আসল সম্পর্ক পর্ব-০৬

0
139

#আসল_সম্পর্ক
#পর্ব_৬
#ইশরাত_জাহান

প্রিয়তা ও মিসেস পুরোভি মিলে সন্ধায় পিঠা বানায়।অনুপম এসেছে অফিস থেকে।এসে ফ্রেশ হয়ে বাবার সাথে বসেছে।আড্ডা দিচ্ছে সবাই।রাতে পিঠা খেয়ে সবাই ঘরে চলে আসে।

অনুপম বেলকনিতে এসেছে।সিগারেট ধরাতে।প্রিয়তা বই পড়ছে।অনুপমের সিগারেট নেওয়াতে বিরক্ত প্রিয়তা।কিন্তু অনুপমকে কিছু বলছে না।অনুপম সিগারেট খাওয়া শেষ করে ঘরে আসে।প্রিয়তা ও অনুপম মিলে বিছানা রেডি করে।ঘুমাবে এখন তারা।কেউ কোনো কথা বলে না। চুপচাপ ঘুমিয়ে যায়।

সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে সালাত আদায় করে।অনুপম ও মিস্টার অরুণ মসজিদে যায়। নামাজ পড়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে। হাঁটাহাঁটির এক পর্যায়ে তারা এক জায়গায় বসে।

কিছুক্ষণ নিরব থেকে মিস্টার অরুণ বলতে থাকে,”আমি তোমার মায়ের ভালোবাসার পুরুষ ছিলাম না।”

বাবার কথা শুনে অবাক হয় অনুপম।কিছু না বলে শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।মিস্টার অরুণ পুণরায় বলতে থাকেন,”তোমার মায়ের আরেকজন ভালোবাসার পুরুষ ছিলো।ভেবোনা সে তোমার মাকে ছেড়ে দিয়েছিলো।এমন কিছুই না।তোমার মাও তাকে ছাড়েনি।ভাগ্য তাদের আলাদা করেছিলো।তবে আমাদের সবার একটু সচেতন হওয়া দরকার ছিলো।শুনতে চাও আমাদের বিয়ের কাহিনী?”

অনুপম বাবার দিকে তাকিয়ে হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।মিস্টার অরুণ স্মিত হাসলো।এই হাসির কোনো সুখ নেই।আছে শুধু হাহাকার।সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে থাকলেন,”আমি তোমার নানাবাড়ির পাশের বাড়িতেই থাকতাম।গ্রামেই আমাদের সবকিছু।তোমার নানুভাই আর দাদুভাই দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন।একসাথে পাশাপাশি জমির মালিক।দুজনে মিলে একসাথে ব্যাবসা করতেন।তাদের সম্পর্ক যেনো মজবুত।আমি পড়াশোনার জন্য ঢাকা চলে আসি।বাবার কথা রাখতে। এখান থেকে পড়াশোনা করে ডাক্তারিতে চান্স পাই।পশু পাখি ভালোবাসি আমি।গ্রামে কতশত পশুপাখি রোগ হয়ে মারা যেতো।মানুষের রোগ দেখার জন্য ডাক্তারের অভাব নেই।কিন্তু পশুপাখির জন্য অভাব আছে।তাই আমার ইচ্ছাকে সম্মান দেয় তোমার দাদু।ভাগ্যক্রমে আমাদের গ্রামেই এই সুযোগ পাই।”এটুকু বলে একটু থামলো।

