আ না ম পর্ব-৭+৮

0
71

“আনাম”- ৭
-Azyah সূচনা

-“লিয়ানার গল্প শোনাতে লিয়ানা খোদ এসেছে”

রামশার শব্দে পিছু ফিরে চাইলো রবিন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হাসপাতালে যাওয়ার। হাতে এভিডেন্সও এসেছে কিছু রুবি সম্পর্কে।ভর সন্ধ্যায় হোটেল ত্যাগের পূর্বে সেই মেয়েটির গল্প শুনতে মোটেও ইচ্ছুক নয় রবিন।তবে দেখতে চায় তাকে।সবুজ চোখের মেয়েটিকে।পিছু ফিরে তাকানোর পরও রামশা ব্যতীত কাউকে দেখা গেলো না।

রবিন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলো, -“কোথায়?”

রামশা সরে গেলো সামনে থেকে।সিনেমার দৃশ্যের মতন তার পিছন থেকে একজন নারী অবয়ব দৃশ্যমান হয়।লম্বায় আর স্বাস্থ্য দুটোই রামশার থেকে কম।তাইতো পুরপুরি আড়াল ছিলো রামশার পেছনে।রবিন দুয়েক কদম এগিয়ে আসে।ভালোভাবে গোলগোল চোখে চেয়ে থাকা মেয়েটির মুখপানে চাইলো। রামশার বলা কথা মিথ্যে নয় মেয়েটির চেহারা সম্পূর্ণটাই ধাঁধানো।ভ্রম ধরে যাচ্ছে মুহুর্তেই।অত্যন্ত ফ্যাকাশে মলিন।যেমনটা রামশা বলেছিলো।চোখের পলক অব্দি পড়ছে না।সামান্য ঘাড় বেকিয়ে অপলক চেয়ে রবিনের দিকে।

দুজনকে একে ওপরের দিকে এরূপ চেয়ে থাকতে দেখে রামশা বললো,

-“ঠিক এই অবস্থাই আমার হয়েছিলো। লিয়ানার ভয়ঙ্কর মায়াবী মুখ দেখে আমি মেয়ে হয়ে চোখ সরাতে পারিনি।তুমিতো বরং ছেলে!”

চোখের পলক ফেললো রবিন।অনিচ্ছাকৃত হাসলো।বললো,

-“নাইস টু মিট ইউ মিস লিয়ানা।কিন্তু আমি অত্যন্ত দুঃখিত আপনাদের এখন সময় নিতে পারছি না।আমার জরুরি মিটিং আছে যেতে হবে।”

-“ইটস ওকে” গম্ভিরতায় পূর্ণ কণ্ঠে বললো লিয়ানা।

রামশা ছটফট করে উঠে।বলে, -“আমিও যাবো”

আকস্মিক গলার আওয়াজ উচুঁ করে রবিন।রেগে বলে উঠে,

-“প্লিজ রামশা।আমি কাজে যাচ্ছি।আর সেখানে তোমার কোনো কাজ নেই।কি করবে তুমি?এমনেতেই শাবাব ধরে ফেলেছে তুমি কোনো ক্রাইম রিপোর্টার নও। দয়া করে এসবে জড়াবে না।”

লিয়ানার সামনে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলার কারণে রামশার অপমানিত বোধ হয়।সেও রেগে উঠে।বলে,

-“আমি এসবে জড়াতে চাচ্ছিও না।”

-“তাহলে কেনো বাঁধা হচ্ছো আমার কাজে?”

-“তুমি আমাকে সন্দেহ করছো রবিন?”

অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলো রবিন।সন্দেহের কথা আসছেই বা কেনো?এটাই মাথায় ধরলো না।জবাবে বললো,

-“কোনো সন্দেহ করছি না।আমার সাথে আছো।আমাকে অন্তত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছো আপাদত এটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো।”

-“ফাইন!”

শারীরিক দুর্বলতাকে উপেক্ষা করা যায়।কিন্তু মনের দুর্বলতাকে?এই সংস্থার অফিসারদেরকে সকলেই হয়তো ভাবে অনুভূতিহীন।তবে তার বক্ষস্থলের মধ্যে থাকা হৃদয়ের দুর্বলতা সম্পর্কে কেউ এক বিন্দু টের পায় না।রবিন হাঁটছে আর ভাবছে মন মস্তিষ্কের সম্পূর্ণটায় রামশা নামক মেয়েটাকে ভর করতে না দিলেই পারতো।নিজেকে শক্ত রাখতে পারতো তার কিছু বিষয়ে।সেটা আর হচ্ছে না। কঠোরতা দেখিয়ে বুক জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।তবে আজ কষে লাগাম টেনে নেয়।দুর্বলতাকে পাত্তা না দিয়ে হাটতে শুরু করলো ব্যুরোর উদ্দেশ্যে।

রামশা রবিনের যাওয়ার পরপর লিয়ানার দিকে চায়।সে আগে থেকেই তার পানে তাঁকিয়ে। রামশা নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে বললো,

-“এসব নিয়ে তুমি ভেবো না।এসো গল্প করি।পড়ে ডিনার করতে যাবো কেমন?”

লিয়ানা তার কথার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করে,

-“কেমন গল্প?”

