আহনাফ চৌধুরী পর্ব-০৪

0
71

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
ঠান্ডায় শরীর শিউরে উঠছে অর্ষার। সাথে রয়েছে অসহনীয় ব্যথা। শীতকালে একটুখানি হোঁচট খেলেও মনে হয় জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে। সেখানে দূর থেকে কাচের গ্লাস এসে লেগেছে বলে কথা! অর্ষার দু’চোখ বেয়ে নিরবে অশ্রু ঝড়ছে। সাজেদা বেগম উদ্বিগ্নচিত্তে একটা কাপড়ে আইস কিউব নিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে আলতো করে ঘষে দিচ্ছেন। যন্ত্রণা যেমন হচ্ছে, তেমনই আবার ঠান্ডাও লাগছিল।

আহনাফ হতবিহ্বল হয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে নিজের রুমে চলে গেছে। পুরো ড্রয়িংরুমে জিনিসপত্র ভেঙেচূড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। বাড়ির মেইড সাবধানে আগে কাচের টুকরাগুলো একটা পাত্রে তুলে নিচ্ছে। তামিম ব্যথিত নয়নে কিছুক্ষণ অর্ষার দিকে তাকিয়ে রইল। তার নিজেকে এখন ভীষণ অপরাধী লাগছে। যদি সে অর্ষাকে এই বাড়িতে না আনতো তাহলে মেয়েটার সাথে এমনকিছুই হতো না আজ। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে আহনাফের রুমে গেল। আহনাফ তখন খাটের একপাশে মাথা নত করে বসে ছিল। তার শূন্য দৃষ্টি ফ্লোরে স্থির। একবার মনে হচ্ছে এখনো তার ভেতর রাগ জ্বলজ্বল করছে, আরেকবার মনে হচ্ছে সে অনুশোচনা করছে। কার জন্য তার এমন দ্বিমুখী ভাবাবেগ তামিম এখনো তা ঠাওর করতে পারছে না।

আহনাফের সাথে বন্ধুত্ব দুই, একদিনের নয়। সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে। যখন তারা দুজনই নার্সারির ছাত্র ছিল। আহনাফ ছোটোবেলা থেকেই পড়ার প্রতি আগ্রহী থাকলেও তামিম ছিল বিপরীত। তার পড়াশোনা ভালো লাগতো না। তারওপর ছিল ছিঁচকাঁদুনে। তাকে যেদিন স্কুলে ভর্তি করাল নার্সারিতে সেদিন তার সে কী কান্না! সে কিছুতেই ক্লাস করবে না। তামিমের মা জোর করেই ওকে ক্লাসে দিয়ে এসেছিল। ওর পাশেই সেদিন বসে ছিল আহনাফ। শান্ত, চুপচাপ, গম্ভীর। তামিম ওর গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা দেখে আরও বেশি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিল। এক প্রকার সে আহনাফকে ভয়ই পাচ্ছিল। তার ভয়কে অভয় দিতে তাকে অবাক করে দিয়ে আহনাফ ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে আধো স্বরে বলেছিল,

“কাঁদে না!”

