আড়ালে আবডালে পর্ব-০২

0
6525

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________

নিহি বোকার মতো তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। তবুও চেষ্টা করছে অনলের ভাবমূর্তি বোঝার। কী উদ্দেশ্যে অনল এখানে এসেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনল এক হাতে নিহিকে সরিয়ে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। হাতে অল্প পানি নিয়ে নিজের চুল ভিজিয়ে দু’হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে আয়নার মধ্য দিয়েই নিহির দিকে তাকায়। নিহি তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। অনল মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি জানি আমি সুন্দর। তাই বলে তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে বিষয়টা আমার ভালো লাগছে না।”

নিহি দাঁত কিড়মিড় করে মনে মনে বলে,
“হ্যাঁ রে কচুর সুন্দর তুই! শরীরের রং তো খরগোশের মতো। না, না খরগোশ তো কিউট আছে। খোরগোশের সাথে তোর তুলনা করা ভুল। তোর গায়ের রং মুলার মতো। হ্যাঁ, মুলাই তোর জন্য একদম পার্ফেক্ট উদাহরণ। মুলা হয়ে নিজেকে আপেল ভাবিস নাকি রে বলদ?”

হাতে অবশিষ্ট থাকা পানি আবারও ছিটিয়ে দেয় নিহির মুখে। নিহি নাক, গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকে। অনল বলে,
“এইযে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে আমায় গালি দিচ্ছ তাতে কি কোনো লাভ হচ্ছে? হচ্ছে না তো। না, আমি শুনতে পাচ্ছি আর না তুমি তৃপ্তি পাচ্ছ।”
নিহি আমতা আমতা করে বলে,
“আশ্চর্য! আমি কেন আপনাকে গালি দিতে যাব?”
“মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলতে গিয়ে তোমার ঠোঁট কাঁপছে।”
“এতদিকে আপনাকে কে লক্ষ করতে বলেছে?”
“লক্ষ করার কী আছে? তাকালেই তো দেখা যাচ্ছে।”

নিহি চুপ করে থাকে। অনল চলে যাওয়ার আগে নিহির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,
“আজ ছেড়ে দিয়েছি মানে এই নয় পরেও আবার ছেড়ে দেবো। আমায় থাপ্পড় মেরে কাজটা তুমি একদম ভালো করোনি। এর ফলও তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তার জন্য প্রস্তুত থেকো।”

মুখে হাসি রেখেই অনল চলে যায়। নিহি পড়ে যায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে। কী প্ল্যান ঘুরছে তার মাথায়? নিহির আসতে দেরি হচ্ছে দেখে উপমা ফের আবার আসে। তাড়া দিয়ে বলে,
“আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? চলো!”
নিহি মৃদু হেসে বলে,
“হুম, চলো।”

মাঠে গিয়ে বসার পর উপমা অস্থির হয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। নিহি সেটা খেয়াল করে বলে,
“কাউকে খুঁজছ?”
“আরে ঐযে ঐ ছেলেটা। যার কথা বলেছিলাম।”
“এখন খুঁজতে হবে না। বসো চুপ করে।”
“জানো, এখন যে তোমায় ডাকতে গেলাম তখনও তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। কী সুন্দর করে হাসে!”
নিহি উপমার কথায় আর মাথা ঘাটায় না। চুপচাপ বসে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে। মন মগ্ন আছে চিন্তার শহরে। না জানি অনলের মাথায় এখন কী ঘুরছে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার সময় উপমা হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
“ঐযে নিহি ওর কথাই বলেছিলাম। সাদা শার্ট পরা ছেলেটাকে দেখেছ?”