-“বলার মতো তো কত কথাই আছে”

-“নেইতো”

রামশা তার এই অদ্ভুত ব্যবহার পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে দেখছে।এক বাক্য অথবা এক শব্দেই পুরো কথা শেষ করে দেয়।মুখমণ্ডল আর কথা উভয়েই কেমন অদ্ভুত গুমোট ভাব।তার আচরণের এই ভিন্নতা রামশার মনে ধরেছে। পরিচয়ের প্রথমে তাকে ভয় হলেও তিনদিন “শূন্য আশ্রম” এ থাকার পর বুঝলো কম কথা বলা এই মেয়েটি কিছুটা অস্বাভাবিক হলেও শান্ত এবং ভদ্র।আগলে রেখেছে আশ্রমের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুদের।খেয়াল রাখছে তাদের সমস্ত কিছুর।বুদ্ধি খাটিয়ে বৃদ্ধাশ্রম এবং অনাথ আশ্রম একই সাথে গড়ে তোলে যেনো কেউ বাবা মা আর সন্তানের অভাব অনুভব না করে।বেশ ভালো লেগেছে ছোট্ট এই মেয়েটিকে।তার চেয়ে বেশি তার করা কাজ।সমাজসেবার সাথেই অনেকাংশে জুড়ে আছে।

রামশা স্মিথ হাসে।বলে,

-“ঠিক আছে।আমি আমার গল্প তোমায় শোনাবো।”

-“শুনবো” বলে জবাব দেয় লিয়ানা।

অম্বরপানে অক্ষি নিবেশ লিয়ানার।মেঘেদের সাথে কথা বলে সে মনে মনে।তার চোখের সবুজ রহস্যে ভেসে যায় স্বপ্নের দুনিয়া।চিন্তামগ্ন মনে মেঘের নীচে বিচার করে।গাছের সাথে চলে ভিন্ন আলাপন।টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় এই প্রকৃতি।আমন্ত্রণ জানায় অতল গহ্বরে।একটি অদ্ভুত নারীরূপে পরিচয় তার।মেঘের প্রতিফলিত ছায়ার মতো।স্বপ্নের সৃষ্টি ও বাস্তবতা মধ্যে সীমাহীন মধ্যবর্তী দুনিয়া তৈরি করেই মত্ত থাকে সর্বক্ষণ।

অনেক সময় যাবৎ নিজের আর রবিনের প্রেমের গল্প বলছিলো রামশা।এক সময় মনে হলো লিয়ানা ব্যস্ত।ভীষণ রকমের ব্যাপৃত আকাশের সাথে কোনো অমীমাংসিত আলাপনে। ঠোঁটজোড়া অনবরত চলছে।তবে শব্দহীন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলো রামশা।

লিয়ানার ঠোঁটের চলন বন্ধ হয়ে গেলে রামশা বললো,

-“কি এমন কথা বলছিলে আকাশের সাথে শুনি?”

-“দিনের আকাশের সচ্ছ মেঘমল্লার আমার বন্ধু।রাতের আকাশের তারা-রা একাকীত্বে সঙ্গী। চাঁদ তাদেরই মধ্যে সবচেয়ে সম্মানীয়” ঘোরালো আওয়াজে বলে উঠে লিয়ানা।

-“তুমিতো দেখছি ভারী প্রকৃতি প্রেমী?কি সুন্দর করে বিশ্লেষণ করলে”

-“তুমি যাকে জড়বস্তু হিসেবে দেখো।তারা সকলেই জীবন্ত”

-“আমি গল্প,উপন্যাস, মুভিতে দেখেছি।তারা প্রকৃতির সাথে কথা বলে।অনুভব করে তাদের।”

লিয়ানা সরাসরি উত্তর দেয়,

-“মিথ্যে বলে তারা।ভনিতা করে”

রামশা অবাক সুরে জানতে চায়,

-“এত শিউর কি করে তুমি?”

-“সমাজটা মিথ্যে মনুষত্বে ভরপুর।যা দেখো সবটাই দেখানো হয়।বলো? চাঁদ দেখতে সুন্দর। দেখতেই ইচ্ছে হয় বারবার।কখনো ওই সাদা আলোর মাঝে ডুবে গেছো? কল্পনায় কথোপকথন হয়েছে কখনো?”

-“হয়নি কখনো” ভেবে চিন্তেই উত্তর দিলো রামশা।

নীরবতায় ঢেকে গেলো চারিদিক। রামশা আবার চাইলো লিয়ানার দিকে। চাঁদের আলোয় চোঁখদুটো আরো উজ্জ্বল হয়েছে।একজন মেয়ে হয়েও এই মেয়েটিকে এত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে রামশা।নারীকে সুন্দরতম উপায়ে বিশ্লেষণ করাতো পুরুষের কাজ। আনমনে হাসে রামশা।নিজের নীরবতা নিজেই কাঁটায় লিয়ানা।

নিজ থেকে বললো,

-“আমার একটা কল্পনার জগৎ আছে।এই জগতে আমি সব সাজিয়েছি আমার নিজের মতো করে।এখানে আমার ইচ্ছে চলে।জীবনে আমি যা যা চেয়েছি সবকিছুর পূর্ণতা দেই এখানে। এই জগতে সব ভালো।এই জগতে খারাপের জায়গা নেই।এই জগৎ আমার!আমি সুখী এখানে।নেই কোনো লেনাদেনা বাস্তবের সাথে।নেই মানুষের সাথে।”

__

প্রফেসরের কাছ থেকে বিশেষ কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। একই কথা তোতা পাখির মতন বলে যাচ্ছেন।যা থানায় বলেছিলেন। শাবাব আর রবিনের সন্দেহ প্রখর।দুজনেই আন্দাজ করেছে একই সাথে। প্রফেসর রাজিনের কথাবার্তায় কিছু একটা মিসিং।হয়তো কিছু লুকাচ্ছে।তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাকে আপাদত জেরা করা থেকে বিরত রাখলো শাবাব আর রবিন উভয়েই সম্মিলিতভাবে।তবে রুবিকে দেখা গেছে। ঢাকায় সিটি হসপিটালের বাহিরে।রবিন অফিসার নিয়োগ করলো তার সঠিক লোকেশন জানার জন্য। আশা আছে খুব শীগ্রই রুবি তাদের সামনে উপস্থিত হবে।

মিটিং শেষে আজ একই সঙ্গে কফি খাওয়ার সুযোগ হলো রবিন আর শাবাবের।সবাই যারযার কাজে মগ্ন। মস্তিষ্ককে ঠান্ডা রাখতে দুজন বসেছে।

শাবাব কফির মগ টেবিলে রেখে বললো, -“আপনার ক্রাইম রিপোর্টার যে এলো না আর? রিপোর্ট তৈরি করবে না নাকি?”

সংকোচ বোধ করে রবিন। রামশার কথা জিজ্ঞেস করছে শাবাব।উত্তর দিলো,

-“আসেনি। আপনিইতো না করেছেন”

-“সে কেস সম্পর্কে সবটাই জানে তাই না?”

