আহনাফ চৌধুরী পর্ব-০২

0
92

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
আহনাফ রুমের বারান্দায় পায়চারি করছে। প্রচণ্ড বাতাস এখানে। তবুও এতে তার কিছু যায় আসে না। বরং যেন একটু ভালোই লাগছিল। তার ধ্যান, জ্ঞানও এখন তার নিজের মাঝে নেই। অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেও কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি থেকে কোনো কল আসছে না দেখে অধৈর্য হয়ে পড়ে সে। অপেক্ষার প্রহরও যেন আর ফুরাচ্ছে না। অবশেষে সে নিজেই সুপ্তিকে কল করে। তিনবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করল সুপ্তি। ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে বলল,

“হ্যালো।”

কণ্ঠ শুনেই যেন মনটা ভালো হয়ে গেল আহনাফের। প্রশান্তি কাজ করছে ভেতরে। সে বলল,

“মন ভালো?”

“হ্যাঁ। ফুলগুলোর জন্য ধন্যবাদ।”

“শুধু ধন্যবাদ? ভালোবাসি বলবে না?”

“ভালো তো বাসিই। এটা আবার বলা লাগবে?”

“লাগবে। আমার শুনতে ভালো লাগে।”

“আচ্ছা ভালোবাসি, ভালোবাসি। এখন শোনো, বাসায় মেহমান এসেছে বুঝেছ। আমি তোমাকে পরে কল করব।”

“এই সময়ে মেহমান?”

“হ্যাঁ, আব্বুর বন্ধু-বান্ধব আসছে। মায়ের সাথে হাতে হাতে একটু কাজ করতে হবে।”

“ঠিক আছে। ঘুমানোর আগে তাহলে কল দিও।”

“আচ্ছা দেবো। টাটা।”

কল কেটে দেওয়ার পরও আহনাফ অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চিরকুটের ব্যাপারে সুপ্তি কিছু বলল না কেন?
.
.
রাত দেড়টা বাজে।

অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে অর্থি। অনেকবার সরিয়ে দেওয়ার পরও ঘুরেফিরে সেই ওকেই আবার জড়িয়ে ধরছে। অর্ষার একটা বাজে স্বভাব আছে। কেউ ওর গায়ে হাত-পা রাখলে ওর ঘুম হয় না, মেজাজ খারাপ হয়। বিরক্ত লাগে। আবার অন্যদিকে ও কাউকে বা কোলবালিশ না জড়িয়ে ধরলেও ঘুম হবে না। অর্থি হওয়ার আগে রাতে অর্ষা বড়ো বোন ঐশির সাথে ঘুমাতো। অর্থির মতোই এরকম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ঐশির অবশ্য অর্ষার মতো এরকম অদ্ভুত স্বভাব ছিল না। অর্ষা যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয় তখনই ঐশি আর ওর রুম আলাদা হয়ে যায়। রাত জেগে অর্ষার পড়তে হতো বিধায় ঐশির ঘুম হতো না। অর্থির বয়স এখন ১২ বছর। কিছুদিন পূর্বেই তার পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা হলো। প্রচণ্ড দুষ্টু সে। তার শোবার ঘর নির্দিষ্ট নয়। কখনো ঐশির সাথে ঘুমাবে তো কখনো অর্ষার সাথে। গত এক সপ্তাহ্ অর্থি ঐশির রুমে ঘুমালেও আজ স্থান গেড়েছে অর্ষার রুমে। কারণটাও অবশ্য অর্ষার নিকট পরিষ্কার। ফুলের লোভে আজ এই রুমে ঘুমিয়েছে। মনে মনে হাসল সে।

অর্থির হাত-পা ওর ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে ভালো করে লেপ দিয়ে ঢেকে দিল। রিহানের কথা মনে পড়ে গেল তখন। অর্ষার গায়ে হাত-পা রাখলে যে ঘুম হয় না একবার কথায় কথায় এটা সে রিহানকে বলে ফেলেছিল। এ নিয়ে রিহান প্রায়ই ওকে এটা বলে ক্ষ্যাপাতো যে, বিয়ের পর কী করবে? লজ্জায় তখন সে নতজানু হয়ে থাকত। কোনো উত্তরই দিতে পারত না।

রিহানের কথা ভাবতে ভাবতেই অর্ষার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে রিহানের নাম। মুখ তৎক্ষণাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল অর্ষার। তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে ধীরস্বরে বলল,

“হ্যালো!”

