আহনাফ চৌধুরী পর্ব-০৯

0
86

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন আমেনা বেগম। তাদের থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে বাকি সবাই। আহনাফ তামিমের বাবার নাম্বারে কল করে জলদি অর্ষাদের বাড়িতে আসতে বলেছে। খবর পেয়ে তামিমের বাবা-মা’সহ চলে এসেছেন। আমেনা বেগম আসার পর থেকেই কেঁদে চলেছেন। তার মেয়েটা যে এভাবে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে ম’র’ছি’ল তিনি সেটা কাজের ব্যস্ততায় বুঝতেই পারলেন না!

তামিমের বাবা-মা ভদ্র মানুষ। শিক্ষিত পরিবার। তারা অবস্থা বুঝতে পেরে অর্ষার পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,

“ভাই, এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা একটু-আধটু ভুল করবেই। এখানে আর কী করার আছে বলেন? শুধু খারাপ লাগে এটা ভাবলেই যে, মানুষ কেন শুধু শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে অন্য একটা মানুষের মন ভাঙে! যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন অর্ষাকে সময় দিতে হবে। ওকে এই ট্রমা থেকে বের করে আনতে হবে। সবসময় ওর সাথে সাথে থাকতে হবে। প্রয়োজনে একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে যান। তামিম এবং ঐশির বিয়েটা কয়েকদিন পিছিয়ে দেই আমরা। ভয় নেই! বিয়ে ভাঙব না। এরকম কিছু আমার মেয়ের সাথেও হতে পারত। আর আমার মেয়েটাও কিন্তু ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। আল্লাহ্ ওর সহায় ছিল তাই প্রতারণার শিকার হয়নি। অর্ষাও আমার মেয়েরই মতো। একটা ভুলের জন্য কি আমি আরেকটা মেয়েকে কষ্ট দেবো? বিয়ে অবশ্যই হবে ইন-শা-আল্লাহ্। শুধুমাত্র অর্ষাকে আগে সবকিছু থেকে বের করে আনতে হবে।”

তামিমের বাবা তৈয়ব রহমানের কথা শেষ হলে ওসমান আলমের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তার তিন মেয়েকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। প্রথম সন্তান তার মেয়ে হওয়াতে অনেকে চোখ বাঁকা করলেও তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলেন ছোট্ট ঐশির মুখ। এরপরের সন্তানও যখন মেয়ে হলো, এতেও বিন্দুমাত্র আক্ষেপ করেননি তিনি। অর্ষাকে কোলে নিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন,’আমার আরেকটা জান্নাত!’ এরপর আর তাদের বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু বেশ অনেক বছর পর অর্থি যখন আমেনা বেগমের গর্ভে এলেন তখনও তিনি বাচ্চা নিতে অসম্মতি জানাননি। অর্থির আগমনেও ছিলেন বেজায় খুশি তিনি। এজন্যই ঐশি এবং অর্ষার সাথে অর্থির বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি।

তিনি তৈয়ব রহমানের হাত ধরে বললেন,

“আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমি ভাই।”
.

রাত বাজে দেড়টা। আমেনা বেগমের দু’চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই অর্ষার চোখেও। ফোলা ফোলা চোখে সে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। আমেনা বেগম ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“এত কষ্ট চেপে রাখলি! একটাবার বললিও না আমাকে!”

অর্ষা জড়িয়ে ধরল মাকে। সঙ্গে সঙ্গে কান্না করে বলল,

“মানুষটা এভাবে আমাকে কেন ঠকাল মা?”

“ও তোকে ভালোবাসে না আমি আগেও বলেছিলাম তোকে।”

“একটা দিনের জন্যও ভালোবাসেনি, মা?”

আমেনা বেগম অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,

“না। যদি ভালোবাসতো তাহলে ছেড়ে চলে যেত না। রেখে দিত তোকে। আগলে রাখত।”

“আমি মানতেই পারছি না!”

“মানতে হবে। আর সবকিছু থেকে নিজেকে বেরও করে আনতে হবে। কার জন্য কষ্ট পাচ্ছিস তুই? কার জন্য চোখের পানি ফেলছিস? সেই মানুষটা তো দিব্যি ভালো আছে। অর্ষা শোন, তুই কাঁদবি না। কারণ তুই ওকে হারাসনি। ও তোকে হারিয়েছে। ও ঠকিয়েছে তোকে। তুই লয়্যাল ছিলি। তাহলে তুই কেন কাঁদবি? চোখের পানিগুলো জমিয়ে রাখ, মা। চোখের পানি এত সস্তা না। সবার জন্য দামি ও মূল্যবান চোখের পানি নষ্ট করতে হয় না।”

অর্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,

“এত ভালোবেসে কী পেলাম মা? কষ্ট ছাড়া?”