-“হ্যাঁ”

শাবাব ভালোভাবে রবিনের মুখটা পর্যবেক্ষণ করে। পরক্ষনেই বলে উঠলো,

-“সাথে রাখতে পারেন।ক্রাইম রিপোর্টিং করুক।দেখি কত পারে”

-“হঠাৎ এই কথা বলছেন যে?” জানতে চাইলো রবিন।

শাবাব স্মিথ হেসে বললো, -“প্রেম হয়তো-বা ভালো এস. আই রবিন।তবে প্রেমে অন্ধ হওয়া ভালো না”

-“আপনার কথাবার্তা খুবই পেঁচানো”

-“আমি লোকটাই জঞ্জালে পূর্ন”

-“প্রয়োজন হলে তাকে আনবো।তাছাড়া এসব কাজে অন্য কাউকে ইনভলভ না করাই বেটার।”

শাবাব ফোন হাতে তোলে।আড়ালে টুকটুক করে একটি মেসেজ লিখলো।মির্জার কাছে যাবে সরাসরি।মির্জা ব্যুরোতে বসে দূর হতে শাবাবের পানে চায়।পরপর মোবাইলের স্ক্রিনে মেসেজটি পড়লো।

-“রামশা ডিসুজাকে নজরে নজরে রাখো”

ফিরতি মেসেজে পাঠায় মির্জা,
-“কেনো?”

-“তাকে আমি গত রাতে ব্যুরোর নিচে একা দেখেছি।তার কাজকর্ম আমার সন্দেহজনক লাগছে”

ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়েছে।রবিন এর খোঁজ নেই।নিজের রাগ, অভিমানকে দূরে সরিয়ে কল করলো তাকে।একবার,দুইবার। পঞ্চমবারেও কলটা রিসিভ করেনি রবিন।চিন্তা হতে শুরু করলো রামশার যখন দেখলো অনেকটা রাত হওয়ার পরও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।কপালে রেখা ফুটেছে।চোখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে হাটা শুরু করলো রবিনের ঘরের উদ্দেশ্যে।তার কাছে চাবি আগেই দিয়েছে রবিন। ঘর খুলে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।ফাইলের উপর রবিনের ফোন রাখা।বুঝতে পারে রাগের মাথায় ফোন রেখেই চলে গিয়েছে সে।ফোন নিয়ে চোখ যায় নীল রঙের ফাইলের দিকে। রামশা এদিক ওদিক চেয়ে ফাইলটা হাতে তুলে নেয়। পাতা এদিক ওদিক উল্টে দেখলো।তবে মাথায় কিছুই ঢুকলো না। ফাইল আর ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরে রবিনের ঘর থেকে।

-“তোমাকে বোধহয় একদমই যত্ন করা হয়না তাইনা?তোমার দেহে কাঁটা আবৃত বলে?এই অফিসটাকে সুন্দর করার জন্যে তোমাকে এখানে এনে সাজানো হয়েছে।কত অযত্ন এখানে তোমার ক্যাকটাস!অথচ তুমি এক উপকারী গাছ।মানুষ এটা জানে!তারপরও কেনো?”

একে একে ব্যুরোর সকলে চেয়ে আছে এই অদ্ভুত রমণীর পানে। উপস্থিত আছে রবিন, শাবাব,মির্জা।পাশেই দাঁড়িয়ে সাইফাও। রামশা একবার সকলের দিকে আরেকবার লিয়ানার দিকে।ছোট্ট ক্যাকটাসের সাথে বাক্যালাপ। যার প্রাণ প্রায় অর্থ।শুকিয়ে এসেছে। এসেছিলো হৃদয়ে বিশাল সাহস নিয়ে রামশা। ফাইল আর ফোনটা দিতে। শাবাব তাকে এই কাজের জন্য সাধুবাদও জানায়। ফাইলটা অত্যন্ত দরকারি।তবে সকলের মনোযোগ টেনে নিলো সোফায় বসে থাকা লিয়ানা।

-“মানুষ বড্ড অকৃতজ্ঞ!” আবার ক্যাকটাসের পানে চেয়ে বললো লিয়ানা।

সাইফা প্রশ্ন করলো ধীর গলায়, -“ও কি গাছের সাথে কথা বলছে?”

রামশা উত্তর দিলো, -“হ্যাঁ”

শাবাব অদ্ভূত চোখে চেয়ে আছে।গাছের সাথে কি করে কথা বলা যায়?হেঁটে গেলো সামান্য দুরত্বে থাকা রামশার দিকে।কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই লিয়ানা বলে উঠে,

-“জানেন কি উত্তর দিয়েছে এই গাছটা?”

মির্জা হেসে বললো, -“গাছ উত্তর দেয়?”

-“দেয়তো!” চোখ তুলে বলে লিয়ানা।

মির্জা ঠাট্টার সুরে বলল, -“আমরাতো শুনতেই পেলাম না কি উত্তর দিলো।আপনার কানে কানে বলেছে বুঝি?আমাদেরকেও শোনান”

লিয়ানা গুরুত্ব দিলো না মির্জার ঠাট্টার।মুখের ভঙ্গিমায় তা স্পষ্ট।তুচ্ছ হেসে বলে,

“উপকারীর উপকার স্বীকার না করলে সে নিজ থেকে ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে।”

সামান্য একটা গাছের জন্য কত ভারী বাক্য ব্যবহৃত হচ্ছে!মির্জা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগে শাবাব চোখের ইশারায় থামিয়ে দেয়।ফ্রি টাইম আছে বলে আজগুবি বিষয়ে অপচয় করবে না।

শাবাব রামশার দিকে চাইলো।আঙ্গুল তুলে দেখালো লিয়ানাকে।বললো,

-“এই পাগলটাকে কোথা থেকে ধরে এনেছেন?”