বিস্ময়ে তামিম যেন কাঁদতেই ভুলে গেছিল তখন। সেই পড়াচোর স্বভাবের তামিমকে আহনাফই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। ওর জন্যই তামিম স্কুলে আসত। মাঝে মাঝে আহনাফ ওর হোমওয়ার্কও করে দিত। সেই থেকে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি দুজনে একইসাথে শেষ করেছে। এখন জবও করে দুজন একই কোম্পানীতে। সেই এইটুকু বয়স থেকে তো সে আহনাফকে দেখে আসছে তাই আহনাফের স্বভাব, আচরণ সম্পর্কে সে অবগত। আহনাফ যতটা সাইলেন্ট, রেগে গেলে তারচেয়েও অধিক বেশি ভা’য়ো’লে’ট হয়ে যায়। যদিও এত বছরে সে আহনাফকে মাত্র দু’বারই এমন রাগ করতে দেখেছিল। প্রথমবার স্কুলে দেখেছিল। এক ছেলে আহনাফের মা তুলে গালি দেওয়ায় ভাঙা বেঞ্চের কাঠ দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিল সেই ছেলেটাকে। দ্বিতীয়বার অত্যাধিক মাত্রায় আহনাফকে রাগতে দেখেছিল যখন ওরা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। তামিমকে সিনিয়র এক ছেলে মজা করে সবার সামনে অপমান করেছিল। সেই রাগে আহনাফ ঐ ছেলেকে মা’রার জন্য যেতে চেয়েছিল। তামিম আটকিয়েছিল বলে জিদ্দে সে তামিমের ল্যাপটপ ভেঙে ফেলেছিল। টানা দশদিন কথাও বলেনি। আর আজ তৃতীয়বারের মতো আহনাফকে সে এমন রাগ করতে দেখল। হয়তো গত দু’বারের চেয়েও বেশি। অবশ্যই এর পেছনে শক্ত কোনো হেতু রয়েছে।

সে নিঃশব্দে গিয়ে আহনাফের পাশে বসল। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে?”

আহনাফ কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে রইল। তামিম পূর্বের মতোই শান্তকণ্ঠে ফের শুধাল,

“বল? এত রেগেছিস কেন?”

এবারও আহনাফের থেকে কোনো জবাব এল না। তামিম নিজে থেকেই বলল,

“বাড়িতে আন্টি আছে। কাজের খালা আছে। তাদের সামনে কি এমন ভাঙচুর করাটা ঠিক হয়েছে তোর? আন্টি অসুস্থ হয়ে গেলে পরে? তারওপর এতটাই রেগে আছিস যে আশপাশ কিচ্ছু খেয়াল করিসনি। একটুর জন্য গ্লাসটা অর্ষার চোখে লাগেনি জানিস? মেয়েটা ব্যথায় এখন কাঁদছে।”

আহনাফ এবার মুখ খুলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“সব সহ্য হয় আমার। কিন্তু প্রতারণা! প্রতারণা আমার সহ্য হয় না। আমি কি চিটিং ডিজার্ভ করি? আমি যার প্রতি লয়্যাল সে কেন আমার সাথে চিট করবে? ভালোবাসা, সময়, কেয়ার কোনটার কমতি ছিল?”

“সুপ্তির সাথে কিছু হয়েছে?”

আহনাফ এবার ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে একটা ছবি বের করে তামিমের হাতে দিল। ছবি দেখে তামিম যে শুধু অবাকই হয়েছে এমন নয়। সেই সাথে তার নিজেরও আহনাফের মতোই রাগ হচ্ছে। সুপ্তি এক ছেলের কোলে বসে আছে তাও গলা জড়িয়ে ধরে। আর ছেলেটা সুপ্তির গালে চুমু দিচ্ছে। এরকম ছবি কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার জন্যই সুখকর হবে না স্বাভাবিক। তামিম কী বলবে বুঝতে পারছে না। ফোনটা বিছানার ওপর রেখে জিজ্ঞেস করল,

“রিসেন্ট ছবি?”

“হু। ওর পরনের শাড়িটাও আমার গিফ্ট করা।”

তামিমের মেজাজ চিড়চিড় করছে। মনে মনে বিশ্রী কিছু গালি দিল সে সুপ্তিকে। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠল। সুপ্তি কল করেছে তাকে। আহনাফও তাকাল তখন ফোনের দিকে। ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল,

“ওর নাম্বার ব্লক করে দিয়েছি। আইডিও। এজন্য বোধ হয় তোর কাছে কল করেছে।”

“দাঁড়া। ধুঁয়ে দিচ্ছি আমি!”

“না। খারাপ কোনো আচরণ করবি না।”

“এরপরও?”

“হ্যাঁ, এরপরও। কারণ ও একটা মেয়ে!”

তামিম আহনাফের ওপরও বিরক্ত হলো। মেজাজ শান্ত রেখে রিসিভ করল কল। সুপ্তি ওপাশ থেকে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,

“তামিম ভাইয়া, আহনাফের সাথে কি আপনার কথা হয়েছে?”

