আ না ম পর্ব-০৫

0
60

“আ না ম”- ৫
-Azyah সূচনা

প্রকৃতি জানান দিয়েছে অঝোর ধারায় বর্ষণ হবে।নিশির তমসাবৃত অম্বরে স্বর্ণবর্ণের বজ্রপাত।আকাশে যেনো ভিন্ন আলোকচিত্র।বৃষ্টিপাতের ঘোষণা করে নিশিকারার কানে। ঝড়ের স্বরে নাচছে উপকুল গাছ গাছালি।ভীষণ বাতাসের ঝুলন্ত শব্দে রাস্তাগুলি শূন্যতায় ডুবে।নৃত্য করছে বৃষ্টির পৃষ্ঠে পড়া পাতাগুলি।গা ছমছম বাদল ধারায় একা হাঁটছে রামশা। পরিধেয় গায়ে লেপ্টে আছে নিষিক্ত।হিম সর্বাঙ্গ।অক্ষি পল্লব থেকে টপটপ নিপতিত সলিল সামনের দৃশ্যকে করে তুলছে ঝাপসা। ক্ষীণদৃষ্টির সাথেই দ্রুত কদমে এগোচ্ছে।একা নির্জন রাত্তিরে কোনো মেয়ের একা রাস্তায় ঘুরাফেরা মোটেও উচিত নয়। অনুচিত কাজ থেকে বিরত রাখতেই রামশা সামনের দিকে এগোয়।মিনিট দশেক হাঁটার পর সামনে একটি দালানের অবয়ব চোখে ঠেকলো।কিছু সময় আগে একজন হয়তো এই বাড়িটির কথাই বলেছিলো।তবে কি আশ্চর্য্য!এই এলাকা জুড়ে কোনো বাড়িঘর নেই।এই একটি বাড়ি দেখেও যেনো বিস্মিত হয়।ভেজা ভেজা আওয়াজ তোলা বৃষ্টির মাঝেই এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে ঢুকলো পুরোনো গেট বেয়ে। দারোয়ানও নেই কোনো।ভেতরকার পরিস্থিতি আরো বিস্ময়জনক।গাছ গাছালি আড়াল করেছে এই বিশাল বিল্ডিংটাকে।শেওলা পড়া দেয়ালে দেয়ালে।অনেক পুরোনো আমলের বাড়ি বোধহয়।দরজায় দাড়িয়ে নেমপ্লেট এর দিকে চায় রামশা।লিখা “শূন্য আশ্রম”। বোধগম্য হয় এটা একটা আশ্রম।এখানে অবশ্যই শেল্টার পাবে সে।

কলিং বেলের দিকে হাত দেওয়ার পূর্বেই মাঝারি আকারের দরজাটা খুলে গেলো। আতকে উঠে রামশা।দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে এক পলক দেখে চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো।গোলাপী রঙের কাপড়ে দাঁড়ানো এক যুবতী।মাথা অতি সামান্য ডানদিকে এলিয়ে আছে। মুখখানায় এক ফ্যাকাশে মলিন ভাব। অকস্মাৎ চোখে চোখ পড়ে গেলো রামশার।মেয়েটির চোখ বলছে ভিন্ন গল্প।বাদামি রঙের চোখের মনি সম্পর্কে অবগত ছিলো সে।তবে সবুজ?যেনো সাদা অংশের মাঝে শেওলা পড়া এক বৃত্ত।

রামশাকে চুপচাপ থাকতে দেখে যুবতীর তরফ থেকে প্রশ্ন আসে,

-“পরিচয়?”

নারী গম্ভীর গলার আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গে রামশার।বলে,

-“আম…আমি রামশা ডিসুজা।”

ফের একই কন্ঠস্বরে প্রশ্ন এলো,

-“কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

কন্ঠটা বারেবারে ঝিম ধরিয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে এই শীতলতা কি শুধুই বৃষ্টিস্নাত রাতের প্রভাব?একজন মেয়ে হয়ে সামনে দাঁড়ানো মেয়ের ভ্রমে আচ্ছন্ন হচ্ছে।

রামশা কম্পিত;জর্জরিত।বললো,

-“আমি একজন ট্রাভেলার। কক্স বাজার এসেছিলাম সোলো ট্রিপের জন্য। সমুদ্রদ্বারে বাস করা মানুষের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য।আমার হোটেল এখান থেকে অনেক দূরে।আর বৃষ্টিও হচ্ছে।একজন বললো এখানে থাকা যাবে….আজ রাতটা এখানে..”