রামশা চক্ষু নত করে।উত্তর দিলো না কোনো। শাবাবের সাথে কথায় পারবে না। তাছাড়া কোনো উত্তরও নেই তার কাছে। শাবার ঘুরে তাকায়।ভরকে উঠলো তৎক্ষনাৎ।ভয় শব্দের সাথে তার সম্পর্ক বহুদূরের।আজ কাছে এসে ধরা দিল। শাবাব পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে তার চেয়ে উচ্চতায় অনেকটা কম লিয়ানার দিকে।নিষ্পলক অক্ষিবিভ্রম।অনেকটা সাহসিকতার সাথে চেয়ে আছে তার দিকে।নিজের উপস্থিতি কোনোভাবেই পূর্ব উপলদ্ধি করতে দেয়নি।একে অপরের দিকে চেয়ে সময় অতিক্রম কয়েক মিনিট দুয়েক।কেউ কারো থেকে পিছিয়ে নয়।

এক পর্যায়ে শাবাব লিয়ানার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-“আমার চোখের দিকে এত সাহস নিয়ে চেয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা অল্প”

-“অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে আমার নামটা যোগ হলো আজ”

মির্জাসহ সাইফার চক্ষু ছানাবড়া। নীরব দর্শক রামশা আর রবিন।দুজনার মধ্যে বাকিরা শব্দহীন। শাবাবের চেহারায় ক্রমান্বয়ী ক্ষিপ্ততা।চোয়াল শক্ত করে বললো,

-“তাই?”

-“মাত্রাতিরিক্ত ইগো.. অ্যাটিটিউড মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।কন্ট্রোল করুন অফিসার”

-“ওহ রিয়েলি?আমাকে শেখাবেন আপনি?”

-“এডভাইস দিলাম।…বিনামূল্যে”

-“নট একসেপ্টেড। বাট থ্যাংকস”

ঘাড় বাঁকায় সাইফা। নিজস্ব শৈলী তৈরি করে নিয়েছে।নজরের চাল আজগুবি। পাংশু আনন।মায়া আর ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ।চোখ সরানো দায়।তবে শাবাব লাগাম কষতে জানে।প্রপঁচে ডুববে না কিছুতেই।নিজের দেহ ও মুখ ভঙ্গিমা বজায় রেখে সরে যায় সামনে থেকে।

ফাইল হাতে তুলে বললো, -“সাইফা ওনাদের দেখেশুনে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে এসো”

রাত্রির প্রহরে চোখজোড়া কাচের বাহিরে নিবদ্ধ।কি সুন্দর এই প্রকৃতি।এক ভিন্ন ডাকে আবেদন করছে।এসে মিশে যেতে তাদেরই মাঝে। ল্যাম্প পোস্টের মৃদু আলো যেনো তাদেরকে স্পষ্ট করে দেখার ব্যবস্থা করে দিলো।লিয়ানার চোখ দেখছে;হারাচ্ছে তরতর করে পিছু চলে যাওয়া গাছগাছালি।শুধু এই চাঁদটাই পিছু ছাড়লো না। তার কাছে গাড়ীর গতিবেগ কিছুই নয়।সে স্থির নিজ জায়গায়।আকাশ থেকে উকি দিয়ে দেখছে।সাইফা নিজে ড্রাইভ করে লিয়ানা আর রামশাকে হোটেলে পৌঁছে দেয়।হোটেলের সামনে জিপ থেকে নেমেই লিয়ানার দিকে পা বাড়ালো।

বললো, -“একটা কথা বলবো কিছু মনে করবে নাতো?”

লিয়ানা ভার গলায় উত্তর দিলো, -“বলুন”

-“তোমার আচরণ হয়তো আমার সিনিয়রদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।তবে আমার কাছে নয়। প্রকৃতি প্রেম স্বর্গীয়।আমার মনে হলো তুমি এই প্রেমের অনেকটা গভীরে ডুবে গেছো। শাবাব স্যারের কথায় কিছু মনে করবে না।উনি এমনি”

গুমোট ভাবটা কেনো জেনো সর্বদাই থাকে লিয়ানার মুখে।মনে হয় কোনো যন্ত্র। প্রতিক্রিয়াহীন।শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলো সাইফার কথার বিপরীতে।শুধু একটা নাম।

-“শাবাব?”

-“হ্যাঁ ওনার নাম শাবাব”

-“ভালো”

গুরুত্বহীনতার মাঝে অন্ত হয় তাদের আলাপচারিতা। প্রসঙ্গের শেষ নিজেই করেছে লিয়ানা।তবে সাইফা চেয়েছিলো তার সাথে কথা বলতে।ঠিক রামশার মতই তারও এই মেয়েটিকে মনে ধরেছে।তবে লিয়ানাকে অনিচ্ছুক দেখা যায়।বিদায় জানিয়ে রওনা হয় ব্যুরো এর উদ্দেশ্যে।আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছেছে সাইফা।এসেই দেখলো বিকট আওয়াজে হাসছে মির্জা।পাশেই রাগী মুখে বসে শাবাব।আগুন ঝরাচ্ছে মির্জার দিকে চেয়ে।হাসি আর রাগের কারণ জানতে সাইফা এগিয়ে যায়।

প্রশ্ন করে মির্জার উদ্দেশ্যে, -“হাসছেন কেনো স্যার?”

মির্জা হাসি থামায় এবং বলে, -“তোমার শাবাব স্যারের যে টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে।সেটা দেখেই হাসছি”

এমন কথায় দ্বিগুণ রাগ দেখা গেলো শাবাবের মুখে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এক দৃষ্টিতে চেয়ে। অতিরিক্ত জেদে কথা বলা থেকে বিরত থাকে। অবোধ সাইফা আবার প্রশ্ন করলো,

-“মানে?”

-“শাবাবকে কেউতো টেক্কা দিতে পেরেছে।এটা ভেবেই হাসছি।দেখো!একবার ওর মুখটা দেখো” বলে পুনরায় হেসে উঠে মির্জা।

শাবাবের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার পূর্বেই সে বললো,

-“বেশি বেশি হচ্ছে মির্জা!আমার আঙ্গুলের সমান মেয়ে আমাকে টেক্কা দিবে?…. ওর শুধু মুখের জোর।”

-“বিষ দিয়ে বিষ ঝাড়া যায়।আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে মেয়েটাকে।দুটো ধারালো অস্ত্র একসাথে সেইরকম দেখাবে!”

