আহনাফ চৌধুরী পর্ব-০১

0
110

#আহনাফ_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

অর্ষা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের ঠিক মাঝ বরাবর। সময় এখন মধ্যদুপুর হলেও এক চিলতে রোদ্দুর নেই কোথাও। তবে মৃদু পবনের ধাক্কায় শরীর শিউরে ওঠে। কুয়াশার আড়ালে কোত্থাওটি সূর্যের দর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। এই শীতেও একটা পাতলা শাল গায়ে জড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির কুয়াশাচ্ছন্ন দূর গগনে। পাখিদের উড়ে চলা দেখার পাশাপাশি কিছু হিসাব-নিকাশও সে মনে মনে করে নিচ্ছে।

আমেনা বেগম ছাদে এসেছেন কাপড় শুকাতে দিতে। রোদ না থাকলেও বাতাসে শুকিয়ে যাবে। পেছন থেকে মেয়েকে দেখে খানিকটা আঁতকে উঠলেন তিনি। আকাশী রঙের একটা থ্রি-পিস অর্ষার পরনে। ভেজা লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় যখন মৃদু মৃদু উড়ছিল তখন পেছন থেকে আমেনা বেগমের মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ঠিক উপন্যাসের কোনো নায়িকা দাঁড়িয়ে আছে। তার মেয়ের মাঝে অবশ্য উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার গুণও রয়েছে। আকাশ-পাতাল চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন অর্ষার কাছে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

“একা একা ছাদে কী করছিস?”

মায়ের উপস্থিতিতে অর্ষার ভাবনায় ভাঁটা পড়ল। হাসার চেষ্টা করে বলল,

“কিছুই না। এমনি এসেছি।”

আমেনা বেগম দড়িতে আধভেজা কাপড়গুলো ছড়িয়ে দিতে দিতে শুধালেন,

“কিছু কি ভাবছিস?”

অর্ষা এবার ছাদের মাঝখান থেকে সরে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। প্রবল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“কতকিছুই তো ভাবি!”

“এখন কী ভাবছিলি?”

“জীবনের হিসাব-নিকাশ।”

কাপড় দড়িতে দিয়ে এসে তিনিও মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

“হিসাব-নিকাশ?”

অর্ষা মাথা দুলিয়ে হাসার চেষ্টা করল। সেই হাসি সুখ কিংবা আনন্দের নয়। বিষাদের পাহাড়। পূণরায় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“মা, আমি যদি কারও জন্য একশো পারসেন্ট কিছু করি, তাহলে আমি কি তার থেকে ষাট পারসেন্টও ডিজার্ভ করি না?”

আমেনা বেগম তৎক্ষণাৎ কোনো প্রত্যুত্তর করতে পারলেন না। তার এই মেয়েটি আহামরি কোনো সুন্দরী নয়। তবে অসাধারণ একজন। দশটা মেয়ের মাঝে যদি তার মেয়েকে রাখা হয় তাহলে সেই দশজনের মধ্য থেকে লোকে তার মেয়েকেও পছন্দ করবে। সৌন্দর্যকে হার মানিয়ে অনেক সময় মায়া জিতে যায়। ঠিক সেরকম মায়া তার মেয়ের চোখে-মুখে আছে। স্কুল জীবন থেকেই তার মেয়ের পেছনে অনেক ছেলেকে ঘুরতে দেখেছেন। অনেকের অনেক পাগলামিও দেখেছেন। কিন্তু কাউকে এই পর্যন্ত মায়ায় আটকে থাকতে দেখেননি। এখন অর্ষা বড়ো হয়েছে। অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্রী সে। সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তনও এসেছে। এখন চাইলেই তার মেয়েকে কেউ দুমদাম বলে দিতে পারে না যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু এরপরও অনেকে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসে। ভালোবাসা প্রকাশ করে। সেই অনেক মানুষের মাঝে তার বোকা মেয়েটা এমন একজনকে তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেঁসে গেছে যে, তার কাছে মেয়েটার কোনো মূল্যই নেই।