“হ্যালো বাবুই, ঘুমাওনি এখনো?”

“উঁহু!”

“কেন? অলমোস্ট রাত দুটো বাজতে চলল।”

“ঘুম আসছে না।”

“দিনে ঘুমিয়েছিলে?”

“উঁহু।”

“তাহলে ঘুম আসছে না কেন?”

“জানিনা তো!”

“আচ্ছা তাহলে কী করছিলে এতক্ষণ?”

“তোমাকে মিস করছিলাম।”

“তাই? কতটা?”

“অনেএএএএক!” একটু টেনে বলল অর্ষা।

রিহান হেসে ফেলল। হেসে হেসেই বলল,

“আমিও তো মিস করি বাবুই। মাত্র কাজ শেষ করে স্টুডিও থেকে বের হলাম। এখন বাসায় যাচ্ছি।”

“রাতে তাহলে খাওনি?”

“খেয়েছি তো। তুমি খেয়েছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“বাবুই।”

“বলো।”

“লাভ ইউ।”

“লাভ ইউ টু।”

“আমার ওপর তোমার খুব রাগ না?”

“কেন?”

“এইযে তোমাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারি না। ব্যস্ত থাকি অনেক।”

“ব্যাপার না। কাজ তো করতে হবেই।”

“আমার লক্ষীটা! তুমি আমায় এত বোঝো কেন বলো তো?”

“ভালোবাসি তাই বুঝি। আমি না বুঝলে আর কে বুঝবে? অন্য কেউ আছে?”

“একদমই না। বাসার সবাই কেমন আছে?”

“সবাই ভালো আছে। তোমার?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ সবাই ভালো আছে। অর্থির কী খবর?”

“ভালো। ঘুমুচ্ছে এখন।”

“তোমার সাথে নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“কবে যে এভাবে পাশে আমি থাকব!”

“বিয়ে করারই নাম নেই।”

“করব। খুব শীঘ্রই। একটু অপেক্ষা করো শুধু। আগে আমার ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে নিই।”

“হুম।”

“তুমি তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো বাবুই।”

“ঠিক আছে। তোমার পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?”

“অলমোস্ট পৌঁছে গেছি।”

“ঠিক আছে। সাবধানে যাবে। রাখছি।”

“লাভ ইউ।”

“লাভ ইউ টু। আল্লাহ্ হাফেজ।”

“আল্লাহ্ হাফেজ।”

ফোন রেখে মনে মনে কিছুক্ষণ নাচল অর্ষা। এইটুকু কথাতেই তার মন ভালো হয়ে গেছে। আসলে সে তো রিহানের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা সময় চায় না। সে চায় এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পুরো সময় মিলিয়ে অন্তত চব্বিশটা মিনিট রিহান তার সাথে কথা বলুক। মাঝে মাঝে অবশ্য অল্প চাওয়াটুকুও অপরপক্ষের কাছে বিরাট কিছু মনে হয়। রিহানের ক্ষেত্রেও হয়তো এমনটাই হবে। তবে যাই হোক, রিহান তো তাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করছে এত ব্যস্ততার মাঝেও। অর্ষা তাতেই খুশি। খুশিতে অর্থিকে জড়িয়ে ধরে সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
______

ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু আজ এত বেশি কুয়াশা পড়েছে যে চারপাশের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুক্রবার আজ। অফিস নেই। তবুও সকাল বেলাতেই আহনাফের ঘুম ভেঙে গেছে। সে একটা চেয়ার নিয়ে বারান্দার দরজায় বসে আছে। তার বারান্দায় কিছু ফুলের গাছ আছে। গাছগুলো সে লাগায়নি। তার মা সাজেদা বেগম লাগিয়েছেন। এগুলোর পরিচর্যাও তিনিই করেন। গাছগুলোর ডগায়, পাতায় কীভাবে শিশিরে ভিজে আছে সেটাই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। মনকে কোনো এক জায়গায় স্থির করতে চাইছে। কেননা তার ঘুমই ভেঙেছে দুঃস্বপ্ন দেখে। তখন থেকেই মন অস্থির এবং অশান্ত হয়ে আছে। অস্থিরতার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে সুপ্তি। স্বপ্নটা সে সুপ্তিকে নিয়েই দেখেছে। ঘুম ভাঙার পর থেকে অনেকবার কলও করেছে সে সুপ্তিকে। কোনো রেসপন্স পায়নি। অবশ্য রেসপন্স যে এখন পাবে না এটা আহনাফও জানে। কারণ সুপ্তি সবসময় ফোন সাইলেন্ট মোডে রেখে ঘুমায়।

নয়নতারা ফুলের পাতা গড়িয়ে দুফোটা শিশিরবিন্দু ফ্লোরে পড়তেই আহনাফ আনমনে হেসে উঠল। তার মনে হলো যেন শিশিরবিন্দু নয়; বরং সে নিজেও এভাবেই সুপ্তির প্রেমে টুপ করে পড়েছিল। যদিও সুপ্তিই প্রথম তাকে ভালোবাসা নিবেদন করেছিল। তখন সে নতুন নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে। কাজের প্রচুর ব্যস্ততা ও চাপে হিমশিম খাচ্ছিল তখন একটা চিকন মিষ্টি কণ্ঠ বলে উঠেছিল,

“কফি খাবেন?”

আহনাফ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিল সুন্দরী এক মেয়ে। যার নাম সুপ্তি। আহনাফের ছোটোবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গ তেমন একটা পছন্দ নয়। এর মানে এই নয় যে সে মেয়েদেরকে পছন্দ করে না। তবে থাকে না কিছু মানুষের পছন্দের গণ্ডি? আহনাফেরও পছন্দের গণ্ডির বাইরে ছিল মেয়েরা। মেয়ে বলতে সে তার আত্নীয়-স্বজন অর্থাৎ চাচি, মামি, কাকি, ফুপি, দাদি, নানি, মা, বোন এবং ভাগ্নি এদের পছন্দ করতো। এছাড়া স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটি যেটাই হোক সে মেয়েদের এড়িয়ে চলত। কলেজ-ভার্সিটিতে বন্ধুরা যখন চুটিয়ে প্রেম করত আহনাফ তখন বইয়ের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে রাখত। এটা নিয়ে তার বন্ধুরাও কম মজা করত না। প্রেম যে কখনো আহনাফের জীবনে আসেনি এমনটাও নয়। এসেছিল হাই-স্কুলে। কিন্তু চুপচাপ স্বভাবের হওয়াতে মনের কথা জানানো হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর মেয়ের বাবার বদলি হওয়ায় ওরা ঢাকা থেকে সিলেট চলে যায়। এরপর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সময়ের সাথে সাথে আহনাফও সেসব ভুলে গেছে। ওটাকে আসলে প্রেম বলবে নাকি মোহ, আবেগ, ভালো লাগা তা নিয়েও সে যথেষ্ট সন্দিহান। এরপর আর কাউকে ভালো লাগলেও নিজেই নিজেকে শাসিয়েছে। সম্পর্ক থেকে দূরে থেকেছে। প্রপোজাল পেলে রিজেক্ট করেছে। কিন্তু তার সকল দম্ভ, সংকল্প কেন জানি সুপ্তির নিকট আর টিকল না। সে যতই সুপ্তিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত ততই সুপ্তি ওকে মানানোর চেষ্টা করত। কলিগ হওয়াতে কিছু কঠিন কথা শোনাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিত। ভদ্রতাসূচক যতটুকু মেশা বা কথা বলার প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই বলত। কিন্তু একদিন যখন সে দেখল সুপ্তি সিকিউরিটি গার্ডকে খাবার কিনে দিচ্ছে তখন তার কৌতুহল হলো এবং সেদিন সে যেচে নিজেই সুপ্তির সাথে কথা বলেছিল। সুপ্তি এতে যেমন অবাক হয়েছিল তেমনিভাবে খুশিও হয়েছিল। সুপ্তির ভাষ্যমতে আহনাফ জানতে পেরেছিল, সেই সিকিউরিটি গার্ড গ্রাম থেকে ঢাকায় নতুন এসেছে। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তিনবেলা খাবারও জোটে না। তাই সুপ্তি তাকে মাঝেসাঝেই খাবার কিনে দেয়। কখনো বা বাড়ি থেকে খাবার এনে দেয়। তাদের মধ্যে এখন মামা-ভাগ্নির সম্পর্ক। সুপ্তির এই উদার মানসিকতাই আহনাফকে মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতার জের ধরেই সে আর সুপ্তিকে এড়িয়ে চলতে পারত না। কথা বলা, রেস্টুরেন্টে একসাথে খাওয়া, উইকেন্ডে দেখা করা এসব প্রায়ই হতো। একসময় সুপ্তি সরাসরি মনের কথা প্রকাশ করলে আহনাফও রাজি হয়ে যায়। তখন থেকেই তাদের সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্কের বয়স দুই বছর হলেও আহনাফের ভালোবাসা এখনো সেই প্রথমদিনের মতোই রয়ে গেছে। যদিও সে লক্ষ্য করে দেখেছে সুপ্তির মাঝে বেশ পরিবর্তন এখন।

