আড়ালে আবডালে পর্ব-০১

0
7898

#আড়ালে_আবডালে
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

ভরা ক্যাম্পাসের সামনে নিহিকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয় অনল। আজকে কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান থাকায় নিহি শাড়ি পরে এসেছিল। কেউ কেউ ভেবেই নিল নিহি শাড়ি পরে হাঁটতে পারে না বিধায় পরে গেছে। ক্যাম্পাসে, কলেজ মাঠে, গেইটে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। এতগুলো মানুষের সামনে পড়ে যাওয়াটা কম লজ্জাজনক নয়। অনল আর অনলের বন্ধুরা সবাই হাসাহাসি করছে। দূরের কয়েকজনও হাসাহাসি করছে। কেউ বা মুখটিপে হাসছে আবার কেউ বা উচ্চস্বরে। লজ্জায়, ব্যথায় কান্না চলে আসে নিহির। অনল নিহির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,

“অনলের সাথে পাঙ্গা নেওয়ার ট্রাই কোরো না। জুনিয়র তুমি। আমি তোমার সিনিয়র হয়ে যা বলব তাই শুনতে হবে। আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ এবং আমার না তে না বলবা। আর ভুলেও যেন এসব কথা আম্মুর কানে না যায়। তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না আর। মাইন্ড ইট!”
নিহি পায়ে ব্যথা নিয়েই উঠে দাঁড়ায়। অনলের ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। রাগী দৃষ্টিতে নিহি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অনলের দিকে। তারপর ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসায় অনলের গালে। অনলের বন্ধুসহ বাকিরা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিহি যে এমন কিছু করে ফেলবে কল্পনায়ও ভাবেনি কেউ। নিহি গলায় কাঠিন্য ও তেজ এনে বলে,
“নিহি কোনো বাউণ্ডুলে ছেলের সাথে পাঙ্গা নেয় না। নিহি পাঙ্গা নেয় তার লেভেলের মানুষদের সাথে। আপনি তো কোনো লেভেলেই পড়েন না। হ্যাঁ, এটা ঠিক আপনি আমার সিনিয়র। আর আমি আপনার জুনিয়র। তার মানে এই নয় যে আমি আপনার সব কথা শুনব। আপনি স্রেফ আমার সিনিয়র, আমার স্বামী নন যে আপনার হ্যাঁ তে হ্যাঁ এবং আপনার না তে না বলব। ইভেন আমার স্বামীর হ্যাঁ তে হ্যাঁ এবং না তে না-ও বলব না যদি সে অন্যায় কিছু বলে থাকে। আর সেখানে আপনি তো…! আরো কী বললেন, আপনার মায়ের কানে যেন এসব না যায়? লিসেন, আমার বলার কোনো দরকার নেই। আমার উত্তর আমি নিজেই দিতে পারি। নেক্সট টাইম যদি কোনোভাবে আমাকে বিরক্ত বা হ্যারাস করার চেষ্টা করেছেন তো তাহলে আমার চেয়েও খারাপ আর কেউ হবে না। মাইন্ড ইট!”