-“মেন্টালি সিক ওই মেয়ে!”

মাঝেমাঝেই মনোবিজ্ঞানী মস্তিষ্ক জেগে উঠে।চুপচাপ বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছে লিয়ানাকে।তার আচরণ তার কথার ধরন আর তার মুখের ভঙ্গি।সেই প্রেক্ষিতে মির্জা বললো,

-“তার লক্ষণতো অনেক কিছুই বলে”

-“ওর লক্ষণ যাই বলুক!আমাদের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।তোমাকে বলেছিলাম রামশা ডিসুজার দিকে নজর রাখতে। মেয়েটাকে আমার সাস্পেসিয়াস মনে হচ্ছে কেনো জেনো।সব কাজে জড়াতে চায়।হুটহাট চলে আসে।ওর ইন্টারফেয়ারেন্স আমার ভালো ঠেকছে না।”

মির্জা ঠাট্টা বাদ দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে উঠে বসলো।সোজা হয়ে বললো,

-“প্ল্যান কি?”

-“প্ল্যান এটাই ওই মেয়েকে অনুমতি দেওয়া হবে আমাদের সাথে থাকার।ওর চাল চলন বিশেষভাবে নজরদারি করতে হবে।বাকিটা তোমরা জানো কি করা উচিত।আরেকটা কথা এস. আই রবিন যেনো এই ব্যপারে ধারণা না পায় যে আমরা রামশাকে সন্দেহের তালিকায় রাখছি।”

চলবে…

“আ না ম”- ৮
-Azyah সূচনা

-“আপনার মনে হয় না প্রফেসর রাজিন আপনি কিছু লুকাচ্ছেন?”

শাবাবের প্রশ্নে থমকে যায় প্রফেসর। হাতে ক্যানোলা লাগানো। পড়নে হাসপাতালের পোশাক।স্ত্রী আর সন্তানরাও এখানেই উপস্থিত আছে। বেঁচে আছে সে এটি সঠিক ভাবে উপলব্ধি করার আগেই পরপর দুবার অফিসার্সদের প্রশ্নের স্বীকার হয়। বেড এর একপাশে শাবাব অন্যপাশে রবিন।

শাবাব থাকলে রবিন আরো একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

-“কোনো কারণ ছাড়া-তো কেউ কারো জীবন নিতে যাবে না তাই না?”

প্রফেসর রাজিন দুপাশে চাইলো।উভয় দিকেই বাঘের দৃষ্টি।জেরা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ নেই।সে বলে উঠলো,

-“আপনারা এভাবে প্রশ্ন কেনো করছেন আমায়?আমি নিজে ভুক্তভুগী।বারবার বলেছি আমি জানি না সে আমাকে কেনো মারতে চেয়েছে”

-“নাহ প্রফেসর।আপনি একজন শিক্ষক।আপনাকে সবাই সম্মান করার কথা। ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা নেইতো কারো সাথে?” রবিন বললো।

-“কারো সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নেই।বিশ্বাস না হলে আমার পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন।”

-“তাহলে আপনাকে বাঁচিয়ে কি লাভ হলো?আমাদের কোনো সাহায্যই করতে পারছেন না।”

শাবাবের এই কথায় চমকে উঠে প্রফেসর রাজিন। কথাটা অদ্ভূত শোনালো।খানিক আক্রোশ দেখিয়ে বললো,

-“আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমাকে বাঁচিয়েছেন?”

-“হ্যাঁ কেস সলভ এর জন্য।” ভাবলেশহীন জবাব দেয় শাবাব”

রবিন বলল,

-“শুনুন প্রফেসর।আমরা জানি আপনি পুরো কথা বলছেন না।অনেককিছু এখনও আড়ালে।তবে একটা কথা বলে রাখি যদি আপনার না বলা সত্য আমাদের নিজেদের সময় অপচয় করে খুঁজে বের করতে হয়?তাহলে পরিণাম দ্বিগুণ খারাপ হবে।”

রবিনের কথায় তাল মিলিয়ে শাবাব বললো,

– “পায়ে অদৃশ্য শিকল বেঁধে রেখেছি। পালানোরও সুযোগ নেই আপনার।”

দ্বিমুখী চাপের স্বীকার প্রফেসর রাজিন।খামচে ধরে বেড এর সাদা চাদর।দুই জোড়া চোখ তার দিকে কঠোরভাবে দৃষ্টিপাত করে আছে। ইঙ্গিত দিচ্ছে ভবিষ্যতের। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।মস্তিষ্কে বিশাল প্যাঁচ।

মির্জা ব্যুরোতে আছে। শাবাবের আদেশ মোতাবেক পরিকল্পনা শুরু করলো।কি করে রামশাকে ট্রিক করে তাদের মধ্যে শামিল করা যায়।রবিন ব্যুরোতে এসেছে।শাবাব সাইফা গিয়েছে রুবির বিশ্ববিদ্যালয়ে।এই প্রফেসর এর জন্ম থেকে এই অব্দি সব খবরাখবর দরকার তাদের।

মির্জা রবিনকে বললো, -“এস আই রবিন?”

রবিন উত্তর দেয় স্বাভাবিক সুরে, –

-“কাজের কথা বাদ দিন।আসুন একে ওপরের সাথে পরিচয় হই।কতদিন যাবৎ আছেন আমাদের সাথে।ঠিকঠাক আলাপত হলো না।”

-“সময় আর পেলাম কোথায় বলেন?”

মির্জা মাথা দুলিয়ে বলে,

-“তাও ঠিক।…আপনার বাবার নাম শুনেছি অনেক।নিজের সময় একজন সেরা অফিসার ছিলেন।”

-“বাবার দেখাদেখিই এই পেশায় আসা”

-“হুম.. আই সি।কিন্তু রবিন আমরা কিন্তু ধরে ফেলেছি আপনার একটা বিষয়”

রবিন সামান্য চমকে জানতে চাইলো, -“সেটা কি?”