নিহি হা করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। উপমার দেখানো ছেলেটাকেই কি নিহি দেখছে? নাকি উপমা অন্য কারো কথা বলছে! নিহি যাকে দেখছে সে অনল। বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে অনল, মিলন, সাকিব ও আরো কয়েকজন বন্ধুরা। ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে ভেবে অস্বস্তি লাগছে নিহির। অন্যদিকে উপমা খুশিতে গদগদ। সামনে থেকে আরেকবার পছন্দের মানুষটিকে দেখতে কার না ভালো লাগে? দাঁতমুখ খিঁচে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল নিহি। উপমা একটু পরপরই অনলের দিকে তাকাচ্ছিল। সেটা অনলের এক মেয়ে ক্লাসমেট খেয়াল করে বলে,
“এই মেয়ে এই, এদিকে আসো তো।”

উপমা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। সাথে জোর করে দাঁড় করায় নিহিকেও। উপমা পারলে এখন খুশিতে আকাশে উড়ে বেড়ায়। আহ্লাদী হয়ে বলে,
“ঐযে ওরা ডাকছে।”
“আমাদের না। হয়তো অন্য কাউকে।”
“না, আমাদেরই। চলো তো!”
ঠেলেঠুলেই নিহিকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় ওদের সামনে। অনল ফোন চাপছিল। নিহিকে খেয়াল করেনি। মেয়েটা উপমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফার্স্ট ইয়ার?”
উপমা লাজুকলতার মতো নুইয়ে গিয়ে বলে,
“জি।”
মেয়েটা হেসে হেসে বলে,
“যাওয়ার সময় রাস্তা দেখে না হেঁটে এদিকে কী দেখো?”
এবার অনল ফোন থেকে দৃষ্টি সরায়। নিহিকে দেখে এক গাল হেসে বলে,
“আরে নিহি ম্যাম যে!”
অনলের এমন ব্যবহারে ভড়কে যায় নিহি। কথায় আছে ‘অতিভক্তি চোরের লক্ষণ।’ অনলও নিশ্চয়ই বড়কিছু ভেবে রেখেছে। নিহি কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অনল মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলে,
“ওদেরকে র্যাগ দিস না সুমাইয়া। ছেড়ে দে।”
“র্যাগ তো দিচ্ছিলাম না। মেয়েটা তোর দিকে তাকিয়ে ছিল তাই ডেকেছি।”
“সিম্পল। হ্যান্ডসাম কোনো ছেলে দেখলে যেকোন মেয়েই তাকাবে।”
সকলের দৃষ্টির অগোচরে নিহি একবার ভেংচি কাটল। অনল ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমরা যাও।”

অনলের বলতে দেরি নিহির হাঁটতে আর দেরি হয় না। পথে উপমা কতবার যে অনলের প্রসংশা করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রথম পরিচয় বলে উপমাকে কিছু বলতেও পারছে না। পুরনো বান্ধবী হলে শুধু বলতোই না কয়েক ঘা লাগিয়েও দিত। কিন্তু আপাতত মুখ বুজে ওর বকবক শোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
.
.
“শুধুমাত্র আমি বলেই তোমার সংসার করছি। অন্য কোনো মেয়ে মানুষ হলে কবেই তোমার সংসার ছেড়ে চলে যেত। যত দুঃখ, কষ্ট সব আমার। ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়েই তোমার সব অনাচার-অত্যাচার সহ্য করেছি আমি।”

টিভি দেখতে দেখতে ন্যাকিসুরে কথাগুলো বলছিলেন সালেহা বেগম। পাশের সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন নিজাম ইসলাম। সালেহা বেগম এতগুলো কথা নিজাম ইসলামকেই বলছিলেন। এটা নতুন কিছু নয়। দৈনিক ঘটনা এই সংসারে। পান থেকে চুন খসলেই একই বক্তব্য পেশ করবেন সালেহা বেগম। বাড়িতে এসেই বাবা-মায়ের টম এন্ড জেরীর ঝগড়া দেখতে পায় নিহি। যদিও বাবা এখনো কিছুই বলেনি। তিনি আবার পত্রিকা পড়ার সময় খুবই সেনসিটিভ। কারো কোনো কথাই তখন তিনি কানে তুলবেন না। এতে যদি বাড়ির সবকিছু উলটপালট হয়ে যায় তাতেও সে সায় দেবে না। প্রয়োজনে কানে তুলো ঢুকিয়ে পত্রিকা পড়বেন। পত্রিকা পড়ার সময় বিরক্ত করা পছন্দ করেন না। এতে যদি কেউ ইচ্ছে করেও বিরক্ত করে তবুও তিনি বিরক্ত হবেন না। কী করে বিরক্ত হবে? তিনি তো কারো কথা তখন কানেই নেন না। হাতের পার্স সোফার ওপর রেখে নিহি রান্নাঘরে চলে যায়। নিহির ভাবি তমা তখন রান্না করছিল। নিহি শাড়ি পরেই ক্যাবিনেটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে বলে,

