কেউ আসবে সেটাও আম্মুর হাতে না। উপরওয়ালার ইশারা। তাহলে এটার জন্য আমার আম্মু কেন জবাবদিহিতা দিবে কিংবা সমাজের এসব যুক্তিহীন তামাশায় লজ্জিত হবে?
আমাদের সমাজটাই এমন। একটা মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক অথচ বিয়ে হচ্ছে না তাতেও সমাজ কথা শুনাবে। আবার আরেকটি মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে হচ্ছে এতেও সমাজের সমস্যা। একটি ছেলে ভবঘুরে হলেও তাদের সমস্যা আবার একটি ছেলে দায়িত্ববান হলেও বলবে মায়ের নেওটা। একজন নারী মা হতে না পারলেও তাদের তাচ্ছিল্য ছুড়বে আবার কেন বয়স হয়ে মা হচ্ছে তাতেও হাসাহাসি করবে। সমাজ কোন ব্যাপারে চুপ থাকে বলবি একটু? প্রতিটা পদক্ষেপেই তো সমাজ কথা বলেই তাহলে সেই সমাজের দোহাই দিয়ে তোরা আপন মানুষেরাও মুখোশ খুলে ফেলিস কেন? সমাজ কাকে নিয়ে? আমি, তুই, এ, ও…. আমাদের নিয়েই তো সমাজ নাকি? আজকে তোর চিন্তাভাবনা বদলা, কালকে আরেকজন বদলাবে, পরশু পুরো সমাজ বদলাবে। অথচ সমাজের দোহাই দিয়ে যদি আমরাই অন্যের ব্যাক্তিগত জীবনে নাক গলানোর এই রীতি চালিয়ে যাই তবে এই সমাজ কখনো বদলাবে না। প্রথমে নিজেকে বদলাতে হবে, তারপর তো সমাজ!”

পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। রিনা হোসাইন, কবির সাহেব সহ সকলে ফ্যালফ্যাল করে তুবার দিকে তাকিয়ে রইল। তুবা আলগোছে নিজের গলার স্বর্ণের চেইনটা খুলে তার হবু শাশুড়ি হতে দিয়ে দিল। তার জন্য সহজ হচ্ছে না এই ব্যাপারটা। যাকে একসময় ভালোবাসতো তাকে এক বাক্যেই ভুলে যাওয়া সম্ভব না। হিমেলও এবার কিছুটা থতমত খেলো। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“তুবা, যা করছো, ভেবে করছো তো?”

তুবা হাসলো, “আজকে সব ভেবেই করছি তাই তো সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারলাম। এতদিন ভাবিনি বলেই তো তোমার সাথে সংসার করতে চেয়েছিলাম!”

তুবার এমন আচরণের পর আর কেউ-ই কিছু বলার সাহস করল না। একে একে মাথা নত করে বেরিয়ে গেলো সব৷ কেবল পিছে রয়ে গেল তুবার হবু শাশুড়ি আঞ্জুমান রোজী। তিনি তুবার হাত ধরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর রিনা হোসাইনের দিকে তাকিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বললেন,
“তুবার ভালো হবে আপা, ভালো হবে। সেদিন তুবার মতন একজন সন্তান আমার পাশে দাঁড়ালে আমাকে সমাজের ভয়ে ছোটো ভ্রুণটিকে নষ্ট করতে হতো না। আমার স্বামী, সন্তান তখন আমার সঙ্গে যেমন আচরণ করেছিল, আমার মনে হয়েছিল সে বয়সে মা হওয়াটা বোধহয় পাপ! কী ভাগ্য করেই না আপনি তুবার মতন একজন সন্তান পেয়েছেন! আপনার গর্ভ ধন্য, আপা। ধন্য।”

ভদ্রমহিলা আর দাঁড়ালেন না। প্রায় চোখ লুকিয়ে ছুটে গেলেন মনে হলো। ক্লান্ত চোখে প্রেমের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে তুবা বসে পড়ল সোফায়। বুকের মাঝে ঝনঝন শব্দ তুলে হৃদয়টা ভেঙেচুরে বোধহয় একাকার হয়ে গেলো। রিনা হোসাইন কেঁদে দিল বাচ্চাদের মতন। কী হয়ে গেলো এটা! অনাগত সন্তানের জন্য তার এই সন্তানের জীবনে এমন ঝড় উঠলো?
তুবা মুখ ঢেকে বসে থাকার কিছুক্ষণ পরই অনুভব করল তার কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া। হাতের মালিক ধীরে ধীরে তার পাশে এসেই বসেছে। তুবা ধীর মস্তকে সে হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই তিতাসের লম্বাটে মুখটি ভেসে উঠল। তুবা অবাক চোখে তিতাসের দিকে চাইল, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এখানে কী? তখন তো খুব ছুটে গিয়ে দরজা দিয়েছিলিস৷ এখন কী এখানে? নাকি তোরও কিছু বলার আছে? কথা শুনানোর আছে?”