“আহনাফ! এই ঠান্ডায় বসে আছিস কেন বাবা?”

সাজেদা বেগমের হঠাৎ আগমনে আহনাফ কিছুটা হকচকিয়ে উঠল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

“এমনিই!”

“এমনি কেউ ঠান্ডার মধ্যে বসে থাকে? ভেতরে আয়। বারান্দার দরজা বন্ধ কর।”

মায়ের কথার অবাধ্য হলো না আহনাফ। সুবোধ বালকের ন্যায় দরজা লাগিয়ে রুমে এসে বসল। সাজেদা বেগমও পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন,

“এত তাড়াতাড়ি উঠেছিস কেন? কোনো কাজ আছে?”

“না। ঘুম ভেঙে গেছে।”

“আচ্ছা নাস্তা করবি আয়।”

“পরে খাব।”

“তামিম এসেছে।”

“কখন?”

“মাত্রই। ওকে খেতে বসিয়েই তোকে ডাকতে এসেছি। চল।”

আহনাফ মায়ের সঙ্গে ডাইনিংরুমে গিয়ে দেখল তামিম মুখ পাংশুটে করে বসে আছে। ওর পাশে বসে আহনাফ বলল,

“কী হয়েছে?”

তামিম পাংশুটে মুখেই বলল,

“হয়নি। হবে।”

“কী হবে?”

“বিয়ে।”

“মানে?”

“মানে আজ মেয়ে দেখতে যাবে বাড়ির সবাই।”

“বাহ্! এটা তো গুড নিউজ। বিয়ের কথা শুনলে ছেলেরা খুশি হয়। তুই মুখ এমন করে রেখেছিস কেন?”

“আমার নার্ভাস লাগছে।”

“আজব! তুই মেয়ে দেখতে যাবি। মেয়ে তোকে দেখতে আসবে না।”

“তাও! তুই আমার সাথে চল।”

“আমি যাব কেন?”

“আমার সঙ্গে থাকবি। আমায় সাহস দিবি। প্লিজ! না করিস না। বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে থাকবি না?”