কথাগুলো বলেই নিহি কলেজের ভেতর চলে যায়। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। হলুদ শাড়িতে ধুলোময়লা লেগে একদম ফুঁটে আছে। এগুলো পরিষ্কার করা দরকার। কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে পানি নিয়ে শাড়ি পরিষ্কার করে। আর ভাবতে থাকে ঠিক কতদিন এই কলেজে টিকে থাকতে পারবে নিহি। ছোটবেলা থেকেই সব রকম ঝামেলা থেকে দূরে থেকেছে। আর যতবার ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে ঠিক ততবারই ঝামেলা সব উড়ে এসে জুড়ে বসেছে নিহির কপালে। কলেজে এসেও হলো তাই। সিনিয়র কারো পাল্লায় যে এমন বাজেভাবে ফেঁসে যাবে সেটা কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি নিহি। এভাবে না মেরে অনামিকা ম্যামকে জানালেই বোধ হয় ভালো হতো। শুধু শুধু থাপ্পড়টা দিয়ে এখন খাল কেটে কুমিরকে ডেকে আনল।
কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমে আসে উপমা। গতকাল কলেজে আসার পর উপমার সাথেই প্রথম পরিচয় হয় নিহির। উপমা নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি তোমায় কোথায় কোথায় খুঁজছি। আর তুমি এখানে?”
নিহি শাড়ি পরিষ্কার করতে করতে বলে,
“কখন এসেছ?”
“একটু আগেই। তোমার শাড়িতে ময়লা লাগল কীভাবে?”
“পড়ে গেছিলাম।”
“বলো কী! কীভাবে?”
“পরে বলছি।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। অনুষ্ঠান তো শুরু হতে চলল। চলো যাই।”
“তুমি যাও আমি আসছি।”
“নিহি!”
“কী?”
“আমার না একটা ছেলেকে খুব ভালো লেগেছে।”
“কলেজে আসতে না আসতেই এই কাহিনী?”
উপমা লাজুক হেসে বলে,
“তুমি তাড়াতাড়ি আসো। ছেলেটাকে দেখাব তোমায়।”
“আচ্ছা।”
উপমা চলে যায় কলেজের মাঠে।
.
মাঠের এক কোণায় বসে আছে অনল আর ওর বন্ধুরা। রাগে, জিদ্দে অনলের শরীর কাঁপছে। কলেজের সবার সামনে জুনিয়র একটা মেয়ে থাপ্পড় মেরে গেল! এটা যে ঠিক কতটা অপমানের বিষয়! মিলন বলে,
“এখানেই বসে থাকবি?”
“তো কি নাচব গিয়ে?” রাগ দেখিয়ে বলে অনল।
“আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছিস কেন?”
অনলি চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“আমি তো ঐ মেয়েকে একদম ছাড়ব না।”
সাকিব বলে,
“শুধু শুধু তুই মেয়েটার পেছনে লেগেছিস। দোষ তো প্রথমে তুই-ই করেছিস। সবার সামনে মেয়েটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিলি।”
অনল ক্ষেপে গিয়ে বলে,
“শালা তুই আমার বন্ধু হয়ে ঐ মেয়েটার সাপোর্ট নিচ্ছিস?”
“আমি কারো সাপোর্টই নিচ্ছি না। আমি শুধু সত্যি কথাটাই বলছি।”
“রাখ তোর সত্যি কথা! শুনে রাখ তোরা, ঐ মেয়ে আমায় থাপ্পড় মেরেছে। আমি ওর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলব।”
.
.
বেসিনের আয়নার দিকে নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে আছে নিহি।ভাবে অনলের সাথে গতকাল ঝামেলার শুরুটা!
গতকাল কলেজে প্রথম দিন ছিল নিহির।

কলেজের সামনে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অনেক মেহনতের পর নিজের পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে নিহি। ছোট ছোট কদমে হেঁটে যায় কলেজ ভবনের দিকে। ক্যাম্পাসের বারান্দা দিয়ে হাঁটছিল তখন পেছন থেকে একজন নিহির উদ্দেশ্যে বলে,
“অ্যাই লম্বা চুলওয়ালী!”
নিহি আশেপাশে একবার তাকায়। সেটা দেখে ছেলেটা হেসে বলে,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকেই বলেছি। এদিকে আসো।”
নিহি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায়। না হলেও সামনে দশজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখেই চাপা হাসি। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ছেলেটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে,
“ফার্স্ট ইয়ার না?”
নিহি মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
“হু।”
নিহি একটু পাশে তাকাতেই দেখতে পায় ওর মতোই কয়েকজন নিউ কামারদের নাজেহাল অবস্থা। শুধু মেয়ে নয়। ছেলেরাও আছে। তারা কি Rag দিচ্ছে নাকি? নিহি এরকম অনেক দেখেছে। ভয়ে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। নিহিকে ডেকে বলে,
“তোমার চুলগুলো কি আসল নাকি নকল?”
“আসল।”
“কই দেখি? ঝুটি খুলো তো।”
নিহি অবাক হয়ে তাকায়। এই লোকসমাগমে চুল খুলবে! পাশে থাকা আরেকটা ছেলে বলে,
“অনল মেয়ে তো দেখি হেব্বি ঘাড়ত্যাড়া।”
অনল বাঁকা হেসে বলে,
“আমিই বা কম কীসের?”
অনল এবার ধমক দিয়ে বলে,
“খোলো বলছি।”
ধমক খেয়ে সাথে সাথে চুলের রাবারটা খুলে ফেলে নিহি। শ্যাম্পু করা সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পুরো পিঠ ছড়িয়ে পড়ে। একগাছি চুল নিহির মুখে এসে পড়ে। নিহি হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়। অনলের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠল!
কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল,
“ট্যাক্স দাও।”
“কীসের ট্যাক্স?”
“লম্বা চুলের ট্যাক্স দিতে হয় জানো না?”
“আমার চুল লম্বা হোক বা ছোট হোক। ট্যাক্স কেন দেবো?”
“সিনিয়রদের সাথে মুখে মুখে তর্ক করছ?”
অনল ওর বন্ধু মিলনের উদ্দেশ্যে বলে,
মিলন একটা কাগজ আর কলম দে তো ও’কে।”
মিলন একটা কাগজ আর কলম নিহির দিকে এগিয়ে দিল। অনল বলে,
“এখানে একশো বার লেখো আই লাভ ইউ।”
“আই লাভ ইউ কেন লিখব?”
“এটা তোমার পানিশমেন্ট।”
“কী করেছি আমি?”
“বেয়াদবি করেছ মুখে মুখে তর্ক করে। বেশি কথা বললে পানিশমেন্ট কিন্তু বাড়িয়ে দেবো।”
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল নিহির। কাগজ কলম নিয়ে গুনেগুনে একশো বার লাভ ইউ লিখতে বসল।