অর্ষা নিজ থেকেই বলল,

“আমি লাইফ নিয়ে খুব বিরক্ত, মা। আমার জীবন আর ভালো লাগে না। আমার কোনো কিছুই ভালো লাগে না। প্রায় এক সপ্তাহ্ আমি আউট অফ নেটওয়ার্ক ছিলাম। কিন্তু কি জানো যাদের কাছে এক্সপেকটেশন রেখেছিলাম তারা কেউই কোনো খোঁজ নেয়নি আমার। বিশেষ করে সেই একজন! আমি কি এইটুকুরও প্রাপ্য নই? অথচ এই মানুষটার সাথে একবেলা যোগাযোগ না হলে আমি অস্থির হয়ে যেতাম ভয়ে তার কিছু হলো কিনা! কোনো বিপদ হলো কিনা!”

আমেনা বেগম মেয়ের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,

“শোন অর্ষা, যার মাঝে তোকে নিয়ে কোনো অস্থিরতা নেই, তোকে হারানোর ভয় যার মধ্যে নেই সে কখনোই তাকে ভালোবাসতে পারে না। তোর সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, কথা বলতে ভালো লাগে তাই কথা বলে। পাওয়ার ইচ্ছে থাকলে মানুষ চেষ্টা করে। ছোট্ট একটা উপায় পেলেও সেটাকে আঁকড়ে ধরে প্রিয় মানুষটাকে নিজের করার চেষ্টা করে। আর যে চায় না সে কখনোই চেষ্টা করে না বরং সে অজুহাত দেখায়, পরিস্থিতির দোহাই দেয়।”

অর্ষা নিশ্চুপ। তিনি বললেন,

“আর কত এইভাবে চলবে বল তো? কেন সরে আসছিস না? অনেক তো হলো অন্যের জন্য। এবার একটু নিজের জন্য ভাব। নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা কর।”

“আমি ভালোবাসি মা!”

“জানি। তুই ভালোবাসিস। কিন্তু এক তরফা। ও তোকে আর ভালোবাসে না এটা বুঝিস না? তুই এখন এক তরফাভাবে ওকে চাস, ও তোকে চায় না। যদি চাইত তাহলে তোকে পাওয়ার চেষ্টা করত। একটু ভাব সময় নিয়ে। উত্তরগুলো তোর কাছেই আছে।”

অর্ষা কিছু বলতে পারল না। সত্যি বলতে সেও বোঝে সব। সে বাচ্চা নয় কিন্তু সে বোকা, পাগল। পাগলও তো নিজের ভালো বোঝে। কিন্তু অর্ষা সেটুকু বুঝতেও নারাজ। পিছুটানে এমনভাবে আটকে গেছে যেখান থেকে শত কষ্ট পেয়েও সে ফিরে আসতে পারছে না। এই কষ্ট না কখনো কাউকে বোঝানো যায়; আর না বোঝানো সম্ভব নয়। কিছু কষ্ট থাকে, যা একান্তই নিজের হয়।

আমেনা বেগম অর্ষাকে নিরব দেখে নিজেই বললেন,

“এইযে আরও যারা তোকে ভালোবাসি বলে দাবি করে আমার কি মনে হয় জানিস? এরা কেউই তোর জন্য নয়। তোর জন্য যেই মানুষটাকে আল্লাহ্ বরাদ্দ করে রেখেছেন, সে হয়তো এখনো তোর জীবনে আসেইনি।”

অর্ষা উত্তর দেওয়ার আগেই ছোটো বোন অর্থির আগমন ঘটে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“মা, আব্বা আসছে। ডাকে তোমায়।”

আমেনা বেগম অর্ষার উদ্দেশ্যে বললেন,

“ভেতরে চল।”

“তুমি যাও। আমি আসছি।”