“আজ আবার দুজনের কী নিয়ে ঝগড়া লাগল?”
তমা হেসে বলে,
“মা বাজার থেকে গরম জিলাপী আনতে বলেছিল। বাবা বলেছে সন্ধ্যার পর বাইরে যাবে। তখন এনে দেবে। আর এটা নিয়েই শুরু।”
“আব্বু এখনো কিছু বলেনি না?”
“না। আগে তো পত্রিকা পরা শেষ হোক।”

নিজাম ইসলাম পত্রিকা পরা শেষ করে পত্রিকা ভাঁজ করতে করতে বলেন,
“এখন বলো কী যেন বলছিলে?”
সালেহা বেগম দাঁত কটমট করে বলেন,
“এতক্ষণ যে বলছি কানে কথা ঢুকেনি?”
“না, ঢুকেনি। তাও বলতে পারি তুমি কী বলেছিলে। এত বছরের সংসারে এক কথা শুনে শুনে এখন আমারও মুখস্থ হয়ে গেছে।”
“কী? কী বললে তুমি? আমি এক কথাই বলি সবসময়?”
“হ্যাঁ, একদম। ভাঙা রেকর্ড যেমন একটু পরপর ঘ্যারঘ্যার শব্দ করে তুমিও তেমন করো।”

তমা দুজনের জন্য চা নিয়ে যায়। তমাকে দেখে সালেহা বেগম বলেন,
“বউ মা শুনেছ তোমার শ্বশুর আমায় কী বলল? বলো, আর কাকে বলব আমি আমার দুঃখের কথা। বললে তো বিশ্বাস করবে না কত কষ্ট করে যে এই লোকটার সংসার করি আমি।”
তমার ভীষণ হাসি পাওয়া সত্ত্বেও হাসিটাকে চেপে রাখছে। এখনে বেশিক্ষণ থাকলে দুজনই দুজনের নামে নালিশ করতেই থাকবে। তাই রান্নার কথা বলে আবারও রান্নাঘরে চলে আসলো। নিহির দিকে তাকিয়ে হোহো করে হেসে ফেলে। সঙ্গে নিহিও হাসে। ক্যাবিনেটের ওপর থেকে নামতে নামতে বলে,
“এবার দুটোকে থামাতে হবে। যাই গিয়ে দেখি!”
“যাও।”

নিহি গিয়ে দুজনের মাঝখানের সোফায় বসে বলে,
“অনেক হয়েছে। এবার ঝগড়া থামাও।”
“আমি ঝগড়া করি নাকি? ঝগড়া তো করে তোর মা।” বললেন নিজাম ইসলাম। সালেহা বেগম ক্ষেপে গিয়ে বলেন,
“আর তুমি তো তুলসী পাতা!”
নিহি মেকি ধমক দিয়ে বলে,
“আবার!”
নিজাম ইসলাম বলেন,
“আচ্ছা ঝগড়া বাদ। তুই কলেজ থেকে কখন আসলি?”
“এসেছি অনেকক্ষণ হবে। তুমি তো পত্রিকা নিয়ে বিজি আর মা সিরিয়াল নিয়ে।”
নিজাম ইসলামের মুখটা চুপসে যায়। কথা এড়িয়ে গিয়ে বলেন,
“আজকে কেমন লাগল কলেজে?”
নিহি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“ভালো। আচ্ছা শোনো, এখন আর কেউ ঝগড়া করবে না বলে দিলাম। আমি গোসল করতে গেলাম। তারপর সবাই একসঙ্গে খাব।”
“আচ্ছা যা।”