ভেতরে ভেতরে রাগে ফুসলেও শান্তকণ্ঠে বলল,

“কেন?”

“ওর সাথে আমার একটু দেখা করিয়ে দেবেন প্লিজ? প্লিজ ভাইয়া! আর্জেন্ট, খুব দরকার।”

ফোন লাউডস্পিকারে দেওয়া ছিল। আহনাফ সুপ্তির কথা শুনে তামিমের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলো,

“রুফটপ রেস্টুরেন্টে আসো ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই।”

সুপ্তি অবাক হয়ে বলল,

“আহনাফ! আমার কথা…”

“ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই!” বলে কল কেটে দিল আহনাফ।

তামিম বিরক্ত হয়ে বলল,

“তুই ওর সাথে দেখা করবি কেন?”

আহনাফ কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ড্রয়িংরুম দিয়ে যাওয়ার সময় মায়ের রুমের দিকে নজর পড়ল তার। অর্ষাও ঐ রুমেই। সাজেদা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে কিছু বলছে ওকে। অর্ষা নিশ্চুপে শুধু চোখের পানি ফেলছে। তার ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল! সে আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

সাজেদা বেগমের ভীষণ খারাপ লাগছে অর্ষার জন্য। কষ্টও হচ্ছে। চোখ ছলছল করছিল। সে ধরে আসা গলায় অর্ষাকে বলল,

“আমার ছেলেটাকে ভুল বুঝো না, মা। ও আসলে এমনি খুব শান্তশিষ্ট। কিন্তু যখন রাগে তখন সামলানো খুব মুশকিল হয়ে যায়। তোমরা আসার কিছুক্ষণ আগেই ও বাইরে থেকে আসলো। এসেই ভাঙচুর শুরু করেছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার সুযোগটুকুও দিচ্ছিল না। এরমধ্যে তোমার সাথে এমন অঘটন ঘটে গেল। আমার ছেলের হয়ে আমি মাফ চাইছি, মা!”

অর্ষা সাজেদা বেগমের হাত ধরে আহতস্বরে বলল,

“এভাবে বলবেন না আন্টি। এখানে তো মাফ চাওয়ার মতো কিছু হয়নি। আর উনারও কোনো দোষ নেই। উনি তো আর ইচ্ছে করে আমাকে আঘাত করেনি। প্লিজ এটা নিয়ে আপনি মন ছোটো করবেন না!”

সাজেদা বেগম এবার কেঁদেই ফেললেন। তামিম এসে বলল,

“অর্ষা, বাড়ি চলো।”

সাজেদা বেগম বলল,

“এখন যেতে হবে না। বিকেলে দিয়ে আসিস। আমার কাছে থাকুক।”

অর্ষা বলল,

“না, আন্টি। মা চিন্তা করবে। আমি অন্য একদিন আসব ভাগ্যে থাকলে।”

সাজেদা বেগম অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“এমন মন্দভাগ্য নিয়ে এসো না। পরেরবার ভালো ভাগ্য নিয়ে আসবে। আমি অপেক্ষায় থাকব।”

অর্ষা মৃদু হাসল। চোখের কিনারে লাগলেও ডানপাশের চোখসহ স্থানটা ফুলে লাল হয়ে আছে। তামিমের সাথে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তামিম অপরাধের ন্যায় বলল,

“সরি, অর্ষা।”

“সরি কেন?”

“আমার জন্যই এমন হলো। আমার খুব খারাপ লাগছে।”

“আপনারা সবাই যদি এভাবে নিজেদের দোষারোপ করেন তাহলে এতে আমার খারাপ লাগবে ভাইয়া। এখানে আপনাদের কারও-ই কোনো দোষ নেই। এমনকি আপনার বন্ধুরও না। ঘটনাটি আকস্মিক ঘটে গেছে। এখানে কারও কোনো হাত নেই।”

“তবুও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। গ্লাসটা তো আমার দিকেও লাগতে পারো!”