অর্থিও ছাদে রয়ে গেল। আমেনা বেগম একাই চলে গেলেন নিচে। অর্থি ছাদে দৌঁড়াচ্ছে। অর্ষা ওর দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে আবার আকাশপানে তাকাল। মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। তার জন্য যাকে তৈরি করা হয়েছে সেই মানুষটা কি সত্যিই এখনো আসেনি? তাহলে ভুল মানুষের জন্য কেন এত মন পোড়ে, কেন এত ভালোবাসা তৈরি হয়?
.
.
বিকেলে রুমে এসে রিহানের ম্যাসেজ পায় অর্ষা। এক সপ্তাহ্ পর অবশেষে তার অর্ষার কথা মনে পড়েছে। ম্যাসেজে জানিয়েছে দেখা করতে চায়। এইটুকু বার্তাই তাকে খুশি করে দিয়েছে। কিন্তু মা জানলে মোটেও খুশি হবেন না। এমনকি দেখা করার অনুমতিও হয়তো দেবেন না। অর্ষা জানে, মা তার ভালো চায়। কিন্তু অর্ষারই বা কী করার আছে? সে যে ভালোবাসে মানুষটাকে। তাই যতই অবহেলা পাক, অভিমান করুক দিনশেষে রিহান হাত বাড়ালে অর্ষা আর হাত গুটিয়ে রাখতে পারে না। এইতো যেমন আজও পারল না সে।

মাকে এক প্রকার মিথ্যে বলেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে একদম সাধারণভাবে। সে সর্বদা এরকম সাধারণভাবেই চলতে অভ্যস্ত। আর সত্যি বলতে, রিহান নিজেও ওর সাধারণত্ব দেখে ওকে পছন্দ করেছিল।

শীতকাল। দিন ছোটো। অর্ষার রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেছে। একটুপরই মাগরিবের আজান দিয়ে দেবে। বেশি দেরি করা যাবে না। রেস্টুরেন্টে চোখ বুলিয়ে দেখল রিহান এখনো আসেনি। একটু মন খারাপই হলো ওর। অথচ সম্পর্কের শুরুতে যতবার ওদের দেখা হয়েছিল রিহানই আগে পৌঁছে যেত। বিষন্ন মনেই একটা কর্ণারে গিয়ে বসে পড়ল অর্ষা। মিনিট দুয়েক বাদেই টেবিলের ওপর লাল টকটকে গোলাপের তোড়া দৃশ্যমান হলো এবং সেই সাথে কোনো একজনের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল অর্ষা। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গেলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, মানুষটা তার খুব কাছের এবং কাঙ্ক্ষিত। সেও আলতোভাবে রিহানকে জড়িয়ে ধরল। রিহান অর্ষাকে ছেড়ে পাশে বসে শুধাল,

“কেমন আছো বাবুই?”

অর্ষা মৃদু হেসে বলল,

“ভালো। তুমি কেমন আছো?”

“এইতো তোমাকে দেখে ভালো হয়ে গেলাম। তুমি কি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলে? সরি, বাবুই। লেইট হয়ে গেছে। আসলে আজ একটা গানের রেকর্ড ছিল তো। সরাসরি স্টুডিও থেকে এখানে চলে এসেছি। আবার ঢাকা-শহরের জ্যাম সম্পর্কে তো তুমি জানোই!”

অর্ষা রিহানের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

“রিল্যাক্স! এত এক্সপ্লেইন চাইনি আমি। আর আমিও এসেছি বেশিক্ষণ হয়নি।”

রিহান আদুরে ভঙ্গিতে অর্ষার গাল টেনে দিয়ে মেন্যু কার্ড এগিয়ে দিল। বলল,

“দেখো, কী অর্ডার করবে।”

“তুমি যা খাবে তাই।”

“এটা কোনো কথা হলো? বলো কী খাবে? আর তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ না? এসব তো আমার একদম পছন্দ নয়। তুমি নিজের যত্ন কেন নাও না?”

ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। তাই অর্ষা বলল,

“আগে খাবার অর্ডার দাও।”

“আমার পছন্দেই?”

“হ্যাঁ।”

রিহান মেন্যু কার্ড দেখে খাবার অর্ডার দিতে লাগল। অর্ষা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিহানের দিকে। সামনে থাকলে মানুষটা ওকে নিয়ে এত অস্থির হয়ে যায়, এত কেয়ার করে। কিন্তু দূরে গেলে, চোখের আড়াল হলেই এমন বদলে যায় কেন? এতদিনেও অর্ষা রিহানকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।

খাবার অর্ডার দেওয়া শেষ হলে রিহান বলল,

“এখন বলো তোমার সমস্যা কী?”