————————————-

পরেরদিন কলেজে যেতে একটু লেট হয়ে যায় নিহির। ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে প্রিন্সিপ্যাল স্যার এবং ক্লাস টিচার আগেই এসে পড়েছে। নিহিকে দরজার সামনে দেখে প্রিন্সিপাল স্যার ভেতরে আসতে বলে। নিহি গিয়ে উপমার পাশে বসে। প্রিন্সিপাল স্যার সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথাবার্তা বলে চলে যায়। পর পর চারটে ক্লাসের পর টিভিন টাইমের সময় হয়। যে যার মতো খেতে চলে যায়। নিহি বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। উপমা নিহিকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“এই সবাই খেতে যাচ্ছে। আর তুমি বই নিয়ে বসে আছো এখনো?”
নিহি বইটা বন্ধ করে উপমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আর কী করার আছে? যেদিকে তাকাই সেদিকেই কাপল।”
“মাত্র তো ক্লাস শুরু। আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচয় হবে। তারপর তোমারও একটা লাইন হয়ে যাবে।” মুচকি হেসে বলে উপমা। নিহি নোখ খুঁটতে খুঁটতে বলে,
“না, না বাবা! আমি এমনিতেই বেশ আছি।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন চলো তো।”
“কোথায় যাবে?”
“ক্যান্টিনে। এখানে বসেই খাবে নাকি?”
“ওহ হ্যাঁ, চলো।”

নিহি আর উপমা কথা বলতে বলতে ক্যান্টিনে চলে যায়। যাওয়ার সময় অনলের সঙ্গে একবার চোখাচোখিও হয়ে যায়। অনল ওর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,
“চল ক্যান্টিনে যাই।”
ওর বন্ধুরাও ওর সঙ্গে ক্যান্টিনে যায়। ভার্সিটির বড় ভাই বলে জুনিয়ররা সবাই ওদের সালাম দেয়। অনল সালামের উত্তর নিয়ে একটা চেয়ার টেনে উপমার পাশে বসে। উপমা আর নিহি মুখোমুখি বসেছিল। উপমার পাশে বসায় এখন অনলও নিহিকে মুখোমুখি দেখছে। উপমার উত্তেজনায়, খুশিতে হাত-পা কাঁপছে। ক্রাশ পাশে বসেছে বলে কথা!

নিহি বাড়ি থেকেই টিফিন নিয়ে এসেছিল। অনল নিহির টিফিন বক্সটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে। খেতে খেতে বলে,
“বাহ্! দারুণ টেস্টি তো।”
শুধু যে নিজে খেয়েছে তা নয় সঙ্গে বন্ধুদেরও খাইয়েছে। নিহি না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে কিছু বলতে। উপমা চুপচাপ শুধু দেখে যাচ্ছে ওদের কাণ্ড। অনল উপমাকে বলে,
“তুমি খাচ্ছ না কেন? খাও।”
“এ্যা? হ্যাঁ, খাচ্ছি।” বলে, উপমা নিহিকে বলে,
“তুই আমার টিফিন শেয়ার কর।”
নিহি কিছু বলার আগেই অনল উপমাকে ধমক দিয়ে বলে,
“আমি কি বলেছি তোমার টিফিন ওর সাথে শেয়ার করতে?”
উপমা ভয়ে কাচুমুচু হয়ে বলে,
“না।”
“তাহলে চুপচাপ খাও।”

উপমা অসহায়ের মতো নিহির দিকে তাকায়। উপমা খাচ্ছে না দেখে অনল সুমাইয়াকে ইশারা করে। সুমাইয়া তখন জোর করে উপমাকে খাইয়ে দেয়। অনলের ওপর খুব বেশিই রাগ হচ্ছে নিহির। কতক্ষণ যে এই রাগটাকে দমিয়ে রাখতে পারবে তা নিহি জানে না। খাওয়া শেষ হলে টিফিন বক্সটা নিহিকে ফিরিয়ে দিয়ে ঢেকুর তোলে অনল। নিহির পানির বোতল নিয়ে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে বোতলটা নিহির দিকে ফিরিয়ে দেয়। রাগ আর কন্ট্রোল করতে না পেরে বোতলটা ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয় নিহি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,
“তিনদিনের ক্ষুধার্ত ব্যক্তির মতো এরকম কাড়াকাড়ি করে না খেয়ে আমায় বললে আমি নিজেই দিয়ে দিতাম। রাস্তার এরকম অনেক অসহায় লোককে খাইয়েছি আমি। আর আপনি ভাবলেন কী করে আপনার মুখ লাগিয়ে পানি খাওয়া বোতলে আমি পানি খাব?”
রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করে অনলের চক্ষুদ্বয়। সুমাইয়া নিহিকে ধমক দিয়ে বলে,
“এই মেয়ে কার সাথে কথা বলছ জানো তুমি?”
অনল সুমাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ক্যান্টিনের সবাইকে এখনই বাইরে যেতে বল। আর খেয়াল রাখবি কোনো টিচার যেন এখানে না আসে। এখানে যারা আছে তাদের সবার রোল, নাম লিখে রাখবি আর বলে দিবি এখানের খবর বাইরে যেন না যায়।”