অনামিকা ম্যাডাম ক্যাম্পাস পার হয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়। সকলেই তখন ভয়ে জড়সড়। অনামিকা ম্যাম শুধু এই কলেজের টিচারই নন। অনলের নিজের মা তিনি। ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে ভীষণ ক্ষেপে আছেন তিনি। রাগি গলায় বলেন,
“তোমায় আমি কতবার করে বলেছি এসব র্যাগ-ফ্যাগ না দিতে? তুমি তো কলেজের স্টুডেন্টও নও। ভার্সিটির থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তাহলে তুমি কলেজের স্টুডেন্টদের কীভাবে র্যাগ দাও? তোমার সাহস হয় কী করে মেয়েটার চুল খুলতে বলার? উপর থেকে তো আমি সবই দেখলাম। তোমার এত অধঃপতন হয়েছে যে আমার মনে হচ্ছে কবে তুমি মেয়েদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে!”
অনল ভীরু গলায় বলে,
“আম্মু আমি এমনটা কখনোই করব না। আমি তো জাস্ট…”
“শাট আপ! এটা কলেজ। ম্যাম বলে সম্বোধন করো। সাফসাফ বলে দিচ্ছি এই র্যাগের কাহিনী এখানেই বন্ধ করো।”

অনামিকা ম্যাম সকলকেই বললেন ক্লাসে চলে যেতে। নিহি অবাক হয়ে তাকে দেখছেন। সুন্দর শরীরের গঠন, চেহারার আদল। চোখগুলো টানা টানা। মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে। সবমিলিয়ে অপরূপ দেখতে। নিজের ছেলের সাথেও কেউ এমন কাঠখোট্টা ব্যবহার করতে পারে? অনামিকা ম্যাম নিহির হাত ধরে দাঁড় করায়। চুলগুলো হাত দিয়ে সাইজ করে একটা ঝুটি করে দেন। মিস্টি হেসে বলেন,
“কোন গ্রুপের তুমি?”
“সায়েন্স।”
“আমি সায়েন্সের ক্যামেস্ট্রি টিচার।”
“আপনি খুব ভালো ম্যাম।”
প্রতুত্তরে এবারও তিনি মিষ্টি হাসেন।
“যাও ক্লাসে যাও।”

চোখেমুখে পানি ঝাপটায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে নিহি। সামনে তাকিয়ে দেখে অনলকে। মুখে ভয়ের চিহ্ন প্রকাশ না পেলেও ভেতরে ভেতরে কলিজাটা বোধ হয় লাফালাফি করছে। নিহির তো সন্দেহ হচ্ছে কলিজা লাফানোর শব্দ অনল আবার শুনতে পাচ্ছে না? কলেজের ভেতর এখন কেউই নেই। বাইরে বক্সের বিদঘুটে আওয়াজ। এখন চেঁচালেও কেউ শুনবে না। সত্যি বলতে চিৎকার তো দূরে থাক একটা শব্দও মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না নিহির। সব কথা গলা পর্যন্ত এসেই আটকে যাচ্ছে। দৌঁড়ে যে পালাবে তারও কোনো উপায় নেই। একদম সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অনল। চোখেমুখে রাগের আগুন। কেন এসেছে? কী করবে উনি? ভয়ে বড় বড় ঢোক গিলে নিহি। অনল ঠোঁটে শয়তানির হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“তখন তো খুব বড় বড় কথা বলেছিলে। এখন ভয়ে এমন চুপসে যাচ্ছ কেন?”
নিহির বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কোথায় ভয় পেয়েছি আমি? আমি তো ভয় পাইনি।’ কিন্তু এইসব উত্তর শুধু গলাতেই আটকে আছে। মনে মনে বলে,
“কে বলে খাল কেটে কুমির এনেছি! আমি তো মনে হয় কুমিরভর্তি খালেই লাফ দিয়েছি।”

চলবে…