-“এইযে মিস রামশা যে কোনো ক্রাইম রিপোর্টার নয়।বরং সে আপনার বিশেষ কেউ”

রবিন চোখ নামিয়ে হাসে।এটা সকলের কাছেই পরিষ্কার। বিপরীতে আর কি সাফাই গাইবে সে?উত্তর দিলো না রবিন। লাজুক ভঙ্গিতে হেসে গেলো কিছুসময়।

মির্জা বলে,

– “সে বোধহয় আপনাকে নিয়ে ইন্সিকিউর তাই না?”

-“তেমন কিছুই না।একটু পাগলাটে-ছটফটে স্বভাবের মেয়ে।”

-“আপনি চাইলে তাকে সাথে রাখতে পারেন। শাবাবকে আমি সামলে নিবো।খুব কাছের বন্ধু আমার।আমার কথা ফেলবে না।”

-“কি দরকার?আমাদের কাজে ওকে ইনভলভ না করলেই ভালো।পার্সোনাল আর প্রফেশনাল মিক্স হয়ে যাবে।”

-“এস. আই রবিন?আমরা সবসময় ভাবি পার্সোনাল আর প্রফেশনাল দুটো আলাদা রাখা উচিত।তবে সত্যিই কি পারি?দুটো কোনো না কোনোভাবে একটার সাথে আরেকটা মেসডআপ হয়…..ভালোবাসা কোনো নিয়ম নীতি,প্রফেশনাল,পার্সোনাল বুঝে না।সত্যি বলতে এমন একটা সিচুয়েশনে আমিও ছিলাম।কিন্তু শেষমেশ ধরে রাখতে পারিনি।আমি দুআ করি আপনার ভালোবাসাটা সবসময় সচ্ছ থাকুক।কোনো কালো দাগ না পড়ুক।তবে হ্যাঁ!আবেগে গা ভাসাবেন না আমার মতন।দিনশেষে পুরুষের অন্তরের যন্ত্রণা কেউ দেখে না”

মির্জার কথায় ছলনা।নিজের ডিউটি পালন করছে।তবে রবিনের মুখের হাসি অনুশোচনা বোধ করাচ্ছে তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তার মতন যেনো রবিনের হৃদয় না ভাঙ্গে।অন্যদিকে শাবাবের কথাও চিন্তা করলো।অনেক কমই তার আন্দাজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে।তবে খুব করে চাইলো মির্জা।যেনো এবার শাবাব ভুল প্রমাণিত হয়। রামশা যেনো কোনোভাবে কোনকিছুর সাথে জড়িত না থাকে।

রবিনের ফোনে ফোন আসে। জুনিয়র অফিসার মিহির এর কল।ঢাকা থেকে।ফোন রিসিভ করলো দ্রুত।বললো,

-“বলো মিহির”

-“স্যার রুবির লোকেশন ট্র্যাক করেছিলাম।ফোন অন হওয়ার সাথেসাথেই সে উত্তরা তার এক বান্ধুবির বাড়িতে থেকেছে এই কয়দিন।আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায় আজ রাতের বাসে সে কক্স বাজার গিয়েছে।”

-“আর কোনো ইনফরমেশন?”

-“স্যার আমরা সন্দেহ করছি সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কোনো কারণে।আমরা তার পিছু নিয়েছে সেটা জানে।”

-“এক কাজ করো আবার যাও ওর বান্ধুবির বাড়িতে।বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করো।যদি কোনো ইনফরমেশন পাও”

-“ইয়েস স্যার!”

__

সময় পেরিয়ে আরো একদিন,

কি অদ্ভূত সম্পর্ক!জীবন্ত এক প্রাণের সমস্ত আলাপন নির্জীবের সঙ্গে।লিয়ানা অনুমতিবিহীন এসে হাজির বিশাল হোটেলের ছাদে। নীরবতায় ঘেরা সারা ছাদ।যেমনটা সে চাচ্ছিলো।তার সঙ্গীরা এসে গেছে।দুদিন হলো তাদের সাথে কথা বলা হয়না।আশ্রমের কিছু কাজে এসেছিল চট্টগ্রামে। ব্যস্ততা ছিলো।দখিনা আকাশের ঠিক ডান দিকে,সন্ধ্যা আর বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে একগুচ্ছ মেঘ থাকে লিয়ানার অপেক্ষায়। তারাও জানে সে আসবে।এসে কথা বলবে দুরাকাশের মেঘেদের সাথে।সেই সত্য কারো কাছে স্বীকার্য না সেই সত্যি শুনে সেই একগুচ্ছ মেঘ।

মেঘেরা যেনো লিয়ানার পায়ের শব্দ আচ করে বলে উঠলো,

-“এসেছো?আজ কি শোনাবে? তাড়া আছে আমাদের। সন্ধ্যে হতে চললো যে!দখিনা আকাশে অন্য মেঘেরা আসবে এবার।”

-“একটু অপেক্ষা করে নাও মেঘ।আজ কিছু বলবো তোমাদের।”

লিয়ানা আনমনেই ভেবে নিলো। মেঘেরা উত্তর দিচ্ছে,

-“বলো শুনছি”

দীর্ঘশ্বাস টেনে লিয়ানা বললো,

-“আমাকে মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ ভাবছে।তবে সত্যিটা ভিন্ন।আমি একজন মানুষ,আমি মানি!মৌলিক, জৈবিক সকল চাহিদা আমার মধ্যে আছে,মেঘ।…..”

-“তাহলে সমস্যা কোথায়?”