লাজুক তিতাস একবার পিটপিট চোখে দূরে দাঁড়ানো মা-বাবার দিকে তাকাল, একবার বোনের দিকে তাকালো। তারপর প্রায় মিনমিন করে বলল,
“আপু, তখন না আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। এত বড়ো বয়সে তো কারো ভাই-বোন হয় না তাই। কিন্তু আমার না ভেতর ভেতর ভীষণ আনন্দও হচ্ছে। আমি কী করব এখন?”

তিতাসের দ্বিধাদ্বন্দে পরিপূর্ণ চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থমথমে পরিবেশের সকলেই হেসে উঠল। তুবা ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এখন আমাদের আম্মুর সেবা করতে হবে। এবং ভাই কিংবা বোন যে-ই আসুক, তার জন্য সব কেনাকাটা করতে হবে। বুঝলি?”

তিতাসও বোনকে জড়িয়ে ধরলো লাজুক মুখে। রিনা হোসাইন ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলল,
“সমাজের সকল মানুষ তুবা এবং তিতাস হয়ে উঠুক। মাতৃত্ব হয়ে থাকুক চির আশীর্বাদ।”

_

তারপর……

তুবা, তিতাস এবং তাদের পরিবারের এই যাত্রা খুব সহজ অবশ্য ছিলো না। সমাজের কত হাসিঠাট্টা ছিলোই। কেউ তুবাকে বলেছে, ‘বাচ্চা পালার সময়ে, ভাই-বোন পালছো?’ কেউবা রিনা হোসাইনকে পিঞ্চ করেছে, “কী সৌভাগ্য! নাতি-নাতনি দেখার বয়সে সন্তান জন্ম দিচ্ছো।” কিন্তু সেই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মায়ের উত্তর হয়েছে তুবা এবং তিতাস। কবির সাহেবও নিজের স্ত্রীর পাশে ছিলেন বটবৃক্ষ হয়ে।
যেহেতু ত্রিশের পর প্রেগন্যান্সির সময়টা ঝুঁকিপূর্ণ থাকে কিন্তু পরিবারের সঠিক যত্ন এবং মানসিক শান্তি সে ঝুঁকি কমিয়ে আনে অনেক শতাংশ। রিনা হোসাইনের ক্ষেত্রেও হলো তাই। তার গর্ভকালীন সময় কাটলো নির্বিঘ্নে। ভীষণ যত্নে। শুধু কী তাই? নিপাও যোগ দিল এই আনন্দে।

সমাজ বড়ো বড়ো চোখে দেখল, মুখ ঝামটি দিয়ে বলল— নির্লজ্জ সব।
তাতে কার কী? সমাজের নিজের চোখেই তো লজ্জা নেই, তার মন্তব্য দিয়ে অন্যেরই বা কী আসে যায়?
সমাজ বলতে বলতে একসময় চুপ হয়ে যায়। এরপর সব আবারও চলতে থাকে সুন্দর, সহজ, সাবলীল।

রিনা হোসাইন তার পাঁচ বছরের মিষ্টি মেয়েটার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ভাবে কেবল, ভাগ্যিস সেদিন সমাজকে সে প্রাধান্য দেয়নি! নাহয় পৃথিবীতেই যে স্বর্গ আছে তা কি আর উপলব্ধি করতে পারতো কখনো? ভাগ্যিস তার তুবা আর তিতাস ছিল!

তুবারও তো বয়স হলো সাতাশ-আটাশ। বিয়ে করেনি এখনো। আত্মীয় স্বজন কানাঘুষো করে। মুখ ঝামটি নিয়ে বলতে নেয়, ‘বিয়ে করবি কবে, তুবা? বয়স তো হলো। সমাজ কী বলবে……’
তুবা উত্তরে কেবল হাসে। যেদিন থেকে তুবার প্রতিবাদী কণ্ঠের জন্ম হলো ঠিক সেদিন থেকেই সমাজের বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে এখন বুঝে, সমাজ কী বলবে কথাটা ভাবলেই আর আগানো যায় না। সমাজ কী বলবে তা সমাজের কাঁধে ছেড়ে দিলেই আমাদের প্রকৃত ভাবে বেঁচে থাকা শুরু। সমাজের বলা সমাজ বলুক, সব বলা শুনতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই তাই না?

#সমাপ্ত