-“ভেতরে আসুন”

পুরো কথা শোনার পূর্বেই মেয়েটি অনুমতি দেয়।উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকলো। রামশাও তার পিছু পিছু হাঁটছে। বাহিরটা যেমন পুরোনো ভেতরকার অবস্থাও ঠিক তাই।তবে বহুল কামরা বিশিষ্ট একটি বাড়ি।নিচ তলায়ই বোধহয় পাঁচ সাতটার মতন ঘর হবে।ভেতরে দেখা গেলো কয়েকজন বৃদ্ধ নারীদেরকে।সাথে কয়েকজন বাচ্চা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে।মেয়েটি থেমে গেলো।বাচ্চাদের মধ্যে একজনের হাত টেনে ধরে।বাকিরাও থেমে গেছে।

সে তার অতিমাত্রার গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বলে,

-“এখন খেলার সময় না।”

তাদের মধ্যে একজন উত্তর দেয়,

-“কাল ছুটির দিন।তাই আজ ঘুম আসছে না আপু”

মেয়েটি তাদের কথার তেমন গুরুত্ব দিলো না।আদেশ ছুড়লো,

-“এক্ষুনি ঘুমোতে হবে।”

বাচ্চারা মাথা নুয়ে ফেলে।এক এক করে চলে গেলো যারযার ঘরে।বৃদ্ধ মহিলাগুলো এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রামশার দিকে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় একটি ঘর খুলে দিয়ে ঘুরে তাকায় মেয়েটি।
বলে,

-“এখানে সব ধরনের,সব মাপের কাপড় আছে আলমারিতে।যেটা ইচ্ছে পড়ে নিন।”

রামশা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলে, -“থ্যাংক ইউ সো মাচ”

-“ধন্যবাদ শব্দটা আমার পছন্দ নয়।”

বলে মেয়েটি অত্যন্ত ধীর গতিতে হেঁটে নিচে চলে গেলো। অদ্ভুত লাগছে এই জায়গাটা,এই মেয়েটাকে আর এই জায়গার পরিবেশগুলোকে।পুরোনো চৌকি আর স্টিলের আলমারি ফেলা একটা ঘর। জানলার ধূসর পর্দা উড়ছে অকপটে। বৃষ্টির ঝাপটায় মেঝে ভিজে একাকার।আয়তনে অত্যন্ত ছোট ঘরটি আজ রাতের জন্য রামশার আবাসস্থল।আরো একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিললো ওয়াশরুমও আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রামশা।আলমারির দিকে এগোয়।পাঁচ জোড়া কাপড় টানানো।সবটাই মেয়েদের।যেনো কোনো মেহমানের জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা করা।অবাক আর কত হবে?নিজের মাপমত একটি সেলওয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

মিনিট দশেক পর চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে রামশা।দরজায় চোখ পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সং সেজে দাড়িয়ে আছে সেই মেয়েটিই।মুখের ভঙ্গি ঠিক একই রকম।

রামশা কিছু বলবে তার পূর্বেই মেয়েটি বলল, -“রাতে খেয়েছেন?”

খাওয়াদাওয়া হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছিল সে।আশপাশে খাবারের দোকানতো দূরের কথা বাড়িঘরও ছিল না।তবে অসস্তি বোধ করলো রামশা স্বীকার করতে।

মিথ্যে হেসে উত্তর দিলো, -“খেয়েছি”

মেয়েটি এতক্ষন অপেক্ষায় ছিলো রামশার জবাবের।জবাব পেয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না।আখি প্রসারিত করলো সামান্য।সময় নিয়ে উত্তর দেয়,

-“পেটে ক্ষিদে থাকলে খেয়ে নিতে হয়।”

থতমত খেয়ে রামশা বলে,

-“আমার ক্ষিদে নেই সত্যি”

-“আসুন খেয়ে নিন”

সরাসরি নয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আদেশ করলো যেনো।সে পূনরায় হাটা ধরেছে।এই মুহূর্তে রামশার চোখ গিয়েছে তার চুলের দিকে।ছোট ছোট কাঁধ অব্দি কাঁটা চুলগুলো।হাঁটার সময় হাতের তালু মুঠ করে আছে। রামশাও কয়েক সেকেন্ড ভেবে তার পিছু নেয়।