-“আমার পথ শেষ হয় না।আমি গন্তব্য খুঁজে পাই না।তাই ভাবলাম ছেড়ে দেই!বাদ দেই!নিজের কল্পনা রাজ্যকে সাজাই নিজের মত করে।সেখানে আমি আমার সকল অপূর্ণ ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিচ্ছি।আমি সুখী এখানে মেঘ!কেনো আমাকে মানুষ সুখী দেখতে চাচ্ছে না?আমার অধিকার নেই?আমি দুই চারজন মানুষের বিপরীতে একা হাসি বলে?আমি অন্যের সাথে না নিজের সাথে নিজে একা একা কথা বলি বলে? আমিতো কখনো করো সুখে বাঁধা হতে যাইনি।তাহলে কেনো সবাই আমাকে পাগল বলে বেড়ায়?আমি ভালো আছিতো!থাকতে দেক না আমাকে ভালো।আমি কারো জন্য ক্ষতিকারক?আমি সড়কের এক কোনে বাড়তে থাকা দূর্বা ঘাসের মতন। যার মধ্যে মাঝেমধ্যে ধুলো পড়ে আবার শিশিরও।”

মেঘেদের নীরব কথা লিয়ানার কর্ণপাত হয়।যেনো তাকে ডেকে বললো,

-“চলে এসো আমাদের সাথে।হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে।এখানে তোমায় কেউ বিচার করবে না।”

-“কি করে আসবো?আমি ভাসতে চাই তোমাদের সাথে ওই নীল আকাশে”

মেঘেরা জবাব দিলো,

-“চোখ বন্ধ করে ফেলো।অনুভব করো।কল্পনা করো নরম তুলতুলে সাদা মেঘের দলের সাথে অত্যন্ত ধীর গতিতে ভেসে বেড়াচ্ছ তুমি”

শ্যামল মনি জোড়া আচ্ছাদিত হয়ে গেছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে অসম্বদ্ধ করে নিজেকে এই ইহজগৎ থেকে। দূরে সরিয়ে নেয় পার্থিব সমস্ত চেতনা থেকে।মনন নিবেশিত হচ্ছে নভোমন্ডলে।বদ্ধ নয়নের সম্মুখে চিত্র ভিন্ন।রং বেরঙের রঙের মেলা।যেনো কেনো ঐশ্বরিক রংধনু।ধারাধর ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হচ্ছে।ভেলায় ভাসাচ্ছে লিয়ানাকে।নতুন আগমনী মেহমানকে নিয়ে চলছে মেঘেদের আয়োজন।ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিলো সর্ব কল্পনাকে এই বিশেষ কল্পনা।

পিছে দাঁড়িয়ে সবটা পরিষ্কার দেখেছে রামশা।শুনেছে কান খাঁড়া করে।তার এরূপ কর্মকাণ্ড এবারে অস্বাভাবিক মনে হলো তার কাছে।রেলিংয়ের উপরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অত্যন্ত বিপদজনক।যেখানে সে তার নিজের হুশ জ্ঞানে নেই।ধীর পায়ে এগিয়ে খুব সাবধানে দুহাত টেনে ধরলো লিয়ানার।যেনো আকস্মিক চমকে গিয়ে পড়ে না যায়।

লিয়ানা চোখ মেলে চায় রামশার দিয়ে।তাকে ধরে নামিয়ে রামশা বললো,

-“কতটা বিপদজনক এটা জানো?”

-“কতটা বিপদজনক?”

বোকার মতন প্রশ্নে রামশা বিরক্ত হয়।সবসময় হেয়ালি ভালো লাগে না।জোর গলায় বললো,

-“পড়ে যেতে এখান থেকে।”

-“পড়লে পড়তাম”

-“আশ্চর্য্য লিয়ানা!এগুলো কেমন কথা? কার সাথে কথা বলছিলে?”

-“দখিনা আকাশের মেঘেদের সাথে।নিয়ে যাচ্ছিলো আমায়”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রামশা। যতটা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছিলো অতটা স্বাভাবিক নয় লিয়ানা। মাত্রাতিরিক্ত কল্পনায় বিচরণ তার। সবকিছুই যেনো জীবন্ত তার কাছে।এক পলক লিয়ানার দিকে চেয়ে ভাবলো রামশা।

হতাশ গলায় বললো,

-“ইউ আর হ্যালুসিনেটিং”

-“আই অ্যাম জাস্ট ইমাজিনিং!”

-“চলো লিয়ানা এখান থেকে”

গোল টেবিল বৈঠক চলছে।আবারো আলোচনায় মত্ত অফিসার্সগণ।এবার সরাসরি সন্দেহ গেলো রুবির উপর।পালিয়ে বেড়ানো আসামির স্বভাব।কে জানে?হয়তো সেই প্ল্যান করেছে প্রফেসরকে মারার?ছদ্মবেশ ধারণ করেছে?মেজাজ এর পারদ উচুতে শাবাবের।চোখ বন্ধ ও হাত মুষ্টিবদ্ধ।টেবিলের উপর ঠেকিয়ে ছক তৈরি করলো।

রবিন বলল, -“রুবি সেই ছদ্মবেশী আনাম আই গেস”

মির্জা বললো, -“এখন?”

শাবাব চোখ খোলে।বলে, -“এখন কি?আমরাও এখন ছদ্মবেশ ধারণ করবো”

সাইফা বললো, -“মানে?”

-“রুবি জানে তাকে আমরা খুঁজছি।প্রত্যেকটা কদম সে এখন খুব সাবধানে ফেলবে।আমরা কক্স বাজার যাচ্ছি।”

মির্জা জানতে চাইলো, -“ছদ্মবেশে?”

-“হ্যাঁ”

-“হাতেনাতে ধরতে হবে।আর রুবিকে ট্রিক করার সব প্ল্যান মির্জা আপনি করবেন” বললো রবিন।

ফাইনাল হয় এটাই।আগামীকাল পুরো টিম যাচ্ছে কক্স বাজার।কাউকে বাদ রাখা যাবে না।সবার প্রয়োজন সেখানে থাকা।তারা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে এক্সপার্ট।আলোচনার মাঝে চোখাচোখি হলো মির্জা আর শাবাবের। ইশারায় জানতে চায় শাবাব কিছু।মির্জা চট করে ধরে ফেলে শাবাবের ইঙ্গিত। রামশা সম্পর্কে জানতে চাইছে। আশ্বস্ত করে প্ল্যান মোতাবেক সব কাজ হচ্ছে।নীরবে দুজনার কথোপকথন বিশেষভাবে লক্ষ্য করলো সাইফা।কিছু বুঝলো আর কিছু বোধগম্যতার বাহিরেই রয়ে যায়।