“আপনি তো দেখি খুব বাচ্চা!” হাসার চেষ্টা করে বলল অর্ষা।

“আমি তোমার মতো স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা মানতে পারছি না। যাই বলো না কেন, দোষটা আমারই। তোমার বাসায় জানলে কী একটা অবস্থা হবে সেটাই ভাবছি!”

“বাসায় বলতে যাবেন কেন?”

“তোমায় দেখলেই তো বুঝে যাবে।”

“বাসায় আমি ম্যানেজ করে নেব। বলব যে রাস্তায় পড়ে গেছিলাম।”

“তারাও বিশ্বাস করে নেবে?”

“সঙ্গে আরও কিছু ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে দেবো। আপনি এটা নিয়ে এত ভাববেন না তো। ফর গড সেইক, ভুলেও মুখ ফসকে আপুর কাছে আবার সত্যিটা বলে দিয়েন না।”

“বললে কী হবে? বিয়ে ভেঙে দেবে?”

অর্ষা হেসে ফেলল। বলল,

“না। আপনি তো হাতে-পায়েই বড়ো হয়েছেন। কিন্তু মন এখনো সেই প্লে-নার্সারির বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেছে। আমার আপু হাতে-পায়ে আপনার চেয়ে শর্ট হলেও মন কিন্তু বাচ্চাদের মতো নয় মোটেও। ও অনেক ম্যাচিউর। আপনার মতো করে আপু ভাববে না। তবে আপনার বন্ধুর সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হতে পারে। এখন তার তো এখানে সত্যিই কোনো দোষ নেই। এরপরও যদি কেউ অযথাই বিরুপ ধারণা তৈরি করে নেয় তাহলে এটা আমারও ভালো লাগবে না।”

তামিম চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,

“অর্ষা, তুমি কি জানো তুমি একটা অসাধারণ মেয়ে?”

অর্ষা হাসল। তামিম বলল,

“সত্যিই বলছি। প্রথমদিন দেখে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু তোমার ব্যবহার, কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম সাধারণ মেয়েটার মধ্যেও রয়েছে অসাধারণত্ব।”

“হয়েছে, হয়েছে। এত প্রসংশায় তো লজ্জা পাচ্ছি।”

তামিমও হেসে ফেলে অর্ষার কথার ধরণে। এমন মুহূর্তেও মেয়েটা কী সুন্দর সাবলীল মজা করছে যেন কিছুই হয়নি। রিকশা বাড়ির সামনে এলে অর্ষা একাই নামল। জিজ্ঞেস করল,

“ভেতরে আসবেন না?”

“না।”

“কেন?”

“ভয়ে তোমার আপুর সামনে আবার সত্যিটা না বলে ফেলি!”

অর্ষা হেসে বলল,

“ঠিক আছে। সত্যি বলার রিস্ক আছে বলে আজ জোর করলাম না। সাবধানে যাবেন।”

“আচ্ছা।”

অর্ষা চলে যাচ্ছিল তখন তামিম পেছন থেকে ডেকে বলল,

“অর্ষা, শোনো?”

অর্ষা পিছু ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। তামিম বলল,

“সরি বোন। ভাইটাকে মাফ করে দিও।”

“আবার!”

তামিম মলিন হেসে বলল,

“আসছি।”

অর্ষা বাড়িতে আসার পর আমেনা বেগম তুলকালাম কাণ্ড শুরু করেছেন। প্রথমে কিছুক্ষণ ইচ্ছেমতো কথা শোনালেন অর্ষাকে। কেন সে দেখে-শুনে হাঁটে না, নিজের খেয়াল রাখে না এই সেই অনেক কিছু। তার কিছু পরেই আবার আদর করে জিজ্ঞেস করলেন ও কিছু খাবে কিনা। মায়েরা বোধ হয় এমনই হয়। আসলে মা তো মা-ই। সন্তানের কষ্টে কষ্ট পাবেন আবার বকবেনও। অর্ষা কোনো কিছু না বলে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“ভালোবাসি মা।”
.
.
আহনাফ এবং সুপ্তি মুখোমুখি বসে আছে। সুপ্তির চোখে-মুখে ভয়। তবুও সে সাহস সঞ্চয় করে বলল,