বিশাল খাবার ঘর।লম্বা আকারের টেবিল আর অজস্র চেয়ার রাখা।দেখে বোঝা গেলো এখানে একত্রে অনেক মানুষ খাওয়া দাওয়া করে।আশ্রম বলে কথা। রামশাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে কিচেনের দিকে এগোলো মেয়েটি।দেয়াল ঘড়িতে রাত আড়াইটে। বৃষ্টির জোর এখনও একই রকম।আশপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে খাবার এসে হাজির।গরম গরম ধোঁয়া ওঠানো ভাত আর মুরগির তরকারি।

রামশা বললো, -“থ্যাংক ইউ”

-“ধন্যবাদ শব্দটা আমার পছন্দ নয়”

রামশা জ্বিভ কাটে।একটু আগেই মেয়েটি বলেছিলো তার ‘ধন্যবাদ ’ শব্দের অপছন্দের কথা।এত অল্প সময়েই ভুলে গেলো?

“আসলে মনে ছিলো না।আপনি কিছু মনে করবেন না।”

“হুম”

খাবার প্লেট নিজের দিকে এগিয়ে খাওয়া শুরু করে রামশা।এমন পরিস্থিতিতে আগে একবার পড়েছে।এক কুড়েঘরে থেকেছিলো সুনামগঞ্জ গিয়ে।তবে আজ পরিস্থিতিতে ভিন্নতা।কেমন যেনো ভয়ঙ্কর গুমোট ভাব এখানে।

খেতে খেতে চোখ গেলো মেয়েটির দিকে। অদ্ভুতভাবে দেখছে তাকে।চোখের চাহনি সম্পূর্ণটাই রামশার দিকে নিবিষ্ট। রামশা তার দিকে চেয়ে বলল,

-“আপনার নামটা….”

-“লিয়ানা” চটপট জবাব দিলে গলাটা এখনও ভারই রয়ে গেছে মেয়েটির।

-“বাহ বেশ সুন্দর নাম।আপনি এই আশ্রমে থাকেন?”

-“আমার আশ্রম”

-“ওহ ওয়াও।বৃদ্ধাশ্রম নাকি অনাথ আশ্রম?এখানে উভয়ই দেখেছি আমি।কিছু মনে না করলে জানতে পারি কি?”

লিয়ানা পূনরায় নীরবতায় ডুবে গেলো।চেয়ার টেনে বসলো।অথচ কোনো প্রকার শব্দ হয়নি।চেয়ারে সম্পূর্ণ দেহ ভার এলিয়ে বললো,

-“বৃদ্ধা মানুষরা কাদের সঙ্গ চায়?”

রামশা চোখ এদিক ওদিক ফেরায়।ভেবে চিন্তে উত্তর দেয়,

-“পরিবারের।তাদের সন্তানদের।”

পরপর লিয়ানা আবার প্রশ্ন করলো,

-“অনাথ শিশুদের জীবনে কিসের অভাব?”

এবার দ্রুতই জবাব দিল, -“বাবা মায়ের ভালোবাসার।”

মাথা তুলে বাঁকা চাঁদ এর ন্যায় হাসলো লিয়ানা। শব্দহীন হাসি।বললো,

-“মানুষের মস্তিষ্ক ভাবতে পছন্দ করে।সেই সুবাদে আপনিও ভাবুন।নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই পাবেন।এটা অনাথ আশ্রম নাকি বৃদ্ধাশ্রম?”

খুবই সোজাসাপ্টা উত্তর এর।এই ভবনে বাবা মা -হীন শিশুরা এবং সন্তানহীন বাবা মায়েরা একই সঙ্গে থাকে। রামশার মস্তিষ্কে এর সঠিক চিত্রায়ন হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু জোড়া উচু করলো সে।খুবই ভালো এবং সময় উপযোগী চিন্তাধারা।এই বুদ্ধিটা আগে কেনো কারো মাথায় আসেনি?

-“কারণ কেউ আমার মতন করে ভাবেই নি!”