পরদিন,

প্ল্যান মোতাবেক রামশাকে তাদের সাথে ইনক্লুড করা হয়েছে।অবাকের চরম পর্যায়ে রামশা। অফিসার শাবাবের ব্যবহার পরিবর্তন ভাবাচ্ছে তাকে বেশ।আজ বিকেলে কক্স বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হবে।চারিদিকে তোড়জোড়।কেউ কেউ নিজেদের মতন প্ল্যানে ব্যস্ত। রামশা লিয়ানাকে একা ছাড়লো না।নিয়ে এসেছে সাথেই। মেয়েটা আবার না ছাদে দিয়ে বসে পড়ে।

মির্জার সামনে বসে লিয়ানা আর রামশা। নজরদারি করার দায়িত্ব তার। শাবাব লিয়ানাকে দেখলেই তার পিত্তি জ্বলে উঠবে। হলোও তাই।দুরত্বে দাঁড়িয়ে চোখ বড় করে চেয়ে আছে শাবাব।মির্জা পরিস্থিতি সামলাতে কি করবে বুঝে উঠলো না।লিয়ানা শাবাব আর মির্জা দুজনের দিকে চেয়ে দেখে নিলো তাদেরকে।

বললো, -“আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত”

রামশা নারাজ।বলে, -“থাকো এখন।আমরা এমনেতেই কক্স বাজার যাচ্ছি।আমাদের সাথে চলো”

শাবাব রামশার কথায় আরো রেগে যায়। একটু সুযোগ পেতে না পেতেই ঘাড়ে চড়ে বসার উপক্রম।নিজে থেকে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।কি দরকার এই পাগলটাকে সাথে নেওয়ার?

-“আপনি কক্স বাজার থাকেন?” মির্জা জানতে চাইলো লিয়ানার কাছে।

-“জ্বি” জবাব দেয় লিয়ানা।

মির্জা হাস্যোজ্জ্বল স্বরে বলে উঠে,

-“আপনার স্বাভাবিক কন্ঠস্বরও কেমন যেনো অদ্ভূত শোনায় মিস লিয়ানা।….আবার গাছ পালার সাথেও কথা বলেন।ভীষণ ইন্টারেস্টিং কিন্তু”

-“আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে?”

-“অবশ্যই!”

-“ভাগ্যিস কিছু মানুষের মতন পাগল মনে হয়নি”

দুহাতে ল্যাপটপে কাজ করছে শাবাব। তুখোড় শ্রবণশক্তি এই কথাটি শুনেছে পরিষ্কার।লিয়ানা তার দিকে না চেয়ে তাকেই ইঙ্গিত করে বলে।এটাও বুঝতে বাকি নেই।

মির্জা বললো, -“কেনো পাগল ভাববো?আমি বলবো আপনার চিন্তাধারা বেশ গভীর।এভাবে চিন্তা করতে পারে এমন খুব কম মানুষ থাকে।”

রামশা বললো, -“ডক্টর?আমার মনে হয় এত গভীর চিন্তাভাবনাও ভালো না।যে ভয়ঙ্কর হ্যালুসিনেট করে।”

কথার অর্থ বুঝতে মির্জা বললো, -“অর্থাৎ?”

-“এই মেয়েটা গতকাল হোটেলের ছাদে একা বসে মেঘেদের সাথে কথা বলছিলো।রেলিংয়ের উপর বসে।”

মির্জার ভ্রুদ্বয় আপনাআপনি কিঞ্চিত উচুঁ হয়ে উঠে।অন্যদিকে শাবাব হতাশায় মাথা দুলিয়েই যাচ্ছে।মনে মনে আওড়াচ্ছে ‘ পাগলে কত কিই না করে’ মনের কথা মনেই রয়ে গেলো।খুবই ঠাণ্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে হবে। রামশা যেনো কোনোভাবেই টের না পায়।

মির্জাও ঠিক তাই।দুহাত মুঠ করে টেবিলের উপর রাখলো।লিয়ানার দিকে চেয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বললো,

-“আপনার আর আমার বেশ জমবে জানেন।আসুন আমরা একটা প্রোপার কনভারসেশন করি।”

-“কেমন কনভারসেশন?” ভারী গলায় জানতে চায় লিয়ানা।

-“আপনি সবচেয়ে বেশি কি ভালোবাসেন?”

অটলভাবে নির্বিঘ্নে উত্তর আসে,

-“আকাশ, হিমশীতল বাতাস,এই শুভ্র চাঁদ,ওই জ্বলন্ত সূর্য,জীবন আছে তবে নীরবে দাড়িয়ে থাকা গাছপালা।তাদের নীরবতার আড়ালে বলা বিশাল উপন্যাস শুনি আমি। আর্তনাদ আছে তাদেরও।মানুষ শুধু উপভোগ করে তাদের।তবে জানতে চায় না তাদের রূপকথা।আমি শুনি,বুঝি।উত্তর দেই। কান পেতে শুনবেন কখনো। বাস্তবিকতার বাহিরে এক আলাদা জগৎ আছে।সত্য মিথ্যার উর্ধ্বে।ভিন্ন,বিচিত্র।অনুভব শক্তিকে প্রখর করুন।আপনিও শুনবেন তাদের গান।”

কি বোর্ডে চলন্ত আঙ্গুল থেমে গেছে। কর্ণ,নেত্র আর মনোযোগ কেড়ে নিলো লিয়ানা। অভিনিবেশে শুনছে শাবাব। এ কেমন বিশ্লেষণ?কেমন কথা বলার ধরন।চক্ষু নয় পুরো মানবী বিভ্রম আবৃত।মানুষ এরূপভাবে ভাবতে পারে?চকিত অন্তর্দৃষ্টি তার।মনশ্চক্ষু নিশিত।কথার ঘোর ছড়িয়েছে ব্যুরো জুড়ে।তিনজন মানুষকে কথায় আকৃষ্ট করেছে।মির্জা ঘোর থেকে জাগ্রত করে নিজেকে।বুঝে উঠলো বিশাল সমস্যা এখানে।তাদের কেস এর চেয়েও জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা।

চলবে।