সাথে করে আনা পানির বোতল থেকে পানি পান করে আবার বলতে শুরু করলো,”তোমার মায়ের প্রণয় ছিলো তার ক্লাসের এক বন্ধুর সাথে।তারা ছিলো মধ্যবিত্ত।তোমার মায়ের ওই বন্ধুর নাম ছিলো সায়ন।দেখতে সুদর্শন,ভদ্র ও চুপচাপ ছিলো।ওই সময় ফোন ছিলো না।চিঠি আদান প্রদান করে ওরা প্রেম নিবেদন করতো।সায়নের খুব ইচ্ছা বিলেত পড়াশোনার।ব্যারিস্টার হওয়ার সখ ছিলো তার।বাবা মাকে বলে জমি বিক্রি করে চলে যায় বিলেত।তোমার মাও যেতে সম্মতি দেয়।যখন বিলেতে যায় ওই সময় তোমার মা ও সায়ন আয়ে পাশ করে।বিলেত যাওয়ার পর তাদের কথা হতো না আর।চিঠি দেওয়ার ব্যাবস্থা জানতো না কেউ তেমন।সায়ন বিলেতে যায় তার এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে। যার ওখানে পড়াশোনা শেষ করতে এক বছর বাকি।সে পড়াশোনা শেষ করে চলে আসে বিলেত।ততোদিনে আমাদের গ্রামে মোবাইল আসে।কিন্তু তা দোকানে যেয়ে কথা বলতে হয়।দেখতে দেখতে তোমার মায়ের পড়াশোনা শেষ।সায়নের আসার কথা এতদিনে।কিন্তু সে আসেনা।

সায়নের সিনিয়র ভাই একদিন খবর দিলো।যেদিন সায়নের আসার কথা ওইদিন এক বিমানে হামলা হয়।ওখানে অনেক জনকে খুন করা হয়।ভয়তে কাপতে থাকে তোমার মা।ঢাকায় আসবে বলে কান্না কাটি করে।নিয়ে আসা হয় তাকে।ঢাকার বিমানবন্দরে আনার পর শুনতে পায়,”যাদেরকে তারা রক্ষা করতে পেরেছে মৃত/জীবিত অবস্থায় তাদেরকে পরিবারের কাছে দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।কিন্তু বাকিদেরকে হামলাকারী নিয়ে যায়।”

ভেঙ্গে পড়ে তোমার মা।ওখান থেকে বাসায় আনা হয় ওকে।পাগলের মত আচরণ করতে থাকে।তখনকার প্রেম ছিলো একদম খাটি প্রেম। যা এখন আর হয় না।তারপর কোনো রকমে সুস্থ করিয়ে তোমার মাকে পড়াশোনা শেষ করানো হয়।তোমার নানু খুব চিন্তা করতেন।মেয়ের বয়স বাড়ছে।কে বিয়ে করবে!তখন আমার বাবা প্রস্তাব দিলো আমার সাথে তোমার মাকে বিয়ে দিবে।বিয়ে হলো কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়া।তোমার মা কিছু বলেনি।বিয়ের পর আমাদের সংসার সাভাবিক ছিলো না।তোমার মা রোবটের মত থাকতো।আমার দিকে ফিরেও তাকাতো না।তাকাবে কি?
সে তো ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করতো না।নিজের যত্ন নিতো না।একসময় পলাশ ভাই তার স্কুলে চাকরি দেন।ও বাচ্চাদের সাথে মিশে সাভাবিক হয়।আমার সাথেও সাভাবিক হয়। তবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হয়নি আমাদের।এগুলো ঘটে বিয়ের দুই মাসের মধ্যে।

আমাদের বিয়ের ঠিক দুই মাস পরেই গ্রামে আসে সায়ন।এসেই দেখা করে আমাদের সাথে।সবাই মিলে এক হয়ে আমরা কথা বলি।জানতে পারি ও ওখানে একটি কোর্সের জন্য থেকে যায়। কোর্স করার ভিতর অনেকবার দোকানে কল দিতো।কিন্তু নাম্বার বন্ধ।কারণ ওই দোকানের ফোন নষ্ট হয়ে যায়।আমি দেখেছি ওইদিন তোমার মায়ের হাহাকার।কান্না করতে থাকে খুব।আমার তখন মনে হয় এই সংসার করার কোনো মানে নেই।যেখানে নিজেকে তৃতীয় ব্যাক্তি মনে হয়।আমি তোমার মাকে ছেড়ে দিবো বলে চিন্তা করি।
কিন্তু ওইদিন তোমার মা প্রথম আমার কাছে কিছু চাইলো।আমার কাছে এসে বললো,”আমাকে একটি বাচ্চা দিতে পারবেন?”
আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।ও আবার বলতে থাকে,”আমি আপনার কাছে এই প্রথম কিছু চাইলাম।না করবেন না আশা করি।আমি সম্পর্ক ভাঙতে পারবো না। এতো বড় পাপ আমার দ্বারা হবে না।”