“তুমি।”

“আমি?”

“হ্যাঁ, তুমি। তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না।”

“এটা কেমন কথা বললে তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি না এটা বলতে পারলে?”

“ভালোবাসো?”

“অবশ্যই।”

“তাহলে কেন তা তোমার চোখে প্রকাশ পায় না রিহান?”

“কীসব ইমম্যাচিউর মেয়েদের মতো কথা বলছো অর্ষা! আজকাল কি গল্প, উপন্যাসের বই বেশি পড়ছ? কবিদের ভাষায় কথা বলছো যে! ভালোবাসা কি চোখে দেখার জিনিস?”

“রিহান, আমি গত এক সপ্তাহ্ ধরে আউট অফ নেটওয়ার্ক ছিলাম। তুমি জানো সেটা? খেয়াল করেছ? এই এক সপ্তাহে তুমি আমাকে একটা কল, ম্যাসেজ কোনো কিচ্ছু করোনি। একটাবার আমার সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করোনি।”

“হোয়াট! সাতদিন তুমি অনলাইনে ছিলে না? কিন্তু কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

অর্ষা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে নির্বাক। বিস্ময় না লুকিয়ে বলেই ফেলল,

“ওহ তুমি জানতেই না?”

“আমি কী করে জানব বলো? আমি তো এই কয়দিন ঢাকাতেই ছিলাম না। কাজ নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম।”

অর্ষার আর কিছু বলতেই ইচ্ছে করল না। সে জানে,বলেও কোনো লাভ নেই। শুধু শুধু বাহানা শুনতে হবে। তাই সে চুপ করে রইল। রিহান রাগ ভাঙাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

“কথায় কথায় এত রাগ করে বাচ্চাটা! এতদিন পর দেখা হলো আমাদের। এভাবে গাল ফুলিয়ে থাকবে? কথা বলবে না?”

রিহানের কথা ভেবেই অর্ষা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। যা হওয়ার তো হয়েছেই। চলে যাওয়া সময়গুলো তো আর ফেরত আনা যাবে না। তাই সেসব ভেবে এই মুহূর্তটাকেও নষ্ট করতে চাইছে না সে। এর মাঝে খাবারও চলে এসেছে। দুজনে খেতে খেতে গল্প করছে। রিহান পেশায় একজন সুরকার এবং গায়ক। যদিও অত বড়ো পর্যায়ে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। তবে তার বিশাল একটা ফ্যানব্যাজ রয়েছে। অনেক ভক্ত তার। অর্ষার সাথেও রিহানের পরিচয় হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি ছিল অর্ষাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ই ডিসেম্বর উপলক্ষে। সেখানে রিহানের গানের শো ছিল। অর্ষার গানের গলা বেশ ভালো। রিহানের শো শুরু হওয়ার আগে সে এবং ক্লাসের আরেক ছেলে দুজনে ডুয়েট গান গেয়েছিল। গানের মাঝখানেই রিহান পৌঁছে গেছিল এবং বাকি গানটুকু সেও দর্শকদের সাথে উপভোগ করেছিল। সেখান থেকেই ভালোলাগা শুরু, পরিচয় এবং এক পর্যায়ে সেটা প্রণয়ে রূপ নেয়।

মাগরিবের আজান দিয়েছে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যাবেলাকেও দেখে মনে হচ্ছে রাত হয়ে গেছে। বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় রিহানের একটা কল আসে। কথা শেষ করে রিহান বলে,

“বাবুই, আমার আর্জেন্ট একটা কাজ আছে। যেতে হবে এখনই। তুমি সিএনজিতে যেতে পারবে না?”

“পারব।”

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে সিএনজি ঠিক করে দিচ্ছি।”

“লাগবে না। আমি ঠিক করে নিতে পারব। তুমি যাও। নয়তো দেরি হয়ে যাবে।”

“চুপ করো! বললেই হলো নাকি? এই সন্ধ্যায় আমি তোমায় এভাবে ছাড়ব? কাজ না থাকলে তো আমিই তোমাকে দিয়ে আসতাম। তোমার প্রতি আমার একটা রেসপন্সিবিলিটি তো আছে নাকি?”