“আমি আসলে…”

আহনাফ ওকে থামিয়ে বলল,

“তোমার সব কথা আমি শুনব। তার আগে তুমি আমাকে এটা বলো যে, ঐ ছবি নিয়ে তুমি কোনো এক্সপ্লেইন আমাকে দিতে পারবে? আছে যথাযথ কোনো এক্সপ্লেইন তোমার কাছে? যদি থাকে তাহলে দাও। তারপর আমি তোমার বাকি কথা শুনব।”

সুপ্তি চুপ করে আছে। তার কাছে তো কোনো জবাব নেই। সে এক্সপ্লেইন করবে কীভাবে? সে উপায় না পেয়ে আহনাফের হাত ধরে কেঁদে বলল,

“আমার ভুল হয়ে গেছে আহনাফ। এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ!”

আহনাফ এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। আ’গুন’ঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

“কীসের ক্ষমা করব তোমাকে? কোনটাকে ভুল বলছ তুমি? তুমি তো ভুল করোনি। চিট করেছ আমার সাথে। তুমি একটা চিটার। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা মানুষ কখনো কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য হয় না। তুমিও সেই যোগ্য মানুষ নও। না চাইতেও অনেক ভালোবাসা পেয়েছ তো এজন্য আমাকে ভ্যালুলেস মনে হয়েছে তাই না? ভেবেছ আহনাফ একটা গাধা, বোকা! কিচ্ছু জানবে না, বুঝবে না।”

”আহনাফ…”

“চুপ! তোমার ঐ নোংরা মুখে আমার নামও নিও না তুমি। আর একটা কথা শুনে নাও, আজকের পর থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করার একদম চেষ্টা করবে না। নট ইভেন অ্যা সিঙ্গেল ট্রাই! এন্ড আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি ইউর ফেইস এনিমোর।”

এরপর সুপ্তিকে কোনো কিছু বলার সুযোগ দেয়নি আহনাফ। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। বাড়িতে ফিরে রুম অন্ধকার করে শুয়ে রইল সে। আপাতত তার মাথায় সুপ্তির চিন্তা বেরিয়ে অর্ষার চিন্তা ঢুকেছে। অর্ষার জন্য খারাপ লাগছে। অনুশোচনা হচ্ছে। নিজেকে অনেক খারাপ মনে হচ্ছে। নিজের রাগের শিকার হতে হলো মেয়েটাকে। বালিশের পাশ থেকে ফোন নিয়ে সে তামিমকে কল করল।

তামিম কল রিসিভ করে বলল,

“বল। সুপ্তির সাথে দেখা হয়েছে?”

“হু। ওর ব্যাপারে পরে কথা বলব। এখন আমার কথা শোন। রাতে ফ্রি আছিস?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“ভাবিকে ফোন করে ডিনারের দাওয়াত দে।”

“মানে?”

“মানে বুঝিসনি? বলবি যে রাতে ডিনার বাইরে করবি। আর অর্ষাকে নিয়ে আসতে বলবি।”

“এই অবস্থায় অর্ষা আসবে?”

“তুই বললে আসবে।”

“ওকে কী দরকার? একটুর জন্য তো বেচারির চোখটা নষ্ট হয়নি! আর কী চাস?”

“ভাই আমি এমনিই অনুতপ্ত! তুই আর কথা শুনাস না। আমি ওকে সরাসরি সরি বলতে চাই। তুই দেখা করার ব্যবস্থা কর।”

“তুই সরি বলবি?”

“হ্যাঁ, বলব। এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। যা করতে বলেছি কর। রাখছি এখন।”
.

অনেক কষ্টে ঐশি এবং অর্ষাকে কনভিন্স করিয়ে ডিনারের জন্য রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে তামিম। আহনাফ যাতে অর্ষার সাথে আলাদা কথা বলতে পারে তাই আসার সময় তামিম অর্ষাকে বাহানা দিয়ে বলেছে, ঐশি এবং তাকে যেন একটু আলাদা কথা বলতে দেয়। অর্ষাও সেই কথা মাথায় রেখে ঐশিকে বলল,

“আপু, খাবার আসতে তো সময় লাগবে। আর এই রেস্টুরেন্টটা সুন্দর। আমি একটু ঘুরে দেখি?”