অনলের কথায় পুরো ক্যান্টিন খালি করে ফেলে মিলন, সুমাইয়া আর বাকি বন্ধুরা। নিহি চলে যেতে চাইলে অনল নিহির হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও নিহি পারছে না। রাগে হাতের বড় বড় নোখ দিয়ে অনলের হাতে খামচিও দেয়। তবুও অনল নিহির হাত ছাড়ে না। ক্যান্টিন ফাঁকা হওয়ার পর অনলের বন্ধুরাও চলে যায়। তখন অনল নিহির হাত ছেড়ে দেয়। নিহি মনে মনে নিজেকেই বলে, “উফ! আবারও কেন গেলি ঝামেলা বাঁধাতে? নিহি তুই কি কোনোদিনই শুধরাবি না! কেন নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারছিস না কেন!”

অনল নিহির দিকে এগোতে এগোতে বলে,
“এখন বলো কী কী যেন বলছিলে? রাস্তার অসহায় ছেলে আমি? আমার মুখ লাগিয়ে পানি খাওয়া বোতলে তুমি পানি খাবে না?”
“যা বলেছি ঠিকই বলেছি।” বলে, নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরে নিহি। মনে মনে বলে,
“মাথামোটা নিহির বাচ্চা! আবার কেন উত্তর দিতে গেলি?”
অনল বলে,
“হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছ কেন? তুমি কি ভেবেছ আমি তোমায় চুমু খাব?”
“ছিঃ না!” মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলে নিহি।

অনল মাথাটা কিঞ্চিৎ নিচু করে চাপদাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলে,
“সত্যিই ভেবেছ আমি তোমায় চুমু খাব? তাহলে তো একটা চুমু খেতেই হয়। এসো, কাছে এসো।” হাত বাড়িয়ে বলে অনল। নিহি ফ্লোর থেকে বোতলটা তুলে বলে,
“খবরদার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না বলে দিলাম।”
অনল এবার হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলে,
“তুমি কি এই বোতল দিয়ে এখন আমার সাথে যুদ্ধ করবে না কি? লাইক সিরিয়াসলি?” আবারও উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে,
“এই বোতল দিয়ে আত্মরক্ষা করবে তুমি? এরচেয়ে যদি বলতে সেফটিপিন দিয়ে আমার পেট ফুঁটো করে দেবে বা নোখ দিয়ে আমায় খামচি দেবে তাহলেও না হয় বুঝতাম নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে তুমি। তা না করে বোতল! বোতল দিয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছ?”

ভয়ে নিহির কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। ভীষণ বিপদে পড়া গেল। মনে মনে যে কয়টা সূরা মুখস্থ আছে সব পড়ে ফেলেছে নিহি। ভয় পেলে অনল আরো কাবু করে ফেলবে ভেবে সাহস দেখিয়ে বলে,
“দেখেন আমি কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে বিচার দেবো।”
অনল ঘনঘন চোখের পলক ফেলে বলে,
“ওহ তাই? তা কী বিচার দেবে শুনি? কী করেছি আমি?”
নিহি এবার থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই তো এখনো কিছু করেনি। টিফিন খেয়ে ফেলেছে এই বিচার দেওয়ার বয়স কি এখন আর আছে? এই ছেলেটা সবদিক থেকেই আটকে ফেলছে। অনল হেসে বলে,
“তাছাড়া কাল যেন কী বলেছিলে? নিহি নিজের উত্তর নিজেই দিতে পারে! ওহ বাবাগো! সাহসী মাইয়া? তো এখন প্রিন্সিপাল স্যার বলে বলে ম্যা ম্যা করছ কেন?”
“এই শুনুন, আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। আমাকে যেতে দিন। নয়তো ভালো হবে না বলে দিলাম।”
“আমায় ভয় দেখাচ্ছ তুমি? তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে চুমু খাব? ইয়াক! আমার রুচি এখনো এত খারাপ হয়নি।”