কথাগুলো বলতে বলতেই রিহান একটা সিএনজি থামিয়েছে এবং ভাড়াও দিয়ে দিয়েছে। অর্ষা সিএনজিতে ওঠার আগে মলিন হেসে বলল,

“টাকা দিয়ে সেই রেসপন্সিবিলির দায় মেটাতে চাইছ?”

“মানে!”

“কিছু না। সাবধানে যেও।”

“বাড়িতে পৌঁছে কল দিও।”

অর্ষা সিনএজিতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বলল। কেন জানিনা তার চোখ ছলছল করছে। এখনই হয়তো কেঁদে ফেলবে সে। এতই ব্যস্ততা? শুধু অর্ষার বেলাতেই!

মাঝ রাস্তায় গিয়ে সিএনজিও খারাপ হয়ে গেল। অর্ষা অবশ্য বিরক্ত হলো না। ড্রাইভার বলল,

“আপা, একটু দেরি করন লাগব।”

“তাহলে আমি নেমে যাচ্ছি। সমস্যা নেই।”

ড্রাইভার টাকা অর্ধেক ফেরত দিতে চাইলে অর্ষা বলল,

“লাগবে না। আপনি রেখে দিন।”

এরপর সে ফুলের তোড়াটা নিয়ে ফুটপাত দিয়ে আনমনে হাঁটতে লাগল। মাথায় তখনো শুধু রিহানের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্যমনস্ক থাকায় বামদিকে ঘুরতে গিয়ে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে যায় অর্ষার। সঙ্গে সঙ্গে ফুলের তোড়াটাও নিচে পড়ে যায়। ঐপাশের মানুষটা ফোনে কথা বলছিল বিধায় সেও কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল। আশ্চর্য করা বিষয় হচ্ছে সেই লোকটির হাতেও একই রকম ফুলের তোড়া; যেটার স্থানও এখন মাটিতে। লোকটি কল কেটে মাটি থেকে ফুলের তোড়া দুটো উঠিয়ে বলল,

“সরি! আমি খেয়াল করিনি।”

অর্ষা মৃদুস্বরে বলল,

“ইট’স ওকে।”

এরপর সে ফুলগুলো নিয়ে আবারও হাঁটতে লাগল। অল্প কিছুক্ষণ হেঁটে একটা রিকশা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে গেল। বাড়ি ফিরে আগে রিহানকে কল করল জানানোর জন্য যে, সে পৌঁছে গেছে। দুবার কল করার পরও যখন রেসপন্স পেল না তখন একটা টেক্সট করে দিল,

“আমি পৌঁছে গেছি।”

এরপর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফোন টেবিলে রাখতে গিয়ে ফুলগুলোর ওপর হাত রাখল। ফুলের তোড়াটা বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। চোখের পানি ফেলে আনমনে বলল,

“ভালোবাসি। ভালোবাসি ভীষণ!”

অনেকক্ষণ পর ফুলের তোড়া রাখতে গিয়ে দেখল ফুলগুলোর মাঝে একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ। কাগজটা খুলেই দেখল এটা ছোট্ট একটা চিরকুট। যেখানে লেখা রয়েছে,

“আমার অভিমানিনী রূপকন্যা, তোমার চোখে অশ্রুর বন্যা মানায় না। তুমি সদা-স্নিগ্ধ এই তাজা গোলাপ ফুলের মতো। তুমি ভোরের শিশিরের মতো হাসবে। ভালোবাসি তোমায়।

~আহনাফ।”

শেষে নামটা দেখে চক্ষু চড়কগাছ অর্ষার। ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেছে তার। সে এতক্ষণ অবধি ভেবেছিল চিরকুটটা রিহানের। কিন্তু এই আহনাফ কে? পরক্ষণেই তার ধাক্কা খাওয়ার ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। কোনোভাবে কি ফুলের তোড়া অদলবদল হয়ে গেছে? এবং সেই ছেলেটাই কি আহনাফ?

চলবে…