খাবার গলায় আটকে যাচ্ছে। খুকখুক করে কেশে উঠে রামশা।কেই বা সহ্য করতে পারবে কেউ তার নীরব মনের ভাবনার জবাব দিচ্ছে?তাও সরাসরি বসে।পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় লিয়ানা।

বলে,

-“টেক ইট ইজি”

স্বাভাবিক ভাবে নিতে বললেই কি নেওয়া যায়?মুখ সম্মুখে কেউ মনের কথা ভাষায় প্রকাশ করলে সেটি কখনোই সাধারণ মানুষ শমিত করবে না।প্রথমেই মস্তিষ্কে আসবে ভ্রান্ত উদ্ভট কল্পনা।সামনের এই মানুষটি জ্বীন ভুত নয়তো?

খাবার অর্ধেকও শেষ করতে পারলো না রামশা। কথার ঘোর প্রখর।এখানে আসার পর থেকেই এক অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছে।ভয়ানক এক পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ।নিসর্গের বাতাবরণও ভুতুড়ে। বহির্ভাগ বৃষ্টির ধ্বনিতে মুখরিত ভেতরটা ততটাই গুমোট। রামশা এক সময় ভাবলো এত চিন্তা ঠিক হবে না।রাতের আঁধারে অপরিচিত জায়গায় এসেছে বলেই তার মধ্যে এত দ্বন্দ্ব।ভাবনা চিন্তায় দাড়ি বসালেই সংশয় কেটে যাবে।ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাতগুলোতে পূনরায় হাত রাখে।খাবার নষ্ট করা ঠিক হবে না। গপাগপ খেয়েই উঠে দাঁড়ায়।

হাত ধুয়ে লিয়ানার দিকে চেয়ে বলল,

-“ধন্যবাদ-তো আপনার পছন্দ নয়।তবে কি করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো বলে দিন?”

জবাব আসে, –

“নিজের মধ্যকার ভীত সন্ত্রস্ত হৃদয়কে মজবুত করুন”

দ্বিতীয়বার!তবে এই বার মনের ভাব ধরে ফেলার বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিলো রামশা।তার মুখের ভয়ের ছাপ।যেকোনো মানুষই ধরে ফেলতে পারবে। রামশা ঠোঁট জুড়ে হাসির রেখা টানলো। আলগোছে নিঃশ্বাস ফেলে। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টায়।

পরপর বললো,

-“আচ্ছা”

লিয়ানা জবাব দেয়,

-“গুড নাইট”

ভোরের আলো ছড়াচ্ছে।কল্পনায় ডুবে আকাশের দিকে চেয়ে গল্প বলছিলো রামশা।মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উকি দিয়ে আলো ছুঁড়ে তার দর্শনইন্দ্রিয়তে।আকষ্মিক দৃষ্টিতে ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠলো যেনো। ধাঁধিয়ে উঠে অতর্কিতে।সাথেসাথে রবিনও হাত ঘড়িতে চোঁখ বুলায়।অনেক সময় পাড় হলো। ব্যুরোতে যেতে হবে।

রামশাকে থামিয়ে বলল,

-“এখন এতটুকুই থাক।লিয়ানার বাকি গল্প রাতে এসে শুনবো।”

রামশা জ্বলতে থাকা চোখ বারংবার পিটপিট করে উত্তর দেয়,

-“এস. আই শাবাব তোমায় রাতে ফিরতে দিবে?”

-“দেখি!এখন চলো”

___

সকাল আটটায় চারটে ফাইল হাতে নিয়ে ব্যুরোতে এসেছে সাইফা। ফাইলের দিকে নজর থাকায় আকস্মিক ধাক্কা খেয়েছে গ্লাস নির্মিত দরজার সাথে।ফিক করে হেসে ফেললো নিজের এমন বোকামিতে।হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছে।একই দৃশ্য প্রতিদিনের ন্যায়।একই মানুষ।শুধু আজ একই মানুষের কর্মে ভিন্নতা।কে জানে সাদা রঙের শার্টে কি এমন আছে? শাবাব সাহেব ছাড়তেই চায় না এই রঙটাকে।আজও তাই। গোলাকৃতির টেবিলে নিজের একহাতকে বালিশ হিসেবে তৈরি করেছে।সেখানটায় মাথা রেখে প্রগাঢ় ঘুমে মগ্ন শাবাব।দুটো সাদা কাগজ বিখড়ে আছে জমিনে।মাঝারি আকারের টেবিল ল্যাম্পটাও জ্বলছে অকপটে।ঘুমন্ত পুরুষ সুন্দর হয়?শুধু সুন্দর নয় বেজায় সুন্দর হয় বোধহয়। নাহয় শাবাবকে এতটা সুদর্শন দেখাবে কেনো?