আহনাফ মুচকি হেসে বলল,

“আচ্ছা যাব। এখন নাস্তা কর।”
.
.
অর্ষাকে বিকেলবেলা রেডি হতে দেখে আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“কোথাও যাবি?”

অর্ষা মাথায় ওড়না দিতে দিতে বলল,

“হু। কুরিয়ার অফিসে যাব একটু।”

“এখনই যেতে হবে?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“ঐশিকে একটু পরেই ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।”

“আপুকে দেখতে আসবে, মা। আমাকে নয়। আর তোমাকে যতটুকু কাজে সাহায্য করার ততটুকু তো করেছি। এখন তারা আসলে শুধু সামনে খাবার দেবে।”

“ঐশিকে রেডি কে করাবে?”

“মা! আপু কি বাচ্চা?”

আমেনা বেগম চুপ করে আছেন। অর্ষা হেসে ফেলল। সে তো তার মাকে চেনে। বাইরে কোথাও গেলেই অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। সে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

“জলদি চলে আসব।”

এরপর সে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। পথে একবার রিহানকে কল করেছিল। সকাল থেকে এখন অবধি আর কথা হয়নি। কাজে আছে নাকি ঘুমায় কে জানে! কিন্তু ফোন রিসিভ করল না রিহান। অর্ষাও আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করল না। ফ্রি হলে কলব্যাক করবেই। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজছিল। তখন তার ভার্সিটির এক ক্লাসমেট শাকিল রিকশায় করে কোথাও যাচ্ছিল। অর্ষাকে দেখে রিকশা থামিয়ে উঁকি দিল সে। অগত্যা অর্ষাও এগিয়ে গেল। শাকিল হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। কোথাও যাচ্ছ?”

“হু। একটু কুরিয়ার অফিসে যাব।”

“ওহ। রিকশায় উঠো। আমি কুরিয়ার অফিসের সামনে দিয়েই যাব।”

“সমস্যা নেই। আমি রিকশা খুঁজে নেব।”

“আমার সাথে গেলে কি সমস্যা?”

অর্ষা কী বলবে বুঝতে পারল না। তাই কথা না বাড়িয়ে রিকশায় উঠে পড়ল। সে জানে ক্লাসের আরও কয়েকজনের মধ্যে শাকিলও একজন, যে অর্ষাকে পছন্দ করে। যদিও মুখে বলেনি তবে হাভেভাবে বুঝিয়েছে। অর্ষাকে নিশ্চুপ দেখে শাকিল জিজ্ঞেস করল,

“ক্লাসে আসো না কেন? আইডিও ডিএক্টিভেট ছিল দেখলাম।”

“এমনিই।”

“এমনিই নাকি কোনো কারণ আছে? জানো কত মিস করছিলাম? আমি তো ভেবেছি, আবার বিয়েটিয়ে করে ফেলেছ কিনা!”

শাকিল কথাটা হেসেই বলল। সঙ্গে মৃদু হাসল অর্ষাও। বলল,

“করিনি এখনো। তবে করব শীঘ্রই।”

শাকিল মলিন স্বরে বলল,

“ওহ।”

এরপর কথা বেশিদূর আগায়নি। কুরিয়ার অফিসের সামনে নেমে অর্ষা ভাড়া দিতে চাইলে শাকিল বলল,

“পাগল নাকি! তুমি ভাড়া দিচ্ছ কেন? আমি দিয়ে দেবো। তুমি যাও।”

“আমি দিলে কী সমস্যা?”

“আমি দিলেও সমস্যা নেই। যাও। আসছি। আর ক্লাসে এসো।”

শাকিল চলে যাওয়ার পর অর্ষা বিদ্রুপ করে হাসল। সবারই শুধু চোখের মায়া। যতক্ষণ চোখের সামনে থাকে ততক্ষণ ভালোবাসা, কেয়ার সব উপচে পড়ে। চোখের আড়াল হলে কেউ একটা খোঁজ তো নিবে দূরে থাক; অর্ষা নামে পৃথিবীতে যে কেউ আছে এটাই সবাই ভুলে যায়।

কুরিয়ার অফিসে গিয়ে অর্ষার আক্কেল গুড়ুম। এতগুলো বই এখন সে কী করে বাড়ি অবধি নিয়ে যাবে? উপায় না পেয়ে কুরিয়ারের ছেলেটাকে অনুরোধের স্বরে বলল,

“বইগুলো একটু রিকশা পর্যন্ত নিয়ে দেবেন প্লিজ?”