আমি খুশি মনে মেনে নেই তোমার মাকে।আমাদের মাঝে তুমি এলে।তার ঠিক কয়েকমাস পর।তোমার মা তোমাকে মানুষ করা নিয়ে আমার সাথে অনেক ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে ভুলে যায় সব।কিন্তু আদৌ কি ভুলে থাকা যায়!যায় না।তোমার মা পারেনি ভুলতে।অভিনয় করছে ভুলে থাকার।তবে আমাকে কিন্তু বুঝতে দেয় না।আমাকে দুষ্টু মিষ্টি বকা দেয়।আমার যত্ন নেয়।আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করে।সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ রাখছে শুধু নিজেকে।”

একাধারে বলতে থাকেন কথাগুলো।বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি পড়ে মিস্টার অরুণের।বাবার চোখে পানি দেখে খারাপ লাগে অনুপমের।কিছু বলতে পারে না।কি বলবে জানা নেই তার।মিস্টার অরুণ দেখলো ছেলে তাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছে।

ছেলের মাথায় হাত দিয়ে আবার বললেন,”এগুলো তোমাকে কেনো বলছি জানো?”

অনুপম না বোধক মাথা নাড়ালো।মিস্টার অরুণ ঠোঁট প্রসারিত করলো।আবার বললো,”আমরা বাবা ছেলে একই ভাগ্য নিয়ে হয়েছি।বউয়ের ভালোবাসা না পেয়ে বরং সংসারি হচ্ছি।আমি জানি তোমার আর প্রিয়তার মধ্যে সম্পর্ক ভালো না।তোমাদের দেখলেই বোঝা যায়।কি বলতো সম্পর্কের ভিতর তৃতীয় ব্যাক্তি না থাকলেও তার একটি বৈশিষ্ট্য থাকে।সে কোনো এক জায়গায় থেকে যায়।কিন্তু তৃতীয় ব্যাক্তির মূল্য থাকে না।যদি থাকতো তাহলে আমার আর পুরোভি এতদিন টিকে থাকতাম না।প্রিয়তা শোকে আছে।ওর দুঃখ তোমাকে মোচন করতে হবে।ওকে একা একা বিরহ থেকে বাহির করা যাবে না।তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কি বলছি আমি?”

বাবার কথার মানে বুঝলো অনুপম।আসলেই তো তার বাবা ঠিক কথা বলেছে।সংসার মানে তো স্বামী স্ত্রী।তিন কবুল বলে পবিত্র সম্পর্ক।প্রিয়তা নাহয় আবেগে ইগো এনেছে।তার কি উচিত ছিলোনা প্রিয়তাকে বাধা দেওয়ার!দেয়নি তো বাধা।থেকেছে আলাদা ঘরে।কিন্তু কখন জ্বর এসেছে বা কষ্ট পাচ্ছে এগুলোর তো খোঁজ সে রাখেনি।প্রিয়তা এখন তার বউ।বউয়ের মর্যাদা দেওয়া উচিত তাকে।