সম্মুখের চিত্রে কদম যুগল থেমে আছে বুঝতে পারলো সাইফা সময় নিয়ে। পলকহীন নেত্র কয়েকবার ঝাপটে এগিয়ে গেলো। ফাইলগুলো টেবিলে রেখে দুঃসাহসিকতার দিকে এগোয় সাইফা।বিশাল মুখমণ্ডলে হাত রেখে সোজা করতে চাওয়ার পূর্বেই কেউ পিছন থেকে কেশে উঠলো।

সাইফা পিছু ফেরার পূর্বেই ঠাট্টার সুরে উক্তি ছুঁড়ে,

-“জেনে শুনে আগুনে ঝাঁপ দেওয়াও কিন্তু মানসিক রোগের লক্ষণ!”

দ্রুত শাবাবের চেহারার কয়েক ইঞ্চি দুরত্বে রাখা হাত সরিয়ে নেয় সাইফা।পরিচিত আওয়াজে পিছু ফিরে রাগী চেহারা বানিয়ে বলে,

-“মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সবাইকেই মানসিক রোগী ভাবে।এটা তাদের কাছে একটা খেলা”

-“তাই নাকি সাইফা?” মির্জা হেঁটে এসে চেয়ারে আসন গ্রহণ করে।

-“হ্যাঁ তাই”

-“প্রেম শব্দটাকেও আমি মানসিক রোগ হিসেবেই ধরি।”

বুকে হাত বেঁধে সাইফা জানতে চায়, “কে প্রেম করছে এখানে?”

চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে মির্জা বললো,

-“মনেতো হচ্ছে সাইবার এক্সপার্ট অফিসার সাইফা বিনতে জুনায়েদ”

সাইফা নড়েচড়ে উঠলো।তৎক্ষনাৎ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে।মাথা এদিক ওদিক দুলিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরায়।কফি ম্যাশিনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-“আজগুবি কথাবার্তা।আপনার উচিত নিজেও একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া।”

শব্দ করে হেঁসে উঠে মির্জা।পুরুষের হাসির আওয়াজ।দেয়ালের কোণায় কোণায় আঁচড়ে পড়েছে।কিছুটা সামনে তন্দ্রায় মগ্ন শাবাবের শ্রবণইন্দ্রিয়তেও এসে বাজে। ঝটপট চোখ খুলে চায় সে। অস্পষ্টতা কাটাতে চোখ কচলে নিলো।সামনে মির্জা আর সাইফাকে দেখে গাঢ় গলায় বললো,

-“গুড মর্নিং”

মির্জা দুষ্টু ভীষণ।বলে উঠে,

-“মর্নিং সাইফার জন্য গুড নয়।”

বিচিত্র মুখের ভঙ্গিমায় শাবাব জানতে চায়,

-“মানে?”

মির্জা হাসির ছলেই বললো,

-“ঘাড় বাঁকা করে ঘুমাচ্ছিলে। সাইফার এটা দেখে বেশ কষ্ট হয়েছে।ঠিক করে দিতে চাইছিলো।আমি এসে বাঁধা দিলাম।সাথে লজ্জাও দিলাম।তাই মেয়েটার মর্নিং ব্যাড হয়ে গেলো।ওকে ব্যাড মর্নিং বলো শাবাব”

দ্রুত চায় শাবাব সাইফার দিকে।অথচ সাইফার চোখ মির্জার দিকে।বিস্ফোরণ ঘটবে নয়নের মণি। অতিমাত্রায় প্রসারিত হয়ে থাকার কারণে।কি অবলীলায় বলে ফেললো।ঘোরানো পেঁচানো বাক্যসমগ্র।তারপরও ঠিকঠাক ভুল ইঙ্গিত দিয়েছে।

সাইফা বললো, -“মিথ্যে কথা বলেন কেনো আপনি স্যার?”

-“মিথ্যে কোথায় বললাম?” ফিরতি প্রশ্ন করে মির্জা।

-“মিথ্যেই বলছেন।যত্তসব!”