মেয়েদের অনুরোধ উপেক্ষা করা পুরুষের কাম্য নয়। সেই ছেলেটিও উপেক্ষা না করে বরং সাহায্য করল। অর্ষা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বইগুলো নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এলো। ভাড়া দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলল,

“মামা, বইগুলা একটু দোতলা পর্যন্ত নিয়ে দেবেন?”

রিকশাওয়ালা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলল,

“আম্মা, আমার কোমরত বেদনা। ভারি জিনিস নিতাম ফারি না। নইলে নিয়া দিতাম।”

“ওহ। আচ্ছা তাহলে থাক।”

ভাড়া দিয়ে বইগুলো নিয়ে অর্ষা বাড়ির মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকেই পাচ্ছে না হেল্প চাওয়ার জন্য। সে উপায় না পেয়ে বাবাকে কল করল কয়েকবার। কিন্তু রিসিভ করেনি। এখন তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। নিজের ওপরেই বিরক্ত সে। এতগুলো বই একসাথে অর্ডার করতে কে বলেছিল তাকে? বিরক্তি নিয়ে বাড়ির ভেতরে তাকাতেই দেখতে পেল একটা ছেলে লনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। সে এখান থেকেই জোরে ডাকল,

”হ্যালো, এইযে? শুনছেন?”

ছেলেটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে যখন দেখল তাকেই ডাকা হয়েছে তখন কল কেটে সে সামনে এগিয়ে এলো। ছেলেটাকে কাছ থেকে দেখেই অর্ষার ভ্রু কুঁচকে গেল। এটা তো মনে হচ্ছে গতকাল ধাক্কা খাওয়া সেই ছেলেটি। কী যেন নাম! ওহ হ্যাঁ, আহনাফ। অর্ষা যখন নিশ্চুপ থেকে মনে মনে প্রশ্নের জাল বুনছিল তখন ছেলেটি প্রশ্ন করল,

“আমায় ডেকেছেন?”

“জি। একটা হেল্প দরকার ছিল।”

“কী হেল্প?”

“যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে বইগুলো একটু দোতালা পর্যন্ত নিয়ে দেবেন?”

এমন কোনো হেল্প চাইবে সে হয়তো আশা করেনি। অবাক হয়ে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ যেতে সাহায্য চাইলে তাকে তো মুখের ওপর ‘না’ও বলা যায় না। তাই সে অর্ষাকে হেল্প করার জন্য বইয়ের ভারি প্যাকেট দু’হাতে তুলে নিল। তখনই তার এক হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটি বেজে ওঠে। রিসিভ করতে গিয়ে চাপ লেগে লাউডস্পিকার অন হয়ে যায়। ওপাশ থেকে একটা পুরুষকণ্ঠ চাপাস্বরে বলে উঠল,

“আহনাফের বাচ্চা! আমাকে রেখে কোথায় গেলি? জলদি আয়!”

আহনাফ একটু বিব্রতভাবে অর্ষার দিকে তাকাল। শুধু ‘আসছি’ বলে কলটা কেটে দিল সে। এদিকে অর্ষার মনের কনফিউশনও দূর হয়ে গেছে যে, এই ছেলেই আহনাফ।

দোতালায় উঠে অর্ষা যখন কলিংবেল বাজাল তখন আহনাফ একটু অবাকই হয়েছে। সে হয়তো ভাবেনি যে, তার বন্ধুর জন্য যেই পাত্রী দেখতে এসেছ তারই কেউ হবে এই মেয়ে। দরজা খুলে দিয়েছে অর্থি। অর্ষা নিশ্চুপে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। পিছু পিছু বই নিয়ে আহনাফও গেল। অর্থিও পিছু আসতে আসতে বলছে,

“আপু, কী এনেছ? কী এনেছ?”