“চল আমিও যাই তোর সাথে।”

অর্ষাকে এই অবস্থায় একা ছাড়তে চাচ্ছিল না ঐশি। অর্ষা তড়িঘড়ি করে বলল,

“না, আমি একাই ঘুরব। তুই বোস।”

ঐশি কিছু বলতে যাবে তখন তামিম চোখের ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইল। ঐশি না বুঝলেও অর্ষাকে আর বাধা দেয়নি। অর্ষা উঠে যাওয়ার পর তামিম বলল,

“সমস্যা নেই। আমি আহনাফকে বলে দিচ্ছি। ও থাকবে অর্ষার সাথে। আর খাবার এলে আমরা ওদের কল করে ডেকে নেব।”

“আহনাফ ভাইয়াও এসেছে নাকি? দেখলাম না তো!”

“নিচে আছে।”

আহনাফ অনেকক্ষণ ধরে এলেও এখনো অর্ষার মুখোমুখি হয়নি। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল তার। অনুশোচনা এতটাই প্রবল যে সামনে যেতেও তার ইতস্ততবোধ হচ্ছিল। এজন্য দূর থেকেই সে অর্ষার প্রতি লক্ষ্য রাখছিল এবং মনে মনে সাহস সঞ্চয় করছিল সামনে যাওয়ার।

অর্ষার ডানপাশের চোখটা তখনও ভীষণ ব্যথা করছিল। আস্তে আস্তে জায়গাটা কালশিটে হয়ে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্ট ঘোরার মতো মন ভালো নেই তার। শুধুমাত্র ঐশি এবং তামিমকে স্পেস দিতেই সে মিথ্যে কথা বলেছে। এখন বসে আছে অন্যপাশে ওদের থেকে দূরের একটা টেবিলে। থাইগ্লাস দিয়ে বাইরের আধো আলো- অন্ধকার আকাশটাকে দেখছিল সে। আকাশ কেমন গুমোট হয়ে আছে। চাঁদ, তারা কিছুই নেই আজ। আলো ঝলমলে রেস্টুরেন্টে বসেও তার মনে গভীর তমসা। এই পর্যন্ত রিহান তাকে একটা কল বা ম্যাসেজ কিছুই দেয়নি। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফেসবুকে ঢুকল। নিউজফিডে প্রথমেই এলো রিহানের আইডি থেকে কিছুক্ষণ আগে পোস্ট করা অনেকগুলো ছবি। সে একটা একটা করে রিহানের হাসিমুখের ছবি দেখতে লাগল। ছবিগুলো আজকে তার জন্মদিন সেলিব্রেট করার। কেউ কেউ রিহানকে কেক খাইয়ে দিচ্ছে, আবার রিহান অন্যদের কেক খাইয়ে দিচ্ছে এরকম অনেকগুলো ছবি এবং ভিডিয়ো। এসব দেখে তার মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। চোখের কোণায় জমা হলো অশ্রুকণা। অশ্রুতে টইটুম্বুর করছে তার নেত্রদ্বয়। আজকাল কি সে বেশি ইমোশোনাল হয়ে যাচ্ছে? বেশি কষ্ট পাচ্ছে সবকিছুতে? বুকটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে। দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে তার। ডান চোখের ব্যথাটাও টনটন করছে।

আহনাফ সবকিছুই পাশের টেবিলে বসে দেখছিল। মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন? সে নিঃশব্দে অর্ষার পাশের চেয়ারে বসল। কাঁপা কাঁপা হাত অর্ষার চোখের দিকে এগিয়ে নিয়েও আবার ফিরিয়ে আনছিল। অবশেষে সে হাত গুটিয়ে নিয়ে ম্রিয়মাণ স্বরে বলল,

“আ’ম সরি!”

চলবে…