“কষ্ট পাবি না। কষ্ট মনে করবি না। ও যদি তোকে ছাড়া ভালো থাকতে পারে তাহলে তুইও ভালো থাকতে শিখে নে। তোরও ভালো থাকার অধিকার আছে। আমার কথা বুঝতে পেরেছিস?”

অর্ষা কিছু বলল না। নিরবে কাঁদছে। আমেনা বেগম ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

“বোকা নেয়ে! এত কেন ভেঙে পড়ছিস?”

“মানুষটা যে আমায় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে গেল মা! মৃ’ত্যু যন্ত্রণা দিয়ে গেল আমায়।”

“কেউ একজন এসে ঠিক তোকে গড়ে নিবে দেখিস। শুধু নিজেকে এমনভাবে তৈরি কর, যাতে করে তোকে আর কেউ ভাঙতে না পারে। ভেঙে পড়বি না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। তিনি সব ঠিক করে দেবে দেখিস। নতুন করে জীবনটাকে শুরু কর। পারবি না বল?”

অর্ষা ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। এখনো তার চোখে পানি। মা বললেন,

“আর চোখের পানি ফেলবি না। সবসময় হাসি-খুশি থাকবি। কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিস না, মা। আমরা সবসময় তোর পাশে আছি আর থাকব ইন-শা-আল্লাহ্।”

অর্ষা প্রত্যুত্তর করল না। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিরবে কাঁদতে লাগল। আমেনা বেগম বললেন,

“আমি যেন আর তোকে কাঁদতে না দেখি।”

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেই নিদ্রার শহরে পা রেখেছে অর্ষা। কিন্তু তখনও ঘুমাননি আমেনা বেগম। তার মেয়ের বুকের ভেতর অশান্তির প্রভাব তার মনেও পড়েছে। ঘুমন্ত অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা চিনচিন করে উঠল। মেয়েটার ভেতরকার হাহাকার যেন কান্না হয়ে গালে চিটচিটে ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার আদরের মেয়েটাকে কেউ এভাবে আঘাত করতে পারল! বুক কাঁপল না একবারও? তিনি আলতো করে ঘুমন্ত অর্ষার গালে হাত রাখলেন। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,

“খোদা, আমার মেয়েটার সকল দুঃখ তুমি মুছে দিও।”
_____

শীতের প্রকোপ পেরিয়ে সকালে আজ সোনালী মিঠে রোদ্দুর উঠেছে। অর্ষার ঘুম ভাঙে রোদ্দুরের আলিঙ্গনে। আমেনা বেগম রোদ উঠেছে দেখে সকালে জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন। থাই গ্লাস ভেদ করে মিঠে রোদ্দুরের আবেশে অর্ষা উঠে বসল। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর তার রিহানের কথা মনে পড়ে যায়। সাথে সাথে বুকের ভেতর তার ব্যথা শুরু হয়। মনের ওপর অশান্তির প্রভাব অনুভব হয়। ঠোঁট ভেঙে কান্না চলে আসে। সেই সাথে মায়ের বলা গতকাল রাতের কথাগুলোও মনে পড়ে যায়। হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে সে দু’চোখের পানি মুছতে থাকে আর অনবরত বলতে থাকে,

“আমি কাঁদব না! কাঁদব না, কাঁদব না। আমি আর কাঁদব না।”

চোখ সেই বারণ শোনে না। কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে অর্ষা। বড়ো বড়ো শ্বাস নেয়। পরমুহূর্তেই দু’হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“প্লিজ আল্লাহ্! হেল্প মি!”

কিছুক্ষণ পর তার কান্না কমে আসার পর সে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। আমেনা বেগম এসে খেতে নিয়ে গেছেন। খাবারও তার গলা দিয়ে নামছিল না। মাকে সন্তুষ্ট করতে সে অল্প কিছু খাবার খেল কষ্ট করে। অর্থিকে আর্ট পেইপার, রঙতুলি এসব নিয়ে কোথাও যেতে দেখে অর্ষা জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় যাস?”