ওর কণ্ঠস্বর শুনেই সবার মনোযোগ ওদের দিকে পড়েছে। আহনাফের হাতে বই দেখে আমেনা বেগমের চক্ষু চড়কগাছ। তিনি তড়িঘড়ি করে অর্ষার রুমে গিয়ে বললেন,

“একি! তুই ওকে দিয়ে বই এনেছিস কেন?”

এরপর তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,

“বাবা, তুমি রাখো এগুলো রাখো। ও তো জানতো না আসলে…”

আহনাফ তাকে শান্ত করতে বলল,

“সমস্যা নেই আন্টি।”

অর্ষা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মা এই ছেলেটাকে এত তোষামোদ কেন করছে? তাকে হেল্প করেছে বিধায় আহনাফকে সে ভেতরে এনেছিল ভদ্রতাসূচক এক কাপ চা খাওয়াতে। ড্রয়িংরুমে মানুষজন দেখে বুঝতে পেরেছে যে পাত্রপক্ষ এসেছে ঐশিকে দেখতে। তাই সে ভেতরের রুমে নিয়ে এসেছে। সাথে করে অর্থিকেও এনেছিল মাকে ডেকে পাঠাবে বলে। কিন্তু মা তো নিজেই হাজির। আবার এর প্রতি এত আদর-যত্ন!

আমেনা বেগম ব্যস্ত হয়ে বললেন,

“বাবা, তুমি এসো খাবে। আসার পর থেকে তো কিছুই খাওনি।”

আহনাফ কিছু না বলে তার সাথে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। অর্ষা তখন অর্থিকে জিজ্ঞেস করল,

“এই ছেলে কে রে?”

“এই ভাইয়াটাও তো মেহমান।”

“মেহমান মানে? আপুকে যারা দেখতে এসেছে ওদের সাথে আসছে?”

অর্থি উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। অর্ষা নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে বলল,

“ধ্যাত!”

আহনাফ তামিমের কাছে গিয়ে বসেছে। তামিম তখন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় ছিলি?”

আহনাফও ফিসফিস করে বলল,

“তোর হবু শালিকা তো ফ্রিতে আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিল।”

“মানে!”

“পরে বলব। শুধু এইটুকু বলি, তুই সাবধানে থাকিস বিয়ে হলে।”

দেখার পর্ব শেষ হলে কথাবার্তা বলল সবাই। এরপর খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার সময় মা-বাবার সাথে অর্ষা এবং অর্থিও নিচে নামল তাদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য। বড়োরা সবাই তখনো কথাবার্তা বলতে বলতে হাঁটছিল। তামিম এবং আহনাফ হাঁটছিল একসাথে। অর্ষা আহনাফকে ফের উদ্দেশ্য করে বলল,

“শুনছেন?”

আহনাফ এবং তামিম দুজনেই পিছু ফিরে তাকাল। অর্ষা সেই চিরকুটটা আহনাফকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“এটা বোধ হয় আপনার।”

এরপর সে তামিমকে বলল,

“ভাইয়া, সাবধানে যাবেন।”

তামিম বেশ অবাক হয়েছে এই ঘটনায়। এই কাগজ আহনাফের মানে? নাকি ঘোল খাইয়ে প্রেমপত্র দিল? অর্ষা এবং অর্থি চলে আসার পর আহনাফ কাগজের ভাঁজ খুলে ভড়কে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,

“হাউ দিস পসিবল!”

“দেখি কী এটা?” বলে তামিম কাগজটা হাতে নিল।

লেখা পড়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,

“কী রে? তুই আমার হবু শালিকাকে চিঠি দিছিলি ক্যান?”

চলবে…