অন্যদিকে~~~~~
সোফায় বসে চা পান করছে প্রিয়তা ও মিসেস পুরোভি।মিসেস পুরোভি চা হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন,”জানিস প্রিয়,সংসারের মায়াজালে কখন যে আমি অনুপমের বাবাকে ভালোবেসেছি নিজেই জানি না। লোকে বলে জীবনে একজন কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে অন্য কাউকে ভালোবাসা যায় না।এটা পুরোই মিথ্যা রে।কিভাবে ভালোবাসা যায় না বল!এই যে আমি এখনও অরুণের কথা চিন্তা করি।লোকটা বাইরে গেছে।তার হার্ডের সমস্যা আছে।হঠাৎ করে বুকে ব্যাথা ওঠে।বেশি হাটা উচিত না।কিন্তু সে হাঁটবে।জানিস আমার মনের ভিতর কি রকম তোলপাড় যাচ্ছে।আমি শুধু প্রকাশ করাতে অধম।কি করবো বল লজ্জা পাই যে।শুরু থেকে যে দূরত্ব ছিলো তার মোচন করতে লজ্জা লাগে।তাই রাগ দেখিয়ে সেবা করি।লোকটা বুঝতে পারে না এই ভালোবাসা।”বলেই দীর্ঘশ্বাস নেয় পুরোভি।

প্রিয়তা জানে তার ফুফু আম্মা যত সুখ দুঃখ তাকেই বলে।কাউকে বলতে পারে না।প্রিয়তা একমাত্র যাকে মনের কথা বলতে তার দুই সেকেন্ড সময় লাগে না।

মিসেস পুরোভি কিছুক্ষণ থেমে আবার বলেন,”স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হলো আসল সম্পর্ক।এই সম্পর্ক ওপর আলার থেকে ঠিক করা।যে বিনা কারণে এই সম্পর্কের ছেদ ঘটাবে সে তার শাস্তি পাবে।আমাদের সবার জীবন কঠিন।অনেকের জীবনে হয়তো তৃতীয় ব্যাক্তি থাকে না।কিন্তু তারপরও তারা সুখে থাকে না।স্বামী খারাপ বা শাশুড়ি খারাপ।তারপরও সংসার করতে হয়।আমি বলবো না যে সংসার মানে মুখ বুঝে সব সহ্য করা। অবশ্যই তা নয়।আমার কাছে মনে হয় ভুল বুঝাবুঝি বা কঠিন পরিস্থিতি যাাই হোক।একবার ভালোভাবে চেষ্টা করতে হয়।দ্বিতীয়বার কঠিন হয়ে দেখতে হয়।যদি কাজ না হয় তখন আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যাবে।আমি যখন অরুণের কাছে প্রথম সন্তান চাই।ও কিন্তু আমাকে দূর করে দেয়নি।বরং দিয়েছে আমার অনুপমকে।আমিও ভালোবেসেছি আমার সন্তানের বাবাকে।তার কথা বলা দুষ্টুমি করা আমাকে ভয় পাওয়া এগুলো যেনো আমার এক অন্য ভালোবাসা।কিছু কিছু ইসলামিক ভিডিও দেখবি।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাবি। তাহলে দেখবি তুইও আমার মত তোর বরকে ভালোবেসেছিস।”

প্রিয়তা তাকালো ফুফু আম্মার দিকে।ভালোবাসা পরিবর্তন হওয়া যায়।একজনকে ভালোবাসার পরও অন্যজনকে ভালোবাসা যায়?হয়তো যায়।আমরা তো আমাদের বাবা ও মা দুজনকেই ভালোবাসি।কই তাদের একজনকে একতরফা ভাবে দেখি না।জন্ম বিয়ে মৃত্যু এগুলো তো ওপর ওয়ালার ঠিক করা সম্পর্ক।ইগোকে বাড়িয়ে উল্টো সম্পর্কের নষ্ট করা বোকামি।সে ঘরের বউ।তাকে উল্টো তৃতীয় ব্যাক্তিকে উপড়ে ফেলা উচিত। তা না করে সে নিজেই তৃতীয় ব্যাক্তিকে ওয়েলকাম করেছে।অনুপমের ইচ্ছা কি তাও শুনেনি।

চলবে,