-“সিসিটিভি ফুটেজ দেখাবো?”

আর কথা বাড়ায় না সাইফা।নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো অস্থিরতা সহিত। মোটামুটি আকৃতির ডেক্সটপের আড়ালে আংশিক মুখ লুকিয়েছে।মির্জা হাসলো পূনরায়।

গুরুত্বহীন শাবাব জানতে চায় মির্জার কাছে,

-“এখানে কি করছো?”

-“এসেছিলাম সুসংবাদ দিতে”

-“কি?” ভরাট গলায় জানতে চাইলো শাবাব।

-“প্রফেসরের অবস্থায় উন্নতি হচ্ছে।আবির আর ট্রেইন্ড ডাক্তারদের বদৌলতে আমরা ৯০% সফল।”

শাবাবের ঠোঁটে যেনো হাসি আসতে চেয়েও আসলো না।দমিয়ে ফেললো নিজেকে।বললো,

-“জবানবন্দি নেওয়া যাবে?”

-“না এখন না। আবির জানালো সে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সেন্সলেস।আমার মনের হয় পুলিশের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছে সেটা এনাফ”

-“নাহ মির্জা। ইচ অ্যান্ড এভ্রী ডিটেইল দরকার।কোনো ধূলিকণার মতন বিষয়ও যেনো হেঁয়ালি করে না দেখা হয়”

-“আমার জন্য এখন কি অর্ডার?”

শাবাব চোখ নামায়।পরপর আবার দৃষ্টি তুলে বললো,

-“হাসপাতালে যাও।আমি আসছি”

ঝটপট উঠে দাঁড়ায় মির্জা।যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বললো,

-“ওকে টেক কেয়ার।”

ফ্রেশ হতে গিয়েছে শাবাব।যাওয়ার পথে জামিলকে চেঁচিয়ে ডাকে। কড়া কফির আদেশ করে চলে যায়। সাইফা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।পিঠের পেছনে দেয়ালে মাথা এলিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে।চোখটা বন্ধ করলো।মস্তিষ্ক সতেজ করার উপায় এটা। যন্ত্রের মাঝে যন্ত্র হয়ে যাওয়ার পূর্বের সাবধানতা।

কিছু সময়ের অতিবাহনের পর কফির মগের আওয়াজে চোখ খুলে চায় সাইফা।স্বয়ং শাবাব মহারাজ দাড়িয়ে। কুঁচকানো সাদা শার্ট গায়ে। ঢোক গিলে সাইফা মাথা তোলে।

বলে, -“জ্বি স্যার?”

-“রুবির খোঁজ পেয়েছো?”

-“ফাহাদ এর দায়িত্বে আছে স্যার। খোঁজ চলছে”

-“রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজ?”

-“নেই স্যার।সব ক্যামেরা ডিস্ট্রোয় করা হয়েছে ঘটনার পূর্বে”

-“রাস্তার ফুটেজ?”

-“আছে”

-“রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের কি খবর?”

-“হাসপাতালে আছে স্যার।”

বেগবান প্রশ্ন-উত্তর।উত্তর জত গতিশীল ঠিক জবাবের গতিও একই।দ্রুতগামী। ডেস্কের রাখা কফির মগ তুললো শাবাব। ধোঁয়া তুলছে গরম কফি। অথচ চোখের পলকে গটগট গিলে ফেললো। সাইফা চোঁখ তুলছে কখনো আবার কখনো নামিয়ে ফেলছে।সব রিপোর্ট করলো।এখনও কেনো দাঁড়িয়ে এই লোক?

সাইফার প্রশ্নের উত্তর দিতে শাবাব সামান্য ঝুঁকে এলো।নিরাপদ দূরত্ব এর ঠিকঠাক খেয়াল রেখেছে।দৃষ্টি ঘোরসম্পন্ন।কপাল কুঁচকে রাখায় অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এতক্ষন তোতাপাখির মতন জবাব দেওয়া সাইফার ঠোঁটে বিশাল তালা ঝুলেছে।বলিষ্ঠ হাত ডেস্কে ঠেকিয়ে বললো রুঢ় গলায়,

-“নারী স্পর্শ আমার দেহ এবং হৃদয় উভয়ক্ষেত্রেই অসহনীয়”

চলবে…