অর্থি উত্তর দিল,

“ছাদে যাই আপু। দেখো আজ কত সুন্দর রোদ উঠেছে! তোমার কি খাওয়া শেষ? তাহলে তুমিও আমার সাথে আসো।”

অর্ষা মায়ের দিকে তাকাতেই মা বললেন,

“যা। আমিও হাতের কাজ সেরে তারপর আসছি। খাবার নিয়ে যা। ছাদে বসে খাবি আর অর্থির ছবি আঁকা দেখবি।”

অর্ষা খাবার নিয়ে এলেও খেল না। প্লেটটা রেলিঙের ওপর রেখে একপাশে চেয়ারে চুপ করে বসে রইল। অর্থি অন্যপাশে ছবি আঁকতে বসেছে। সে তার বয়সের তুলনায় খুব সুন্দর ছবি আঁকে। তবে একটা সমস্যা আছে। কারও সামনে অর্থাৎ কেউ তাকিয়ে থাকলে সে আঁকতে পারে না। অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি।

অর্ষা কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,

“অর্থি, একটা পেইপার দে তো। আর একটা রঙ পেনসিল।”

অর্থি কোনো প্রশ্ন না করে একটা পেইপার আর রঙ পেনসিল দিয়ে আবার নিজের জায়গায় চলে গেল। অর্ষা কিছুক্ষণ কাগজে আঁকিবুঁকি করল। এরপর কাগজটাকে প্লেইন বানিয়ে উঁড়িয়ে দিল। যদিও উড়ে বেশিদূর যায়নি, বরং নিচে পড়ে গেছে। কোথায় গিয়ে পড়েছে দেখার আগ্রহবোধও করল না সে।

অনেকক্ষণ পর একবার সে অর্থির দিকে তাকাল। অর্থির মনোযোগ সাদা কাগজটার দিকে। সে চুপ করে বসে থাকলেও তার মাথায় নানান ধরণের চিন্তা-ভাবনা ঘুরছিল। কথায় আছে ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।’ বর্তমানে অর্ষার সাথেও এমনটাই হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় সে ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

“আমাকে যে দিল মৃ’ত্যু’যন্ত্রণা
তাকে পরিও খোদা তুমি, সুখের মালা।”

লাইনটুকু শুনেই অর্ষা চমকে পেছনে তাকাল। তার আঁকিবুঁকি করা সেই প্লেইনটা এখন আহনাফের হাতে। আহনাফের বলা লাইনটাও তারই লেখা। নিশ্চয়ই নিচে তার সামনেই পড়েছিল। আহনাফ দু’কদম এগিয়ে আসলো। অন্য একটা চেয়ার নিয়ে বসল অর্ষার মুখোমুখি। বলল,

“এতটা ভালো হওয়াও উচিত নয়।”

“মানে?” প্রশ্ন করল অর্ষা।

“এইযে আপনি যেরকম উদার মনের! যে আপনাকে মৃ’ত্যু যন্ত্রণা দিয়ে গেছে, আপনি খোদার কাছে তার জন্য সুখ প্রার্থনা করছেন?”

“হ্যাঁ, করছি।”

“কেন করছেন?”

“আমি তার মতো নই তাই। সে আমাকে ভালোবাসেনি। কিন্তু আমি তো বাসি।”

“এখনো?”

অর্ষা চুপ করে আছে। আহনাফ বলল,

“একটা কথা কি জানেন? প্রতারকদের ভালোবাসা দিতে নেই। যেই মানুষ আপনাকে ভেঙেচূড়ে যাবে সে শুধু আপনার ঘৃণাটুকুই ডিজার্ভ করে। ভালোবাসা নয়!”

“আমায় নিয়ে আপনি কেন এত ভাবছেন?”

আহনাফ কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে বলল,

“কারণ আমিও আপনার মতোই একজন ভাঙা মনের মানুষ। তাই আপনার কষ্ট হয়তো আমি একটু হলেও অনুভব করতে পারছি।”

অর্ষা চুপ করে রইল। আহনাফ বলল,

“এভাবে নিজেকে শেষ করার তো কোনো মানে হয় না। কলেজে যাওয়া শুরু করুন। ক্লাস করুন। ফ্রেন্ডদের সঙ্গে হ্যাংআউট করুন। আর এর মাঝে শুধু পাঁচবার আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। নিজের মনের কথা, দুঃখ-কষ্ট সব তাকে বলুন। দেখবেন নিজেকে হালকা লাগছে।”

অর্ষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহনাফ মৃদু হেসে বলল,

“অন্যকিছু ভাববেন না। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীর মতোই। আপনার ভালো চাই। যেকোনো সময়, বিপদে আমি আপনার পাশে থাকতে চাই। একজন বন্ধু হিসেবে।”

অর্ষা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার মতো এমন ভাঙা অর্ষা অনেক আছে পৃথিবীতে। কিন্তু আফসোস, সেই অর্ষাদের সামলানোর জন্য আপনার মতো কোনো আহনাফ নেই!”

চলবে…
[বিঃদ্রঃ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]