“কিহ্! এত্ত বড় অপমান। নিহিকে অপমান। খবরদার নিহি তুই কিন্তু একদম মুখ খুলবি না। সময় তোরও আসবে। এখন শুধু এই মুলার হাত থেকে বেঁচে ফেরাটাই প্রধান উদ্দেশ্য তোর।” মনে মনে বলে নিহি।
অনল নিহির হাত ধরে টেনে ক্যান্টিনের পাশের রুমে নিয়ে যায়। এই রুমে স্যার,ম্যামদের জন্য রান্নাবান্না ও খাবারের আয়োজন করা হয়। রান্নার দায়িত্বে যে খালা থাকে তাকে অনল জিজ্ঞেস করে,
“খালা আজ কী রান্না হয়েছে?”
উত্তরে খালা বলে,
“ভাত আর মুরগীর মাংস।”
“আচ্ছা। আপনি বাইরে যান। আমি ডাকলে আসবেন।”

খালা অনলের কথামতো বাইরে চলে যায়। অনল নিহিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলে,
“আমায় খাবার নিয়ে খোঁটা দাও তুমি? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই তোমার।”
“একটা সাধারণ মেয়ের ওপর জোর খাটিয়ে বলছেন এটা আপনার ক্ষমতা?”
“কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করো।”
“আমি খাব না।”
“চুমু খেতে না চাইলে খাও।”
“আপনার রুচি এত খারাপ নয় বলেছিলেন। সো, ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।”

অনল নিহির দিকে একটু ঝুঁকে বলে,
“নিজের জেদকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমি সব করতে পারি। তখন রুচির বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেবো না। কথা ক্লিয়ার?”
নিহি অনলকে দু’হাতে সরিয়ে দেয়। তারপর হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু করে। অনল পাশের চেয়ারে বসেই ফোন টিপে। আর আড়চোখে নিহির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। খাওয়া শেষ হতেই নিহি বলে,
“এবার আমি যাই?”
“যাবে না তো কি আমার কোলে বসে থাকবে?”
নিহি বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়। এখন থেকে বের হতে পারলেই শান্তি। দরজার কাছে যেতেই আবার অনলের ডাক পড়ে।
“আমায় ফ্রিজ থেকে একটা আপেল বের করে দাও তো!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিহি একটা আপেল বের করে অনলের দিকে এগিয়ে দেয়। অনল ফোনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে আপেলের দিকে তাকায়। তারপর নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“নোংরা হাত দিয়ে আপেলটা আমায় দিচ্ছ। তোমার হাতে জীবাণু আর আপেলেও জীবাণু। আমার পেট খারাপ হলে পরে? তখন কী হবে? যাও আপেল ধুয়ে আনো।”
নিহির ইচ্ছে করছে অনলের পিণ্ডি চটকাতে। তাহলেই মনটা শান্ত হতো।কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই মনের দুঃখ মনে রেখেই আপেল ধুতে বেসিনের কাছে যায়। বেসিনে ভিম সাবান দেখে শয়তানি বুদ্ধি মাথায় আসে নিহির। ভিম সাবান দিয়ে আপেল ধুতে ধুতে বিড়বিড় করে বলে,
“চান্দু এইবার বুঝবা মজা। বারবার আমায় জ্বালাও না? এই নিহিও কম না হুহ!”
আপেলটা অনলকে দিয়ে বলে,
“এই নিন জীবাণুমুক্ত আপেল।”

নিহির চঞ্চলতা দেখে অবাক হয় অনল। আপেলে কামড় বসিয়ে বলে,
“আপেলের থেকে কীসের গন্ধ আসছে?”
নিহি দাঁত কেলিয়ে বলে,
“ভিম সাবানের গন্ধ। আপনি না বললেন আমার হাতে আর আপেলে জীবাণু? তাই ভিম সাবান দিয়ে আগে নিজের হাত ধুয়েছি তারপর আপেলও ভিম সাবান দিয়ে ধুয়েছি। কোনো জীবাণু নেই এখন। দেরি না করে খেয়ে ফেলুন।”
“তোমাকে তো আমি…” চেয়ার ছেড়ে উঠে নিহিকে ধরতে যাবে তার আগেই নিহি দৌঁড়ে বেরিয়ে যায়।

চলবে…